পূর্ণিমা সন্ধ্যা পর্ব-০৭

0
41

#পূর্ণিমা_সন্ধ্যা
লেখক: নবনীতা শেখ
[৭]
ভার্সিটি থেকে টিউশনিতে গেল অরণী। ওর স্টুডেন্টের নাম মিথি। দেখতে ভীষণ মিষ্টি। হাসলে গালে টোল পড়ে বলে মিথি সারাটাক্ষণ হাসতে থাকে। নিজেকে সুন্দর দেখানোর জন্য মেয়েরা সবই করে। কেউ কেউ তো কাঁদতে গিয়েও আয়না দেখে, কীভাবে সুন্দর করে কাঁদা যায় তার অনুশীলন করে।

অরণীকে দেখে মিথি গালভরা হাসি দেখিয়ে সালাম দিয়ে বলল,
-“কেমন আছেন, ম্যাম?”

অরণী সালামের জবাব নিয়ে বলল,
-“এই তো ভালো আছি, তুমি?”
-“আমিও ভালো।”
-“ওকে, গতকালের পড়া পড়েছ?”

মিথি দু-ধারে মাথা নেড়ে নেতিবাচক জবাব দিলো। অরণী জিজ্ঞেস করল,
-“কেন?”
-“আসলে ম্যাম, গতকাল কী হয়েছে জানেন! আমার বয়ফ্রেন্ডের সাথে আমার ফার্স্ট ডেইট ছিল। ফিরতে ফিরতে রাত নয়টা বেজে গিয়েছিল। এসে আর পড়া হয়নি।”

অরণী বড়ো করে শ্বাস ফেলে বলল,
-“সামনে এইচএসসি, আর এটা তোমার ডেইটের সময়?”

মিথি হিহি শব্দ করে হেসে বলল,
-“অসময়ও তো নয়, ম্যাম। তাছাড়া হিসেব করে সময় মিলিয়ে কাজ করা যায় না। যখন করে ফেলা হয়, তখনই তার সময়।”
-“বুঝলাম। ফিজিক্স বের করো।”

মিথি বই বের করতে করতে আড়চোখে তাকাল অরণীর দিকে, ঠোঁট চেপে জিজ্ঞেস করল,
-“ম্যাম, আপনি কোনোদিন ডেইটে যাননি?”

এত বাড়তি কথা বলে মেয়েটা! অরণীর ইচ্ছে করল নিজের কপাল চাপড়াতে। অথচ তা করতে না পেরে সে অসহায় চোখে তাকিয়ে রইল। থমথমে গলায় বলল,
-“পড়ায় ফোকাস করো।”

জেদি, দুষ্ট ও অসম্ভব মিশুক মিথি দু-মিনিট পড়ে আবারও জিজ্ঞেস করল,
-“ম্যাম, আপনার বয়ফ্রেন্ডের নাম কী?”

অরণী শুনেও শুনল না যেন। মিথি এরপর বলল,
-“আমার ইয়ের নাম জিকু। আমার তিন বছরের সিনিয়র। পুরান ঢাকাইয়্যা। বাপজান মানবে না। এজন্য এইচএসসির পর পালাব। ম্যাম, আপনি বিবাহ করবেন না?”

তার সম্পূর্ণ কথায় ঠাট্টার সুর ছিল। এখনকার এই বাচ্চা-কাচ্চারা! হাহ্‌! বড়ো-ছোট মানে না, কার সাথে কী বলা লাগে তা-ও বোঝে না। অরণী হতাশ হয়ে ভাবল সেসব। প্রচণ্ড ধৈর্যের সাথে বলল,
-“তুমি কোন কোন টপিকে উইক, আমাকে জানাও। আজ সেগুলো প্র‍্যাক্টিস করব।”

মিথি বলল,
-“আমি আন্ডারস্ট্যান্ডিংয়ে উইক, ম্যাম। জিকুর কলকাতা বলার জন্য মুখ খুলে ক বললে, আমি কুত্তার বাচ্চা শুনতে পাই। এরপর ঝগড়া লাগিয়ে দিই এই বলে—অই বাঙ্গিরফু, তুই আমারে কুত্তার বাচ্চা কইলি কোন সাহসে?”

মিথি একটু থামল, চরম হতাশ গলায় বলল,
-“আপনিই বলেন ম্যাম, এভাবে কী চলে?”

