পুনর্মিলন পর্ব-০২

0
99

#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_২

বাসের ঝোঁক সামলাতে না পেরে ফাল্গুনী তার নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে। আষ্টেপৃষ্ঠে জায়গা করে নিয়েছে জাগ্রতর কোলে। জাগ্রতও আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে আছে ফাল্গুনীকে। দুরত্ব এখন বহুদূরে। ফাল্গুনীর হৃদস্পন্দন বেড়ে গেছে। তার মনে হচ্ছে তার বুক পাঁজরে তীব্র গতিতে স্পন্দনকৃত হৃদয় বুঝি বেরিয়ে আসছে বুক চিঁড়ে।

জাগ্রত অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে ফাল্গুনীকে দেখছে। চমকেছে এতটাই যে ফাল্গুনীকে প্রশ্নে উথলানো দৃষ্টি ফিরিয়ে দিতে ভুলে গেছে সে। ফাল্গুনী তাড়াহুড়ো করে উঠে পড়ে ধপ করে বসে যায় নিজের জন্য বরাদ্দকৃত সিটটিতে। জাগ্রত বুঝতে পারছে না তার প্রতিক্রিয়া এখন কেমন হওয়া উচিত। একজন অপরিচিত পরপুরুষ এর ন্যায় নজর সরিয়ে নেওয়া উচিত নাকি মনের ভেতর বৃষ্টির পানির ন্যায় জমানো শত সহস্র প্রশ্ন আর অভিযোগ এর ধারা বহানো উচিত। সম্মোহনী রেখায় ভাঁজ হলো জাগ্রত। মায়া মিশেল কন্ঠে ডেকে উঠলো,
‘ফাগুন’ বলে।

ফাল্গুনীর অন্তর কেঁপে উঠলো ডাক টি শুনে। ফাগুন! নামটা যে মনের ভেতর গভীর এক আঁচড় কেটে দিলো। তবে উত্তর সে দিলো না। বরফের ন্যায় জমে কঠিন হয়ে বসে রইলো। জাগ্রতর চোখ মুখে এতক্ষণ যে অবাকের রেশ ছিলো হঠাৎ তা গায়েব হয়ে গেলো। কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলো। তারপর তাচ্ছিল্য মুখভঙ্গিতে বলে ওঠলো,

‘তুমি বরিশালে যে! নিজের বাড়িতে বুঝি জায়গা হয়নি? ওখানেও মানিয়ে থাকতে পারনি সবার সাথে, তাই না? তা না হলে টাঙ্গাইলে নিজের বাড়ি রেখে বরিশালে তোমার কি কাজ? আমার জানা মতে, সেখানে তো তোমার কোন আত্মীয়ের বাড়িও নেই।’

ফাল্গুনীর সোজা বুকে গিয়ে লাগলো কথাখানা। এসব কথার সম্মুখীন হওয়ার ভয়-ই সে পেতো। এতক্ষণের নিরবতার বিচ্ছেদ ঘটিয়ে ফাল্গুনী জবাব দিয়ে ওঠলো,

‘মানিয়ে চলার প্রশ্ন তখন আসে যখন আশেপাশে সুস্থ মস্তিষ্কের মানুষ বসবাস করে। সেই অভাবেই তো কোন একদিন মানিয়ে নিতে না পারার তকমা লেগেছিলো গায়ে। তবে তা নিজের বাড়িতে নয়। কেননা নিজের বাড়িতে কখনো মানিয়ে চলার প্রয়োজন হয় না। তাছাড়া আমার বাড়িতে আমি থাকবো কি থাকবো না তা আমার সিদ্ধান্ত। আর তাছাড়া বরিশাল তো আর আপনি কিনে নেননি। সেখানে কে এলো কে গেলো তা দিয়ে আপনার কি কাজ? কই আমার তো আপনার উপস্থিতি বা অনুপস্থিতি নিয়ে কোন মাথা ব্যাথা নেই। তাহলে আপনার কেন হচ্ছে?’

জাগ্রত দমে গেলো না। হাসি মুখেই বলে ওঠলো,

‘কারো মাথা ব্যাথা হওয়ার কারণ হতেও কিছু গুণের অধিকারী হতে হয়। তোমার ভেতর তার ছিটেফোঁটাও নেই। তুমি কারো মাথায় বড়জোড় বোঝা হতে পারো, ব্যাথা নয়।’

জাগ্রত কথা শেষ করে হঠাৎ কিছু একটা ভেবে আবারও বলে ওঠলো,

‘বাই দা ওয়ে, তুমি একা একা নাইট শিফটে কেনো জার্নি করছো? এখনও বুঝি দিন দুনিয়ার হিংস্রতা সম্পর্কে জ্ঞান হয়নি? নাকি বলবে এখনও বয়স হয়নি পরিস্থিতি বোঝার? দিনের বেলায়ই আজকাল একটা মেয়ে যেখানে সেইফ নয় সেখানে তুমি এত রাতে জার্নি করছো তাও আবার সম্পূর্ণ একা একা। আমার জায়গায় তো একজন অচেনা পরপুরুষ ও থাকতে পারতো। এভাবে কোন পরপুরুষ এর কোলে চড়ে বসে থাকতে?’

