প্রণয়ী পর্ব-০১

0
41

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
(লেখা কপি করা নিষেধ)

০১.

‘আপনি আমাকে ফলো কেনো করছেন? কি সমস্যা আপনার?’

‘ফলো কাকে তোমাকে? বিশ্বাস করো আমি তোমাকে ফলো করি নাই। সমস্যা আমার না বাইকের। বাইকটা হঠাৎ থেমে গেলো তাই দেখছিলাম কি সমস্যা। এই রফিক জলদি দেখ বাইক কেনো স্টার্ট নিচ্ছে না।’

ছেলেটার কথা মতো রফিক দৌড়ে এসে বাইক দেখার ভঙ ধরে। প্রিয়তা ভালো করেই বুঝতে পারে বাইকের কিছু হয়নি কারণ পুরোটা রাস্তা বাইক নিয়ে তাকে ফলো করতে করতে এসেছে আর এখানে এসেই থেমেছে। বাইকে বসা ছেলেটার নাম জাইন । এলাকায় সে জান ভাই নামে পরিচিত। গাঢ় রঙের জিন্স সাথে কালো রঙের পাঞ্জাবি পরেছে সে। চোখে কালো চশমা সাথে পাঞ্জাবির হাতা গুটিয়ে রেখেছে। তবে তার হাতের ব্রেসলেটটা চোখে পড়ার মতো। প্রিয়তা যবে থেকে এই এলাকায় এসেছে তবে থেকেই এই ছেলেকে রোজ বের হলেই দেখতে পায়। ইদানীং ছেলেটাকে তার আশপাশে বেশ কয়েকবার দেখতে পায়। আজকে তার মনে হলো সরাসরি ছেলেটাকে কিছু বলা দরকার। না হলে আরো সাহস পাবে সে।
আশেপাশের মানুষজনের কাছ থেকে শুনেছে ছেলেটা রাজনীতি করে তাই এলাকায় দাপট তার। সেই সাথে মাস্তানী করে বেড়ায়। দূর থেকে একবার এক ছেলেকে মারতেও দেখেছিলো। অবশ্য প্রিয়তা এসব পরোয়া করে না। সে সবসময় অন্যায়ের প্রতিবাদ করে।

প্রিয়তা রাগী গলায় বলে,’আপনাকে যেনো আমার আশেপাশে না দেখি। আমি ভদ্র ঘরের মেয়ে আপনার মতো গুন্ডা মাস্তান না।’

প্রিয়তার কথা শুনে জাইন হেসে উত্তর দেয়,’রাস্তাটা তো সরকারি। এই রাস্তায় চলতে গেলে তোমার অনুমতি লাগবে?’

জাইনের প্রশ্নে বিরক্ত হয়ে কথা না বাড়িয়ে প্রিয়তা বাড়ির দিকে আবারো হাঁটা দেয়। সে জানে এখন কথা বাড়ালেই বাড়বে আর জাইনও তার সাথে কথা বাড়াতে চাইবে। শুধু শুধু এখন কথা বাড়িয়ে লাভ নেই বেশ বুঝতে পারছে সে। তাই চিন্তা করে পরেরবার ফলো করতে দেখলে আচ্ছা মতো কথা শুনিয়ে দিবে।

‘এই যে আমার প্রশ্নের উত্তর তো দিলা না।’
পিছনে থেকে আবার ডাক পড়ায় খানিকটা বিরক্ত হয় প্রিয়তা। হাঁটা অবস্থায় ঘাড় ঘুরিয়ে চোখ ছোট ছোট করে ক্ষ্যাপা বাঘিনীর ন্যায় দৃষ্টি দেয় সে। প্রিয়তার এরূপ দৃষ্টি দেখে অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রয় জাইন। কয়েক সেকেন্ড পর সামনে ঘুরে মাথায় থাকা ওড়নাটা আরেকটু টেনে হাঁটা না থামিয়ে দ্রুত পা চালায় প্রিয়তা। ভর দুপুর বেলা তর্ক করতে মোটেও ভালো লাগছে না তার। তা ছাড়া এক গলি পরই তার বাসা এখন পরিচিত কেউ এভাবে দেখলে উল্টোপাল্টা ভেবে বসবে।

