প্রণয়ী পর্ব-২৪+২৫

0
34

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|২৪.| (১৮+ এ্যালার্ট)
(লেখা কপি করা নিষেধ)
………

মেঘেরা ছুটে চলেছে গন্তব্যহীন। আঁধার রাত্রিতে আলোর ছিটেফোঁটাও নেই। চন্দ্র বোধহয় অভিমান করে লুকিয়ে আছে। তার দেখা সাক্ষাত নেই আজ। কি হলো চন্দ্রের? এতো সুন্দর নির্জন রাত্রিবেলা সে নেই কেনো! মৃদু হাওয়া বইছে যার দরুন গাছের ছোট্ট ছোট্ট লতাপাতা দুলছে। ফুলগুলো শব্দহীন ভাবে হাসছে। যেনো পাল্লা দিয়েছে কে কার থেকে বেশি হাসতে পারে।

জাইন গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে এসব দেখছে আর কল্পনা জুড়ছে। ফোন বের করে সময়টা দেখে নিলো। আধাঘন্টা পেরিয়ে গেলোও প্রিয়তার কোনো হদিস নেই। ইতিমধ্যে অধৈর্য্য হয়ে কয়েকখানা বার্তা সে পাঠিয়েছে। না এভাবে আর কতক্ষণ অপেক্ষা করবে? কতদিন বাদে প্রিয়তাকে দেখবে বলে খুলনা থেকে যশোর নেমেই ছুটে এসেছে। প্রথমে ভেবেছিলো আগামীকালকে সকালে প্রিয়তার বাসার নিচে এসে তাকে চমকে দিবে কিন্তু প্রিয়তার মেসেজ দেখে তার আর তর সয়নি। বাসায় না ঢুকে ক্লান্তি নিয়েই চোরের মতো ছাদে এসেছে। চোর ভেবে লোকজন তাকে ধরে এখন উত্তম মাধ্যম দিলেও ঠেকানোর শক্তি নেই। প্রচন্ড ক্লান্ত সে। একটা বিশাল ঘুম দরকার তার। কিন্তু ঘুমের চেয়েও প্রিয়তা তার কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
না এভাবে আর অপেক্ষা করতে পারছে না সে।
পকেট হাতরে তামাক বের করে ধরায়। সেই সাথে ফোন বের করে প্রিয়তাকে আরেকটা বার্তা পাঠায়।

‘তুমি কী আসবা নাকি আমি আসবো? আমি নিচে আসলে কিন্তু খারাপি হবে বলে দিচ্ছি। জলদি আসো।’

বার্তা পাঠানোর মিনিট দুয়েক পর উত্তর এলো।
‘আসছি।’

উত্তর পেয়ে ফোনটা পকেটে রেখে দেয় জাইন। প্রিয়তা আসার পূর্বেই হাতের তামাকটা শেষ করতে হবে নইলে সেদিনের মতো মিথ্যে বলতে হবে। সে প্রিয়তাকে কি করে বলবে তার থেকে দূরে থাকতেই সে তামাক টানছে। প্রিয়তাকে দেখলে তার যে বড্ড কষ্ট হয় নিজেকে সামলাতে। এ কথা তো সে মুখ ফুটে বলতে পারে না।

ঝনঝন নুপুরের শব্দে জাইন পিছনে ফিরে তাকায়।
লাল রাঙা শাড়ি গায়ে জড়িয়ে দাঁড়িয়ে প্রিয়তা। ঢেউখেলানো কেশগুলো উন্মুক্ত। ডান হাতের আঙুল দিয়ে যত্ন করে ছোট কেশ গুলো কানের লতির পিছনে গুঁজে দিলো সে। মাথা নিচু করে নিজের লজ্জামাখা মুখটা আড়ালের চেষ্টা করছে সে।
জাইন বাকরুদ্ধ হয়ে চেয়ে আছে। ইশ! এতো সুন্দর লাগছে কেনো? প্রিয় যে আজ তাকে নিজের সৌন্দর্য দিয়ে মে রেই ফেলবে। প্রিয়কে দেখে তার শ্বাস প্রশ্বাস আঁটকে আসছে। দূর্বল পায়ে এগিয়ে গেলো প্রিয়তার দিকে। চিবুক ধরে মুখটা উঁচু করতেই প্রিয়তা নেত্র যুগল বন্ধ করে ফেললো। কাঁপা কাঁপা শুষ্ক ওষ্ঠ জাইনকে টানছে।

জাইন ফিসফিস করে বলে,’দুষ্ট ঠোঁট গুলো তোমার শুষ্ক ঠোঁটে উষ্ণ পরশ দিতে চাইছে দিবো?’

