#প্রণয়ডোর
|৩৩|
-রামিশা আঞ্জুম বুশরা
আজ আরাফের হলুদ সন্ধ্যা। বেশ কয়েক বছর পর ‘নীল নীলাঞ্জনা’ বাড়িটায় উৎসব লেগেছে। আগে আরাফের জন্মদিনে উৎসব হতো। কিন্তু আরাফ যখন দেশের বাইরে চলে যায় তখন থেকে আর উৎসব করা হয় না। বলা যায় মৃত বাড়িটায় পুনরায় প্রাণ ফিরে এসেছে। বাড়িটা ঘটা করে বাইরের দিক না সাজালেও ভেতরের দিকটা বেশ চাকচিক্যময় লাগছে। এক কথায় যাকে বলে সিম্পলের মধ্যে গর্জিয়াস।
সেদিন রাতে ডিনারের পর ফারিহা কেও আরাফের বিয়েতে ইনভাইট করা হয় । সেই জন্যই আজ হলুদ সন্ধ্যায় ফারিহা আর শুভ্রা একই ছাদের তলায়। ফারিহা এদিকে সেদিকে যেতে যেতে যখনই যেখানে যেই কাজ পাচ্ছে সেটাতে হাত লাগাচ্ছে । বলা যায় এখানে এসে সে হাত পা গুটিয়ে বসে থাকছে না। বরং কাজের কাজ করছে। বোধহয় বুকের ভেতরে থাকা চাপা কষ্টটা সে লুকানোর প্রয়ায়াসেই এইরকম করছে ।
তার এখন উপলব্ধি হচ্ছে যে, প্রিয় পুরুষের সাথে অন্য একটা মেয়েকে দেখাউর যে অসহ্য জ্বালা। সেটা দ্বিতীয় কোনো জ্বালা হতেই পারে না। বারবার চোখে ভাসছে তাদের ঝলমলে অতীত। যদিও সম্পর্কটা হারাম ছিল কিন্তু….।
চোখের পানি এক হাতে মুছে নেয় সে। শুভ্রা আর ফারিহা দুজনেই আজ একই ধরনের ড্রেস পড়েছে দুজনেরই হলুদ আর সবুজ রঙের কম্বিনেশনের গাউন । সাথে ম্যাচিং হিজাব। এলিনার বাড়ি থেকে অনেকেই এসেছে। বন্ধুরা বেশি এসেছে। গাঁয়ে হলুদের উপহার নিয়ে। সেদিক পানে যায়নি সে। ইচ্ছে করেনি তার। সকাল সকাল চলে এসেছে সে। আরাফ বোধহয় তার এখানে থাকার খবর টা জানে। তাতে কার কি। তার তো নতুন কারোর সাথে ঘর হবে। তাকে নিয়েই হয়তো চিন্তিত সময় পার করছে।
ভাবতে ভাবতেই ফারিহা হাতের কাজটা শেষ করে ফেললো। আওয়াজ আসলো অপরিচিত একটি পুরুষ কণ্ঠস্বরের।
-“হ্যালো , প্রিটি গার্ল।”
পেছন ঘুরিয়ে তাকালো সে। তার থেকে অনেকটা লম্বা একটা ছেলেকে আবিষ্কার করলো। ছেলেটার গাঁয়ের রঙ সুন্দর , মুখে চাপ দাড়ি , ঠিক ভ্রু বরাবর কালো কুচকুচে মধ্যম আকারের তিল। এক কথায় মা-শা-আল্লাহ । কিছু সময়ের জন্য থমকালো ফারিহা। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নিল। মাথা নামিয়ে নিল। এ কি করছে সে ! একটা পরপুরুষের দিকে নজর দিচ্ছে ? কিন্তু কেনো ! সে তো তখন দৃষ্টি নত করতে চেয়েও পারলো না । এইটা কি মন্দ না ? নিশ্চয়ই ছেলেটা তাকে বাজে মেয়ে ভাবছে।
-“উহুম উহুম!”
লোকটা কেশে গলা পরিষ্কার করে নিলো। দু’কদম এগিয়ে আসলো। তাদের দূরত্ব স্বাভাবিক’ই রইলো ।
-“আ,,আমি?”
-“এই আপনি কি তোতলা?”
অপরিচিত কারো কণ্ঠ থেকে এইরকম একটা অপ্রত্যাশিত প্রশ্ন শুনে কিছুটা বিব্রত হলো সে। ছেলেটা কি তার সাথে ফ্লার্ট করতে এসেছে৷? সাথে সাথে কাঠিন্যতা চলে আসলো তার মাঝে।
-“বলুন কি বলবেন।”
-“আরে ব্বাস। আপনি তো দেখছি ভালোই নাটক করতে জানেন । হঠাৎ এমন কাঠিন্যতার পরিচয় দিচ্ছেন কেনো? আমি কিন্তু আপনাকে ভালো করেই চিনি এবং জানি।”
ছেলেটার কথায় ভ্রু কুচকে নিলো সে। জিজ্ঞাসু হয়ে জিজ্ঞাসা করলো,
-“শেষে কি বলেছেন?”
