#পিঞ্জিরা
#পর্ব_৩৬
#জান্নাত_সুলতান
রিহান কথা টা বলে চলে তো যাচ্ছিলো। কিন্তু মিরা ঝড়ের বেগে গিয়ে রিহান এর সামনে দাঁড়ালো। এরপর আচমকাই রিহান এর কলার ধরে নিলো। রাগী স্বরে বলতে লাগলো,
-“কি বললেন আপনি আবার বলুন! বউ আনতে যাচ্ছেন! একজন দিয়ে হচ্ছে না?”
রিহান ভ্যাবাচ্যাকা খেলো। ফ্যালফ্যাল করে শুধু বউয়ের রণচণ্ডী রূপ দেখে বেচারা থমথম হয়ে আছে। দুই হাত উপর তুলে দাঁড়িয়ে আছে।
মিরা’র গাল দু’টো অল্প লাল আভা ফুটে উঠছে। হয়তো ঠান্ডার জন্য। কিন্তু চোখ গুলো লাল। রিহান বউয়ের ক্রোধিত মুখ দেখে মনে মনে নিজে কে শ’খানেক গালি দিলো। এতো ভাবসাব নিয়ে ওটা বলার কি দরকার ছিলো! এখন হলো তো! বউয়ের রণচণ্ডী রূপ দেখা। রিহান গম্ভীর স্বরে বললো,
-“তুমি ভুল ভাবছো জান। আমি তো বিয়ে ক,,,
-“চোপ। আর একবার বিয়ের নাম মুখে নিলে আপনার চৌদ্দ গোষ্ঠীর নাম আমি আপবাকে ভুলিয়ে দেবো রিহান।”
রিহান এর পুরো কথা সম্পূর্ণ করার আগেই মিরা তেতে উঠলো। দাঁত খিঁচে দিলো এক ধমক। রিহান ভয় পায় নি। চোখ পিটপিট করে পুরুষ টা। মিরা’র এতে একটু মনে মনে ভয় পেলো। কারণ রিহান তো কেমন এটা মিরা খুব ভালো করে জানে। এখন যদি ধমক টমক দেয় তাহলে নিশ্চিত মেয়ে টা এই মূহুর্তে জ্ঞান হারাবে। রিহান ততক্ষণে নিজের মাথা দুই হাতে চেপে ধরেছে। এরপর মাথা উপর নিচ দুই বার ঝাঁকিয়ে বলে উঠলো,
-“আরে আমার বাপ আগে পুরো কথা তো শুনবে!”
মিরা দৃষ্টি স্থির রাখে রিহান এর মুখের দিকে। রিহান মিরা কে এক টানে নিজের বুকের সাথে উলটো করে চেপে ধরলো। মিরা’র পিঠ গিয়ে ঠেকলো রিহান এর শক্ত করে মেয়ে টাকে নিজের সাথে চেপে রেখে বলল,
-“বিয়ে আমি করবো না। বিয়ে তো ইফাদ করবে।”
মিরা হঠাৎ যেন আসমান থেকে টপকালো। থতমত খেয়ে একদম চুপ হয়ে গেলো। রিহান বউয়ের ঘাড়ে নাক ঘষে। পরপর কয়েকবার সেখানে অধর ছুঁয়ে দিলো। বললো,
-“এক্সাম না এক টা থেকে! তুমি চলে যেয়েও। আমি সন্ধ্যায় নিয়ে আসবো গিয়ে।”
মিরা শুধু মাথা নাড়ে অল্প করে। রিহান মুচকি হেঁসে বউয়ের কপালে চুমু খেয়ে বেরিয়ে গেলো।
মিরা বুকে হাত দিয়ে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ছাড়ে। অল্পের জন্যে বেঁচে গেলো আজ। নয়তো রিহান রেগে গেলে ধমক দুই চার টা ফ্রি-তে খেতে হতো। অবশ্য ফ্রি-তে না এটার জন্য তো সে নিজে দায়ী হতো। কি দরকার ছিলো পুরো কথা না শুনে এমন রেগে রণচণ্ডী রূপ ধারণ করার!
