#পুষ্প_কন্যার_প্রেম_পাবক
#পর্ব১৫( অন্তিম_পর্ব)
#রাউফুন
‘আউচ্! শার্টের বোতাম লাগাতে দিয়েছি, আমার বুক ফু’টো করতে দেই নাই। কালি…রে তোকে দিয়া একটা কাজ হয় না। দিলি তো র’ক্ত বের করে।’
একথা শুনতেই ঝুমুর কটমট করে তাকালো। তীর্থ কিছুটা ঘাবড়ে গেলো ঝুমুরের শক্ত চাহনিতে৷ ঝুমুর পা দুটো উঁচু করে তীর্থর বুকের উপর রক্তাক্ত জায়গায় নিজের জিহ্বা দিয়ে শুষে নিলো ক্ষ’ত স্থান থেকে বেরিয়ে আসা র’ক্ত টুকু।
‘কি করছিস…?’ বলতে বলতে থেমে গেলো তীর্থ।
শরীরে এমন শিহরণ বয়ে গেলো যে কথা আটকে গেলো তার। সেই প্রথম দিনের মতো আজও একই ভাবে ঝুমুরের স্পর্শে শিহরিত হয় সে। ঝুমুর ওতো কিছু ভেবে কি আর রক্তটা জিহবা দিয়ে শুষে নিয়েছে?
‘তোমার অফিস যাওয়ার সময়ই কেন মনে হয় বোতাম লাগানোর কথা? এতো বোতামই বা কেন ছিড়বে? আমার জীবনটা ত্যানা ত্যানা করে দিসো। এই রোজ রোজ আমি বোতাম লাগাতে পারবো না।’
‘তাহলে তোর কষ্ট কমাতে আরেকজনকে নিয়ে আসি?’
‘মানে?
‘মানে ধর, আমি আরেকটা বিয়ে করলাম, সে কাজ করলো সব, আমার বোতাম ছিড়লে লাগাই দিবো। তুই আর আমি শুধু প্রেম করবো। তোর আর কোনো কাজ থাকবো না।’
‘তীর্থর বাচ্চা!আইজকা তোর একদিন কি আমার একদিন।’
তীর্থ ঝুমুরের অগ্নিশর্মা রূপ দেখে সোজা পা চেপে ধরে বলল, ‘ক্ষমা করে দে আর বলবো না এমন কথা।’
‘এই ভাবে আর কত পা ধরবা? আর কত ক্ষমা চাইবা? আমাকে খাটাতে খুব ভালো লাগে তাই না? সরো, আর জীবনে যদি পা ধরছো খবর আছে তোমার।’
তীর্থ পা ছেড়ে উঠে ঝুমুরের কোমড় চেপে ধরলো। অকপটে বললো, ‘ভীষণ ভালো লাগে। তোকে রাগাতে, তোকে খা’টা’তে, তোকে ভীষণ ভাবে জ্বালাতে। তোকে আমার দিকে আকর্ষণ করতে, আর…’
‘আর কি?’
‘আর তোর আদর পেতে ভালো লাগে। তোর কাছে আসাটা ভালো আমার হৃদয়ে প্রতিবার ছন্দ তুলে।’
‘বাবা আমি কিন্তু ছব দেকছি!’
ঝটপট ছেড়ে দিলো তীর্থ ঝুমুরকে। সে এই মেয়েকে নিয়ে ভীষণ জ্বালায় আছে। যখনই তাকে আর ঝুমুরকে এক সাথে দেখবে বাইরে গিয়ে সবটা ফাঁস করে দেবে। যা কিছু দেখবে অনর্গল বলে বেরাবে জনে জনে। ওর এমন কান্ডে ওঁরা দুইজন ই লজ্জা পরে যায়৷ এদিকে মা, এদিকে মেয়ে। ধুর ভাল্লাগে না। ঝুমুর ঠোঁট চেপে হাসি আটকালো তীর্থর অবস্থা দেখে। তীর্থ মেয়ের কাছে এগিয়ে কোলে তুলে নিলো। মেয়ের গালে টুকুস করে চুমু দিয়ে বলল, ‘আম্মা আপনি কি বাবার সঙ্গে বাইরে যেতে চান?’
