প্রণয়ী পর্ব-১৩+১৪

0
135

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|১৩.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
………..

প্রিয়তার জ্বর কমার বদলে উল্টো বেড়ে যায়। অনু প্রিয়তার গায়ে কাঁথা দিয়ে তাকে শুইয়ে দিয়েছে। জাইন এখনো ফেরেনি। প্রিয়তা জ্বরের ঘোরে একবার উঠে বসে বাসায় যাওয়ার জন্য কিন্তু অনু তাকে বুঝিয়ে আবার শুইয়ে দিয়েছে।
জাইন ফেরে প্রায় দুই ঘন্টা পর। তবে সে একা আসে না সাথে একজন ডাক্তার নিয়ে আসে। প্রিয়তা বিছানায় শুয়ে জ্বরে কাতরাচ্ছিলো পাশে বসে অনু তার কপালে জলপট্টি দিচ্ছিলো।
ডাক্তার আসতেই অনু সরে যায়। ডাক্তার প্রিয়তাকে চেকআপ করে কিছু ঔষধ লিখে দিয়ে যায়। জাইনের সাথে রফিকও এসেছে। কিছু ফলমূল এবং খাবার এনেছে।
অনু এতকিছু দেখে বলে,’ভাইয়া এমনিতেই আপনি আমাদের জন্য যা করেছে তা অনেক এসব আনতে গেলেন কেনো?’

জাইন জবাব দেয়,’আমি চাই তুমি সব কাজ ফেলে প্রিয়র দিকে একটু খেয়াল দাও। যাতে প্রিয় দ্রুত সুস্থ হয়ে যায়।’

জাইনের কথা শুনে অনু অবাক হয়। তার কাছে একটু একটু মনে হয়েছিলো জাইন প্রিয়তাকে পছন্দ করে কিন্তু এখন এসব দেখে মনে হচ্ছে শুধু পছন্দ না ভালোবাসে।

প্রিয়তার ঘুম ভাঙে বিকাল বেলা। চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে কক্ষে কেউ নেই। আস্তে আস্তে মনে পড়ে সে অনুর সাথে দেখা করতে এসেছিলো। শোয়া থেকে উঠে বসে। জ্বরটা নেই এখন তবে শরীর দূর্বল লাগছে তার।

‘কেমন লাগছে এখন?’
জাইনের গলা পেয়ে চোখ তুলে তাকায় সে।

‘অনু কোথায়?’

‘ওরা বাহিরে বসে আছে। আমি ডেকে দিচ্ছি।’
জাইন এসেছিলো দেখতে প্রিয়তার ঘুম ভেঙেছে কিনা। প্রিয়তা ঘুমাচ্ছিলো তাই সকলে বাহিরে বসেছিলো।
একটু পর অনু আসে। অনু এসে প্রিয়তাকে ধরে বাথরুমে নিয়ে যায়। লম্বা সময় ধরে চোখে মুখে পানি দেওয়ার পর প্রিয়তার ভালো লাগে খানিকটা।
বিছানায় বসিয়ে অনু প্রিয়তাকে যত্ন করে খাবার খাইয়ে দেয়। জানালা দিয়ে সে দৃশ্য জাইনের দৃষ্টি এড়ায় না। প্রিয়তা খাচ্ছে আর অনু তাকে নানা গল্প শোনাচ্ছে। দু’জনকে দেখে মনে হচ্ছে কত বছরের পরিচয়। একবারের জন্যও মনে হচ্ছে না গত কালকেই তাদের আলাপ হয়েছে।
বিকালের শেষ ভাগে প্রিয়তা এসে ছাদে বসে। জাইন ছাদের এক কোনায় বসে আছে। তার পাশে মকবুল বসা।
‘এই শুনে যাও একটু।’
অনুর ডাকে মকবুল ফিরে তাকায়। অনু তাকে ইশারায় ভেতরে যেতে বলে। মকবুল উঠে অনুর কাছে যায়। অনু তাকে টেনে রান্নাঘরের দিকে নিয়ে যায়। মকবুল ঘটনার কিছুই বুঝতে পারে না।

‘তুমি বেকুবের মতো ওখানে বসে ছিলে কেনো? ওনাদের একটু আলাদা সময় কাটাতে দাও।’
অনুর কথার মানে বুঝতে মকবুলের সময় লাগে।

‘মানে?’

‘মানে তোমার মাথা। চা বসাবো এখানেই থাকবা।’
বাধ্য ছেলের মতো মকবুল অনুর পাশেই দাঁড়িয়ে থাকে।

জাইন চুপচাপ বসে সামনের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তাও আশেপাশে তাকিয়ে দেখছিলো। হঠাৎ তার নজর যায় বাম দিকের ছাদে। সেখান কয়েকজন মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের দৃষ্টি এদিকে। তার কিছু বলছে আর হাসছে। ভালো করে তাকাতেই প্রিয়তা বুঝে এরা জাইনের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তা সেদিক থেকে চোখ সরিয়ে অন্য দিকে তাকিয়ে থাকে। তবে এর মধ্যে ঘটে যায় অন্য ঘটনা।

‘এই যে হ্যান্ডসাম তুমি কি সিঙ্গেল? সিঙ্গেল হলে নাম্বারটা ছুঁড়ে মারো।’
মেয়েগুলোর কথা শুনে প্রিয়তা চোখজোড়া বড় বড় করে সেদিকে তাকায়। এদের বয়স বেশি হবে না। বড় জোর পনেরো কিংবা ষোল হবে। জাইনেরও দৃষ্টি আকর্ষণ হয় মেয়েগুলোর ডাকে।
জাইন তাকাতেই একটা মেয়ে হাত নাড়ে তার দিকে। জাইনও না বুঝে হাত তুলে হাত নাড়ে। এতে মেয়েটা লজ্জায় মুখ ঢেকে ফেলে।

‘তুমি কি সিঙ্গেল? তোমার নাম্বারটা দাও।’

মেয়েটার কথা শুনে জাইন হাসে।

‘মামানি আমার ঠিক সময় বিয়ে হলে তোমার সমান বাচ্চা থাকতো। আর শুনো আমার একটা রাগী গার্লফ্রেন্ড আছে সে দেখতে পেলে তোমাদের ঠ্যাং ভাঙবে।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা হতভম্ব হয়ে যায়। সে আশা করেনি জাইন এমন কিছু বলবে। মেয়েটা জাইনের কথায় মজা পেয়ে হাসে।

‘সমস্যা কি গার্লফ্রেন্ড আছে বউ তো নাই। আমাকে তোমার বউ বানাও হ্যান্ডসাম।’

‘সরি মামনি বউয়ের জায়গা সে দখল করে ফেলেছে। তবে তোমার জন্য অন্য একটা জায়গায় খালি আছে রাজি থাকলে বলো।’

মেয়েটা কৌতুহল হয়ে জিজ্ঞেস করে,’কি?’

