পুনর্মিলন পর্ব-০৪

0
73

#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৪

ফাল্গুনী কথা শেষ করে সামনের দিকে ঘুরে দাঁড়িয়ে রইলো অন্যমনস্ক হয়ে।
সোহাগ ফাল্গুনীর খাওয়া পাইপ দিয়েই অনায়াসে বাকি জলটুকু খেয়ে নিলো। ফাল্গুনীর সে খেয়াল নেই। সে মজে আছে অন্য চিন্তায়। ফেরি তো প্রায় পারে চলে এলো। এবার তো আবার সেই বাঘের সাথে বাঘের গুহায় ঢুকে হরিণের মতো বসে থাকতে হবে। না জানি কখন হামলা করে বসে। ফাল্গুনী মনে মনে পণ করে নিলো বাসে ওঠে আর ঘুমন্ত বাঘকে কোনভাবে জাগতে দেবে না। যতই বাঘ গর্জে উঠুক সে একেবারে নিশ্চুপ হয়ে বসে রবে। তারপর আবার ভাবে, এখন তো এতো ভয় হচ্ছে জাগ্রত কে নিয়ে তাই তার সাথে কথা না বাড়ানোর চিন্তা আসছে মাথায়। বাসে উঠার পর মাথায় রাগ না চাপলেই হলো। নয়তো রাগের বসে যেচে পড়ে বাঘের থাবার শিকার হতে হবে। কপাল ভালো এখন আশেপাশে নেই নয়তো সোহাগের সাথে এমন অনাকাঙ্ক্ষিত ঘটনা দেখে নিলে না জানি কতো খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে কথা শোনাতো আর দোষ ধরতো। কিন্তু ফাল্গুনী জানতে পারলো না বাঘ তো আরও আগেই ক্ষেপে গেছে। তার তো খোঁচা লেগেছে সোজা বুকের ভেতর। ক্ষত হয়েছে গভীর। এবার বাঘ কি করবে কে জানে!

ফেরি পৌঁছে গেছে তার গন্তব্যে। বাস, প্রাইভেট কার বা অন্যান্য যানবাহনের সকল যাত্রীরা যারা পুরো ফেরির এদিক সেদিক ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিলো সবাই যার যার নিজের সিটে গিয়ে বসতে শুরু করে দিয়েছে। ফেরির কর্মচারীরা গাড়িগুলো বের হবার জন্যা রাস্তা করে দিলে সারি সারি সব গাড়ি গুলো নামতে শুরু করবে। ফাল্গুনী এবং সোহাগদের বাস একদম শেষ সারি তে। তাই তাদের বাস সবার শেষে বের হবে।

ফাল্গুনী এবং জাগ্রত নিরবে বসে আছে তাদের সিটে। বাসে উঠার পর দুজনের মধ্যে কথা তো দূর দৃষ্টি ও বিনিময় হয়নি। দুজন দু’দিকে ফিরে বসে আছে। তবে জাগ্রত এবার জানালার পাশে বসে নি। সে আগে থেকেই সামনের সিটে এসে বসেছিলো। ফাল্গুনী বাসে উঠলে সে দাঁড়িয়ে গিয়ে ফাল্গুনীকে ভেতরে বসার সুযোগ করে দিয়েছে। তবুও মুখে কোন কথা বলে নি। ফাল্গুনীও নিশ্চিন্তে আছে জাগ্রতকে নিশ্চুপ দেখে।

হটাৎ তড়িঘড়ি করে সোহাগ এসে দাঁড়ালো ফাল্গুনীর জানালার কাছে। সোহাগ কে এমন সময় দেখতে পেয়ে ফাল্গুনী ভীষণ চমকে উঠে। জাগ্রত অতি মাত্রায় আশ্চর্য হয় সোহাগকে এভাবে শেষ মুহুর্তে এখানে দেখে। বুঝতে পারে এ ছেলে সহজে পিছু ছাড়বে না। সোহাগ হুড়মুড় করে বলে উঠে,