-“আমি এক কথা রিপিট করিনা। আরেকটা কথা ! আমি আবির। ব্রাদার অফ…।”
•
হাতের কাজে দ্রুত শেষ করার চেষ্টা চালাচ্ছেন মিসেস মির্জা। সেইসাথে শুভ্রা। ছেলের হলুদ সন্ধ্যা বলে কথা। কোনো কিছুর কমতি তিনি রাখবেন না। আর কিছুক্ষণ পরেই নিজের দায়িত্ব পালন করতে ছুটে চলবেন ছেলের কাছে। তিনি এক পলক শুভ্রার দিকে তাকালেন। মেয়েটা খুব গুরুত্ব দিয়ে প্রত্যেকটা কাজ করছে। মিসেস মির্জার কাছে ভালো লাগলো ব্যাপারটা। তিনি এগিয়ে গেলেন মেয়েটার কাছে।
-“বলি ও মা । অনেক তো কাজ করেছো এবার স্টেজের দিকে যাও ৷ অতিথিদের আপ্যায়ন কর গিয়ে। আমি এদিকটা সামলে আসছি ।”
মিসেস মির্জার নরম কন্ঠে বলে উঠা কথায় এক পলক থাকায় শুভ্রা। মুচকি হাসি উপহার দেয় তাকে। চোখ দুটো আস্তে করে বুঝে নিলো সে। তারপর আবার চোখ মেলে তাকিয়ে মাথা উপর নিচে নাড়ায় । আর বলে ।
-“ঠিক আছে আন্টি । আমি বরঞ্চ এই কাজটা শেষ করে তবেই যাচ্ছি। ”
-“ঠিক আছে মা।”
•
স্টেজের সামনে থাকা একটা চেয়ার নিয়ে কোনায় গেলো। সেখানে সে বসবে। অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকার ফলে এখন তার কোমড় ব্যথা করছে । বিরস মুখে বসে পড়ে চেয়ারটায়। হাতে থাকা ফোনটা লক স্ক্রীনে তাকায়। হলুদের অনুষ্ঠান এতক্ষণে শুরু হয়ে যাওয়ার কথা। কিন্তু হচ্ছে না। বোরিং লাগছে তার। শুভ্রা কেউ কাছে পাচ্ছে না। যতই এই পরিবার তার ক্ষতি করেছে তবুও সৎ ভাইয়ের প্রতি তার একটা দায়িত্ববোধ থাকেই থাকে। শুভ্রা আর যাই হোক না কেন মেয়েটা অনেক দায়িত্বশীল। ছোট থেকে ছোট কাজ-ও সে বেশ দায়িত্ব নিয়েই করে।
এক মনে ফেসবুক স্ক্রল করছিল ফারিহা। হঠাৎই স্টেজ সহ সকল লাইট অফ হয়ে যায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার নামে মুহূর্তেই। তার মিনিট দুয়েক পর জেনারেটরের দ্বারা চালু হয় লাল নীল মরিচা বাতি।
একজন ইলেকট্রিশিয়ান চেঁচিয়ে বললেন , ইলেকট্রনিক প্রবলেমের কারণে মেইন লাইট গুলো অন হচ্ছে না। সুতরাং কেউ যেন ভয় না পায় এবং এই আলোতেই যেনো নিজেদের জায়গায় বসে থাকে।
ইলেকট্রিশিয়ানের কথাটা শুনে ফারিহা নিজের মত করেই পূর্বের ন্যায় ফোনে মনোযোগ দেয় । তখনই কেউ তার মুখ চেপে ধরে খানিকটা এগিয়ে একটা রুমে প্রবেশ করে। ঘাবড়ে যায় ফারিহা। চিৎকার করার মত কোনো সুযোগ হলো না তার।
-“ কীসের এতো শখ তোর ? ওই ছেলেটার সাথে কি বলেছিলি?”
অতি পরিচিত একটি কণ্ঠস্বর ফারিয়ার কানে ঠেঁকলো। কথার ধরন শুনে আর আবছা আলোয় মুখের অবয়বে তার আর সন্দেহ রইল না যে ব্যক্তিটি কে। ব্যক্তি টি আরাফ। ছিটকে দূরে সরে আসলো সে । খানিকটা রাগান্বিত স্বরে শোধালো,
-“ সমস্যা আমার না সমস্যা আপনার। নিজে…।”
-“কিহ?”
