#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৮
“যদি আপনি সত্যিই পাশে থাকেন তবে আমিও থাকবো আপনার কাছে। তবে শুধু পাশে নয়, বিশ্বাস, ভরসা, সম্মান আর ভালোবাসাও চাই। পারবেন সব মিলিয়ে ভারসাম্য করে পাশে থাকতে? যদি পারেন তবে আমি শুধু কাছে নয় আপনার পাশেও থাকবো।”
জাগ্রত উঠে দাঁড়িয়ে ফাল্গুনীর সামনে হাঁটু ভেঙে বসে পড়লো। ফাল্গুনীর দু-হাত যত্ন করে তুলে নিলো নিজ হাতে বন্দী করতে। তারপর চোখে চোখ রেখে বললো,
“যদি না পারি তাহলে দূরে সরে না গিয়ে কাছে থেকে শিখিয়ে দিও। রাগ না করে অভিমান করো, দোষারোপ না করে অভিযোগ করো আর অন্যায় করলে যথাযথ শাস্তি দিও। তবু ছেড়ে যেও না। আমি বললেও না। আমি নিজেকে সঁপে দিলাম তোমার কাছে। তুমি ভালোবেসে আগলে রেখো আমায়। আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না এই কথাটা বলবো না কারণ তোমাকে ছাড়া এতোদিন যেভাবেই হোক বেঁচেই তো ছিলাম, মরে তো যাইনি আর না থেমে গেছি। তবে এ কথাটা আমি বলতে চাই। মনে প্রাণে বিশ্বাস করে তোমার চোখে চোখ রেখে বলতে চাই যে আমাকে এতোটা ভালোবাসা দিও যেনো তোমার ভালোবাসার প্রলুব্ধতায় প্রলোভিত হই, লালসায় লিপ্সুত হই তোমার ভালোবাসার লোভে, আর ক্ষুদিত হয়ে হলেও যেনো অন্তরআত্মা থেকে বলতে পারি আমি তোমাকে ছাড়া বাঁচবো না। তোমাকে সঙ্গে নিয়েই বাঁচবো আর মরবোও তোমাকে সঙ্গ দিয়েই। দেবে না এমন ভালোবাসা? দেবে না এমন লোভ?”
জাগ্রতর হাতে হাত রেখেও ফাল্গুনীর ততটা অবশ অনুভূতি হচ্ছে না যতটা অবশ উপলব্ধি আর অসাড় অনুভব হচ্ছে জাগ্রতর চোখে চোখ রেখে। আর তার কথাগুলো তো ঝটিকাবিক্ষুদ্ধ তান্ডবলীলার ঘোষণা করে দিয়েছে বুকের পাঁজরে। প্রতিটা শব্দ, প্রতিটা আকুতি মন গহীনে উথাল-পাতাল ঢেউ তুলছে শব্দহীন অনুভূতির। ফাল্গুনী চোখ সরিয়ে নিলো। পারলো না আর চোখে চোখ রাখতে। মাথা নিচু করে নিয়ে বসে রইলো নিশ্চুপ। জাগ্রতও চুপ করে রইলো। খানিকক্ষণ পর নিচ থেকে উঠে আবার বসে পড়লো ফাল্গুনীর পাশে। দুজনের নীরবতায় সময় অতিবাহিত হতে লাগলো। আশেপাশে ঝিঁঝি পোকার ডাক ছাড়া আর কোন শব্দ নেই। জাগ্রত আর ফাল্গুনী দুজনেই কিছু ভাবছে। দুজনেই ভাবুক দেশের দার্শনিক হয়ে আছে রাতের নিস্তব্ধতার কোল জুড়ে। ভাবনার সুতো কেটে ফাল্গুনী মুখ খুললো। ঘার ফিরিয়ে জাগ্রতর পানে চেয়ে মৃদু নরম কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো,
“আপনি কি অতীত নিয়ে আমায় আর কিছু বলতে চান? যা আমি জানি না বা যা আমায় বলেন নি কিন্তু বলা উচিত, এমন কিছু।”
জাগ্রত আনমনা ছিলো। মশগুল ছিলো অতীত এর কিছু খন্ড স্মৃতি অন্বেষণে। ঠিক সেই সময় ফাল্গুনীর মুখে অতীত নিয়ে প্রশ্ন শুনে চমকে উঠলো। ক্ষনিকের জন্য তার মনে হলো, এতোক্ষণ মনে মনে ভাবা অতীত নিয়ে করা স্বীকারোক্তি যেনো সে অন্তরে নয় মুখে মুখেই করে ফেলেছে। জাগ্রত মনে কিঞ্চিৎ ভয় পেলো। উঁহু! কিঞ্চিৎ নয় ঢের ভয় পেলো। জাগ্রতর ভীতচিত্তে উষ্ণতা এনে দিলো ফাল্গুনীর বলা কথা। ফাল্গুনী আবারও বললো,
“সেই কখন থেকে চুপ করে বসে আছেন। প্রশ্ন করছি জবাব দিচ্ছেন না যে? বলুন, আছে কিছু বলার?”