জাইন বাইকে বসে প্রিয়তার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। মেয়েটাকে একদম সাধারণের মাঝে অসাধারণ লাগে তার। যেদিন প্রিয়তা তার পরিবারের সাথে প্রথম এলাকায় আসে সেদিনই তার চোখে পড়েছিলো সে। বাইক দিয়ে এলাকায় টহল দিচ্ছিলো জাইন আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা তখনই দেখতে পায় এক মেয়ে তার মায়ের সাথে রিকশা থেকে নেমে দাঁড়ায়। আকাশী রঙের কামিজ আবার ওড়না টেনে মাথায় দেওয়া ছিলো ফলে মনে হচ্ছিলো এক টুকরো আকাশ রাস্তায় টুপ করে নেমে এসেছে। তবে বেশিক্ষণ মেয়েটাকে দেখতে পায়নি। ট্রাক থেকে আসবাবপত্র নামানো হতেই মেয়েটার ভাই তাদেরকে ভেতরে যেতে বলে। মেয়েটা সঙ্গে সঙ্গে তার মা’কে নিয়ে ভেতরে চলে যায়।
এরপর আরো দুইদিন মেয়েটাকে রাস্তায় দেখেছিলো। সেইসময় ভিন্ন সময়ে ভাই বা তার মায়ের সাথে তাকে দেখা যায়। খোঁজ খবর নিয়ে জানতে পারে মেয়েটার নাম প্রিয়তা, সে এই এলাকায় নতুন এসেছে পরিবারের সাথে। মেয়েটা বর্তমানে ভার্সিটির ষষ্ঠ সেমিস্টারে অধ্যায়নরত। তথ্য যোগাড়ের পর যখনই সময় পায় তখনই প্রিয়তাকে দেখতে ছুটে সে। এতো মাস পর আজকে প্রথম প্রিয়তার সাথে আলাপ হলো তার।

আজকেও জাইন তাকে ফলো করতে করতে আসেনি। তারা কাজ সেরে ফিরছিলো সেই পথ দিয়ে প্রিয়তাও ফিরছিলো। প্রিয়তাকে দেখে বাইকের গতি কমিয়ে দিয়েছিলো তাই প্রিয়তা তাকে ভুল বুঝে কথা শোনালো। এতো মাস ধরে প্রিয়তাকে দূর থেকে দেখছে না তাকে বিরক্ত করেছে না কখনো কথা বলার চেষ্টা করেছে। আজ অযথাই প্রিয়তা তাকে ভুল বুঝলো।
সব কিছু ভেবে জাইন আপন মনে হারিয়ে যায়। রফিক আর সাথে থাকা বাকি দুইজন জাইনের দিকে ড্যাব ড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।

জাইন গম্ভীর হয়ে বলে,’কি সমস্যা তোদের? এভাবে শকুনের মতো নজর দিচ্ছিস কেনো?’

মারুফ উত্তর দেয়,’মেয়েটাকে পছন্দ করিস বললেই পারিস এভাবে ঘুরঘুর করার কি আছে?’

মারুফের কথা শুনে জাইন মাথা চুলকে বলে,’এসব তুই বুঝবি না রে।’

হতাশ গলায় শাকিল বলে,’বুঝস না ওর মজনু হওয়ার শখ হইছে তাই এমন করে। ও এভাবেই মেয়েটারে দূর থেকে দেখবো আর পরে অন্য কেউ এসে ছো মেরে নিয়া যাইবো। এখন বাইক স্টার্ট দে বাসায় যামু খিদা লাগছে।’

শাকিলের কথায় মারুফ বাইক স্টার্ট দেয়। রফিক জাইনের পিছনে আর শাকিল মারুফের পিছনে উঠে বসে। শো শো করে বাইক দু’টি স্থান ত্যাগ করে।

