প্রণয়ডোর পর্ব-১৬+১৭+১৮

0
549

#প্রণয়ডোর
#পর্ব_ষোলো
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম

— তাসবির পোস্ট মর্টেমের ভুয়া রিপোর্ট তৈরি করে জমা দিয়ে দাও।

— ম্যাম ! একটা জীবিত মানুষ কে মৃত বানানোর এতো কুট-কৌশল কেন ?

— সময় হলেই জানতে পারবে।

— ম্যাম, এইটা স্যারের প্রশ্ন।

— তাহলে তো আমি আরোও বলবো না। আর তোমার স্যার কে বলো ঐ দিন যেভাবে মরতে চেয়েছিলো সেভাবেই মরার মতো পড়ে থাকতে। নাহলে আমাকে পেতে হবে না। দু’জন কেই মেরে গুম করে দেবে।

— আপনার সাথে কথা বলতে চাইছে ম্যাম।

— আমার সাথে ওনার কথা মানে দেয়ালের সাথে টিকটিকির চিপকে থাকে। যার ইচ্ছে আমার বিন্দুমাত্র নেই। ফোন রাখো।

এটুকু বলেজ ফোন কাটতে নেয় সে। তখনই আওয়াজ শুনতে পায় তাসবির। সে বলছে ,

— কথা বলবো না জাস্ট এক নজর দেখবো ও ঠিক আছে কি না। কেমন আছে।

এটুকু শুনে শুভ্রা আর আগালো না। গাড়িটা ড্রাইভ করে এক সাইডে নিয়ে থামায়। আর অপর পাশের অনুমতি ছাড়াই অডিও কল ভিডিও তে কনভার্ট করে। সাথে সাথে রিসিভ হয় কল। দৃশ্যমান হয়েছে তাসবির মুখখানা। একদিনে অনেক অবনতি দেখতে পাচ্ছে সে। চোখ নামিয়ে নিলো। তাসবির মাথায় আর হাত পায়ে ব্যান্ডেজ। তাসবি অপলক দৃষ্টি তে তাকিয়ে আছে স্ক্রিনে। পলক ফেললেই বুঝি চলে যাবে। শুভ্রা বুঝে পায়না লোকটা তাকে এতোটা ভালো কেনো বাসে। যার একটু অবহেলা তে মরতে পর্যন্ত গিয়েছিলো। ভাগ্যিস…! সেসব বাদ দিয়ে তাসবি কে কড়া গলায় শোধালো,

— কোনো অনিয়ম চলবে না। নিজের ক্ষতি করবেন যতো, আমাকে হারানোর চান্স বাড়বে ততো। এবার চয়েজ আপনার। আশা করি নিজের খেয়াল রাখবেন।

তাসবির চোখ ছলছল করছে। বোধহয় কিছু বলবে। স্বামী-স্ত্রী কে স্পেস দিতে চলে গেলো মেয়েটি। তাসবি হাতে ফোন নিয়ে বসে আছে। ফ্যাকাসে মুখটা তার ভেতর ভেতর জ্বালিয়ে মারছে। চোখ বন্ধ করে বড় একখান শ্বাস নিলো। আর বললো ,

— ভালোবাসি আপনাকে । পাগলামো করবেন না প্লিজ। আমাকে এই সময় আঘাত করবেন না মানসিকভাবে। নীল নীলাঞ্জনা তে যাচ্ছি। এখন রাখি, আল্লাহ হাফেজ।

এই বলেই কাট হলো কল। বিস্ফোরিত নয়নে অপরপাশের ব্যক্তির অভিব্যক্তি খানিক টা চক্ষুগোচর হলো বোধহয় তার। তবে পরক্ষনেই প্রশান্তির হাঁসি টার দেখা মিললো না তার। এর আগেই কল কেটে দিয়েছে সে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলে,

— বারবার অপ্রকাশিত রাখতে গিয়েই খেই হারিয়ে ফেলি। আর এই লোকটা তো তা করার জন্য বাধ্য করায় এক্সপার্ট । অদ্ভুত লোক একটা যেনো। না জানি কি ভাবে আজ। তবে তার কাছে আমায় যেতেই হবে। নাহলে ইমপ্রুভ বোধহয় হবে না। ইমপ্রুভ না হলেও সমস্যা আমারই !