——-
আতিক চৌধুরীর অবস্থা আগের চেয়ে কিছু টা ভালো। বাড়ি নিয়ে আসা হয়েছে উনাকে। সাথে বাড়িতে সব ট্রিটমেন্ট এর ব্যবস্থা করে দিয়েছে। এখন কথা বলতে জিহ্বায় বাজে। কিন্তু ডক্টর বলে দিয়েছি হয়তো উনার স্মৃতিশক্তি দুর্বল হতে পারে সাথে কথা যা-ও একটু বলতে পারে এটাও হয়তো এক সময় বন্ধ হয়ে যেতে পারে।
এখন একমাত্র ঔষধ আর আল্লাহর উপর ভরসা। কাজল বলেছে বাহিরে ভালো কোনো দেশে নিবে। চিকিৎসা করাতে। কিন্তু এখন নয়। এটার জন্য সময়ের প্রয়োজন।
আর এখন যেহেতু কিছু টা সুস্থ বা এরচেয়ে খারাপ কিছু হওয়ার আশংকা নেই বা পুরোপুরি সুস্থ কোনো দিন হবে না তাই এসব করেও লাভ নেই।
এদিকে সব কিছুর দায়িত্ব কাজল এর উপর পড়েছে। অফিস ব্যবসা বাবা-র রাজনীতি।
এতে অবশ্য শিশির অনেক বেশি হেল্প করে যাচ্ছে ভাইকে। যেহেতু সে নিজেও পড়াশোনা করেছে। তাই তেমন একটা সমস্যা হচ্ছে না শিশির এর সব কিছু বুঝতে। আর এতো সব সামলানোর ভীড়ে আর নিজের বাবা-র করা অপরাধে শিশির অনেক বেশি ভেঙ্গে পড়েছে। ভেতর থেকে দুর্বল হয়ে গিয়েছে।
দুপুরে শিশির কাজল দু’জনেই বাড়ি ফিরে শেখ বাড়ির সব পুরুষদের দেখে অনেক বেশি অবাক হয়েছে। আতিক চৌধুরী অসুস্থ হওয়ার পর সবাই কমবেশি তাদের খবরা-খবর নিয়েছে আবার দু’দিন করে এসে দেখেও গিয়েছে।
তবে সবার পোশাকআশাক আর ভাবসাব দেখে শিশির একটু নার্ভাস হয়ে গেলো। কারণ সবাই ওকেউ দেখছিলো।
কারিরা বেগম এসে মেয়ে কে টেনে নিলো। এরপর রুমের দিকে চলে গেলো।
কাজল গিয়ে সোফায় বসলো নিজের ফুপা আর রিহান এর সাথে কথা বললো। রেহনুমা বেগম অসুস্থ একটু। সেইজন্য আর আসে নি। কিন্তু ভাইয়ের খোঁজ খবর নেয় ফোন করে। কাজল এতে নিশ্চিত হয় ফুপিমণি বাবা-র উপর রাগ নেই। হয়তো অভিমান আছে সাথে অভিযোগ ও। কেনো তার ছেলে কে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিলো সেই অভিযোগ।
কাজল এর ভালোমন্দ কথা শেষ রমজান শেখ বেশ গম্ভীর স্বরে বললো,
-“আমরা তোমার মায়ের সাথে কথা বলেছি। শিশির আর ইফাদ এর ব্যাপারে। এখন তুমি মতামত দিলে আমরা সামনে এগুতে চাই।”
-“মতামত না দিলেও আগাবো।”
রমজান শেখ এর কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে রিহান বলে উঠলো। কাজল মাথা নিচু করে বসে থাকে। ইফাদ তার বোন কে ভালোবাসে সে জানে। কিন্তু শিশির এখন রাজি হলে হয় এই অবস্থায়। কিন্তু কাজল মনেপ্রাণে চাইলো শিশির রাজি হয় যেন। এমনিতেই বাবা-র জন্য কষ্ট পাচ্ছে আবার নিজের ভালোবাসার জন্য। সে চায় তার বোন সুখে থাকে। আর সেটা এখানে এভাবে থেকে কিছুতেই হবে না।
এদিকে কারিরা বেগম মেয়ে কে রীতিমতো ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে যাচ্ছে। শিশির যেন নিজের মাকে চিনতে কষ্ট হচ্ছে।
-“দেখছো তো বাবা অসুস্থ হয়ে গিয়েছে। যেকোনো সময় যা কিছু হতে পারে। তারউপর তোমার নিজের ও তো বিয়ের বয়স হয়েছে। এভাবে কারোর জীবন চলতে পারে না। কাজল সামলে নেবে সব।
আশা করি তুমি তোমার এবং আমাদের সবার ভালো টা চিন্তা করবে।”