জাগ্রতর বুকে ওঠানামা করা হৃদযন্ত্রটা শান্ত হলো। বুঝতে পারলো সে মুখে কিছু বলে ফেলেনি। যা ছিলো মনেই ছিলো।
মনে মনে বললো, যা মনে ছিলো তা মনেই থাক। মুখে এনে তোমাকে হারাতে পারবো না। তোমার এই প্রশ্নের প্রকৃত উত্তর টা যদি আমি দেই তবে তুমি ভুলই বুঝবে আমায়। বিশ্বাস করার মতো কাজ কোনদিন করলে তো বিশ্বাস করবে। এতো সাধনার পর এক টুকরো আশার আলো পেয়ে তা এক স্বীকারোক্তিতে হারাতে চাই না। সারাজীবন না হয় নিজের অন্তরআত্মার কাছে অপরাধী হয়ে রবো কিন্তু তোমার কাছে অপরাধী হয়ে হারাতে পারবো না তোমায়। গত একবছর…. একবছর থাক, সব মিলিয়ে পুরো চার বছরে এমন কোন একটা দিন নেই যেদিন অনুভব করি নি তোমায়। কল্পনায় চুমু এঁকেছি তোমার কপালে, মনে মনে ভালোবাসি বলেছি রোজ। কিন্তু আর না। তোমাকে আমার কাছে আর পাশে দুইয়েতেই চাই। মনে তো আগেও ছিলে এখনও আছো আর ভবিষ্যতেও থাকবে এবার তোমাকে সবেতেই চাই। আমার করে ফাগুন, আমার করে। হোক শুরুটা লুকোচুরি দিয়ে। তবুও তোমাকে হারাতে রাজি নই।
“কথা বলতে ইচ্ছে না হলে আমি যাচ্ছি। আমার এতো ঠেকা পড়ে রয় নি আপনার সাথে যেচে পড়ে জোর করে কথা বলার।”
জাগ্রতর কাছে আশানুরূপ প্রতিক্রিয়া আর স্পষ্ট জবাব না পেয়ে অভিমানী কন্ঠে অভিযোগ করে উঠে দাঁড়ালো ফাল্গুনী। জাগ্রত নিজের ভীতিকে দূরে সরিয়ে ফাল্গুনীতে মন দিলো। ফাল্গুনীর অভিমানী কন্ঠের অভিযোগ শুনে এক রাশ মুগ্ধতায় বুঁদ হয়ে বললো,
“আমার নিরবতায় তুমি যদি অভিমান করে এমন মিষ্টি করে অভিযোগ করো তবে সারাজীবন এর জন্য আমি নিরব থেকে যাবো। সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করবো তিনি যেনো আমায় বাকশক্তিহীন করে দেয়। তবে হয়তো রোজ তোমার থেকে ঝুড়ি ঝুড়ি অভিমানের অভিযোগে অভিযুক্ত হবো। রাগে তোপে দোষারোপ তো অনেক হলো এবার না হয় অন্য কিছু হোক। আমি তোমার সমস্ত অভিমান, অভিযোগের একমাত্র অভিযুক্ত হতে চাই। তোমার একান্ত প্রেমিক রূপে।”
______________________
সেধে সেধে নিজের নরম আলো ছড়াচ্ছে সকালের সূর্য। প্রকৃতি বেশ চনমনে। ঝকঝকে-তকতকে পরিবেশ। জানালা চিরে মধ্যতেজের আলো প্রবেশ করছে নিজমনে। সেই আলোয় আলোকিত হয়ে ঝলমল করছে আঁখির গোলগাল মিষ্টি মুখটা। নিসান মেঝেতে বসে বিছানায় হেলান দিয়ে আঁখির দিকে চেয়ে আছে অনিমেষ। গতকাল ঢাকায় পৌঁছিয়ে বড় বোনের বাসায় উঠেছিলো। যেতে যেতে রাত হয়ে যাবে ভেবে আর রওয়ানা করে নি বরিশালের উদ্দেশ্যে। গতকাল বোনের বাসায় আসার পর রাত দুটো পর্যন্ত ছাঁদে আড্ডা চলেছে সবাই মিলে। দুটোর পর