#পিঞ্জিরা
#অন্তিম_পর্ব
#জান্নাত_সুলতানা
-“রিহান পাগল হয়েছেন আপনি! নিচে নামান।”
রিহান মিরা’র কথায় পাত্তা দিলো না। গাড়ি থেকে কোলে তুলে নিয়েছে সে বউ কে। সন্ধ্যায় নিশ্চয়ই এখন সবাই লিভিং রুমে। মিরা’র রাগে দুঃখে হাত পা ছড়িয়ে বসে কাঁদতে ইচ্ছে করছে।
মিরা’র ভাবনা সত্যি হলো। সবাই লিভিং রুমে বসে আড্ডা দিচ্ছে।
মিরা লজ্জায় রিহান এর গলায় মুখ গুঁজে রইলো। রিহান সোজা সবার সামনে দিয়ে নিজের রুমের দিকে এগিয়ে এলো। পেছনে বিস্ময় কয়েক জোড়া চোখ বড় বড় করে তাদের দিকে তাকিয়ে। সেদিকে পুরুষ টার কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই।
রুমে এসে রিহান বউ কে বিছানায় ফেলে নিজের গায়ের স্যুট কোট টাই সব এক এক করে খুলে নিতে লাগলো। শার্ট অর্ধেক খুলেই বিরক্ত হলো পুরুষ টা। পুরো টা না খুলেই বউয়ের পা টেনে ধরে এক টানে নিজের নিকটে নিয়ে এলো। মিরা চমকালো। শরীর শিরশির অনুভূতি হচ্ছে। এই ভরসন্ধ্যায় রুমের দরজা বন্ধ করে রাখলে সবাই কি ভাববে! মিরা এ-সব ভেবে হয়রান হলেও রিহান এর মাদকাসক্ত চাহনি আর মাতাল করা স্পর্শে মিরা’র প্রাণ যেন দেহ ছেড়ে বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে।
কিন্তু রিহান কে সেটা হতে দিবে! উঁহু। এক মাত্র বউয়ের বলে কথা। রিহান বউয়ের মুখ বন্ধ করে দিলো। মিরা ছটফট করতে করতে এক সময় শান্ত হয়ে গেলো।
——–
শিশির শেখ বাড়িতে আসার পর একবার ও ইফাদ এর রুমে আসে নি। তবে সবার সাথে বিহেভিয়ার নরমাল। রাতে খাবার খেতে বসেও ইফাদ কে খাবার সার্ভ করে দিয়েছে। ইফাদ এতে মনে মনে একটু অবাক হলেও উপরে উপরে ভাব এমন যেন সে-ও এসব নিয়ে ভাবছে না। কিন্তু মনে মনে সে ঠিকই ভয়ে আছে এভাবে হুট করে বিয়ে করে নিয়ে এলো জোর করে মেয়ে টা নিশ্চয়ই রেগে আছে তার উপর!
ইফাদ খাবার খেয়ে রুমে এসে চিন্তিত মুখে বসে রইলো বিছানায়। আজ তাদের বাসর রাত। এখানে অপেক্ষা করার কথা ছিলো বউয়ের। উলটো সে নিজে অপেক্ষা করছে বউয়ের জন্য। অদ্ভুত ব্যাপার। ইফাদ জোরে শ্বাস ফেলে বিছানা ছাড়লো। নিজের ব্যালকনিতে গিয়ে কিছুক্ষণ সময় কাটালো। কিন্তু শিশির এলো না। ইফাদ চিন্তিত মুখে কক্ষ জুড়ে পায়চারি করতে লাগলো।
ঘড়ির কাঁটায় কাঁটায় বারো টা বাজতে শিশির কক্ষে প্রবেশ করলো। এসে মুচকি হাসলো। ইফাদ অপ্রস্তুত হলো। কোন প্রতিক্রিয়া দেওয়া উচিৎ এক মূহুর্তের জন্য শিশির এর হাসি মুখের দিকে তাকিয়ে ভুলে গেলো। শিশির আসার সময় নিজের লাগেজ নিয়ে এসেছিলো। সেখান থেকে পোশাক নিয়ে ওয়াশ রুমে গেলো। গায়ে তার সেই নরমাল বিয়ের শাড়ী। শাড়ী টা ইফাদ এর মায়ের শাড়ী। নরমাল খয়েরী রঙের একটা জামদানী শাড়ী। বেশ পুরোনো। তবে বেশ নজরকাঁড়া শাড়ীর সৌন্দর্য। ইফাদ বুঝতে পারছে না আসলে শাড়ী টাই সুন্দর না-কি সুন্দরী রমণী শিশির এর গায়ে জড়িয়ে শাড়ী টা সুন্দর দেখাচ্ছে! হয়তো দুই টাই।