‘আমার মেয়ে হবা? তোমাকে মেয়ে বানাতে চাই মামনি।’

জাইনের উত্তর শুনে মেয়েটার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। তার সাথের মেয়ে গুলো হো হো করে পেট চেপে হাসতে থাকে। অপমানে মেয়েটা সেখান থেকে চলে যায়। জাইনও নিঃশব্দে হাসে। জুতার শব্দে পিছনে ফিরে তাকাতেই দেখে প্রিয়তা ভেতরে যাচ্ছে। এতক্ষণ সে খেয়ালই করেনি প্রিয়তা এখানে ছিলো।

‘জ্বর কমেছে?’

জাইনের প্রশ্ন শুনে প্রিয়তা থামে।
‘হুম কমেছে।’

‘তাহলে আমাদের বের হওয়া উচিত নইলে বাসায় ফিরতে তোমার আরো দেরি হবে। অনুকে বলো আমরা বের হবো।’

জাইনের কথার কোনো উত্তর না দিয়ে প্রিয়তা ভেতরে যায়। সন্ধ্যা নামার পরই অনুদের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দেয় তারা। প্রিয়তা রিকশায় চড়েছে আর জাইন তার বাইকে।

রিকশা থামে প্রিয়তার বাসার সামনে। অপরদিকে জাইন না থেমে বাইক টেনে চলে যায়। রিকশা থেকে নেমে ভাড়া পরিশোধ করতে নিলে রিকশাওয়ালা জানায় ভাড়া পরিশোধ করা হয়েছে। প্রিয়তা খানিকটা অবাক হয় এরপর বুঝে নেয় এই কাজটা কার।

‘কিরে কই গেছিলি?’
তুহিনের গলা পেয়ে চমকে তাকায় প্রিয়তা। সবেই অফিস থেকে ফিরেছে তুহিন।

‘এই তো বান্ধবীর বাসা থেকে।’

‘রাত বাজে আটটা এখন তুই বান্ধবীর বাসা থেকে ফিরিস? উপরে চল।’

তুহিন প্রিয়তাকে ধমকে উপরে যেতে বলে। প্রিয়তা মাথা নিচু করে হাঁটা দেয়। আজকে তুহিন বাসায় জলদি ফিরেছে।

বাসার দরজা খুলতেই মিসেস মাসুমা ছেলের রাগান্বিত চেহারা দেখে আন্দাজ করে এখন ঘরে অশান্তি হবে।
‘আমাকে কল দিয়ে জানাইছো তোমার মেয়ে যে বাসায় ফিরে নায়? রাত বাজে আটটা এখন সে নাচতে নাচতে বাসায় ফিরে।’

তুহিনের চিৎকার চেঁচামেচি শুনে মাসুদা ঘর থেকে বের হয়। তাকে দেখে মনে হয় সে পরিস্থিতি ঠান্ডা করে আসেনি উল্টো মজা নিতে এসেছে।

মিসেস মাসুমা বলে,’আমি তোকে এখনই জানাতাম।’

‘কখন জানাতা? মেয়ে কারো হাত ধরে চলে গেলে?’
তুহিনের কথা শুনে প্রিয়তার ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়।

‘ভাইয়া মায়ের সাথে একদম চেঁচামেচি করবে না। মায়ের কোনো দোষ নেই। যা বলার আমাকে বলো।’

প্রিয়তার কথা শুনে তুহিন ক্ষেপে যায়।
‘দিন দিন তোর পা মনে হয় লম্বা হয়ে গেছে। দাঁড়া তোর বাহিরে বের হওয়া বন্ধ করতেছি।’

প্রিয়তাকে ঝারি মেরে তুহিন নিজের কক্ষের দিকে যায়। মিসেস মাসুমা আঁচল দিয়ে চোখ মুছে। প্রিয়তা তার কাঁধে হাত রাখলে সে হাত ঝারা দেয়।

‘ধরবি না একদম আমাকে। কতগুলা কল দিছি তোরে? তুই উল্টা পাল্টা কাজ করবি আর কথা শুনবো আমি? কাউকে পেয়ে থাকলে তার হাত ধরে চলে যা এভাবে অশান্তি করিস না আমার সংসারে।’
মিসেস মাসুমার কথা শুনে প্রিয়তা মাথা নিচু করে ফেলে। কোনো দিকে না তাকিয়ে নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।
রাতের বেলায় বেল্লাল হোসেন ফিরলে এ বিষয়ে তাকে কেউ কিছু বলে না। প্রিয়তাও বাবাকে এসব জানিয়ে অশান্তি বাড়াতে চায় না। মাসুদা কয়েকবার চেষ্টা করে বলার কিন্তু মিসেস মাসুমা তাকে সুযোগ দেয় না।

___________

আজকে ভার্সিটি বন্ধ তবুও মিথ্যে বলে বাসা থেকে হয়েছে প্রিয়তা। রিমি আর হৈমন্তীর সাথে শপিং মলে ঘুরছে। হৈমন্তীর বেশ কিছু কেনাকাটা আছে তাই তাদেরকে টেনে এনেছে। আগামী সপ্তাহে মিড তখন তো আর সুযোগ পাবে না বের হওয়ার। গত সেমিস্টারের রেজাল্ট বের হয়েছে। সেখানে রিমির রেজাল্ট খারাপ হলেও হৈমন্তী আর প্রিয়তার রেজাল্ট ভালো হয়েছে। হৈমন্তীর এখন টার্গেট আরো ভালো রেজাল্ট করা তাই পুরো সময়টাই পড়ায় দেয় সে। আজকে খুবই শিডিউল করে বের হয়েছে সে।
প্রিয়তা মাথায় চিন্তা নিয়েই ঘুরছে। তুহিন সেই রাতে চেঁচামেচি করার পর থেকে তার সাথে কথা বলে না। মিসেস মাসুমা একটু ঘাটাঘাটি করে জানতে পারে তার বোন মাসুদা কল করে তুহিনকে জানায় প্রিয়তা বাসায় নেই সে সকালে বাসা থেকে বেরিয়েছে। তাই তুহিন সেদিন জলদি বাসায় ফেরে। এ ঘটনা জানার পর মিসেস মাসুমা ক্ষেপে নিজের বোনকে সবটা জিজ্ঞেস করলে সে অস্বীকার যায়। শেষে ঝগড়া লাগিয়ে নিজের বাসায় ফিরে যায়। মাসুদা যাওয়ার পর মিসেস মাসুমার মন খারাপ হয় কিন্তু প্রিয়তা খানিকটা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
‘প্রিয়ু কি হয়েছে তোর?’
রিমির ধাক্কায় প্রিয়তার ধ্যান ভাঙে।