দুজনে ঘরে এসে দেখে পুরো ঘর ফুল দিয়ে ঢেকে রেখে দিয়েছে কেউ আড্ডার ফাঁকে। চারিদিকে শুধু ফুল আর ফুল। নিসান অনুমান করে নিয়েছিলো কাজ টা কার। কিন্তু এসবে লাভ কি! সে তো আঁখির সাথে কথাই বলছে না। আঁখি বেচারি পুরো ঘরে ফুল দেখে লজ্জা পেলেও নিজেকে যথাসম্ভব স্বাভাবিক রেখে নিসান এর সাথে কথা বলার চেষ্টা করে গেছে৷ কিন্তু নিসান কোন কথা বলে নি। শুধু চুপ করে শুনে গেছে আঁখির কথা যেনো ঘরে শুধু সে একাই আছে। আঁখি কথা বলতে বলতে একসময় বিছানার এক কোনে ঘুমিয়ে পড়েছে। আঁখির পর নিসান ও ঘুমিয়ে পড়েছিলো মেঝেতে আধশোয়া হয়েই। সকালে ঘুম ভাঙলে চোখের সামনে আঁখির মিষ্টি মুখের মিষ্টি আদোল দেখে নিসান এক মুহুর্তের জন্য থমকে যায়। তারপর থেকে একভাবে দেখে যাচ্ছে আঁখিকে। এ দেখার শেষ নেই। যেন অনন্তকাল ধরে দেখে গেলেও মিটবে না এ চোখের তৃষ্ণা।
নিসান দেখতে দেখতে এক সময় মাথাটা একটু সামনে বাড়িয়ে আঁখির খুব কাছে গিয়ে থামলো। আঁখির শ্বাস টেনে নেয়ার শব্দটাও যেনো কোন এক শ্রুতিমধুর সুরের মতো লাগলো নিসান এর কাছে। ধীরে ধীরে আঁখির সারা মুখে চোখ বুলালো। ঠোঁটে এসে থেমে গেলো নিসান এর মুগ্ধ দৃষ্টি। কিন্তু তৎক্ষনাৎ চোখ সরিয়ে নিলো। আটকে রাখলো না নিজেকে ওখানে। নিসান চায় সে তার প্রিয়তমাকে প্রথম চুমু দেবে প্রিয়তমার সজ্ঞানে। সারাজীবন যেনো দুজনের মনে গেঁথে থাকে সেই প্রথম চুমুর বুক কাঁপানো অনুভূতি। কোন এক মন খারাপের বিকেলে যেনো এক চিলতে লজ্জামাখা হাসি ফুটে উঠে আঁখির ঠোঁট জোড়ায় নিসানের থেকে পাওয়া প্রথম স্পর্শকে মনে মনে অনুভব করে।
নিসান তার দৃষ্টি এবার এনে রাখলো আঁখির ভ্রুতে। দুই ভ্রুয়ের মাঝখানে নাক ছুঁয়িয়ে দিলো আলতো করে। তারপর ঠোঁট ছোঁয়াতে গিয়ে থেমে গেলো। দোমনা হলো কেমন যেনো। কিছুক্ষণ থেমে থেকে ঠোঁট জোড়া বসিয়েই দিলো কপালের মাঝ বরাবর। নিজেকে বললো, “এই অনুভূতিটা একান্ত আমার থাক। তোমাকে না-হয় আরও কোন গভীর অনুভূতির সঙ্গী করে নেবো অন্যকোন দিন।”
বেশ কিছুক্ষণ পর আঁখিকে একটু নড়েচড়ে উঠতে দেখে নিসান চোখ বন্ধ করে কনুই এর আড়ালে চোখ ঢেকে রেখে আধশোয়া হয়ে রইলো। নিসান দেখতে চায় আঁখি কি করে। নিসান এর মুখ দেখে প্রথম সকাল আজ আঁখির জীবনে। সে সকালটায় আঁখি প্রতিক্রিয়া অনুভব করতে চায় নিসান। আঁখি কি নিসান এর চুলগুলো এলোমেলো করে দেবে? নাকি চুল সরিয়ে কপালের মাঝখানটায় আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াবে? নাকি অন্যকিছু? আখি কি করবে সেই শত ভাবনায় এক বুক আশা নিয়ে মুখিয়ে রইলো নিসান।