‘ফাল্গুনী! ঝটপট ব্যাগ নিয়ে নেমে পরো তো। আমার দুই সিট সামনে একটি সিট খালি আছে। আমার পাশে বসা আংকেল কে বলে ওখানে পাঠিয়ে দেবো। তুমি বাকি পথ আমার সাথে করেই যেতে পারবে। জলদি করো গাড়ি গুলো বেড়িয়ে যেতে শুরু করবে এখন।’

‘আরে আপনি পাগল হয়ে গেছেন সোহাগ? বাস ছেড়ে দেবে এখন। আপনি নিজের বাসে গিয়ে বসুন যান। নয়তো বাস মিস করবেন। আর টিকিট ছাড়া এভাবে হুট করে অন্য বাসে যাওয়া যায় নাকি?’

‘তোমাকে এসব ভাবতে বলেছে কেউ? তুমি শুধু চলে এসো বাকিটা আমার দায়িত্ব। তুমি এই রাতে অচেনা একজন বাইরের পরপুরুষ এর সাথে বসে জার্নি করছো আমার সেটা একটুও ভালো লাগছে না ফাল্গুনী। আমার সাথে থাকলে তোমার সেইফটি নিয়ে অন্তত নিশ্চিন্ত হবো।’

সোহাগ তার শেষ কথাটা ধীর আওয়াজে বললেও জাগ্রতর তা শুনতে অসুবিধা হয় নি। ‘অচেনা বাইরের পুরুষ’ কথাটা বেশ গায়ে লাগলো জাগ্রতর। হাত মুষ্টিবদ্ধ হয়ে গেলো স্বয়ংক্রিয় ভাবে। অঙ্গের প্রতিটি শিরায় শিরায় আঘাত হানলো এ তিনটি শব্দ। মনে আশা জাগল ফাল্গুনী হয়তো তার দুঃসহ কন্ঠের কড়া শব্দের ধ্বনি তুলে বলে উঠবে, ‘উনি মোটেও আমার অপরিচিত কেউ নয়। আর না বাইরের কেউ। আপনি চলে যান সোহাগ। আমি এখানে যথেষ্ট কমফোর্টেবল এবং সেইফ ফিল করছি। এখানে আর এক মুহূর্ত দাঁড়াবেন না।’

কিন্তু জাগ্রতর আকাঙ্ক্ষায় মাটি চাপা পরলো। ফাল্গুনী তেমন কিছুই বললো না। শুধু সোহাগ কে অনুরোধ করলো,

‘দেখুন আমার সাথে আমার কোন ব্যাগ নেই। ওগুলো বক্সে রাখা আছে। এখন রিসিট দেখিয়ে তারপর বক্স থেকে ওগুলো বের করার মতো এতো সময় নেই। বাস এক্ষুনি ছেড়ে দেবে।’

এর মধ্যেই ফেরিতে সারিবদ্ধ যানবাহনগুলো সব একে একে স্টার্ট দিয়ে দেয়। প্রথম লাইন থেকে শুরু করে বেরিয়ে যেতে থাকে একেকটা গাড়ি।

‘ওইতো গাড়ি স্টার্ট দিয়ে দিয়েছে। আপনি প্লিজ নিজের বাসে গিয়ে বসুন। নয়তো বাস মিস করবেন। এতো রাতে এমন বিপদ ডেকে আনবেন না। আপনার কাছে হাত জোর করে রিকোয়েস্ট করছি আমি প্লিজ।’

সোহাগ মন খারাপ করে দৌড়ে চলে যায় নিজের বাসে। বড্ড সম্মানে লেগেছে তার। মনে মনে পণ করলো ফিরে যাওয়ার পর কোন কথা বলবে না ফাল্গুনীর সাথে। মেয়েটা চাইলেই চলে আসতে পারতো। কিন্তু ইচ্ছে করেই এলো না। তারপর ভাবলো, পাশে বসা লোকটা কি ফাল্গুনীর চেনা কেউ? হাবভাবে তেমনই মনে হচ্ছিলো। তখন ফাল্গুনীর সাথে কথা বলার সময় কেমন করে এগিয়ে আসছিলো তাদের দিকে। দৃষ্টি স্বাভাবিক ছিলো না। কিছু একটা ছিলো যেনো সেই দৃষ্টিতে।