‘আপনি আবারো সিগারেট টানছেন?’
প্রিয়তার ঝাঁঝালো কণ্ঠে জাইনের ধ্যান ভাঙে। এতোক্ষণ সে কল্পনাতে ডুবে ছিলো। ডুবে ছিলো প্রিয়তার কল্পনায়। বাস্তবতায় ফিরতেই দেখলো প্রিয়তা সামনে দাঁড়িয়ে আর সে বেঞ্চে বসা।
প্রিয়তা দেখলো জাইন তার দিকে অদ্ভুত দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। ভ্রু কুঁচকে আবারো ধমক দেয়।

‘সমস্যা কী আপনার? কথা কানে যায় না? সিগারেটটা ফেলুন হাত পুড়ে যাচ্ছে।’

জাইন তাকিয়ে দেখলো সত্যিই তামাকটা পুড়ে তার হাতের আঙুল জ্বলে গেছে। হাত উঁচিয়ে অবশিষ্ট অংশ ছুঁড়ে দেয় সে। আঁধারে তামাকের অংশবিশেষ হারিয়ে যায়।

‘আপনার সাহস তো কম না বারবার না করা সত্ত্বেও এভাবে ছাদে আসেন আর আমাকে আসতে বলেন।’

জাইন প্রিয়তার কথায় কান না দিয়ে তাকে দেখতে শুরু করে। না প্রিয়তা শাড়ি পরেনি, তার কেশও উন্মুক্ত না। বরাবরের মতোই সেলোয়ার-কামিজ পরা আর ওড়না দিয়ে মাথা ঢাকা।

‘কি বললাম শুনেছেন?’

জাইন অস্ফুট স্বরে বলে,’হু।’

এতক্ষণ প্রিয়তা কি বলেছে সে কিছুই খেয়াল করেনি। শুধু এইটুকু খেয়াল করেছে প্রিয়তা তার কথা রাখেনি।

‘কী শুনেছেন? কী বলেছি আমি?’

জাইন প্রিয়তার প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে পাল্টা প্রশ্ন করে,’শাড়ি পরনি কেনো? আমি তোমাকে কী বলেছিলাম?’

‘আমি কেনো আপনার কথা শুনবো? চুপচাপ আছি এর মানে এই না আপনাকে ভয় পাই কিংবা আপনার কথা অমান্য করার সাহস আমার নেই। না আমি আপনাকে ভয় পাই না পছন্দ করি।’

‘চেঁচাচ্ছো কেনো? আস্তে বললেও শুনতে পাবো।’

প্রিয়তা থেমে যায়। আসলেই তো এতো রাতে গলা উঁচিয়ে কথা বললে লোকে জেগে যাবে।
হালকা কেশে গলার স্বর নামিয়ে প্রিয়তা বলে,’আপনি এসব বাদ দিয়ে নিজের কাজে মন দিন আর আমাকে আমার মতো থাকতে দিন।’

‘সরি সেটা সম্ভব না।’

‘কেনো সম্ভব না?’

‘সেটার উত্তর পরে দিবো আগে তুমি বলো আমি কী এখন নিজ ইচ্ছায় এসেছি?’

‘অবশ্যই।’

‘তুমি ডাকনি?’

এবার প্রিয়তা চুপ হয়ে যায়।

জাইন পকেটে হাত গুঁজে বসা থেকে উঠে এসে প্রিয়তার সামনে দাঁড়ায়। জাইন দাঁড়াতেই প্রিয়তাকে তার সামনে বিড়াল ছানার মতো লাগে। প্রিয়তা দু কদম পিছিয়ে দূরত্ব বাড়ায়।

‘উত্তর দাও আমার প্রশ্নের।’

প্রিয়তা চুপ করে রয়। জাইন তার দিকে এগুতেই সে পিছিয়ে যায়।

‘তুমি যত দূরে যেতে চাবা তত এগিয়ে আসবো আমি।’

প্রিয়তা কিছু বলার চেষ্টা করে এর মধ্যেই দেয়ালে তার পিঠ ঠেকে যায়। সরতে নিলেই দুই পাশে দুই হাত রেখে তাকে বন্দী করে ফেলে জাইন। দু’জনের মধ্যে যথেষ্ট দূরত্ব তবুও প্রিয়তার অস্বস্তি হয়।

‘দূরে সরুন।’

‘কেনো?’