আঁখি চোখ খুলে প্রথমেই দেখতে পেলো একটা পুরুষালী হাত তার সামনে। প্রথমে চমকে উঠলো। তারপর মাথা তুলে নিসান কে দেখে নিজেকে শান্ত করলো একটু মুচকি হেসে। কয়েক সেকেন্ড সময় নিয়ে বুক ভরে তৃপ্তির শ্বাস টেনে নিয়ে আবার শুয়ে পড়লো নিসানের মাথা বরাবর। নিসানের মুখ দেখতে পাচ্ছে না আঁখি। শুধু মাঝারি আকারের ঝরঝরে চুলগুলো দেখতে পাচ্ছে। হালকা রোদে চিকচিক করছে চুলগুলো। আঁখি কিছুক্ষণ চেয়ে রইলো নিসান এর দিকে তারপর হুট করেই হেসে উঠলো শব্দহীন। তারপর পাতলা ঠোঁট জোড়ায় হাসি ধরে রেখে এক ভাবেই চেয়ে রইলো নিসান এর দিকে।
নিসান কনুইয়ের আড়াল থেকে দেখতে পাচ্ছে আঁখির মুখভরা হাসি। অন্য সময় আঁখির মুখে এমন ঝলমলে রোদ্দুরের মতো হাসি দেখে হয়তো তৃপ্ত বুকে মুগ্ধ চোখে চেয়ে থাকতো কিন্তু এই মুহূর্তে আঁখির মুখের হাসিটা মোটেও সহ্য হলো না নিসান এর। হাসারও তো একটা সঠিক সময় আছে। এমন একটা পরিস্থিতিতে মেয়েটার কি হাসি ছাড়া আর কিছুই পেলো না! নিসান ধপ করে উঠে দাঁড়িয়ে বেরিয়ে গেলো রুম থেকে। আঁখি বেকুব বনে চেয়ে রইলো শুধু। বুঝে উঠলো না কেউ কি করে এমন ধুপধাপ ঘুম থেকে উঠ ঝুপঝাপ চলে যায় রুমের বাইরে।
____________________
রোদের তেজ বাড়ছে নিজ গতিতে। যেনো গরমে সিদ্ধ হয়ে যাওয়ার যোগাড়। রোদের তেজ গায়ে মেখে জাগ্রত আর ফাল্গুনী বসে আছে রিক্সায়। সারারাত দুজনে একসাথে বসে মশার কামড় খেয়ে পার করেছে। কেউ ঘুমোতে যায় নি। তারপর ভোর পাঁচটায় সবাইকে বিদায় জানিয়ে রওয়ানা করেছে গাজীপুরের উদ্দেশ্যে।
ফাল্গুনী নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করছে যথাসম্ভব। মনে তার কেমন একটা করছে। ফাল্গুনী বুঝতে পারছে না এটা ভয় নাকি অন্যকিছু। আর জাগ্রত বসে আছে উত্তেজনা আর উৎফুল্লতা নিয়ে। ঠোঁট থেকে যেনো হাসি সরছেই না। জাগ্রত চেয়েও পারছে না একদম স্বাভাবিক হয়ে বসে থাকতে। ফাল্গুনী তার সাথে তার নীড়ে যাচ্ছে তারই সঙ্গী হয়ে কথাটা মনে করতেই মুখে এক চিলতে হাসি এসে যাচ্ছে। এখন থেকে সবসময় তার খুব কাছেই থাকবে মেয়েটা। কিভাবে দিন শুরু হবে, কিভাবে রাত শুরু হবে, ফাল্গুনী নিজ হাতে তাকে রেঁধে বেরে খাওয়াবে, মাঝেমধ্যে খাইয়িয়েও দেবে এমন হাজারও চিন্তায় ডুবে ডুবে মুচকি হাসি ধরে আছে জাগ্রত নিজ ঠোঁটে। এর মাঝেই ফাল্গুনীর গলা পেয়ে ঘাড় ফিরিয়ে হাসি মুখে পাশে তাকালো। ফাল্গুনী বললো,
“আপনি তো বলেছিলেন দশ মিনিটও লাগবে না বাসায় পৌঁছাতে। অথচ রিক্সায় উঠেছি পনেরো বিশ মিনিট হতে চললো। আর কত দূর?”
