প্রণয়ী পর্ব-০২

0
36

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|০২.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)

…………

‘প্রিয়তা আপু ভালো আছো?’
সকাল সকাল রকির মুখে আপু শুনে প্রিয়তা আর সাথে থাকা হৈমন্তী, রিমিও বেশ চমকায়। এর আগে কখনোই রকির মুখে আপু ডাক শোনা হয়নি তাদের কারো। উপরন্তু বেশ নমনীয় স্বরে ডাকছে সে। গুটি গুটি পায়ে রকির দিকে এগিয়ে যায় তিনজনে। আজ অবশ্য রকি একা। তার বন্ধুদের দেখা নেই।

রকি আবারো শুধায়,’প্রিয়তা আপু আমার উপর নিশ্চয়ই তুমি বিরক্ত। দেখো বড়ভাই হিসেবে তোমার একটু খোঁজ খবর নিতাম। আমার আচরণে কখনো খারাপ লাগলে মাফ করে দিও। আর কখনো অযথা তোমায় ডেকে হয়রানি করবো না। আজ থেকে আমি তোমার বড় ভাই আর তুমি আমার ছোট বোন।’

রকির কথা শুনে রিমি আর হৈমন্তী একে অপরের দিকে চোখ বড় বড় করে তাকায়। তারা যেনো নিজের কানতে বিশ্বাস করতে পারছে না। এ যেনো আশ্চর্যজনক এক ঘটনা!

খানিকটা বিস্মিত স্বরে প্রিয়তা বলে,’জি?’

‘ভার্সিটিতে তোমার কোনো সমস্যা হলে বা কেউ বিরক্ত করলে আমাকে এসে জানাবা। ঠিক আছে?’

রকির কথার প্রতিত্তোরে প্রিয়তা শুধু ‘জি’ বলে।

‘ঠিক আছে এখন ক্লাসে যাও।’
রকির কথা মতো তিনজনেই ক্লাসের দিকে হাঁটা দেয়। প্রিয়তা যেতেই রকি গেইটের দিকে তাকায় যেখানে রফিক বাইক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। এভাবে ক্ষমা না চাইলে রকির রক্ষে হতো না। বাইক স্টার্ট দিয়ে রফিক চলে যেতেই রকি হাঁপ ছেড়ে বাঁচে।

দুপুরবেলা ভার্সিটিতে ক্লাস শেষ করে প্রিয়তা,হৈমন্তী,রিমি হেঁটে চলেছে। সকালের বিষয়টা নিয়ে এখনো ভেবে চলেছে প্রিয়তা। তার এখনো মাথায় ঢুকছে না কীভাবে কি হলে। হৈমন্তী বিষয়টা আচঁ করতে পারে।

হৈমন্তী প্রিয়তার কাঁধে হাত রেখে প্রশ্ন করে, ‘কিরে প্রিয়ু কি ভাবছিস?’

প্রিয়তা উত্তর দেয়,’কিছু না।’

হৈমন্তী বলে,’সকালের বিয়য়টা নিয়ে ভাবছিস?’

প্রিয়তা এবার মুখ খুলে,’হ্যা একটু অবাক লাগছে। হঠাৎ রকি ভাই এভাবে ক্ষমা চাইলো আবার আমাকে বোন ডাকলো। বিষয়টা হজম করতে পারছি না। তোদের আশ্চর্য লাগছে না? একটা মানুষ এক রাতে কীভাবে বদলে গেলো?’

রিমি বলে,’ছাড় তো ঐ রকি আলাপ। মেলা বসেছে চল যাই।’

রিমি যেনো প্রিয়তার কথাকে পাত্তাই দিলো না।
প্রিয়তা হাত ঘড়ির দিকে তাকিয়ে বলে,’বাসায় ফিরতে নইলে দেরি হয়ে যাবে। আর দেরি হলে তো মা রাগ করবে।’

‘চল তো।’ রিমি প্রিয়তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে হাত ধরে হাঁটা দেয়। হৈমন্তীও পিছন পিছন আসতে থাকে।

মেলায় ঢুকে বেশ অবাক হয় প্রিয়তা। ভেবেছিলো ছোটখাটো মেলা চলছে কিন্তু এসে দেখছে এলাহি কারবার। রিমি প্রিয়তাকে টেনে চুড়ির দোকানে নিয়ে গেলো। একের পর এক চুড়ি দেখে চলেছে রিমি। প্রিয়তা চুড়ি গুলোর দিকে চোখ বুলাচ্ছে কিন্তু তার তাতে মন নেই। হৈমন্তী রিমিকে সাহায্য করছে চুড়ি পছন্দ করতে।