ফ্ল্যাটের সামনে দাঁড়িয়ে চার পাঁচ বার কলিং বেল দেওয়ার পর প্রিয়তার মা এসে দরজা খুলে। রান্নাঘর থেকে দৌড়ে এসে দরজা খুলেছে সে। দরজা খুলেই আবারো রান্নাঘরে দৌড় দেয় সে। বাসায় এখন প্রিয়তা আর তার মা রয়েছে। দরজা লাগিয়ে ফ্রিজ থেকে এক বোতল পানি নিয়ে নিজের রুমের দিকে পা বাড়ায় সে। গা থেকে ওড়না আর ব্যাগটা সরিয়ে বিছানায় আরাম করে বসে। ভার্সিটির ক্লাস শেষে এই ভর দুপুর বেলা বাসায় হেঁটে ফিরতে বেশ কষ্ট হয় তার। বাসা থেকে হাত খরচের জন্য যেই টাকা দেওয়া হয় সেই টাকা দিয়ে তার সারা মাস চলতে বেশ কষ্ট হয় তবুও এভাবেই টেনে টুনে চলছে। ভার্সিটিতে পায়ে হেঁটে যাতায়াত করে সে এতে অবশ্য তার খারাপ লাগে না। তার বাবার ফার্মেসী রয়েছে যাতে ইনকাম সামান্য। বয়স হয়ে যাওয়াতে সরকারি চাকরি থেকে তাকে অব্যহতি দেওয়া হয়েছে। চাকরি থেকে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে এই ফার্মেসিটা দিয়েছে সে। প্রিয়তার বড় ভাই চাকরি করছে সেই সাথে সরকারি চাকরির জন্যও চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। আগের বাসায় ভাড়া বাড়ানো হয়েছিলো তাই সেই বাসাটা ছেড়ে ছোট্ট এই বাসায় উঠেছে তারা। এই বাসায় তিনটে রুম। এক রুমে প্রিয়তার বাবা-মা আরেক রুমে প্রিয়তা এবং স্টোর রুমটায় তার ভাই তুহিন থাকে।

‘এই প্রিয়তা আলুগুলো একটু কেটে দিয়ে যা।’

রান্নাঘর থেকে মায়ের ডাক পড়তেই প্রিয়তা বিছানা থেকে জোড়ে নিজেকে তুলে সেদিকে যায়। একটু পর তার ভাই আর বাবা খেতে আসবে তাই প্রিয়তার মা মিসেস মাসুমা বেশ তোরজোর শুরু করেছেন।

রান্নাঘরে এসে আলু কাটতে শুরু করে প্রিয়তা। অতঃপর কাজ করতে করতে মা মেয়ে গল্প শুরু করে।

রাতের বেলা খাবারের টেবিলে সকলে একত্রে খেতে বসেছে। মিসেস মাসুমা সকলের পাতে তরকারি বেড়ে দিচ্ছেন।

খাওয়ার মধ্যে তুহিন প্রিয়তাকে জিজ্ঞেস করে,’তোর সেমিস্টার রেজাল্ট দিবে কবে?’

প্রিয়তা জবাব দেয়,’এই মাসের শেষে তো দেওয়ার কথা।’

তুহিন বলে ওঠে,’আর তো তিন সেমিস্টার এরপর তোর জন্য ভালো পাত্র দেখে তোকে বিদায় করার প্রস্তুতি নিবো।’

তুহিনের কথায় প্রিয়তা ক্ষেপে যায় তবুও বড় ভাইকে যথাযথ শ্রদ্ধা করে বিধায় চুপ করে রয় সে। বাবা কি বলবে সেটা দেখার জন্য বাবার দিকে তাকায়। ছোট বেলা থেকেই পরিবারে তাকে শেখানো হয়েছে বড়দের সাথে সম্মান দিয়ে কথা বলতে হবে। তুহিন আর প্রিয়তার মধ্যে ছোট বেলা থেকেই মিল নেই। তুহিন বোনের সাথে গম্ভীর হয়ে থাকতেই পছন্দ করে। অন্য ভাইয়ের মতো বোনের সাথে খোলামেলা কথা বলা কিংবা দুষ্টুমি করা সে পছন্দ করে না। প্রিয়তা ছোট বেলায় বেশ চঞ্চল ছিলো। সে তুহিনের সাথে সুসম্পর্ক গড়ার চেষ্টা করেছে সবসময় কিন্তু তুহিন তাকে সবসময় ধমকে নিজেকে বড় জাহির করেছে।

প্রিয়তার বাবা বেল্লাল হোসেন বলেন,’আহা মেয়েটাকে আগে পড়াশোনা শেষ তো করতে দিবি। কি বিয়ে নিয়ে পড়ে আছিস। ও পড়াশোনা শেষ করে নিজের পায়ে দাঁড়াবে এরপর আমরা ওকে বিয়ে দিবো। এতো তাড়াহুড়োর কিছু নেই।’

বেল্লাল হোসেনের কথার মাঝে মিসেস মাসুমা বলে,’মেয়ে হয়েছে বিয়ে করতে হবে না? বয়স হয়ে গেলে তো পরে কেউ নিবে না। পড়াশোনা করে চাকরি করে কি হবে?’