ফাল্গুনীর কথা শুনে জাগ্রতর মাথায় বাজ পরার মতো অবস্থা। আশেপাশে চেয়ে দেখে বাসা থেকে দশ মিনিটের দুরত্বে এসে গেছে। রিক্সাওয়ালাকে শুধু এলাকার নাম বলে উঠেছিলো কিন্তু বাসার যথাযথ অবস্থান বলে নি তাই রিক্সাওয়ালাও মনের সুখে প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে এগিয়ে যাচ্ছে এলাকার শেষ মাথায়। আর জাগ্রত! সে তো মশগুল ছিলো নিজের কল্পনার জগতে। জাগ্রত ফাল্গুনীর দিকে আঁড়চোখে চেয়ে দেখে রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা ঘোরাতে বললো। যথাযথ ঠিকানা বলে আরেক দিকে মুখ করে রইলো মুখ চোখ খিল মেরে রেখে। লজ্জা করছে একটু একটু। ফাল্গুনীর সাথে প্রথম দিনেই এমন হতে হলো! ফাল্গুনী বুঝতে পারলো তারা বাসা থেকে দূরে এসে গেছে। বুঝেও কোন প্রশ্ন করলো না। এক ভাবে বসে রইলো।
~চলবে
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_১৯
জাগ্রত ফাল্গুনীর দিকে আঁড়চোখে চেয়ে দেখে রিক্সাওয়ালাকে রিক্সা ঘোরাতে বললো। যথাযথ ঠিকানা বলে আরেক দিকে মুখ করে রইলো মুখ-চোখে খিল মেরে। লজ্জা করছে একটু একটু। ফাল্গুনীর সাথে প্রথম দিনেই এমন হতে হলো! ফাল্গুনী বুঝতে পারলো তারা বাসা থেকে দূরে এসে গেছে। বুঝেও কোন প্রশ্ন করলো না। এক ভাবে বসে রইলো।
কয়েক মিনিট অতিক্রম হলো নিরবতায়। রিক্সা এসে থেমে গেলো একটি তিনতলা বাড়ির সামনে। রিক্সা থামতেই আগে আগে নেমে গেলো জাগ্রত। ভাড়া মিটিয়ে ব্যাগ হাতে নিয়ে ফাল্গুনীকে ইশারা করলো ভেতরে এগিয়ে যেতে। ফাল্গুনী নিশ্চুপ এগিয়ে গেলো সাদাসিধা ঘরানার বিল্ডিংয়ের ভেতর দিকে। সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠে দোতলায় গিয়ে থেমে গেলো জাগ্রত। তালা খুলে ভেতরে প্রবেশ করলো ফাল্গুনীকে নিয়ে। তবে ভেতরে প্রবেশ করার সময় ফাল্গুনীর হাতটা টুপ করে বন্দী করে নিয়েছে নিজ হাতের মুঠোয়। ফাল্গুনী তেমন কোন প্রতিক্রিয়া দেখায়নি তাতে।
জাগ্রতর বাসাটায় একটি এটাচ বাথরুম সহ একটি বেডরুম, একটি ডায়নিং রুম ও ছোটখাটো একটি কিচেন রুম দেখতে পেলো ফাল্গুনী। জাগ্রত ফাল্গুনীর হাতে ধরে নিয়েই সবটা ঘুরিয়ে দেখালো আর বললো সামনে মাসে বড় একটা বাসায় উঠবে দুজন। এতোদিন তো একা একা ছিলো তাই ছোট বাসা নিয়ে থেকেছে। এখন আর এ বাসায় চলবে না দুজনের। জাগ্রত ফাল্গুনীকে ভেতরে গিয়ে কাপড় বদলে ফ্রেশ হতে বলে নিজে গিয়ে ঢুকলো রান্নাঘরে। ঝটপট নুডলস বসিয়ে দিলো চুলায়। সকালের নাস্তা হিসেবে ডিম দিয়ে নুডলস খুব একটা খারাপ হবে না।
জাগ্রতর নুডলস হতে হতে ফাল্গুনী হাত মুখ ধুয়ে মায়ের সাথে কথা বলে নিলো তারপর চলে এলো রান্না ঘরে। ফাল্গুনীকে টেবিলে বসতে বলে দু বাটি ভরে নুডলস বেরে নিয়ে জাগ্রত বসে পড়লো এক পাশে চেয়ার টেনে। জাগ্রতর বসতে দেরি হলেও নুডলস মুখে পুরতে দেরি হয় নি। এদিকে ফাল্গুনী চামচ হাতে বাটির দিকে চোখ রেখে তাকিয়ে আছে অলস অভিব্যক্তি নিয়ে। জাগ্রত চতুর্থ বারের মতো নুডলস মুখে পুরে ফাল্গুনীর দিকে চেয়ে দেখে সে এখনো একটুও মুখে তুলেনি।
“কি হলো খাচ্ছো না যে? নুডলস পছন্দ নয়? আমি কি অন্যকিছু করে দেবো? আসলে অফিসের টাইম হয়ে আসছে তো তাই ঝটপট এটাই করে ফেলেছি। তোমাকে জিজ্ঞেস করা….”