ফোন কানে দিয়ে ভীড়ের মধ্যে হাঁটছে জাইন। মেলায় এসেছে একজনকে খুঁজতে। খুঁজে পেলে তার সাথে বোঝাপড়া করবে। ফোনের অপর পাশ থেকে তাকে বারবার সতর্ক করে দিচ্ছে যেনো ঝামেলা না করে ঠান্ডা মাথায় বিষয়টা মিটমাট করে। জাইন শুধু ফোন কানে দিয়ে ‘হু..হ্যা’ করে যাচ্ছে। তার পিছন পিছন রফিক,মারুফ,শাকিল আসছে। কান থেকে ফোনটা নামিয়ে তিনজনকে ইশারা করে তিন দিকে গিয়ে খুঁজতে। তিনজন যেতেই সে অন্য দিকে হাঁটা দেয়। এতো বড় মেলার মাঝে এক জনকে খুঁজে পাওয়া বেশ মুশকিলই। উপরন্তু জাইনের মেজাজ খারাপ হয়ে আছে। যাকে খুঁজতে এসেছে না পেলে আরল মাথা গরম হয়ে যাবে।
‘এতো দাম চাইলে কিনবো কীভাবে? আপনি ৩০টাকা করে রাখুন নইলে নিবো না।’

পরিচিত গলা পেয়ে জাইন চুড়ির দোকানের দিকে তাকায়। পিছন থেকে দেখে মনে হচ্ছে মেয়েটা প্রিয়তা। নিশ্চিত হওয়ার জন্য খানিকটা এগিয়ে যায়। প্রিয়তা চুড়ি গুলো রেখে অন্য দোকানে যেতে উদ্যত হয়। দোকানদার তাকে বুঝানোর চেষ্টা করছে এই দামে দিতে পারবে না কিন্তু প্রিয়তা বুঝতে নারাজ। তারা হাঁটা দেয় পাশের দোকানে। ভীড়ের মধ্যে জাইন এগিয়ে যায় দোকানের দিকে। দোকানিকে বুঝিয়ে বলে বাকি দাম পরিশোধ করে দেয়। এদিকে প্রিয়তা আর তার বান্ধবীরা অন্য দোকানে দুল দেখতে ব্যস্ত। প্রিয়তার নজর তার দিকে পড়ার পূর্বেই সে সেখান থেকে সরে যায়। মানুষের ভীড় থাকায় প্রিয়তা তাকে খেয়াল করেনি। এরি মধ্যে পূর্বের দোকান থেকে এক ছেলে এসে বলে,
‘আপা ৩০টাকা করেই দেন।’

ছেলেটার কথা শুনে হৈমন্তী আর রিমির চোখ কপালে উঠে।

রিমি চমকে প্রশ্ন করে,’এই না আপনি বললেন এই চুড়ি ১২০টাকা ডজন? ৩০টাকা করে কীভাবে দিতে রাজি হলেন?’

হৈমন্তী রিমিকে গুঁতা দেয় এমন বেফাঁস কথা বলার জন্য।

প্রিয়তা বলে,’লাগবে না। যখন নিতে চাচ্ছিলাম আপনাদের দোকানের মালিক দেয়নি। এখন অন্য দোকান থেকে নিবো।’

রিমি প্রিয়তাকে থামিয়ে বলে,’না না নিবো। চুড়ি গুলো প্যাকেট করুন।’

ছেলেটা মাথা নাড়িয়ে চলে যায়।
‘প্রিয়ু কি করছিস। যেই দামে চাইলাম দিচ্ছে নিয়ে নে। এতো রাগ করা ভালো না জানিস তো।’

রিমির কথায় প্রিয়তা শান্ত হয় না।
‘সকাল থেকেই সব কিছু গোলমাল লাগছে আমার। চল দ্রুত বাসায় যাবো এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।’

দোকানে এসে দেখে দোকানদার প্যাকেট করে রেখেছে। দাম পরিশোধ করে প্যাকেটগুলো ব্যাগে নিয়ে নেয় তিনজনে। কেনাকাটা শেষে তিন বান্ধবী আইসক্রিম খেতে যায় এমন সময় সামনেই একটা মানুষের জটলা দেখতে পায়। আইসক্রিমের থেকে জটলার দিকে বেশি আকর্ষণ রিমির। আইসক্রিম রেখে সে জটলার দিকে যায় কি হচ্ছে দেখতে। প্রিয়তা আর হৈমন্তী তাকে পিছন থেকে ডাকতে থাকে কিন্তু কে শুনে কার কথা। ডাক শুনে পিছনে তাকিয়ে হাঁটতে গিয়ে ধাক্কা খায় রিমি।
ধাক্কা খেয়ে রিমি বিলাপ করে,’কানার ঘরের কান্না।’

‘মানুষ সামনে তাকিয়ে হাঁটে আর আপনি পিছনে তাকিয়ে হাঁটছেন! হাঁটতে না জানলে বাহিরে বের হন কেনো?’