‘আপনার গায়ে সিগারেটের গন্ধ যা আমার সহ্য হয় না।’

‘চুমু খেলে সয়ে যাবে।’

‘ছিঃ! আবারো অসভ্য কথা বলছেন। আপনি না সরলে আমি চেঁচাবো।’

‘চেঁচাও। লোকে দেখুক,জানুক যে জাইন রহমান এক মেয়ের জন্য মাঝ রাতে চোরের মতো এসেছে। এরপর ধরে বিয়ে দিয়ে দিক। আমার আপত্তি নেই এতে কোনো। ইউ নো আজ রাতে বিয়ে হলে কালকে দিনেই মধুচন্দ্রিমা।’

শেষের কথাটা দুষ্টু হাসি দিয়ে বলে জাইন।

‘আপনার মুখে কিছু আঁটকায় না?’

‘আঁটকায় বরং সবসময় মুখ বন্ধই থাকে কিন্তু তোমাকে দেখলে আজকাল বেসামাল হয়ে যাই। সবই বয়সের দোষ।’

প্রিয়তা নিজের মেজাজ ঠান্ডা করার চেষ্টা করে। এর মধ্যে জাইন এক কাজ করে বসে। তার মাথা থেকে ওড়না সরিয়ে দেয়।

‘কী করছেন?’

‘চুপ। বেশি কথা বললে অন্য কিছু করে বসবো।’

প্রিয়তা চুপ হয়ে যায়। ইতিমধ্যে জাইন তার কেশের খোঁপাটাও খুলে ফেলেছে। প্রিয়তার ঢেউখেলানো কেশ গুলো স্বাধীনতা পেয়ে পিঠে ছড়িয়ে যায়।

জাইন ফিসফিস করে বলে,’তুমি না বলেছো এখন এলে যা বলবো তা করবা। কিন্তু তুমি তো কথা রাখনি। তাহলে এখন তোমায় কী শাস্তি দিবো বলো তো?’

প্রিয়তা ঢোক গিলে বলে,’আমার শাড়ি নেই। মায়ের শাড়ি সেদিন পরেছিলাম। এখন শাড়ি মায়ের রুমে তাই সম্ভব হয়নি বের করে পরার।’

প্রিয়তার কথা শুনে জাইন একটু ভাবে এরপর বুঝা গেলো না তার মতিগতি।

‘তাহলে এখন শাস্তিটা নাও শাড়িরটা পরে দেখা যাবে।’

‘শাস্তি!’

‘হ্যাঁ। কথা দিয়ে কথা না রাখার শাস্তি। এদিকে আসো।’

জাইন প্রিয়তার হাত টেনে বলে। প্রিয়তা হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করতেই সে বলে,’শুধু হাত ধরেছি। বেশি ছোটাছুটি করলে অন্য কিছু করতে বাধ্য হবো।’

প্রিয়তা স্থির হয় জাইনের হু ম কি তে।
প্রিয়তাকে টেনে বেঞ্চে বসায়। এরপর সে রেলিং এ হেলান দিয়ে দাঁড়ায়। প্রিয়তা এখনো বুঝতে পারছে না জাইন কী করতে চাইছে। একটু পর ফুল গাছগুলোর কাছে গিয়ে একটা ফুল ছিঁড়ে এনে প্রিয়তার কানে গুঁজে দেয়। এরপর আবারো সরে রেলিং এ হেলান দিয়ে প্রিয়তাকে দেখতে থাকে। যতক্ষণ তার ইচ্ছে করেছে প্রিয়তাকে মন ভরে দেখে নেয়। পুরোটা সময় কাটে নিরবতায়। প্রিয়তাও চুপচাপ বসে থেকেছে। চোখ তুলে কয়েকবার তাকালেও জাইনের ঐ দৃষ্টির দিকে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকতে পারেনি।
প্রিয়তা বিরবির করে বলে,’ঘায়েল করা দৃষ্টির দিকে তাকানো যাবে না।’

‘তাকিয়ে থাকলেই প্রেমে হাবুডুবু খাবা।’
জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা চমকে তাকায়। জাইন কী তার কথা শুনে ফেললো?

