#প্রণয়ডোর
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম
#পর্ব-দশ
‘নীল নীলাঞ্জনা’ লেখাটুকু পড়েই দু পা থামিয়ে দেয় ফারিয়া। হাত পা ইতোমধ্যেই কাঁপাকাঁপি শুরু করে দিয়েছে। দু পা পিছনের সরে গাড়িতে হেলে দাঁড়িয়ে যায়। তার এমন অবস্থা দেখে ভ্রু কিঞ্চিত কুঁচকে ফেলে তাসবি। বোনকে খানিকটা সন্দেহ হলো তার। তবে মুখে কিছুই বললো না। তবে এগিয়ে গিয়ে শুভ্রা কে জানাতে ভুললো না। শুভ্রা তার কথা শুনেই ফিচেল হেঁসে বলে তোমরা এগোও আমি আপু কে নিয়ে আসছি। শুভ্রার কথায় মা ছেলে উভয়েই রাজি হয়। তারা এগিয়ে যান সামনের দিকে। পেছনে এসে শক্ত করে ফারিয়ার হাত ধরে শুভ্রা।
“ ভয় পেয়ো না । আজ হয়তোবা সে বাড়িতে নেই , কারণ আজ শনিবার। তার স্পেশাল একটা দিন। সো ,,, রিলাক্স ! ”
শুভ্রা এমন কথা শুনে ফারিয়া উত্তরে বলে,
“ নান,,,নারে শুভ্রা ! আমি দ্বিতীয়বারের মতো আর প্রবেশ করতে পারবো না এই বাড়িতে। ”
“ আপু তুমি কি বোকা তুমি নিজে তাকিয়ে দেখো তুমি অলরেডি এই বাড়ির এক প্রান্তে পা দিয়ে দিয়েছো। শোনো বাস্তবতা সম্মুখীন হতেই হবে। সেটা আজ হোক বা কাল। আর হ্যাঁ আজ কিন্তু আমরা তোমার খালার বাসায় আসিনি । এসেছি আমার বাবার বাড়িতে। এককালের বান্ধবী তুমি আমার। ধরে নাও তুমি তোমার বান্ধবীর বাড়িতে এসেছো। না চেনার একটি না হয় ভালো করলে। ”
এই কথা শুনেও কোন ভাবান্তর দেখা গেল না ফারিয়ার মাঝে। ফারিয়াকে ভরসা দিতা আবারও শুভ্রা বলে ,
“ শোনো ! ফাইয়াজ মির্জা ওরফে নেওয়াজ খারাপ হলেও তার দ্বিতীয় বউ কিন্তু অনেক ভালো। তবে তার ছেলেটা যদি একটু ভালো হতো। কিন্তু কি আর করার বলো ? ছেলে বাপের ধারা টাই পেয়ে গিয়েছে। তাই তো,,,,। ”
“ যে অতীত আমি ফেলে এসেছি সেই অতিত আমি আর মনে করতেও চাইনা। প্লিজ ! ”
“ তাহলে আগানো যাক ? চলো ! ”
এবার আর দ্বিরুত্তর করল না ফারিয়া। শুভ্রার হাত ধরে ঢুকলো এককালীন চেনা জানা বাড়িতে। যে বাড়িতে রোজ সে এসে নিজের শান্তি কুড়িয়ে নিতো । কেটে গিয়েছে ৩ বছর। বলা যায় প্রায় বছর তিন পর সে এই নীল নীলাঞ্জনা বাড়িতে প্রবেশ করছে । বাড়িটার আশপাশে ভালো করে লক্ষ্য করল। কিছুই যেন পরিবর্তন হয়নি। তবে পাশের জায়গাটায় বেশ খানিকটা পরিবর্তন হয়েছে। যেখানে তার পছন্দের কাঠগোলাপ গাছ টা ছিল, সেটা আজ নেই। হয়তো বা বিচ্ছেদের সাথে সাথে কাঠগোলাপেরও মৃত্যু হয়েছে। জায়গাটা খালি হয়ে পড়ে আছে। ঠিক যেমন শূন্য হৃদয় নিয়ে বেঁচে আছে সে। আশপাশ থেকে চোখ সরিয়ে সামনের দিকে অগ্রসর হলো। বুক টা খা খা করছে। শূন্যতা ঠিকরে ধরেছে তাকে। মাথায় আওড়ালো কয়েকটি কথা !
