#পিঞ্জিরা
#পর্ব_৩৫
#জান্নাত_সুলতান
-“রিহান!”
মিরা রিহান এর কাঁধে মাথা রেখেই ডাকে। রিহান আঁড়চোখে বউয়ের মুখের দিকে ই তাকিয়ে আছে। বললো,
-“বলো।”
মিরা ভাবে। দূরে অন্ধকারে তাকিয়ে ভাবে। এরপর রিহান এর দিকে তাকিয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠলো,
-“যাদের সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম থাকে তাদের তো মন বলে কিছু থাকে না। অনুভূতি নেই। তাহলে আপনার মনে কি করে আমার জন্য ভালোবাসা হলো?”
-“কে বলেছে তোমার জন্য আমার মনে শুধু ভালোবাসা আছে! তুমি আমার জেদ। ভালোবাসার আগে তুমি আমার জেদ। ফুপিমণি বলেছিলো আমাকে তার মেয়ের জামাই বানাবেন। ছোট ছিলাম। তবুও কোথাও মনে জেদ ছিলো আমি ফুপির মেয়ের জামাই হবোই হবো । কিন্তু পরিস্থিতি বদলে গেলো। ফুপিমণি পালিয়ে গেলো। কিন্তু তবুও আমার মনোভাব পালটায় নি কখনো। পালিয়েছে তো কি হয়েছে! ফুপিমণির মেয়ে হলে তো বিয়ে আমি ই করবো। এবং মেয়ে হলো। তবে অনেক লেইট। আমার বয়সের গ্যাপ টা অনেক হয়ে গেলো। এতে আমার একটু খচখচানি ছিলো। পরে তোমার কথা তোমায় সব সময় চোখের সামনে ঘুরঘুর করতে থাকা। তোমার আমার প্রতি ভালোবাসা আমাকেও বাধ্য করেছিলো তোমাকে ভালোবাসতে। আর পরে সত্যি সত্যি ফুপিমণির শ্বশুর বাড়িকে আমার শ্বশুর বাড়ি বানিয়ে নিলাম।”
রিহান বেশ গম্ভীর স্বরে কথা গুলো বলে থামলো। মিরা চোখ পিটপিট করে তাকিয়ে থাকে আবছা অন্ধকারে রিহান এর মুখপানে। কি অদ্ভুত লোক। তার জন্মের আগে তাকে এই বেডা বউ বানিয়ে ফেলেছিলো!
রিহান এর শরীর থেকে পারফিউম এর ভোঁটকা গন্ধ বাতাস এর সাথে নাসারন্ধ্রে পৌঁছাতে মিরা’র শরীর গুলিয়ে উঠলো। চোখ ঝাপসা লাগলো। মুখে লবনাক্ত পানির আভাস পেতে বসা ছেড়ে উঠে এক দৌড়ে রুমে চলে গেলো। রিহান নিজেও হতভম্ব হয়ে পেছনে এলো। মিরা ওয়াশ রুমে গিয়ে গড়গড় করে বমি করতে রিহান চমকালো। একটুর জন্য ভুলে গেলো এই মূহুর্তে বউ কে সাহায্য করা প্রয়োজন। মিরা নিজেই ফ্রেশ হয়ে এলো। মিরা বেশ ক্লান্ত হয়েছে। গায়ের চাদর টা বিছানার এক পাশে ফেলে বিছানায় ধপাস করে বসে গেলো। কেমন ভেপসা গরমে মেয়ে টা হাসফাস করতে লাগলো। রিহান বউয়ের এমন কান্ডে অবাক হলো। থতমত খেয়ে দ্রুত এগিয়ে গিয়ে নিজের গায়ের জ্যাকেট এর জিপ খুলে বউ কে নিজের বুকের মধ্যে চেপে ধরলো। এতো ঠান্ডায় মেয়ে টা ভারি কাপড় কেনো ফেলে দিলো বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। মিরা’র একটুর জন্য কান্না পেলো। সে এতো টা ক্লান্ত হলো বমি করে অথচ রিহান একবার তাকে ধরতে পর্যন্ত গেলো না। ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিতে গিয়েও দিলো না। তার এমন অনুভূতিহীন মানুষ টাকে বড্ড অচেনা লাগছে। ইদানীং বেশি ছন্নছাড়া থাকে পুরুষ টা।
মিরা একই ভঙ্গিতে বসে আছে। রিহান কিছু সময় পর বউ কে ছেড়ে দিয়ে শুয়ে দিলো। এরপর কম্ফর্টার দিয়ে ডেকে লাইট অফ করে এলো।
নিজেও পাশে শুয়ে জিজ্ঞেস করলো,
-“হঠাৎ বমি কেনো হলো?”