-“হ্যাঁ , যেটা শুনেছেন।”
-“সাহস বেড়েছে কেনো এতো ?”
-“কোন অধিকার নেই আপনার আমার বিষয়ে কথা বলার।”
ফারিহার এমন কথা শুনে মাথার চুলগুলো তে হাত চালালো। ফারিহা সেটা লক্ষ্য করলো। নিষ্ঠুর পুরুষটিকে আরেকটু আঘাত করার তীব্র ইচ্ছে জাগলো তার। তাই ফের শোধালে ,
-“তো বিয়ে করছেন সেটায় মনোযোগ দিন। নতুন কেউ আপনার জীবনের সহিত জুড়তে চলেছে , তাকে নিয়েই না হয় ভাবুন ? আমায় নিয়ে ভাবতে কে বলেছে। এছাড়াও আমাকে খেয়াল রাখার মতো অনেক মানুষই আছে। ”
আরাফ নিশ্চুপ। বলার মতো কোনো ভাষা তার অভিধানে পেলো না। ফারিহার কষ্ট সে উপলব্ধি করতে পারে। কিন্তু সে যে ভেতর ভেতর কষ্ট পাচ্ছে সেই কষ্ট কাকে বোঝাবে ? এই কষ্ট কাউকে বোঝানোর নয় । যাকে বোঝানো হবে তার শেষ পরিণতি হবে মৃত্যু।”
ফোঁস করে শ্বাস ফেলে স্থান পরিত্যাগ করতে উদ্যত হলো। তখনই আলো চলে এলো চারদিকে। ফারিহা রাশ ভারী কণ্ঠস্বরে ডাকলো ,
-“শুনুন।”
পা থামিয়ে দেয় আরাফ।
-“এদিকে আসুন।”
পেছন দিকে হেটেই ফারিহার একপাশে দাঁড়ায়। ততক্ষণাত নিজের হাত থেকে একটা রিং খুলে আরাফের মুখ বরাবর ধরে। আর বলে ,
-“এইটা নিন। আপনার বিয়েতে আপনার হবু বউকে দেওয়া অগ্রিম উপহার।”
কিছু না বলেই চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়ালো আরাফ। হাতটা ধরে ফেললো শুভ্রা। অনেক বছর পর মানুষটা স্পর্শ করলো। চোখ বেয়ে জল আসলেও , তা সন্তোর্পণে লুকিয়ে ফেললো।
-“এই টা আপনাকে নিতেই হবে।”
আরাফ এবারে মুখ খুললো। কাঠকাঠ গলায় ছ’শব্দের তৈরি করা এক বাক্যে শোধালো ,
-“আমি দেওয়া জিনিস ফেরত নিই না।”
বলেই মুখ ফিরিয়ে নেয় আরাফ। বুকে দুহাত গুঁজে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে। আর তার বরাবর সটান হয়ে দাঁড়িয়েছে ফারিহা। এক পা এগিয়ে হাতের জিনিসটার পানে তাকায়। তারপর শোধায়,
-“সেটা তো আর আপনার ভালোবেসে দেওয়া জিনিস না।”
-“কিন্তু আমার জিনিস তো?”
আরাফের সাথে সাথে উত্তর। কিছু বললো না সে। পুরুষটার মুখখানায় একবার তাকিয়ে চলে এলো। জিনিসটা সে যোগ্য পাত্রীর হাতেই দেবে। চোখের জল গুলো ভারী হয়ে আসলো। দুঃখ , কষ্টে হাত-পা ছোড়াছোড়ি করে কাঁদতে ইচ্ছে হলো ওর। তবুও অন্য কারোর ভালোবাসায় ভাগ বসাবে না বলে নীরবে নিভৃতে জ্বালা সহ্য করে নিলো।
বোধহয় মেয়েটা এই কাজটি করে নিজেকে মহৎ ভাবছে।
#চলবে?
#প্রণয়ডোর
|৩৪|
-রামিশা আঞ্জুম বুশরা
সব কাজ শেষে এবার স্টেজের দিকটায় আসলো শুভ্রা। ব্যস্ত পায়ে হেঁটে আসছে সে। স্টেজ বরাবর দাঁড়িয়ে এদিক ওদিক তাকাতে লাগলো। পেলো না ফারিহা কে। মনে প্রশ্ন জাগলো ,
-“মেয়েটা গেলো কোথায় ?”