“ যা কোনদিন পাওয়া হবেনা কিংবা যার কোনদিন পাওয়া সম্ভবই না তার দিকে আগ্রহ না দেখানো ভালো। এট লিস্ট নিজেকে ভালো রাখার জন্য হলেও সেগুলো এড়িয়ে চলতে হয়। ”
~~
“ আসসালামু আলাইকুম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহু ! ”
হঠাৎ কোনো মহিলা কণ্ঠে সালাম শুনে বিস্মিত হয় মিসেস মোর্শেদা মির্জা। সোফায় বসে কাজ করছিলেন তিনি। হাতের কাজ শেষের পথে । সুতার কাজ তিনি বেশ ভালো করেই পারেন। এত বড় বাড়িতে তার তো ওত বেশি কাজ নেই , তাই তো কাজের ফাঁকেই এগুলো করে বেড়ান তিনি। যে বয়সে বিয়ে করে বউমা দেওয়ার কথা , সে বয়সে ছেলে বিদেশে চলে গিয়েছে , আর স্বামী তো কাজের নানান ব্যস্ততায় এখানে সেখানে ইচ্ছেমতো ঘুরে বেড়ান। তাই বিস্মিত হয়েই বললেন ,
“ কারা আপনারা ! ”
“ আরে বাসায় নতুন অতিথি এসেছে। সালাম দিয়েছে আপনাকে , কোথায় সালামের উত্তর দেবেন , তার বদলে আপনি পাল্টা প্রশ্ন করছেন , যে কারা আপনারা? এটা কি ঠিক ? এটা কি নীল নীলাঞ্জনা বাড়ির প্রথা নাকি ? ”
তাসবীর বলা কথায় খানিকটা বিব্রত হয় ভদ্রমহিলা। হাতের কাপড়টুকু আর সুই সুতা রেখে উঠে দাঁড়ান তিনি। নিজের ছেলে বয়সী ছেলেকে দেখে খানিকটা আবেগাপ্লুত ও হন তিনি । আবেগ মাখা কন্ঠ নিয়ে বলেন ,
“ ওয়ালাইকুম আসসালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহি ওয়া বারাকাতুহ। তোমাদেরকে চিনলাম না, কে তোমরা ? যদি বলতে তাহলে একটু ভালো হয় আমার জন্য। আর হঠাৎ করেই সালাম দিয়েছ তো ; আমি আমার চিন্তায় মগ্ন ছিলাম , আর হুট করে নারী কন্ঠ শুনে আমি চমকে গিয়েছিলাম আর তাই আমি বেশি উত্তেজনায় বলে ফেলেছি যে, কারা আপনারা ! ”
“ সে ঠিক আছে ! কিন্তু আমাকে তো আপনি চিনেন ই না দেখছি । তবে আমার জানা মতে আমাকে তো আপনার বেশ ভালোভাবে চেনার কথা। একদম ভালো ভাবেই ! ”
“ সত্যিই আমি চিনতে পারছি না আপনাকে। আপনি আমার কাছে নতুন মুখ ! একদম ই নতুন মুখ ! ”
“ আপনার নামটা কি আমি জানতে পারি ? ”
“ জি আমি মোর্শেদা মির্জা ! ”
“ ওয়াইফ অফ ফাইয়াজ মির্জা ? ”
“ না , নেওয়াজ মির্জা ! ”
এবার এক ভ্রু উঠিয়ে শুভ্রা শোধায় ,
“ ওওও ! ভেরি স্ট্রেঞ্জ ! ফাইয়াজ মির্জা থেকে এখন কনভার্ট হয়ে নেওয়াজ মির্জা ? আরে বাহ ! এখন তো আমার মনে হচ্ছে মির্জা বংশের একটা তালিকা তৈরি করার অনেক দরকার ছিল। তাহলে বেহুদায় মির্জা বংশের লোকেদের চিনতে আর হিমশিম খেতে হতো না । ”
