#পিঞ্জিরা
#পর্ব_৩৩
#জান্নাত_সুলতানা
অনেক সময় পানির নিচে তারউপর এতো ঠান্ডার মধ্যে মিরা’র যেন দাঁত খিঁচে এলো। চোয়াল কাঁপতে লাগলো। অনেকক্ষণ বউয়ের দিকে রাগী চোখে তাকিয়ে থাকলে ও হঠাৎ যেন বউয়ের ফ্যাকাসে ওষ্ঠপুটে এর দিকে তাকিয়ে হুঁশ এলো রিহান এর। পরপরই অনুভব করে শরীর টাও মেয়ে টার ঠান্ডা হয়ে গিয়েছে। রিহান টুঁটি ছেড়ে নিজের গায়ের রক্ত ভেজা শার্ট খুলে নিলো এক টানে। দরজার ছিটকিনি খুলে ঝটপট। এরপর বউ কে ঝট করে কোলে তুলে দ্রুত কদম ফেলে রুমে চলে এলো।
বিছানায় শোয়ানো মাত্র মিরা লাফিয়ে উঠলো। ঠান্ডায় কাঁপতে থাকা ওষ্ঠ নেড়ে বিস্ফোরিত নয়নে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“করছেন কি এসব! বিছানা ভিজে যাবে তো।”
রিহান থমথম খেলো। এমন পরিস্থিতিতে বউ বিছানা নিয়ে ভাবছে। অদ্ভুত। তবে নিজে কে সামলে নিয়ে মিরা কে বিছানায় ফের ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিলো। মিরা’র ফ্যাকাসে অধর জোড়া নিজের অধর দ্বারা আবদ্ধ করে নিলো।
কিছু সময় পর রিহান নিজেই বউয়ের অধর ছেড়ে লাইট অফ করলো। বউয়ের ভেজা শরীর আগলে নিয়ে গলায় ঘাড়ে নাক ঘষে। ফিসফিস করে বলে,
-“নাউ আই ওয়ান্ট ইউ। সো ডোন্ট ডিসটার্ব।”
মিরা প্রথমে পুতুলের মতো পড়ে থাকলে-ও রিহান এর উষ্ণ নিঃশ্বাস আর বেহায়া কাজকর্মে মেয়ে টা শেষ-মেষ স্থির থাকতে পারলো না।
——-
সারাদিন মিরা রিহান এর আশেপাশে ই ঘুরঘুর করলো। এবং আজ এতো মাসের ভেতর রিহান কে আলমারির উপর থেকে একটা বক্স নামিয়ে সেখান থেকে এই প্রথমবারের ন্যায় ঔষধ খেতে দেখলো।
রিহান আজ আর কিচ্ছু আড়াল করলো না। সন্ধ্যায় আতিক চৌধুরীর সাথে যে মিটিং করবে সেটাও ইফাদ কাজল আর তার একজন এসিস্ট্যান্ট কে নিয়ে মিটিং করেছে। মিরা ব্যালকনিতে এসে মায়ের সাথে কথা বলতে বলতে সবটাই অবলোকন করে। রোকেয়া বেগম সব শুনেছে মেয়ের কাছে। মিরা মায়ের প্রতি অঢেল বিশ্বাস রয়েছে। ভরসার একটা স্থান তার মা। মা তাকে বেশ বুঝিয়েছে। যা করার ভেবে চিন্তে করার জন্য বলেছে।
মিরা রুমে গিয়ে দেখলো রিহান রেডি হচ্ছে। মিরাও একটা কালো রঙের কুর্তি আর জিন্স এর প্যান্ট পড়ে রেডি হয়ে নিলো। রিহান কিছু বললো না। রিস্ক হবে ওখানে বউ নিয়ে যাওয়া। তবে মিরা কে এখন বারণ করলে পুরো বাড়ি একটা নাড়া খাবে। তাই চুপচাপ রেডি হয়ে বেরিয়ে এলো। মিরা নিজেও গলায় একটা ওড়না পেঁচিয়ে তার উপরে একটা শাল জড়িয়ে রিহান কে অনুসরণ করে।
