পূর্ণিমা সন্ধ্যা পর্ব-১৩ এবং শেষ পর্ব

0
51

#পূর্ণিমা_সন্ধ্যা
লেখক: নবনীতা শেখ
[১৩]
গোটা এক সপ্তাহ হয়ে গেল আয়শার চলে যাওয়ার। অরণী একদম নিশ্চুপ হয়ে গেছে। মাকে যতক্ষণ সামনে পেয়েছে সে দেখেছে৷ কোনো শব্দ করার ক্ষমতা পায়নি আর সেদিন। তারপর মা চলে গেল। অরণীর পুরো দুনিয়া যেন এক নিমিষেই থমকে গেল। এসব তো হওয়ার কথা ছিল না! এসব তো ভাবেইনি। সে ভেবেছিল, মাকে কীভাবে কীভাবে ভালো রাখা যায়, কী কী করা যায় ভবিষ্যতে। মা সেদিন বলেছিল, আগে বাবার সাথে বিভিন্ন জায়গায় ঘুরতে যেত। অরণী তখনই ভেবে রেখেছিল, এখন থেকে প্রতি উইকেন্ডে মাকে নিয়ে ঘুরতে যাবে সে।

অরণীর নিঃশ্বাস নিতেও কষ্ট হয় এখন। এই বাড়ির প্রতিটা দেয়ালের দিকে তাকালেই কেমন ডুকরে কান্না পায়। মাথাটা ভার হয়ে আসে। যেদিন ও বাড়ি থেকে মায়ের হাত ধরে চলে এসেছিল, সেদিন তো কত কিছুই ভেবেছিল! এখন জীবন সুন্দর হবে, গোছানো হবে! কই? কী হলো এসব? অরণী চারপাশে তাকাল। কেউই নেই!

আচমকা কল আসে ফোনে। জড়োসড়ো হয়ে বসে থাকা অরণী আতকে ওঠে শব্দে। তারপর ফোনটা হাতে নেয়। কল রিসিভ করে। ইফতি জিজ্ঞেস করে,
-“কী করছ?”

অরণী থেমে থেমে বলে,
-“কি-ছু না।”
-“আমি খাবার রেখে এসেছিলাম। খেয়েছ?”
-“না।”
-“দুপুর হয়ে গেল তো, খাওনি?”
-“উঁহু।”

ইফতি কোমলভাবে বলল,
-“না খেয়ে থাকলে কিছু হবে? তোমার মা ফিরে আসবেন?”

অরণী কান্নাভেজা গলায় বলল,
-“না।”
-“তবে? লক্ষ্মী হয়ে খেয়ে নাও। আমি দ্রুত ফিরে আসব, হু?”
-“হু।”

তনুজা কলেজ থেকে ফিরে সোজা অরণীর ফ্ল্যাটে চলে এলো। যতটা পারে সে এখন অরণীর সাথেই থাকার চেষ্টা করে। একটা শক্তপোক্ত মেয়েকে এক ঝটকায় ভেঙে গুড়িয়ে যেতে দেখে সে নিজেও কিছুটা ভীত হয়ে আছে! মানসিক অবস্থা বেশ খারাপ অরণীর। তার ধারণা, অরণী যে-কোনো সময় সুইসাইডাল এটেম্পট নেবে। অথচ এটা যাতে না করে, তাই সর্বোক্ষণ জীবন নিয়ে বিভিন্ন গল্প বলে যায় তনুজা। অরণী চুপচাপ শোনে। মাঝে মাঝে চোখ ভিজে আসে তার। এ-ই তো.. এভাবেই চলছে।

ইফতি বিকেলের দিকেই ফিরল অরণীর কাছে। সকালে দেখে গেছিল, যেভাবে বসে আছে এখনও সেভাবেই বসে আছে। ইফতি ওর মুখোমুখি বসল। পরনে একই কাপড় মেয়েটার। গোসলও করেনি! ইফতি জিজ্ঞেস করল,
-“খেয়েছ?”

অরণী খেয়াল করল ইফতি এসেছে। ছোট্ট করে বলল,
-“হু।”
-“আমি বাথরুমে কাপড় গুছিয়ে রেখে আসছি, শাওয়ার নিয়ে নাও। কেমন?”
-“আচ্ছা।”

ইফতি কাপড় রেখে এলো। অরণী শাওয়ার নিল আধ ঘন্টা ধরে। রুমে আসার পর ইফতি জিজ্ঞেস করল,
-“রাতে কী খাবে? কী বানাব?”
-“জানি নাহ।”
-“পরোটা?”
-“আচ্ছা।”
-“না-কি অন্য কিছু?”