‘কিছু না তো।’

‘কিছু না মানে? কতক্ষণ ধরে তোকে হৈমি ডাকছে শুনছিস না?’
হৈমন্তী স্টোরের এক মাথায় দাঁড়িয়ে তাদের দিকে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তা রিমির হাত ধরে সেদিকে হাঁটা দেয়। তারা ঢুকেছে বিশাল এক সুপার শপে।

মিসেস পারুল ট্রলি নিয়ে ঘুরছে আর লিস্ট দেখে এরা ওটা ট্রলিতে রাখছে। সামনে রমজান মাস তাই সবাই বাজার করতে এসেছে। মিসেস পারুলের মন ভালো নেই। রমিজউদ্দিনের তার সাথে আসার কথা অথচ লোকটা এখনো আসেনি। লিস্ট মোতাবেক একটা সোয়া সস লাগবে কিন্তু সোয়া সসের বোতল সবার উপরের তাকে রাখা। ওনার হাত সেখানে পৌঁছাচ্ছে না। আশেপাশে তাকিয়ে কর্মীর খোঁজ করে কিন্তু পায় না। এতো মানুষের ভীড় যে কর্মীরা সামাল দিতে হিমশিম খাচ্ছে। মিসেস পারুল অসহায় বোধ করে। ফোন বের করে রমিজউদ্দিনকে কল দেয় কিন্তু উনি কল রিসিভ করেন না। এরপর কল লাগায় জাইনকে। দু’বার রিং হতেই জাইন কল রিসিভ করে।

‘হ্যা আম্মা বলো।’

‘তোরা এতো মানুষ থাকতেও আমার একা একা শপিং করা লাগে।’

জাইন তার মায়ের গলা শুনে বুঝে সে কোনো কারণে রেগে গেছে।

‘কি হয়েছে আম্মা?’

‘কি আর হবে? আমি একা একা বাজার করতেছি তোর বাপের কোনো খবর নাই।’

‘এই জন্যই তো বলি ভাইকে বিয়ে করাও তাহলে তো তুমি সঙ্গী পেয়ে যাবা।’

‘ফাইলামী করিস? বাপের মতো হইছিস একদম।’

‘আহা আম্মা চেইতো না। এড্রেস দাও আমি এক্ষুনি আসতেছি।’

মিসেস পারুল অভিমান করে কল কেটে দেয়। এরপর আবার চেষ্টা করে বোতলটা নামানোর। এমন সময় একটা হাত এসে তার পাশ থেকে সোয়া সসের বোতল নামায়। পাশে তাকাতেই দেখে এক মেয়ে বোতলটা নামিয়েছে। এর থেকে বেশি আশ্চর্য হন যখন মেয়েটা তার দিকে বোতলটা এগিয়ে দেয়।

‘আমি দেখলাম আপনি এটা নামানোর চেষ্টা করছেন তাই ভাবলাম একটু সাহায্য করি।’

মেয়েটার কথা শুনে মিসেস পারুলের মুখে হাসি ফুটে উঠে।

‘তোমাকে চেনা চেনা লাগছে। কোথাও দেখেছি মনে হয়।’

‘আপনি একদিন আমার জান বাঁচিয়েছিলেন।’

প্রিয়তার কথা শুনে মিসেস পারুলের মনে পড়ে।

‘ও হ্যা তুমি সেই মেয়ে! তখন শাড়ি পরিহিত ছিলা এখন তো পরনে কামিজ তাই চিনতে পারিনি।’

মিসেস পারুলের কথায় প্রিয়তা হাসে। সেই সাথে খুশি হয় ভীষণ। প্রিয়তা মিসেস পারুলকে সাহায্য করে লিস্টের বাকি জিনিসগুলো খুঁজে নিতে।
কেনাকাটা শেষ হতেই একজন কর্মী মিসেস পারুলের ট্রলি পার্কিং এর দিকে নিয়ে যায়। প্রিয়তা বের হয় মিসেস পারুলকে এগিয়ে দিতে। দু’জনের মধ্যে টুকটাক কথাবার্তা হয়।

‘একি তুমি আমাকে রেখে সব কেনাকাটা সেরে ফেলছো? তাহলে আমি এলাম কেনো?’

হঠাৎ রমিজউদ্দিনকে দেখে মিসেস পারুল মুখ ভাড় করে ফেলে।
‘আপনার আসার কথা কখন আর এলেন কখন? কয়টা বাজে খবর আছে?’

‘হে হে রাগ করছো কেনো মজা করছিলাম তো। চলো চলো তোমাকে শপিং করিয়ে দেই।’

‘না আমার কিছু লাগবে না।’

‘তা বললে হয় নাকি? দশটা না পাঁচটা না তুমি আমার এক মাত্র ছিচকাদুনী বউ।’

‘আমি আপনার সাথে জীবনেও শপিং করতে যাবো না।’

‘মানলাম আমার একটু বয়স বেড়েছে আর হালকা একটু ভুঁড়ি হয়েছে কিন্তু তাতে কি আমি এখনো মনের দিক দিয়ে সুইট সিক্সটিন। এম আই রাইট ইয়াং লেডি?’
শেষের প্রশ্নটা প্রিয়তার দিকে ছুঁড়ে দেয় রমিজউদ্দিন। প্রিয়তা হচকচিয়ে মাথা নাড়িয়ে সায় দেয়।

রমিজউদ্দিন হেসে বলে,’দেখলে তো ইয়াং লেডিও সায় দিলো। চলো এবার।’

মিসেস পারুল মিছে মিছে আর রাগ করে থাকতে পারলেন না।
রমিজউদ্দিন বলে,’তোমাকে শপিং শেষে সিনেমা দেখাবো এরপর পার্কে ঘুরতে নিবো। আজকে শুধু আমাদের একান্ত সময় কাটবে। প্রেম করার সময় লুকিয়ে লুকিয়ে প্রেমিক প্রেমিকা যেভাবে ঘুরে সেভাবে ঘুরবো। চলো সুন্দরী ঘুরে আসি।’

রমিজউদ্দিনের কথা শুনে মিসেস পারুল হেসে দেয়।

প্রিয়তাকে উদ্দেশ্য করে মিসেস পারুল বলে,’ভালো থেকো মা। আসি আবার দেখা হবে।’

রমিজউদ্দিনও প্রিয়তাকে বলে,’থ্যাংকিউ ইয়াং লেডি আমার ছিচকাদুনীর খেয়াল রাখার জন্য। বায় টেক কেয়ার।’