তুহিনও মায়ের কথায় সম্মতি দেয়,’ওর চাকরি বাকরি করতে হবে না। ওর টাকা কি আমরা খাবো নাকি? তাছাড়া ভালো ঘরের ছেলেরা বউকে চাকরি করতে দেয় না।’

মিসেস মাসুমা ছেলের যুক্তির সাথে একমত হন। বেল্লাল হোসেন মেয়ের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারে তার মন খারাপ হয়ে গেছে। খাবার রেখেই প্রিয়তা উঠে নিজের কক্ষের দিকে হাঁটা দেয়। এখানে তার বেশ বিরক্ত লাগছে। বেল্লাল হোসেন পিছনে থেকে ডাক দিলেও তোহফা জবাব দেয় না। মিসেস মাসুমা কিংবা তুহিন তাকে ডাকে না খাবার শেষ করতে।

….

রাত বারোটার দিকে বাসায় ফিরে জাইন। সিঁড়ি বেয়ে নিজের কক্ষের দিকে যেতে নিলেই পিছন থেকে বাবার ডাক পড়ে।

রমিজউদ্দিন শেখ রাগান্বিত গলায় বলে,’কোনো ভদ্র ঘরের ছেলে এতো রাত করে বাড়ি ফিরে? কাজ তো করো না কিছু। সারাদিন টইটই করে ঘুরে বেড়াও। এসব ছেড়ে তোমার ভাইয়ের সাথে ব্যবসায় সাহায্য তো করতে পারো।’

জাইন শান্ত গলায় উত্তর দেয়,’রাজনীতি করলে সময় অসময় বাড়িতে ফিরবো এটা স্বাভাবিক বিষয় আর তা ছাড়া ব্যবসা বানিজ্য আমাকে দিয়ে হবে না ঐইটা আপনার বড় ছেলেকে দিয়েই করান।’

জাইনের কথা শুনে ক্ষেপে যান রমিজউদ্দিন। ক্ষিপ্ত গলায় বলেন,’একটা আস্ত বেয়াদব জন্ম দিয়েছি বাপের মুখে মুখে তর্ক করে। যেটাকে তুমি রাজনীতি বলো সেটা হলো চামচামি। এই চামচামি করে জীবনে কিছুই পাবা না।’

রমিজউদ্দিনের রাগান্বিত গলা পেয়ে কক্ষ হতে মিসেস পারুল আর নিহারিকা বের হয়।

পরিস্থিতি ঠান্ডা করতে মিসেস পারুল বাবা আর ছেলের মাঝে এসে দাঁড়ায়।
‘আহা চিল্লাচিল্লি করে নিজের বিপি বাড়িও না। আমি ওর সাথে কথা বলবো তুমি গিয়ে শুয়ে পড়ো।’

মিসেস পারুলের কথা শুনে রমিজউদ্দিন বলে,’ওকে বলে দাও এটা বাসা হোটেল না যে যখন খুশি সে আসবে।’

কথাগুলো বলে রমিজউদ্দিন নিজের কক্ষে চলে যায়। রমিজউদ্দিন যেতেই মিসেস পারুল জাইনকে বলে,’তোকে না বলছি তোর বাবা ফেরার পূর্বে বাসায় ফিরবি? তাহলে দেরি করিস কেনো? জানিস না তোর বাপ কেমন?’