অরণী তাকিয়ে রইল কেবল। ইফতি মেয়েটাকে এই গত এক বছরের মধ্যে এতটা মলিন কোনোদিনই দেখেনি। যেই মেয়ের দৃঢ় চাহনিতে সে বাঁধা পড়েছিল, সেই মেয়ের উদাসীন দৃষ্টি তার বুকে কেমন কেমন যে ক্ষত আঁকে—বলে বোঝানো যায় না।

ইফতি রান্না করল। তারপর অরণীকে মুখে তুলে খাইয়ে দিলো। আরও অনেক গল্প করল। নিজের জীবন নিয়ে, যেভাবে চলছে তা নিয়ে, বিভিন্ন রসিকতাও করল। অথচ মেয়েটা নির্জীব যেন!

রাতে ইফতি ড্রয়িংরুমেই থাকল আর অরণীর সাথে তনুজা ঘুমোল। এইভাবেই দিন যাচ্ছে। কিন্তু এভাবে আর কতদিন? ইফতির দীর্ঘশ্বাস আসে শুধু। অরণীর দিকে তাকালেই বুকটা ফেঁটে আসে তার।

এভাবে আরও ক’টা দিন কেটে গেল। ইফতি অফিসের একটা মিটিংয়ে ছিল। আচমকা তার কল বেজে ওঠে। কলটা অরণীর। এই কয়দিনে অরণী নিজ থেকে একবারও কল দেয়নি। এই প্রথম দিয়েছে। কাজেই ইফতির কাছে মিটিংয়ের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ এখন অরণীর কল পিক করা। সে সবাইকে একটু অপেক্ষা করতে বলে, মিটিংরুম থেকে বেরিয়ে গেল ফোনটা নিয়ে। কল রিসিভ করেই বলল,
-“হ্যালো? অরণী? কী করছ?”

ওপাশ থেকে ভেসে এলো অপরিচিত একটা আওয়াজ! সে জানাল, অরণীর এক্সিডেন্ট হয়েছে রোকেয়া সরণীতে। এখন পার্শ্ববর্তী একটা ক্লিনিকে আছে সে। কন্ট্যাক্ট লিস্টে তার নাম্বার ছিল বলে, তাকেই কল করা হয়েছে। ইফতি যেন দ্রুত সেখানটায় চলে আসে।

ইফতি একমুহূর্তের জন্য থ মেরে গেল। মস্তিষ্কে ভেসে আসছিল অরণী, অরণী ও শুধুই অরণী। পরক্ষণে সে ছুটে গেল ক্লিনিকে।

________
সম্পূর্ণ সাদায় মোড়ানো একটা রুমের মাঝে রাখা বেডে অরণী বসে আছে। তার পরনে সাদা জামা। হাতে ও কপালে ব্যান্ডেজ করা। নিষ্পাপ চেহারা নিয়ে বসে আছে সে। ইফতি তার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। অরণী তাকাল চোখ তুলে। সাদা শার্ট ইন করে পরা ফর্মাল লুকে দাঁড়িয়ে আছে ইফতি। গলার কাছের বোতাম দুটো খোলা। স্লিভস ফোল্ড করা। আর মুখ অসম্ভব লাল হয়ে আছে।

অরণীকে চুপ থাকতে দেখে ইফতি জিজ্ঞেস করল,
-“কী সমস্যা?”

পালটা প্রশ্ন করল অরণী,
-“কী?”
-“এসব কী? বাইরে এসেছ কেন?”
-“একা ভালো লাগছিল না বাসায়।”
-“আমাকে জানিয়েছিলে? একা কেন বের হয়েছ?”

অরণী মিনমিনে স্বরে বলল,
-“এমনিই। ভেবেছিলাম ফুটপাত দিয়ে হাঁটব একটু। রোডক্রস করতে গিয়ে এ-ই হলো…”
-“ওভারব্রিজ নেই? আশ্চর্য মেয়েলোক তো! আমি তোমাকে নিয়ে কতটা টেনসড থাকি, ধারণা আছে তোমার?”
-“সরি।”
-“এখন তোমার সরি দিয়ে আমি কী করব? এই যে ব্যথা পেলে, এগুলো সেরে যাবে?”
-“বকছেন?”
-“বকছি।”

অরণী মাথা নিচু করে ফেলল। কান্না পাচ্ছে তার। এক ফোঁটা চোখের পানি গড়িয়ে পড়ল হাতের পিঠে। ইফতি তা দেখতে পেল। এগিয়ে গিয়ে অরণীর সামনে দাঁড়াল। আলতো হাতে অরণীর মাথাটা নিচের বুকে চেপে ধরে নরম হয়ে বলল,
-“আমি তোমাকে আগের মতো দেখতে চাই, সোনা। এতটা নাজুক আমার অরু একদমই না। সে তো বাঘিনী। অথচ প্রতিনিয়ত তোমার অসহায় মুখটা দেখে আমার ভেতরটায় যন্ত্রণা হয়। তুমি বুঝতে পারছ না?”