রমিজউদ্দিন মিসেস পারুলের হাত ধরে নিয়ে যায়। এ দৃশ্য দেখে প্রিয়তার মুখে অজান্তেই হাসি ফুটে ওঠে। তাদের বাসায় ছোট বেলায় একটু আধটু বাবা মায়ের মধ্যে ভালোবাসা দেখেছিলো কিন্তু বড় হওয়ার পর তার বাবা-মা কেমন জানি রোবট হয়ে গেছে। দু’জন সারাদিন পর একত্রে বসে একটু গল্পও করে না। তাদেরকে তেমন একটা কথাও বলতে দেখা যায় না। অথচ এদের দেখে প্রিয়তার মনে হচ্ছে সদ্য কৈশোরে পা দেওয়া কিশোর-কিশোরী। প্রিয়তার ইচ্ছে হয় নিজের বাবা-মাকে এভাবে একদিন ঘুরতে দেখতে। ছোট বেলায় বাবা-মায়ের সাথে ঘুরতে যেতো তারা। প্রয় দশ বছররের অধিক সময় হয়েছে তারা আর ঘুরতে যায় না। মিসেস মাসুমাও একলা সারাদিন ঘরে পড়ে থাকে। প্রিয়তা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। সে জানে বাস্তবতা ভিন্ন। সকলের জীবন এক হয় না। কারো জীবন রঙিন ঘুরি কারো বা সাদাকালো টিভি।
প্রিয়তা আবারো সুপার শপের দিকে যায়। সেখানে গেলে দেখে রিমি আর হৈমন্তী তার জন্য অপেক্ষা করছে। তারা তাকে নানান প্রশ্ন করে। প্রিয়তা তাদেরকে ঘটনা বলে। এরপর গল্প করতে করতে তিন বান্ধবী খেতে যায়।

____________

শুক্রবার দিন তুহিনের অফিস বন্ধ। অন্যান্য শুক্রবারে সে বেলা করে ঘুম থেকে উঠে গোসল করেই নামাজে যায় কিন্তু আজকে ভিন্ন। সকাল নয়টায় ঘুম থেকে উঠেছে এমন কি বাজারে গিয়ে বাজার করে এনেছে। বাসার সবাই বেশ অবাক। সকলের সাথে তুহিন বেশ হেসে হেসে কথা বলছে। প্রিয়তার কাছে বিষয়টা খটকা লাগে তবুও আমলে নেয় না। ভাবে হয়তো তুহিন বাসার পরিস্থিতি ঠিক করতে চায়। বেল্লাল হোসেনকেও আজকে দোকান খুলতে দেয় না।

দুপুর বেলা নামাজ শেষ হতেই বাসার কলিংবেল বাজে। প্রিয়তা হাত মুছে যায় দরজা খুলতে। মাথার ওড়না ঠিক করে দরজা খুলতেই দেখে দরজায় আশরাফ দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তাকে দেখে দাঁত বের করে সে হাসি দেয়। প্রিয়তা বিরক্ত হয় আশরাফকে দেখে।

‘ভেতরে আসতে দিবা না? নাকি এখানে দাঁড়িয়ে আলাপ করবা?’

প্রিয়তা সরে আশরাফকে ভেতরে যেতে জায়গা দেয়। আশরাফ কেনো এসেছে একটু একটু আন্দাজ প্রিয়তা করতে পারছে। মিসেস মাসুমা রান্নাঘর থেকে জানতে চায় কে এসেছে। প্রিয়তা রান্নাঘরে গিয়ে জানায় কে এসেছে। কিছুক্ষণ পর আবারো বেল বাজে। এবার দরজা খুললে তুহিন আর বেল্লাল হোসেন প্রবেশ করে।
প্রিয়তা নিজের কক্ষে চলে যায়। দুপুরের খাবারের সময় প্রিয়তাকে ডাকা হয়। সে মাকে সহায়তা করতে আসে খাবার পরিবেশনে। সকলের খাবার হতেই প্রিয়তা নিজের কক্ষে আবারো চলে আসে। একটু পর তুহিন এসে তাকে তৈরি হতে বলে। প্রিয়তা তৈরি না হয়ে ওভাবেই বসে থাকে। বাহিরের কথাবার্তা শুনে বুঝে আশরাফকে তুহিন এনেছে তার বাবা-মায়ের সাথে দেখা করাতে। তার উদ্দেশ্য আশরাফের সাথে প্রিয়তার বিয়ে দিবে। প্রিয়তা দাঁতে দাঁত চেপে বসে থাকে। বেল্লাল হোসেন সরাসরি বলছেন বিয়ের বিষয়ে পরে ভাববেন কিন্তু তুহিন আর আশরাফ তাকে নানান ভাবে বোঝানোর চেষ্টা করছেন। মিসেস মাসুমা নির্বাক। উনি কোনো কথা বলছেন না।

এক সময় বেল্লাল হোসেন কোনো কথা না বলে নিজের কক্ষে চলে যায়। ইতিমধ্যে বিকাল নেমেছে। আশরাফ এখনো যায়নি। তুহিন আবারো আসে প্রিয়তাকে ডাকতে।

‘আশরাফ ভাই ছাদে যাচ্ছে তুই তৈরি হয়ে যা। দেরি করবি না একদম। আর ত্যাড়ামি করলে তোর কপালে শনি আছে।’
তুহিন এক প্রকার হুমকি দিয়ে চলে যায়। প্রিয়তা শাড়ি না পরে কামিজ পরেই ছাদের দিকে যায়। আসার সময় ফোনটা সাথে এনেছে।

ছাদে আসতেই দেখে আশরাফ দাঁড়িয়ে পাশের ছাদে থাকা মেয়েদের দিকে হা করে তাকিয়ে আছে। প্রিয়তা ফোনটা বের করে মেসেজ টাইপ করে পাঠায়। একটু পর মেসেজের উত্তর আসে।
মেসেজের টুংটাং আশরাফ পিছনে তাকায়। এরপর প্রিয়তার সামনে এসে দাঁড়ায়।
প্রিয়তা তার দিকে মনোযোগ না দিয়ে মেসেজে মনোযোগ দেয়। এই মূহুর্তে এই বদ লোকের হাত থেকে একজনই তাকে বাঁচাতে পারে।

‘সাহায্য লাগবে আপনার।’

‘কার লাগবে সাহায্য? তোমার? কার থেকে? আমার থেকে? এম আই ড্রিমিং?’

‘নাটক না করে বলুন সাহায্য করবেন কিনা?’