এদিকে ফাল্গুনী ভেতর থেকে বড্ড ভয়ে আড়ষ্ট হয়ে আছে। জাগ্রত কিছু করবে বা বলবে সেই ভয়ে ভেতরটা খেয়ে যাচ্ছে। না জানি কি প্রতিক্রিয়া দেখাবে মানুষটা। ভেতরের বিচ্ছিন্ন অবস্থা বাহ্যিক আচরণে স্পষ্ট রূপ না দেওয়ার অসীম প্রয়াস করে যাচ্ছে। তাই জানালার দিকে সম্পূর্ণ ফিরে বসে আছে আর ভাবছে হাজারও ভাবনা।

‘অচেনা বাইরের পরপুরুষ’ কথাটা তারও মনের গহীনে ঝড় তুলেছে। সেই চার বছর আগের পুরোনো ঝর। পুরোনো ক্ষত তাজা হয়ে অসহ্য যন্ত্রণা হতে শুরু করেছে। বারবার নিজেই নিজেকে বোঝাচ্ছে তাদের সম্পর্কটা তো শুরু হবার আগেই শেষ হয়ে গেছিলো। এখন আর একে অপরের উপর কোন অধিকার নেই। তাই সে কি বলবে বা কি করবে সেই ভয় পাওয়ার ও নিমিত্ত কোন কারণ নেই। তবু বুকের ভেতর যেনো কালবৈশাখী ঝড়ের কোন থামাথামি নেই। মহাতান্ডব এ লুটিয়ে পড়ছে বুকের পাঁজর। পরমুহূর্তেই আবার মনকে জিজ্ঞেস করছে, আচ্ছা মানুষ টা এভাবে চুপ করে কেনো ছিলো? এখনও চুপ করে আছে। এতোকিছুর পরেও যে কিছুই বললো না তার কি একটুও খারাপ লাগেনি কথাটা শুনে। সে প্রতিবাদ কেনো করলো না।

ফাল্গুনীর অশান্ত মনে ক্ষনে ক্ষনে পাল্টাচ্ছে নিজের ইচ্ছে, আকাঙ্খা, অনুভূতি। জাগ্রত কখন কি বলে ওঠে সেই ভয়ে ভেতর থেকে গুটিয়ে আছে, আবার চুপ করে কেনো আছে তা নিয়েও কষ্ট পাচ্ছে। নিজেই নিজেকে চিনে ওঠতে পারছে না আর না বুঝতে পারছে মন কি চায়। হতে পারে বুঝেও তা মেনে নিচ্ছে না। নয়তো এতো কিসের দোমনা, কেনো এতো সংশয় !

‘ছেলেটা কে?’

দীর্ঘ নিরবতার পর আচমকা জাগ্রতর প্রশ্নে ধক করে ওঠলো ফাল্গুনীর বুকের পাঁজর। তীব্র আন্দোলন শুরু হলো হৃদয়ের হৃৎস্পন্দনে। শুকনো ঢোক গিলে গলা ভেজানোর প্রয়াস করলো, কিন্তু হলো না। পাশ থেকে জলের বোতল তুলে নিয়ে ঢকঢক করে গিলে নিলো কয়েক ঢোক ঠান্ডা জল। ঘাড় ঘুড়িয়ে চাইলো জাগ্রতর দিকে। চোখে চোখ পড়লো না। তবে জাগ্রত কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে। যেনো শত সহস্র অভিযোগ দায়ের করা আছে এই দৃষ্টিতে।

ফাল্গুনী চোখ নামিয়ে নিয়ে জবাব দিলো,

‘ওনার নাম সোহাগ। বরিশালে আমি যে বাসায় থাকি সেই বাসাটা ওনার মামার। সে থেকেই পরিচয়।’

‘ছেলেটা তোমায় ভালোবাসে তাই না?’