“ কারা তোমরা ? আর আমার বাড়িতে এসে আমার সাথেই সিনক্রিয়েট করছো কেন ? ”
এ কথা শুনে এবার এগিয়ে আসে শুভ্রা। তার অবস্থান এখন সামনে। তার দুই পাশে রয়েছে তিনজন। তাসবি , তার মা আর তার ছোট বোন ফারিয়া । তাদের মুখের রিয়াকশন দেখে বোঝা যাচ্ছে না যে, তারা কোন মুডে আছে । তবে শুভ্রা খুব সিরিয়াস। বুকে দুহাত বেঁধে টান টান করে দাঁড়িয়ে জোর গলায় বলে ,
“ আই এম শুভ্রা । ডটার অফ ফাইয়াজ মির্জা ওরফে নেওয়াজ মির্জা ! ”
একথা শুনে ভদ্র মহিলা ছাড়া বাকি কারোর মধ্যে কোন ভাবাবেগ দেখা দিলো না। ভদ্রমহিলা চমকিত। তার মুখমন্ডল বলে দিচ্ছে সে প্রশ্নবিদ্ধ করবে এবার শুভ্রা কে ।
তবে তাজবি মনে মনে ভাবছে শুভ্রার বলা একটা কথা , “ডটার অফ ফাইয়াজ মির্জা ”। সে বুঝি শুভ্রার কেউ না ? নাকি তার আর শুভ্রার সম্পর্ক কোনদিন প্রকাশিত হবে না ? এবার সে খানিকটা অসহায় বোধ করল নিজেকে। তারা আর শুভ্রার সম্পর্ক এতটাই নড়বড়ে যে কোন দিন প্রকাশ হবে দূর, তার আগেই ভেঙে যাবে।
এটুকু বলেই শুভ্রা তাসবীর দিকে তাকায়। সে তাসবীর রিয়েকশন বোঝার চেষ্টা করছে। সে তার কাঙ্ক্ষিত উত্তর পেয়ে মনে মনে আওড়ায় ,
“ ওয়েট মিস্টার ইয়ানাত তাসবি । আপনার পরিচয়ে নিজেকে পরিচয় করানোর মতো সময় এখনো হয়নি। আপনাকে সাময়িক দুঃখ দেওয়ার জন্য দুঃখিত। তবে শীঘ্রই আপনার সেদিনটা আসবে যেদিন টার জন্য আপনি অধীর আগ্রহে বসে আছেন। সে পর্যন্ত আপনার নিরাপত্তার জন্য হলেও আমাকে আমাদের সম্পর্ক টা আমায় লুকিয়ে রাখতে হবে। প্রকাশ্যে আনা তো একদমই যাবে না। ”
~~
কপালে সুক্ষ চিন্তার ভাজ ফেলে চেয়ারে বসে আছে ফাইয়াজ মির্জা। তার চোখে মুখে বিস্ময় । তার সামনে ওপেন করা আছে একটি ল্যাপটপ যেখানে সে তার বাড়ির সিসিটিভি ফুটেজ স্বচক্ষে শব্দ সহকারে শুনছে। তার মাথায় অনেকগুলো প্রশ্ন ঘুরপাক খাচ্ছে। একটাই প্রশ্ন বারবার মস্তিষ্ক তাকে করছে ,
“ এই মেয়েটা যদি তার মেয়ে হয় , তাহলে সে কাকে কিডন্যাপ করতে চেয়েছে ? এই মেয়েটা,,,, ! ”
আর ভাবতে পারছে না সে। তার স্ত্রী মানে মোর্শেদা মির্জাকে তো সে মানিয়ে নিতে পারবে। কিন্তু এই মেয়েকে কিভাবে দূর করবে ? যদিও মেয়েটা তার পরিচয় দিয়েছে কিন্তু কি উদ্দেশ্যে সে তার বাড়িতে এসেছে সেটাও এখনো বলেনি । নিজের ওভার থিংকিং কে বাদ দিয়ে, এবার পূর্ণদৃষ্টি নিক্ষেপ করে ল্যাপটপের দিকে।
~~
“ তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো ? তুমি কিভাবে আমার স্বামীর মেয়ে হও ? আমি আমার স্বামীর,,,। যাই হোক আমাদের একটা ছেলে আছে। এবং ওই একটাই ছেলে আছে আমাদের, কোন মেয়ে নেই। সুতরাং তুমি কোন দিক থেকে বলতে পারো নিজেকে যে তুমি আমার স্বামীর মেয়ে ? ”
“ আমি কেন যে জেগে আপনাকে মিথ্যা কথা বলতে যাব ? খুব বেশি যেন আগ্রহ থাকলে আপনি আপনার স্বামীকে ডাকুন না ! ”
এবার ক্ষিপ্ত হয় ভদ্রমহিলা। রাগী কন্ঠে বলে ,
“ আমি আমার স্বামীকে যথেষ্ট ভালোভাবে চিনি। আর আমার তোমাকে দেখে মনে হচ্ছে তুমি আমার ছেলের বয়সী মেয়ে । সেই সমীকরণ অর্থে আমার স্বামীর একাধিক স্ত্রী থাকা দরকার। কিন্তু আমার স্বামীর কোন স্ত্রী ছিল না, আমিই তার প্রথম স্ত্রী। ”
এবার শুভ্রার কাছে খানিকটা ব্যাপার পরিষ্কার হয়। মনে মনে বলে,
“ তাহলে তার বাবার খবর ফুফাতো বিদেশিনী বোন তাহলে উধাও হয়ে গিয়েছে। কিন্তু গেলো কোথায় ? আর শেষ পর্যন্ত কি’না টিকে রয়েছে এই মহিলাটি। নাহ ! সমীকরণ দেখছি বেশ বড় ! তবে যাই হোক এই সমীকরণ নিয়ে এখন তার ভাবলে চলবে না। তার উদ্দেশ্য এখন আপাততো মিস্টার নেওয়াজকে কনফিউজড করে দেওয়া। সে আশা করছে যেটা অলরেডি সে করে দিয়েছে। ”
এবার ভদ্রমহিলা আবারো প্রশ্ন করলেন ,
“ কি চাও তুমি এখানে ? ”
“ মেয়ের অধিকার ! ”
এটুকু শুনে উপস্থিত সকলে চমকে যায়। এরকম কিছু শুভ্রা যে বলবে তা জানায়নি তাদের তিনজনের কাউকেই । তবে শুভ্রার মুখে ভুবনভুলানো হাসি। অপরদিকে ফাইয়াজ মির্জা এসব দেখে উঠে দাঁড়িয়ে পেছন থেকে চেয়ারটাকে লাথি মেরে সরিয়ে দেয়। দুহাত সজোরে রাকজে টেবিলে। এবার তাকে বাড়িতে যেতেই হবে। প্রস্থান ঘটায় দ্রুত বাড়ি যাওয়ার উদ্দেশ্যে।
—চলবে?
#প্রণয়ডোর
#পর্ব_এগারো
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম
— কে তুমি ? কি চাও আমার বাড়িতে ?
অতি পরিচিত একটি কন্ঠস্বর শুনে পেছনে তাকায় শুভ্রা। মুচকি হাঁসে সে। দীর্ঘ ১৫ বছর পর সে এই ব্যক্তির মুখোমুখি হয়েছে। ব্যক্তিটি সম্পর্কে তার বাবা হয়। ভাবতেই শুভ্রার অনেক হাঁসি পায়। যদি অন্য কোনো মেয়ে ১৫ বছর পর বাবার মুখোমুখি হতো , সেখানে মেয়েটি ছুট্টে গিয়ে এক দৌড়ে বাবাকে জড়িয়ে ধরে ‘বাবা’ বলে মৃদ্যু চিৎকার করতো। কিন্তু তার ক্ষেত্রে ? তার মধ্যে কোন রিয়াকশন নেই ! বরঞ্চ মুখে লেপ্টে আছে নজরকাড়া রহস্যময় হাঁসি। মুখে রহস্যময় হাসির রেশ টেনেই ব্যক্তির উদ্দেশ্যে বলে ,
— আরেহ ! মিস্টার ফাইয়াজ মির্জা । আপনি এভাবে ঘামছেন কেন ? এনি প্রবলেম ?
