#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩৩
জাগ্রতর অফিস ছুটি হয়েছে বেশ কিছুক্ষণ হলো। কিন্তু বাড়ি ফেরার নাম নেই তার, আর না আছে তাড়া। হাতে আধপোড়া জ্বলন্ত সিগারেট। কিছুক্ষণ পর পর তা ঠোঁটে চেপে ধরছে। মাঝে মাঝে আবার কিছু একটা মনে করে চোখমুখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলছে। যেন কত-শত দুঃখ জেঁকে ধরছে আষ্টেপৃষ্ঠে। মুখাবয়ব দেখে বোঝার উপায় নেই চেহারার অভিব্যক্তির কি নাম। দুঃখ? নাকি লজ্জা? নাকি আফসোস? অভিব্যক্তি অস্পষ্ট হলেও অভিব্যক্তির কারণ একেবারে স্পষ্ট। আজকের সকালটাই হলো আস্ত একটা কারণ।
জাগ্রতর রোদে পোড়া সকাল টা আজ শুরু হয়েছে ফাল্গুনীর মাথাভর্তি ভেঁজা চুলের গা হিম করা জলের ঝাপটানিতে। আচমকা চোখে মুখে জলের ছিটে পড়ায় চোখ মুখ কুঁচকে ছিটকে উঠছিল ইঞ্চি কয়েক। চোখ খুলতেই আরও একটা ঝটকানি খেয়েছিল মুহুর্তেই। সবুজ হলুদ মিশেলের চকচকে রোদ্দুর মাখানো শাড়ী গায়ে জরিয়ে দাঁড়িয়েছিল ফাল্গুনী। চোখে মুখে বিন্দু বিন্দু জলের ফোঁটা; ঠিক যেনো সদ্য মাথা তোলা কচি সবুজ ঘাসের উপর শিশির বিন্দু দানা বেঁধে বসেছিল হালকা রোদ্দুরে। আবার নড়েচড়ে ভেজা চুলগুলো আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে এপাশ ওপাশ করে দলা পাকিয়ে মুছে নিচ্ছিল নরম হাতে।
জাগ্রত ঘুম ঘুম আবেশে আলগোছে বালিশ কোলে তুলে আরাম করে উঠে বসেছিল। আড়মোড়া ভেঙে সদ্য ঘুম ভাঙা গলায় ফাল্গুনীকে বলেছিল,
“ফাগুন! মধ্যরাতে বউয়ের ঘুম ভাঙিয়ে বউকে আদর করলে যে সকাল বেলায় এমন আদর আদর ফিলিংস পাওয়া যায় জানা ছিল না। ফিলিংস টা কিন্তু জোশ। সকাল সকাল বউয়ের স্নান, শাড়ীর ফাঁক গলিয়ে উঁকি দেওয়া কোমর অব্দি ভেজা চুলের রাজত্ব, চোখেমুখে বিন্দু বিন্দু জলের ছিটে, তারওপর আবার বউয়ের এমন আদুরে মুখখানা। আহা! কি সকাল! তা রাতে না আমরা একসাথে স্নান করলাম, এখন আবার এতো সকালে কেন স্নান করলে?”
ফাল্গুনী এমন চেহারা বানিয়ে তাকিয়েছিল জাগ্রতর দিকে যে বেচারা ভাবনায় পরে গেছিল ঘুমের ঘোরে কোন গালি টালি দেয় নি তো! ফাল্গুনী পাক্কা দশ সেকেন্ড সময় নিয়ে তাকিয়ে ছিল জাগ্রতর পানে। আর জাগ্রত সেই সময় টুকুন কাজে লাগিয়ে চিন্তাভাবনার রেল ছুটিয়েছে। কি বলল? কেন বলল? কাকে বলল?
সেকেন্ড দশেক বাদে দুজনেই একসাথে জিভে কামড় দেয়। ফাল্গুনী দৌড় লাগায় রান্নাঘরে আর জাগ্রত দৌড় লাগায় বাথরুমে। ফাল্গুনী দু’হাতে চোখ ঢেকে লজ্জা থেকে পালাবে নাকি কান চেপে কথা শোনা থেকে বাঁচবে সেই চিন্তায় দিশেহারা। আর জাগ্রত ওয়াশরুমে গিয়ে মুখ লুকোবে কোথায় সেই চিন্তায় প্রায় জ্ঞানহারা। পারে না তো কমোডের ভেতর গিয়ে লুকিয়ে পড়ে। তাতেও যেন রেহাই নেই এ লজ্জা থেকে।
জাগ্রত পাক্কা এক ঘন্টা পর বেরিয়েছে ওয়াশরুম থেকে। এই এক ঘন্টা শুধু নিজেকে কথাই শুনিয়েছে বেচারা। হরেক রকমের উপদেশ দিয়েছে নিজেই নিজেকে। যেমন, “স্বপ্ন হোক বা বাস্তব, বউকে আদর করে আর কখনো ঢোল পিটাবি না জাগ্রত। অফিসের বসের কাছ থেকে লম্বা লম্বা ঝারি খেয়ে সে ঝারি হজম করতে পারিস আর সামান্য একটা স্বপ্ন হজম করতে পারিস না? তাও আবার বউকে নিয়ে দেখা স্বপ্ন! এটাও লিক করতে হয়? কথা পেটে রাখতে শেখ জাগ্রত, কথা হজম করতে শেখ। না না, সরি। স্বপ্ন পেটে রাখতে শেখ জাগ্রত। স্বপ্ন হজম করতে শেখ।”
ওয়াশরুম থেকে বেরিয়ে কোনমতে তৈরি হয়ে রওয়ানা করেছিল অফিসের উদ্দেশ্যে। খাবার টেবিলে আর নজর বোলায়নি।
হাতের সিগারেট শেষ হতেই উঠে দাঁড়াল জাগ্রত। কতক্ষণ আর বসে থাকা যায়। বাসায় তো ফিরতেই হবে। এরইমধ্যে ফোনে কল রিংটোন বেজে উঠলো। বিলাসি দেবী কল করেছেন। জাগ্রত ফোন রিসিভ করতেই বিলাসি দেবী বললেন,
“তোমাদের কি স/ম/স্যা বলো তো? ফাল্গুনীকে সারাদিন ধরে কল করে যাচ্ছি ও রিসিভ-ই করছে না। তোমাকে দুপুরে একবার কল করলাম রিসিভ করলে না। তোমরা কি আবার ঝগ/ড়া/ঝাঁ/টি করছো জাগ্রত? নিশ্চয়ই ঝ/গ/ড়াই করেছো দুজনে। তাইতো আমার ফোন তুলছো না কেউ।”
জাগ্রত হতভম্ব হয়ে গেল শ্বাশুড়ী মায়ের কথায়। নম্র গলায় বলল,
“মা কি বলছেন? ঝগড়া কেন করব? ফাল্গুনী আমার হারিয়ে ফিরে পাওয়া সুখ। ওর যত্ন আমি ওর জন্য না হোক নিজের সুখের স্বার্থে হলেও করব। আর দুপুরে আমার ফোন সাইলেন্ট ছিল তাই টের পাইনি আমি। কিন্তু ফাল্গুনী কেন ফোন তুলছে না তা তো জানি না। সারাদিন কথা হয়নি। আমি বাসায় গিয়ে দেখছি। আপনি চিন্তা করবেন না।”
“তোমার অফিস তো ছুটি হয়েছে আরও অনেক আগেই জাগ্রত। তুমি এখনও বাসায় যাও নি। আবার বলছো সারাদিন দুজনের কথা হয়নি। সত্যি করে বলতো জাগ্রত, দুজনের মাঝে সব ঠিক আছে তো?”