____________

দুপুরবেলা জাইনকে টেনে ঘুম থেকে উঠিয়েছে মিসেস পারুল। সে বারবার বলছিলো আরেকটু ঘুমাবে কিন্তু মিসেস পারুল শোনেনি।অগত্যা উঠে গোসল করে টেবিলে খেতে বসে। বাসায় এখন কেউ নেই। রমিজউদ্দিন সকালে কাজে বেড়িয়েছে। নিহারিকা আর নুহাশ স্কুলে গেছে। ছেলেকে সামনে বসিয়ে এক থালা খাবার দিয়েছে খেতে। ছেলেটাকে আজকাল সে কাছেই পায় না। তাই আজকে সকালে উঠেই অনেক রান্নাবান্না করেছে জাইনের জন্য। সেইজন্যই ঘুম থেকে জোর করে তুলে খাওয়াতে বসিয়েছে।
জাইন খাবার মুখে দিতেই মিসেস পারুল উৎসুক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। জাইন কোনো কথা না বলে খাবার চিবুতে থাকে আর ফোন দেখতে থাকে। মিসেস পারুল জাইনের হাত থেকে ফোন কেঁড়ে নেয়।
‘খাবারটা কেমন হয়েছে?’

‘ভালো।’

‘শুধু ভালো?’

‘আরে মা তোমার রান্না সবসময়ই বেস্ট। এবার ফোনটা দাও।’

‘ফোন এখন দিবো না খাওয়া শেষ করলে দিবো। আর তোর সাথে আমার কথা আছে।’

জাইন খাবারে মনোযোগ দেয়।

মিসেস পারুল বলে,’জারিফের জন্য একটা ভালো মেয়ে দেখেছি। মেয়েটা যেমন সুন্দরী তেমন লক্ষী আর ভদ্র।’

‘তাহলে দেরি না করে বিয়ে পড়িয়ে দাও।’

‘জারিফ না এলে মেয়ে দেখতে যাবো কীভাবে? আমি তো দেখে এসেছি। আর তোর বাবাও যাবে যখন সকলে যাবি। রইলো বাকি তুই আর জারিফ।’

‘আরেকজনের বউকে দেখে আমি কী করবো? আমি তো নিজেরটাকেই দেখে কূল পাই না।’

‘বাজে বকিস না। জারিফকে আনানোর ব্যবস্থা কর জলদি।’

‘ঠিক আছে চেষ্টা করবো। আর একটা কথা ছিলো।’

‘বল।’

‘ভাইয়ার বিয়েটা বলে আমারটার ব্যবস্থা করবা।’

জাইনের কথা শুনে মিসেস পারুলের চক্ষুদ্বয় বড়বড় হয়ে যায়।

‘এভাবে তাকিয়ে আছো কেন?’

‘তার মানে সত্যিই তোর গার্লফ্রেন্ড আছে? নুহাশ আর নিহারিকা এতোদিন যা বলছে সত্যি!আমি আরো ভাবলাম ওরা মিথ্যে বলছে।’

‘হু আছে এক তরফা গার্লফ্রেন্ড।’

‘এক তরফা মানে?’

‘লম্বা কাহিনী সে সব থাক। তুমি খালি ঘটাঘট ভাইয়ার বিয়ে দিয়ে আমার হবু শ্বশুড় বাড়ি যাবা গিয়ে বলবা,মেয়েকে আমার ছেলের পুত্র বধূ করতে চাই। আপসে দিলে দেন না হলে ছেলের মাথা গরম হলে তুলে নিয়ে যাবে।’

‘মেয়ে রাজি তো?’

‘মেয়ে তো রাজিই আম্মা খালি বাপ-ভাইকে ভয় পায়।’

‘তাহলে তুই চিন্তা করিস না। আমি গিয়ে ওর পরিবারের সাথে কথা বলবো।’

জাইন খুশি হয় মিসেস পারুলের বাহু জড়িয়ে ধরে।

‘আমি তো জানি আমার আম্মা জান এদিকটা সামলে নিবে। এখন আমি বের হলাম থাকো।’

‘কই যাস আবার?’

‘একটু ক্লাবে ঘুরানি দিয়ে তোমার পুত্র বধূকে দেখতে যাবো।’

মিসেস পারুল বাঁধা দেওয়ার পূর্বেই জাইন তাকে হাবিজাবি বুঝিয়ে বেরিয়ে যায়।

..

