#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব১১
#রাউফুন
আজিজ সাহেবের কানে কথা যেতেই ছোট ভাই আসলামকে কল করলেন। ইতিউতি করতে করতে শেষে তীর্থর কথা বললেন,
‘ওঁরা মারা’মা’রি করছে।’
‘মা’রা’মা’রি!’
‘হ্যাঁ র’ক্তা’র’ক্তিও। একজনের তো মাথা ফে’টে হাঁ!’
বুকের ভেতর টা গুরগুর করে উঠলো আসলামের৷
‘কি বলতাছো এইসব। কিসের মা’রা’মা’রি? আমগো তীর্থর কিছু হইছে?’
‘হুম। তোর ছেলে সত্যি টা না জাইনা পালাইছে।’
‘পালাইছে? ক্যান পালাইছে?’
‘কে আবার আমাগো তীর্থ! যার মাথা ফা’ই’টাইছে সে এখন সুস্থ পুরোপুরি। কিন্তু তোর পোলায় ভাবছে সেই পোলায় ম’র’ছে। পুলিশ ধরবো ভাইবা পালাই গেছে। এখন কই খুঁজে পাই কো তো? তুই এহনি বৌমা রে লইয়া শহরের দিকে রওনা দে। এর মধ্যে দেহি কি করন যায়!’
ম’ড়া’র উপর খাঁ’ড়া’র ঘাঁ কাকে বলে তার কিছুটা এবার হৃদয়ঙ্গম করতে পারেন আসলাম। মুখ থেকে তার একটি কথাও বের হয় না। কথা শেষ করে যখন চেয়ারে বসে পরলো হঠাৎ বারান্দার দিক থেকে শোনা গেলো নারীকন্ঠের এক কাতর আর্তনাদ! ফোন স্পীকার দেওয়া থাকাই তীর্থর আম্মা এতক্ষণ চুপচাপ অন্ধকারে দাঁড়িয়ে কথাবার্তা শুনছিলেন। এবারে রীতিমতো চেঁচিয়ে কেঁদে উঠলেন।
‘ওরে আমার বাছা রে… তুই সত্য না জাইনা পালাই গেলিরে! ক্যান তোরে শহরে পাঠাইছিলাম আল্লাহ গো! আমার বাছারে ফিরাইন আনবেন আপনে এক্ষনি তীর্থর বাপ। আমি কিছু জানি নে।’
হতভম্ব হয়ে আসলাম স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তার আর্তনাদ দেখেন। এই প্রথম বোধহয় এমন নিঃস্বঙ্গতা অনুভব করলেন তিনি। শান্ত স্বরে বললেন,’আরে কাঁন্দার কি আছে? আমরা এক্ষনি গিয়া শহর থেইক্কা ওঁরে আইনা পড়মু। কাঁইন্দো না। আহো বাইর হো দেহি! কাপড় বদলানোর দরকার নাই। বোরখা খান পিন্দা লোও উফরে। এহন কাঁন্দার সুময় না। আহো দেহি।’
এই কথা শুনে তীর্থের মায়ের কান্নার দমক বেড়ে গেলো আরও।
‘আমার আঁচলের মানিকরে আমি এমনি করেই খোয়ালাম রে,হায় হায় রে!’
•
দৌঁড়াতে দৌঁড়াতে মনে হচ্ছিলো, খুব বিচ্ছিরি একটা গ্যাসে ভরা ঘুপচি ঘরের মাঝখানে সে আটকা পরেছে। সেই ঘরের দরজা জানালা নাই৷ একটা স্কাইলাইট পর্যন্ত চোখে পড়ছে না। যেখান দিয়ে কষ্টে সৃষ্টে বাহিরে গলা যা-ওয়া যায় না। তার কাছে তো একটা ফোন ও নেই। ফোনটা তার ঘরে অযত্নে পরে আছে এখন।
তীর্থ হাঁটছে আর আর পেছনে কিংবা ডানে-বামে তাকাচ্ছে, আর ঘামছে। চটচটে ঘাম বেরুচ্ছে তার মুখ, বুক আর পিঠের চামড়া ফুটো করে। যেনো খুব
শিগগিরই তার প্যান্ট জামা থেকে টসটস করে ঘাম ঝরতে শুরু করবে পথের ওপর।
সে এতো তাড়াতাড়ি পা চালাচ্ছে; অথচ কি আশ্চর্য , সে লক্ষ্য করলো তার পা আটকে যাচ্ছে, হাঁটা এগোচ্ছে না। আর সারাটা শরীর এতো ভারী লাগছে, যা কল্পনাও করা যায় না। কারোর শরীর এরকম স্টিমরোলারের মতো ওজনদার হয়ে উঠতে পারে তা যেনো বিশ্বাস হয় না।
তীর্থর সারা শরীর কাঁটা দিয়ে উঠলো, মসজিদ রোডের গা ঘেঁষে একটা প্যাঁচানো গলির ভেতর ঢুকতে ঢুকতে। সে যেনো অনুভব করছে হিং’স্র একদল পুলিশ ত্রস্ত পায়ে ছড়িয়ে পরেছে ঢাকায় শহরের অলিতে গলিতে! ছড়িয়ে পরবে না? দিনে দুপুরে এমন খু’ন, তার ওপর কতজন সাক্ষী আছ!