“মায়েদের কাজ-ই হচ্ছে চিন্তা করা। আর স্বভাবও। তাই আপনার চিন্তা করা নিয়ে কিছুই বলছি না মা। আমি না হয় সরাসরি ফাল্গুনীর সাথে কথা বলিয়ে দিচ্ছি আপনাকে। আপনি একটু অপেক্ষা করুন। আমি বাসায় গিয়ে আপনাকে ফোন করছি।”
জাগ্রত পা চালিয়ে বাসার উদ্দেশ্যে রওয়ানা করল। ফাল্গুনীর কথা মনে মনে ভেবে হাসলো মনভরে। ইশ! মেয়েটা কি লজ্জাই না পেয়েছে। সারাদিন তাকে ফোন তো দেয় নি আবার মায়ের ফোন-ও রিসিভ করেনি। নিশ্চয় ফোন একদিকে আর সে আরেক দিকে বসে আছে সারাদিন। ওমন লড়াকু সৈনিকের মতো ঝগড়ুটে মেয়েটাও বুঝি এতো লজ্জা পায়! ফাল্গুনীর কথা বাদ যাক, সে কি করেছে? সে নিজেও তো লজ্জায় সারাদিন কল করেনি ফাল্গুনীকে।
জাগ্রত যতোটা দুরন্ত গতিতে বাসার সামন অব্দি এসে পৌঁছাল ততোটাই ধীর হয়ে গেল বাসায় ঢোকার আগে। যেন পা চলবেই না আর। তার মধ্যে আবার বৃষ্টিও শুরু হয়ে গেল। জাগ্রত গলা পরিষ্কার করে নিল বার কয়েক কাশি দিয়ে। তারপর নক করল দরজায়। কিন্তু আশ্চর্যজনক ভাবে নক করতেই খুলে গেল দরজা। জাগ্রত বুঝল দরজা আলগোছে চাপানো ছিল মাত্র। ভেতর থেকে লক করা ছিল না তাই হাত ছোঁয়াতেই খুলে গেছে। দরজাটা পুরো খুলে ফেলল; ঢুকল ভেতরে। দরজা চাপিয়ে দিয়ে ফাল্গুনীর নাম ধরে ডাক দিল দু’বার। কিন্তু ফাল্গুনীর কোন সাড়াশব্দ পেল না। জাগ্রতর মনে খচখচ করতে লাগল। চোখে পড়লো ডায়নিং টেবিল এর একটা চেয়ার কাত হয়ে পরে আছে। জাগ্রত সন্দেহ নিয়ে জুতো না খুলেই পা বাড়াল বেডরুমের দিকে। কিন্তু সেখানেও দেখা মিলল না। জাগ্রতর বুকের ভেতর যেন খামচে ধরল ফাল্গুনীর অনুপস্থিতি। বাথরুম, রান্নাঘর একে একে চোখ বুলালো সবখানে। কিন্তু কোথাও নেই ফাল্গুনী।
জাগ্রত এবার ত্রস্ত পা দু’খানা নিয়ে বাইরে এলো এক দৌড়ে। কোথায় খুঁজবে, কাকে জিজ্ঞেস করবে সব যেন গুলিয়ে গেল মস্তিষ্কে। বিল্ডিংয়ের কারও সাথেই তেমন কথাবার্তা হয়নি কখনো, পরিচয়-ই নেই চেনা তো দূরের কথা। বাইরে আবার বৃষ্টিও হচ্ছে। বুকের ভেতর চিনচিনে ব্যথা নিয়ে পাশের ফ্ল্যাটে নক করতে গিয়েও করল না। কিছু একটা ভেবে দৌড় লাগাল ছাঁদের দিকে। সিঁড়ি ভেঙে ছাঁদের মেঝেতে পা রেখে চোখ বুলালো পুরো ছাঁদে। নজরে এলো এক নারী অবয়ব। ভয়ঙ্করদর্শন করল যেন জাগ্রতর দুনয়ন। খোলা ছাঁদে পা রাখতেই বৃষ্টির বিন্দু বিন্দু বরফ মুক্ত দানাগুলো যেমন জাগ্রতর গা শীতল করে দিল, ঠিক তেমন-ই ফাল্গুনীকে দেখতে পেয়ে শিরদাঁড়া বেয়ে উদাসীন অনুষ্ণ এক ঠান্ডা স্রোত বয়ে গেল। সে স্রোতের গন্তব্য স্টেশনবিহীন। জাগ্রত যেমন গতিতে ছাঁদের সিঁড়ি ভেঙে উঠে এসেছে তেমন গতিতেই ছুটলো ফাল্গুনীর কাছে। পেছন থেকে জরিয়ে ধরলো আষ্টেপৃষ্ঠে।
ফাল্গুনী আপনমনে দাঁড়িয়ে ছিল ছাঁদের এক কোনায়। দুহাতে রেলিং খামচে ধরে মুখ উঁচিয়ে রেখেছিল আকাশপানে। যেন সঁপে দিয়েছে নিজেকে বৃষ্টির কাছে। আচমকা নিজের শরীর জুড়ে কারও স্পর্শ অনুভব করে ছিটকে দুহাত দূরে সরে গেল। সামন ঘুরতেই চোখে পড়লো জাগ্রতকে। চেনা আপন মুখটা দেখে শান্ত হলো মন। জাগ্রতর হৃদয়েও জল এসেছে এতোক্ষণে। ভীতি কাটিয়ে উঠেছে, চেহারার আদোল-ও বদলে গেছে। ফাল্গুনী কিছু জিজ্ঞেস করবে করে মুখ খুলতেই জাগ্রত ধমকে উঠলো। গলার আওয়াজ যেন মেঘের গর্জনকে-ও অনায়াসে টেক্কা দিয়ে দেবে। এক নাগাড়ে বিরতিহীনভাবে বলতে লাগল,
“এক চড়ে পুরো বত্রিশটা দাঁত খুলে ফেলব ইডিয়ট। বাসার দরজা খুলে রেখে ছাঁদে এসে ভূতের মত দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এখানে কি করছো? সিনেমার শুটিং চলছে এখানে? সন্ধ্যা পার হয়েছে কখন! চারদিকে অন্ধকার তারওপর আবার বৃষ্টি। এরমধ্যে ছাঁদে আসতে একটুও ভয় লাগলো না? আমি ছুঁলে তো ভয়ে কাঁপাকাপি শুরু হয়ে যায়। আর রাতের বেলা বৃষ্টির মধ্যে ছাঁদে এসে ভূতের মতো দাঁড়িয়ে থাকতে ভয় করে না তাই না? ইচ্ছে তো করছে কষিয়ে দু’গালে দুটো বসিয়ে দিই……”
