পূর্ণিমায় বিলীন চন্দ্র পর্ব-০১

0
1

#পূর্ণিমায়_বিলীন_চন্দ্র
#সাদিয়া_আক্তার
#সূচনা_পর্ব

ভরা মজলিশে পোলাউতে পাথর পাওয়াতে পুনমের গালে পরপর দুইটা চর দিলো ওর চৌদ্দ বছর বয়সী পুনম গালে হাত দিয়ে অবাক চোখে তাকিয়ে আছে। গাল বরাবর আরেকটি চড় পরতেই পুনমের ধ‍্যান ভাঙ্গে। শুনা যায় তার মা রোজিনা গমগমে স্বরে বলছে
-” চাল বাছার সময় ধ‍্যান কই ছিলো তোর,, কোনো কাজটাও তো ঠিকঠাক করতে পারিসনা।

মায়ের কথা শুনে পুনম মাথা নিচু করে ফেলে পরোক্ষনেই মায়ের আহাজারি শুনতে পায় –মেয়েটার কি হবে না আছে রূপ না আছে গুন। না একটু পড়াশোনায় ভালো।
পুনম পড়াশোনায় এভারেজ ছাত্রী। দশ থেকে পনেরোর মধ‍্যে থাকা ছাত্রী। আজকে তার গালে তিনটা থাপ্পড় পরার কারণ হলো তার মামী।
পুনম একপলক সবার দিকে তাকিয়ে দৌড়ে তাদের জন‍্য বরাদ্দ ঘরে চলে যায়।

বালিশে মুখ গুজে কাদতে কাদতে সকালের কথা মনে করতে থাকে।
মামা বাড়িতে বেড়াতে এসেছে তারা,, মা রোজিনা বেগম তারা তিন বোন _ রুপশা,, পুনম,, আর নিশা। সকালে মামী পুনমের দুই বোনকে শপিং করাতে নিয়ে যাওয়ার সময় তাকে মিষ্টি স্বরে বলে গেছে “” কিছু কাপড় ভাজানো আছে,, আর আজ দুপুরের জন‍্য রান্নাঘরে পোলাওর চাল আছে সেগুলো বেছে ধুয়ে রেখে দিতে।

পুনম কোনো রকম মাথা নাড়িয়ে হ‍্যা সম্মতি দিয়েছিল। মামা মামী খালারা তার দুই বোনকে খুব আদর করে করেন কারণ তার দুই বোন রুপে গুনে অপরূপা। পুনম কালো কোনো কিছু পারেনা।। সবার ধারনা যদি কিছু করতে পারে তাহলে রুপশা,, নিশাই করতে পারবে। পুনমের দ্বারা কিচ্ছু হবে না।।

বেশ ছোট থেকেই পুনম এই কথা গুলো শুনতে শুনতে বড় হয়েছে তার কাছে এগুলো দুধ ভাতের মতো। এগুলো শুনতে শুনতে সে এখন নিজেও মানে তার দ্বারা কিছু সম্ভব না। সে জীবনে কিচ্ছু করতে পারবেনা।

_____________,,,,,,,,

পুনমের বাবা পারভেজ সাহেব থমথমে মুখে বসে আছেন। পুনমকে যখন মারা হয় তখন তিনি উপস্থিত ছিলেন না। গতকাল তার স্ত্রী কন‍্যা চলে আসলেও সে আসতে পারেনি তাই আজ এসেছে। বিকাল পযর্ন্ত থেকে সবাইকে নিয়ে বাড়িতে রওয়ানা দিবে তবে শশুর বাড়িতে এসে স্ত্রীর কান্না শুনে ভরকে গেলো দ্রুত তার দিকে এগোতে নিলে শুনতে পায় স্ত্রী রোজিনা বেগমের আহাজারি।

— ভাবী আমার পেটে ওমন একটা মেয়ে কিভাবে হলো। হইতো একটা পোলা দিতো আল্লায় তাও মানা যাইতো

রোজিনা বেগমের কথার উত্তরে তার ভাবী শান্তনা স্বরে বলল — কি করবা রোজিনা সবই কপাল দেখো তোমার আর দুইটা মাইয়া কি সুন্দর আর ঐটা এমন কালো হইলো কেমনে। আর নামডাও রাখছে পুনম,, তবে ওর নামের লগে মিলছে দেখতেও আন্ধার রাইত,, নামেও আন্ধার রাইত

সমন্দি বউয়ের এমন কথা শুনে চুপ থাকতে পারলো না পারভেজ সাহেব সে গম্ভীর স্বরে বলল
— আমার মেয়ে কালো না ভাবী শ‍্যাম বর্ণ

রোজিনা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে — কি হয়েছে এমন মরা কান্না কাদছো কেনো??