প্রিয়তার বাসার নিচে এসে একের পর এক কল দিয়েই চলেছে জাইন। প্রিয়তার নাম্বার বন্ধ। পায়চারী করছে আর প্রিয়তার কক্ষের বন্ধ জানালার পানে তাকাচ্ছে। ভরা সন্ধ্যার সময় এ অবস্থায় তাকে দেখলে যে কেউ ভাববে সিরিয়াস কিছু ঘটে গেছে। ধীরে ধীরে জাইনের মস্তিষ্ক সতর্কবার্তা দেয়।
‘প্রিয়তা তোকে ইগনোর করছে।’

চেপে থাকা রাগটা আ গু নে র মতো সারা অঙ্গে ছড়িয়ে যায়। প্রিয়তার দেখা না পেলে এ রাগ ফেটে বেরিয়ে আসবে। সব কিছু ভুলে প্রিয়তাদের বাসা বিল্ডিং এ প্রবেশ করে সে। বিদ্যুতের বেগে সিঁড়ি বেয়ে উঠে আসে। দরজায় কড়া নাড়তে নিলে দেখে তালা ঝুলানো। এবার তো জাইনের মাথা ঘুরে যাওয়ার মতো অবস্থা। কী করবে বুঝে উঠতে পারে না। একবার চিন্তা করে রুমাদের বাসায় কড়াঘাত করে রুমাকে জিজ্ঞেস করবে পরক্ষণেই নিজেকে সামলায়। নিচে নেমে একটা তামাক ধরিয়ে আবারো প্রিয়তার নাম্বারে কল লাগায়। এখনো ফোন বন্ধ। প্রিয়তার চিন্তায় একে একে অনেকগুলো তামাক খেয়ে শেষ করে ফেলে সে।
লাগাতার কল দিতে দিতে এক সময় কল ঢুকে। জাইনের জানে পানি আসে। এখনো রাস্তার মধ্যে পায়চারী করছে সে। লোকজন যাচ্ছে আর অদ্ভুত ভাবে তার দিকে তাকাচ্ছে।
প্রিয়তা কল রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে জাইনের রাগান্বিত গলা পায়।

‘কই আছো তুমি? সারাদিন ধরে ফোন বন্ধ কেনো?’

‘আমি তো..’

‘কী আমি তো? এতো দায়িত্বজ্ঞানহীন কেন তুমি? আমাকে মা র তে চাও? এতো যন্ত্রণা না দিয়ে একেবারেই মে রে ফেলো। রি ভ ল ভার দিচ্ছি একটা গু লি করে সব খতম করো।’

‘আপনি আমার কথাটা শুনুন।’

‘কেনো তোমার কথা শুনবো? তুমি আমার উপর এতো বিরক্ত যে বাসাই বদলে ফেললে?’

‘আরে বাসা বদলাইনি।’

‘তাহলে তালা ঝুলছে কেনো?’

‘আমি মায়ের সাথে সকালে নানু বাড়ি এসেছি।’

প্রিয়তার কথা শুনে জাইন ঠান্ডা হয় না তবে একটু থামে।

‘হ্যালো,শুনতে পাচ্ছেন?’

জাইন গম্ভীর গলায় জবাব দেয়,’ফোন বন্ধ ছিলো কেনো?’

‘রাতে চার্জ দিতে ভুলে গেছি তাই ফোন বন্ধ হয়ে গেছিলো। আর এখানে বিদ্যুৎ ছিলো না সারাদিন। মাত্র এলো আর চার্জে লাগালাম।’

জাইন আর কোনো কথা না বলে চুপ থাকে। প্রিয়তা বুঝতে পারে জাইনে ভীষণ রেগে গেছে। অন্য সময় এসব পাত্তা না দিলেও আজ জাইনের জন্য তার মায়া হচ্ছে। নিশ্চয়ই লোকটা তাকে কলে না পেয়ে চিন্তায় ছিলো।

প্রিয়তা গলার স্বর নিচু করে জিজ্ঞেস করে,’রেগে আছেন?’

‘হুম।’

‘কী করবো তাহলে?’

গম্ভীর গলায় জাইন বলে ‘বুকে এসে ঠান্ডা করো আমাকে।’

প্রিয়তা হাসে। অবশেষে একটু হলেও জাইনকে থামাতে পেরেছে এটাই স্বস্তি। হাসির শব্দে জাইন গলে না বরং গম্ভীর থাকে।

‘আচ্ছা ফিরে নেই তারপর।’

‘কবে ফিরবে?’

‘সম্ভবত দু’দিন কিংবা তিনদিন পর।’

‘বুকের জ্বালা তো বেড়ে যাবে আরো।’

‘বরফ ঘষেন কমে যাবে।’

হঠাৎ জাইন ঠান্ডা গলায় ডাকে,’প্রিয়!’