জাইন হাই তুলে জবাব দেয়,’আরে কাউন্সিলরের অফিসে গিয়েছিলাম তাই দেরি। প্রচুর ঘুম পেয়েছে থাকো গেলাম।’

নিহারিকা কথার মধ্যে বলে,’বিয়ে করিয়ে দাও দেখবা সন্ধ্যা হতেই বাসায় হাজির হবে সে।’

নিহারিকার কথা শুনে জাইন বলে,’তোকে বিদায় না করে এ বাসায় আমার বউ আনবো না। তুই থাকলে আমার বউটারে জ্বালাবি।’

‘জান ভাই ঠিক বলছে। আমি ভাইয়ের সাথে একমত। আমিও বউ আনবো না এই শাঁকচুন্নিকে বিদায় করে।’
নুহাশের গলা পেয়ে সবাই সিঁড়ির দিকে তাকায়। শব্দ পেয়ে সেও এসেছে কি হচ্ছে দেখতে।

নুহাশের কথা শুনে নিহারিকা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠে। এগিয়ে এসে নুহাশের কান টেনে ধরে।সমবয়সী হওয়াতে দুই ভাই-বোনের মধ্যে ছোটখাটো যুদ্ধ লেগেই থাকে।

ছেলে-মেয়েকে চুপ করাতে মিসেস পারুল ধমক দেন। ‘তোরা দু’জন নিজেদের রুমে যা এক্ষুণি আর তুই গিয়ে ফ্রেশ হ আমি খাবার আনছি।’

নুহাশ আর নিহারিকা একে অপরের দিকে ভেংচি দিয়ে নিজেদের কক্ষে চলে যায়।

জাইন মিসেস পারুলকে বলে,’মা খেয়ে এসেছি আমি। প্রচুর ক্লান্ত ঘুমাবো এখন।’

মিসেস পারুল ছেলের সাথে কথায় পেরে উঠতে পারে না। জাইন নিজের কক্ষে চলে যায়। সারাদিন দৌড়াদৌড়ি শেষে নিজের কক্ষে এসেছে অবশেষে। তোয়ালে নিয়ে বাথরুমে চলে যায় গোসল করতে। গোসল সেরে বেরিয়ে দেখে ভাতের প্লেট নিয়ে বসে আছে মিসেস পারুল। জাইন জানে তার মা এখন না খাইয়ে ছাড়বে না। তোয়ালে দিয়ে চুল মুছতে মুছতে বিছানায় এসে বসলে মিসেস পারুল তাকে ভাত খাইয়ে দেয়। রাতের বেলা দেরি করে বাসায় ফিরলে এভাবেই তাকে খাইয়ে দেয় তার মা। প্রতিবার সে বারণ করে কিন্তু মিসেস পারুল তা শুনে না।
খাওয়া শেষ হতেই মিসেস পারুল চলে যায় আর জাইন বিছানায় গা এলিয়ে দেয়।

__________________

সকাল সকাল প্রথম ক্লাস সেরে ভার্সিটির ক্যান্টিনে এসে রিমি আর হৈমন্তীর সাথে আড্ডায় বসেছে প্রিয়তা। ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার পর রিমি আর হৈমন্তীর সাথে প্রিয়তার পরিচয় হয়।
দুপুর বেলা আরো দু’টো ক্লাস শেষ করে ভার্সিটি থেকে বের হয় তিনজন। কিছুক্ষণ গল্পগুজব করে বাসায় ফিরবে সকলে।

‘প্রিয়তা ইয়াসমিন।’
পিছন থেকে ডাক পড়ায় তিনজনই থমকে দাঁড়ায়। প্রিয়তা বিরক্ত হয় কারণ সে জানে কে ডেকেছে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও তিনজন সেদিকে যায়। অবশ্য না গিয়েও উপায় নেই। পরের দিন এলে ঝামেলা করবে।

রিমি সালাম দেয়,’আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। আমাদের ডেকেছেন?’

গাছ তলায় বসা রকি বিরক্ত হয় রিমি প্রথমে কথা বলাতে। সে রিমিকে ধমকে বলে,’তোমার নাম কি প্রিয়তা? নাকি তোমার বান্ধবী বোবা? প্রতিবার তাকে মনে করিয়ে দিতে হয় কেনো আমাকে সালাম দেওয়ার কথা?’