ফাল্গুনী দু’গালে হাত চেপে দাঁড়িয়ে আছে এক কোনায়। জাগ্রত শেষ কথা বলতে বলতে হাত তুলে এগিয়ে এসেছিল খানিক। তাই দুগালে দুহাত চেপে ধরেছিল ভয়ে। ফাল্গুনী কিছু না বলে আলগোছে নেমে গেল নিচে। নামার আগে এক কোনায় জড় করে রাখা কাপড় গুলো নিয়ে নিয়েছে হাতে। বাসায় ঢুকে হাতের ভেজা কাপড়গুলো রেখে শুকনো কাপড় হাতে ঢুকে গেল ওয়াশরুমে। কিছুক্ষণ পর কাপর বদলে নিয়ে বের হতে না হতেই সামনে পড়ল জাগ্রত। চোখমুখ কুঁচকে দাঁড়িয়ে আছে সে পথ আঁটকে। ফাল্গুনী এক হাতে জাগ্রতকে সরিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে চাইলে সে ধরে ফেললো ফাল্গুনীর হাত। ফাল্গুনীর অভিমানী মুখটায় লাল হয়ে যাওয়া নাকে দৃষ্টি ফেলে অদ্ভুত চেহারা বানিয়ে বলল,
“আশ্চর্য! কাঁদিয়েও জিতবে, কেঁদেও জিতবে! ফোঁস ফোঁস করছো কেন? আমি তোমায় মেরেছি?”
ফাল্গুনী উত্তর দিল না। নিরুত্তর ভঙ্গিতে জাগ্রতর থেকে হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতে লাগল। জাগ্রতর বিরক্তিভাজন চেহারায় আরও একটু বিরক্তি মজুদ করে বলল,
“আমি না ছাড়লে তুমি ছাড়াতে পারবে? অত শক্তি আছে তোমার গায়ে?”
ফাল্গুনীর প্রচেষ্টা থামলো না জাগ্রতর তাচ্ছিল্যে। জাগ্রতও থামল না। আবারও বলল,
“আচ্ছা জ্বালা তো। কান্ড ঘটালে তুমি আবার রাগ-ও দেখাচ্ছ তুমি। তোমার এমন দায়িত্বহীনতার জন্য আমি কতটা ভয় পেয়েছি জানো?”
ফাল্গুনী এবারও নিরুত্তর। জাগ্রতর এবার আর সহ্য হলো না ফাল্গুনীর নিশ্চুপ থাকা। কোলে তুলে ওয়াশরুমে ঢুকে দরজা দিয়ে দিল সশব্দে। দরজা লক করতে করতে বলল,
“দেখি কতো চুপ থাকতে পার আজ। তেমাকে দিয়ে আজ চিৎকার যদি না করিয়েছি তাহলে আমার নাম-ও জাগ্রত নয়।”
_______________________
বৌভাতের অনুষ্ঠানটা যতোটা ছোট আকারে ও জাঁকজমকহীন সারবে বলে প্রথমে ভেবেছিল চন্দনা, তার থেকেও চারগুন জাঁকজমকপূর্ণ অনুষ্ঠান হয়ে গেল। চন্দনার ঠিক যেমন ইচ্ছে ছিল ছেলের বৌভাতের অনুষ্ঠান নিয়ে তেমনটাই হলো। হয়তো আমন্ত্রিত অতিথিদের সংখ্যা খুব বেশি নয়, কিন্তু আমোদ ফুর্তি অথবা আনন্দের কোন কমতি নেই। নিসান তার মামাতো পিসাতো ভাইগুলো আর বন্ধুদেরকে কাজে লাগিয়ে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছে মায়ের সব ইচ্ছেগুলো পূরণ করার।
চন্দনা আজ বড্ড ব্যস্ত। কেমন কেমন যেন সব কাজ বেড়েই চলেছে চারিদিকে। ব্যস্ততা কমছেই না। তবে কাজের ভারে হাতটা ভারী হলেও মনটা তার আজ বেশ হালকা। গৌরব আর দোলার কাছে আঁখির পরিবার আর রতনের সাথে জবরদস্তি বিয়ের সম্পর্কে সব শুনেছে। বুঝেছে তার ছেলে কেন এমন হুট করে এক কথা বলেই চলে গেল আর ফিরল সাথে বউ নিয়ে। আর আঁখিকেও বড্ড মনে ধরেছে। যেমন লক্ষ্মী প্রতিমার মতো মুখ তেমন সহজ, সরল আর শুভ্র হৃদয়। মনে কোন পেঁচ নেই। একটুতেই কেমন ভয়ে নীল হয়ে যায়। আবার একটুতেই কেমন খুশি হয়ে যায়। কথা বলে খুব বেশি না, তবুও সবার সাথে কেমন মিলে গেছে। বড্ড লক্ষ্মমন্ত মেয়ে। হটাৎ ভাবনায় ছেদ পড়ল পায়ে কারও স্পর্শ পেয়ে।
নিসান এসেছে মায়ের কাছে। মায়ের হাঁটুতে মাথা গুঁজে দিয়ে দুহাতে জরিয়ে নিয়েছে মায়ের পা। চন্দনা রাণী চমকালেন না। নিসান এমন হার হামেশা-ই করে থাকে।
নিসান চোখ বন্ধ করে কিছুক্ষণ চুপ করে রইল। অতঃপর বলল,
“মা, সবাই বাইরে আছে তুমি ঘরে একা একা বসে কেন আছো?”
