পুনর্মিলন পর্ব-০৩

0
81

#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩

জাগ্রত সিট থেকে উঠে দাঁড়ালো। ধপাধপ্ নেমে গেলো বাস থেকে। বসে থাকতে পারলো না চুপচাপ। নেমে গিয়ে ফাল্গুনী যেদিকে দাঁড়িয়ে আছে সেদিকটায় পা বাড়ালো। কিছুদূর যাওয়ার পর তার মনে হলো, কেনো এলো সে! আর ওখানে গিয়েই বা কি করবে। অযথা উঠেই বা কেনো এলো, ভাবলো আবার ফিরে যাবে বাসে। কিন্তু আচমকাই ফাল্গুনীর চোখে চোখ পড়ে গেলো। ফাল্গুনীকে চেয়ে থাকতে দেখে সোহাগ ও তাকিয়েছে জাগ্রতর দিকে। এবার ফিরে গেলে কেমন দেখাবে ভেবে আর ফিরে গেলো না জাগ্রত। এগিয়ে গেল ফাল্গুনীর দিকে আর পাশ কাটিয়ে চলে গেল দোতলায়। অঙ্গভঙ্গি এমন, যেনো সে তাঁদের চেনে না। দেখেও নি কোনদিন।

ফাল্গুনী নিজেও অতি স্বাভাবিক ভাবে তার দৃষ্টি ফিরিয়ে নিয়েছে। সোহাগ কে বুঝতে দেয়নি কিছু। প্রথমে জাগ্রতকে এগিয়ে আসতে দেখে ভয় পেয়ে গিয়েছিল ফাল্গুনী। শ’ঙ্কায় ছিলো কোন বি’প’ত্তি না সৃষ্টি হয়। সোহাগ আছে সাথে। যদি উল্টোপাল্টা কিছু বলে তার সামনে তাহলে লজ্জায় মাথা কা’টা যাবে। এদিকে সোহাগের বকবকানির কোন থামাথামি নেই। মাথাটাও দপদপ করছে ব্যাথায়। একসাথে এতো মানসিক চাপ আর নেওয়া যাচ্ছে না।

‘ফেরিতে উঠার পর কিছু খেয়েছিলে তুমি?’

সোহাগের কথায় ঘোর কাটে ফাল্গুনীর। ছোট্ট করে জবাব দেয়, ‘না খাইনি।’।

‘সেকি, রাতের এখন ক’টা বাজে সে খেয়াল আছে? ভোর হতে খুব বেশি দেরি নেই। চলো খাবে চলো। আমিও তেমন ভারি কিছু খাইনি। খাবো বলেই উঠেছিলাম দোতলায়। তারপর তোমায় দেখে নেমে এলাম নিচে। ফেরি ওপারে পৌঁছাতে আর বেশি সময় নেই। চলো জলদি। দুজনে আজ ইলিশ দিয়ে ভাত খাবো। ইলিশ ভাজা আর ইলিশ ঝোল দুটোই নেবো কি বল?’

‘আপনি ব্যস্ত হবেন না। এসবের কোন প্রয়োজন নেই। গাড়িতে বমি হয়েছিলো গলা বোধহয় ছিলে গেছে। এখন খেতে পারবো না কিছু। গলায় জ্বালা করবে, কষ্ট হবে ভীষণ। আপনি যান খেয়ে আসুন। আমার তেমন খিদে নেই।’

‘আরে সেটা আগে বলবে তো। দাঁড়াও এক মিনিট আমি এক্ষুনি আসছি। এখান থেকে কোথাও যেও না কিন্তু। এখানেই দাঁড়াবে।’

সোহাগ ফটাফট পা চালিয়ে ফেরির শেষ মাথায় চলে গেল। ফেরিতে ওঠার পর প্রথমেই সেখানে ডাবের সন্ধান পেয়েছিলো সে। ফেরি তে প্রায় সবধরনের খাবার এর জিনিস এবং জরুরি দ্রব্যাদি পাওয়া যায়। বড় ফেরি হলে তো কথাই নেই। ডাব বিক্রেতা দুই পাশে দুই বাধি ডাব নিয়ে বসেছে। আকার আর আয়তন ভেদে দুই রকমের দর নির্ধারিত করা আছে। সোহাগ বেছে বেছে বেশ বড় এবং কচি একটি ডাব বাছাই করে কাটতে বললো ডাব বিক্রেতাকে। দর হলো সত্তর টাকা। সময়টা মধ্যরাত তাই দামও একটু চড়া। দিন হলে পঞ্চাশ টাকায় অনায়াসে দিয়ে দিত।