তটস্থ পায়ে ছূটলো। আশপাশ টা খুঁজে দেখবে। সারাদিনে এতোটাই ব্যস্ত সে ছিলো যে কারনে বান্ধবী কিছু খেয়েছে কিনা সে খোঁজ টাও নেয়নি। নিজের কাছে নিজেকেই ছোট লাগছে তার। সে এই প্রথম দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। ননদ আর বান্ধবী , অতিরিক্ত দায়-দায়িত্ব ছিলো মেয়েটার প্রতি।
এদিক ওদিক ঘুরেও ফারিহা কে খুঁজে পেলো না সে। হঠাৎ ই দাঁড়িয়ে যায়। মনে পড়ে ফোনে কল করলেই তো সব ক্লিয়ার হয়ে যায়। দ্রুত হাতে ডায়াল করে ফারিহার নাম্বার। রিং হচ্ছে। কিন্তু কেউ রিসিভ করলো না। এইভাবে চারবার টানা কল করার পর রিসিভ হলো।
-“কোথায় তুমি?”
-“বাথরুমে।”
-“হোয়াট?”
-“হুম।”
-“বাথরুমে কেনো গিয়েছো?”
-“ঘুমুতে।”
-“ছেহ! এইগুলো কোনো কথা বইন?”
-“হুম।”
-“কোথায় আছিস সেটা বল।”
-“বললাম ই তো।”
-“ঠিক আছে , আসছি।”
কল কেটে দিলো শুভ্রা। বিরক্তি তে নাক মুখ কুঁচকে আসলো তার। এই মেয়ে ভারী অদ্ভুত। কখন কি করে বসে সেটা সে নিজেও বুঝতে পারেনা। আজ জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা পুরুষের হলুদ হয়ে যাচ্ছে আগামীকাল বিয়ে আর এই মেয়ের কোনো হেলদোল’ই নেই ।
শেষের কথাটুকু বেশ কয়েকবার আওড়ালো। ফের মনে মনে বললো,
-“কষ্ট পাচ্ছে না কই। হয়তো কান্না করতেই বাথরুম গিয়েছে। নয়তো অন্য কোনো ব্যাপার তো অবশ্যই আছে।”
আবারো হাঁটা ধরলো। আগে ওর রুমের ওয়াশরুমে খুঁজে আসবে। কারন মেয়েটার এই সাহস এখনো হয়নি যে অন্য কোনো বা অন্য কারোর বাথরুমে গিয়ে লুকোবে।
•
স্টেজে মনমরা হয়ে বসে আছে আরাফ। অন্য কিছু নিয়ে সে ভাবছে। প্রচন্ড ভাবছে। তখন ফারিহার বলা কথাগুলো বারবার কানে বাঁজছে। ভেতর ভেতর প্রকাশ্যহীন যন্ত্রনা শুরু হয়েছে তার। এই বিয়েটা করলে আর যা হোক সে ভালো থাকবে না। সৎ মা কেও বাবা কষ্টে রেখেছে। সেদিন রুমে ডেকে অর্ধেক সত্যি তাকে বলেছে। সাথে এও বলেছে যদি সে এই বিয়েটা করায় কোনো প্রকার ঝামেলা সৃষ্টি করলে চারজনের জীবন বিপন্ন হবে । ভাবনার রেশ তার চোখে-মুখেই ফুটে ওঠছে। নাহ এবার আর বসা থাকা চলবে না। যা হয় হোক। বাবার কাছে যেতেই হবে। এর একটা বিহিত করা লাগবেই। বাবাকেও ছেলের যন্ত্রণা বুঝতে হবে। এই বলেই আসন থেকে উঠে দাঁড়ায় সে।
-“আব্বে যাচ্ছিস কোথায় ? বোস বোস।”
বলেই ততক্ষণাৎ এলিজা কে ভিডিও কল করে তার বন্ধু তালহা। ক্যামেরা ধরা হলো তার সামনে। সৌজন্যতা মূলক হাঁসি দিয়ে মলিন মুখখানা ক্যামেরায় নিবদ্ধ করলো। মেয়েটা স্লিভলেস ব্লাউজের সাথে হলুদ রঙের শাড়ি পড়েছে। হেভি মেকআপ সাথে আর্টিফিশিয়াল গহনা পড়ে আছে। দেখতে বেশ ভালোই লাগছে।
-“আমায় কেমন দেখাচ্ছে ডিয়ার হাবি?”
-“হুম। মা-শা-আল্লাহ। সুন্দর লাগছে।”
-“আমার যে কি আনন্দ হচ্ছে তুমি জানো ? ফাইনাললি আমি তোমার হতে যাচ্ছি। ইউ নো না ? তোমার নামের টাইটেল আমি ব্যবহার করতে কতটা আগ্রহী ?”