“আমি খেয়ে নিচ্ছি। আমার কোন সমস্যা নেই। আপনি খেয়েদেয়ে অফিসের জন্য তৈরি হয়ে নিন। আর আজকের পর কোনদিন রান্নাঘরে ঢুকবেন না। কোনদিনও না।”
জাগ্রত মুখ ভর্তি নুডলস নিয়ে চোখ বড়সড় করে তাকিয়ে রইলো নিচের দিকে। বুঝতে পারলো না এটুকু সময়ে কি করে ফেললো সে। জাগ্রত জিজ্ঞেস করবে করে ফাল্গুনীর দিকে তাকাতেই দেখে সে এক হাতে বাটির নুডলস চেপে ধরে আরেক হাতে বাটি নিয়ে কাত করে ধরে রেখেছে। বাটি থেকে তেলের ধারা বইছে ঝর্ণার জলের মতো। জাগ্রত এই আকর্ষণীয় দৃশ্য অবলোকন করে জিভ কামড়ে ফটাফট খাওয়া শেষ করে চলে গেলো রুমে।
ফাল্গুনী খাওয়া শেষে রুমে এসে দেখে জাগ্রত ফরমাল ড্রেসে বসে আছে বিছানায়। ফাল্গুনীকে দেখে জাগ্রত বসতে বললো তার পাশে। ফাল্গুনী বিনা বাক্যে দের হাত দুরত্ব নিয়ে বসে পড়লো এক পাশে।
“আপনি এখনো বসে আছেন যে, অফিসের জন্য বের হবেন না?”
“বেরুনোর জন্য পনেরো বিশ মিনিট হাতে আছে এখনো।”
“কিছু বলবেন?”
“তোমার ফোন নাম্বার টা! মানে কখন কি প্রয়োজন পড়ে, তুমি তো একা থাকবে বাসায় তাই আরকি…”
“নাম্বারটা তুলুন।”
“থ্যাংকস।”
“আর কিছু?”
“আমি দুপুরে ক্যান্টিনে খেয়ে নেবো আর তোমার খাবার টা কাওকে দিয়ে পাঠিয়ে দেবো। আজ তো বাজার করার সময় নেই তাই আজকের মতো ম্যানেজ করে নাও। কাল সকাল সকাল বাজার তুলে আনবো না-হয়। মানে বাজার করে আনবো না-হয়।”
“আর?”
“আর?”
“হুম।”
“একটা আবদার ছিলো। বলবো?”
‘বলতে তো আর দোষ নেই। বলে ফেলুন।”
“আমি একটু.. মানে রোজ..মানে অফিস যাওয়ার আগে তোমার কপালে যদি….”
মানে মানে করে জাগ্রতর কথা আর শেষ হলো না। ফোনের রিংটোন বেজে উঠলো পুরো উদ্যমে। আর জাগ্রতও চুপ করে গেলো তৎক্ষনাৎ।
ফাল্গুনী এক ধ্যানে বসে মনোযোগ দিয়ে জাগ্রতর কথা শুনছিলো। তার অবচেতন মন বুঝতে পারছিলো পাশে বসা মানুষটার মানে মানে করে চাওয়া আবদারের তাৎপর্য। তখনই ফোনের রিংটোন শুনে ঘোর ভাঙলো অচিরেই। ফোন হাতে নিয়ে নাম না দেখেই তড়িঘড়ি করে রিসিভ করে কানে তুলে নিলো মুখ ছোট করে। ওপাশ থেকে ভেসে এলো পুরুষালি গলার উৎকন্ঠিত ডাক,
“ফাল্গুনী।”
সোহাগের গলা শুনে একটু দমে গেলো ফাল্গুনী। জাগ্রতর পাশে বসে কথা বলতে অস্বস্তিবোধ করলো। ফোনটা কেটে দিতে আরও বেশি বাধবাধ অনুভূতি হলো। জাগ্রত তো প্রথম দিনেই সোহাগ কে অপছন্দ করেছিলো, আজ তার সামনে কথা বললে যদি কিছু মনে করে এই ভাবনায় দ্বিধা দ্বন্দ্ব নিয়ে উত্তর দিলো ফাল্গুনী।
“হ্যাঁ। কেমন আছেন বলুন।”
“ভালো আর থাকতে দিলে কোথায়। গতকাল সকালে তোমায় ফোন দিলাম কেটে দিয়ে মেসেজ করে বললে পরে কথা বলবে। বিকেলে ফোন দিলাম রিসিভ করলে না আর রাতে তো ফোন অফ করেই রেখে দিয়েছিলে। আমার তো তোমার উপর রেগে থাকার কথা ছিলো আর উল্টো তুমিই কিনা আমার উপর রাগ করে কথা বলা বন্ধ করে রেখেছো!”