ধৈর্য-অধৈর্যের বর্ডারে দাঁড়িয়ে অরণী বলল,
-“ফার্স্ট পেপারে কোনো সমস্যা নেই, তাই তো?”

মিথি এবার পড়ায় মন দিলো। অরণী হাঁফ ছেড়ে বাঁচল।

_________
ইফতির সাথে অরণীর দেখা হলো মেট্রোস্টেশনে। দুইজনই বাসায় ফিরছে। ইফতি আগ বাড়িয়ে কথা বলেনি, অরণীও না। অথচ দুইজন দুইদিকে না গিয়ে বরঞ্চ দুই-হাত ব্যবধানে এগোচ্ছে৷

আচমকা ইফতি লক্ষ করল একটা আধবয়সী লোক অরণীর খুব কাছ দিয়ে এগোচ্ছে। একটু পর পর দূরত্ব কমাচ্ছে। সে হাত ওঠাল ছোঁয়ার তাগিদে, চোখে লালসা। আচমকা ইফতির রক্ত মাথায় উঠে গেল৷ তীব্র রাগমিশ্রিত চোখে তাকাল সে। খপ করে ধরে ফেলল হাতটা।

লোকটা ভয় পেয়ে ইফতির দিকে তাকাল। ইফতি ওখানেই স্থির দাঁড়িয়ে আছে রক্তলাল চোখে। হাতের শিরা ফুলে উঠেছে। অরণী তখন অনেকটা এগিয়ে গেছে। লোকটা কিছু বলতে মুখ খুলতে যাচ্ছিল, ওমনিই ইফতি ঘুষি মেরে বসল লোকটার বাম চোয়ালে। মুহূর্তেই লোক জড়ো হয়ে গেল এখানে, আশেপাশে ভীড় ও কোলাহল জমে গেল। ইফতি দুই ঘুষিতেই লোকটাকে ফেলে দিয়েছে রাস্তায়। বাকিটা পাবলিক দেখে নেবে।

অরণী আওয়াজ পেয়ে এদিকে তাকিয়ে ভীড় ছাড়া কিছু দেখতে পেল না। পাশে যে ইফতি নেই, এটুকু দেখেই স্বস্তির শ্বাস ফেলল। কিছুটা এগোতেই কোত্থেকে যেন পাশে এসে ইফতি দাঁড়াল। অরণী দেখেও চোখ সরিয়ে নিল। ইফতি পাশাপাশি যথেষ্ট দূরত্ব রেখে হাঁটতে হাঁটতে ডাকল,
-“অরণী?”

অরণী জবাবে ছোট্ট করে বলল,
-“বলুন।”

ইফতি সামনে তাকিয়েই বলল,
-“আপনার প্রতি আমার অসীম কৌতূহল। আমি আগ্রহ দমাতে হিমশিম খাচ্ছি। এমতাবস্থায় কী করতে পারি?”

অরণী এতে বিন্দুমাত্র অবাক হলো না। নির্লিপ্তভাবে বলল,
-“ব্যাপার না। সৃষ্টির শুরু থেকেই নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি মানুষের প্রবল আগ্রহ।”

ইফতি থমকে গেল সামান্য,
-“আপনি আমার জন্য নিষিদ্ধ?”

আশে-পাশে তাকিয়ে অরণী বলল,
-“হ্যাঁ।”
-“আপনি নিশ্চিত?”
-“হ্যাঁ।”

তারা নিজেদের বাড়ির গলিতে চলে এসেছে। এদিকে মানুষের যাতায়াত নেই বললেই চলে। ইফতি ভীষণ অবাক হয়ে সেখানেই দাঁড়িয়ে পড়ল। তা দেখে কিছুটা সামনে অরণীও দাঁড়াল। এগিয়ে গিয়ে মুখোমুখি হলো ইফতি, শক্ত গলায় শুধাল,
-“কীভাবে?”