জাগ্রত দোতলায় খানিক আড়াল হয়ে হয়ে বসে আছে। না চাইতেও নজর রেখে যাচ্ছে ফাল্গুনীর গতিবিধির উপর। নিজের মনকে শাসিয়েও নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি নিজের দৃষ্টি সীমানার। বারবার শুধু আলোর গতিতে ছুটে চলে গেছে ফাল্গুনী বরাবর। এ সীমার সীমানা ঘাঁটি যেনো ফাল্গুনীতেই শেষ।

ফাল্গুনী যখন ক্ষনে ক্ষনে হাসছিলো আর কথার জবাব দিচ্ছিলো সোহাগের সাথে, জাগ্রত তখন অতীত হাতড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছিলো তাদের দুজনার একসাথে কোন হাসিখুশি মুহুর্তের প্রতিচ্ছবি। যেখানে জাগ্রতর কথায় এমন মিষ্টি করে হেসেছে তার ফাগুন। কিন্তু হায়! সে খুঁজে পায়নি এমন কোন মুহূর্ত। এক বছরের সংসার ছিলো দুজনের। তিনশো পঁয়ষট্টিটি দিন। একটি দিনও এমন যায়নি যেদিন দুজনে সামনাসামনি হয়ে হেসে দুটো কথা বলেছে। ভাগ করে নিয়েছে হৃদয় নিঙড়ানো অনুভূতি। তবু কেন এত পিছুটান। কেন?

ফাল্গুনীর ভীষণ অস্থির লাগছে। তার মনের ভেতর শুধু জাগ্রতকে নিয়ে ঘাটাঘাটি হচ্ছে। কোনভাবেই ওই মানুষটার চিন্তা মাথা থেকে অপসারণ করতে পারছে না। সোহাগ কে নিয়ে আরও বেশি চিন্তা। সোহাগকে তার সাথে দেখে আবার উল্টো পাল্টা না ভেবে নেয় জাগ্রত। তাহলে আবার তার দোষ গুণের ময়নাতদন্ত নিয়ে বসবে। তখন যেভাবে তাদের দিকে এগিয়ে আসছিলো মনে হচ্ছিল গোল বাঁধাতেই আসছে। তারপর হটাৎ পাশ কাটিয়ে চলে গেলো দোতলায়। দোতলায় বসে আবার নজর রাখছে কি না এদিকে সেটা নিয়েই এখন চিন্তা হচ্ছে। অস্বস্তি হচ্ছে প্রচন্ড। চোখ তুলে ওপর দিকে চেয়ে দেখতেও মনে সায় দেয় না। যদি চোখে চোখ পড়ে যায়। তাহলে কি হবে? না তাকিয়েও শান্তি লাগছে না। মনটা খুব নিশপিশ করছে।

হটাৎ এক দারুণ বুদ্ধির আগমন হলো ফাল্গুনীর মস্তিষ্কে। দেড় হাত দূরে পার্ক করে রাখা আছে একটি বাইক। সেই বাইকের সম্মুখভাগে থাকা লুকিং গ্লাসটি দিয়ে অনায়াসে দোতলায় নজর হাঁটকানো যাবে। দোতলায় যথেষ্ট মাত্রায় আলোর উপস্থিতি বিদ্যমান তাই বিষয়টা খুব একটা কঠিন হবে না। যেই ভাবা সেই কাজ। ফাল্গুনী দুই পা এগিয়ে গিয়ে দাঁড়ালো বাইকটির কাছে। সজাগ নজরে আশপাশটা একটু দেখে মনে মনে ভাবলো, ‘কে জানে বাইকটির মালিক কে আর কোথায় আছে। এসে দু’টো ঝারি না মারলেই হয়।’ বাইকের লুকিং গ্লাসটি ঘুড়ানোর উদ্দেশ্যে হাত বাড়াতেই আচমকা উপস্থিত হলো সোহাগ। ফাল্গুনীর দিকে ডাব এগিয়ে দিয়ে বললো,

‘ঝটপট এটা শেষ করতো। এটা খেলে গলাও জ্বলবে না আর পেট ও ভরবে।’