“আমি আপনার উপর রাগ কেনো করবো? আপনি ভুল বুঝছেন, আসলে একটু ব্যস্ত ছিলাম আঁখিকে নিয়ে। বুঝতেই তো পারছেন বিষয়টা কতোটা সেন্সিটিভ।”
“আচ্ছা বাদ দাও এসব। মাসিমার সাথে ভালো করে কথা হয়েছে? আর তুমি ফিরবে কবে? আমি কিন্তু বলে রাখছি তুমি অবশ্যই অবশ্যই আমার সাথেই ফিরবে। কোন না আমি শুনবো না। শুধু সময়টা বলে দিও বান্দা হাজির হয়ে যাবে।”
“আমি এখন বরিশালে ফিরবো না সোহাগ। আপনি নিজের সময় সুযোগ বুঝে চলে যান।”
জাগ্রতর গুরুত্বপূর্ণ কথার মাঝে ফাল্গুনীর ফোন চলে আসায় এমনিতেই একটু বেজার হয়ে গেছিলো তার মনটা, তারওপর আবার এতোখনের বার্তালাপের পর সোহাগের নামটা শুনে মস্তিষ্কে চট করে জ্যাম বেঁধে গেলো। বাসের পুরো ঘটনা মনে মনে উলটপালট হতে লাগলো। সোহাগের নাম শোনার পর বসে থেকে একটুও সময় নষ্ট করলো না, উঠে গিয়ে ফাল্গুনীর সামনে দাঁড়িয়ে দুজনের ফোনালাপের মাঝেই বলে উঠলো,
“ফাগুন! আজ থেকে রোজ আমি অফিস যাওয়ার আগে তোমার কপালে চুমু এঁকে যাবো। এই সময়টা আজ থেকে শুধুই আমার। তাই কোন আলতু-ফালতু কাজে আমার সময়টা একদম নষ্ট করবে না। আর তোমার হাতে যত কাজই থাক না কেনো এই সময়টা শুধু আমার জন্য তুলে রাখবে।”
জাগ্রত ফাল্গুনীর চোখে চোখ আবদ্ধ করে কথা শেষ করলো। ফাল্গুনীর মাথার দুপাশে হাত রেখে কপাল বরাবর ঠোঁটও ছোঁয়ালো আলতো করে। তারপর সরে আসতে গিয়েও আবার কাছে গেলো খানিক। ফাল্গুনীর যে কানে ফোন চেপে ধরা সেই কানের পাশে শব্দ করে চুমু খেলো টুপ করে। তারপর জাগ্রতকে আর পায় কে! রমরমা পায়ে হেঁটে “আসছি” বলে বেড়িয়ে গেলো অফিসের উদ্দেশ্যে। এদিকে ফাল্গুনী এখনও ফোন ধরে আছে কানে। ওদিক থেকে এদিকের চুমুর শব্দ পেয়ে যে ফোন ভেঙে বসে আছে কেউ তা টের পেলো না সে। জাগ্রতর ছোঁয়ায় দুনিয়া হারা হয়ে যেখানে ফোন ভাঙাই টের পায়নি সেখানে হৃদয় ভাঙার শব্দ কি আর শুনবে? ফাল্গুনী চোখ বন্ধ করে ফোন কানে নিয়েই বসে রইলো। অনুভব করতে লাগলো হৃদয়ের হিসেব ছাড়া ধুকপুকুনি। অনুভব করলো হৃদয়ের কম্পন। আবিষ্কার করলো নিজেকে নতুনভাবে।
__________________
আঁখি সবার সাথে বসে আছে ড্রয়িংরুমে। সবাই থাকলেও নিসান এখানে অনুপস্থিত। সেই কখন থেকে দেখতে পাচ্ছে না সে নিসানকে! আকুল হয়ে আছে নিসানকে একটু দেখার জন্য, একটু কথা বলার জন্য। সকালে সেই যে উঠে বেড়িয়ে গেলো ঘর থেকে তারপর আর দেখাই পেলো না। কাল থেকে আঁখির খুব ইচ্ছে করছে নিসানের বুকে পড়ে কান্না করতে। কান্নায় কান্নায় ভাসিয়ে দিতে ইচ্ছে করছে নিসানের সমস্ত অভিমান, অভিযোগ। কিন্তু কথাই তো বলছে না মানুষটা। তার কি একটুও কষ্ট হচ্ছে না এমন মুখ ফিরিয়ে থাকতে? বুকটা ফাঁকা ফাঁকা লাগছে না তার প্রিয়তমাকে বুকে টেনে নিতে না পেরে? এতো নিষ্ঠুর কি করে হতে পারছে মানুষটা?