শুভ্রার এমন কথা শুনে ব্যক্তিটির ভ্রু খানিকটা কুঁচকে গেল। বোধহয় তিনি কনফিউজড। ব্যক্তিটির মুখের ভাব দেখে শুভ্রা তার সাইড ব্যাগ থেকে একখানা টিস্যু বের করে লোকটির দিকে এগিয়ে দিয়ে বলে,
— নিন ! মুছে নিন আপনার মহামূল্যবান ঘাম গুলো । আর নিজের বাড়িতে এসে নিজেই বাড়ি সদর দরজায় দাঁড়িয়ে থাকবেন নাকি একটু এগিয়ে এসে আরোও কাউকে দেখবেন ? আসুন ! আপনার জন্য অনেক চমৎকার কিছু অপেক্ষা করছে যে। এসে দেখুন তো একখানা মুখকে চিনতে পারেন কিনা !
কথা শুনে লুকিয়ে তড়িঘড়ি করে এগিয়ে আসলো। আশপাশ খরচ করতে ব্যক্তিটির। দু’পা কয়েক কদম পিছিয়ে গেল। সন্দেহের দৃষ্টিতে তাকালো ব্যক্তির মিসেস। এগিয়ে এসে বলে,
— আরে তুমি এত তাড়াতাড়ি চলে আসবে আমাকে তো বলোওনি । আর এনারা আমাদের বাড়িতে এসেছে তুমি জানলে কি করে ? আমি তো তোমাকে খবর দিইনি। তাহলে ? জানো ! ওনারা আমাকে বারবার বলছে যে কি যেন একটা নাম তার সারনেম ও ছিল মির্জা। তো আমি সেই মিসেস মির্জাকে চিনি কিনা। কিন্তু আমি না অনেক চেষ্টা করলাম কিন্তু আমি তেমন একটা কিছু পাইনি , যে আসলেই আমি কোন মিসেস মির্জাকে চিনি কিনা। মানে যার কথা তারা বলছে । তুমি কি চেনো ? জানো ?
ফাইয়াজ মির্জা নামক ব্যক্তিটি সহধর্মিণীর কথার উত্তর না দিয়ে এগিয়ে এসে শুভ্রার মুখোমুখি দাঁড়ায় । শুভ্রার পাশে ছিল তাসবি। আর তাসবির হাত ধরেই দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রার খালামনি। নিজের প্রথম প্রিয়তমা স্ত্রী শিলুর মতোই দেখতে মহিলা কে দেখে যা বোঝার তা বুঝে যায় মিস্টার মির্জা। কাঠ কাঠ কন্ঠে শোধায়,
— কি চাই এখানে ?
বাবার এমন কথাতে মেয়েটি ও যেন শক্তপোক্ত হয়ে ওঠে। উত্তরে বলে,
— একটা মেয়ে দীর্ঘ ১৫ বছর পর তার বাড়িতে ফিরে আসে কিসের জন্য ? আন্দাজ করুন তো…? দেখি আপনার আইকিউ লেভেল কতটুকু ?
কন্ঠে ক্ষুদার্ত বাঘিনীর একটা সুপ্ত গর্জন ছিলো। তবে এবার কনফিউশানে পড়ে গেলেন মিস্টার মির্জা। তিনি এতোদিন তাহলে কার পেছনে ঘুরছিলেন ? সেই মেয়েটা যদি তার নিজের মেয়ে হয় তাহলে এটা কে ? তবে সন্দেহ তো দূর করতেই হবে। তাই সন্দেহ মেটানোর প্রয়াসে লোকটি আবারো শুভ্রা কে জিজ্ঞাসা করে ,
— তুমি যে আমার মেয়ের সাথে প্রমাণ কি ? প্রমাণ দাও !