অতঃপর ড্রাইভ করায় মনযোগ দিলো

~~

‘নীল নীলাঞ্জনা’ বাড়িটির সামনে দাঁড়িয়ে আছে শুভ্রা। কলিং বেল চেপেছে মিনিট দুয়েক হলো। কিন্তু ভেতর থেকে কারোর কোনো সাড়া শব্দ পাওয়া যায়নি। বিরক্তি বোধ করলো না সে। যথেষ্ট ধৈর্য তার আছে। অল্পতেই নাক মুখ কুঁচকে ফেলা মেয়ে সে নয় । তাই আবারো সেই কাজের পুরাবৃত্তি করলো। সেকেন্ড কয়েক পর মিসেস মোর্শেদা মির্জার গলার আওয়াজ আসলো। আওয়াজ শুনে সে সেভাবেই ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। সাইড ব্যাগ থেকে ফোন বের করতে যেয়েও করলো না। এই বাড়িটা তার জন্য একদম অনিরাপদ। আগে বাড়িতে ঢুকে নিজের জন্য খতিয়ে কিছু জায়গা নিরাপদ যাচাই করতে হবে। নেওয়াজ মির্জার যা কুট বুদ্ধি। নির্ঘাত তাকে মেরে ফেলতে মন চাইবে তার। কিন্তু মারতেও পারবেনা, কারন রহস্য নিয়ে কেউ বাঁচতে চাইবে না। নেওয়াজ মির্জার মতো লোক তো একদম ই না। এসব ভাবনার মাঝেই সদর দরজা খুলে যায়। উন্মোচিত হয় মিসেস মোর্শেদা মির্জার মুখমণ্ডল। তাকে দেখে ওনার রিয়াকশন শূণ্য। ভাবছে সতীনের মেয়ে না জানি কেমন হয়। তবে তিনি ব্যাপার টা কীভাবে নিয়েছেন সেটাও তার অজানা। তবে মহিলার সাথে মন যুগিয়ে কথা হাশিল করতে হবে। এটুকু মাথায় ঢুকিয়ে নেয় সে। তখনই ভদ্র মহিলা তাকে উদ্দেশ্য করে বলে,

— তুমি?

মহিলার কন্ঠ স্বাভাবিক। এতে সে খানিকটা অবাক হলো। তবে সেটা বুঝতে দিলো না। মহিলাকে উদ্দেশ্য করে বললো,

— জি, আমি।

তারপর ট্রলি টা চোখের ইশারায় দেখিয়ে বললো,

— আজ থেকে আমি এখানেই থাকবো। ওনি কোথায় ? আই মিন আপনার হাসবেন্ড !

শুভ্রার এমন কথায় ভদ্র মহিলা এবার চরম অবাক হলেন। আর বললেন,

— এভাবে কেন বলছো ? ওনি তো তোমার বাবা। বাবা বলে ডাকো ? জানি তোমাকে ফেলে এসে ওনি ভালো করেননি কিন্তু বাবা তো সবসময় বাবাই হয়। তাইনা ?