ধাক্কা খেয়ে ছেলেটার মুখ থেকে ক্ষমা আশা করেছিলো রিমি কিন্তু উল্টো ছেলেটা তাকে কথা শুনালো।

‘আপনি চোখে দেখেন না? আমি জলজ্যান্ত মানুষ হেঁটে আসছি এটা দেখেও কেনো থামলেন না?’

‘আপনি একটা মেন্টাল কেস।’

‘কি বললেন? আপনার সাহস তো কম না!’

রিমি আর কিছু বলবে এর পূর্বেই পিছন থেকে ছেলেটার ডাক পড়ে। ‘এই মারুফ জলদি আয়।’

ছেলেটা রিমির সাথে কথা না বাড়িয়ে জটলায় ঢুকে যায়। রিমি গা ঝেরে জটলায় উঁকি দেয়। ছেলেটাকে আরো কিছু কথা শুনাতে পারলে তার ভালো লাগতো। পিছন থেকে হৈমন্তী এসে তার হাত ধরে টেনে নিয়ে যায়।

হৈমন্তী রিমিকে বকাঝকা করে। এদিকে প্রিয়তা তাড়া দেয় বাসায় যাওয়ার জন্য।
এরিমধ্যে রিমি বলে,’জান ভাইকে দেখলাম এক ছেলের কলার ধরে ধমকাচ্ছে।’

রিমির কথা শুনে প্রিয়তার চোখ ছোট হয়ে আসে।
বিরবির করে বলে,’গুন্ডা।’

হৈমন্তী জিজ্ঞেস করে,’কিছু বললি?’

প্রিয়তা জবাব দেয়,’না চল।’

মেলা থেকে বেরিয়ে বাসার দিকে রওনা দেয় তিনজনে।

জাইন ছেলেটাকে ধমকাতেই দুই হাত জোড় করে সে জাইনের কাছ মাফ চায়। আশেপাশে অনেক মানুষ জড়ো হওয়াতে মারুফ জাইনকে বলে ছেলেটাকে ছাড়তে। পাবলিক প্লেসে ঝামেলা এড়াতে বলা হয় তাকে। জাইনও ছেলেটাকে শেষবার শাসিয়ে চলে যেতে বলে। ছাড়া পেয়ে ছেলেটা সেখান থেকে পালায়। কালো সানগ্লাসটা চোখে পরে জাইন হাঁটা দেয়। সে যেই দলের হয়ে কাজ করে তার বিপরীত দলের লোক আজ সকালে তাদের দলের একজনকে মেরে আহত করেছে। যারা মেরেছে তাদের মধ্যে একজনকে ধরে মাত্র শাসিয়েছে জাইন। দল থেকে বলা হয়েছে মুখে শাসিয়ে ছেড়ে দিতে নইলে ছেলেটার রক্ষে ছিলো না।

কলেজ জীবনে রাজনীতির সাথে জড়িত হয় জাইন। প্রথমে ছাত্র রাজনীতি করে এরপর নিজের কাজের মাধ্যমে পড়ে যায় বাংলা দলের বড় বড় নেতাদের চোখে। তারা জাইনকে অনুরোধ করে নিজেদের দলে টেনে আনে। যদিও জাইন বাংলা দলের হয়ে কাজ করে কিন্তু এখনো সে অন্যায় কিছু করেনি। সর্বদা চেষ্টা করে মানুষের সহোযোগিতা করার জন্য। ছাত্ররা বিপদে পড়লে সর্ব প্রথম জাইনকে স্বরণ করে। মানুষের সাহায্য সহযোগিতা করার জন্যই সব ছেড়ে রাজনীতিতে কাজ করছে সে। অসৎ নেতাদের ভীড়ে সে নিজেকে সৎ নেতা বানানোর প্রচেষ্টায় নিয়োজিত।

….

বিকাল বেলা প্রিয়তা নিজের কক্ষের দরজা বন্ধ করে মেলা থেকে কিনে আনা চুড়ি গুলো দেখতে বসে। প্যাকেট খুলতেই বেরিয়ে আসে তার পছন্দ করা চুড়ি গুলো আর সাথে আরো কিছু। ভ্রু কুঁচকে সেগুলো দেখতে থাকে সে। একটা পায়েল আর দুই জোড়া দুল অতিরিক্ত দেওয়া হয়েছে যা প্রিয়তা কিনেনি। দোকানি ভুল করে তাকে এসব দিয়ে দিয়েছে বেশ বুঝতে পারে সে। ফোন বের করে রিমিকে কল দেয়। বিকাল বেলা আরামসে ভাত ঘুম দিয়েছিলো রিমি। প্রিয়তার কলে তার আরামের ঘুম ভাঙে।
কল ধরে বিরক্তি নিয়ে বলে,’একটু ঘুমিয়েছি আর দিলি কল।’