— যদি দিতে পারি ?
— তাহলে মেনে নেব তুমি আমারি মেয়ে !
এটুকু কথা বলতেই মিস্টার মির্জার কপালে সূক্ষ্ম চিন্তার ভাঁজ পড়লো। তবে তা শুভ্রার চোখ লুকোতে পারলো না। এর মধ্যেই মোর্শেদা মির্জা স্বামীর দিকে সন্দেহের দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রশ্ন ছুড়লেন ,
— আরে তুমি কি পাগল হয়ে গিয়েছো ? আমাদের তো একমাত্র ছেলে আরবি মির্জা । তাহলে মেয়ে আসবে কোত্থেকে ?
মিসেস মির্জার কথা শুনে মিস্টার মির্জা থামিয়ে দেয় আর বলে ,
— আরে সেজন্য এটা বললাম। দেখি ওর মুরাদ কতটুকু। প্রমান করতে পারে কিনা !
এই কথাটা শুনে শুভ্রা মুচকি হাসে। আর বলে
— গভীর জলের মাছ বৃষ্টির খবর না রাখলেও, খাদ্যের সন্ধানে জলের উপরে তো উঠে আসে তাই না ?
ভ্রু খানিক কুচঁকে আসে মিস্টার মির্জার। মনে মনে একটা কথা আওড়ায়,
— যদি এ প্রমাণ করতে পারে যে ও আমার মেয়ে , তাহলে তো আমার গেমে জেতাটা খুব সহজ’ই হবে।
এটুকু ভেবে একটু মুচকি হাঁসে মিস্টার মির্জা। বাবার মুখের হাঁসি দেখে শুভ্রা বলে ,
— বাবা ! মানুষটা দেখতে তুমি নিষ্পাপ অথচ ভেতর টা ড্রেনের কালো পানির চেয়েও কালো। বলি এত কালো দূর করবে কিভাবে ?
এটুকু ভেবেই বাবার দিকে এগিয়ে আসে শুভ্রা। এবার গলার স্বর খানিকটা নিচে নামিয়ে বাবাকে উদ্দেশ্য করে বলে ,
— আমি যে আপনার মেয়ে সেটা প্রমাণ করার জন্য আমাকে ডিএনএ টেস্ট করতে হবে। তো আপনি কি আপনার কোন ডিএনএ স্যাম্পল দিতে পারবেন ? আমি টেস্ট করে আগামীকালই আপনাকে প্রমাণ করে দেবো যে আমি আপনার মেয়ে। ফারিয়াতুল নিথিয়া মির্জা ওরফে শুভ্রা । ডটার অফ ফাইয়াজ মির্জা ওরফে নেওয়াজ মির্জা !
— উহু ! তোমাকে তো বিশ্বাস করা যাচ্ছে না। কেননা তখন দেখা গেল যে তুমি ডিএনএ রিপোর্টটা ভুলভাল বানিয়ে আনবে তখন কি হবে ?
— এত সন্দেহ আপনার কবে থেকে মিস্টার মির্জা ? চিন্তা করবেন না। আমি অন্তত আপনার মত মীরজাফর না। যদিও আমি জানি আপনি আমার জন্য আপনার মূল্যবান সময় হসপিটালে কাটিয়ে ডিএনএ রিপোর্ট আনাবেন না। তাই বলব যখন আপনার আর আমার ডিএনএ টেস্ট করা হবে তখন ডক্টর নিজে ভিডিও কলে আমাদের রেখে তারপর করবেন। ওকে ?
