পূর্ণিমা সন্ধ্যা পর্ব-০৮

0
43

#পূর্ণিমা_সন্ধ্যা
লেখক: নবনীতা শেখ
[৮]
অরণী ছলছল চোখে তাকাল। কিছুটা এগিয়ে গিয়ে ইফতি অরণীর মাথায় হাত রেখে বলল,
-“একা লাগছে? চাঁদের মতো?”

বিষণ্ণ পৃথিবীটার সকল বিষ ও যন্ত্রণা যেন এক মুহূর্তেই শুষে নিল এই দুটো বাক্য। হয়তো বাক্যে বিদ্যমান নমনীয়তা ও মাথায় রাখা ভরসার হাত অরণীর ভীষণ রকমের স্বস্তির কারণ হয়ে দাঁড়াল।

আকাশে একটা থালার মতো চাঁদ। আলো ছড়াচ্ছে বিক্ষিপ্তভাবে। কী সুন্দর! লক্ষ করা গেল, পূর্ণিমার জোৎস্নার এক ধরনের বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে। সকল সুন্দর জিনিসের সৌন্দর্য বহুগুণে বাড়িয়ে তোলার বিশেষত্ব। ইফতির অদ্ভুত লাগল। এতদিন চোখের জলের সাথে মুক্তোর দানার মতো বিশেষণ বহুবার সে শুনেছে। তবে এই প্রথম বাস্তবিকপক্ষেই তা উপলব্ধি করল।

চোখ বুঁজে ফেলল অরণী। পরপর তাকাল তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে। জলে ভেজা চোখ দুটো অসম্ভব শাণিত। গলার আওয়াজে কাঠিন্য চলে এলো নিমিষেই,
-“ততক্ষণ অবধি একটা মানুষ একা নয়, যতক্ষণ সে আত্মনির্ভরশীল হয়ে প্রবল আত্মবিশ্বাসের সাথে আত্মমর্যাদা রক্ষা করে চলে। যখনই সে ঢলে পড়ে, তখনই মানুষের প্রয়োজন হয়, একাকীত্ব অনুভূত হয়। ইফতেখার, নিজেকে নিজ দায়িত্বে গড়ে নেওয়া মানুষেরা আর যাই হোক, মানুষের অনুপস্থিতি উপলব্ধিতিতে গুমোট হয় না।”

অরণী বেশ দাম্ভিকতার সাথে কথাগুলো বলল। প্রকৃতিও নিজের দম্ভ দেখাল। ভীষণ প্রশান্ত বাতাস স্থির লাগল, ভ্যাপসা গরম উপলব্ধ হলো। প্রকৃতি নিজ অহংবোধে যখন স্থিরতা প্রকাশ করল—ইফতি তাতে কিঞ্চিৎ হাসল,
-“ম্যাডাম, স্রষ্টা তবে নারী ও পুরুষ সৃষ্টি না করে শুধুই একপক্ষকে সৃষ্টি করত।”

ইফতি থামল। কিছুটা ঝুঁকে এসে চোখে চোখ রেখে ফিসফিসিয়ে বলল,
-“পৃথিবীতে পরিপূরক শব্দটা অস্তিত্বশঙ্কায় পড়ে যেত না?”

অরণী চোখ সরিয়ে অন্যত্র তাকাল। ইফতি প্যান্টের পকেটে হাত গুঁজে টানটান হয়ে দাঁড়িয়ে রইল আরও মিনিট খানেক। এরপর আস্তে-ধীরে প্রস্থান ঘটাল। অরণী সেখানেই বসে রইল মধ্যরাত অবধি। চিন্তা-ভাবনা বিক্ষিপ্ত তার। এই অসহ্যরকমের অস্বস্তিপূর্ণ পুরুষের মুখাবয়ব বার বার চোখের সামনে ভাসতে লাগল। তার একেকটা বাক্য কী পরিষ্কারভাবে শোনা যেতে লাগল। অরণী চাইছে না এসব। অথচ মানুষ যা চায় আদতে কি তা পায়? যা পায়, তা-ই কি চায়?