‘অবশ্যই হ্যা। একশতবার হ্যা। তুমি শুধু বলেই দেখো।’

‘ছাদে আসুন এক্ষুনি।’

‘আমি একটু দূরে আছি। আচ্ছা থাকো আমি আধা ঘন্টার মধ্যে আসছি।’

‘একা আসবেন না সাথে আপনার বন্ধুদের নিয়ে আসবেন।’

‘কাহিনী কি বলো তো। কি সাহায্য লাগবে?’

‘আসলেই দেখতে পারবেন।’
মেসেজটা পাঠিয়ে প্রিয়তা সামনে তাকাতেই দেখে আশরাফ তার দিকে অদ্ভুত ভাবে তাকিয়ে আছে।

আশরাফ বলে,’তুমি কি আমার উপর বিরক্ত? কত গুলা প্রশ্ন করলাম শুধু হু হ্যা উত্তর দিলা।’

প্রিয়তা জবাব দেয়,’না তেমন কিছু না। চলুন বসে গল্প করি।’
প্রিয়তা ইশারায় বেঞ্চটা দেখায়। আশরাফ খুশি হয় প্রিয়তার প্রস্তাবে। সে ভাবে প্রিয়তাকে পটিয়ে ফেলেছে। কিন্তু এদিকে তার জন্য যে কি অপেক্ষা করছে সেটা জানলে লেজ গুটিয়ে সে পালাতো।

………
(চলবে..)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|১৪.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
……….

জাইন এলো তবে আধা ঘন্টা না এক ঘন্টা দশ মিনিট পর। এই পুরো সময়টা প্রিয়তার কাটে ভীষণ বিরক্তিময়। ইতিমধ্যে মাগরিবের আজান দিয়েছে চারিদিকে। আশরাফ লোকটা এতো বকবক করে যে প্রিয়তার কান ঝালাপালা করে ফেলেছে। শেষবার ঐ যে জাইন বললো আসতেছে এরপর আর তার খবর নেই।

প্রিয়তা শেষে বিরক্ত হয়ে উঠে দাঁড়ায়। এমন সময় আশরাফ তার পিছন পিছন আসে।
‘কোথায় যাচ্ছো প্রিয়তা?’

দাঁতে দাঁত চেপে জবাব দেয়,’মরতে যাচ্ছি যাবেন?’

‘ছি ছি কি বলো এসব। সামনে আমাদের বিয়ে।’

রাগে প্রিয়তার শরীর জ্বলে যায়। লোকটা এতো বেহায়া। যতক্ষণ পাশের ছাদে মেয়েরা ছিলো ততক্ষণ সে মেয়ে গুলার দিকে একটু পর তাকাচ্ছিলো। মেয়েগুলো টিকটকে নাচানাচি করছিলো সেগুলো দেখে আশরাফ মজা নিচ্ছিলো। এমনিতেই আশরাফকে প্রিয়তার অপছন্দ তার উপরে তার এসব কর্মকান্ড দেখে আরো বিরক্ত হয়ে গেছে সে।

‘তা বিয়ে কবে করছেন বড় ভাই?’
হঠাৎ পুরুষালি গলা পেয়ে আশরাফ এবং প্রিয়তা সেদিকে তাকায়। জাইন ততক্ষণে ছাদ টপকে এই ছাদে চলে এসেছে। তার পিছন পিছন মারুফ,শাকিল,রফিকও এসেছে।

সকলকে দেখে আশরাফ খানিকটা ঘাবড়ে যায়। আশরাফের কাঁধে হাত রেখে জাইন জিজ্ঞেস করে,’বড় ভাই বিয়ে করতেছেন অথচ দাওয়াত দিলেন না যে। তা আপনার পাত্রী কে?’

আশরাফ ঘাবড়ে প্রশ্ন করে, ‘আপনি এখানে?’

‘হাওয়া খেতে এসেছিলাম ছাদে। তখনই আপনার বিয়ের কথা কানে এলো। তা আপনার পাশে যিনি আছেন তাকে বিয়ে করছেন নাকি?’
শেষের কথাটা বলে জাইন মিটমিট করে হাসে। আশরাফ এবার সহজ হয়। লজ্জা মাখা মুখে প্রিয়তার দিকে একবার তাকায়। জাইনের কথাবার্তায় প্রিয়তা খানিকটা ভ্যাবাচ্যাকা খায়।

আশরাফ গলার স্বর নামিয়ে বলে,’হ্যা প্রিয়তার সাথে আমার বিয়ে হবে।’

জাইন অবাক হওয়ার ভান করে বলে,’ওরে বাবাহ্ কংগ্রেস।’

মারুফ আশরাফের এক হাত ধরে আরেক হাত শাকিল ধরে।
মারুফ বলে,’এতো বড় সুখবর মিষ্টি মুখ ছাড়া হয় বলেন? চলেন একটু মিষ্টি কিনে নিয়ে আসি। আর আপনাকেও স্পেশাল মিষ্টি খাওয়াবো আজকে।’

রফিক মাঝখানে বলে ওঠে,’গ্রামের মাইনষে কয় টাক ওয়ালাগো বুদ্ধি কম থাকে আজকে নিজের চোক্ষে তা দেখে নিলাম।’

শাকিল বলে,’শালা তোর কলিজা আছে। এতো বেইজ্জতির পরও এই মেয়ের পিছনে পড়ে আছিস। আমি হইলে কচু গাছের সাথে ফাঁ সি দিতাম। এদিকে প্রেম করার জন্য মাইয়া পাই না তুই বিয়ের জন্য মাইয়া পটাই ফেলছিস।’

মারুফ আফসোসের স্বরে বলে,’সবই ভুঁড়ি আর টাকের কামাল মামা।’

জাইন শুকনো কাশি দিতেই তিনজনের হুঁশ হয়। আশরাফকে টানতে টানতে পাশের ছাদের দিকে নিয়ে যায়। আশরাফ পিছনে ঘুরে অসহায় দৃষ্টিতে প্রিয়তার দিকে তাকায়।
‘প্রিয়তা সাহায্য করো।’

আশরাফের কথার কোনো জবাব প্রিয়তা দেয় না।এই মূহুর্তে কি করা উচিত বুঝে উঠতে পারে না।

জাইন নিচু গলায় বলে,’এই ঝামেলা দেখানোর জন্য ডেকেছো?’
জাইনের গলার স্বর ইতিমধ্যে বদলে গেছে। নরম স্বরের বদলে এখন গাম্ভীর্য নেমে এসেছে।
প্রিয়তা কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে ফেলে। ঐ সময় তার যেটা ভালো মনে হয়েছে করেছে কিন্তু এর পরিণতি ভাবেনি।তার ভাই এসব জানলে তো অনেক অশান্তি হবে ঘরে। আর তার জন্য ঘরে অশান্তি হোক সেটা সে চায় না।
‘আশরাফ ভাইকে বুঝিয়ে ছেড়ে দিন কোনো ক্ষতি করবেন না। আমি ঝোঁকের মাথায় আপনার কাছে সাহায্য চেয়েছি এর বেশি কিছু না। আমার আপনাকে ডাকা উচিত হয়নি।’

প্রিয়তার এমন কথায় অসন্তুষ্ট হয় জাইন। হুট করেই মেজাজটা খারাপ হয়ে যায় তার। দলের কাজ ফেলে সে ছুটে এসেছে আর প্রিয়তা এখন তাকে এসব বলছে।
প্রিয়তাকে ধমকে বলে জাইন,’তোমার কি আমাকে পা গ ল মনে হয়? নাকি মনে হয় আমি রাস্তার কোনো বখাটে? ফাইজলামি করো তুমি আমার সাথে?’