——-
আজ আর জিপগাড়ি নেয় নি রিহান। নিজের বাবা-র গাড়ি নিয়েছে। কালো রঙের গাড়ি টা এক সময় সে বাবা-মাকে তাদের এনিভার্সারিতে গিফট করেছে। গাড়ি টা হাইওয়ে ধরার আগে রিহান গাড়ি টা থামিয়ে নিলো। হঠাৎ গাড়ি থামায় মিরা হকচকিয়ে গেলো। সে গভীর ধ্যানে মগ্ন ছিলো বিধায় একটু নড়েচড়ে বসলো। তারপর রিহান এর দিকে তাকাতে আচমকাই রিহান মিরা কে নিজের কাছে টেনে নিলো। বউয়ের গালে নিজের দুই হাত ঠেকিয়ে নিজের অধর বউয়ের অধর স্পর্শ করলো। প্রথমে তা হালকা হলে পরবর্তীতে গাঢ় হলো। মিরা একটু অপ্রস্তুত হলে-ও সময়ের সাথে নিজে কে সামলে নিয়ে পুরো ধ্যান রিহান এর স্পর্শে দিলো। ঠিক তক্ষুণি গাড়ি সুক্ষ্ম এক যন্ত্রণা অনুভব করলো। ত্বরিতে নিজের হাত ছুঁয়ে সেখানে বুঝতে পারলো সেখানে সুই ফোটানো হয়েছে। এবং তার মস্তিষ্ক অচল হচ্ছে। সব কিছু ঝাপসা দেখছে। তবে রিহান অসহায় দৃষ্টিতে ওর দিকে তাকিয়ে আছে এটা দেখে মিরা’র মুখে তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠলো। কোনো রকম অধর নেড়ে আওড়াল,
-“আপনি পাষাণ এবং নিষ্ঠুর একজন পুরুষ। যার ভালোবাসার মানুষ টার জন্য ও একটু মায়া নেই মনে।”
কথাগুলো বিড়বিড় করে বলতে বলতে মিরা চোখ বুঝে নিলো। কিন্তু তখন পুরোপুরি জ্ঞান হারায় নি মেয়ে টা। শুধু চোখ গুলো মেলে রাখতে কষ্ট হচ্ছে। পেছনের দিকে ঢলে পড়তে নিলেই রিহান বউ কে আগলে নিলো। জড়িয়ে ধরে ললাটে ওষ্ঠদ্বয় ছুঁয়ে দিয়ে বললো,
-“আমায় ক্ষমা করো। এটা ছাড়া তোমাকে আটকানোর কোনো রাস্তা আমার কাছে ছিলো না। আতিক চৌধুরী জঘন্য একজন মানুষ। তুমি আমি ওর নিজের সন্তানের ক্ষতি করতেও দু’বার ভাববে না। আমি চাই না আমার জন্য তোমার কোনো ক্ষতি হয়।”
এরপর মিরা’র গায়ের শাল টা দিয়ে ভালো করে ঢেকে নিলো দু’জন কে। ফোন হাতে কল করলো কাউকে। রিসিভ হতে রিহান বলে উঠলো,
-“আমাদের ফ্ল্যাটে মিরা কে রেখে যাচ্ছি। তুই ঘন্টাখানেক সময় এর মধ্যে ওখানে আয়।”
ওপাশের মানুষ টা বোধহয় অবাক হয়েছে এরূপ কথায়। জিজ্ঞেস করলো,
-“কেনো ভাইয়া? তুমি মিরা কে আমাদের বাড়ি নিয়ে এসো না!”