হাজারোও আক্ষেপ, অভিযোগ আর অভিমানে স্থান, কাল ভুলে অবচেতন মনে নিজের অজান্তেই কেঁদে ফেললো আঁখি। চোখের অশ্রু বিসর্জন দিলো দানা দানা মুক্তোর মতো। চোখের জল মুছতে গিয়ে ঘোর ভাঙলো আঁখির। মনে পড়লো চারপাশে বসে আছে সবাই। মাথা নিচু করে ভেজা গাল আর ভেজা চোখ মুছে নিলো তৎক্ষনাৎ। মুছতে না মুছতেই আবারও চোখোর কোল ভিজে উঠলো একইভাবে। অথচ কান্নার না আছে কোন শব্দ আর না আছে কোন ফুঁপিয়ে উঠার গা ঝাঁকানি।
ড্রয়িংরুমে বসে ছিলো নিসান এর দিদি দোলা তার স্বামী, দেওর, ননদকে নিয়ে। আঁখি তাদের গল্পের নিরব দর্শক হয়ে বসেছিলো। হটাৎ করে আঁখিকে মাথা নিচু করে চোখ মুছতে দেখে দোলা আর তার ননদ সিমি আঁখিকে জিজ্ঞেস করতে লাগলো কি হয়েছে কাঁদছে কেনো। আঁখি সবার কাছে ধরা পরে আরও একটু কেঁদে উঠলো। গা ঝাঁকিয়ে ফুপাতে ফুপাতে মাথা নেড়ে বুঝালো তার কিছুই হয়নি। দোলা এদিকে তার দেবর সৌম্য-কে পাঠালো ওর রুমে নিসানকে ডেকে পাঠাতে। সকালের নাস্তা শেষে সৌম্যের রুমে গিয়ে শুয়ে আছে সে। সৌম্য নিসানকে ডেকে নিয়ে এলে সে এসে দেখে আঁখি নিরব হয়ে বসে আছে কিন্তু চোখের পাপড়ি আর গাল দুটো ভেজা। মাঝে মাঝে আবার গায়ে ঝাঁকুনিও দিচ্ছে। নিসান তার জামাইবাবুর পাশে গিয়ে আরাম করে বসে দোলা কে বললো,
“ওকে জিজ্ঞেস করতো ওর বাড়ির জন্য মন খারাপ করছে কি না। তাহলে দিয়ে আসি ওকে এলেঙ্গা। তাও কান্নাকাটি দেখতে পারবো না।”
এলেঙ্গা দিয়ে আসার কথা শুনে আঁখির গা ঝাঁকুনি থেমে গেলো তৎক্ষনাৎ। দু’হাতে ফটাফট মুছে নিলো পুরো মুখ। দোলাকে বললো,
“আমি কোথাও যাবো না দিভাই। আমি আর কাঁদবো না।”
দোলা আঁখির হাত ধরে বসে এতোক্ষণ দুজনের মধ্যেকার বিষয়টা বুঝতে চেষ্টা করছিলো। কাল থেকেই তার মনে হচ্ছিলো নিসান আর আঁখির মাঝে ঠিকঠাক চলছে না সব। যাকে বিয়ে করার জন্য পুরো পরিবারের সাথে লড়ে গেলো তাকে পাওয়ার পর কেনো এমন অবহেলা করছে তা বুঝে উঠতে পারলো না দোলা।
সমস্ত সংকোচশূন্য হয়ে নিসানকে জিজ্ঞেস করলো কেনো সে এমন করছে। ঠিকঠাক কথা বলা তো দূর যেখানে আঁখির উপস্থিতি থাকছে সেখানে পা ও রাখছে না সে। দোলার বর নিরব ও জানতে চাইলো নিসান এর এমন ব্যাবহারের কারণ। নিসান সবার প্রশ্ন চুপচাপ শুনে কাটখোট্টা জবাব দিলো,
“তোদের প্রশ্নের উত্তর আঁখি নিজেই ভালো দিতে পারবে। জিজ্ঞেস কর ও কি করেছে। আর হ্যা, ও যদি ঠিকঠাক বলতে পারে যে ওর এতোগুলো ভুলের মধ্যে কোন ভুলের জন্য আমি রেগে আছি তাহলে আমি আর রেগে থাকবো না। ভুলে যাবো সব। এই আমি বসলাম। এবার ওকে ওর নিজের মুখ দিয়েই বলতে বল গত একমাস আগে থেকে বিয়ে পর্যন্ত ও কি কি করেছে।একমাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ ব্যাখ্যা করতে বল। একটু কিছুও যেনো বাদ না যায়।”
আঁখি অশ্রু ভেজা চোখের পাতা তুলে চাইলো নিসান এর দিকে। চোখে চোখ পড়ে যাওয়ায় আবার নামিয়ে নিলো দৃষ্টি। ড্রয়িংরুমের সবার নজর এখন আঁখির দিকেই। আঁখি আমতা আমতা করে বললো,
“আমার দিকে সবাই এভাবে তাকিয়ে থাকলে আমি কথা বলতে পারি না।”
~চলবে