-“রাতে না ডিম খেয়েছিলাম হয়তো সেইজন্য।”
রিহান আর কিছু বললো না। মিরা ও স্বস্তির নিঃশ্বাস ছাড়ে। এরপর চোখ বন্ধ করে ভাবলো আরো সাবধান হতে হবে। অন্তত রিহান যতদিন না চিকিৎসার জন্য বাহিরে যাচ্ছে।
———-
একটি সাইকোঅ্যাকটিভ ড্রাগ , মন-পরিবর্তনকারী ড্রাগ , বা চেতনা-পরিবর্তনকারী ড্রাগ হল একটি রাসায়নিক পদার্থ যা মস্তিষ্কের কার্যকারিতা পরিবর্তন করে এবং এর ফলে উপলব্ধি , মেজাজ , চেতনা , জ্ঞান বা আচরণে পরিবর্তন হয়। মানসিক রোগ সাধারণত একজন ব্যক্তির আচরণ, মতানৈক্য, অনুভূতি বা মতানৈক্যের সমন্বয় দ্বারা সংজ্ঞায়িত হয়। এটি মস্তিষ্কের বিশেষ অঞ্চল বা ফাংশনগুলির সাথে যুক্ত হতে পারে, প্রায়ই একটি সামাজিক প্রেক্ষাপটের সাথে তার সংযুক্তি থাকে । মানসিক ব্যাধি মানসিক স্বাস্থ্যের একটি দিক। রিহান এর যেহেতু বুঝ হওয়ার পর থেকে মানসিক কিছু সমস্যা ছিলো। একরোখা, জেদ, কোনো কিছু নিয়ে তার অতিরিক্ত বাড়াবাড়ি কারোর খারাপ ভালো এসব তার তোয়াক্কা ছিলো না তখন তাকে এক সাইকোলজিস্ট এর কাছে নেওয়া হয়। এবং সেই সাইকোলজিস্ট এর পরামর্শ অনুযায়ী তাকে সাইকিয়াট্রিস্ট দেখানো হয়। এবং তিনি পুরো নিশ্চিত করেন রিহান সাইকো। তবে সেটা বর্তমানে তেমন গুরুতর না হলেও ভবিষ্যতে এর অবস্থা ভয়াবহ হবে। আর যদি হয় ড্রাগস নেওয়ার নেশা তাহলে সে আরো বেশি অসুস্থ হবে। এবং এটা তাকে আরো বেশি ভোগান্তিতে ফেলবে। কিংবা এটা তাকে মৃত্যু যন্ত্রণা ও দিতে সক্ষম হবে। আর আতিক চৌধুরী সেটার সুযোগ নিয়েছে। ড্রাগস দিয়েছে। যার ফলে রিহান এর অবস্থা আগের চেয়েও শোচনীয়। আর রিহান সুস্থ হওয়া না হওয়া সুনিশ্চিত নয় এখন। দীর্ঘ দিন যেমন তার মধ্যে এটা বসবাস করছে তেমন এটার বসবাস ছাড়াতে দীর্ঘ সময় এর প্রয়োজন হবে।
মিরা সব কিছু জেনেছে রিহান এর সেই ডক্টর এর থেকে। দীর্ঘ সময় হতে পারে তিন বছর পাঁচ বছর কিংবা যুগ লাগতে পারে। মিরা এতেও রাজি। যদি এক্কেবারে সুস্থ হয়ে ফিরে আসবে তার ভালোবাসা তাহলে সে এতেই রাজি।
তারজন্য মানুষ টার মনে অনুভূতি হতে হবে। ভালোবাসা হতে হবে। মায়াদয়া থাকতে হবে মনে। নয়তো ওই নরকের পথে আবার হাঁটতে রিহান দ্বিতীয় বার ভাববে না।
——-
সকালে রিহান ঘুম ভেঙ্গে বউ কে পাশে পেলো না। বরং সকাল সকাল ইফাদ কে নিজের রুমে বসে থাকতে দেখে থমথম খেলো।
সোজা হয়ে উঠে বসলো। এরপর ঘড়ি দেখলো। সকাল আটটা বাজে। অফিস আছে দশ টা থেকে। কিন্তু ইফাদ এখানে কেনো বসে আছে বুঝতে অক্ষম সে। ভ্রু কুঁচকে জিজ্ঞেস করলো,
-“এতো সকালে এখানে কি চাই?”