অরণী ফুঁপিয়ে উঠল, ভেজা গলায় বলল,
-“কিছুই তো আর আগের মতো নেই। আমার সবই তো গেল! কিছুই তো নেই আর।”

অরণীর আঁধারে আচ্ছন্ন মনের আসমানটায় যেন ফিনকি দিয়ে চাঁদের জোৎস্না উঁকি দিলো, এমনভাবে ইফতি বলে উঠল,
-“আমি এখনও আছি। চলো, নতুনভাবে সব শুরু করি।”

ইফতির বুকের মধ্যে থাকা অবস্থাতেই অরণী কেঁপে উঠল। সেই কম্পন টের পেল ইফতি। পকেট হাতড়ে নিজের ফোন বের করল। কল লাগাল বাবাকে।

সাদেক সাহেব কল রিসিভ করে বলল,
-“কী অবস্থা ব্যাটা, অল ওকে?”
-“উঁহু। অবস্থা ক্রিটিকাল।”
-“কী হয়েছে?”
-“তোমার হবু বউমা এক্সিডেন্ট করে মরতে বসেছিল। আমি বিয়ের আগেই বিপত্নীক পুরুষমানুষ হতে চাইছি না।”

ইফতি আগেই অরণীর ব্যাপারটা সাদেক সাহেবকে বলে রেখেছিল। তিনি তখনই বলেছিলেন, বিয়ে করে ওকে নিয়ে আসতে। কিন্তু ইফতির মন মানছিল না, এখনই বিয়ের প্রসঙ্গ তোলাটা কেমন যেন ছিল!

সাদেক সাহেব চিন্তিত কণ্ঠে জিজ্ঞেস করলেন,
-“ঠিক আছে, অরণী?”
-“আল্লাহ জানে কয়লিটার রক্ত ক্ষয় করেছে! কপালে কেটেছে, হাতে ও পায়ে ছিঁলেছে।”

অরণী বলল,
-“গায়ে রক্ত কম, বেশি বের হয়নি।”

ইফতি নিজের বুকে মাথা রেখে গুটিশুটি মেরে বসে থাকা অরণীর দিকে শক্ত চোখে তাকাল। এরপর বাবাকে বলল,
-“বাবা, বিয়ে করতে চাইছি।”

থতমত খেয়ে অরণী তাকাল ইফতির দিকে। ইফতি ওর চোখে চোখ রেখেই বলল,
-“এখন এবং এই মুহূর্তে। হসপিটালে। ব্যবস্থা করো তুমি। দ্রুত।”

সাদেক সাহেব হেসে বললেন,
-“তোর দাদা তোর দাদিকে তুলে নিয়ে মসজিদে গিয়ে বিয়ে করেছিল। আমি তোর মাকে নিয়ে কাজি অফিসে বিয়ে করেছিলাম। তোর চাচা তোর চাচিকে রেস্টুরেন্টে বিয়ে করেছে। তোর চাচাতো ভাই ফোনে বিয়ে করেছিল। আর তুই হসপিটালে? বংশের ধারা অব্যাহত রাখছিস!”

এক ঘন্টার মধ্যে কাজি ও সাক্ষীসমেত সাদেক সাহেব ক্লিনিকে চলে এলেন। কিছু বুঝে আসার আগেই ইফতেখার মাহমুদের সাথে আঞ্জুমান অরণীর বিয়ে হয়ে গেল। যতবার অরণীকে কবুল বলতে বলা হয়েছিল, ততবার সে ইফতির দিকে তাকিয়েছে। বেঁচে থাকার একমাত্র কারণরূপে ইফতিকে সে কবুল করে নিল।

ইফতি শুধু তাকিয়েই ছিল। সাদা কাপড় পরা, কপালে ব্যান্ডেজ, হাতে ব্যান্ডেজ, ক্যানুলা, সেলাইন চলছে, এমন অবস্থায় তার বউ তাকে কবুল করছে। কী একটা অবস্থা বাপরেহ!