শুভ্রার কথার কোনো প্রকার উত্তর না দিয়ে নিজের রুমে চলে আসে মিস্টার মির্জা। মেয়েটা তার ডিএনএ অব্দি চলে গিয়েছে, সত্যিই কি তার মেয়ে ? মাথায় দুহাত চেপে বিছানায় বসে পড়লো। নাহ রিপোর্ট না আসা অব্দি শিউর হওয়া যাচ্ছে না। আপাততো তার একটু ট্রিটমেন্ট দরকার। দ্রুত কল করলো নিজস্ব ডক্টর কে। এদিকে বাবার এমন হাবভাবে শুভ্রা মনে মনে বলে,
— কেনো এতোটা বদলে গেলে বাবা ? যে বাবার গা ঘেঁষে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে পড়্তাম সে বাবার কাছেই আজ আমি অনিরাপদ ! শুধুই কি সম্পত্তি ? নাকি তুমি আমার বাবাই নাহ ? সব গোলমেল হয়ে যাচ্ছে কেনো ? আচ্ছা আমার হাতে যেমন একটা দাগ আছে ঠিক সেরম দাগ তো তোমার পিঠে আছে। তাহলে কি তোমার পিঠের দাগ টা আমি দেখবো ? কিন্তু কীভাবে ?
~চলবে?
#প্রণয়ডোর
#পর্ব_বারো
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম
গ্রুপের ভিডিও কলে ডাক্তারের সাথে আছে মিস্টার এবং মিসেস মির্জা সেইসাথে শুভ্রা। তাদেরকে অন ক্যামেরা তে রেখেই ডিএনএ টেস্ট করা শুরু করলেন ডাক্তার। কিছুক্ষণ পরেই ডাক্তার চমকিত হয়ে উত্তর দিলেন ,
— আরে বাহ আপনাদের ডিএনএ তো ম্যাচ করে গিয়েছে !
ডাক্তারের কথাটা বলতে দেরি হয়েছে কিন্তু মিস্টার মির্জার ধড়ফড় করে ওঠা দেরি হয়নি । তার মুখে বর্তমানে বিরাজ করছে এক আকাশ সম বিস্ময়তা। দ্রুততার সাথে তিনি কল কেটে দেন । এবার থেকে অন্য পথ বেছে নিতে হবে। আগের মেয়েটা কে ছিল তা তাকে বের করতে হবে। এদিকে মিসেস মোরশেদা মির্জাও কিছু জিজ্ঞাসা করার উপায়ন্তর পাননি। তার আগেই বাসা ত্যাগ করে মিস্টার মির্জা। এদিকে কলে ডাক্তারকে থ্যাঙ্ক ইউ জানিয়ে কল কেটে দিয়ে মুখে প্রশান্তির হাসি হেসে বলে ,
— অতীত থেকে আর কিভাবে পালাবে বাবা ? যে অতীতকে ঢাকতে তুমি এত কিছু করছো সেই অতীত’ই তোমার সামনে। একদম তোমার সম্মুখে ! প্রস্তুত থাকো বাবা তোমার মুখোমুখি আমি আবারও হবো। তবে ভিন্ন একটা চরিত্রে, যে চরিত্র আমার ! একদম আমার ! যা একান্তই ফারিয়াতুল নিথিয়া মির্জার।
এই ভেবেই পাশে বসে থাকা তাসবির দিকে চোখের ইশারায় কিছু বলে চলে যায়। এদিকে শুভ্রার খালামণি ও তাকে কিছু বলতে পারল না। তবে এটুকু বুঝলো যে মেয়েটা হয়তোবা বিজয়ের চূড়ান্ত পর্যায়ে আছে। এভাবেই তিনি আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন ।
~~