থমকে গেলো আরাফ। মাথা টা ভন ভন করে উঠলো তার। এতক্ষণ ভেবেছিল বাবার কাছে গিয়ে বিয়েটা করবে না বলবে। কিন্তু এখন এলিজার কথা শুনে তার বিবেকে বাধছে । কোন দিকে সে যাবে কোনো কুল-কিনারাই সে খুঁজে পাচ্ছে না। নিজের কষ্ট কমাতে যদি এ বিয়েটা সে না করে তবে এলিজা সুইসাইডও করতে পারে। আবার বিয়েটা না করলে শুধু ফারিহা কষ্টে পাবে আর বাকি সবাই সুখে থাকবে।
দুটো থেকে কোনটা সে বাছাই করবে সেটা নিয়েই দ্বিধাদ্বন্দ্বে ভুগছে। জীবনের চরম একটা বিষাদ সে উপভোগ করতে যাচ্ছে। তার খুব করে কান্না পেল। ছেলেরা নাকি সহজে কাঁদে না। আজ হয়তোবা সেটা ভুল প্রমাণিত হলো। যখনই সে ভাবে ফারিহা অন্য কাউকে বিয়ে করবে , অন্য কারো সাথে সংসার করবে ইত্যাদি ইত্যাদি তখনই ভীষণ কান্না পায় তার । তার ইচ্ছা হয় সব ভুলে নতুন করে কিছু শুরু করার। কিন্তু নতুন করে জীবন দেখলেই মৃত্যু এসে কড়া নাড়বে।
কান্নামাখা মুখ প্রকাশ করতে পারে না। কারণ বাবার বেড়াজালে আটকে যাওয়ার সাথে সাথে কান্নাটাও সেখানে আটকে গিয়েছে। বাহিরে শুধু প্রকাশিত হয় ভালো একখানা মুখ । যে মুখ অন্ধকার জগতে অনেকের ভয়ের কারণ আর বাস্তবে কিছু মানুষের ভালোবাসার কারণ।
-“কি ভাবছো?”
এলিজার ডাক শুনে ভাবনা থেকে বেরিয়ে আসে সে । মেয়েটা জিজ্ঞাসু ভঙ্গিতে তাকিয়ে আছে তার দিকে ।
-“আচ্ছা এলিজা আমরা একটু পরে কথা বলি ? অনুষ্ঠান বোধহয় এই শুরু হবে হবে ।”
-“তোমাকে আজ অন্যরকম লাগছে।”
-“কেমন?”
-“কেমন যেনো ! সবদিক থেকেই অন্যরকম ।”
মলিন হাঁসলো আরাফ। পাশ থেকে তালহা বলে উঠে , ‘আরে ভাবীসাব। বিয়ের হাওয়া গাঁয়ে লেগেছে তো তাই…!’
উপস্থিত সকল বন্ধুরাই হেঁসে উঠলো। অতঃপর তাদের আরোও কিছুক্ষণ কথা চললো।
•
-“ভেতরে কে?”
নিজের রুমে এসে প্রথমে রুমের পরিবেশ চেক করলো । স্বাভাবিক ই রয়েছে। বাথরুমের দিকে নজর দিলো। দরজা লক। তাই এগিয়ে গিয়ে উপরোক্ত প্রশ্ন টি করলো।
ভেতর থেকে আওয়াজ আসলো না কোনো। ফের দরজায় আওয়াজ তুললো শুভ্রা। কিছু বলার আগেই দরজা খুলে বাহিরে বেরিয়ে আসে ফারিহা। তাকে দেখে শুভ্রার চক্ষু চড়কগাছ। মেয়েটা শাওয়ার নিয়েছে। আর পড়েছে তার পোশাক। তার পোশাক পড়াতে অবাক হয়নি শুভ্রা। সে অবাক হয়েছে যে এই সময়ে শাওয়ার কেন ?
-“আমি আসলাম বলেই বেরিয়ে কি বেরিয়ে এলি নাকি…।”
-“আমার গোসল শেষ হয়েছে অনেক আগেই। তোর অপেক্ষা করছিলাম। তুই এলেই দরজা খুলবো। তাই…।”
-“শাওয়ার নিয়েছিস?”
-“সন্দেহ আছে?”
-“কিন্তু কেন? একটু পরেই তো অনুষ্ঠান শুরু হবে। গাউনটা কি করেছিস?”
-“ভিজাইনি তবে ওখানে আমার না থাকলেও চলবে।”
কিছু বলতে নেয় শুভ্রা। তার আগেই ফারিহা ফের বলে,
-“প্লিজ ! ভেতরকার ক্ষত বাড়াতে চাচ্ছি না। অতীত ফেলে আসাই উত্তম। এছাড়াও তার আমার ভালোবাসা আমার বিশ বছরে আসা বসন্তের কুড়ির মতোন। বিশ বছর পেরোতেই তা শেষ।”
ফারিহার কথা গাঁয়ে মাখলো না শুভ্রা। দুহাতে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো। কানে কানে বললো,
-“পাশা পাল্টেও তো যেতে পারে বৎস !”