বিয়েটা বিকেলে হলো। অরণীকে একরাত থাকতে হবে এখানে। সঙ্গে ইফতিও থাকবে। অরণী খেয়াল করল, ইফতির ওর সাথে ঠিকভাবে কথা বলছে না আগের মতো। আগের মতো গল্প করছে না। কেমন যেন চুপ হয়ে আছে। রাতে তনুজা এসেছিল খাবার নিয়ে। কিছুক্ষণ গল্প করে চলে গেছে। যাওয়ার পর ইফতি গালে তুলে খাইয়ে দিয়েছে। কিন্তু কোনো কথা বলেনি। অরণীর নিজ থেকে বলল,
-“রেগে আছেন, ইফতি?”

ইফতি তাকাল অরণীর দিকে। খাবার শেষ করে, হাত ধুয়ে এসে পাশে বসল। এরপর বলল,
-“না।”
-“কথা বলছেন না যে?”
-“তুমিও তো বলছ না।”
-“আগে আমি কথা না বললেও, আপনি বলতেন। আপনি বিয়ে হতেই পালটে গেলেন!”

কী বিষাক্ত কথা! ইফতি তাতে হেসে ফেলল,
-“আমি ভাবছি, অরু। আমাদের লাইফটা গোছানো দরকার। ব্যাচেলর তো থাকলামই কতবছর। এখন সাংসারিক হতে হবে। কাগজে-কলমে এবার তোমার দায়িত্ব নিয়েছি। কী কী দায়িত্ব আমার আছে, তা ভাবছিলাম। কীভাবে কী করলে তোমাকে আরও ভালো রাখা যায়, এসব ভাবছিলাম।”
-“ওও।”
-“কিছু কথা বলি, মন দিয়ে শুনবে। ঠিক আছে?”
-“বলুন।”
-“আমরা একটামাত্র লাইফ পাই, তাই জীবদ্দশায় কোনো ধরনের কম্প্রোমাইজ আমরা করব না। কোনো কথা বলতে চাইলে বলে ফেলব, মনের ভেতর রেখে দেবো না। আমাদের সপ্তাহান্তের একটা বেলা আলোচনার জন্য রাখতে হবে। তখন আমরা সকল অভিযোগ একে-অপরকে জানাব। আমরা একে-অপরকে বোঝার চেষ্টা করব। বিষয়টা এমন, ম্যাক্সিমাম বিচ্ছেদের মূল সমস্যা হলো তারা একে-অপরের পয়েন্ট অভ ভিউটা দেখার চেষ্টাও করে না। ধরো, ছেলেটা ভাবছে মেয়েটা তাকে বুঝতে পারছে না। মেয়েটাও ভাবছে, ছেলেটা তাকে বোঝে না। অতঃপর তারা দুইজনেই একে-অপরকে হার্ট করে কথা বলল। অথবা মনের সকল অনুভূতি চেপে রেখে বাহিরে থেকে ডোন্ট কেয়ার ভাব দেখাল। তখন একপর্যায়ে গিয়ে দেখতে পাবে, লাভের লাভ হচ্ছে না এই সম্পর্কে, ভালোবাসা নেই যেখানে সেখানে থেকে কী হবে! শেষান্তে বিচ্ছেদ। অথচ আমি তোমার সাথে গোটা এক জনমের সব স্বপ্ন পূরণ করতে চাই। বুঝলেন, ম্যাডাম?”

অরণী মাথা নাড়ল। সে বুঝতে পেরেছে। ইফতি আবারও বলল,
-“বার্ধক্যের শহর দেখতে চাই তোমার সাথে। তুমি তৈরি?”
-“হুঁ।”

রাতে অরণীকে মেডিসিন দেওয়া হয়ে গেলে ইফতি ওর বেডেই শুয়ে পড়ল। অরণী বুকে মাথা রেখে ঘুমাল। এত শান্তির ঘুম অরণী শেষ কবে ঘুমিয়েছে, মনে নেই তার। তবে এটুকু বুঝতে পারছে সে, আগামী দিনগুলো পূর্ণিমার মতো সুন্দর হবে।

অথচ ইফতি সারারাত ঘুমোতে পারল না। দু’চোখে তার দুশ্চিন্তার ছাপ। আজকের মতো ঘটনা যেন আগামীতে না ঘটে, এজন্য তাকে বহুগুণে বেশি সতর্ক থাকতে হবে। ভঙ্গুর অরণীকে তৈরি করতে হবে আগের চেয়েও অধিক শক্তিশালীভাবে। ইফতির দায়িত্ব বেড়ে গেল। ইফতির চিন্তাচেতনার দিক পালটে অরণীতে এসে থামল। বুকেতে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছে মেয়েটা!

|অসমাপ্ত|