ভদ্র মহিলার কথা শুনে সে সহজ হতে চেষ্টা করলো। খানিকটা উপলব্ধি করলো এই মহিলার ও দোষ নেই, দোষ তো তার জন্মদাতা পিতার। এই মহিলা কে খানিকটা না বরং পুরোটা ভরসা করতে ইচ্ছে হলো তার। তবে দমে গেলো। আগে যাচাই-বাচাই হোক। তারপর না-হয় ! তবে ওই মহিলা কোথায়, যার জন্য তার বাবা তার মাকে অত্যাচার নির্যাতন দ্বিধা করেননি। তবে মহিলাটা তাকে কত সহজ ভাবে মেনে নিচ্ছে দেখালেও হয়তো ভেতর ভেতর তিনি পুড়ে যাচ্ছেন। তিনি সৎ মেয়ের সাথে অভ্যস্ত নন। তবে ভদ্র মহিলার এই আতঙ্ক সে দূর করবে। যদি তিনি নির্দোষ হন তবেই। এটুকু ভেবে মুখে আলতো হাঁসির রেখা ফুটিয়ে ভদ্র মহিলা কে বলে,

— আচ্ছা , বললেন না বা,,,

তাকে আর কষ্ট করে কিছু বলতে হলো না। ভদ্র মহিলাই বললেন,

— তোমার বাবা বাহিরেই বেশিরভাগ থাকেন। আজও এর ব্যতিক্রম না। আমি ওনাকে কল করে বলছি ওনি এসে যাবেন। তুমি বরং আসো। ভেতরে আসো।

ভদ্র মহিলার কথায় সে মাথা নাড়ালো। নাকের ডগায় চশমা টা ভালোমতো ঠেকিয়ে নিলো। বাবা ডাকটা ভুল মানুষকে ডাকলে বড্ড কষ্ট হয় তার। তাই কথা না বাড়িয়ে সামনে এগিয়ে গেলো। ভদ্র মহিলাও দরজা আটকিয়ে চললেন দ্রুত পায়ে। শুভ্রা সোফায় বসে শুধু তা পরখ করলো। ভদ্র মহিলা কে রান্না ঘরের থেকে বের হতে দেখলো সে। হাতে ফল কাটার ছুরি। ক্রমশ এগিয়ে আসছেন তিনি শুভ্রার দিকে। হঠাৎ…

#চলবে

#প্রণয়ডোর
#পর্ব_সতেরো
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম

মিসেস মোর্শেদা মির্জা হাতে ছুড়ি নিয়ে শুভ্রার পাশের সোফাটাতেই বসে পড়লেন। খুব মনযোগ সহকারে আপেল কাটছেন তিনি। শুভ্রা মুচকি হাঁসলো। মহিলা টা তাকে পরীক্ষা করছিলো। আসলে তিনি ছুড়ি নিয়ে সেভাবেই এগিয়ে আসছিলেন কিন্তু কাছে এসেই রূপ বদলালেন। শুভ্রার মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেলো না। তবে মুখে চাপা হাঁসি রেখেই ভদ্র মহিলা কে জিজ্ঞাসা করলেন ,

— আরাফ ভাইয়া কোথায় ?

শুভ্রার মুখে আরাফের নাম শুনে মাথা তুলে তাকায় ভদ্র মহিলা। তার মুখে মুচকি হাঁসি দেখা যায়। সেভাবেই বলে ,

— আমার আরাফের কথা তুমি জানো ?

— বা রে ! বাবার বাড়ি আসবো , বাবাকে জানবো , আর তার আরেকটা সন্তান কে জানবো না ?

— তা ই বলো ! আরাফ আজ রাতে আসবে বিডি তে। কি যেনো ইম্পোর্টেন্ট কাজ আছে এখানে। অবশ্য ওর অধিকাংশ কাজ দেশের বাহিরেই থাকে। তবে হঠাৎ বিডি তে৷ সে যাই-হোক বাদ দাও। আচ্ছা আমার সম্পর্কে তুমি জানো ?

— কিছুটা !

— জানতে চাও আমায় ?

— যদি জানান, তবে জানতে অসুবিধে নেই আমার।

— আচ্ছা বেশ । বলবো। আগে যাও ফ্রেশ হয়ে নাও। তারপর না হয় সব কথা হবে।

— আ,,আমা …

— তোমার রুম । তাইতো ?

— হ্যাঁ !

