পুনর্মিলন পর্ব-০৭

0
63

#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৭

ফাল্গুনী তড়িৎ বেগে চোখ মেললো। পাশে জাগ্রত নয় বসে আছে অ’চে’না একটি ছেলে। চোখ ফেরালে আবার চোখে পড়ে জাগ্রত সামনের সিট থেকে সিটের উপর দিয়ে মাথা উঁচু করে চেয়ে আছে হ’ত’বা’ক হয়ে। দুদিকের পরিস্থিতি বুঝে ফাল্গুনী মাথায় হাত চেপে নিজেই নিজেকে বলে উঠলো, ‘বি পজেটিভ ফাল্গুনী! বি পজেটিভ।’

‘আমারও!’

অচেনা ছেলেটির মুখে ‘আমারও’ শব্দটি শুনে প্রশ্নবিদ্ধ দৃষ্টিতে তাকালো ফাল্গুনী। জিজ্ঞেস করলো, ‘মানে?’
ছেলেটি মিষ্টি হেসে জবাব দিলো, ‘ব্লাড গ্রুপ। আমারও বি পজেটিভ।’
‘আমাকে কি আপনার রক্তশুন্যতার রুগী বলে মনে হচ্ছে?’
‘কই নাতো…।
‘তাহলে ব্লা’ড গ্রু’পের প্রচার করতে এসেছেন যে।’
‘হা হা হা। প্র’চা’র করতে আসিনি পরিচিত হতে এসেছি। এতোক্ষণ তো স্কোপই পাচ্ছিলাম না। আর কিছুসময় পর তো আপনি নেমে যাবেন। তাই সিট খালি হতে দেখে চলে এলাম।’
‘আপনি চেনেন আমায়?’
‘না আপনাকে চিনি না তবে আপনাদের দুজনের মাঝে এই দুরত্বটাকে আমি চিনি।’
‘দুরত্ব চেনা যায় না, অনুভব করা যায়।’
‘হ্যাঁ, ভালো বলেছেন। আমি অতো গুছিয়ে বলতে পারি না। যাইহোক….’
ছেলেটাকে কথা শেষ করতে না দিয়ে ফাল্গুনী চট করে বলে উঠলো,
‘আপনার সিট কোথায়?’
‘আপনার সিট এর এক সিট পিছনে।’
‘সেখানে গিয়ে বসুন। আমি অচেনা কারো সাথে সিট শেয়ার করে এভাবে কথা বলতে কমফোর্টেবল নই।’
‘যদি কিছু মনে না করেন একটা কথা বলতে চাই।’
‘বলুন।’
‘আপনাদের পিছনে বসার দরুন প্রথম থেকে শুরু করে এতোক্ষণ অবদি আপনাদের দুজনের সমস্ত কথাই আমি শুনেছি। আপনাদের সম্পর্কের অতীত ও বর্তমান নিয়ে আমার ছোটখাটো একটা ধারণা হয়ে গেছে। আমার মনে হয়েছে আপনারা এখনো ভালোবাসেন দুজন দুজনকে। আলাদা কেনো হয়েছেন জানি না। আলাদা হওয়ার অযুহাত খুজলে মাইলের পর মাইল লম্বা লিস্ট খুঁজে পাওয়া যায়। কিন্তু ভলোবেসে একসঙ্গে থাকার জন্য একটি অযুহাত ও-ই যথেষ্ট। সেই একটি অযুহাত খুঁজে নেবেন। পৃথিবীর সবথেকে সুখী ব্যক্তি মনে হবে নিজেকে। আমিও সেই পথেরই পথিক। অযুহাত খুজতে ও খুঁজে দিতে নেমে পড়েছি ভাঙ্গনের রাজপথে। আপনাদের মাঝে আমার মতোই আরেক অধমের ছিটেফোঁটা নজরে এলো, তাই আগ বাড়িয়ে কথা বলতে এলাম। আর প্রথম কথাটা মজা করে বলেছিলাম মাফ করবেন। ভালো থাকবেন। আসছি।’

ফাল্গুনী ভাবলেশহীন। যেনো প্রাণহীন কোন কাঠের পুতুল। বসে আছে শক্ত হয়ে। জাগ্রত প্রথমে ছেলেটার কথা শুনে সিট ছেড়ে দাড়িয়ে পড়ে ক্ষুদ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকলেও পরের কথাগুলো শুনে বসে পড়েছে সিটে। চুপচাপ বসে শুনে গেছে কথাগুলো। আর তারপর অতীত হাতড়ে খোঁ’জ শুরু করেছে সেই একটি অ’জু’হা’তের। যা নিয়ে থাকা যেতো একসাথে। ছিলো তো তেমন হাজারও অজুহাত, ছিলো অনুভূতির বহর। কিন্তু বুঝতে বড্ড দেরি হয়ে গেছিলো কিনা। তাই ধরে রাখতে পারেনি তার হৃদয়হরনীকে।