প্রিয়তা ঢোক গিলে। এই ডাকটাই সে ভয় পায়। প্রিয় ডাকটা তাকে আকর্ষণ করে জাইনের দিকে।

জাইন আবারো শুধায়,’প্রিয়!’

প্রিয়তা জড়তা ভেঙে বলে,’বলেন।’

‘ক্যান আই টাচ ইউ ইন মাই ড্রিমস?’

প্রিয়তা কেশে বলে,’নো।’

‘তাহলে কল্পনায় এসে বিরক্ত করো কেনো?’

‘কখন বিরক্ত করলাম?’

‘রোজ করো। গতকালকে আমার শ্বাস আঁটকে দিয়েছিলে। কল্পনাতে লাল শাড়ি পরে সামনে এসেছিলে। তোমায় ছুঁইলাম যেই উষ্ণ পরশ দিতো যাবো দেখি তুমি নাই।’

প্রিয়তা নিজেকে সামলে বলে,’কল রাখছি মা ডাকছে।’

‘পালাচ্ছো কেনো?’

‘পালাচ্ছি না সত্যি ডাকছে।’

‘আমার কল্পনাতে এসে বিরক্ত করা বন্ধ করো।’

প্রিয়তারও বলতে ইচ্ছে করে,’আপনিও তো আমার কল্পনায় এসে আমায় বিরক্ত করেন। কই আমি তো অভিযোগ জানাইনি।’
এ কথা বলার সাহস প্রিয়তার হয় না।

‘কী বলেছি বুঝেছো?’

না শুনেই প্রিয়তা বলে,’হ্যাঁ।’

‘এবার বিরক্ত করলে তোমার নিস্তার নেই।’

‘আচ্ছা তাহলে রাখছি।’

‘না রাখবা না।’

‘কী বলবো তাহলে?’

‘যা খুশি তাই। আর কিছু বলার না থাকলে কানে ফোন চেপে চুপ থাকো।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা বুঝতে পারে সে এখন রেগে আছে। তাকে আর না ক্ষ্যাপিয়ে লক্ষী মেয়ের মতো তার কথা শোনে সে।

মিনিট পাঁচেক ফোন কানে চেপেই সে দাঁড়িয়ে থাকে। দু’জনেই নিশ্চুপ।
হুট করে জাইন গাইতে শুরু করে,
‘তুমি বুকে টেনে নাওনা প্রিয় আমাকে,
আমি ভালোবাসি,ভালোবাসি,ভালোবাসি তোমাকে..’

দেয়ালে পিঠ ঠেকিয়ে প্রিয়তা দাঁড়ায়। ইশ! কী সুন্দর গায় লোকটা। মাতাল করা কন্ঠ। একদম ডুবে যেতে ইচ্ছে করে।

…………
(চলবে..)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|২৫.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
……….

হুট করেই সকাল বেলা প্রিয়তার মামা তার মাকে কল দিয়ে জানায় তার বাবা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। মিসেস মাসুমা বাবার অসুস্থতার খবর পেয়ে দেরি করেননি। মেয়েকে নিয়ে ছুটে এসেছেন। তার বাবার শারীরিক অবস্থার উন্নতি নেই এখনো। মামা বাড়িতে এসে প্রিয়তার অস্থিরতা আরো বেড়ে গেছে। গতরাতে জাইন তাকে ঘুমাতে দেয়নি। অজানা কারণে কলটাও কাটতে পারেনি সে। কলে থাকা অবস্থায় কখনো জাইন গান শুনিয়েছে,কখনো ছোট বেলার মজার ঘটনা শুনিয়েছে,কখনো আবার বলেছে তাকে কতটা চায় সে। কথা ফুরিয়ে গেলে দু’জনই নিশ্চুপ থেকেছে। যদিও প্রিয়তা এক কথা বললে জাইন তার বিপরীতে বলেছে দশটা।
ঘুম ঘুম চোখে বাড়ির আঙিনায় বসে আছে প্রিয়তা। তার নানাকে নিয়ে তার মা আর মামা গেছেন সদরে ডাক্তার দেখাতে। বাড়িতে শুধু সে আর তার নানী। সকাল সকাল রোদ্দুর থাকলেও এখন মেঘে ঢেকে গেছে। ধীরে ধীরে গগণের রঙ বদল হতে শুরু করে। ছেয়ে যায় কালো মেঘে। দেখে মনে হচ্ছে গগণের মন খারাপ। একটু পরই সে কেঁদে ভাসাবে।