— সোজা গিয়ে লেফটের রুম টা তোমার। আমি কদিন আগেই গোছগাছ করে রেখে ছিলাম। তবে তোমার যদি কোনোকিছু ঠিক ঠাক করা লাগে, আমাকে বলিও। আমি দেখবো ব্যাপারটা।

— এতো ব্যস্ত হবেন না সৎ মেয়েকে নিয়ে ।

শুভ্রার এমন কথা শুনে হাত থেকে ছুড়ি টা রেখে দেন ভদ্র মহিলা। তার ফল কাটা শেষ। প্লেট হাতে নিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে এক পলক তার দিকে তাকিয়ে বলে ,

— মা তো মা ই হয় । সৎ আর আপন বলতে কিছু হয় ? হয়তো গর্ভে ধারণ করা মেয়ে তুমি আমার নও। কিন্তু আমিও একজন মা। আমি আমার এক ছেলের পাশাপাশি তোমাকে আমার মেয়ে হিসেবে পেয়ে কিন্তু আমি বেশ খুশি। আমি অন্যান্য মায়েদের থেকে একদম আলাদা।

শুভ্রাও উঠে দাড়ালো। ভদ্র মহিলার প্লেট থেকে এক টা আপেলের অংশ নিয়ে নেয় সে। সেভাবেই বলে ,

— ওওও ! তাই নাকি ?

তাচ্ছিল্যের সুর খানিকটা তবে সেটা পরোয়া করলেন না ভদ্র মহিলা। মুখ ফুটে বললেন ,

— মিলিয়ে নিও ! আর হ্যাঁ ! আপেলের টুকরো টা ধুঁয়ে তারপর খাও। তুমি ফ্রেশ হয়ে যাও , এগুলো তোমার জন্যই কেটেছিলাম। আমি তোমার রুমে নিয়ে যাচ্ছি। যাও।

— না লাগবে না। আমি এমনিতে ফল খাইনা, কিন্তু ওই কথার ছলে নিয়ে নিলাম একটা। যা একবার নেই তা ফিরিয়ে দিইনা আমি। তাই না চাইতেও খেতে হবে।

শুভ্রার এমন উত্তরে কিছু বললেন না ভদ্র মহিলা। শুধু নিজের কাজে মগ্ন হলেন। মেয়েটা ছোট থেকেই বাবা-মায়ের নাগাল ছাড়া ছিলো কি-না ! একটু তো অন্যরকম থাকবে।

