পুনর্মিলন পর্ব-০৬

0
69

#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৬

প্রথমে তা-ও মনে হচ্ছিল তুমি আমায় দেখে চ’ম’কে’ছ, অ’স্ব’স্তি’র স্বী’কা’র হচ্ছো, হয়তো কিছুটা ভ’য় ও পেয়েছো কিন্তু না, তারপরেই আবার ধীরে ধীরে ব’দ’লে যাচ্ছো! তোমাকে আমার অ’চে’না লাগছে, ব’ড্ড অ’চে’না। চার বছরে একটা মানুষের এতোটা ব’দ’ল কি সত্যিই অ’ভা’ব’নীয় নয়?

‘আচ্ছা, আমরা দুজন মু’খো’মু’খি হওয়ার পর আপনার মুখ নিঃ’সৃ’ত প্রথম কথা যেনো কি ছিলো? মনে আছে?’

‘এটা বুঝি আমার প্রশ্নের উত্তর ছিলো?’

‘ওকে। তাহলে চুপচাপ বসে থাকুন। কারোও কোন কথা বলার প্রয়োজন নেই আর প্রশ্নোত্তরের পর্ব বাড়ানোর ও দরকার নেই। কোন একজন যাত্রী নেমে গেলে আমি নাহয় সিট ব’দ’লে নেবো।’

জাগ্রত দমে গেলো। বিরক্তি ভরা কন্ঠে নরম করে বললো,

‘আমার অতো গুছিয়ে মনে নেই। তোমার তো মনে আছে, তুমিই বলো। বলে তোমার কথা শে’ষ করো তারপর আমাকে আমার প্রশ্নের উত্তর দাও, প্লিজ।’

‘বলেছিলেন টাঙ্গাইলে নিজের বাড়ি রেখে আমি বরিশালে কেনো? নিজের বাড়িতে কি জায়গা হয়নি নাকি, বরিশালে তো আমার কোন আত্মীয় নেই তবুও সেখানে কেনো। নিজের বাড়িতে মানিয়ে থাকতে পারিনি ইত্যাদি ইত্যাদি। এরকম কিছু কথাই বলেছিলেন রাইট?’

জাগ্রত জবাব না দিয়ে অপলক চেয়ে রইলো। ফাল্গুনী উত্তরের আশায় বসে রইলো না। বলতে শুরু করলো,

একটু আগেই আবার প্রশ্ন করলেন, সে’পা’রেশ’ন এর দিন থেকে এ পর্যন্ত আমি কোথায় ছিলাম। তাই না?’

‘কি বোঝাতে চাচ্ছো?’

‘মুখোমুখি হওয়ার পর নিজেকে আমার সামনে এমন ভাবে উপস্থাপন করলেন যেনো আমার খোঁজ খবর আপনি কিছুই জানেন না। ক’স্মি’নকা’লে কখনো শোনেন ও নি আমি আমার বাড়িতে নেই। মানে টাঙ্গাইলে নেই। তারপর বেশ আ’য়ে’শ করে তু’চ্ছ’তাচ্ছি’ল্য করলেন আমায়। ছো’ট করার কোন ফাঁ’ক ফোকড় ও বাদ দেন নি। তারপর একটু আগে আবার প্রশ্ন করছেন সে’পা’রে’শন এর দিন থেকে এ পর্যন্ত আমি
কোথায় ছিলাম। বিষয়টা হা’স্য’কর না? আপনি সব জেনেও এমন ভাবে নাটক চালিয়ে গেলেন যেনো আপনি কিছুই জানেন না আমার ব্যাপারে। তা এসব না’ট’কে’র মূল উদ্দেশ্য এই তো যে আমি যেনো জানতে না পারি আপনি আমার খোঁ’জ রেখেছেন। তাহলে আপনার মেল ই’গো’তে ঠে’স লাগতো। তাই না?