‘হ্যাঁ চাই।’
‘তাহলে একটা শর্ত আছে। মানলে সুন্দর একটা জায়গায় ঘুরতে নিয়ে যাবো।’
‘কি শত্তো!’
‘আলে আলে আমার আম্মা শর্তও বুঝতে শিখেছে দেখছি!’
‘মা শিকিয়েচে! এখন বুলো!’
‘এখন যা কিছু তুমি দেখলে কিছুই বাইরে গিয়ে বলা যাবে না।’
‘আচ্চা বাবা!’
তীর্থ অফিস যাওয়ার পর ঝুমুরের তিন বছরের একরত্তি মেয়ে সুপ্তি ঘুটঘুট করে হেঁটে বড় খালার রুমের দিকে চলে গেলো। ঝুমুর শুধু পেছন থেকে দেখলো মেয়েকে যাওয়ার সময়। দেখতে দেখতে কখন এভাবে চারটি বছর এভাবেই চলে গেলো বুঝতেই পারলো না।
ঋতুর শাশুড়ী মা’রা যাওয়ার পর থেকে ঋতুও তার ননদকে নিয়ে শহরে চলে এসেছে। তার এখনো সন্তানাদি হয়নি। বিয়ের এতো বছর পরেও যখন বাচ্চা হলো না তখন তার আর তুষারের সুখের সংসারে অশান্তি সৃষ্টি হলো। অশান্তির শুরুটা হয় ঋতুর দিক থেকে। সেই সবচেয়ে দুঃখে কাটায় একটা বাচ্চার কারণে। অবশ্য এখন সুপ্তি হওয়ার পর সে অভাব অনেকটা ঘুঁচেছে। কিন্তু মা ডাক শুনতে কার না মন চাই? সেও এর ব্যাতিক্রম নয়। তু্ষারের বাচ্চা না হওয়া নিয়ে কোনো রকম সমস্যা নেই। তার একটাই কথা, ‘এখন বাচ্চা হচ্ছে না মানে যে পরবর্তীতে হবে না তা তো নয়।’
তাদের যেহেতু কোনো সমস্যা নেই তাহলে বাচ্চা হবে না এটা বলা উচিত না। তুষার সব সময় ঋতুকে জড়িয়ে ধরে শান্ত কন্ঠে বলবে, ‘আল্লাহ চাইলে আমাদের সুন্দর ফুটফুটে একটা বাচ্চা হবে দেখে নিও। আমাদের তো কোনো সমস্যা নেই তাহলে এতো চিন্তার কি আছে।’
ঋতু উত্তরে বলে, ‘যদি আমরা বাচ্চাটা বিয়ের পর পরেই নিয়ে নিতাম তবে বোধহয় এই সমস্যা হতো না।’
ঋতুর ভাবনার মাঝেই সুপ্তি ডাকলো, ‘আম্মা! কালা আম্মা!’
চমকে উঠে ঋতু এমন ডাকে। সুপ্তির মুখে আম্মা ডাক শুনে খুশিতে আত্মহারা ঋতু জাপ্টে ধরলো সুপ্তিকে। তুষারও যেনো হাতে চাঁদ পাওয়ার মতো খুশি হলো। ঋতুকে খুশি হতে দেখে সেও হাসলো। এগিয়ে এসে সুপ্তির মাথায় হাত দিয়ে বললো, ‘সুপ্তি মামনির জন্য খালুজান কি আনবে?’
‘কালুজান না, আব্বা! বড় আব্বা!’
‘কি ডাকলে আবার ডাকো?’
‘বড়ো আব্বা!’