~~

বাথরুম থেকে ফ্রেশ হয়ে টাওয়াল টা বারান্দায় মেলে দিয়ে এসে বেডে বসে পড়ে। হাত দুটো পেছনে ভর দিয়ে মাথা ও খানিকটা উচুঁ করে উপরে তাকায়। বুঝতে পারছে না, রুম টা তার জন্য সেইফ কি-না। এতোক্ষণে বোধহয় নেওয়াজ মির্জা এসে গিয়েছেন। না আসবার কোনো কারন নেই। আসতেই হতো। এবার পুরো দমে নেওয়াজ মির্জা কে শরীরের ঘাম ছুটিয়ে দেওয়ার জন্য প্রস্তুত হতে হবে। তবে আরাফের বিয়ে অবধি অপেক্ষা করতে হবে। কবে যে এই ছেলেটা বিয়ের কথা বলবে। তবেই না সহজ হবে পুরো কাজ টা। এগিয়ে গিয়ে নিজের রুমের ইলেক্ট্রিসিটি বোর্ডের সুইচ অফ করে দেয়। তারপর নিজের আনা ব্যাগ থেকে একটা যন্ত্র বের করে দেয়ালের শুরু থেকে শেষ অবধি পরীক্ষা করে নেয়। যদি কোনো ইলেক্ট্রনিক্স জিনিস থাকে তবে সে জায়গায় গিয়েই মেশিনিটা রেড এলার্ট দিবে। যেটা আর হয়নি। এতে খানিকটা অবাক হয় সে। বাবার বাড়ি এসেছে তাও বাবার ভয়ানক রুপ দেখবে না ? বাবাও বা কেমন ? তাকে তার ভয়ানক রূপ দেখাবে না ? এসব ভাবতে ভাবতেই তার নাম ধরে কেউ ডাকলো। শুভ্রা বুঝতে পারলো তার বাবা তাকে ডেকেছে । ব্যাগ থেকে ওড়না নিয়ে গাঁয়ে খুব ভালোমতো জড়িয়ে আয়নার সামনে দাঁড়ায়। মুখের অতিরিক্ত মাস্ক টা ঠিকঠাক ই আছে। তারপরেও খুব সতর্কতার সাথে ডায়নিং রুমে গেলো । সেখানে গিয়েই চরম অবাক হলো সে। আরাফ বসে আছে ডায়নিং টেবিলে, তার পাশেই নেওয়াজ মির্জা। অল্প অল্প করে খাবার খাচ্ছে। আর এটা সেটা বলে বার বার হাঁসছে। এমন একটা পরিবেশ কক্ষনো আশা ও সে করেনি। তাই তার আকাশচুম্বী বিস্ময়তা ধরা দিলো চোখে আর মুখে। তবে আরাফ তাকে দেখে কি রিয়্যাক্ট করে সেটাই দেখবার বিষয়। তাই না ভেবেই সামনে আগালো। তখনই মিসেস মোর্শেদা মির্জার চোখে শুভ্রা কে পড়ে। আজকে মেয়েটা সাদা পড়েছে। পুরো একটা শুভ্রপরী যেনো। বোধহয় আজ তার নামের স্বার্থকতা পেয়েছে। এই বলেই মুচকি হেঁসে ডাক দেন শুভ্রা কে। চোখ তুলে তাকায় সবায়। অতি পরিচিত একটি নাম শুনে চমকে মায়ের ডাকের অনুসরণ করলো ছেলে আরাফ। মুখ দর্শন করে অতি চেনা একটা মুখ দেখে অবিশ্বাস্যতা ফুটে উঠলেও সাথে সাথে কাঠিন্যতা বিরাজ করে চোখে মুখে। ক্রোধে অনুভূতি শুন্য হয়ে, আর উঠে দাঁড়িয়ে পেছনের চেয়ার টায় লাথি মেরে সোজা হয়। ক্ষেপে উঠে বলে ,

#চলবে

#প্রণয়ডোর
#পর্ব_আঠারো
#লেখিকা_রামিশা_তাসলিম

আরাফের লাথির খানিকটা আওয়াজে ভ্রু কুচকে তাকায় মিস্টার নেওয়াজ মির্জা। ছেলের দৃষ্টি অনুসরণ করতেই তার চোখ যুগল আটকালো মেয়ে নিথিয়া ওরফে শুভ্রার দিকে। দৃষ্টি নামিয়ে দ্রুত বামহাতে পকেট থেকে ফোন বের করে। ফেস লক তাকায় ঝামেলা হয়নি। ফোন খুলে যায় কয়েক সেকেন্ডেই। নেওয়াজ মির্জা আবার বাম হাতি। সেই সুবাধে খুব দ্রুতই কোনো একজন কে ওয়াটসঅ্যাপ এ মেসেজে কিছু বলে দেয়। তারপর পুনরায় ফোন পকেটে রেখে সামনে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে। শুভ্রা কে বাহু টেনে টেবিলে বসাচ্ছে মিসেস মির্জা। আরাফ আর দাঁড়ায় নি। ফের বসে গিয়েছে। নেওয়াজ মির্জা আর শুভ্রা একে অপরের মুখোমুখি আর আরাফ শুভ্রার পাশের চেয়ারেই বসা। তা দেখে শুভ্রা মুচকি হাঁসি উপহার দিলো।

প্লেটে খাবার তুলে দিলেন মিসেস মোর্শেদা মির্জা। আর সেভাবেই নিজের ছেলেকে জিজ্ঞাসা করলেন ,

— কি আরাফ! খাবারের মাঝে তুমি চেয়ারে লাথি দিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে পড়েছিলে কেন ? কোন সমস্যা ? খাবার খেতে ভালো হয়নি ?