জাগ্রতর আচমকা এমন উগ্রতা দেখে অবাক হলো ফাল্গুনী। সেও খানিক হাসি মুখেই প্রত্যুত্তর করে উঠলো,

‘পরিস্থিতি বোঝার সামর্থ্য কতটুকু হয়েছে জানি না তবে যে কোন পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার বুদ্ধি ও মনোবল অবশ্যই হয়েছে। আর পরপুরুষ এর কথা বলছেন, আপনি বুঝি আমার জন্য পরপুরুষ নন? আপনি আমার আপন কেউ?’

‘ফাউল তর্ক করার অভ্যেস এখনো ভুলো নি দেখছি।’

‘আপনি দোষারোপ করা ভুলেননি
দেখছি।’

‘এখানেও ঝগড়া বাঁধাচ্ছো!’

‘আগের মতো আজও ঝগড়ার দায়ভার আমার ওপরেই চাপাচ্ছেন। শুনুন, আমি আপনার ঘরের বউ নই। তাই দোষ খোঁজা বন্ধ করুন। আর দয়া করে একটু চুপ থাকুন। মনে করুন আমাকে আপনি চেনেন না। আগে কখনো দেখা হয়নি আমাদের। আশা করি আর কথা বাড়িয়ে নিজের নির্লজ্জতার পরিচয় দেবেন না।’

ফাল্গুনীর এবার নিজেকে পৃথিবীর সবথেকে অসহায় এক প্রাণ বলে মনে হচ্ছে। ভেতর থেকে দুমড়ে মুচড়ে বেড়িয়ে আসছে অতীতের অধ্যায়। চার চারটি বছর সে পার করেছে একা। সম্পূর্ণ একা। বাকি জীবনটাও এবাবেই পার হয়ে যেতো। কেনো আবার দেখা হলো।

দুজনেই জখম হৃদয় নিয়ে চুপচাপ বসে আছে দুদিকে ফিরে। মুখোমুখি হওয়ার পর পেরিয়ে গেছে দুই ঘন্টা। এই দুই ঘন্টায় কেউ কোন কথা বলে নি একে অপরের সাথে। অতিক্রম হয়েছে দীর্ঘশ্বাস এ ভরপুর আকাশ সমান এক বিশাল মূহুর্ত। কেউ কোন কথা খরচ করে লোকসানের ভাগিদার হয়নি। আর না দৃষ্টি বিনিময়ে হয়েছে কোন আবেগ, ক্ষোভ বা অনূভুতির প্রকাশ। দুজনেই অপেক্ষায় আছে এক নতুন ভোরের। যে ভোরে বাস গিয়ে থেমে যাবে নির্দিষ্ট গন্তব্যে। আর মুক্ত হয়ে গন্তব্যে পা বাড়াবে দুজন দু’দিকে।

কিছুক্ষণের মধ্যেই বাস থেমে গেলো। ফেরিঘাটে এখনো পৌঁছাতে পারে নি বাসটি। ফেরিঘাট থেকে পাঁচ কি.মি. দুরে জ্যামের ধুলো-ধোঁয়ায় আটকা পড়েছে। এ কোন নতুন কিছু নয়। এ রাস্তায় এটি প্রতিনিয়ত হয়ে থাকে। তা যাত্রীগণ সবাই জানে। বাস থামতেই ভিড় করছে বিভিন্ন ফেরিওয়ালাদের দল। হাঁকিয়ে যাচ্ছে একেকজন একেক বস্তু ফেরি করার উদ্দেশ্যে। বাস থামছে আবার চলছে, আবার থামছে আবার চলছে। এভাবেই চার ঘন্টার বেশি অতিক্রম হয়ে গেলো।

চার ঘন্টা পর বাস পৌঁছে গেলো ফেরি ঘাটে। ফেরি ছাড়তেই ফাল্গুনী উঠে যায়। এক প্রকার দৌড়ে চলে যায় চার তলা ফেরির ছোট পরিসরের ছাদখানায়। ছাদটা খালি। মানুষের আনাগোনা শুরু হয়নি এখনও।