অরণী চোখে চোখ রাখল। দৃঢ়তার সাথে বলল,
-“পুরুষমানুষের প্রতি বিন্দুমাত্র ঝোঁক আমার নেই, ইফতি। আপনি সুদর্শন, আপনি ব্যক্তিত্ববান; আপনি বড়ো সুপুরুষ। অথচ আমি এদিকটায় ভীতসন্ত্রস্ত।”

একই ব্যথা তবে? ইফতির কেমন অদ্ভুত অনুভূত হলো। সে কিছু বলতে চেয়েও পারল না। কী বলবে, তা-ও ভেবে পেল না। পাশকাটিয়ে অরণী চলে গেল। যাওয়ার আগে কোমল গলায় বলে গেল,
-“ইফতি, নিজেকে সংযত করুন। আপনাকে কষ্ট পেতে দেখলে আমার ভালো লাগবে না।”

_______
এরপর কেটে গেল আরও চারমাস। ইফতি নিজেকে সংযত করা তো দূর, কৌতূহলী কদম আটকাতে অবধি পারেনি। সে একপা দু’পা করে এতটা দূরে এগিয়ে গেছে যে এখন আর ফেরার পথ নেই। ব্যাপারটা এমন না যে, সে প্রেমে পড়েছে অরণীর। প্রেম জিনিসটা ভিন্ন। সেরকম অনুভূতি আসেনি এখনও। তবে এর চেয়েও ভয়ংকর কিছু ঘটেছে। অদ্ভুত কিছু, বিশেষ কিছু, অন্যরকম কিছু, ক্ষতিকর কিছু। সেই কিছু একটাকে আমরা চাইলে অভ্যেস বলতে পারি।

ইফতির ইচ্ছে করলে গুলশান থেকে অফিস করতে পারত। ওখান থেকে দূরত্ব কমই বটে। অথচ তা না করে কাজিপাড়ার এই ফ্ল্যাটেই থাকছে সে। এখানে থাকতেই স্বস্তি বোধ করছে। শান্তি পাচ্ছে। যখনই অস্থিরতায় হাঁসফাঁস করতে থাকে, তখনই সে ওপরের ফ্ল্যাটের ভীষণ উদ্ভট মেয়েটাকে ভাবে। সেই মেয়েটা তারও অধিক একাকিত্বে স্থির থাকছে। সে কি মেয়েটার চেয়েও বেশি দূর্বল? সে কেন অল্পতেই ভেঙে পড়বে? এসব ভেবে ইফতির আর দুঃখবিলাস করা হয় না। দু-চারটে সিগারেট উড়িয়ে কাজে মনোযোগী হয়।

অভ্যস্ত কাজগুলোর বিশ্লেষণে—সে রোজ ভোরে উঠে বারান্দায় গিয়ে বসে। কাজ করতে করতে বেতের সোফাটিতে জড়োসড়ো হয়ে ঘুমিয়ে পড়া মেয়েটাকে ভোরের প্রথম আলোয় ভীষণ স্নিগ্ধ দেখায়। ইফতির দিনের শুরুটা এভাবেই হয়, তাকে দেখে। এরপর অফিস যায়। ফেরে বিকেলের পর। তখন থেকে বারান্দায় বসে স্মোক করতে করতে অপেক্ষায় থাকে মেয়েটির বাসায় ফেরার।

খুবই সাধারণ, অথচ ইফতি চোখ ফেরাতে পারে না এমন ভঙ্গিমায় গলির ওই মাথা থেকে এগিয়ে আসতে থাকে মেয়েটা। পরনে সবসময় হালকা রঙের গোলজামা, প্লাজো আর ওড়না। চুলগুলো বেশিরভাগ সময় বিনুনি গাঁথা থাকে। মাঝেমধ্যে হয়তো কোনোরকমে একটা কাটা দিয়ে খোঁপা করে রাখে। মুখে কখনও কোনো প্রসাধনী ব্যবহার করে না। চোখে সামান্য কাজলও না। ইফতির বড়ো ইচ্ছে করে, এই মেয়েকে সাজতে দেখতে। কেননা সজ্জিত অরণীকে কল্পনা করাটা একটু কষ্টসাধ্য ইফতির জন্য।

অরণী তটস্থ পায়ে যখন এগিয়ে আসতে থাকে, ইফতির জ্বলজ্বলে দৃষ্টি একমুহূর্তের জন্যও অন্যত্র যায় না তখন। সে নিষ্পলক দেখে। যেন একসেকেন্ড অন্যদিকে তাকালে, সেই এক সেকেন্ডই অরণীকে দেখা থেকে সে বঞ্চিত হবে।