বাধঁন ছাড়িয়ে উত্তর দিলো,
-“সম্ভব না।”
-“যদি বলি যেই আরাফ কে তুই ভালোবেসেছিলি এইটা সেই আরাফ না। তবে?”
পিলে চমকে উঠলো ফারিহার। কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো সে। এগিয়ে গেলো শুভ্রা। ফারিহার সোজা প্রশ্ন,
-“তাহলে কে ও? আরাফের মতোই কেন…!”
-“অনেক প্যাঁচ লেগেছে মনা। শুধু এইটুকু জেনে রাখুন আপনার ভালোবাসার সো কল্ড আরাফ আপনার ই হবে।”
#চলবে?
#প্রণয়ডোর
|৩৫|
-রামিশা আঞ্জুম বুশরা
-“প্লিজ ! ভেতরকার ক্ষত বাড়াতে চাচ্ছি না। অতীত ফেলে আসাই উত্তম। এছাড়াও তার আমার ভালোবাসা আমার বিশ বছরে আসা বসন্তের কুড়ির মতোন। বিশ বছর পেরোতেই তা শেষ।”
ফারিহার কথা গাঁয়ে মাখলো না শুভ্রা। দুহাতে মেয়েটাকে জড়িয়ে ধরলো। কানে কানে বললো,
-“পাশা পাল্টেও তো যেতে পারে বৎস !”
বাধঁন ছাড়িয়ে উত্তর দিলো,
-“সম্ভব না।”
-“যদি বলি যেই আরাফ কে তুই ভালোবেসেছিলি এইটা সেই আরাফ না। তবে?”
পিলে চমকে উঠলো ফারিহার। কয়েক কদম পিছিয়ে গেলো সে। এগিয়ে গেলো শুভ্রা। ফারিহার সোজা প্রশ্ন,
-“তাহলে কে ও? আরাফের মতোই কেন…!”
-“অনেক প্যাঁচ লেগেছে মনা। শুধু এইটুকু জেনে রাখুন আপনার ভালোবাসার সো কল্ড আরাফ আপনার ই হবে।”
শুভ্রার কথায় ফারিহার চোখে মুখে বিস্ময়তা ভর করলো। ছোট্ট করে জিজ্ঞাসা করলো,
-“ওহ! তা কীভাবে?”
-“সময় হোক।”
-“আমার মনে হয় তুই আমার কাছে আরোও অনেক কিছু লুকিয়ে রেখেছিস।”
ফারিহার এমন প্রশ্নে শুভ্রা খানিকক্ষণ নিজের মতো চুপ করে রইলো। অতঃপর বললো,
-“শোনো আপু। মিথ্যা আমি সহজে বলিনা। তাই বলবো যে , লুকিয়েছি এইটা সত্য কিন্তু মিথ্যে বলিনি। এ অব্দি যা যা শুনেছো সবই সত্য। আর মাঝেমাঝে এমন অনেক প্রশ্ন তুমি আমায় করো যেগুলোতে মিথ্যে বলে থাকা যায়না তাই আমি কৌশলে এড়িয়ে যাই। সুতারাং তুমি যেটুকু জানোই সেটুকুর সবটা সত্যি।”
-“সব সত্যি জানতে পারবো কোনদিন?”
-“তোমার স্বামীর বিয়ে যেদিন।”
চার শব্দের এক বাক্য। ছেত করে উঠলো ফারিহার ভেতর। চুল চিরুনি করতে করতে বললো,
-“আমার স্বামী বলছো আবার….”
-“চিন্তা করো না। সব ঠিকঠাক হলে আল্লাহর রহমতে শীঘ্রই আমাদের কষ্টের অবসান ঘটতে চলেছে।”
-“হু…!”
•
আরাফের হলুদের অনুষ্ঠান শেষ হয়েছে কিছুক্ষণ আগেই। এখন ফটোশুট চলছে। তিন চারটা লোক বিভিন্ন ভাবে শুট করছে। শুভ্রা স্টেজের সামনে থাকা মধ্যিখানের একটা চেয়ারে বসে আছে। পাশে ফারিহা। তখন যাবেনা যাবেনা করলেও মিসেস মির্জার কড়া আদেশে আসতে বাধ্য হয় সে। ফারিহার কাছে মিসেস মির্জাকে দারুণ লেগেছে। মানুষটা সৎ মা জেনেও কত আপন ভাবে দেখছে। ভদ্র মহিলার প্রশংসা না করে শান্তি পাচ্ছে না ফারিহা। অবশেষে মুখ টা খুলেই ফেললো। এতোক্ষণ ধরে ভাবুক হয়ে থাকা মুখখানায় কথার খৈ ফুটলো ।
-“তোর সৎ মা কিন্তু অনেক ভালো। কেমন সবাইকে নিজের মেয়ের মতো ভাবে!”