পারভেজ সাহেবের কথা শুনে রোজিনা ঢোক গিলল। পারভেজ সাহেব মেয়েদের গায়ে হাত তোলা পছন্দ করেন না। সে মানে তার তিন মেয়ে তিনটা জান্নাত।।
— কি হলো বলো কি করেছে আমার মেয়ে যার জন‍্য তুমি এভাবে কাদছ??

পারভেজ সাহেবের কথার উত্তরে রোজিনা বেগমের বড় ভাই রিয়াজ সাহেব বলল — আমি বলছি,,

পারভেজ সাহেব তাকায় রিয়াজ সাহেবের দিকে। রিয়াজ সাহেব বলল — সকালে ওর মামী ও রোজিনা সহ সবাই শপিং এ গিয়েছিল যাওয়ার আগে পুনমকে বলে গেছে কাপড় ভিজিয়ে রাখা আছে সেগুলো একটু ধুয়ে রাখতে আর চালটা বেছে রাখতে তোমার অকর্মা মেয়ে চাল বাছতে পারে নি খেতে গিয়ে আমার পাতে পাথরের কনা পড়েছে। আমি এমনিতে অসুস্থ,,,,,,

রিয়াজ সাহেব ঘটনা এমন ভাবে বললেন যেনো এখানে পুনমের দোষটাই বেশী। পারভেজ সাহেব সকলের দিকে তাকিয়ে বলল — পুনম কোন ঘরে আছে,,

নিশা লাফ দিয়ে উঠে বলল — আব্বা আমার সাথে আসো।
পারভেজ সাহেব ছোট মেয়ের পিছন পিছন যায়। সে যেতেই রোজিনা হাফ ছেড়ে বাচে পুনমের মামার মুখে হাসি ফুটে। এই মেয়েটাকে তাদের কারোই পছন্দ না তার ওমন সুন্দর বোনের পেটে ওমন কালো মেয়ে হলো কিভাবে তারা ভাবতে পারেনা।

নিশা বাবাকে পুনম আপার ঘরে দিয়ে এসে কুটিল হাসে তার আব্বা পুনম আপাকে একটু বেশীই ভালোবাসে তাই সে হিংসেয় নিশা জ্বলে পুড়ে যায়। রুপশা আর নিশার মধ‍্যে একটু বেশীই ভাব তাই সে চলল বড় আপার কাছে। তাকে নিয়ে পুনম আপার বিচার সভা দেখবে।

অপরাধী চেহারা করে পুনম মাথা নিচু করে দাড়িয়ে আছে। পারভেজ সাহেব মেয়ের মুখের দিকে তাকায় কাদতে কাদতে চোখের দুই কোনা ফুলে গেছে। শ‍্যাম বর্ণ হলেও গালে পাচঁটা আঙ্গুল জ্বলজ্বল করছে। মেয়েটা শুয়ে ছিলো বালিশে মুখ গুজে সেখান থেকেই টেনে নিয়ে এসেছে।

— তুমি কি তোমার মামীর দেওয়া সব কাজ করেছ ??

পারভেজ সাহেবের গম্ভীর স্বরে কেপে ওঠে পুনম তবুও কোনো রকম মাথা নাড়িয়ে হ‍্যা সম্মতি দেয়।
পুনম মাথা নাড়িয়ে হ‍্যা সম্মতি দিতেই ঠাসস করে একটা থাপ্পড় পরে পুনমের গালে।
উপস্থিত সবাই বেশ খুশী হয়। পুনম পারভেজ সাহেব না তাকিয়ে বুঝতে পারে। পারভেজ সাহেব আবারো বলল — তোমার মামী যখন তোমাকে রেখে ওদের নিয়ে শপিং এ যাওয়ার সময় কাজের কথা বলেছিল তখন তুমি কিছু বলেছিলে,,

পুনম আবারো না সম্মতি দিতে আরেকটা থাপ্পড় মারে
— তুমি তখনই কেনো বলনি তুমি এ বাড়ির কাজের লোক না যে তোমাকে দিয়ে কাজ করাবে তুমি তখনই কেনো বাড়িতে চলে যাওনি কেনো?? নাকি বাড়িতে যাওয়ার মতো টাকা তোমার কাছে ছিলো না,,,ছিলো না কথা চিল্লিয়ে বলে ওঠে পারভেজ সাহেব।

উপস্থিত সবাই কেপে ওঠে। রিয়াজ সাহেব ও তার স্ত্রী থমথমে মুখে বসে আছে। ঐ যে বলে না ঝিকে মেয়ে বউকে বুঝায় পারভেজ সাহেব সেই পন্থাই অবলম্বন করেছেন উনি তিনটা থাপ্পড় স্ত্রী সমন্দি ও তার বউকে দিয়েছেন এমন বুঝিয়েছে উপস্থিত সবাইকে।