হৈমন্তী বলে,’সরি ভাইয়া।’

রকি এবার হৈমন্তীকে ধমক দেয়,’এই মেয়ে তোমাকে কথা বলতে বলছি? তোমার বান্ধবীকে বলো আমার কথার জবাব দিতে।’

প্রিয়তা নিরবতা ভেঙে বলে,’জি আসসালামু আলাইকুম ভাইয়া। কেনো ডেকেছেন বলেন।’

রকি এবার খুশি হয়। ভার্সিটির সিনিয়র সে তাই তাকে অমান্য করার সাধ্য নেই প্রিয়তার। ফ্রেশার হয়ে যখন থেকে এসেছে তখন থেকেই রকি তাকে বিরক্ত করে চলেছে। ডিপার্টমেন্ট কয়েকবার অভিযোগ করার পর কোনো কাজ হয়নি উল্টো রকি তাকে আরো বেশি বিরক্ত করছে। তাই প্রিয়তা ভেবেছিলো নিজেই এর সমাধান করবে কিন্তু হৈমন্তী আর রিমি তাকে বারণ করেছে। তাদের ভাষ্যমতে রকির বাবা প্রিন্সিপালের বন্ধুর ছেলে তাই কিছু বললে প্রিয়তারই ক্ষতি। তাই চুপচাপ সবটা সয়ে নিচ্ছে প্রিয়তা।

রকি প্রিয়তাকে ভালো করে দেখে বলে,’তোমাকে তো আজকাল দেখাই যায় না কোথায় থাকো তুমি?’

প্রিয়তা জবাব দেয়,’জি ভাইয়া ক্লাসে থাকি। গুরুত্বপূর্ণ কিছু বললে বলুন না হলে আমরা আসি তাড়া আছ।’

রকি বলে,’এতো তাড়া কীসের তোমার? বাইকে উঠো বাসায় ছেড়ে আসি।’

প্রিয়তা বিরক্তি নিয়ে বলে,’লাগবে না,আসছি।’

প্রিয়তা হাঁটা দিতেই পিছন থেকে রকি কয়েকবার ডাক দেয় কিন্তু সে আর ফিরে তাকায় না। রিমি আর হৈমন্তীও প্রিয়তার সাথে চলে যায়। দূর থেকে এসব রফিক দেখে।

সন্ধ্যা বেলা রকি তার বন্ধুদের সাথে চায়ের দোকানে বসে আড্ডা দিচ্ছিলো। মাঝে মাঝে রাস্তা দিয়ে মেয়ে গেলে তাদের দেখে আজেবাজে মন্তব্য করছিলো। হঠাৎ সেখানে রফিক আর মারুফ উদয় হয়।
রফিক রকির কাঁধে হাত দিয়ে জিজ্ঞেস করে,’কিরে রকি ভালো আছিস?’

রকি হেসে জবাব দেয়,’জি ভাই ভালো।’

রফিক আবারো বলে,’চল তোর সাথে জান ভাই কথা বলবে।’

জাইনের নাম শুনে রকি আনন্দিত হয়। এলাকার বড় ভাই জাইন তাকে সবাই এক নামে চিনে। তাছাড়া রাজনীতির সাথে যুক্ত সে। একবার জাইনের দলে ঢুকতে পারলে রকি জানে তাকে আর কেউ কোনো কাজে বাঁধা দিতে পারবে না।
‘আমার অনেক ইচ্ছা জান ভাইয়ের সাথে চলার। ভাই আপনারা আমাকে দলে নিয়ে নেন।’

রকির কথা শুনে রফিক মারুফের দিকে তাকিয়ে হাসি দিয়ে বলে,’আয় তোর ইচ্ছা পূরণ করি।’

রকিকে নিয়ে মাঠের পাশে ক্যারাম খেলার জায়গায় আসে রফিক আর মারুফ। জাইন ক্যারাম খেলায় ব্যস্ত।

রফিক রকির কাঁধ থেকে হাত নামিয়ে জাইনের সামনে তাকে টেনে নিয়ে যায়।
‘ভাই নিয়ে আসছি।’

রকি জাইনকে দেখে সালাম দিয়ে কুশল বিনিময়ের চেষ্টা করে।
জাইন পাঞ্জাবির হাতা ঠিক করতে করতে রকিকে প্রশ্ন করে,’কোন সেমিস্টারে পড়িস?’

রকি উত্তর দেয়,’ফাইনাল সেমিস্টারে এইবার।’

‘ভার্সিটিতে পড়াশোনা করতে গেছিস অথচ তোরে তো অন্য সব কিছু করতে দেখা যায়।’
জাইনের বলা কথার মানে বুঝতে পারে না রকি।

‘ভাই বুঝতে পারলাম না কি বলতেছেন।’

রকির কথা শুনে রফিক তার মাথায় চাপড় দিয়ে বলে,’প্রিয়তা নামের মেয়েটাকে চিনিস?তুই নাকি ওরে উত্যক্ত করিস?’