অন্ধকার কক্ষ। চারি পাশে জানালা আছে নাকি নেই সেটা বোঝারও ক্ষমতা নেই। যেন চারিপাশে আলোর বড্ড অভাব। তবে শুভ্রা সেই ঘরে প্রবেশ করার সাথে সাথে আলো জ্বলে উঠলো। সেই সাথে আবারো বন্ধ হয়ে গেল। তবে একটা ফোকাস লাইট পড়লো চেয়ারে বসে থাকা ব্যক্তিটির উপর। তার হাত-পা বাধা মুখে টেপ লাগানো। চোখ দুটোর দিকে তাকিয়ে শুভ্রা মুচকি হাঁসলো। মাথায় পড়ে থাকা ক্যাপটা উঠিয়ে ডান হাতের বুড়ো আঙ্গুল দিয়ে কপাল স্লাইড করে নেয়। ভাবে, এখানে সে এসেছে বিশ্বাসঘাতকতা ও প্রতিশোধ নিতে। বলা যায় এটা তার প্রথম ধাপ।
চেয়ার টেনে সামনে বসলো। ব্যক্তিটির চোখ দু’খানা দেখে চিনতে অসুবিধে হয়নি তার। আর ব্যক্তিটিও শুভ্রাকে দেখে চমকে যায়। শুভ্রা খানিকটা নড়েচড়ে বসে ব্যক্তির মুখের টেপ টা সরিয়ে দেয়। কণ্ঠস্বর খানিকটা উঁচু করে বলে,
— কিহ সিয়াম ? একা তো জীবন আমাকে ঠকিয়েছো ! তার ওপর এখন আমাকে পুরোপুরি শেষ করার জন্য আমার বাবার সাথে হাতে হাত মিলিয়েছো বাহ ! তোমার কাজের প্রশংসা করতেই হয়।
এমন কথা শুনে মুচকি হাসে সিয়াম। উত্তরে বলে ,
— তোমার ক্ষতি করব না তো কি অন্য কারো ক্ষতি করব ? তুমি ভুলে গিয়ে বসেছ যে তুমি আমাকে একটা সময় ভালবাসতে । প্রচন্ড রকম ভালবাসতে। আর সেই তুমি কিনা এখন আমাকে ভুলে গিয়েছো। তাই না ? সুতরাং তুমি আমার না মানে অন্য কারোরই না। সেজন্যই তো তোমার ক্ষতি করতে লেগেছি।
— আরে বাহ ! ঠকানোর সময় এই কথাটা মনে ছিল না তোমার ? যাই হোক ! আগের হিসেব বাদ। এখানে তোর তামাশা দেখতে আসিনি সেইসাথে বানোয়াট কথা বন্ধ কর, তোর ভালোবাসা সম্পর্কে আমার ধারণা হয়েই গিয়েছে। ভাগ্যিস তুই আমার লাইফে থাকিস নি, সেজন্যই তো একজন সঠিক মানুষ পেয়েছি জীবনে। আল্লাহ আমাকে রক্ষা করেছেন। বাদ দে, একটা অতিরিক্ত কথা বলবি না যাতে আমার মাউথ ল্যাঙ্গুয়েজটা চেঞ্জ হয়ে যায় । এবার কাজের কথা বল, বাবাকে তুই কীভাবে চিনিস ?
— সব জেনেও কেন আমার থেকে আবারো জানতে চাইছো ?
— কারণ আমি তোর থেকে জানতে চাচ্ছি ! এবার বল।
— তুমি এভাবে আমার সাথে কথা বলতে পারো না। কঠিন গলায় তো একদম ই না।
সিয়ামের গলায় খানিকটা অধিকার বোধ ছিলো। যার ফলস্বরূপ শুভ্রা চেচিয়ে উঠলো,
— পর পুরুষ হয়ে একদম আমার উপর কোন অধিকার খাটাতে আসবি না। আমার হাজব্যান্ড জানতে পারলে তোর জিভ টেনে ওখানেই ছিড়ে কুকুরকে খেতে দেবে। মেয়েদের ইউজ করাই তো তোর প্রফেশন। তাহলে ওটা ছেড়ে আমার পিছু কেনো নিলি ?
শুভ্রার কন্ঠস্বর ছিলো অতিরিক্ত রাগমিশ্রিত। এবার সিয়াম ও ক্ষেপে গেলো। আর মুখ ফসকে সত্যিটা বলেই দিলো। আর এরকম একটা সত্যি শুনে কয়েক কদম পিছিয়ে যায় শুভ্রা। গুনে গুনে কি প্রিয় মানুষ দের ই তার সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করতে হবে ? কেনো ?
~চলবে?