প্রিয়তা চোখ তুলে এক পলক জাইনের দিকে তাকায়। জাইনের চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে চেতে গেছে সে। হয়তো সে আশা করেছিলো অন্য কিছু।

‘কথার জবাব দিচ্ছো না কেনো? সাহায্য চেয়েছো বুঝলাম কিন্তু আবার বলছো তারে যেনো কিছু না করি ঝোঁকের মাথায় আমাকে ডেকেছো। এসবের মানে কি? তোমার কোনো আইডিয়া আছে আমি কিভাবে সব কিছু ম্যানেজ করে এসেছি? এসব তো দেখবা না দেখবা তো কারে মা র লা ম কিভাবে হাতে ক্ষত হলো। কেনো মা র লা ম আর কেনো ক্ষত হলো সেটা তো জানবা না কিংবা জানতে চাবা না।’

‘এসব জেনে আমার কোনো লাভ নেই। এগুলো আপনার ব্যক্তিগত বিষয়। আপনি গুন্ডামি মাস্তানী করেন কেনো সেটাও জানতে চাই না।’

‘আমি যদি গুন্ডা হই তাহলে গুন্ডার কাছে সাহায্য কেনো চাও? বলো উত্তর দাও।’

জাইনের কথায় আহত হয় প্রিয়তা। চোখে চোখ রেখে বলে,’আমার ভুল হয়েছে মাফ করেন। আর কখনোই আপনার সাহায্য লাগবে না আমার। আর আপনিও আমাকে একদম বিরক্ত করবেন না।’

কথাগুলো বলেই প্রিয়তা হাঁটা দেয়। জাইন বড় বড় কদম ফেলে তার সামনে গিয়ে রাস্তা আটকায়।

‘সরুন আমাকে যেতে দিন।’
জাইন চুলগুলো পিছনে টেনে নিজেকে শান্ত করার চেষ্টা করে। প্রিয়তার বিয়ের কথা শুনে তার মাথা গরম হয়ে গেছে তার উপর প্রিয়তা তার মনে কথা বুঝতে চাইছে না। উল্টো ত্যাড়া ত্যাড়া কথা বলে তাকে আরো রাগিয়ে দিচ্ছে। সে যতবারই চেষ্টা করছে প্রিয়তাকে সবটা বুঝাতে ততবারই ব্যর্থ হচ্ছে। না মাথা গরম করলে কাজ হবে না কারণ প্রিয়তা এতে উল্টো বেঁকে বসবে। সহজে ধরা দেওয়ার মেয়ে সে নয়।

নরম স্বরে জাইন বলে,’শুনো প্রিয় আমি ওভাবে বলতে চাইনি। আমরা বসে ঠান্ডা মাথায় কথা বলি চলো। তোমাকে অনেক কিছু বলার আছে।’

জাইন এগিয়ে এসে প্রিয়তার হাত ধরতে নিলে প্রিয়তা তার হাত ঝারা দেয়। এরপর যেই কাজটা করে এটা স্বপ্নেও ভাবেনি জাইন। ঠাস করে তার ডান গালে চ ড় বসায় প্রিয়তা। হতভম্ব হয়ে সে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে রয়। ইতিমধ্যে প্রিয়তা রাগে ফুঁসছে।

‘বললাম না আমাকে যেতে দিন। আপনার সাহস কি করে হয় আমার হাত ধরার? আপনার মতো গুন্ডা ছেলেকে আমি ঘৃণা করি। একদম আমার আশেপাশে আসবেন না। আই হেইট ইউ।’

কথাগুলো বলে গটগট করে হেঁটে সেখান থেকে চলে যায় প্রিয়তা। জাইন মূর্তির মতো সেখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। বুকের বাম পাশে চিনচিন করতে শুরু করে জাইনের। প্রিয়তা কি অনেক রাগ করেছে তার উপর? সে তো এখনো প্রিয়তাকে জানাতেই পারলো না তাকে সে কতটা ভালোবাসে আর নিজের কতটা আপন করে তাকে চায়। এখন সে কিভাবে প্রিয়তাকে বলবে সবটা? প্রিয়তা যদি তাকে ঘৃণা করে তাহলে সে তো কখনোই প্রিয়তার মনে তার জন্য জায়গা করে নিতে পারবে না। আকাশে মেঘ জমে নামে ঝুম বৃষ্টি। বৃষ্টির মধ্যে ফোন বের করে প্রিয়তাকে কল দেয় সে। কিন্তু প্রিয়তার নাম্বার বন্ধ দেখায়। বৃষ্টির সাথে সাথে চিনচিন ব্যথাটাও বাড়তে শুরু করে।

নিজের কক্ষে এসে দরজা লাগিয়ে বিছানায় বালিশ টেনে সেটা জড়িয়ে শুয়ে পড়ে প্রিয়তা। অজানা কারণে তার খারাপ লাগছে ভীষণ। কেনো খারাপ লাগছে সেটা এখনো ঠাওর করতে পারছে না। ফোনটা বন্ধ করে বিছানায় ফেলে রেখেছে। বারবার চোখের সামনে জাইনের মুখটা ভেসে উঠছে। চ ড় খাওয়ার পর জাইন যেভাবে অবিশ্বাস্য চোখে তাকিয়ে ছিলো তাতে মনে হচ্ছিলো সে বিষয়টা হজম করতে পারেনি। প্রিয়তার কান্না পায় নিজের রাগ সামলে না রাখতে পারায়। হুটহাট এভাবে তার উচিত হয়নি খারাপ আচরণ করা। দরজায় ক্রমাগত নক করার শব্দে তার ধ্যান ভাঙে। বিছানা থেকে নেমে দরজা খুলতেই তুহিন কক্ষে প্রবেশ করে।

‘আশরাফ ভাই কই? তারে ফোন দিতেছি কেটে দেয় ক্যান?’