চন্দনা জবাব দিল না। নিসান জবাবের জন্য অপেক্ষা না করে বলল,
“মা, তোমার হাসিমুখটা দেখি না ক’দিন হলো হিসেব আছে? তুমি আমার সামনে বসে থেকে জোর করে আমায় খাওয়াও না কতদিন হয়েছে তার হিসেব আছে? আমার মাথায় তেল ঠেসে দাওনা কতদিন হলো তার কি হিসেব আছে? এই দেখো আমি তোমার পা জরিয়ে ধরে বসে আছি অথচ তোমার হাত দুটো এখনও আমার চুলে ছোটাছুটি করছে না। আমার কষ্ট হচ্ছে মা। আমি জানি আমার থেকে বেশি তোমার কষ্ট হচ্ছে। মা আঁখি খুব ভাল মেয়ে। তোমার মনের মত। যেমন তুমি চাইতে তোমার ছেলের বউ হিসেবে ঠিক তেমন। মানছি বিয়েটা….”
“জানি আমি। গৌরব আর দোলা বলেছে আমায়।”
মায়ের সারা পেয়ে নিসান থামলো। কিছুক্ষণ থেমে থেকে আবার বলল,
“সারাদিনের আনুষঙ্গিক নিয়ম-কানুন আর আনুষ্ঠানিকতা তো প্রায় শেষ। অতিথির সংখ্যাও তো কমে গেছে। এখন আমায় একটু খাইয়িয়ে দেবে। তখন নাম মাত্র খেয়েছিলাম। প্রচন্ড খিদে পেয়েছে। পেটে ব্যাথাও করছে। দু’দিন ঠিকমতো না খাওয়ায় গ্যাস্টিক এর ব্যাথা হচ্ছে বুকে পেটে। একটু যে ওষুধ খাব তার-ও উপায় নেই। ওদিকে ওরা রুমে ঢুকতে দিল না। সবগুলো দরজা আটকে বসে আছে। তোমার কাছে ওষুধ থাকলে একটা ওষুধ দাও। তারপর কিছু খাইয়িয়ে দাও।”
চন্দনা এবার গম্ভীর কণ্ঠে বলল, “পেট ভরে খাসনি তাই খিদে পেয়েছে বলছিস। তা তুই না খেয়ে তখন উঠে গেলি বলে যে আঁখি-ও আর খেলো না তা দেখিস নি? নিজে খেতে চাইছিস আঁখির চিন্তা কে করবে?”
নিসান মাথা না তুলেই হাসল তৃপ্তির হাসি। কিছু বলল না। চন্দনা বলল,
“বসে থাক আমি খাবার নিয়ে আসছি। ওষুধ দেখ ওই ড্রয়ারে আছে। নিয়ে নে।”
চন্দনা চলে যেতেই নিসান বুক ভরে শ্বাস টেনে নিল। শীতল হল বুকটা। যেন ভারী এক পাথর নেমে গেল বুক থেকে।
“তা বিয়ে না হয় পালিয়েই করেছো নতুন বউ, তাই বলে কি তোমার বাবার বাড়ি থেকে কিছু উপহার দেবে না? মানে এতো ভাল ঘরে বিয়ে হয়েছে, ছেলে এত ভাল চাকরি করে, মাসে মাইনে পায় লাখ টাকার মতো, তাতে না মেনে নেওয়ার মত তো কোন জায়গা নেই। তোমার বাড়ির লোকরা তো নিশ্চয়ই খুশিই হয়েছে। মেয়ে এতো ভাল ঘর আর বর দেখে পালিয়েছে, অখুশি হওয়ার প্রশ্নই আসে না। মেনে না নেওয়ার-ও প্রশ্ন আসে না। তাহলে মেনে নিয়ে থাকলে কোন উপহার সামগ্রী তো অবশ্যই দেবে তাই না?”
নিসানদের প্রতিবেশী মিনতি রাণীকে সঙ্গ দিয়ে আরেক প্রতিবেশী লতা রাণী বলে উঠলো,
“হ্যাঁ, নিসানকে তো গলার চেইন, আংটি অথবা ব্রেসলেট দেবেই তাইনা মিনতি দি? আর ঘর সাজানোর-ও একটা ব্যাপার আছে। তা আবার এমন নয়তো যে মেয়ে ভাল ঘরে পার হয়ে গেছে দেখে আর কোন মাথা ব্যাথা নেই বউয়ের বাবার বাড়ির লোকেদের?”
মিনতি রাণী তাচ্ছিল্য সুরে বলল,
“তাই হবে হয়তো। বাবার বাড়ির তো কাউকেই দোখলাম না। কাউকে জিজ্ঞেস করলেই এড়িয়ে যাচ্ছে। তা হেগো নতুন বউ, তোমার বাবার বাড়ির লোকজন কোথায়? টাকা খরচ করে উপহার দেওয়ার ভয়ে আসেনি বুঝি?”