ফাল্গুনীর ভেতরটা দুমড়ে মুচড়ে উঠলো। কি জবাব দেবে সে। চোখ ভিজে আসতে চাইলো অকারণ আবেগের ঢলে। এতোক্ষণের এতো লুকোচুরি, এতো রাগ, এতো ভয় সব হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে যেনো দুজনের। আবেগ এবার পেয়ে বসেছে দুজনকে। জরিয়ে নিয়েছে আবেগের নরম চাদরে। তাইতো এতো শান্ত হয়ে আছে জাগ্রত, আর ফাল্গুনীও আবেগ অনূভুতি নিয়ন্ত্রণ না করতে পেরে চোখ ভিজিয়ে বসে আছে। তবে কেউ কারো মনে উঁকি দিতে রাজি নয়। যার যার নিজের মনগড়া যুক্তি আর সূত্র ধরে বসে আছে তারা।

‘কি হলো জবাব দিচ্ছ না যে? তার মানে কথাটা সত্যি?’

ফাল্গুনী আটকে আসা গলায় ধীর আওয়াজে বললো,

‘সামনে তার বিয়ে। বাড়ি থেকে মেয়ে দেখা হচ্ছে তার জন্য। খুব শীগ্রই বিয়ের ডেট ফাইনাল করা হবে।’

‘এটা আমার প্রশ্নের উত্তর নয়। আগে কিন্তু এভাবে কথা ঘুরাতে না। এক সাময়িক প্রসঙ্গও নিয়েও মনমতো করে ইতি না টানা পর্যন্ত থামার নামই নিতে না। এতো বদলের কারণ-ও কি স…’

‘আমি ভালোবাসিনা ওনাকে। আর তেমন কোন সম্পর্কও নেই ওনার সাথে। ওনার সাথে আমার সম্পর্কের সীমা বন্ধুত্ব নাগাদ, তার বেশি না।’

জাগ্রত এতোক্ষণ সিটে মাথা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে কথা বলছিলো। মাথা তুলে চোখ মেলে এবার ফাল্গুনীর দিকে তাকালো। তাচ্ছিল্য করে বলে উঠলো,

‘এটাও আমার প্রশ্নের জবাব ছিলো না।’

ফাল্গুনী বিব্রত হলো। বিহ্বলিত আঁখি জোড়া এদিক সেদিক দৌড়াতে লাগলো তার। কয়েক মূহুর্ত পর দীর্ঘ এক শ্বাস টেনে নিয়ে শান্ত হলো। চলন্ত বাসে বসে জানালার বাইরে ফেলে রেখে যাওয়া মুহুর্ত পানে তাকিয়ে রইলো কিছুসময়। অকস্মাৎ বলে উঠলো,

‘ভালোবাসা বা না বাসার উপর আজকাল কিছু নির্ভর করে না। ভালোবাসা আজকাল চাকরির আবেদনপত্রের মতো। একবার চাকরিটা পেয়ে গেলে তারপর আর সেই আবেদনপত্র কোন কাজে আসে না। যত্ন করে তুলে রাখতে হয় মনের আলমারিতে। তখন প্রয়োজন পরে মানসিক ও শারীরিক প্রদত্ত শ্রম, বুঝদার ঠান্ডা মস্তিষ্ক আর নিজের ইচ্ছা অনিচ্ছার বলি দিয়ে উর্ধ্বতন মহলকে পরিতুষ্ট করার মতো ধৈর্যশক্তি। আর হ্যা, যেকোন দোষারোপ বন্ধ মুখে মাথা পেতে নেওয়ার মতো সহ্যশক্তিও কিন্তু চাই। তাহলেই চাকরি টিকবে। নয়তো উপরমহল থেকে ইস্তফাপত্র হাতে ধরিয়ে দেওয়া হবে। অথবা নিজের ব্যার্থতা মেনে নিয়ে নিজে থেকেই পদত্যাগ করে নিতে হবে। যেমন আমাকে আপনি দিয়েছিলেন। ইস্তফাপত্র!’

~চলবে