জাগ্রত আবারও নি’য়’ন্ত্রণ হারালো। সব ভুলে গেলো আর রা’গে’র বসে চি’ৎ’কা’র করে বলে উঠলো,

‘হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তোমার খোঁ’জ নিয়েছি, তোমায় মনে করেছি, তোমাকে এক পলক দেখার আশায় বারবার ছু’টে গেছি ওই বাড়ি কিন্তু কোন খোঁ’জ পাইনি। কেউ বলেনি তুমি কোথায়। তারপর একবছর বাদে যখন সে’পা’রে’শন এর…’

‘কেউ খোঁ’জ দেয়নি মানে! বুঝলাম না ব্যাপার টা। কোথায় খোঁজ করেছেন আর কে খোঁজ দেয় নি?’

‘কোথায় আবার নেবো? যেখানে তোমরা থাকতে সেখানে নিয়েছি। তোমার জেঠুমনির বাড়িতেও খোঁজ করেছি।অনেক খোঁ’জ নেওয়ার চেষ্টা করেছি তোমাদের, পাই নি। শুধু এটুকু জানতে পেরেছিলাম তোমরা কেউ ও ভাড়া বাসায় আর থাকো না। বাড়িওয়ালাও এর থেকে বেশি কিছু বলেনি। কোথায় আছো তা জানতে পারি নি। পু’লি’শের সাহায্য নেওয়ার মতো কোন সুযোগ ছিলোনা। তাহলে অনেক কিছুর জের নিয়ে টানাটানি হতো। এমনিতেও কোর্টের ও নির্দেশ ছিলো এক বছর নাগাদ কেউ কারো লাইফে ইন্টার ফেয়ার করতে পারবো না। তুমি ভরণ পোষণ নিতেও অ’স্বী’কার করেছিলে তাই তোমার সাথে যোগাযোগ ও ছিলো না। তোমার ফ্যামিলিরও কোন খোঁজ ছিলো না। শেষে নি’রুপা’য় হয়ে ছেড়ে দিয়েছিলাম সব আশা। তারপর দিন যাচ্ছিলো আর তোমায় নিয়ে অ’ভি’যোগ এর পাল্লা ভারী হচ্ছিলো। ক্ষো’ভের পাল্লা বেড়েই যাচ্ছিলো। ভাবতাম তোমায় সামনে পেলে সবার আগে দু গা’লে দু চ’ড় বসাবো। খুব অ’প’মা’ন করবো, ঘৃ’ণা করবো, সবার সামনে ছো’ট করবো, কাঁদাব, আর আর আর…আ……..

কথা বলতে বলতেই জাগ্রত চিৎকার করে উঠলো। চিৎকার করে মাথা চেপে ধরে বললো,

‘তুমি আমার জীবনের সবচেয়ে বড় ভু’ল ছিলে সবচেয়ে বড় ভু’ল। আমাকে নিঃ’শে’ষ করে দিয়েছো তুমি। নিঃ’শে’ষ করে দিয়েছো। তুমি কখনোই সু’খি হতে পারবে না, কখনোই না। কোনোদিনও না। তোমাকে মে’রে ফেলতে ইচ্ছে করে আমার আর তারপর নেজেকে।’

বাসের সকল যাত্রীর মনোযোগ এখন জাগ্রত আর ফাল্গুনীর দিকে। তবে এখন আর কেউ বিরক্ত হচ্ছে না। বেশিরভাগই মজা লুটছে আর নিজেদের মধ্যে স’মা’লো’চ’না’র ঝ’ড় তুলছে। কিছু মানুষ উৎ’সুক নয়নে দেখে যাচ্ছে শুধু, কোন প্রতি’ক্রিয়া ছাড়া। আর কয়েকজন ব্যা’থি’ত হচ্ছে একটি সম্পর্কের বি’চ্ছি’ন্নতার নজির দেখে। আফসোস করছে একটি সম্পর্কের ভাঙন দেখে। ক’ন্ট্রা’ক্টর ও সামনে আসেনি। একটু দূরে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে সব। আর মাঝে মাঝে বাস চালককে গিয়ে এদিকের খবর দিচ্ছে। এরই মধ্যে বাস থেমে গেলো। মির্জাপুর এসে পৌঁছিয়েছে বাস। দুজন যাত্রী নেমে গেলো সেখানে। ভোর হতেও দেরি নেই। আলো ফুটতে শুরু করে দিয়েছে অল্প অল্প করে। কিছুক্ষণের পরেই দেখা মিলবে হলদে বামনের। অ’জ’স্র আলো আর অল্প তে’জ নিয়ে পদার্পণ করবে পৃথিবীর বুকে। তারপর ধীরে ধীরে নিজেকে মেলে ধরবে প্রকৃতির সোনামাখা অঙ্গে। দূর হবে সমস্ত কালো অন্ধকার।