ইফাদ গিয়ে বিছানায় বসে। এখন তার কি করা উচিৎ? ঘুমিয়ে পড়বে? না-কি বসে থাকবে? শিশির কি তাকে কিছু বলবে? সে যে জোর করে বিয়ে করে নিলো! তবে ইফাদ এর হঠাৎ গতকাল রাতের কথা মনে পড়লো। ঠিক এই সময় টাই তো সে ছটফট করছিলো মেয়ে টার সাথে একটু কথা বলার জন্য কণ্ঠস্বর টা একটু শোনার জন্য। অন্তর পুড়ছিলো। আর এটা ভেবে মন পুলকিত হতে লাগলো যে কাল যার জন্য সে ছটফট করছিলো আজ সে তার বউ। এবং সে তার কথা রাখতে পেরেছে।
ইফাদ এর ভাবনার মাঝে শিশির বেরিয়ে এলো। পড়নে একটা হাঁটু সমান লম্বা গেঞ্জি আর প্লাজু।
শিশির এসে শাড়ী টা ওয়াশ রুমের সামনে রাখা বিনে রাখলো। গায়ে তার একটা ওড়না। যেটা বিছানায় এক কোণে রেখে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে গেলো। ইফাদ আস্তে করে ঢুক গিলে যা দেখে।
বেচারা একটা সময় প্লেবয় ছিলো। অনেক মেয়ের সাথে হয়তো টুকটাক ফ্লার্ট করা ডেটে যাওয়া। কিন্তু কখনো এরকম অনুভূতি হয় নি।
শিশির নিজের কাজ শেষ করে এসে একদম ইফাদ এর গা ঘেঁষে বসলো। এই পুরুষ টাকে সে ভালোবাসে। অসম্ভব রকমের ভালোবাসে। কিন্তু মুখ ফুটে সে কখনো বলে নি। শিশির এর মনে সব সময় এটা ছিলো যে ভালোবাসলেই পেতে হবে এমন তো কোনো কথা নেই। ইফাদ এর ব্যবহারে শিশির কষ্ট পেতো। তার চলাফেরা শিশির এর হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হতো। শ’খানেক মেয়ের সাথে তার সম্পর্ক এসব শিশির এর দমবন্ধকর অনুভূতিতে নিজে মানসিক অশান্তিতে ভোগাত।
কৈশোরকালের ভালো লাগা। এরপর ভালোবাসা হলো।
মাঝে কত কাহিনি। আর ইফাদ এর করা কাজে সে নিজেই লজ্জিত অনুতপ্ত। কতরকম করে শিশির কে মানাবার চেষ্টা। আজ এক বছর ধরে চলছে।
শিশির তো ভেবেই নিয়েছিলো সে আর এসবে নিজে কে জড়াবে না। কিন্তু সেটা তো আর হলো না। শুধু শুধু এখন নিজে কে এবং এই পুরুষ টাকে কষ্ট দেওয়া ঠিক হবে না।
শিশির আলগোছে ইফাদ এর কাঁধে মাথা রাখলো। ইফাদ প্রথমে চমকালে ও পরক্ষণেই নিজের মুখে হাসি ফুটে উঠলো। মন ভালো হলো। শিশির কে পেছন থেকে এক হাত দিয়ে আগলে নিজের সাথে জড়িয়ে নিলো। সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। দুজনেই চুপ করে একে-অপরকে অনুভব করতে লাগলো। ইফাদ অনেক টা সাহস সঞ্চয় করে জিজ্ঞেস করলো,
-“আমাকে এখনো ঘৃণা করো?”