-“তোকে,,থুক্কু বিয়ে করতে চাই।”
ইফাদ এর কথায় ভ্রু কুঁচকে আসে রিহান এর। সকাল সকাল মস্করা হচ্ছে তার সাথে! কই সকালে ঘুম থেকে উঠে বউয়ের আদুরে মুখখানা দেখবে আর দেখতে হচ্ছে আরেক বেডার মুখ। মেজাজ না চাইতেও চটে গেলো। দাঁত কিড়মিড় করে বলে উঠলো,
-“বিয়ে করবি তো তোর বাপ চাচা কে বল। সকাল সকাল আমার দিন কেনো খারাপ করতে এসছি?”
ইফাদ ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে আছে রিহান এর দিকে। রিহান এর কোনো ভাবান্তর হলো না। মুখ ঘুরিয়ে নিলো কথাগুলো বলেই। ইফাদ এক লাফে সোফায় ছেড়ে রিহান এর কাছে গিয়ে পা ধরে নিচে বসে পা টিপতে লাগলো। এরপর অসহায় কণ্ঠে বলে উঠলো,
-“সোনা মনা ভাই বন্ধু না আমার প্লিজ এবার হেল্প করে দে। পাক্কা প্রমিজ এরপর তোকে বিরক্ত করবো না।”
রিহান বিছানা ছাড়লো। ইফাদ এর থেকে নিজে কে ছাড়িয়ে। এরপর গায়ের ফুল হাতার সুয়েটার টার হাতা গোটাতে গোটাতে ওয়াশ রুমের দিকে যেতে যেতে বললো,
-“নিচে যা।
রেডি হয়ে আসছি আমি।”
ইফাদ খুশি হয়ে গেলো। ধুপধাপ পা ফেলে বেরিয়ে যাওয়ার আগে রিহান এর গালে চুমু খেলো। বললো,
-“আমার প্রথম চুমু বউ কে খাওয়ার আগে তোরে খেলাম। বুঝ কত ভালোবাসি আমি তোরে।”
ইফাদ চলে গেলো খুশি মনে। সে জানে রিহান যেভাবে হউক সবাই কে রাজি করাবে।
এদিকে রিহান বিরক্তিকর চোখে তাকিয়ে নিজের গাল হাত দিয়ে অনেক বার মুছলো। বিড়বিড় করে বললো,
-“অসভ্য কোথাকার। ঘুম থেকে উঠে বউয়ের চুমু খাওয়ার বদলে,, কি হচ্ছে আমার সাথে। ছেঃ।”
রিহান ওয়াশ রুমে গিয়ে একবারে অফিসের জন্য তৈরী হয়ে প্রায় আধঘন্টার মধ্যে বেরিয়ে এলো। এসে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে সাদা শার্ট টার উপর কালো কোট জড়ালো। তখন রুমে এলো মিরা। হন্তদন্ত হয়ে এসে মিরা রিহান এর জুতো জোড়া বের করলো। টাই হাতে নিয়ে রিহান এর সামনে দাঁড়াতে রিহান বাঁধা দিলো। এক হাতে মিরা’র কোমড় জড়িয়ে ধরে নিজের একদম নিকটে নিলো। ঘনিষ্ঠ করলো মেয়ে টাকে নিজের সঙ্গে। এরপর আরেক হাতে ঘাড়ের পেছনে রেখে মুখ টা এগিয়ে আনলো।
সামন্য ঝুঁকে বউয়ের ওষ্ঠদ্বয় আঁকড়ে ধরলো। মিরা আবেশে চোখ বন্ধ করে।
দীর্ঘ সময় গভীর এক চুম্বনে আবদ্ধ রইলো দু’জন। অনেক সময় পর রিহান বউ কে ছেড়ে দিয়ে বিছানা থেকে ব্লেজার হাতের ভাঁজে ঝুলিয়ে নিলো। মিরা ততক্ষণে নিজে কে সামলে রিহান এর জুতো পড়িয়ে দিলো। রিহান কোনো রূপ বাক্য ব্যায় না করে চলে যাচ্ছিলো। মিরা অবাক হলো। রোজ তো এভাবে যায় না। আগে নাস্তা করে তারপর তৈরী হয়ে অফিস যায়। মিরা সন্দিহান কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
-“কোথায় যাচ্ছেন আপনি?”
মিরা’র প্রশ্নে রিহান দাঁড়িয়ে গেলো। পেছন ফিরলো না। মিরা অবাক হলো। সন্দিহান চোখে তাকিয়ে আছে রিহান এর সুঠাম দেহের দিকে। রিহান মিরা কে আরো কয়েকগুণ চমকে দিয়ে খুব শান্ত স্বরে বলে উঠলো,
-“বউ আনতে।”
#চলবে…..