আঁখির দুচোখের কোটর ভর্তি অশ্রু জমে গেছে। কি জবাব দেবে বুঝে উঠতে পারছে না। বর্ষাদের সাথে বসেছিল ড্রয়িংরুমে। রুমে নাকি কিসব সারপ্রাইজ এর কাজ চলছে তাই এতোক্ষণ গেস্ট রুমে বসিয়ে রেখেছিল তাকে। সেখানে আবার কয়েকজন অতিথি চলে আসায় ড্রয়িংরুমে এসে বসেছিল আঁখিকে নিয়ে বর্ষা এবং বাকি বোনেরা। হটাৎ শুভ এসে ডেকে নিয়ে গেল বর্ষাকে। বর্ষার পিছু পিছু বাকিরাও দৌড়ে চলে গেল। তারপরই শুরু হলো দু’জন মহিলার অমানবিক প্রশ্নমালা। তবে আঁখিকে বলা কিছু কথা শুনে নিয়েছে চন্দনা। নিসানের জন্য খাবার নেবে করে ঘর ছেড়ে বেরোতেই শুনতে পায় আঁখিকে বলা সুচালো প্রশ্নগুলো। আঁখিকে চুপচাপ মাথা নত করে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে প্রচন্ড রাগ হলো। ইচ্ছে হলো নিসান কথা না শুনলে যেমন কানে ধরে অথবা পিঠের মধ্যে দু একটা দিয়ে তারপর তাকে কথা শোনায়, তেমন-ই দু একটা আঁখির পিঠে বসিয়ে দিতে। মেয়েটার সাথে কি মাথা আর মুখ কোনটাই নেই। যতই হোক নতুন বউ, হাসিমুখেও তো কথা ফিরিয়ে দেওয়া যায়। নতুন বউ বলেই কি চুপচাপ কারও অপমান সহ্য করতে হবে? মনে মনে বর্ষা, শান্তা, আর কান্তাকেও বকলো। মিতু নাহয় ঘর সাজাতে ওদের সাথে ব্যাস্ত। ওরা কি করছে? এতো করে বলে দিল আঁখিকে যেন একা না ছাড়ে আর কাওকে কিছু প্রশ্ন করার সুযোগ না দেয় তবুও হাওয়া হয়ে গেল মেয়েগুলো। আবার আসুক আঁখির আশেপাশে। কানে ধরে তারপর পিঠগরম করবে।
মনে মনে এমন বিরবির করতে করতে কয়েক পা এগিয়ে গেল আঁখির কাছে। আলতো করে আঁখির দুকাধ জরিয়ে ধরে দুজনকে উদ্দেশ্য করে বলল,
“কি বলতো মিনদি দি, আমি আমার ছেলেকে হাত উপুর করার শিক্ষা দিয়েছি। হাত পাততে শিখাইনি। আমার ছেলে দিতে জানে নিতে নয়। অমন ছোটলোকি আমরা পারি না। আশেপাশের প্রতিবেশীদের থেকে অবশ্য অনেক শেখার চেষ্টা করেছি কিভাবে হাত পাততে হয় অন্যের সামনে, কিন্তু এ বিদ্যা রপ্ত করতে পারি নি; তাই ছেলেকেও শেখাতে পারি নি। সবাই কি আর সব পারে বল? এই যেমন আমার ছেলের বউটার কথাই ভাব না। বাবা-মা কোন শিক্ষা দিয়েই পাঠায়নি। আমাকেই শিখিয়ে পড়িয়ে নিতে হবে সব। এই যেমন লতা দি’র মেয়ের মতো চাপা করা আর মিনতি দি’র ছেলের বউয়ের মতো মুখের উপর ঝামা ঘষে দেওয়া; সবটা আমাকেই শেখাতে হবে। ওর মা শেখায় নি তো কি হয়েছে? আমি শেখাব। শ্বাশুড়ী যখন হয়েছি, দায়িত্ব তো নিতেই হবে। তাই না দিদি?”
~চলবে
#পুনর্মিলন
#গুঞ্জন_চৈতি
#পর্ব_৩৪
“আআআআ…প্লিজ প্লিজ ছেড়ে দিন আমাকে, আমি আর কখনো চুপ করে থাকব না। আর দরজা খুলে রেখে ছাঁদেও যাব না। গেলেও বৃষ্টিতে ভিজব না। যা বলবেন তাই করবো ছাড়ুন আমাকে, প্লিজ নিচে নামান।”
ফাল্গুনীর হাঁটু জরিয়ে উঁচু করে ধরে আছে জাগ্রত। ফাল্গুনীর মাথার ঠিক উপরে ঝুলে আছে মাকড়সার একটা জাল আর সেই জালে আঁটকে আছে প্রায় পাঁচ ছয়টি ছোট বড় মাকড়সা। সাথে অন্যান্য কিছু পোকা-মাকড় ও মরে আঁটকে আছে তাতে। ভেন্টিলেটর এর কাছাকাছি জাল টা হওয়ায় ময়লার-ও অভাব নেই তাতে। রুমের তুলনায় ওয়াশরুমের ভেতরের ছাঁদটা বেশ নিচু হওয়ায় অনায়াসে জাগ্রত ছাঁদের কাছাকাছি তুলে ধরেছে ফাল্গুনীকে। ফাল্গুনী যথাসম্ভব মাথা ঝুঁকিয়ে জাগ্রতর গলা জপটে ধরে নিচু হয়ে আছে যাতে ওগুলো মাথায় না লেগে যায়। ভয়ে নয়, ফাল্গুনী চিৎকার করছে তার গা ঘিনঘিন করছে বলে। ওতে ময়লার অভাব নেই। মাথায় বসে গেলে পরিষ্কার করতে জান বেরিয়ে যাবে।
ছাঁদে জাগ্রত ধমকি-ধামকির পর ফাল্গুনীর দিকে হাত তুলে এগিয়ে যাওয়ায় অভিমান খানিক হয়েছিল ফাল্গুনীর। কিন্তু অতোটাও নয় যে রাগ করে কথা বন্ধ করে দেবে। সে তো এমনি এমনিই একটু রাগ দেখাচ্ছিল জাগ্রতকে। জাগ্রতর রিয়াকশন দেখার জন্য চুপ করে ছিল। কিন্তু তার রিয়াকশন যে এভাবে তাকে বিপদে ফেলবে বুঝতে পারে নি। তাই চিৎকার করে হার মেনে নিয়ে আত্মসমর্পণ করে নিল।
জাগ্রত মুখ বাঁকিয়ে শয়তানি হাসি দিল ফাল্গুনীর কথায়। রসিয়ে রসিয়ে বলল,
“বলেছিলাম না, তোমাকে দিয়ে চিৎকার যদি না করিয়েছি তো আমার নাম-ও জাগ্রত নয়। কর কর, আরও একটু চিৎকার কর। তারপর তোমাকে ছাড়ব আমি, এটুকুতে আমার মন ভরে নি। একচুয়ালি কান ভরে নি।”
ফাল্গুনী না পারতে বলে উঠলো,
“আরে ধুর আমি তো এমনি এমনি একটু চুপ করে ছিলাম। মিছি মিছি একটু রাগ দেখাতে পারি না আমি?”