‘উঠে দাঁড়ান।’

জাগ্রত দু’হাতে চুল খামচে ঝুঁ’কে বসেছিলো। এর মধ্যেই কানে আসে ফাল্গুনীর নরম কন্ঠ। কন্ঠ শুনে মনেই হচ্ছে না এতোক্ষণ কিছু হচ্ছিল তাঁদের মধ্যে। জাগ্রত মাথা তুলে অ’গ্নি’চূর্ণ দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো ফাল্গুনীর চোখে। তবে ফাল্গুনীর দৃষ্টি এদিক সেদিক করে হ্যান্ড পার্স গোছাতে ব্য’স্ত। একবারও নয়ন জোড়া তুলে দেখেনি জাগ্রত আর তার দৃষ্টিকে। কেনো দেখেনি তা শুধু সেই জানে। নিম্নমুখি হয়েই জাগ্রতকে কথা ছুড়ে দিয়েছে সে।

পার্স ব্যাগটি হাতে নিয়ে চল’ন্ত বাসেই উঠে দাঁড়ালো ফাল্গুনী। জাগ্রতকে আবারও বললো উঠে দাঁড়াতে। জাগ্রত বুঝে গিয়েছে ফাল্গুনী তার কোন কথার উত্তর দেবে না। এড়িয়ে যাবে প্রতিটা কথা। কিন্তু তার পেটের কথা ক’লা-কৌ’শল করে ঠিকই বে’র করে নিয়েছে।

ফাল্গুনীর চোখে চোখ রেখে জাগ্রত বললো,

‘বসে পড়ো। কেননা গন্তব্যে পৌছানোর আগ পর্যন্ত আমি তোমার সাথ ছাড়ছি না।’

‘সাথ তো চার বছর আগেই ছে’ড়ে’ছেন। এখন আবার নতুন করে না’ট’ক কেনো করছেন?’

‘এক হাতে কখনো তালি বাজে না। যাই হোক, আমি উঠছি না আর না তোমাকে যেতে দিচ্ছি। চুপচাপ বসে পড়ো আর আমার প্রত্যেকটা প্র’শ্নে’র উত্তর দাও।’

ফাল্গুনী বেশ কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইলো জাগ্রতের দিকে। হয়তো ভেবে নিলো কিছু আর ছ’ক ক’ষে করে নিলো কোন প’রি’ক’ল্প’না। তারপর বসে গেলো নিজের সিটে। জাগ্রতকে বললো,

‘আমি যদি নিজে থেকে কিছু না বলি তাহলে আপনার সা’ধ্যি নেই আমায় দিয়ে কিছু বলানোর। সেটা নিশ্চয়ই বুঝতে পারছেন?’

জাগ্রত শুধু চেয়ে রইলো আর এক দী’র্ঘ’শ্বা’স টেনে নিলো। কোন জবাব দিলো না। ফাল্গুনী বললো,

‘আপনার সমস্ত প্র’শ্ন’গু’লো যদি সাজিয়ে একের পর এক মানে একবারে বলে ফেলতে পারেন তাহলে তার উত্তর আমি দেবো। অন্যথায় নয়। আর হ্যাঁ কোন প্র’শ্ন বা’কি রয়ে গেলে বা ভু’লে গেলে সেটা পরে রিপিট করতে পারবেন না। বলুন রাজি?’