তুষারের ভেতরটা ছলকে উঠলো খুশিতে। সুপ্তিকে কোলে নিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরলো। তার কলিজায় যেনো একটা ঠান্ডা স্রোত নেমে গেলো। ঋতুর ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে কষ্টে। নিজের সন্তান হলে তো সারাক্ষণ বাবা, আম্মু বলে বলে পা’গ’ল করে দিতো। মানুষটা এই টুকুতেই কতোটা খুশি হয়েছে তাকিয়ে তাকিয়ে দেখলো ঋতু। অশ্রুতে টইটম্বুর আঁখি মেলে দেখতে লাগলো ওঁদেরকে।
দরজার আড়াল থেকে ঝুমুর দেখে প্রশান্তির হাসি হাসলো। তার চেয়ে তার আপায় সুপ্তিকে বেশি স্নেহ করে যে৷ সে শুধু জন্মই দিয়েছে সুপ্তিকে। সে তো ছোট ছিলো,বাচ্চা দেখাশোনা করাটা তার জন্য কতটা কষ্টের ছিলো সে-ই জানে। সেসময় যদি তার আপা না থাকতো কি যে হতো। সুপ্তির দেখাশোনা করা থেকে সমস্ত কিছুই তার আপা এক হাতে করেছে। সুপ্তির আসল মা তো তার আপা। তীর্থর সঙ্গে তার ভুল ওয়েতে একটা সম্পর্ক হলেও বিয়ের দেড় মাসের মধ্যেই সে জানতে পারে সে মা হতে চলেছে৷ কিভাবে যেনো তার নানির কথাখানা ফলে গেছিলো সেসময়। আজ মানুষ টা নেই ভাবতেই ভেতর থেকে দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার। সেইদিন মানুষ টা যদি সঠিক সিদ্ধান্ত না নিতো তবে তার জীবনটা কোন দিকে মোর নিতো? আর তীর্থ? এই মানুষ টা তার ক্ষমা পাওয়ার জন্য কম কিছু তো করেনি। তার মাতৃত্বকালীন সময় জান প্রান লাগিয়ে তার সেবা করেছে। যেদিন তার বাচ্চা হবে সেদিন মানুষটার মুখের করুণ অবস্থা দেখেছিলো। বার বার বলছিলো, ‘আজকে তোর এমন করুণ অবস্থার জন্য শুধুই আমি দায়ী৷ তুই আমাকে কোনো দিনও ক্ষমা করিস না ঝুমুর। আমাকে ক্ষমা করবি না তুই। তোর জীবনের এই অনিশ্চয়তার জন্য আমি দায়ী। আমায় ক্ষমা করিস না।’
সেদিন এতো কষ্টের মধ্যেও সে হেসেছিলো। মুচকি হেসে তীর্থর চিবুক নেড়ে বলেছিলো, ‘আমি তোমায় আরও আগে ক্ষমা করেছি জানো?আমি যেদিন আমার মাঝে নতুন এক প্রাণের অস্তিত্ব অনুভব করেছিলাম সেদিন।আজ যদি আমি ম’রেও যায় আমার কোনো আফসোস থাকবে না। ডক্টর বলেছে মা নয়তো বাচ্চা যেকোনো একজনকে বাঁচানো যাবে। আমি তোমাকে বলছি আমার বাচ্চা যেনো বেঁচে থাকে এই সুন্দর পৃথিবীতে। ওঁর বাবা হিসেবে তুমি ওঁকে আগলে রাখবে।’
তার ওমন কথায় হাউমাউ করে কাঁদলছিলো সেদিন তীর্থ। হসপিটালের সকলেই তীর্থের দিকে তাকিয়ে ছিলো অবাক হয়ে। মা-বাবা, তার চাচা চাচি অর্থাৎ তার শশুর শাশুড়ী সবার দোয়াই হইতো সেদিন আল্লাহ তায়ালা কবুল করেছিলেন। তাই তো সেদিন সে আর তার বাচ্চা সুস্থ ছিলো।
•
পরিশিষ্ঠঃ
তীর্থ সন্ধ্যায় এসে সত্যিই ওঁদের মা মেয়েকে ঘুরতে নিয়ে গেলো পার্কে। মা মেয়ের আবদার যেনো শেষ হয় না। শিশু পার্ক জোনে নিয়ে গিয়ে তীর্থ মেয়েকে
দোলনায় বসে পরলো। দোল খাওয়া ঘোড়ায় বসে মেয়েকে আনন্দ দিচ্ছে আর মেয়ে খিলখিল করে হেসে কুপোকাত। ঝুমুরের প্রাণ ভরে যাচ্ছে বাবা মেয়েকে দেখে। এরাই তো তার পৃথিবী।
পুরো গ্রীন অরন্য পার্ক ঘুরে দেখা শেষে রকেট উঠলো তারা তিনজন। হাঁটতে হাঁটতে ক্লান্ত হয়ে তারা রেস্ট করতে একটা ফাঁকা স্থানে গিয়ে বেঞ্চে বসলো। আশেপাশে নজর বুলিয়ে তীর্থ দেখলো সন্ধ্যা নামছে। মানুষের জনের আনাগোনা কমে আসছে এখন। শরীরের কালো শার্ট খানা গায়ের সঙ্গে আঁটসাঁট হয়ে লেগে আছে। তার সঙ্গে ম্যাচিং করে ঝুমুর কালো শাড়ী পরেছে।এমন কি সুপ্তিকেও সিকুয়েন্সের কাজ করা কালো একটি গোল জামা পরিয়েছে। আঠারো বছরের তরুনি পাশে ছোট্ট রাজকন্যা আহ কি অপূর্ব। গোধূলি বিকেলের সোনা রোদ ঝুমুরের চোখে মুখে আছড়ে পরছে। তীর্থ মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে রইলো কতক্ষণ। মেয়েটা যেনো পণ নিয়েছে তীর্থকে উম্মাদ করে দেওয়ার। সে আনমনে বলল,
‘বউ আসো একটা চুমা দেই।’
হঠাৎ তুমি ডাকায় ঝুমুর যারপরনাই অবাক হয়ে তাকালো তীর্থর পানে। বলল, ‘ হঠাৎ তুমি বলছো? আর হঠাৎ এরকম একটা জায়গায় এসব কি কথা?’