প্রিয়তা রিমির বিরক্তিকে পাত্তা দেয় না।
‘দোকানদার ভুলে আমার প্যাকেটে দুল আর পায়েল দিয়ে দিয়েছে। এগুলোর টাকা তো পরিশোধ করা হয়নি।’

‘কালকে গিয়ে ফেরত দিয়ে দিস তাহলেই হলো। এখন ঘুমাতে দে।’
প্রিয়তাকে কথা বলার সুযোগ না দিয়ে কল কেটে আবারো ঘুমাতে যায় রিমি। জিনিসগুলো নেড়েচেড়ে ব্যাগে রেখে দেয় সে। জানালা খুলে বই নিয়ে পরতে বসে।

…..

‘আজকে যারে পাবি তারে পিটাবি। জাইনের বাপও যদি সামনে আহে ঠ্যাং ভাঙবি।’

‘হ জাইনে গোনার টাইম নাই আমগো। চল জলদি কাজটা সারি।’

‘ওর সাহস কত আমারে মেলার মধ্যে এতো গুলা মাাইনষের সামনে শাসায়। ওরে খালি একলা পাই তারপর এর শোধ নিমু। সবাই রেডি হ।’
কথাগুলো বলেই দুইজন ছেলে পা চালায় তাদের পিছন পিছন একদল ছেলে আসতে থাকে। প্রত্যেকের হাতে হকিস্টিক এবং লাঠি। মেলার মধ্যে যেই ছেলেটিকে জাইন শাসিয়েছে তার নাম আলামিন। ছেলেটা জনতা দলের হয়ে কাজ করে। বাংলা দলের চির প্রতিদ্বন্দ্বী জনতা দল। নামে জনতা হলেও জনগনের রক্ত চুষে খায় এই দলের কর্মীরা। জাইন বাংলা দলে যুক্ত হওয়ার পর এলাকায় চাঁদাবাজি কমেছে। জনতা দলের কাউকে চাঁদাবাজি করতে দেখলে সে শাসায়। আজকেও সকালে আলামিন তার লোকদের নিয়ে বাজারে চাঁদাবাজি করছিলো সেই সময় বাংলা দলের একজন এসে তাদের আটকালে আলামিন ক্ষেপে তাকে মারধর করে। খবর পেয়ে আলামিনকে খুঁজে শাসিয়েছে জাইন। এরপর থেকেই চটে আছে আলামিন। চিন্তা করেছে এর বিহিত করে ছাড়বে।

বাংলা দলের স্থানীয় ক্লাবের সামনে এসে আলামিনরা অবস্থান নেয়। অনেকক্ষণ অপেক্ষা করে জাইনের কিন্তু তার দেখা পায় না। আজকে জাইনকে পেলে অপমানের শোধ নিবে। জাইনের দেখা না পেয়ে তারা সিদ্ধান্ত নেয় ক্লাব ভাংচুর করার। পরিকল্পনা মতো ক্লাবে ঢুকে জিনিসপত্র ভাঙচুর শুরু করে। বাদ যায় না দরজা জানালাও। ভেতরে কয়েকজন ছেলে ছিলো তারা কোনো মতে পালিয়েছে। যারা পালাতে পারেনি আহত হয়েছে। মূহুর্তেই বাংলা দলের ক্লাসটা ধ্বংসস্তূপ হয়ে যায়।

খবর পেয়ে জাইন ছুটে আসে। সেই সাথে রফিক,শাকিল আর মারুফও আসে। তারা গিয়েছিলো দলের মিটিং এ। ক্লাব ভাংচুর হতে দেখে বাহিরের একজন কল দিয়ে জানায়। কল পেয়ে মিটিং ফেলে চারজন চলে এসেছে। এসে দেখে এদিকের অবস্থা বেশ খারাপ। ততক্ষণে হামলাকারীরা পালিয়েছে। আহতদের হাসপাতালে নেওয়ার ব্যবস্থা করা হয়। চূর্ণবিচূর্ণ ক্লাবটাকে দেখে জাইনের রক্ত টগবগিয়ে উঠে। সে জানে এই কাজ কাদের। আহতরাও জানিয়েছে আলামিন পোলাপান নিয়ে এসে এসব করেছে। জাইন চোয়াল শক্ত করে হাঁটা দেয় আলামিনকে ধরতে। দূর থেকে জাইনকে দেখে শাকিল বুঝে নেয় আজকে আলামিনের খবর আছে।

………
(চলবে..)