“হ্যাঁ হ্যাঁ অবশ্যই পার। তুমি আমার একটা মাত্র বউ, তুমি আমার মাথা খাবে না তো কি পাশের বাসার আরেকজন এর বউ এসে আমার মাথা খাবে, মানে রাগ দেখাবে? কিন্তু কথা হচ্ছে সব কিছুর একটা গুড এন্ড ব্যাড টাইমিং আছে, ওকে?”
ফাল্গুনী খানিক চেতে উঠল জাগ্রতর মুখে অন্যের বউয়ের কথা শুনে। রাগী গলায় বলে উঠলো,
“এবার কিন্ত বেশি বেশি করছেন আপনি। আমাকে বলছেন বলুন অন্যের বউ নিয়ে কেন বলতে হবে? খুব সখ হচ্ছে নাকি অন্যের বউ এসে আপনার মাথা খেয়ে যাক; মানে রাগ দেখিয়ে যাক। আপনার সাথে কথা বলাই বেকার। এই আপনি নামাবেন আমাকে? ওগুলো আমার মাথায় লেগে যাবে। সব পোকাগুলো নেমে যাবে আমার মাথায়।”
“নামুক না নামুক। তাতে যদি তোমার একটু সুবুদ্ধি খোলে মন্দ হবে না ব্যাপারটা। আমি শিউর, তোমার থেকে ওদের মাথায় বুদ্ধি বেশি। ওরা তোমার মাথায় নেমে না হয় একটু বুদ্ধির চাষ করুক। আমার জানটা বেঁচে যাবে। নয়তো তোমার চিন্তায় চিন্তায় আমার মৃ/ত্যু নিশ্চিত।”
জাগ্রতর মুখে মৃ/ত্যু/র কথা শুনে ঘেঁটে গেল ফাল্গুনী। বা হাতে জাগ্রতর ঠোঁট বরাবর ছোটখাটো একটা চড় বসিয়ে দিল না দেখেই। সাথে বলে উঠলো, “এসব কি কথা।”
কিন্তু চড় গিয়ে লাগল জাগ্রতর ডান গাল বরাবর। বেশ ভালোমতোই লাগল একেবারে। ফাল্গুনীর হাত যে জাগ্রতর ঠোঁটে গিয়ে লাগে নি তা বুঝতে পেরে জাগ্রতর কাঁধে ঝুঁকিয়ে রাখা মাথা খানিক উঁচু করে বোঝার চেষ্টা করলো বর্তমান পরিবেশ। কাঁদো কাঁদো মুখে আলতো করে জাগ্রতর কাঁধে মাথা এলিয়ে দিয়ে কানের কাছটায় বলল,
“সরি। বুঝতে পারিনি গালে লেগে যাবে। না দেখে দিয়ে ফেলেছি। আর ইচ্ছের তুলনায় একটু বেশিই জোড়ে লেগে গেছে। সরি, সরি, সরি।”
কথাগুলো বলে জাপটে ধরে রইল জাগ্রতর গলা। জাগ্রত কোন জবাব না দিয়ে নামিয়ে দিল ফাল্গুনীকে। তৎক্ষনাৎ দরজার সিটকিনি খুলে বেরিয়ে গেল ওয়াশরুম থেকে। ফাল্গুনী অসহায় চোখে কিছুক্ষণ চেয়ে থেকে পিছু পিছু এগিয়ে গেল বেডরুমের দিকে।
এদিকে জাগ্রত রুমে ঢুকে নিয়ে ঠোঁট চেপে হেসে দিল শব্দহীন। তার মৃ/ত্যু/র কথায় যে ফাল্গুনী আচমকা চড় বসিয়ে দিয়েছে নিজের নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে তাতে সে একটুও রাগ করেনি। বরং খুশিই হয়েছে বউয়ের এমন রুপ দেখে। এ রুপে যে এক বুক ভালবাসা মিশে ছিল। ছিল অনুভূতির অনুরাগ।
ফাল্গুনী রুমে এলো এর মধ্যেই। দরজার কাছে এমন ভাবে এসে দাঁড়াল যেন বিড়াল দুধ চুরি করতে এসেছে আর কেউ যেন টের না পায় তার উপস্থিতি। জাগ্রত শার্ট-প্যান্ট বদলে নিয়েছিল ফাল্গুনী ওয়াশরুমে থাকতে থাকতেই। এবার সরাসরি বিছানায় গিয়ে বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে পরল। তারপর ফাল্গুনীকে কাছে ডেকে বলল, “এখানে এসো।”
ফাল্গুনী ধীরপায়ে এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল বিছানার কাছে। জাগ্রত মাথা তুলে না তাকিয়ে বলল, “বসো।”
ফাল্গুনী বসে গেলে বলল, “তোমার ফোন কোথায় ছিল সারাদিন?”