কারিরা বেগম কথা শেষ চলেই যাচ্ছিলো। কিন্তু শিশির মায়ের হাত ধরে আঁটকে নিলো। এরপর মাথা নেড়ে সম্মতি দিলো সে রাজি বিয়ে করবে। কারিরা বেগম মেয়ে কে জড়িয়ে ধরে কাঁদল।
প্রায় অনেক সময় পর মেয়ে কে নিয়ে বেরিয়ে এলো৷ ততক্ষণে শাহনাজ এসে নিচে শিশির এর সম্মতির কথা জানিয়ে দিয়েছে। এরপর রিহান এর এসিস্ট্যান্ট কাজিও নিয়ে চলে এসছে।
বিকেল চার টা বাজতে বাজতে সব কমপ্লিট হয়ে গেলো। খাবার টা কেউ খেলো না। মূলত কারিরা বেগম এর কথা ভেবে এসব ঝামেলা করতে না করলো সবাই। বাড়িতে একজন অসুস্থ মানুষ তারমধ্যে হৈ-হুল্লোড় টা ভালো দেখায় না।
শুধু বিয়ের পর খেজুর দিয়ে কাজ চালালো। এরপর সবাই বউ নিয়ে রওনা দিলো।
——-
রিহান প্রায় এক ঘন্টা ধরে অপেক্ষা করে দাঁড়িয়ে আছে কলেজের সামনে। মূলত পরীক্ষা শেষ হবে পাঁচ টা বাজে। আর সাত আট মিনিট বাকি। রিহান গাড়ি থেকে নেমে বউয়ের জন্য কিছু খাবার আর একটা ফুল কিনলো।
এরপর সেগুলো গাড়িতে রেখে বাহিরে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে ফোন টিপতে লাগলো।
সাদা শার্ট আর কালো স্যুট। হাতে সোনালী রঙের একখানা ব্র্যান্ডের ঘড়ি। চোখে এখান কালো সানগ্লাস।
মিরা’র বুক ধুকপুক করে।
আশেপাশে তাকিয়ে দ্রুত রিহান এর সামনে এসে দাঁড়ালো। রিহান মোবাইল থেকে চোখ তুলে সামনে দৃষ্টিপাত করলো। মিরা কে দেখে প্রথমে যতোটা খুশি হয়েছে তার থেকে বেশি ওর ড্রেসআপ দেখে পুরুষ টার মেজাজ বিগড়ে গেলো।
কোনো দিকে না তাকিয়ে মিরা’র হাত শক্ত করে চেপে ধরলো। প্রশ্ন করলো,
-“বোরকা পড়ো নি কেনো?”
মেয়ে টার উত্তর এর অপেক্ষা করে না পুরুষ টা। হাত টেনে ধরে গাড়ির দরজা খুলে ভেতরে কিছু টা ছুঁড়ে ফেললো। অতঃপর গাড়িতে উঠে বসলো নিজেও। মিরা’র বোধগম্য হচ্ছে না রিহান এমন কেনো করছে! বোরকা তো সে পড়তে চেয়েছিলো। ঈশিতা তো না করলো পড়তে। কারণ পড়নের ড্রেস টা রিহান কিনে দিয়েছে। এটা অনেক দামী একটা থ্রি-পিস।
দেখতে ও সুন্দর। সেইজন্য তো এটা পড়েই চলে এসছে। অবশ্য ওড়না তো সুন্দর করে দেওয়া।
হঠাৎ মিরা’র নিজের হাত দু’টো রিহান এর শক্ত হাতের বাঁধনে বুঝতে পারলো। পরপরই গাড়ির দরজার সাথে সেঁটে গেলো। রিহান অনেক টা বেশি পাগলামি করছে। মিরা নিজে কে কোনো রকম ছাড়ালো। বা হাতে নিজের ঠোঁট মুছে এরপর ওড়না টা ঠিক করে বলে উঠলো,
-“পাগল হয়েছেন আপনি। বাড়ি চলুন।”
-“নো। ডোন্ট মেক মি অ্যাংরি। আই ওয়ান্ট ইউ। রাইট নাউ।”
বলতে বলতে রিহান মিরা’র দিকে আবার এগুতে নিলে মিরা নিজের মুখ টা ঘুরিয়ে নিলো। রিহান এর অধর গিয়ে ঠেকলো গাড়ির জানালার কাঁচে। রিহান এর অবস্থা দেখে মিরা’র হাসি পেয়ে গেলো। কিন্তু ঠোঁট চেপে ধরে রইলো। রিহান চোখ পিটপিট করে তাকাতে মিরা বলে উঠলো,
-“আমার মুড নেই। আপনি বাড়িতে না নিয়ে গেলে আমি অটো করে চলে যাব।”
রিহান আর কি রাগে ফোঁস ফোঁস করে নিজের সিটে বসলো। গাড়ি স্টার্ট করে বিড়বিড় করে বললো,
-“একবার বাড়ি চলো এরপর মুড না এসে কিভাবে থাকে দেখে নেবো আমি।”
#চলবে….
[ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখবেন।]