প্রিয়তা বিরক্তি নিয়ে উত্তর দেয়,’জানি না।’

‘জানোস না মানে? তোর সাথে না ছাদে গেলো? যার সাথে বিয়ে হবে তার খোঁজ খবর রাখোস না?’

তুহিনের কথা প্রিয়তার গায়ে কাঁটার মতো বিধলো।

‘বিয়ে? কিসের বিয়ে? কার বিয়ে? আমি বিয়ে করবো না। জোর করলেও করবো না। অনেক হইছে আর না। তোমাদের আমাকে বোঝা মনে হলে বলো আমি বের হয়ে যাই ঘর থেকে।’

প্রিয়তার কথা শুনে তুহিন কটমট চোখে তার দিকে তাকায়। দেরি না করে বাম গালে চ ড় বসায়। বেল্লাল হোসেন আর মিসেস মাসুমা ছুটে আসেন। প্রিয়তা গালে হাত দিয়ে ভাইয়ের দিকে ক্ষ্যাপা দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে।

‘তোর এতো সাহস আমার মুখে মুখে তর্ক করিস। তোরে আমি..’

মিসেস মাসুমা তুহিনকে ধরে।

‘ছাড়ো মা ওরে আজকে মেরেই ফেলবো। এমন মেয়ে বাসায় রাখার থেকে মেরে ফেলা ভালো।’

‘তুহিন আর এক পা এগুলে আমি কিন্তু তোর গায়ে হাত তুলতে বাধ্য হবো। তুই বলেছিলি প্রিয়তা ঐ ছেলেকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চায় তাই আমি তোর কথায় মত দিয়েছিলাম কিন্তু এখন যখন প্রিয়তা স্পষ্ট জানালো তার এই বিয়েতে মত নেই আমি আমার মেয়েকে কিছুতেই বিয়ে দিবো না।’

‘বাবা তুমিও তোমার মেয়ের মতো উল্টাপাল্টা শুরু করলা? এই মেয়ে তোমার নাম ডুবাবে দেখে নিও। সেদিন তুমি এসে হাত জোর করে বলবা তুহিন তুই ঠিক ছিলি আর আমি ভুল ছিলাম।’

‘মাসুমা তোমার ছেলেকে এখান থেকে নিয়ে যাও।’

বেল্লাল হোসেনের গম্ভীর গলায় পেয়ে মিসেস মাসুমা তুহিনকে টেনে নিয়ে যায়। তুহিন যেতেই প্রিয়তা বাবাকে জড়িয়ে আবেগী হয়ে যায়।

‘তোর উচিত ছিলো আরো আগে মুখ খোলা তুহিনের এসব কাজকর্মকে প্রশ্রয় না দেওয়া। কেউ থাকুক আর না থাকুক আমি সবসময় তোর সাথে থাকবো যতদিন বেঁচে আছি।’

বেল্লাল হোসেন প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়।

_________

রমজান মাস চলছে এখন। ভার্সিটির মিড শেষ হয়েছে গত সপ্তাহে এখন সেমিস্টার ফাইনালের প্রিপারেশন চলছে পুরোদমে। সেমিস্টার ফাইনাল শেষ হলে ছ মাস পর লাস্ট সেমিস্টার। এরপরই ভার্সিটির জীবন শেষ। প্রিয়তা মিডের শুরু থেকেই অন্য দিক থেকে মনোযোগ সরিয়ে পড়ায় মনোযোগ দিয়ে সবটুকু। হৈমন্তী তাকে সাহায্য করছে। রিমির তেমন মাথা ব্যথা নেই। সে হৈমন্তী আর প্রিয়তার নোটস কপি করে পড়ে পরীক্ষা দিচ্ছে। তার সব কিছুই চলছে আগের মতো। লাইব্রেরিতে বসে তিনজন পড়ছিলো। রিমি পড়ছিলো বললে ভুল হবে উল্টাপাল্টা প্রশ্ন করে বিরক্ত করছিলো।

‘এই হৈমি শোন।’
বিরক্তি নিয়ে হৈমন্তী রিমির দিকে তাকায়।

‘কেউ যদি অপরাধ করে মাফ চায় তাহলে তাকে কি করা উচিত?’

‘ক্ষমা করা উচিত। এবার আর আমাকে বিরক্ত করবি না।’

‘ধর সে অপরাধ করেনি আমি শুধু শুধু রাগ করেছি তাকে ক্ষমা করাটা উচিত হবে?’

‘আশ্চর্য কেউ অপরাধ না করলে রাগ কেনো করবি?’

রিমির আর হৈমন্তীর কথা প্রিয়তার কান এড়ায় না।

প্রিয়তা ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করে,’আর কাউকে বিনা কারনে চ ড় মারলে কিভাবে ক্ষমা চাওয়া উচিত?’

প্রিয়তার প্রশ্ন শুনে রিমি আর হৈমন্তী সন্দিহান চোখে তার দিকে তাকায়।

প্রিয়তা নিজেকে সামলে বলে,’আরে এমনিতেই জিজ্ঞেস করছিলাম।’

হৈমন্তী বলে,’দেখ বিনা কারণে কাউকে একটা কথা শোনালেও ক্ষমা চাওয়া উচিত। ক্ষমা চাইলে কেউ ছোট হয় না। তোর করা একটা কাজে কেউ কষ্ট পাক তা তো চাস না। আর ছোট্ট জীবনে কি দরকার মানুষের সাথে মুখ কালাকালি করার। গুরুতর কিছু না হলে মানুষকে ক্ষমা করে দেওয়া উচিত।’

হৈমন্তীর কথার সাথে রিমি একমত হয়। প্রিয়তা মাথা নিচু করে বইয়ের দিকে তাকায়। ছাদের ঘটনার পর সে লজ্জিত। জাইনকে ওভাবে কথা শুনিয়ে চ ড় মারা তার উচিত হয়নি বিষয়টা পরে সে বুঝেছে। কিন্তু এরপর জাইনকে আর কখনো ছাদে দেখেনি। তার সাহস হচ্ছিলো না মেসেজ দিয়ে ক্ষমা চাওয়ার। জাইনের প্রশ্নে সে রেগে ঐ কাজ করেনি তার রাগ হয়েছে অন্য জায়গায় কিন্তু কেনো রাগ হলো সেটাও সে বুঝতে পারছে না। বারবার তার মনে হয় যা ই হোক ভুল যেহেতু তার ক্ষমাও তার চাওয়া উচিত। কিন্তু জাইনকে সে কোথায় পাবে?

..

