#পৌষের_কোন_এক_বিকেলে
পর্ব – ১১
অপরাজিতা অপু
পৌষের কোন এক বিকেলের নরম রোদের মতই মিষ্টি শোনালো ‘তুমি’ সম্বোধন টা। এই প্রথম রুপমের মুখে তুমি শুনে আমার শরীর শিউরে উঠলো। হৃদ কম্পন বেড়ে গেলো। অভিমানের পাহাড় মিলিয়ে গেলো মুহূর্তেই। আমাকে চুপ থাকতে দেখে ভীষণ আদুরে কণ্ঠে বললো
” মন খারাপ?”
আমার ভেতরটা ছলকে উঠলো। আবেগে টলমল আমি কথার খেই হারিয়ে ফেলেছি। তবুও বাচ্চামো ভাবটা ফুটিয়ে তোলার চেষ্টায় অভিমানী কণ্ঠে বললাম
” মন খারাপ হবে কেনো?”
” সেটা আমি কিভাবে বলি? এতো কিছু হয়ে গেলো মন খারাপ হওয়া স্বাভাবিক। কত কথাই না হলো। সেসবের কারণে মন খারাপ হতেই পারে।”
আমি জানালার ধারে দাড়ালাম। মুখটা অন্ধকার করে দূরে কুয়াশার চাদরে মুড়ে থাকা ল্যাম্প পোস্টের আলোর দিকে তাকিয়ে বললাম
” শুধু কথা হলেই মন খারাপ হয়? নাহলেও তো মন খারাপ হতে পারে।”
রুপম আমার কথাটা ধরতে পারলো না। একটু বিরক্তি প্রকাশ করে বলল
” কি বলছো উল্টা পাল্টা? ঠিক করে বলো।”
আমি বললাম না। চুপ করেই থাকলাম। দুপাশের নিশ্বাসের শব্দ ছাড়া আর কিছুই কানে এলো না। নিরবতা ভেংগে রুপম বলল
” যদি চুপ করেই থাকবে তাহলে ফোন দিলে কেনো?”
আমার খুব অভিমান হলো। মন ভীষণ খারাপ হয়ে গেলো। আমি মন খারাপ করে বললাম
” ঠিক আছে। বিরক্ত করলাম। এখন রাখছি।”
” ফোন করে কথা বললে বিরক্ত করা হয়না কথা না বলে চুপ করে থাকা টা বিরক্তির কারণ। তুমি এতো অবুঝ কেনো আজরা?”
আবারো মনের মাঝে ঢেউ খেলে গেলো। আমি চাপা নিশ্বাস ফেলে বললাম
” বিয়ে করে ফেললেন অথচ আমার সাথে আলোচনা করার প্রয়োজন মনে করলেন না।”
” আমি তো সবটা তোমার উপরেই ছেড়ে দিয়েছিলাম। তোমার বাবাকে বলেছিলাম বিয়ের আগে তোমার অনুমতি নিতে। উনি তোমাকে জিজ্ঞেস ও করেছিলেন। আর তুমি নিজেই বলেছ কোন আপত্তি নেই। এখন তো এসব কথা বলে লাভ নেই।”
” বাবাকে কেনো বলবেন? আপনি নিজে বলতে পারেন নি।”
রুপম দীর্ঘনিশ্বাস ছেড়ে বলল
” সেদিন তো আমি তোমাকে বলেই দিয়েছি আমার কথা। এরপর আর কি বলার আছে? তুমি যখন বাসায় কিছুই বলোনি তাই তোমার বাবাকেই বলেছিলাম শুনে নিতে।”
আমি অভিমানী কণ্ঠে বললাম
” সেদিন কি বলেছিলেন? আপনার কিছুই করার নেই। যা করতে হবে আমাকেই করতে হবে। সেই যে চলে গেলেন আর একবারও কথা বলার প্রয়োজন মনে করলেন না। মনে হয়নি মেয়েটা একা একা কিভাবে সামলাবে? আপনি অদ্ভুত মানুষ।”
রুপম এর মৃদু হাসির আওয়াজ কানে এলো। কোমল কণ্ঠে বললো
” সেদিন আরো একটা কথা বলেছিলাম মনে আছে?”