______
“আশঙ্কা ও ভীতিতে অক্ষীণ অস্তিত্ব নড়বড়ে হয়,
তব কিঞ্চিৎ পদচারণে, মোর সর্বাত্মক অবক্ষয়॥”
– আঞ্জুমান অরণী

ভীষণ ব্যক্তিগত ডায়ারিতে গুটিকয়েক শব্দ লিখে অরণী থামল। শেষবার ছাদে ইফতির সাথে মুখোমুখি দেখা হয়েছিল, সে ঘটনার মাস দুই কেটেছে। এরপর পড়াশোনা, কাজে ভীষণ ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল অরণী। আজ তার ফাইনাল সেমিস্টার শেষ হলো। কিছুটা স্বস্তি পেতেই যখন বাড়তি ভাবনা মাথায় আনল, ভীষণ রকমের অস্বস্তিতে মূর্ছাগত হলো সে। ইফতেখার মাহমুদ! নামটা কেন এত জ্বালাচ্ছে?

অরণী বেশ কিছুক্ষণ ছাদে পায়চারি করল। এরপর সিঁড়ি বেয়ে দোতলায় গেল। একপাশে ইফতির ফ্ল্যাট। অরণী অন্যপাশের ফ্ল্যাটের কলিং বেল চাপল। কিছুক্ষণের মাঝেই এক সুন্দরী নারী দরজা খুলে মুচকি হেসে বলল,
-“আরে বাবারে! কী খবর? ভেতরে এসো!”

অরণী ভেতরে এসে বলল,
-“ভালো আছেন?”

তনুজা দরজা আটকাতে আটকাতে বলল,
-“বেশ আছি। তুমি?”
-“আমিও।”
-“বোসো।”

অরণী লিভিং রুমের ওপাশের একটা সোফায় বসল। তনুজা কিছু মিষ্টি একটা প্লেটে সাজিয়ে এনে সেন্টার টেবিলে রেখে বলল,
-“মিষ্টি মেয়ে, মিষ্টি খাও।”

অরণী বলল,
-“এসবের প্রয়োজন ছিল না, তনু আন্টি।”

তনুজা ওখান থেকে একটা মিষ্টি নিয়ে খেতে খেতে বলল,
-“অবশ্যই প্রয়োজন ছিল। তোমার যা বয়স, এই বয়সে বেশি বেশি খাবে।”

অরণী অসহায় মুখে তাকিয়ে বলল,
-“অথচ আমি হাওয়া খেলেও ফুলে যাই। সেখানে মেইনটেইন না করে খেলে দেখা যাবে পরদিন বেলুন হয়ে আকাশে উড়ে গেছি।”

তনুজা মুখের সামনে হাতের উলটো পিঠ রেখে হেসে বলল,
-“আমি সবকিছু খেতে পারি। কোনো সমস্যা হয় না।”
-“আল্লাহর বিশেষ রহম আপনার ওপর।”

তনুজা হাসতে হাসতেই বলল,
-“হ্যাঁ। আমার স্রষ্টা সবাইকে সব দিক থেকে কষ্টই কেবল দেন না। তিনি কিছু ক্ষেত্রে স্বস্তিও দেন।”

অকস্মাৎ অরণীর হাঁসফাঁস লাগতে লাগল। সে সেন্টার টেবিল থেকে পানি উঠিয়ে পুরোটা শেষ করল। এরপর ছোট্ট ছোট্ট শ্বাস ফেলতে লাগল। তনুজা নিচু স্বরে শুধাল,
-“অল ওকে?”

ওপর-নিচ মাথা নাড়ল অরণী। তনুজা বলল,
-“কিছু বলতে চাও?”

কোনোরকমের ভণিতা না করে সরাসরি বলল অরণী,
-“লাইফগেইমে বিশ্রীরকমভাবে হারের সম্মুখীন হয়ে অনেক কষ্টে একটা কূল খুঁজে পেলাম। এরপর যখন এগেইন লাইফ ওয়ান্টস টু প্লে উইদ মি, আমার কি এই গেইমে পার্টিসিপেট করা উচিত?”