-“শিশির ভালো লাগছে না আমার। প্লিজ কাম ফাস্ট।”
রিহান শিশির এর কথা সম্পূর্ণ অগ্রাহ্য করে বললো। শিশির বিষয় টা নিয়ে মনে খুঁতখুঁত করলেও বেশি বাড়াবাড়ি করলো না। আচ্ছা বলে কল রাখলো। রিহান তপ্ত শ্বাস ফেলে ফোন রেখে এক হাতে আস্তে-ধীরে ড্রাইভ করতে লাগলো। পথ টা বেশি নেই। তবে গাড়ি সাবধানে চালাতে হবে।
——–
একটা কক্ষ। অফিসে এই কক্ষ টা খুব জরুরি মিটিং কিংবা গোপন মিটিং গুলো এখানে হয়। বিশাল বড় এই কক্ষ টায় রয়েছে বেশ সুবিধা। বসার জন্য আরামদায়ক ব্যবস্থা থেকে শুরু করে হরেকরকমের বিদেশি নামী-দামী ড্রিংকস। গেম খেলার জন্য বিভিন্ন যন্ত্রপাতি থেকে শুরু করে কিছু মেয়ে। যারা এখানে অনৈতিক কর্মকান্ডের বৈঠক এর সময় বিদেশি কাস্টমারদের দেখভাল করে থাকে। রিহান এখানে বহুবার এসছে। তবে কোনো মেয়ে তার কাছে আসার দুঃসাহস কখনো দেখায় নি। কাজল জানতো তার বাবার একটা বিশেষ বৈঠকখানা রয়েছে তবে এর নমুনা এমন হতে পারে তার ধারণা ছিলো না। আতিক চৌধুরী একটা সোফায় বসা। তার কাছে আরেকটা সোফায় বসা ইরফান এর বাবা। আরো অনেকে রয়েছে। ইফাদ, কাজল, রিহান গিয়ে তিনজনই একটা সোফায় বসলো।
তাদের মধ্যে কথা হলো। কুশলাদি বিনিময়ে সময় গড়ালো কিছু টা। রিহান কে ইঙ্গিতে অনেকে A গ্রুপ না ছাড়ার জন্য বোঝাতে লাগলো। আতিক চৌধুরী শুধু চুপচাপ দেখে যাচ্ছে। রিহান কিছু বলছে না। কাজল রাগে ফোঁসফোঁস করছে। ইফাদ কাজল কে হাত ধরে শান্ত হতে ইশারা করে বসিয়ে রেখেছে। রিহান সবার কথা শুনে। এরপর নিজের বৈধ বন্দুক টা রেখে অবৈধ টা কোমড় থেকে বের করে সামনের সেন্টার টেবিল টায় রাখলো। রিহান কে এমন নীরবে বন্দুক রাখতে দেখে সবাই বুঝে গেলো রিহান আর গ্রুপে থাকবে না। রিহান খুব শান্ত আর গম্ভীর স্বরে বললো,
-“আমি এই গ্রুপে স্বেচ্ছায় আসি নি। আমি অফিসে চেয়ারম্যান পদে ছিলাম। এবং সেটাও আমি হতে চাই নি। মিস্টার চৌধুরীর আবদারে নিজের অফিসের পাশাপাশি এই কোম্পানিতেও সময় দিয়েছি। আমার কাজ শুধু অফিসে ছিলো। আপনার অবৈধ কোনো এক বিজনেস করেন জানতাম আমি। এতে আমার সমস্যা ছিলো না। আপনারা কোম্পানি টাকে শুধু শো হিসেবে রেখেছেন এটা জেনেছি আমি অফিস জয়েন করার দুই বছর পর। আমি এটাও জানতাম না বন্দরে চোরাচালান ব্যতিত আপনারা সুপারি নিয়ে মার্ডার ও করে থাকেন। আমি শুধু আপনার ওই দলের সঙ্গ দিয়েছি। অন্য কোনো খারাপ কাজের সঙ্গ আমি কোনো দিন দেই নি। হ্যাঁ আমাকে A গ্রুপের RS আপনারা বানিয়েছেন। এবং এটা গ্যাংস্টার গ্রুপ আর আমাকে সেখানের লিডার হয়ে অনেক অনৈতিক কাজ এর সামিল হতে হয়েছে। হয়তো খুনখারাপি ও করেছি বহুত। তবেই না গ্যাংস্টার উপাধি পেয়েছি। কিন্তু আমি আপনাদের সাথে চুক্তিবদ্ধ নই। আমি এই পথে আর হাঁটতে চাই না। লাউড এন্ড ক্লিয়ার।”