আমি মনে করতে পারলাম না। রুপম বলল
” বলেছিলাম এমন সুন্দরী মেয়েকে আমি রিজেক্ট করতে পারবো না। তাই তোমাকেই সবটা করতে হবে। চান্স দিয়েছিলাম তো। তুমিই নিতে পারো নি। এখন আর কিছুই করার নেই। এখন চাইলেও আর সম্ভব না। কারণ এই তুমি টা আমার হতে আর কোন বাধা নেই।”
রুপম এর কথা শুনে লজ্জায় আমার শরীর কেপে উঠলো। কথা হারিয়ে গেলো কোথায় যেনো। লোকটা কি অদ্ভুত! আগে কখনো তো এমন কথা বলেনি। রুপম বলল
” কাল নতুন বছরের প্রথম দিন। আর আমাদেরও নতুন জীবনের শুরু। ভাবছি সেটা সেলিব্রেট করা দরকার।”
আমার ঠোটে লজ্জা মাখা হাসি। রুপম বলল
” কাল যদি তোমাকে শাড়ীতে দেখতে চাই সেটা কি সম্ভব?”
আমি মৃদু হেসে বললাম
” কেনো আজ দেখেন নি?”
” না। ”
” কেনো?”
” আজ দেখতে চাইনি। কারণ আমার তুমিটাকে আমার মতো করেই দেখতে চাই। যেমনটা ভেবে রেখেছি ঠিক তেমন টাই।”
আমি অবাক হয়ে বললাম
” আপনি কেমন ভেবেছেন আর আমি কেমন করে সাজবো? সেটা যদি এক রকম না হয়?”
” হবে। আমি তোমাকে প্রথমদিন যখন দেখেছিলাম তখনি আমার ভাবনার মতই দেখতে পেয়েছিলাম। তাই এবারও ব্যতিক্রম হবে না। কাল সকালে আমি বাসায় আসবো তোমাকে নিতে। রেডি থাকবে কিন্তু।”
রুপমের আত্মবিশ্বাস দেখে নিজেই অবাক হচ্ছি। আমার উপরে একটা মানুষের এতো বিশ্বাস। অথচ কয়দিন আর হয়েছে তার সাথে পরিচয় হওয়ার। আমি ফোনটা রেখে দিলাম। মনের মাঝে কেমন অস্থিরতা বেড়েই চলেছে। কাল কি হতে যাচ্ছে। সবকিছু কেমন অবিশ্বাস্য মনে হচ্ছে। ভাবতেই গা শিরশিরিয়ে উঠছে।
—
বাবার হাসির আওয়াজেই ঘুম ভেংগে গেলো সকালে। আমি অবাক হলাম। অনেকদিন বাদে বাবাকে এতো জোরে আর মন খুলে হাসতে দেখলাম। বিছানা ছেড়ে চুলগুলো খোঁপা করতে করতেই দরজায় গিয়ে দাড়ালাম। বাইরে চোখ পড়তেই আমার সমস্ত ঘুম কেটে গেলো। টেবিলে রুপম আর বাবা বসে খোশগল্পে মত্ত। সে গল্পের কারণেই এতো হাসি। আমি বড়ো বড়ো চোখে তাকিয়ে আছি। ভাবী টেবিলে চায়ের কাপ রেখে আমার কাছে এসে ফিসফিসিয়ে বললো
” একটু আগেই এসেছে। তোমাদের নাকি কোথায় যাওয়ার কথা?”