মাঝেমধ্যে ইফতি ছাদেও যায় এখন। অরণীকে সন্ধ্যের দিকে ছাদে পাওয়া যায়। এই সময়টা অরণীর বিশেষ সময়। সে তখন ছাদের মোটা রেলিংয়ের ওপর বসে বসে বই পড়ে, চা খায়। তনুজার পোষা বিড়ালটা ছাদে ঘুর ঘুর করতে থাকে। ইফতি সেই বিশেষ সময়ে কফির মগ হাতে নিয়ে ছাদে যায়। পুরো ছাদে পদধূলি ফেলতে ফেলতে কফি শেষ করে, আড়চোখে অরণীকে দেখতে থাকে। কফি শেষ হতেই চলে আসে। অরণীকে কিছু বলে না সে, অরণী নিজ থেকেও কিছু বলেনি কোনোদিন।

আজ পূর্ণিমা। সন্ধ্যের আকাশটা ভোরের সূর্য ওঠার আগমুহূর্তের আকাশের মতো দেখা যাচ্ছে ঠিক। কেমন মিষ্টি জোৎস্না। মন খুশি হয়ে যায় এমন দিনে। একই প্রস্তুতি নিয়ে ইফতি কফি বানিয়ে ছাদে এলো আজ। পরনে তার অলিভ রঙের টিশার্ট, কালো ট্রাউজার। ছাদের দ্বারে পা রাখতেই একনজরে পুরো ছাদে চোখ বোলাতে লাগল ইফতি।

কার্ণিশে এসে চোখ আটকে গেল তার। বিস্মিত হলো সে। অরণীর পরনে হালকা রঙের একটা শাড়ি। সে এই প্রথম তাকে শাড়ি পরিহিত দেখল। সন্ধ্যে সন্ধ্যে সময় বলে ঠিক রংটা বোঝা যাচ্ছে না। চুলগুলো খুলে একপাশে এনে রাখা। প্রসাধনী ছাড়া মুখটা চাঁদের আলোয় জ্বলজ্বল করছে। হাতে রয়েছে একটা বই। চাঁদের আলোয় বই পড়া যায় না।

আরও লক্ষ করে ইফতি দেখল, অরণী আসলে বই পড়ছে না। বইটা ভাঁজ করে কোলের ওপর রেখে দিয়েছে। সম্ভবত বিকেলের পর পর এসেছিল এখানে। তখনই পড়ছিল। আলো নেমে এলে বইটা এখানে রেখে দেয়।

ইফতি এগিয়ে গিয়ে দাঁড়াল অরণীর পাশে। অরণী মাথা ঘুরিয়ে তাকিয়ে বলল,
-“কিছু বলবেন?”

ইফতি মাথা নাড়ল ইতিবাচকভাবে। অথচ কিছু বলল না। মিনিট পাঁচেক নিস্তব্ধতাকে উৎসর্গ করে কাটিয়ে অরণী বলল,
-“বলুন, ইফতেখার।”

ইফতি বড়ো করে শ্বাস টেনে বলল,
-“তোমাকে চাঁদের মতো দেখাচ্ছে।”

অরণী মলিন হাসল,
-“পরনির্ভরশীল?”

এমন প্রশংসনীয় বাক্যের বিপরীতে কেউ যে এমন বাঁকা প্রশ্ন করে, ইফতির জানা ছিল না। তাই সে কী বলবে তা-ও ভেবে পেল না। অরণী আপনমনে বলা শুরু করল,
-“চাঁদ, সে সূর্যের আলোয় নিজেকে আলোকিত করে। তার নিজস্বতা নেই। সে রাতের আঁধারে আসে, রাত শেষ হতেই বিদায় নেয়। এমন বিশেষণ আমার কাছে প্রশংসনীয় লাগে না।”

ইফতি মুচকি হেসে বলল,
-“চাঁদ, সে স্নিগ্ধ। সে সৌন্দর্যের আরেক নাম। সে বিশুদ্ধতার আরেক নাম। সে জাগতিক সকল আঁধার শুষে নেয়। দিনের সময় তো কাউকে প্রয়োজন পড়ে না, সে রাতে আসে, সে দুঃসময়ে আসে। লক্ষ করো, এখানে দিন হচ্ছে সুসময়, রাত হচ্ছে দুঃসময়। তুমি কি তবে চাঁদ নও? এখনও দ্বিধা করবে?”

অরণী ছলছল চোখে তাকাল। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ইফতি অরণীর মাথায় হাত রেখে বলল,
-“একা লাগছে? চাঁদের মতো?”

চলবে…