গম্ভীর স্বর পুরুষ টার। সবাই নড়েচড়ে বসে একে-অপরের দিকে তাকায়। কিছু করার নেই কারোর এতে। এখন রিহান এর কিছু করতে গেলে বিজনেস গ্রুপ সব হারাতে হবে। আইনি ভাবেও যদি কিছু করতে যায় তাহলে সবার আগে তারাই ফাঁসবে। সবাই যখন নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করতে ব্যাস্ত আতিক চৌধুরী তখন বুকে হাত চেপে চোখ বন্ধ করে বসে আছে। সবার আগে রিহান এর নজর পড়লো। কাজল কে ধাক্কা দিয়ে ইশারা করে দেখাতে কাজল চমকে উঠলো। এই ঠান্ডার মধ্যে আতিক চৌধুরী ঘেমে ন্যায় একাকার অবস্থা। কাজল দ্রুত উঠে এগিয়ে যাওয়ার আগেই দু’জন গার্ড আতিক চৌধুরী কে ধরে নিলো। বুকে হাত দিয়ে ছটফট করতে করতে তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেললো।
কাজল বাবা-র অবস্থা দেখে গার্ডদের আদেশ করলো ডক্টর এর কাছে নেওয়ার ব্যবস্থা করতে।
গার্ডরা তাই করলো।
——–
মিরা যখন হুঁশে এলো তখন সকাল। মিরা বিছানায় উঠে বসে মাথায় পেইন হচ্ছে প্রচুর। দুই হাতে মাথা চেপে ধরে চোখ বন্ধ করতে গতকাল রাতের কথা স্মরণ হলো। তৎক্ষনাৎ চোখ ফেটে কান্না আসতে চাইলো। রিহান তাকে ধোঁকা দিয়েছে। কথা টা ভেবে মিরা অস্থির হলো। কোনো দিকে না তাকিয়ে হাতের কাছে একটা ফোন পেয়ে সেটা ছুঁড়ে ফেলতে নিলে কেউ বাঁধা দিলো। মিরা থেমে গেলো। ঘাড় ঘুরিয়ে পাশে তাকাতে নজর পড়লো উদোম গায়ে বসা রিহান কে। মিরা’র রাগ টা তরতর করে বেড়ে গেলো। রিহান এর হাত ঝটকা মেরে ফেলে দিয়ে রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে চেঁচিয়ে বলে উঠলো,
-“নিষ্ঠুর। পাষাণ। আমি এমন নিষ্ঠুর একজন কে ভালোবেসেছি ভেবে আমার নিজের জন্য মায়া হচ্ছে। কি করে পারলেন আমার সাথে এমন টা করতে? সেদিন রাতে ও জোর করে বেঁধে রেখেছিলেন আর গতকাল রাতেও আমাকে ইনজেকশন দিয়ে অজ্ঞান করে তারপর মিটিং,,,,
কথার মাঝপথে থেমে গেলো মিরা। আচমকাই যেনো কিছু মনে পড়ছে। হঠাৎ আবার বলে উঠলো,
-“হ্যাঁ মিটিং! কি হয়েছে আতিক চৌধুরী কি বলেছে? আপনার কোনো ক্ষতি করবে না তো আবার?”
রিহান বউয়ের এমন পাগলামি দেখে ভ্যাবাচ্যাকা খেয়েছে বেচারা। শুধু ফ্যালফ্যাল করে বউয়ের অনবরত নড়তে থাকা ওষ্ঠপুট এর দিকে ঘোর লাগা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। মিরা জবাব এর আশায় তাকিয়ে রিহান এর মুখপানে। রিহান মিরা’র প্রশ্নবোধক চাহনি উপেক্ষা করে মেয়ে টাকে ধাক্কা মেরে বালিশের উপর ফেলে দুই হাত নিজের হাতের ভাঁজে নিয়ে মিরা’র উপর ঝুঁকে গেলো। আকস্মিক আক্রমণে মিরা অপ্রস্তুত হলো। কিছু বুঝে উঠার আগেই রিহান ওর মুখ বন্ধ করে দিলো।
সময় নিয়ে গাঢ় হতে প্রগাঢ় এক চুম্বন করে বউ কে শান্ত করলো। এরপর ছেড়ে দিয়ে মিরা’র চোখের দিকে গভীর দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয় জানেমান। এখন আমার মুড খারাপ করো না।”
#চলবে……..
[বড় পর্ব দিয়েছি। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]