মায়ের এমন কথা শুনে আরাফ হকচকিয়ে যায়। অপ্রস্তুত ভাবেই উত্তর দেয় ,

— আরে না না মা। তেমন কিছু না। আর তোমার হাতের রান্না বাজে হবে, এইটা কি কখনো হয়েছে ? নাকি হবে ? আমার কাছে তোমার রান্না মানে বেস্ট।

ছেলের এমন কথা শুনে মা-বাবা দুজনই হাসলো। তবে অবাক হলো শুভ্রা। একমনে খাবার খেলেও মনে মনে তার বিস্ময়তা। ছেলেটা এতো নিঁখুত অভিনয় করতেও জানে ? পাক্কা অভিনেতা। এটুকু ভাবতেই ওর চোখে ভাসলো ফারিয়া আপুর মায়াবী মুখখানা। মেয়েটাকে জঘন্য ভাবে ঠকিয়েছে যে এই লোকটা।

কথা উঠলো আরাফের বিয়ের। জিনিয়া নামক এক বিদেশীনির সাথে তার বিয়ে ঠিক করেছে মিস্টার মির্জা। শুভ্রা মনে মনে খানিকটা খুশি হলো। সেইসাথে কাজের চাপ বেড়ে গেলো। তবুও ব্যাপার না , অন্যায় যত দ্রুত সামনে আনা যায় ততই ভালো। এই ভেবে আবারো মন যোগে নেতাদের কথাবার্তা শোনায় । আরাফ বললো ,

— তাহলে এক কাজ করো আগামীকাল সন্ধ্যার দিকে তাদের সবাইকে আমাদের বাসায় ইনভাইট করো। বিয়ের ডেট ডিসাইড হবে। তাহলে ? আমাদের বিয়েটা ফাইনাল হচ্ছে।

উপরোক্ত এই কথাটি বলে আরাফ আড়চোখে শুভ্রার দিকে তাকায়। তার রিয়াকশন কি। কিন্তু কোনো রিঅ্যাকশন তার মুখ দেখে বোঝা গেল না। বোঝার সুযোগ টাই দেয়নি মেয়েটা। মেয়েটা বড্ড চালাক চতুর। কিন্তু কিভাবে নিজের বোনের প্রেমিকের বিয়ে কীভাবে আটকাবে সেটাই দেখার বিষয় ! এটুকু ভেবেই মনে মনে শয়তানি হাসি দেয় আরাফ। খাবারে মনযোগ দেয় ।

এদিকে শুভ্রা ভাবছে অন্য কিছু। মনে হচ্ছে ইদানিং তার মাথায় বেশি চাপ পড়ে যাবে। তাই নিজের সাথে অর্ধেক চাপ অন্য কাউকেও দিতে হবে। সঠিক সময় তাহলে এসে গিয়েছে। এই ভেবে দ্রুত খেতে থাকে সে। রুমে গিয়ে কয়েকটা কাজ তাকে করতে হবে।

~~

জানলার গ্রিল ধরে দাঁড়িয়ে আছে তাসবি। মাথায় ব্যান্ডেজ। পড়নে ব্ল্যাক প্যান্ট আর টি-শার্ট। বাহিরের মৃদ্যু মন্দ হাওয়ায় তার চুলগুলো খানিক নড়ছে। চোখে মুখে লেপ্টে আছে এক রাশ বিষন্নতা। সেদিনের বোকামির জন্য বউ বুঝি থাকে শাস্তি দিচ্ছে। এটা মাথায় ভাবতেই ছোট বাচ্চাদের মতো ঠোঁট উল্টালো। আজ চারদিন সে রুমের বাহিরে যায়না। শুভ্রা ও তার খোঁজ নেয়না। সকলের কাছে বুঝি সে সত্যিই মৃত। তবে এছাড়া উপায় ও নেই। নেওয়াজ মির্জা জানতে গিয়েও জানতে পারেনি শুভ্রার দুর্বলতা এই তাসবি। জানার আগেই অনেক কাঠ খড় পুড়িয়ে প্রমাণ করে শুভ্রা মৃত। তবে সত্যিকার অর্থে তাসবির বেশ আঘাত লেগেছে। সেগুলোর জন্যই রোজ নিয়ম করে একজন সার্ভেন্ট তাকে ওষুধ খাইয়ে দিয়ে যায়। আজও ব্যতিক্রম হয়নি এর। বিশ মিনিট আগেই তার ওষুধ খাওয়া শেষ হয়েছে।