শিশির চুপ করে আছে। ইফাদ ভেবে নিলো হয়তো তার ধারণা সত্যি। এটা ভেবে মন খারাপ হলো। তবে শিশির পুরুষ টার ধারণা ভুল প্রমাণ করে দিয়ে বলে উঠলো,
-“উঁহু। অনেক বেশি ভালোবাসি।”
-“আমিও ভালোবাসি।”
ইফাদ উচ্ছ্বসিত হয়ে সাথে সাথে জবাব দিলো। শিশির মুচকি হাসলো। ইফাদ আবার আমতা আমতা করে বললো,
-“সেদিন এর ছবি গুলো জাস্ট একটা মেয়ের সাথে ঘুরতে গিয়ে তুলে ছিলাম। কিন্তু বিশ্বাস করো মেয়ে টা ছবি গুলো এডিট করে এমন ঘনিষ্ঠ করেছিলো।”
শিশির পিটপিট করে চোখ খুলে তাকিয়ে আছে পুরুষ টার মুখপানে। ইফাদ কিয়ৎক্ষণ বাদে ফের বলে উঠলো,
-“আমি জানি আমি একটা সময় হয়তো অনেক বেশি মেয়েদের সাথে ফ্লার্ট করেছি। কিন্তু কাউ কে বেড,,,
ইফাদ আর কিছু বলতে পারলো না। তার আগেই শিশির ইফাদ এর মুখে আঙুল চেপে ধরলো। এরপর রাগান্বিত হয়ে দিলো এক ধমক।
-“চুপ।
এ-সব আমাকে বলতে হবে না। বিশ্বাস করি আমি। শুধু নিজের অনুভূতি সামলাতে আমি দূরত্ব বেছে নিয়েছিলাম।”
ইফাদ এবার ঝট করে বউ কে কোলে বসিয়ে দিলো। ইফাদ চমকালেও নিজে কে সামলে নিলো। ইফাদ নিজের মুখ উঁচু করে শিশির এর মুখ টা নিচু করে ধরে কপালে কপাল ঠেকাল। দুজনের শ্বাস-প্রশ্বাস খুব ফাস্ট চলছে। জোরে জোরে শ্বাস ফেলছে শিশির। ওর গলায় ইফাদ এর উষ্ণ নিঃশ্বাস মেয়ে টা দিশেহারা হচ্ছে। ইফাদ আস্তে ধীরে শিশির এর থুঁতনিতে চুমু খেলো। শিশির কেঁপে উঠতে ইফাদ মেয়ে টার কোমড় এক হাতে মৃদু চাপ প্রয়োগ করলো। ফিসফিস করে বললো,
-“আই লাভ ইউ।”
-“হু।”
শিশির ছোট করে বলে উঠলো। ইফাদ বউয়ের ঠোঁটের কোণায় আঙুল ছুঁয়ে দেয়। শিশির তখন অস্থির। ইফাদ মেয়ে টার অস্থির চোখের দিকে তাকিয়ে আবার আগের ন্যায় স্বরে বললো,
-“ক্যান আই,,,
-“ইয়াহ্।”
পুরুষ টা সম্পূর্ণ কথা সমাপ্ত করার আগেই মেয়ে টা বলে। ইফাদ উত্তর পেয়ে আর অপেক্ষা করে না। সাথে সাথে অধরে হামলে পড়ে। অধর সুধা পান করতে ব্যাস্ত হয়।
কত বছরের সেই পিপাসা। শিশির নিজেও তৃষ্ণার্ত। আজ যেন একে-অপরকে কাছে পেয়ে সেই তৃষ্ণা দিগুণ হলো।
——-
মিরা’র পরীক্ষা শেষ হয় নি এখনো। আরো তিন টা পরীক্ষা বাকি। আজ রিহান চলে যাচ্ছে সিঙ্গাপুর। সাথে শুধু মেডিক্যাল রিপোর্ট আর প্রয়োজনীয় কিছু জিনিসপত্র ছাড়া আর কিছুই সাথে নিচ্ছে না রিহান। তাই গোছগাছ এর তেমন প্যারা নেই। সাথে যাবে ইফাদ রিয়াজ শেখ রেহনুমা বেগম। মিরা যাবে না। তার যাওয়ার কথা থাকলেও সে কোনো কারণে যাচ্ছে না। সেই কারণ টা কি রিহান জানে না। তার কৌতূহল বেশি হচ্ছে। গত পনেরো দিনে রিহান মিরা’র গতিবিধি কিছু টা লক্ষ্য করে বুঝতে পারছে মিরা’র কিছু একটা হয়েছে কিন্তু কি বুঝতে পারছে না।
রিহান এসব হাবিজাবি ভাবতে ভাবতে ড্রেসিং টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে। কিন্তু হঠাৎ কি মনে করে পাশের ড্রয়ার টা খুললো। আর তৎক্ষনাৎ নজরে পড়লো সেখানে কিছু একটা রয়েছে। যেটা আগে এখানে ছিলো না। রিহান সেই ছোট বস্তু টা হাতে তুলে উলটে পালটে দেখতে ই মাথা চক্কর দিলো। চোখ জোড়া না চাই তেও আকৃতি বেশ বড় হয়ে গেলো। হাত কাঁপছে। ঠোঁট কাপে। তখন রুমে মিরা এলো। রিহান কিছু বুঝে উঠার আগেই মিরা বস্তু টা খপ করে কেঁড়ে নিলো রিহান এর থেকে। রিহান মিরা’র দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে বলে উঠলো,
-“এটা সত্যি?”