ফাল্গুনীর পিছু পিছু এগিয়ে গেছে জাগ্রত। যাওয়ার আগে বার বার নিজের সাথে যুদ্ধ করে তারপরেই এগিয়েছে। মনটা যেনো দুমুখো কাল সাপ। দু’দিকেই বিষ ছোবল মারে। মনের বিষ হজম করে সিদ্ধান্ত নিয়েছে সব প্রশ্নের উত্তর আজই চাইবে সে। আজও কেন এতো ঘৃণা চোখে নিয়ে বেড়ায় মেয়েটা তার প্রতি, তার উত্তর চাইবে। দোষ কি তার একাই ছিলো? সে বুঝি কোন দোষ করেনি? তবু তার দৃষ্টিতে শুধু সে একাই কেন দোষী?

জাগ্রত ছাদে পৌঁছে গিয়ে ফাল্গুনীর পিছনে দাঁড়িয়েছে। ফাল্গুনী পিছু ফিরে দাড়িয়ে আছে। দেখতে পায়নি জাগ্রতকে। জাগ্রত কিছু বলবে এর মধ্যেই কয়েকজন যাত্রী উঠে আসে ছাদে। চারপাশে ঘুরে ঘুরে এদিক সেদিক ফিরে ছবি তুলতে থাকে তারা। জাগ্রত আর কিছু বলে উঠতে পারে না। নেমে যায় নিশ্চুপ হয়ে। বাস একবার ছাড়ুক তারপর কথা বলবে সে।

ফাল্গুনী এসেছিলো কিছুক্ষণ একা থাকতে। কিন্তু এখন আর এখানে একা থাকা সম্ভব নয়। তাই সেও নেমে গেলো নিচে। তবে বাসের ভেতরে প্রবেশ করলো না তৎক্ষনাৎ। ফেরির এক কিনারায় দাঁড়িয়ে রইলো রেলিং ঘেষে। ভাবছে এতোটা পথ কি করে আজ অতিক্রম করবে সে!

হঠাৎ ফাল্গুনীকে কেউ ডেকে উঠলো নাম ধরে। ফাল্গুনী এদিক সেদিক নজর চালিয়ে তেমন কাউকেই খুঁজে পেল না। হঠাৎ তার চোখ যায় দোতলায়। সেখানে কেউ হাত নাড়িয়ে যাচ্ছে। হাত নাড়ানো বন্ধ করে সেখান থেকে সরে এসে উঁচু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নেমে আসে ছেলেটি। মানুষটিকে চিনতে পেরে ফাল্গুনী বিরক্ত হলো। রাগ হলো নিজের কপালের ওপর। এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবে আর কার কার সাথে দেখা হবে আজ রাতে! সোহাগ এখানে কেনো! তার তো আগামীকাল যাওয়ার কথা ছিলো।

‘আরে ফাল্গুনী আমি তো নিজের চোখকেও বিশ্বাস করতে পারছি না। সত্যিই এটা তুমি তো? কি সোনায় বাঁধানো কপাল আমার বলো। স্বয়ং উপরওয়ালাও চান আমাদের দেখা হোক তাই এতো দূর চলে এসেও দেখা হয়ে গেলো। পালাতে পারলে না তো!’

সোহাগের কথায় মহা বিরক্তিতে ছেয়ে গেলেও হাসি মুখে চেয়ে রইলো শুধু ফাল্গুনী। প্রত্যুত্তর করলো না। সোহাগ টুকটাক কথা বলতে শুরু করলো। ফাল্গুনী হাসি বজায় রেখেই হু হা করে করে গেলো। কথা বাড়ানোর মতো মন মানসিকতা তার এখন নেই।

এদিকে জাগ্রত বাসের জানালায় বসে দেখে যাচ্ছিলো ফাল্গুনীকে। অপেক্ষা করছিলো ফেরি পার হয়ে বাস ছেড়ে দেওয়ার। বাসে বসে কথা এড়িয়ে আর যাবে কই হঠাৎ করে ফাল্গুনীর পাশে একটা ছেলে দেখে অবাক নজরে চেয়ে রইলো। সবথেকে বেশি অবাক হলো ফাল্গুনীকে এত হেসে হেসে কথা বলতে দেখে। হাসি যেন সরছেই না মুখ থেকে।

জাগ্রত সিট থেকে ওঠে দাড়ালো। ধপাধপ্ নেমে গেলো বাস থেকে। বসে থাকতে পারলো না চুপচাপ। নেমে গিয়ে ফাল্গুনী যেদিকে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকটায় পা বাড়ালো।

~চলবে