-“বান্ধবীপু! এটা তো আমার সত্যিকারের মা ও হতে পারে।”
শুভ্রার কথায় ফারিহা ফ্যালফ্যাল করে মেয়েটার মুখের আদলে চেয়ে রইলো । আর কত রহস্যের ধোকা তাকে দেবে এই মেয়েটা ? শেষ কোথায় এর ?!
মিসেস মির্জা আর মিস্টার মির্জা আরাফের দু’পাশে বসে আছে। ক্যামেরাম্যান বলেন,
-“আপনাদের ফ্যামিলি ফটো হবে এটি। আর কেউ বাকী থাকলে ডেকে আনুন।”
ডাক পড়লো ফারিহার । মিসেস মির্জা ডেকেছেন। উপেক্ষা করলো না ডাকটার। লোকের সামনে অপমান করার ইচ্ছে হলো না। তাই ভদ্রতার খাতিরে স্টেজে উঠে আরাফের পেছন বরাবর দাড়ালো। ব্যাস , ক্লিক হলো ক্যামেরায়। আবদ্ধ হলো একটা ফ্রেমে।
•
কল এলো ফারিহার ফোনে। ফোনের স্ক্রিনে অতিপরিচিত নাম টা শো করলো। উঠে দাড়ালো নিজ অবস্থান থেকে। ব্যস্ত পায়ে ছুট লাগালো মেইন গেইটের দিকে। অপেক্ষার অবসান ঘটবে। দীর্ঘ ৩ দিন পর নিজের পুরুষটার দেখা মিলবে। উতলা হয়ে আছে তার মননা । সাথে হার্ট টাও খুব দ্রুত বিট করছে। ভেতর ভেতর নিজেকে এলোমেলো লাগতে শুরু করলো। মনে মনে ভাবলো, ‘আরে আজব তো! এতোক্ষণ তো ঠিক’ই ছিলাম কল টা আসার পরপর ই হঠাৎ কেনো এরকম লাগতে শুরু করলো?’ তার মনের প্রশ্ন মনেই রইলো। পরক্ষণেই নিজেকে শামাল দিয়ে নিলো।
-“ওকে ভালোটালো বাসিস নি তো?”
অতি পরিচিত কন্ঠ শুনে ভ্রু কুঁচকে নিলো শুভ্রা । পাশ ফিরে তাকিয়ে ‘হাহ!’ বলে দীর্ঘশ্বাস ফেললো । ছোট্ট করে শোধালো,
-“বাঁদর একটা। মনের কথা বুঝলি কি করে?”
-“বোকা নাকি তুই?”
-“বোকা না বোকি।”
-“হোয়াট?”
-“ফিমেইল ভার্সন।”
-“সিরিয়াসলি?”
-“কোনো ডাউট আছে?”
-“ফালতু।”
-“হু!”
-“কোথাও যাচ্ছিস?”
-“হ্যাঁ।”
থেমে গেলো শুভ্রা। কোমড়ে হাত রেখে মাথা টা উপরে তুলে তাকালো। সামনে থাকা ব্যক্তিটি যে তার থেকেও লম্বা। তার দাঁড়ানো অনুসরণ করে ব্যক্তিটিও থেমে গেলো। এতে শুভ্রা নিজের চোখ দুটো ছোট ছোট করে মুখে বিরক্তির ভাব ফুটিয়ে ব্যক্তিটিকে রাগী কন্ঠে শোধালো,
-“ফলো করছিস আমাকে?”
-“না তো।”
ব্যক্তিটির ছোট্ট উত্তরে শরীর জ্বলে উঠলো শুভ্রার। দাঁতে দাঁত চেপে জিজ্ঞাসা করলো,
-“তাহলে আমার সাথে কী?”
-“কিছুই না।”
-“কোথায় যাবি না বললি। সেখানেই যা!”