প্রিয়তার নাম শুনে রকি হেসে উত্তর দেয়,’চিনি তো। প্রিয়তা মেয়েটার অহংকার অনেক তাই একটু টাইট দেই। এসব মেয়ে উত্যক্ত হওয়ার যোগ্য।’

রকির কথা শুনে জাইন তার চোয়াল শক্ত করে চেপে ধরে। আচমকা আক্রমণে রকি চমকে যায়।

‘আজকের পর প্রিয়তার আশেপাশে তোকে দেখলে এই মাঠের নিচে পুঁতে দিবো,কেউ খুঁজে পাবে না। কি বললাম মনে থাকবে?’,জাইন শান্ত গলায় হুমকি দেয়।

রকি ভয়ার্ত কন্ঠে বলে,’জিইই ভাইয়া মনে থাকবে।’

শাকিল বলে,’প্রিয়তা জাইনের আর তুই সেই মেয়েকে উত্যক্ত করিস।’

রকি ভয়ার্ত কন্ঠে ক্ষমা চায়।’ভাইয়া আর হবে না এমন। আমি আর ঐ মেয়ের আশেপাশে ঘেঁষবো না।’

জাইন চোয়াল ছেড়ে কলার ধরে বলে বলে,’প্রিয়তা তোর কি লাগে?’

রকি জবাব দেয়,’ভাবী লাগে।’

জাইনের শান্ত হুমকিতে রকি বেশ ভয় পায়। রকিকে ছেড়ে দূরে সরে দাঁড়ায় জাইন। এবার চুল ঠিক করতে ব্যস্ত হয় সে,যেনো একটু আগে কিছুই হয়নি!

মারুফ বলে,’আজকের পর থেকে প্রিয়তাকে ভাবী ডাকবি।’

জাইন মারুফের দিকে তাকাতেই সে আবারো বলে,’সম্পর্কে আমাদের সকলের ভাবী লাগে কিন্তু আপাততঃ ওরে আপু ডাকবি না হলে মেয়েটা রাগ করবে। আর ও তোর ছোট বোন লাগে। ছোট বোনের দিকে তাকাবিও না আর কেউ তাকালে সাথে সাথে আমাদেরকে জানাবি।’

রকি সাথে সাথে মাথা উপর নিচ করে অর্থাৎ সে জানাবে।

রফিক বলে,’কিরে আরো ধোলাই খাওয়ার ইচ্ছা আছে? যাস না কেনো এখনো এখান থেকে? বেশিক্ষণ থাকলে জান ভাই মেরে তার হাড্ডি কুত্তাকে খাওয়াবে।’

রফিকের কথা শুনে রকি সেখান থেকে পালায়।
রকি যেতেই জাইন বাদে বাকিরা হেঁসে ওঠে।

মারুফ গুনগুন করে গাইতে শুরু করে,’দিওয়ানা হুয়া মাস্তানা হুয়া..’

জাইন বিরক্ত হয় মারুফের গান শুনে। বাইকে উঠে একাই সেখান থেকে চলে যায়। মারুফ,শাকিল আর জাইন একই বয়সী তবে রফিক তাদের থেকে ছোট।

বিল্ডিং এর নিচে এসে সময় দেখে নেয় জাইন। বাইক থামিয়ে জিন্সের পকেটে দু-হাত গুঁজে আড়াল হয়ে দাঁড়ায় সে। মিনিট দশেক পর প্রিয়তা পাঁচতলা একটা বিল্ডিং থেকে বের হয়। ওড়না টেনে মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকে সে। দুই বিল্ডিং পরই তার বাসা। সন্ধ্যার আগে এই বাসায় আসে একটা বাচ্চাকে পড়াতে। ফোন বের করে দূর থেকেই প্রিয়তার আবছা ছবি তুলে নেয় জাইন। প্রিয়তা বাসায় ঢুকতেই সে আবারো বাইক স্টার্ট দিয়ে চলে যায় অন্য গন্তব্যে।

_________________
(চলবে..)