চোর ধরে পড়ে যাওয়ার পর মুখ যেমন হয় মিরা’র বদনখানি ঠিক এই মূহুর্তে তেমন হয়েছে।
মিরা গলা ঝেড়ে পরিষ্কার করলো। তবে কিছু বলতে পারলো না। রিহান মিরা’র দুই কাঁধে হাত রেখে ঝাঁকিয়ে আবার বলে উঠলো,
-“এই বলো না! এটা সত্যি? আমি বাবা হবো?”
মিরা মাথা নাড়লো। সাথে সাথে রিহান মিরা কে জড়িয়ে ধরলো। তবে মিরা ধরলো না। মিরাা কিয়ৎক্ষণ সময় ব্যবধানে বলে উঠলো,
-“হ্যাঁ সত্যি। আর আপনি এটা নিয়ে কোনো রকম বাহানা যেন করতে না পারেন সেইজন্য এতোদিন বলি নি আমি। আমি চাই আপনি সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন। আমাদের সন্তান নিয়ে আমরা সুখে সংসার করবো। আর এটাই আমি চাই।”
কঠোর স্বর। রিহান এর হাতের বাঁধন ঢিলে হলো। অবাক হয়েছে সে। ভীষণ অবাক। মিরা অনেক বেশি কঠোর হয়ে গেলো কি তার প্রতি? হ্যাঁ। রিহান এর দম বন্ধ লাগলো। সে বাবা হবে। খবর টা এমন মূহুর্তে পেয়েছে যে চাইলেও সে কিছু করতে পারবে না। রিহান এর নিজে কে বড্ড অসহায় লাগলো। মিরা কিছু না বলে রুম থেকে চলে গেলো। রিহান ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইলো বউয়ের যাওয়ার দিকে।
———–
রিহান গাড়িতে বউ কে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে বসে রইলো। এয়ারপোর্টে এসে গাড়ি থেকে নামার আগে ও মিরা’র দিকে বেশ কয়েকবার রিহান অসহায় দৃষ্টিতে তাকিয়েছে। কিন্তু কোনো লাভ হয় নি।
চেক-ইন এ যাওয়ার আগে রিহান বউ কে জড়িয়ে ধরলো। পুরুষ টার চোখের কোঠায় জল। মিরা দেখেও যেন দেখলো না। রিহান বললো,
-“আমার জন্য অপেক্ষা করো।”
মিরা তাড়া দিলো। রিয়াজ শেখ রেহনুমা বেগম ইফাদ চলে গিয়েছে অলরেডি ভেতরে। রিহান ও যেন না চাই তেও বাধ্য হয়ে পা বাড়ালো। বোর্ডিং গেটে রিহান চলে যাওয়ার পর মিরা দূর থেকে
কাচের দেয়ালের ওপারে রিহান কে দেখলো। ঘোষণা দিয়ে দেওয়া হয়েছে। রিহান বিমানে উঠতেই মিরা নিজের পেটের উপর হাত রাখলো। এরপর চোখের জল টা টপ করে নিচে গড়িয়ে পড়লো। মিরা ধরে আসা গলায় বললো,
-“আমরা আপনার জন্য অপেক্ষা করবো রিহান শেখ।”
~সমাপ্ত।
[ গল্প টা শেষ হয়ে ও যেন শেষ হয় নি। আমি এমন একটা যায়গায় এন্ডিং করেছি যেখানে গল্প টার পরবর্তীতে কি হবে সেটা আপনারা নিজেদের মতো করে ভেবে নিতে পারেন। এই যেমন রিহান সুস্থ হয়ে ফিরে এলো আর তারা আবার সুখে-শান্তিতে সংসার করতে লাগলো। আর হ্যাঁ দীর্ঘ দিনের জার্নি শেষ হলো। অনেক অপেক্ষা করিয়েছি আমি আপনাদের তার জন্য সরি। এবং গল্প টাকে এভাবে ভালোবেসে পাশে থেকে সাপোর্ট করার জন্য শুকরিয়া সাথে ভালোবাসা। ভুল ত্রুটি ক্ষমার দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ।]