শহরের সবগুলো রাস্তায় পুলিশরা নিশ্চয়ই তাকে হন্যে হয়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে। তাকে যে করেই হোক খুঁজে বের করবেই। কোথায় পালাবে হ’ত্যা’কা’রী? তাদের হাত থেকে কি কেউই রেহাই পায়? এক সময় সে ধরা পরে যাবেই যাবে। তারপর, তারপর, তারপর? হঠাৎই তার মনে হলো, তার চোখের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদের উচু মিনার টা মুহুর্তে অদৃশ্য হয়ে সেখানে ফুটে উঠলো দোতলা, তোতলা, পাঁচতলা সমান ফাঁ’সির মঞ্চ। তাকে ফা’সি দেওয়া হচ্ছে।
আর তক্ষুনি হঠাৎ প্রচন্ড একটা হোঁচট খেয়েই যেনো থমকে দাঁড়িয়ে যায় তীর্থ। তার প্রায় গা ঘেঁষে বিদ্যুৎ বেগে একটা পুলিশ জীপ চলে গেলো। এইতো এই মাত্র! পোড়া পেট্রোলের গন্ধ এখনো হাওয়ায় ভাসছে। অল্পের জন্য ওঁরা তাকে দেখতে পায়নি।গাড়ির শব্দ শুনে সরু রাস্তার একটা কাপড়ের দোকানের রোয়াকের উপর দাঁড়িয়ে ছিলো তীর্থ।
ভাবলো,’যতোই আমি লুকাই না কেন ধরা পরতে আমার বেশি সময় লাগবে না।’
পাথরের স্ট্যাচুর মতো দাঁড়িয়ে রইলো সে গোলাকার একটা থামের আড়ালে। হতবুদ্ধি, কিংকর্তব্যবিমুঢ় সে। বুকের ভেতর এতো জোরে শব্দ হচ্ছিলো, তীর্থর মনে হলো আশ পাশের লোকেরা সেই শব্দ শুনতে পাচ্ছে।
এখন রাত কইটা? আটটা সারে আট টা মতো! মসজিদ রোড পেছনে ফেলে রাস্তায় পা দিতেই কাদের বাড়ির ভেতর থেকে ঢং ঢং করে কাঁসর ঘন্টা বেজে উঠলো। যন্ত্রচালিতের মতো হাঁটতে হাঁটতে তীর্থর মনে হলো সে যেনো এক সম্পুর্ন অচেঁনা শহরে পা রেখেছে। এখানকার একটা বাড়ি, একটা অফিস, একটা রাস্তাও যেনো সে আগে দেখেনি।
বিপদে পড়লে বা এই ধরনের আকস্মিক দুর্ঘটনা ঘটে গেলে বোধ করি সবারই এরকম হয়। তখন সবাই যার যার প্রিয় রাস্তায় হেঁটে যাওয়ার সময় অস্বস্তি বোধ করে।
এই রাস্তা ধরে কতদিন তার বন্ধু হীরকের বাড়ি গেছে তীর্থ। পাড়াটা ভীষণ সুন্দর! আঁকা বাঁকা রাস্তা, দু ধারে পুরনো সব বাড়ি। কোথায় যেনো ঘেউঘেউ করে উঠলো একটা কুকুর। নিশ্চয়ই কুকুর নিয়ে পুলিশ তাকে খুঁজে বেড়াচ্ছে! সে জানে না কি করবে, কোথায় যাবে। শুধু জানে তাকে পালাতে হবে। দিক বেদিক খুঁজেও কুলকিনারা পেলো না সে। হঠাৎই একটা সরু দেবদারু গাছ দেখলো সে। ঝমঝমিয়ে সে গাছের আগায় উঠে পরলো। গ্রামে থাকতে এরকম কত গাছের ডালে সে ঘাপটি মেরে থেকেছে। এ আর এমন কি।
পুলিশের জীপ আর মানুষ জন চলে যেতেই সে গাছ থেকে নেমে গেলো। একটা বড় মতো গাছ বাগানে ঢুকে দৌড় দিয়ে মেইন রাস্তায় উঠলো। হঠাৎই দেখলো অনেক গুলো টর্চের আলো দেখা যাচ্ছে। সে কান খাড়া করে শোনার চেষ্টা করলো। কেউ একজন চেঁচিয়ে বলছে, ‘ঐ যে ওদিকেই গেছে। ধর ধর৷’
তীর্থ বুঝে গেছিলো তাকেই ধরতে চাইছে, ওঁকে খুঁজছে পুলিশ। পুলিশি জীপের শব্দ কানে এলো মুহুর্তে৷ সে দেখলো এই মুহুর্তে বাঁচার আর কোনো পথ নেই।