ফাল্গুনীর এমন যু’ক্তি’হী’ন কথার পৃষ্ঠে প্রত্যুত্তর করলো না জাগ্রত। যেকোন শ’র্তে’ই সে রাজি। তাই এক চু’ল ও সময় ন’ষ্ট করলো না প্রশ্নের বহর সাজাতে। তৎ’ক্ষ’না’ৎ বলে উঠলো,

‘সে’পা’রে’শন এর পর থেকে এ পর্যন্ত কোথায় কোথায় ছিলে? কার সাথে ছিলে? হটাৎ করে সে’পা’রে’শ’ন এর দিন পুরো পরিবার মিলে গা’য়ে’ব কেনো হয়েছিলে? আর আমার পরে তোমার জীবনে কি কোন পু’রু’ষ এসেছে? এসে থাকলে সে কি সোহাগ? সোহাগ তোমাকে ভালোবাসে? তুমি কি সোহাগ কে ভালোবাসো?’

শেষ প্রশ্নে অ’জ’স্র দী’র্ঘ’শ্বা’স আর বুক ফাঁ’টা আ’র্ত’না’দ এর তী’ব্র গ’ন্ধ যেনো ভেসে ভেসে বেড়াচ্ছে। যে গ’ন্ধে খেই হারালো ফাল্গুনী। তবুও সংযত করলো নিজেকে। বেশ মনেযোগ দিয়ে জাগ্রতর সমস্ত কথা শুনলো। তারপর বললো,

‘আপনি তাহলে এটুকুই জানেন! আর এটুকুই আপনার অভিযোগ?’

‘এটুকুই জানেন মানে কি? হ্যাঁ! কি হলো উত্তর দাও। আচ্ছা, এতোগুলো প্রশ্ন হয়তো ভুলে গেছো। থাক আমি মনে করিয়ে দিচ্ছি।’

‘তার দরকার নেই, আমি সহজে কিছু ভুলি না। চারবছর আগের অতীতই এখনো ভুলতে পারলাম না। সদ্য শ্র’ব’ণ করা প্রশ্নগুলো কি করে ভুলি?’

‘তাহলে বলো।’

‘এক্ষুনি যে বলতে হবে এমন তো কোন কথা ছিলোনা। বলবো বলেছি তবে তা কবে বা কখন বলবো তা তো বলিনি। বলেছি কি?’

জাগ্রত ক্রো’ধে গ’র্জ’ন করে বললো, ‘তাহলে বলতে কেনো বললে?’

ফাল্গুনীর সোজাসাপ্টা জবাব, ‘জেনে নিলাম আপনি ঠিক কতোটা জানেন আর কতোটা জানতে চান।’

জাগ্রত ক্রু’দ্ধ হলো। ক্রো’ধে তার গাঁ যেনো ঈ’ষ’ৎ কাঁ’প’ছে। কঠিন ধাঁ’চে ঝট করে উঠে পরলো সিট থেকে আর এক সিট সামনে খালি হওয়া সিট টায় গিয়ে বসে পড়লো ধপ করে। ফাল্গুনী স্ব’স্তি’র শ্বা’স নিলো। সিটে মাথা এলিয়ে দিয়ে বু’কে হাত দিলো হৃ’ৎ’স্প’ন্দ’নে’র হিসেব
নিকেশ করতে। হিসেবে বড্ড গ’র’মি’ল লাগছে। যেনো হৃ’দ’য় থেকে কেউ ধুকপুক করা কম্পন য’ন্ত্র চু’রি করে নিয়েছে। তাই হৃদয়ের ক’ম্প’ন’কৃ’ত হিসেবে এতো গ’র’মিল। হটাৎ অনুভব হলো পাশের সিটে কেউ এসে বসেছে। ফাল্গুনী চোখ না খুলেই বলে উঠলো,

‘ফিরেই যখন আসবেন তাহলে গেলেন কেনো?’

‘আপনি কি সারাজীবন থেকে যেতে বলছেন?’

ফাল্গুনী ত’ড়ি’ৎ বেগে চোখ মেললো। গলাটা তো অ’চে’না। পাশে দৃষ্টি ফেললে দেখতে পায় জাগ্রত নয় বসে আছে অ’চে’না একটি ছেলে। চোখ ঘোরালে আবার চো’খে পড়ে জাগ্রত সামনের সিট থেকে সিটের উপর দিয়ে মাথা উঁ’চু করে চে’য়ে আছে হ’ত’বা’ক হয়ে। অচেনা পুরুষ কন্ঠে বুঝি আ’ন্দো’ল’ন শুরু হলো তার বুকে!

~চলবে