অকস্মাৎ সোহাগের উপস্থিতিতে ভড়কে গেছে ফাল্গুনী। যেনো চুরি করতে গিয়ে হাতে নাতে ধরা পড়েছে সে। মুখে রেডিমেড হাসি ঝুলিয়ে দ্রুত ডাব নিয়ে নিলো সোহাগের হাত থেকে। ভদ্রতা সূচক সোহাগ কে জিজ্ঞেস করতে ভুলে গেলো ডাব একটা কেন, তার নিজের জন্য কেনো আনেনি। সোহাগের দিকে খেয়াল না রেখেই ডাবে থাকা সরু পাইপটি মুখে নিয়ে নিল তৎক্ষনাৎ। ডাবের ঠান্ডা জল গলা ছুঁয়ে তারপর বুক বেয়ে পেটে চলে যাওয়া টের পাচ্ছে ফাল্গুনী। খালি পেটটা যেনো মুহুর্তেই ঠান্ডা হয়ে গেলো। কিন্তু মস্তিষ্ক ঠান্ডা হলো না। সেই এক চিন্তা মস্তিষ্ক জুড়ে মাছির মত ভনভনিয়ে যাচ্ছে। তার মনে হচ্ছে জাগ্রত তাকে দেখছে। চোখ লাল করে চেয়ে আছে তার দিকে। বাইকের ছোট আয়নাটাও যেনো হাতছানি দিয়ে ডাকছে তাকে, জাগ্রতের রাগী চোখের রক্তিম দৃষ্টির সহিত সাক্ষাৎ করাতে।

সোহাগের ফোনে হটাৎ মেসেজ টোন বেজে ওঠে। সোহাগ পকেট থেকে ফোনটি বের করে নিয়ে খানিক ব্যাস্ত হয়ে গেলে ফাল্গুনী স্বস্তির শ্বাস নেয়। এক হাতে ডাব ধরে রেখে খেতে খেতেই আরেক হাত রাখলো আয়নায়। অতি সন্তর্পণে ছোট আয়নাটি একটু একটু করে নাড়িয়ে চাড়িয়ে দোতলায় নজর চালালো। কিন্তু চোখে পড়ল না সেই চেনা মুখাবয়বটি। এ কোনা থেকে ও কোনা কোথাও নেই মানুষটা। ফাল্গুনীর মন এবার শান্ত হলো। ভাবলো যাক জাগ্রত তাহলে নজর রাখেনি তার ওপর। আবার কেনো জানি একটু মন খারাপ ও হলো। মনে হলো কেনো রাখল না নজর! নিজের চিন্তা ভাবনার ওপর নিজেই বিরক্ত হলো। দীর্ঘশ্বাস ফেলে আয়নাটা টেনে সোজা করলো। কিন্তু ঘটে গেলো আর এক বিপত্তি! এক টানে আয়নাটা সোজা করায় কেচ করে শব্দ করে উঠেছে। ফাল্গুনী ভেবেছে আয়নাটা ভেঙে গেছে। ভয় পেয়ে হাত আলগা করে নিলে অসাবধানতায় অন্য হাতে ধরা ডাব পরে যেতে নেয় আর সোহাগ তা ধরে ফেলে। এদিকে ফাল্গুনীও ঝটপট হাত বাড়ায়। সোহাগ আর ফাল্গুনী দুজনের চার হাত মিলে ধরে নেয় ডাবটি।