পারভেজ সাহেব পিছন ফিরে স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বলে — পাঁচ মিনিট সময় দিলাম এর মধ‍্যে রেডি হয়ে এসো।
পারভেজ সাহেবের কথা শুনে তিন মা মেয়ে হতদন্ত হয়ে দৌড় দেয় নিজেদের ব‍্যাগ আনার জন‍্য। তিনি পুনমের দিকে আবার তাকিয়ে
বলল — আজ থেকে মনে করবে এই দুনিয়ায় তোমার কোনো আত্মীয় নেই তুমি শুধু তোমার জন‍্য। নিজেকে ভালোবাসো আগে।।

বলেই পুনমের হাত ধরে হনহন করে টেনে নিয়ে যায় বাড়ির বাইরে। অটো ঠিক করে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে উঠে বসে ছয় সীটের অটোতে অপরপাশে উঠে বসে তিন মা মেয়ে। সাই সাই করে চলতে থাকে অটো।
বাসায় পৌঁছে পুনমকে ডাকতে যেয়ে দেখে পুনমের গা হালকা গরম। রোজিনা দুই মেয়েকে নিয়ে নিজের মতো নেমে যায়। তার মুখটাও থমথমে সে তার ভাইয়ের অপমান মেনে নিতে পারছে না।।

পারভেজ সেদিকে একবার তাকিয়ে মেয়েকে বুকে জড়িয়ে ধীর স্বরে ডাকে — আম্মা ও মা মাগো উঠ,,

পারভেজ সাহেবের কন্ঠস্বর বুজে আসছে। এই মেয়েটা একদম তার মায়ের মতো হয়েছে সবকিছু তার মায়ের মতো। গরমের সময় তার জন‍্য দৌড়ে শরবত করা শীতের দিনে ভোরবেলা উঠে তার ওযুর জন‍্য গরম পানি করে দেওয়া। একজন মা তার ছেলের যেমন খেয়াল রাখে পুনম ও তার বাবার খেয়াল রাখে।

ধীরে ধীরে পুনমকে বিছানায় শুয়িয়ে দেয়। পুনম আব্বার দিকে তাকায়
— মাগো দুপুরে খেয়েছিলে

— নাহ
পুনম বলতেই দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে পারভেজ সাহেব। দীর্ঘ পাচঁ বছর পর আজ শশুর বাড়িতে পা দিয়েছিল পারভেজ সাহেব শশুর বাড়ির রাস্তায় পা না দেওয়ার প্রথম কারণও ছিলো পুনম। সেবার পুনমের খালা সহ সবাই বেড়াতে গিয়েছিল। তাই পুনমের খালা সবার জন‍্য জামা কাপড় এনেছিল তাদের তিন বোনের জন‍্যও এনেছিল। সেবার পুনম রুপশার জন‍্য আনা কালো জামাটা হাতে নিয়ে বলেছিল — খালামনি এটা আমি নেই আমার পছন্দ হয়েছে

পুনমের খালা পুনমের হাত থেকে জামাটা ছিনিয়ে নিয়ে বলে ওঠে — তুই তো এমনি কালা এই কালো জামা পরলে তরে আরও কাইল্লা লাগব।

সেদিন নয় বছরের পুনম গায়ের রঙের তফাৎ না বুঝলেও পছন্দের জামা না পেয়ে মন খারাপ করে ছিল। সেদিন সবটাই অবলোকন করেছিল পারভেজ সাহেব তবে কাউকে কিছু বলেনি তার পরের দিন চলে আসে নিজের পরিবার নিয়ে । এরপর পাচঁ বছর আর সেদিকে পা বাড়াননি।

তবে এবার রিয়াজ সাহেবের অনেক অনুরোধ ফেলতে না পেরে সবাইকে পাঠিয়েছিলেন কথা ছিলো আজ তিনি যাবেন। যদি জানতো তার দুঃখী মেয়েটার কপালে এবারও অপমান লেখা থাকবে তাহলে আর কোনো দিনও পাঠাতো না।

— আব্বা আর খাব না,,,

পুনমের কথায় ধ‍্যান ভাঙ্গে পারভেজ সাহেবের। সে পুনমকে একটা নাপা খাইয়ে আবার শুতে বলে চলে যায় বাইরে। উঠানে বসে ভাবতে থাকে তার প্রথম সন্তান রুপশার জন্মের পর রোজিনা চেয়েছিলেন এবার তার একটা ছেলে হোক কিন্তু তার ফরিয়াদ আল্লাহ্ তায়ালা কবুল করে নাই। হয়েছে মেয়ে তাও আবার কালো। সেদিন তাকে পারভেজ সাহেব কোলে নিয়ে নাম দিয়েছেন “পুনম ”

একে ছেলে না হওয়া দুই গায়ের রঙ কালো হওয়াতে ছোটবেলা থেকেই পুনম তার মায়ের অবহেলার পাত্রী।

#চলবে