ফাল্গুনী ভাবছে, ভালোবাসার পূর্ণতা শুধু একজন মানুষকে ঘিরে হয়না। পরিবারের সবাইকে নিয়ে হয়। আর যদি পরিবার সে পূর্ণতা না দিতে পারে তাহলে একমাত্র অবলম্বন থাকে নিজের স্বামী। আর সেই স্বামী যখন বিবেক বিবেচনা না করেই ঘোষণা করে দেয় ‘তুমি যোগ্য নও’, অবিশ্বাসের পর্দা টাঙানো চোখে তাকায় আর চোখে চোখে চোখ রেখে দৃষ্টি দিয়েই ঘোষণা করে দেয় ‘তুমি মিথ্যেবাদী’ তখন কোন অযুহাত ও-ই পারে না সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে। ফিকে পরে যায় সব অযুহাত। রঙচটা ঘুনে খাওয়া লাগে সম্পর্ক আর জং ধরে যায় সকল অনুভূতিতে।

বাস থেমেছে টাঙ্গাইল শহরে। বেশ কিছু যাত্রী নেমে গেছে এরইমধ্যে। সবাই যার যার কাছে থাকা রিসিট দেখিয়ে ব্যাগপত্র বের করে নিচ্ছে। জাগ্রতের তেমন বড় কোন ব্যাগ ছিলো না সাথে। তাই সে এক কোনায় দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে যাচ্ছে ফাল্গুনীকে। সে এখন নিজের ব্যাগপত্র বের করায় ব্যাস্ত। ফাল্গুনীর থেকে চোখ সরিয়ে ফোনের স্কিনে চোখ রাখলো। ছয়টা বাজে। জাগ্রত লুকিয়ে দাঁড়িয়ে আছে একটি দোকানের কোনায় গিয়ে। বাস থেকে নেমেই সিএনজিতে উঠেছিলো। তারপর ফাল্গুনীর চোখের আড়াল হতেই নেমে গেছে। ডাবল ভাড়া দিয়ে সিএনজি বসিয়ে রেখে দিয়েছে খানিক সামনেই। ফাল্গুনী কোথায় যায় এবং কার সাথে যায় তা সে দেখতে চায়। কেউ নিশ্চয়ই নিতে আসবে বা এসেছে। নাকি একা যাবে? যদি বাড়িতে যায় তাহলে অনায়াসে আবারও দেখা করা যেতে পারে। আর খোলাসাও হবে অনেক কিছু। দুরত্ব তো বেশি নয়। এক ঘন্টাও লাগে না। কিন্তু যদি অন্যকোথাও যায় তাহলে!

ফাল্গুনী ব্যাগপত্র নিয়ে সুস্থির হয়ে দাঁড়ালো। আশেপাশে চোখ বুলিয়ে দেখতে পেলো না জাগ্রতকে। সিএনজি নিয়ে চলে যেতে দেখেছে সে জাগ্রতকে। একটি অটো ভাড়া করে রওয়ানা হলো নিজ গন্তব্যে। অটো যতোটা পথ এগোতে থাকলো ফাল্গুনীর বুকটা ততোধিক ভারী হতে থাকলো। মানুষটাকে আসার সময় শেষবারও দেখা হলো না। কি নিষ্ঠুরতম অনূভুতি হচ্ছে হৃদয়পটে। যাওয়ার আগে শেষ দেখাও করে গেলো না। শুধু শুধুই তাকে দেখাতে টাঙ্গাইলে নেমে গেলো। একেবারে এলেঙ্গা গিয়ে নামলেই হতো।