‘প্রিতুউ ঘরে আয় মেঘ করছে আকাশে।’
প্রিয়তার নানী ঘর হতে তাকে গলা উঁচিয়ে ডাকে। প্রিয়তার নানার বাড়ির কেউই তাকে তার নাম ধরে ডাকে না। প্রিয়তার নানা ডাকে পুতুল,প্রিয়তার মামা ডাকে প্রিতুলা,প্রিয়তার নানী ডাকে একটু টেনে প্রিতুউ। আগের দিনের মানুষজন সঠিক নামে ডাকে না উল্টো তারা যেই নামে ডাকে সেটাকেই সঠিক বলে অখ্যা দেয়। প্রিয়তা মাঝে মাঝে মুখ কালো করে উল্টোপাল্টা নামে ডাকার কারণে। তবে নানার পুতুল ডাকটা তার ভীষণ পছন্দ।

বসা থেকে উঠে দড়িতে মেলে রাখা কাপড় গুলো নামিয়ে নেয় প্রিয়তা। এরপর ঘরের ভেতর ঢুকে যায়। গগণে বিদ্যুৎ চমকে বাজ পড়ার শব্দ হয় সেই সাথে ঘরের বিদ্যুৎ ও চলে যায়। মিনিট পাঁচেকের মধ্যে শুরু হয় বৃষ্টি। যেমন তেমন বৃষ্টি না জোরদার করে নামছে। যেনো বৃষ্টি তার গুষ্টি সহ চলে এসেছে। বৃষ্টির সাথে মৃদু হাওয়াও উপস্থিত।

‘ঘরের জানলা গুলা বন্ধ কইরা হারিকেন ধরা তো।’
প্রিয়তার নানী পানের বাটা নিয়ে বসে আর তাকে আদেশ দেয়। প্রিয়তা তার নানীর কথা মতো গরের সদর দরজা বন্ধ করে দেয় আর নানীর ঘরের উত্তর দিকের জানালা বন্ধ করে।

‘পিছনের গুলা লাইয়া আয় সামনেরটা খোলা থাকুক।’

ভেতরে গিয়ে একে একে জানালা গুলো বন্ধ করে দেয়। পিছনের দিকের জানালা বন্ধ করতে নিলে বাহিরে দৃষ্টি যায়। চমকে উঠে সে। বৃষ্টি মধ্যে দাঁড়িয়ে ভিজছে এক মানব। সে এক ধ্যানে প্রিয়তার পানে তাকিয়ে আছে। ঘটনা কল্পনা নাকি সত্যি সেটা বুঝার জন্য প্রিয়তা নিজেকে চিমটি কাটে। এরপর ব্যথা লাগতেই বুঝে না এটা কল্পনা না। কিন্তু এই ব্যক্তি এখানে আসা অসম্ভব। প্রিয়তা চক্ষু বন্ধ করে মাথা ঝাকায়। তার মনে হয় রাতে ঘুম না হওয়াতে আবোলতাবোল দেখছে সে। চক্ষু খুলে আবারো সামনে তাকাতেই দেখে লোকটা ভিজছে। সামনাসামনি কখনো এভাবে তাকিয়ে থাকেনি প্রিয়তা। আজ ইচ্ছে হলো কল্পনায় আসা লোকটাকে ভালো করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে। লোকটাকে দেখতে থকে আর নিজেই নিজেকে নানান প্রশ্ন করতে থাকে। বৃষ্টির জলে ভিজে একাকার অবস্থা। গায়ের কালো রঙের পাঞ্জাবীটা একদম মিশে গেছে। হাতের পেশি গুলো স্পষ্ট বুঝা যাচ্ছে। কাটিং করা চুল গুলো হতে চুইয়ে চুইয়ে পানি পড়ছে। হুট করে প্রিয়তার কাছে লোকটাকে বেশ সুদর্শন লাগে।

‘কীরে প্রিতুউ কই গেলি?’

‘আসছি নানী।’

প্রিয়তা দ্রুত জানালা লাগিয়ে দেয়। এরপর হারিকেন ধরিয়ে নানীর কাছে আসে। প্রিয়তার নানী সখিনা বেগম পান চিবুচ্ছেন।

‘এই বৃষ্টি বাদলের দিনে গেলো তো ডাক্তার দেখাইতে মনে হয় না ফিরতে পারবো। একটা কল দিয়া দেখ তো কই আছে।’

‘তোমাদের বাসায় এমনিতেই নেটওয়ার্ক থাকে না আর বৃষ্টির সময় তো ফোন একদম বন্ধ হয়ে যায়।’

‘শক্তপোক্ত মানুষটা বিছনায় পইড়া গেলো কবে জানি টুক কইরা আমারে রাইখা চইলা যায়।’

‘কী যে বলো না নানী। নানা তোমাকে রেখে কোথাও যাবে না।’

এমন সময় বাহিরে বজ্রপাত হয়। খানিকটা কেঁপে উঠে প্রিয়তা। সখিনা বেগম প্রিয়তার পিঠ ডলে তাকে শান্ত করে।

‘ভয় পাইছিস?’