তনুজা ভাবুক হলো,
-“গভীর প্রশ্ন!”

উত্তরের অপেক্ষায় চাতক পাখির ন্যায় তাকিয়ে রইল অরণী। তাকে বড়ো অস্থির দেখাচ্ছে। তার দৃষ্টি বিক্ষিপ্ত। তার মনের অবস্থা তনুজা হয়তো সামান্য বুঝল। আড়াআড়িভাবে অরণীর দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করল,
-“সেল্ফ-কনফিডেন্ট তুমি?”
-“নিঃসন্দেহে।”
-“দেন হোয়াই ডোন্ট ইউ গিভ অ্যানাদার চান্স টু প্লে?”

তনুজা মুচকি হেসে ফের বলল,
-“এইবার হয়তো জিতে গেলে!”

অরণী জিজ্ঞেস করল,
-“যদি আবারও হেরে যাই?”
-“হারলে হারবে। তবে জীবনযুদ্ধে থেমে থাকা চলবে না। প্রথমবার হারবে, দ্বিতীয়বার হারবে, তৃতীয়বার হারবে, চতুর্থবার আরও বাজেভাবে হারবে। হয়তো পঞ্চমবারে জিতে গেলে? মানছি, প্রতিনিয়ত সব কঠিন হতে থাকবে। তাই বলে থেমে থাকলে চলবে? এখন তুমি যদি চতুর্থবারেই থেমে যাও, তবে জয়ী হবে কী করে?”

অরণী তবুও দ্বিধা দূর করতে পারছে না। তার চাহনিতে প্রকাশ পাচ্ছে৷ সে তনুজাকে বলল,
-“যদি ভীষণ কষ্টে নিজেকে তৈরি করা আমিটাই ভেঙে পড়ি?”
-“তবে আবার গড়বে। নিজেকে একবার যে গড়তে শিখে যায়, সে তো ভেঙে পড়ায় ভীত নয়।”
-“যদি দ্বিতীয়বার না পারি?”
-“বার বার পারবে। প্রকৃতি পাষণ্ডীকে ভেঙে দেয়, পথচলতি পথে শক্ত হতেও শিখিয়ে দেয়।”
-“যদি জীবন্মৃত থেকে জীবনের অস্তিত্ব মুছে যায়?”
-“যতদিন আয়ু আছে, ততদিন বাঁচবে, ততদিন জীবনযুদ্ধে লড়ে যাবে।”

অরণী প্রশ্ন করতে পারল না আর। নিশ্চুপ বসে রইল। তনুজা উঠে গিয়ে তার পাশে বসল। তার ডান গালে হাত রেখে মিষ্টি করে হেসে বলল,
-“জীবন আমাকেও একটা বিশ্রী মোড়ে এনে দাঁড় করিয়েছিল। অনেক অনেক ভেবে বুঝতে পেরেছিলাম, আমার গল্পটা সুখের চেয়ে অসুখেই সুন্দর বেশি। তারপর একমুঠো কষ্টের সাথে আমি একাকী জীবন বেছে নিলাম। আর তাই সঙ্গীর অভাব, সঙ্গের অভাব—দুটোই গভীরভাবে উপলব্ধি করি। ভীত আমিটা সুযোগ পেয়েও সুখের দিকে এগোইনি।
কিন্তু তোমার ক্ষেত্রে ব্যাপারটা ভিন্ন। তোমার বেলায় কোনো অপ্রেমের কারবার নেই, কোনো অসুখের হাতছানি নেই। তাই আমি যেটা বেছে নিয়েছি, তুমি তা নিয়ো না। এমন ভুল কোরো না। যখন যখন সুযোগ পাবে, হাতিয়ে নেবে সঙ্গে সঙ্গে। ফলাফল নিয়ে ভেবো না। প্রকৃতির নিয়ম বিচিত্র। ভুলকেও তারা ফুল দেয় কখনও সখনও। এই ‘কখনও-সখনও’-টা কোন কোন ক্ষেত্রে হবে, তা বোঝা যায় না আগে থেকে।”