এদিকে দোতলায় জাগ্রত দাড়িয়ে আছে একটি পিলারের খানিক পিছন দিকে। ফাল্গুনীর গতিবিধির ওপর প্রথম থেকেই নজর ছিলো তার। ফাল্গুনী যে বাইকের লুকিং গ্লাসের সাহায্যে দোতলায় তারই সন্ধান করার চেষ্টায় আছে তা সে আন্দাজ করে নিয়েছে। তার আন্দাজ ভুল হলেও হতে পারে তা সে ভাবলেও সাবধান বশত পিলারের আড়ালে দাঁড়িয়ে গেছে। যাতে সে ফাল্গুনীর চোখে না পড়ে যায়। তারপর সাবধানে একজন লোকের পিছনে দাঁড়িয়ে আড়চোখে নিচের দিকে চাইতেই তার চোখ যেন কপালে উঠে যায়। বুকের ভেতর মোচড় দিয়ে ওঠে ফাল্গুনীর সাথে একজন অন্য পুরুষকে এতটা কাছাকাছি এসে দুজনের চার হাত প্রায় এক করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে। প্রচন্ড রাগ আর অস্থিরতায় দৃষ্টি সরিয়ে নেয়। ফাল্গুনী আর সোহাগ এর চার হাত মিলে একটি ডাব ধরে এতটা কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা অবসহন হয় না জাগ্রতর। বিষিয়ে উঠে ভেতরটা। ছুটে গিয়ে অচেনা ছেলেটাকে রক্তাক্ত করে দিতে ইচ্ছে করে। ভেঙে দিতে ইচ্ছে করে সেই হাত যা ফাল্গুনীর হাত স্পর্শ করেছে। আর ফিরে তাকায় না নিচের দিকে। ওখান থেকে সরে এসে দূরে গিয়ে দাঁড়ায়। যেখান থেকে দেখা যাবে না ফাল্গুনীকে। অপেক্ষায় থাকে পারে পৌছাবার আর তারপর বাস ছেড়ে দেওয়ার। অপেক্ষায় পথ চেয়ে রয় অপলক।

ফাল্গুনী সোহাগের হাতে ডাব ছেড়ে দিয়ে তৎক্ষনাৎ হাত সরিয়ে নেয়। খানিক অপ্রস্তুত হয়ে ডাব ছেড়ে দিয়ে বলে ওঠে,

‘আমি আর খেতে পারছি না। ডাবটি অনেক বড়। আমার পেট ভরে গেছে।’

‘আর একটু খাও। তোমায় তো দুর্বল মনে হচ্ছে। ডাবটা তো ঠিক মতো ধরেও রাখতে পারছো না। তোমার কি খারাপ লাগছে?’

‘না না তেমন কিছু নয়। হাত ফস্কে গেছিলো একটু। আপনি একটু বেশিই বলছেন।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে বাকিটুকু আমিই খেয়ে নিচ্ছি। তুমি তো আর নিজে থেকে আমায় খেতে বলবে না। তোমার ভাগেরটাই নাহয় খেলাম।’

ফাল্গুনী মনে পড়ে সে তো একা একাই এতক্ষণ খেয়ে যাচ্ছিল। সোহাগকে তো জিজ্ঞেস ও করে নি সে নিজের জন্য কেনো আনে নি। নিজের বেখেয়ালি আচরণে বড্ড খেদ হয়। দুঃখ প্রকাশ করে বলে ওঠে,

‘সরি। আপনাকে জিজ্ঞেস করবো খেয়াল ছিল না। আপনি একটা ডাব কেনো এনেছেন? নিজের জন্য আনেন নি যে, আপনিও তো কিছু খাননি বললেন। আমিও আছি এক! আপনাকে জিজ্ঞেস না করে একা একাই খেতে শুরু করে দিয়েছি।’

‘থাক থাক আর মুখ ভার করতে হবে না। আমি এটাই খেয়ে নিচ্ছি।’

‘আমার এঁটো টা খাবেন কেনো? আরেকটা নিয়ে আসুন না।’

‘এঁটো কিভাবে হলো? তুমি কি ডাবের ভেতরে ঢুকে খেয়েছ নাকি? আর তুমিই তো বলো খাবার নষ্ট করা নাকি মোটেও উচিত নয়। তাহলে কি এটা ফেলে দেবো?’

‘আচ্ছা তাহলে দিন আমি বাকিটা খেয়ে নিচ্ছি। আপনি আরেকটা নিয়ে আসুন।’

‘ফাল্গুনী! তুমি না বললে বাসে তোমার বমি হয়েছে। এখন আবার জোর করে বেশি খেলে বাসে উঠে আবারও বমি হবে। আর ফেলে দেওয়াও ঠিক হবে না। তার থেকে বরং আমিই খেয়ে নিচ্ছি।’

‘আচ্ছা ঠিক আছে তাহলে পাইপ টা ফেলে দিন। ওটা তো এঁটো। উঁচু করে খেয়ে নিন।’

ফাল্গুনী কথা শেষ করে সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইলো অন্যমনস্ক হয়ে।
সোহাগ ফাল্গুনীর খাওয়া পাইপ দিয়েই অনায়াসে বাকি জলটুকু খেয়ে নিলো। ফাল্গুনীর সে খেয়াল নেই। সে মজে আছে অন্য চিন্তায়।

~চলবে