জবাবে বলল, “কিজানি, আছে এদিকেই কোথাও একটা।”
সঙ্গে সঙ্গে জাগ্রত একটা গম্ভীর চাহনি দিল। ফাল্গুনী উঠে দাঁড়িয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। ফোন খুঁজতে লাগল এদিক সেদিক। ফোন মিলল ড্রেসিং টেবিলটার এক কোনায়। ফোন মিলতেই জাগ্রত হাত বাড়িয়ে চাইল। ফাল্গুনী দ্বিধাদ্বন্দে পরে গেল। ফোনে তো সোহাগের অসংখ্য মেসেজ আর বিভিন্ন নম্বর থেকে কল হিস্টোরি রয়েছে। জাগ্রত দেখলে যদি ভুল বুঝে বা আরও রেগে যায়। জাগ্রত হাত বাড়িয়ে নিজেই নিয়ে নিল ফোন। দেখল সাইলেন্ট করা রয়েছে। আর মিসড কল দেখাচ্ছে বত্রিশটা। শুধু শ্বাশুড়ী মায়ের নম্বর আর আঁখি নামে সেভ করা নম্বরটা ছাড়া আর বাকি চারটে নম্বর চিনল না। নম্বরগুলোর কাহিনী মস্তিষ্কের এক কোনায় সাইড করে রাখল পরে দেখে নেবে করে। কেননা তার জানা আছে এই নম্বর গুলোর মালিক সোহাগ ছাড়া আর কেউ নয়। আড়চোখে একবার ফাল্গুনীকে দেখে নিয়ে কাউকে একটা কল লাগাল ওই ফোন থেকেই। ফাল্গুনী বুক টা ধক করে উঠল। ভাবল সোহাগের নম্বরেই বোধহয় কল লাগাল জাগ্রত। মনে মনে ভাবল, বড্ড ভুল করে ফেলেছে জাগ্রতকে সোহাগের কথা না জানিয়ে। জানায়নি বললে ভুল হবে, কেননা জাগ্রত জিজ্ঞেস করেছিল পর সে তো বলেছিল সোহাগ ফোন দিয়েছিল। ফোন দিয়ে কি বলেছিল তা হয়তো বলেনি আর জাগ্রতও নিজে থেকে জিজ্ঞেস করেনি। বড্ড আফসোস হচ্ছে কেন যে জাগ্রতকে জানাল না নিজ থেকে! তার মুখ থেকে শুনলে তো ব্যাপারটা আরও সহজ হতো।
জাগ্রত যাকে ফোন করেছে সে ওপাশ থেকে রিসিভ করতেই লাউডস্পিকার করে দিল। সঙ্গে সঙ্গে কারও রাগী কন্ঠ ভেসে এসে ছাড়িয়ে গেল রুম জুড়ে।
“তোমাকে কতবার কল করেছি সারাদিন রিসিভ করোনি কেন ফাল্গুনী? কি করছিলে সারাদিন? ওদিকে জাগ্রতকে কল দিলাম ওর ফোন নাকি সাইলেন্ট ছিল। ও নাহয় অফিসে ব্যস্ত ছিল ওর ফোন সাইলেন্ট থাকতেই পারে তুমি কোন রাজকার্যে ব্যস্ত ছিলে যে ফোন রিসিভ করতে পারনি? গত দু’দিন তো নিজে থেকে দু’বেলা ফোন করে করে খোঁজ নিয়েছ। আজ নিশ্চয়ই ঝগড়া করেছো দুজনে? আমি দু’দিন যাবত তোমাকে কি বলে এসেছি ফাল্গুনী? বলিনি একদম ঝগড়াঝাটি করবে না। কোন…”
“মা, মা, থাম একটু। আমরা ঝগড়া করিনি। ঝগড়া কেন করব। রোজ তোমার ঝগড়ার কথা কেন মনে হয় মা? রোজ শুধু এক কথাই বল। আর আমার ফোন সাইলেন্ট ছিল তাই বুঝতে পারি নি তুমি কল দিয়েছ।”
“তোমাদের দু’জনের হাবভাব মনে করিয়ে দেয় ঝগড়ার কথা। অতীতে তো কম দেখাও নি। দুজনের যা ইগো। আগেও বলেছি এখনও বলছি, ভুলেও জাগ্রতর সঙ্গে কখনো তর্কে জড়াবে না। ও যেমন বলবে তেমন চলবে। স্বামীর মন জুগিয়ে চলাকে যদি আত্মসম্মান বোধে বাঁধা বলে মনে কর তাহলে সুখের দেখা কখনো পাবে না। স্বামীকে যতটা মুল্যায়ণ করবে তোমাদের সম্পর্কটা ততটাই মূল্যায়ন পাবে, সাথে তুমিও। শুধু ভালোবাসায় সংসার হয় না। ধৈর্যশক্তি, সহনশক্তি, বিশ্বাস, ভরসা সব সঞ্চার করে নিতে হয় নিজের মধ্যে। তবেই সংসারে ভারসাম্য করে সুখের সন্ধান পাওয়া যায়।”
জাগ্রত মুখে হাত দিয়ে মিটি মিটি হাসছে ফাল্গুনীর দিকে চেয়ে। ফাল্গুনী বসে বসে মায়ের কথা শুনছে আর আঁড়চোখে একটু পর পর দেখে যাচ্ছে জাগ্রতর হাবভাব।
বিলাসি দেবী আরও কিছুক্ষণ উপদেশ দিয়ে তারপর থামলেন। দু সেকেন্ড সময় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন,
“জাগ্রত আছে আশেপাশে?”