আমি ভাবীর দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়লাম। ভাবী ঠোঁট টিপে হেসে বলল
” বাব্বাহ! একদিনেই এতো পরিবর্তন। কাল পর্যন্ত তো কি করবে সেটাই বুঝতে পারছিলে না। আর আজ বাইরে যাচ্ছো তাও জানতে পারলাম না।”
আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাড়িয়ে থাকলাম। কি বলবো এই কথার জবাবে। কিছুই মাথায় এলো না। ভাবী হেসে ফেলে বলল
” থাক বলতে হবে না। আমরা আর কাবাবে হাড় হবো না। তোমরাই ঘুরে বেড়াও।”
আমি লজ্জা পেলাম ভাবীর কথায়। ভাবী সেখান থেকে চলে গেলো। কিন্তু রুপমের উপরে রাগ হলো। মানুষটা কেমন বেহায়া। সকাল সকাল চলে এসেছে। আর এদিকে আমি এখনো ঘুম থেকেই উঠতে পারলাম না। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো কাল বিয়ে হয়েছে মাত্র। আর আজ সকালে সে পাঞ্জাবি পরে সেজে গুজে একদম না জানিয়ে বাসায় এসেছে। লজ্জা বলতে কিছু নেই নাকি। আমি আর ভাবতে পারলাম না। হাত মুখ ধুয়ে ফ্রেশ হয়ে ওড়নাটা মাথায় টেনে দিয়ে বেরিয়ে এলাম ঘর থেকে। টেবিলের এক পাশে দাড়াতেই বাবা বলল
” এই তো মামনি এসে গেছে।”
আমার অদ্ভুত অনুভূতি হলো। বাবা আমাকে জীবনে কয়েকবারই মামনি বলে ডেকেছে। আর সেসব আমার জীবনের খুব বিশেষ সময়। তবে এই ডাকটা আমার খুব ভালো লাগে। বাবা এমন ভাবে ডাকলে আমার ভেতরটা খুশীতে ভরে যায়।
” এইখানে বসো।”
বাবা মাঝখানের চেয়ারটা দেখিয়ে দিয়ে বললেন। রুপম এক পলক আমার দিকে তাকিয়ে আবার চা খাওয়ায় মনোযোগ দিলো। আমি চেয়ারে বসতেই বাবা উঠে বলল
” তোমরা কথা বলো। আমার একটু কাজ আছে। আমি আসছি।”
বাবা ঘরে চলে গেল। বুঝলাম আমাদের দুজনকে স্পেস দিয়ে চলে গেলো। আমি খুব সন্তর্পনে এদিক সেদিক তাকালাম। কেউ নেই সেটা নিশ্চিত হতেই চাপা আওয়াজে রুপম কে বললাম
” আপনি এই সময় কেনো এসেছেন?”
রুপম হাতের চকচকে সিলভার বেল্টের ঘড়িটা একবার দেখে নিয়ে বলল
” এখন ১০ টা বেজে ৩০ মিনিট। আর আমার জতদুর মনে আছে আমার সকালেই আসার কথা ছিলো।”
” তাই বলে এতো সকালে? আসার আগে আমাকে একবার জানানো উচিৎ ছিলো। ফোন করে আসতে পারতেন।”
রুপম আমার দিকে তাকিয়ে মৃদু হেসে বলল
” মনে হচ্ছিলো তুমি ঘুমাচ্ছিলে। তাই বিরক্ত করতে চাইনি। ভাবলাম একদম বাসায় গিয়েই জানাবো। বাই দ্যা ওয়ে ঘুম কেমন হয়েছে ম্যাডাম?”
আমি ভ্রু কুঁচকে ফেললাম। আমার বিরক্তি শেষ সীমা অতিক্রম করছে। তাই কোন উত্তর দিলাম না। রুপম পেছনে হেলে আরাম করে বসে বলল
” আমার তো খুব ভালো ঘুম হয়েছে। মনে হচ্ছে দীর্ঘ জীবনের সবথেকে ভালো ঘুমটা কাল রাতেই হয়েছে।”
আমি বিরক্তি নিয়ে তাকালাম। রুপম আমার চেহারা দেখে হেসে ফেললো। আমাকে বিরক্ত করতে পেরে সে যেনো খুব খুশী। গরম ধোঁয়া ওঠা চায়ে চুমুক দিয়ে কাপটা টেবিলে রেখে আমার দিকে তাকালো। কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে কাপটা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে ভীষণ আদুরে কণ্ঠে বললো
” এখনো তোমার ঘুম ভাঙেনি। চা টা খাও ফ্রেশ লাগবে।”
আমি এবার চায়ের কাপের দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকালাম। তারপর বললাম
” এটা আপনার চা। আমি কেনো খাবো?”
” তুমি যে পুরোটাই আমার। তাহলে এক কাপ চায়ে এমন বৈষম্য কেনো? তোমার আর আমার বলে আদৌ কি আলাদা কিছু থাকার কথা ছিলো?”
চলবে