জাগ্রত ফাল্গুনীকে অটোতে উঠতে দেখে অবাক হলো। হিসেব অনুযায়ী ওর তো এখন সিএনজি নিয়ে সখিপুর এর দিকে যাওয়ার কথা। উল্টোদিকে যেতে দেখে অবাকই হলো। বিস্ময়-বিহ্বল হলো অতি মাত্রায়। ফাল্গুনীদের নিজেদের বাড়ি বা যেখানে বাসা ভাড়া থাকতো তার কোনটাই তো ওদিকে নয়। কিছুদূর পিছু নেওয়ার পর দেখতে পেলো ফাল্গুনী অটো পাল্টে সিএনজি নিলো। রওয়ানা হলো এলেঙ্গার দিকে। জাগ্রতও আলাদা সিএনজি নিয়ে পিছু করলো। বেশ কিছুক্ষণ পর সিএনজি থামলো এলেঙ্গায় গিয়ে। তারপর একটি রিক্সা নিয়ে আবারও রওনা হলো কোথাও। কিছুদূর যাবার পর থেমে গেলো রিক্সাটি আর নেমে গেলো ফাল্গুনী। পা বাড়ালো পাশের টিনের দোচালা বাড়ির ভেতরে। জাগ্রতও ঢুকে গেলো বাড়ির ভেতরে। তবে দুরত্ব বজায় রাখতে গিয়ে হারিয়ে ফেললো ফাল্গুনীকে। আর কোথাও দেখতে পেলো না। অস্থির হয়ে চারিদিকে দেখতে লাগলো। হটাৎ সামনে পড়ে গেলো একজন বৃদ্ধা মহিলা। এক হাতে লাঠি ধরে আরেক হাতে কোমর চেপে দাড়িয়ে আছে চোখমুখ কুঁচকে। গায়ের চামরার থেকে মুখচোখের ওপর ভাজের প্রকাশ বেশি বলে মনে হচ্ছে জাগ্রতর। হটাৎ সেই বৃদ্ধা মহিলা লাঠি উঁচিয়ে মারার ভঙ্গিতে বললো,

‘ওই ছেমড়া! তুই এমবা কইরা চাইয়া চাইয়া কি দেহস লো? বাড়ির বিতর হানছস ক্যা? বাইর অ কইছি বাইর অ।’

‘ঠাকুমা এই মাত্র একটি মেয়ে এলোনা বাড়ির ভেতরে সেই মেয়েটি কোথায় গেলো? এইমাত্রই ভেতরে ঢুকেছে আমি দেখেছি। পড়নে সাদা কালো কামিজ ওড়না ছিলো। এখানে তো কতগুলো ঘর। একসাথে অনেকগুলো বাড়ি দেখছি। আমি বুঝতে পারছি না। আপনি কি দেখেছেন এমন কাউকে? একটু বলবেন আমায়।’

‘তুই তো পোলা সুবিধার না লো। মেয়া মাইনষের পিছা লইয়া আইছস আমগোর বাড়ি। ও হাসি বাইরে আয় বউ। দেখ তর মাইয়ার নাগর আইজ বাড়ি তোমক আইয়া পড়ছে। বাইর অ তুই বাইর অ।’

‘আপনি এসব কি বলছেন! আমি ওর স্বামী.. মানে প্রাক্তন.. মানে বুঝতেই তো পারছেন।’

‘কি কইলি লো ছেরা! তাইলে তুই সত্যিই হেই পোলা! আর তগোর বিয়াও হইয়া গেছে? হায় হায় কি সর্বনাশ হইয়া গেছে গো! ও হাসি বউ বাইর অ রে, কোতায় যাইয়া হানছস? ও সুভাষ রে তর মেয়া বেবাকটির মাতা হেট কইরা ছাড় দেয় নাই বিয়াও কইরা হালাইছে। বাইরাইয়া যাইয়া খালি এক রাইত থাইক্যা আহে নাই বিয়াও করছে বলে ন*চ্ছা*রে।’

জাগ্রত হতবাক, হতুম্বুবুদের ন্যায় উদ্দাম বেগে এক ধাক্কা খেলো। হৃদয় টা যেনো টুকুস করে খসে পড়ে গেলো পেটের কোন এক কোনায়। পেট হাতড়ে খোঁজ করা মুশকিল। খালি খালি বুক নিয়ে আশপাশ নজর চালালো। কয়েক জোড়া পা এগিয়ে আসছে এদিকেই। সবার মুখাবয়বে ভ’য়’ঙ্ক’র উ’ল্কা’র চিহ্ন যেনো জ্বলজ্বল করছে। এতোক্ষণ অবদি তাও ঠিক ছিলো কিন্তু একটু দূরে দৃষ্টি পড়তেই অন্তর আত্মা গা ছাড়া হয়ে গেলো জাগ্রতর। একজন অর্ধবয়স্ক লোক হাতে কু’ড়া’ল নিয়ে এগিয়ে আসছে এদিকেই। চোখে মুখে রমরমা অ’গ্নি’শি’খা। পড়নের কালো নিল রঙের চেক লুঙ্গির ভাঁজে আবার ছোটখাটো একখানা ছু’রি ও গোঁজা আছে।

‘হাসি কোরে? তর মেয়ারে দরজার সিকল খুইলা বাইরে আন। ওই শঙ্কর যাছে, নিয়ায় আঁখিরে। অর সামনে আইজ কুবামু এই খা****র পো**লা**রে। বাইর কর অরে।’