-“হ্যাঁ , যাচ্ছিই তো।”
-“তো যা না ভাই ! মাফ কর আপাতত।”
শুভ্রার এখন কাঁদোকাঁদো অবস্থা। তবুও ব্যক্তিটি নির্বাক। আস্তে ধীরে করে এদিক ওদিক চোখ বোলাচ্ছে। কথার উত্তরের আশায় সে একটু অপেক্ষা করলো ব্যক্তির । তবুও উত্তর আসলো না। এবার খুব সতর্কতার সাথে নিজের পায়ের গোরায় ভর দিয়ে খানিকটা উঁচু হয়ে ব্যক্তিটার কান টেনে ধরলো। সাথে সাথে ব্যক্তিটির উত্তর,
-“আরে ডাইনি। করছিস টা কি? ছাড় , ছাড়।”
-“আগে বল কোথায় যাচ্ছিস?”
-“আগে ছাড়, তারপর বলছি।”
ব্যক্তিটির দিকে তাকিয়ে শাহাদত আঙুল উঁচিয়ে খানিক নাড়িয়ে কানটা ছেড়ে দিলো। এর ভাষা এমন যে, ‘চালাকি করবি মানেই কানে তালা ঝোলাবো।’
কানটা ছাড়তেই পড়নের পাঞ্জাবী টা ঝাঁড়া মেরে সটান হয়ে দাঁড়ালো।
-“যাচ্ছি তো তোর সাথেই। এবার বল তুই কোথায় যাচ্ছিস?”
-“হুম…তোর দুলাভাই আসছে। একটু দেখা করে আসবো।”
-“ওরে রেহ! আমাকেও নিয়ে চল আপু।”
-“না , তুই বিডি তে এসছিস এক রাত হলো। এর মাঝেই আমি অতিষ্ঠ তোর জ্বালায়। তুই বরং আমার বিপদ টা সামলা? আমি ওনার সাথে কথা বলে আসি।”
-“ঠিক আছে।”
-“কি ঠিক আছে? করবি তো সাহায্য?”
শুভ্রার এমন প্রশ্নে মাথা উপর নিচ করে বলে,
-“রণে-বণে , জলে জঙ্গলে যখনি পড়িবেন বিপদে ,
আবির থাকিবে সাথে।”
হেঁসে ফেললো শুভ্রা। সাথে সাথে মেতে উঠলো আবির। শুভ্রার আপন ভাই সে। শত্রুর নাগাল থেকে দূরে রাখার জন্যই ছোট মামার সহায়তায় কৌশলে দেশের বাহিরে বাঁচিয়ে রাখে তাকে। আবিরের কথা কেউ জানেনা। শুভ্রার মা ছিলেন অতিরিক্ত বুদ্ধিমত্তার অধিকারী। বিপদের আভাস পেয়েই তিনি পরিবার থেকে আলাদা রেখেছিলেন আবির কে। আর….
•
কুয়াশার ভিড়ে নির্দিষ্ট মানুষটাকে দেখা গেলো। পড়নে ব্ল্যাক ড্রেস। হুড়ির টুপি, মাস্ক আর বড় গগলস এর জন্য বোঝাই যাচ্ছে না মানুষটা কে । একবার তার মুখখানা দেখার ইচ্ছে জাগলো। কিন্তু উপায় নেই। রিস্ক আছে এতে। তীরে এসে তড়ি ডুবানোর সাহস নেই তার। তাই নিজের মনকে শাসিয়ে নিজেকে থামিয়ে রাখলো কিছুক্ষণ। তারপর গুটিগুটি পায়ে এগিয়ে গিয়ে ব্যক্তিটার সামনে বরাবর দাড়ালো।
-“দেরি করলে যে?”
অতিপরিচিত পুরুষালী কন্ঠস্বরে মৃদ্যু কম্পন ধরলো শরীরে। আগের শক্তপোক্ত আওয়াজ নিমিষেই মিইয়ে গেলো। নিম্নস্বরে ব্যক্তিটি কে শোধালো,
-“হঠাৎ তুমি করে..!?”
-“আগে বলিনি?”
লোকটার সহজ প্রশ্ন। তাও উত্তর দিতে হিমশিম খেলো। থেমে থেমে উত্তর দিলো,
-“ন,না মানে… ”
-“আর কোনো জটিলতা নয়। সত্যিটা আমি জানি।”
এবার গলা কেশে শুভ্রা খানিকটা সিরিয়াস হয়ে উঠলো । লোকটিকে জিজ্ঞাসা করলো,
-“আপনি ঠিক আছেন তো?”
-“হু!”
-“আর রাস্তায় আবির আমাকে জ্বালিয়ে খেয়েছিলো তাই দেরি হয়েছে আপনার কাছে আসতে।”
-“চাপ নেই। পরবর্তী পদক্ষেপ কি?”
-“নেওয়াজ মির্জার সন্দেহের তালিকায় থাকা সেই শুভ্রাকে মেরে দিয়ে খবর ছড়িয়ে দাও চারিদিকে।
-চলবে?