‘কেন ভালো লাগছে না?’
‘তুই শুনতেই ভালো লাগে।’
‘এখনো যদি তুই বলি, আমাদের মেয়েও তো তুই বলবে তোমাকে।’
সুপ্তি আধো আধো কন্ঠে বলল,
‘বাবা আমাকে আদল দিবা না? আমালেও চুমা দেও।’
‘আসেন আম্মা আসেন। আপনাদের দুইজনরেই চুমা দিবো!’
তম্বন্ধে ঝুমুরের ফোন বেজে উঠলো। ঋতুর কল দেখতেই মুখে হাসি ফুটলো। ঋতু এক মুহুর্ত যদি সুপ্তিকে না দেখে অস্থির হয়ে যায়। ঝুমুর কল রিসিভ করলো। কল রিসিভ করতেই কান্নার আওয়াজ পেলো ঋতুর। বিচলিত হলো সে। উৎকন্ঠা নিয়ে শুধালো, ‘কি হয়েছে আপা? বাড়িতে কারোর কিছু হয়েছে? কাঁদছো কেন?’
ঋতু আর চিন্তায় ফেলতে চাইলো না ঝুমুরকে। কাঁদতে কাঁদতে বললো, ‘সুপ্তির খেলার জন্য আরেকজন যে আসতে চলেছে রে। আজ আমি খুব খুশি। এটা যে খুশির কান্না রে।’
‘কখন জানলে?’
‘একটু আগে! জানার পরই আমি অনবরত কাঁপছিলাম। মা হওয়ার আনন্দ বুঝি এমনই হয়? তোর ভাইয়াকে সারপ্রাইজ দিবো তুই যেনো বলিস না!’
‘আচ্ছা বলবো না। আমরা এক্ষুনি আসছি আপা!’
‘আসা লাগবে না এক্ষুনি। ভালো ভাবে আনন্দ করে ঘুরে আয়!’
‘আচ্ছা।’
‘কি হয়েছে ঝুমুর?’
‘আপার..!
‘আপার কি হয়েছে?’ তীর্থ অস্থির হয়ে জানতে চাইলো।
‘আপা বললো, আমাদের সুপ্তির খেলার সাথী আসতে চলেছে!’
প্রথমে বুঝলো না তীর্থ কিন্তু পরক্ষণেই ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই খুশিতে জড়িয়ে ধরলো ঝুমুরকে। সুপ্তি কি বুঝলো কে জানে। খুশিতে হাত তালি দিয়ে আধো আধো কন্ঠে বলল,’আমাল খেলাল সাতী আসচে! এএএ!’
সুপ্তির কথা শুনে ঝুমুর আর তীর্থ দুই জনেই ঝলমলে হাসি হাসলো৷ মা বাবাকে হাসতে দেখে সুপ্তিও খিলখিল করে হাসিতে মজে গেলো। পার্কের নদীর ঘাটে গিয়ে তিনজন বসতেই দেখলো আকাশের বুকে, ঐ অদূরে গাঙচিলের ঝাঁক উড়ে গেলো।
#সমাপ্ত