সুভাস চন্দ্রের হুমকিসংশ্লিষ্ট ক্ষুদ্ধ গলার জোরালো চিৎকারে কেঁপে উঠলো বাড়ির উঠোনে দাঁড়ানো প্রতিটা মানুষ। হাসি তার মুখে কাপড় চেপে ফুপিয়ে কেঁদে দিলেন নিজের স্বামীর এহেন রুপ দেখে। এর মধ্যে সুভাষ চন্দ্রের দুই ভাই শঙ্কর চন্দ্র আর উত্তম চন্দ্র দু’হাতে জাপটে ধরে আটকে ফেলেছেন সুভাষ চন্দ্রকে। একপ্রকার ধস্তাধস্তি জাবরদস্তির উপর আঁটকে রাখার চেষ্টা করছে দু ভাই। অকস্মাৎ ঘটনায় এতোক্ষণ যাবত সব নির্লিপ্ত ভঙ্গিতে দেখছিলো জাগ্রত। প্রথম দফায় ভয় খানিক পেয়েছিলো বৈকি। জব্বর খিঁচ দিয়েছিলো কুড়াল হাতে কাউকে তার চোখে দৃষ্টি বজায় রেখে এগিয়ে আসতে দেখে। তবে সবার কথোপকথোন শুনে সবার এমন মারকাটারি হাবভাব প্রদর্শনের হেতু বুঝতে সক্ষম হয়েছে জাগ্রত। সবাই অন্যকারো সঙ্গে যে তাকে গুলিয়ে ফেলেছে তা এতোক্ষণে বুঝে গেছে সে। তাই এবার মুখ খুললো জাগ্রত। ঠান্ডা হয়ে সবার উদ্দেশ্য বললো,

‘একজন আমায় অভিশাপ দিয়োছিলো, বলছিলো ধুঁকে ধুঁকে আমার আত্মা গা ছাড়া হবে। বহুত কষ্ট পাবো জীবনে। তার অভিশাপ কিন্তু আমার গায়ের লোমে লোমে লেগে আছে। বহুত কষ্ট পেয়েছি এ পর্যন্ত। এখন বাকি আছে শুধু ধুঁকে ধুঁকে আত্মা গা ছাড়া করে মরে যাওয়া। তাই আপনার ওই কু’ড়া’লে’র দু এক কো’পে আমার কিছুই হবে না। আর না ওই ল্যাড়ল্যাড়ে ছু’ড়ি দিয়ে কিছু হবে। এতো সহজে আমি মরবো না তাই ওসব রাখুন। আমাকে না জিজ্ঞেস করেই এক সেকেন্ডের মধ্যে আমায় কারো ভেগে গিয়ে বিয়ে করা জামাই বানিয়ে দিলেন। একবার নিজেদের মেয়েকে আনিয়ে নিশ্চিত তো করে নিন আমিই সেই অধম কিনা। এবার দয়া করে হাঙ্গামা বাদ দিয়ে আমাকে কেউ একজন জিজ্ঞেস করুন আমি কে, আর কেনো এসেছি। আমিও একটু সুযোগ পাই কিছু বলার। প্লিজ।’

এতোক্ষণের রমরমা অগ্নিসংযোগে জল ঢেলে দিয়েছে জাগ্রত। পরিবেশ টা হটাৎ করেই শান্ত হয়ে গেলো। কম বেশি সবার মুখাবয়বে বিরাজ করছে সন্দিগ্ধতা আর লজ্জাবোধ। এর মধ্যে আগমন হলো নতুন এক মুখের। কেউ একজন টেনে নিয়ে এলো একটি মেয়েকে। মেয়েটি যেনো প্রাণহীন কোন শুকনো লতা। মেয়েটির দৃষ্টি ও মৃত নদীর মতো খড়খড়ে। সুভাষ চন্দ্র আঁখি বলে ডেকে উঠলো মেয়েটিকে।
মেয়েটি চোখ তুলে তাকালো না। ঠাঁয় দাঁড়িয়ে রইলো। একজন মহিলা কানে কানে কিছু বললো মেয়েটিকে। তাতেও তাকালো না। কিছুক্ষণ ধ্যান ধরে দাঁড়িয়ে থেকে হটাৎ বলে উঠলো,

‘সে আসে নি কাকী। সে এলে এতোক্ষণ তোমরা কু’ড়া’ল ছু’ড়ি হাতে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে পারতে না। হাত জোর করে দাঁড়িয়ে থাকতে!’

আঁখির রুদ্ধ কন্ঠের কথা শেষ হতে না হতেই বাড়িতে পুলিশের আগমন হলো। সাথে উপস্থিত হলো নতুন এক জোড়া পা।

~চলবে