অরণীর চোখ দুটোয় এবার সংশয়ের বদলে যেন ভিন্ন কিছুই দেখা গেল। তাতে জ্বলজ্বল করছে অন্যকিছু। প্রবল আত্মবিশ্বাস অর্ধেক জয় এনে দেয়। এ কথা বোধহয় অরণী এবার টের পাবে।

ওদিকে রাত বাড়তে শুরু করেছে। মধ্যরাতে একাকী ঘরে নিশ্চুপ বসে আছে আমজাদ। তার সব গেছে। দুঃখের সাগরে কোনো কূল সে পাচ্ছে না। সবচেয়ে বিশ্রী যেই জিনিসটা ঘটছে তার সাথে, তা হলো—সে কিছু বুঝে উঠতে পারছে না। কী থেকে কী হয়ে গেল! তার এত সুখের একটা সংসার সে নিজ হাতে নষ্ট করল। সে নিজের ভুল মানছে। মানুষমাত্রই ভুল হয়। তাই বলে কি আয়শা আর অরণী একবারও খোঁজ নিল না তার? আত্মগরিমায় ভেসে যাচ্ছে আমজাদ। নিজের কোনো দোষ দিতে সে নারাজ। তার চোখে কেবল পড়ছে মেয়ে ও স্ত্রীর উড়নচণ্ডী দশা। তার মতে, পুরুষমানুষ যা মর্জি করবে; নারীজাতি কেন বাড়ির বাইরে পা রাখার এত সাহস দেখাবে? এত সাহস হয়েছে দু’জনের যে তালাকের কাগজ পাঠিয়ে দেয়!

অথচ উন্মাদ আমজাদ জানেই না, সে সব নির্বোধ অভিযোগ করে বেড়াচ্ছে! অভিযোগগুলো তার প্রাক্তন স্ত্রী প্রতি ও সেই সন্তানের প্রতি, যে সন্তান তাকে পিতা হিসেবে সকল ধরনের দায় থেকে মুক্ত করে দিয়েছে।

______
ইফতি পেশার একজন আর্কিটেক্ট। এই ত্রিশ বছর বয়সে যৌবনের কঠোর পরিশ্রমে বেশ ভালো একটা পর্যায়ে সে নিজেকে এনে দাঁড় করিয়েছে। সম্মান ও গুরুত্ব সবখানেই সমানভাবে পায়। আজ একটা প্রজেক্টের কাজ নিয়ে অফিস থেকে আগারগাঁও যেতে হয়েছিল। সেখানে রাত হয়ে আসে। এরপর ক্লান্ত শরীরে গুলশান যেতে ইচ্ছে করেনি। ওখান থেকে কাজিপাড়া চলে আসে।

ইফতি যখন বাড়ির ভেতরে প্রবেশ করল, করিম বলল,
-“বাজান, ভালো আছেন?”

ইফতি মলিন হেসে বলল,
-“চলছে দিনকাল। তোমার কী অবস্থা?”
-“আল্লাহয় রাখসে।”

আড়চোখে ইফতি ছাদের দিকে ইশারা করে বলল,
-“আর ওপর তলার ম্যাডামের?”

করিম লাজুক হাসল,
-“আপনার খোঁজ করসিলো দুইবার।”

ইফতি তাকাল করিমের দিকে,
-“কী জিজ্ঞেস করেছে?”

করিম মাথা চুলকাতে চুলকাতে বলল,
-“কইসিলো, ‘বাড়িওয়ালার ছেলে আইসবে কবে?’
আমি অ্যালা কইলাম, ‘তারে দিয়া কী কাম? কী করবেন? আমারে কন।’
হেতি কইলো, ইটিশপিটিশ করব চাচা, আপনে করবেন?”

কথাগুলো বলে করিম সব ক’পাটি দাঁত বের করে হাসল। ইফতিও হেসে ফেলল তাতে। প্রশ্নাত্মক ভঙ্গিমায় বলল,
-“আচ্ছা?”

চলবে..