নিজের কথা ভাবা শেষ করে শুভ্রার কথা স্মরণ করলো। রাতের বেলা এখন বউকে স্মরণ করা যেনো তার দৈনন্দিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। শুভ্রা এখন তার বাবার বাড়িতে। ওকে সারাক্ষণ ই পরখ করছে বিধায় সে আর আসতে পারেনি। আসবে আসবে করেও আর আসা হয়নি বউয়ের। হাতের কাছে ফোন নেই। টিভি আছে, দেখলে দেখো আর না দেখলে বসে থাকো। এমন অবস্থা। মুহুর্তেই তার বুকভরা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসলো। আকাশের পানে তাকিয়ে বললো ,

— ইয়া আল্লাহ ! কবে একটু শান্তি দিবে আমায় ? স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক টা নাহলে যে ফিঁকে হয়ে যাবে ! তুমি তো জানো আমার মনের কথা। ভালোবাসা নামক এক তীব্র যন্ত্রনায় আমি ভুগছি। বিয়ের পর বউকে ভালোবাসবো বলে হারামে যাইনি। আর হালাল হওয়ার পর বউকে ভালোবাসলাম ঠিকি কিন্তু বউ দায়িত্বের বেড়াজালে আমাকেই হয়তো ভুলে যাবে। হে আল্লাহ , আমি অসহায় ! আমায় তুমি রক্ষা করো !

কথাগুলো বিরবির করে একদমে বলে ফেলে সে। ততক্ষণে চোখের কার্ণিশ বেয়ে এক ফোঁটা নোনতা জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়লো। ছেলেদের নাকি ওতো সহজে কাঁদতে নেই। অথচ এই ছেলেটা কথায় কথায় কান্না করে। চোখের পানির মূল্য তবে তার কাছে নেই ? কি জানি !

নিজের প্রতি চরম বিরক্ততায় বেলকনি থেকে রুমে এসে বেলকনির থাই লাগিয়ে দেয়। লাইট অফ করে শুয়ে পড়ে সে। ঘড়ির দিকে পরখ করেনি সে। তবে বুঝলো হয়তো গভীর রাত হয়েছে। আজ আর ড্রিম লাইট টাও জ্বালিয়ে ঘুমোয় নি। হয়তোবা রাগ বা জেদের বশে !

মাঝরাতে কপালে একটা হাতের স্পর্শ অনুভব করলো তাসবি। ঘুমের ওষুধ খাওয়াতে চোখ ভালো মতো খুলতে পারলো না। আরোও ছিলো পুরো ঘরে অন্ধকার। যার ফলে কে তাকে স্পর্শ করলো তা বুঝতে পারলো না। তবে স্পর্শ টা তাকে বেশ আরাম দিচ্ছে। অতি আবেশে হাতড়িয়ে কিছু একটা আকঁড়ে ধরে ঘুমিয়ে গেলো।

এহেন কান্ডে খুশিতে তার গাল বেয়ে এক ফোঁটা পানি গড়িয়ে পড়লো। পরক্ষণেই হাতের উলটো পিঠে পানিটুকু মুছে ফেলে মুখে আনলো প্রশান্তির হাঁসি।

#চলবে?