সে ঝাপ দিয়ে আবার একটা গাছের ডালে উঠলো। সেখান থেকেই সরু একটা ডাল ধরে দোলনার মতো করে ধরে লাফিয়ে একটা বিল্ডিংয়ের উপর ঝাপ দিলো। পায়ে ব্যথা লাগতেই উফফ করে শব্দ করলো সে। একটার পর একটা লাগোয়া বিল্ডিং সে এভাবে টপকাতে টপকাতে এগিয়ে যাচ্ছিলো। মনে হচ্ছে তাকে আর ধরতে পারবে না এখন। সর্বশেষ যে বিল্ডিংয়ে সে এসে পরেছে সেটা একটা তিনতলা বাড়ি। এরপরে আরেকটা বিল্ডিং সেটা অনেক দূরত্ব থাকায় সে লাফাতে পারলো না।সে ছাদের চিলেকোঠার ঘরে ঢুকলো। সেখানে একটা ভাঙাচোরা সোফা রয়েছে। সে কোনো কিছু ভাবলো না। নানান চিন্তা ভাবনা মাথায় নিয়ে সোফার গদী তুলে তার নিচে শুয়ে পরলো। কি জানি অন্ধকারে কার মধ্যে হাত পরলো। ঘামে ভেজা মুখ খানা নিজের হাতে মুছে নিলো। বিভিন্ন চিন্তার ভেতর সে কখন যে ঘুমিয়ে পরলো বুঝলো না।
ভোরের আজান কানে আসতেই সে নড়েচড়ে উঠলো। নড়ার সময় মাথায় প্রচন্ড লাগলো। সে ভুলেই বসেছিলো এটা তার বাড়ি নয়। সে এখন এখান থেকে বেরোবে কি করে? বিল্ডিংটার দূরত্বও অনেক। সে ছাদে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে সূর্য উদয়ের দৃশ্য দেখলো। নিচে দিয়ে নামতে গেলেই তো তাকে দেখে ফেলবে গেটের দাঁড়োয়ান। হঠাৎই কোনো পায়ের শব্দ কানে আসতেই সে তড়িঘড়ি করে আবার সেইম পজিশন নিয়ে শুয়ে পরলো। সে ফাঁক ফোঁকর দিয়ে দেখলো কোনো এক বৃদ্ধ মহিলা তজবি হাতে হেলে দুলে হাঁটছে। বয়সের ভাড়ে হাতে লাঠিও নিয়েছেন। সর্বনাশ! চিলেকোঠার ঘরের দরজাটা তো লাগানো ছিলো। তারাহুরোতে লাগাতেই ভুলে গেছে তীর্থ।
চিলেকোঠার ঘরের দরজাটা খোলা দেখে বুড়ির সন্দেহ হওয়ায় ভেতরে ঢুকে উঁকি ঝুকি দিলো বুড়ি! কিন্তু তীর্থকে দেখলো না। ভাবলো হইতো বাতাসের জন্য খুলে গেছে দরজাটা। যেই না বেরোতে যাবে বুড়ি, তখনই একটা তেলাপোকা প্রায় তীর্থর নাকের গোড়ায় সুরসুরি দিলো। সে হ্যাচ্চো করে হাচ্চি করলো। হাচ্চির আওয়াজ পেয়ে বুড়ি সোফার গদির দিকে চোখ রাখলো। চিৎকার করে বাড়ি মাথায় তুলে ফেললো।
‘এই ফারুক, চোর এসেছে চোর, তোরা কই জলদি আয় দেখি। হায় হায় রে সর্ব’নাশ! কই রে আয়!
বুড়ির চিৎকারে বাড়ির সবাই ছুটে এসেছে ঠিকই,কিন্তু চিলেকোঠার ঘরে ভয়ে সাহস করছে না ঢোঁকার৷ এতো কিছুর মধ্যেও ওদের ওমন ঠেলাঠেলি দেখে তীর্থর হাসি পেলো। শেষে হুরমুর করে সকলে এক সাথে ঢুকে পরলো। অগত্যা, তীর্থ বেরিয়ে এলো সোফার নিচ থেকে। তীর্থ শুধু একটাই কথা বললো,
‘দেখুন আমি চোর নই!’
‘চোর কোনোদিন চুরি করে বলে আমি চুরি করেছি? গল্প ফাদছিস ব্যাটা ছেলে?এই দু ঘা দে-তো,মুখ থেকে ঠিক কথা বের হবে।’
অমনি সকলে ওঁকে হিরহির করে টানতে টানতে বের করে আনলো বাহিরে। এলোপাথাড়ি আঘাত হানলো তীর্থর গায়ে। যখনই একজন লাঠির আঘাত করতে যাবে তখনই একটা রিনরিনে কন্ঠঃস্বর ভেসে এলো। তীব্র উৎকন্ঠা নিয়ে বললো,
‘ওঁকে মারবেন না ছোট মামা। ওঁকে যে আমি চিনি!’
#চলবে