ইফতারির পর সন্ধ্যা বেলা পড়ানোর কথা বলে প্রিয়তা ক্লাবের এড়িয়াতে আসে। সেখানে সে চারিদিকে নজর ঘুরিয়ে জাইনকে খুঁজতে থাকে। দিনের বেলা এলে কেউ দেখলে চিনে ফেলতে পারে তাই এই সময় এসেছে সে। জাইনকে মেসেজ দিয়েছিলো কিন্তু সে রিপ্লাই করেনি। তাই তো সে চলে এলো তাকে খুঁজতে। আকাশের অবস্থা বেশি ভালো না। দেখে মনে হচ্ছে বৃষ্টি নামবে। বৃষ্টি নামলে ভিজে যাওয়ার সম্ভাবনা আছে তবুও এসেছে সে। সরু গলি দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ক্লাবের পিছনে চলে এসেছে। জনতা দলের ক্লাব এটা। এড়িয়ার পোলাপান এখানে থাকে। বাহিরের লোকজনের প্রবেশ নিষেধ তবুও প্রিয়তা এসেছে। আশেপাশে তাকাতেই তার নজর যায় জানালা ভেদ করে ক্লাবের নিচ তলার বাম পাশের কক্ষে। কক্ষের ভেতরের দৃশ্য দেখে চমকায় সে।
এক লোক চেয়ারে বসা তাকে দেখে মনে হচ্ছে বেধড়ক মারধর করা হয়েছে। চেয়ারের চারিদিকে অনেক পোলাপান দাঁড়িয়ে আছে। এদের মধ্যে মারুফ,শাকিল,রফিকও রয়েছে। তাদের হাতে মোটা লাঠি। জাইন লোকটার চোয়াল ধরে গালাগাল দিচ্ছে।

‘তোরে না বলছি এই এড়িয়াতে যেনো না দেখি। তুই তারপরও এখানে কোন সাহসে ঢুকছিস? মরার ভয় নাই তোর?’

লোকটা মিনতি করে বলে,’ভাই মাফ করেন আর এমন করুম না।’

‘শু য়ো রে র বাচ্চা নাফ চাস কোন মুখে? আজকে সব গুলা বু লে ট তোর মুখে ভরমু।’
পি স্ত ল বের করে লোকটার মুখে পুরে দেয় জাইন। বাহিরে দাঁড়িয়ে পুরো দৃশ্যটা প্রিয়তা দেখে। এমন সময় এক ছেলে এসে প্রিয়তাকে ধমকায়।

‘এই আপা আপনি এখানে কি করেন? কার অনুমতিতে ক্লাবের এড়িয়াতে ঢুকছেন?’

ছেলেটার কথা মারুফের কানে যেতেই সে পিছনে ফিরে তাকায়। আর দেখতে পায় জানালা থেকে কিছুটা দূরে প্রিয়তা দাঁড়িয়ে। মারুফ ঢোক গিলে জাইনকে ডাকে।

‘জাইন ওটা নামা। জানালায় দেখ।’

মারুফের ডাক শুনে জাইন বিরক্ত নিয়ে তাকায়। মারুফ জানালায় ইশারা করতেই সেদিকে তাকায়। জানালার বাহিরে প্রিয়তাকে দেখে জাইনের বুকের ভেতর ধক করে ওঠে। প্রিয়তার চাহনি বলে দিচ্ছে সে সবটা দেখে ফেলেছে। জাইন করুন চোখে প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা তার দৃষ্টি উপেক্ষা করে হাঁটা দেয়। ছেলেটা না বুঝে প্রিয়তাকে আটকাতে নিলে মারুফ তাকে ধমকায়।
জাইন সব ফেলে দ্রুত সেখান থেকে বের হয়। ছুটে বাহিরে এসে প্রিয়তাকে দেখতে পায় না। ছেলেটা দেখিয়ে দেয় প্রিয়তা কোন দিকে গিয়েছে। জাইন দৌড়ে সেদিকে গেলে দেখে প্রিয়তা গলি পেরিয়ে মোড়ের রিকশায় উঠে বসেছে। সে রিকশার পিছনে ছুটে। তবে বেশিদূর যেতে পারে না। মোড় ঘুরিয়ে প্রধান সড়কে উঠতেই রিকশাটাকে হারিয়ে ফেলে সে। রাস্তার মাঝে বসে হাঁপাতে থাকে। পকেট হাতরে ফোন খুঁজে কিন্তু পায় না। সকালে ফোন রফিকের কাছে দিয়েছিলো এরপর আর নেওয়া হয়নি। কিভাবে প্রিয়তাকে বুঝবে সে এখন?

বাসায় ফিরে ব্যাগটা বিছানায় ফেলে টেবিলে বসে প্রিয়তা। তার মাথা ব্যথা করছে প্রচন্ড। আজকে পড়াতেও যায়নি। ভেবেছিলো দেখা করে ক্ষমা চেয়ে এরপর পড়িয়ে বাসায় ফিরবে কিন্তু ঘটনা যা ঘটলো এরপর সে সোজা বাসায় চলে এসেছে। এতোদিন জাইনকে গুন্ডা ভাবতো কিন্তু আজকে যা দেখলো তাতে তাকে তার ক্রি মি না ল ছাড়া অন্য কিছু মনে হচ্ছে না।

টেবিলে হাত রেখে তার উপর মাথা দিয়ে জানালার পর্দার দিকে তাকিয়ে রইলো কিছুক্ষণ। বাহিরে বৃষ্টি নেমেছে সেই সাথে দখিনা হাওয়া বইছে। জানালার পর্দা সরাতেই কয়েক ফোঁটা বৃষ্টির জল প্রিয়তার চোখমুখে এসে পড়ে। এতো বৃষ্টি দেখে তার ভিজতে ইচ্ছে করছে। ফোনটা বেজে উঠলে তাকিয়ে দেখে জাইনের নাম্বার থেকে কল এসেছে। রিং বাজতে থাকে কিন্তু সে কল রিসিভ ও করে না কিংবা কাটে ও না। নিচে বাইকের শব্দ পেয়ে তাকাতেই দেখে জাইন বাইক পার্ক করছে। বাইক থেকে নেমে প্রিয়তার কক্ষেের জানালার দিকে সে তাকায়। প্রিয়তা তার দিকেই তাকিয়ে আছে। জাইন আবারো তাকে কল দেয়। প্রিয়তা কল রিসিভ করে না। ধৈর্য্য না হারিয়ে জাইন বারবার কল দেয় কিন্তু প্রিয়তা কল রিসিভ করে না। হুট করে প্রিয়তা জানালার পর্দা টেনে দেয় সেই সাথে ফোনও বন্ধ করে দেয়। অসহায় প্রেমিকের মতো প্রিয়তার বাসার নিচে বৃষ্টির মধ্যে দাঁড়িয়ে থাকে জাইন। কি করলে প্রিয়তার রাগ ভাঙবে?

………
(চলবে..)