ফাল্গুনী জাগ্রতর দিকে চেয়ে থেকে বলল, “হুম, আছে।”
বিলাসি দেবী বললেন, “ফোনটা ওর কাছে দাও।”
ফোনটা জাগ্রতর হাতেই ছিল। এক হাতে ফোনটা একটু দূরে সরিয়ে রেখে ফাল্গুনীর কানের কাছে এসে ফিসফিস করে বলল, “এবার দেখো মা আমাকে কি বলে।”
জাগ্রত লাউডস্পিকারে রেখেই ফোন সামনো নিয়ে হ্যালো বলল। সাথে সাথেই জাগ্রতকে বলতে লাগল,
“শোনো জাগ্রত, আমার মেয়েটা মোটেও অবুঝ নয় যে সে ইচ্ছাকৃত এমন কোন কাজ করবে যা বাঞ্ছনীয় নয়। আর মানসিক ভাবে দুর্বল-ও নয় যে তুমি এক তরফা কিছু বললে ও চুপচাপ শুনে যাবে কোন প্রত্যুত্তর না করে। মহিষের সিং মহিষের কাছে কখনো ভারী বোঝা মনে হয় না। আমার মেয়েও আমার কাছে কখনো বোঝা মনে হবে না। হয় নিজেদের মধ্যে সঠিক বোঝাপড়া করে ভালোবেসে সম্পর্কটাকে এগিয়ে নিয়ে যাও নয়তো আমার মেয়েকে আমার কাছে যেকোন সময় এসে রেখে যেও। আমি যতদিন বেঁচে আছি আমার মেয়ের জন্য আমার দ্বার সর্বদা খোলা। তবে হ্যাঁ, আমার মেয়ে যদি কোন অন্যায় করে তবে আমার আগে তুমি ওকে শাষণ করার অধিকার রাখ। দোষ করলে অবশ্যই শাষণ করবে তবে তা তখনই করবে যখন তুমি নিশ্চিত জানবে যে ও আসলেই দোষী।”
বিলাসি দেবী ফোন রেখে দিলেন কথা শেষ করে। বিকেলে আঁখি ফোন করে বলেছিল সে ফাল্গুনীকে সারাদিন ধরে ফোন দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু সে রিসিভ করছে না। এমনিতেই নিজে ফোন দিয়ে পাচ্ছিল না তারওপর আবার আঁখির কথা শুনে আরও বেশি চিন্তায় পরে গেছিল। সবসময় শুধু মনে হয় এই বুঝি মনমালিন্য হলো দুজনের। এই বুঝি আবার ঝগড়া করে আলাদা হলো দুজন। ভাঙা জিনিসে জোড়া লাগিয়ে যতই মজবুত করা হোক না কেন জোড়া লাগানোর দাগ তো থেকেই যায়। তা কি আর মেটে!
জাগ্রত ফাল্গুনীর দিকে চেয়ে প্রশ্ন করলো,
“কি বুঝলে?”
ফাল্গুনী মুচকি হেসে বলল, “আমার মা টা এমনই। ছাড় দেয়, কিন্তু ছেড়ে দেয় না। আর অন্যায় কে তো মোটেও প্রশ্রয় দেবে না। মায়ের মনের ভয় এখনও কাটেনি। সবসময় শুধু আমাদের দুজনকে নিয়ে ভয়ে ভয়ে থাকে।”
“শ্বাশুড়ী মাকে তো একটা কথা বলাই হলো না।”
“কি কথা?”
“এই যে তুমি আমায় আজ মেরেছো।”
“আপনি জানেন আমি ইচ্ছে করে অতোটা জোরে দিই নি। আর গালেও দিতে চাই নি। তবুও সরি। প্লিজ ভুলে যান।”
“এভাবে কেউ সরি বলে নাকি?”
“তো কিভাবে বলব?”
“যেখানে মেরেছো সেখানে চুমু দিয়ে সরি বলতে হবে।”
“কি!”
“আবার বলব?”
“অনেক হয়েছে আপনার ড্রামা। আপনি থাকুন আপনার চুমু নিয়ে। আমি যাচ্ছি। খাবারগুলো গরম করতে হবে। আর ছাঁদ থেকে তুলে আনা ভেজা কাপড়গুলোও চেয়ারে রয়ে গেছে ওগুলোর একটা ব্যাবস্থা করতে হবে।”
জাগ্রত এক হাতে হেঁচকা টান দিয়ে ফাল্গুনীকে বসিয়ে দিল পাশে। প্রেয়সীর মাথাটা টেনে নিল নিজ বুকে। মাথায় গভীর এক তপ্ত চুমু বসিয়ে বলল,
“তুমি তো বোঝইনি আজ আমার পরিস্থিতি। আমি আজ কতোটা ভয় পেয়েছিলাম জানো?”
“দরজা খোলা দেখেই এতো ভয়?”
“শুধু কি তাই? একে তো দরজা খোলা তারওপর আবার চেয়ার উল্টেপাল্টে পড়া দেখেছি। রুমে নেই, ওয়াশরুমে নেই, কোথাও তুমি নেই। কাউকে তেমন চিনিও না এ বাসায় যে জিজ্ঞেস করবো। বাইরে আবার বৃষ্টিও হচ্ছিল। হটাৎ ছাঁদের কথা মাথায় এসেছিল পরে দৌড়ে গেছি ছাঁদে। সেখানে গিয়ে তোমায় দাঁড়িয়ে বৃষ্টি বিলাস করতে দেখে মনে হয়েছিল যেন বৃষ্টি শুধু এ ধারায় নয় আমার বুকেও নেমেছে। শীতল হয়েছে বুকটা।”
ফাল্গুনী মন খারাপ করে বলল,
“আম সরি। দুপুরে ঘুমিয়েছিলাম, উঠে দেখি সন্ধ্যা পার হয়ে গেছে। কেমন ঘুম যে ঘুমালাম কে জানে! তারপর আচমকা মেঘের গর্জন শুনে মনে পরেছে ছাঁদে তো কাপড় শুকোতে দিয়েছিলাম অনেকগুলো। দৌড়ে যেতে গিয়ে গায়ে বেজে একটা চেয়ার পরে গেছিল। আর দরজাটাও শুধু টেনে চলে গেছিলাম। আর গিয়ে দেখলাম সব ভিজে একাকার। নিজেরও একটু ভিজতে ইচ্ছে হলো তাই দাঁড়িয়ে পরেছিলাম রেলিং এর পাশটায়। তারপর আচমকা আপনি….।”
“আচ্ছা এখন এসব থাক। চুপ করে একটু বসে থাক দেখি। দেখতো এখানটায় কিছু শুনতে পাও কিনা?”
“আজ্ঞে সব শুনব, এখন যেতে দিন প্লিজ। ওদিকে ভেজা কাপড়ের জলে বোধহয় রুম ভেসে গেল।”
~চলবে