‘না।’
চোখ তুলে প্রিয়তা বাহিরে তাকায়। এরপর উঠে পিছনের দিকে ছুটে যায়।

‘কীরে কই যাস?’

উত্তর দেয় না প্রিয়তা। জানালা খুলে বাহিরে তাকাতেই কাউকে দেখতে পায় না। সংশয় নিয়ে অন্য জানালা গুলোও খুলে দেখে। না কোত্থাও কেউ নেই! লম্বা শ্বাস নিয়ে ফোন হাতে নেয় প্রিয়তা। সিমে একদমই নেটওয়ার্ক নেই। ক্রস চিহ্ন দেখাচ্ছে।
সামনের ঘর থেকে নানীর গলা পেয়ে সেদিকে ছুটে।

‘কী হয়েছে নানী?’

‘দেখ না কে জানি এই ঠাডা পড়া বৃষ্টির মধ্যে ভিজতাছে।’

সখিনা বেগমের কথা শুনে প্রিয়তা বাহিরে দৃষ্টি রাখে। চমকে উঠে। হ্যা যেটা কল্পনা ভেবেছিলো সেটা সত্যি। জাইনের চোখমুখ দেখে আঁতকে উঠে। অনেকক্ষণ ধরে ভেজার ফলে মুখটা ফ্যাকাসে হয়ে গেছে আর চোখের ভেতরের সাদা অংশ লালচে বর্ণের।

‘পোলাডা কে রে? চিনতাছি না। এতো ভিজলে তো জ্বর আইবো।’

প্রিয়তা দ্রুত দরজা খুলে। জাইন এখনো ঠায় দাঁড়িয়ে আছে।
গলা উঁচিয়ে প্রিয়তা বলে,’আপনি এখানে কী করছেন? চলে যান এখান থেকে।’

‘ঐ মাইয়া পোলাডারে এই বৃষ্টি বাদলের দিনে যাইতে কস কই যাইবো? বেচারা নিশ্চয়ই বিপদে পড়ছে। ভেতরে ডাক।’

‘কিন্তু নানী..’

‘কীসের কিন্তু?’

প্রিয়তা সখিনা বেগমের কথায় দমে যায়। জাইনের দিকে তাকিয়ে বলে,’ভেতরে আসুন।’

জাইন তবুও নড়ে না।
‘কী হলো আসছেন না কেনো?’

জাইন জবাব দেয়,’মন থেকে বলছো নাকি ফর্মালিটি?’

‘যেটাই বলি না কেনো আসতে বলেছি আসবেন এতো কীসের কথা।’

সখিনা বেগম বলে,’ঐ পোলা ভেতরে আসো।’

প্রিয়তা নানীর দিকে এক পলক তাকিয়ে সামনে দৃষ্টি রাখতেই দেখতে পায় জাইন উপস্থিত।

মৃদু গলায় জাইন জিজ্ঞেস করে,’আসবো?’

গলার স্বর নামিয়ে প্রিয়তা জবাব দেয়,’আসুন।’

জাইন ভেতরে প্রবেশ করতেই দরজা বন্ধ করে দেয় প্রিয়তা। চেয়ারের উপর থেকে গামছা এনে দেয় মাথা মোছার জন্য।

সখিনা বেগম আচল টেনে মাথায় তুলে দেয়।
‘তোমারে তো চিনলাম না।’

‘আপনার নাতনী আমাকে ভালো করেই চিনে। ওকে জিজ্ঞেস করুন।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা থতমত খায়। সখিনা বেগম প্রিয়তার দিকে তাকায়।
‘না নানী এনাকে আমি চিনি না। মিথ্যে বলছে।’

ঘাড় বাঁকিয়ে জাইন জিজ্ঞেস করে,’সত্যিই চিনো না? তাহলে চলে যাচ্ছি।’

এগিয়ে এসে প্রিয়তা আঁটকায়।
‘এই বৃষ্টি বজ্রপাতের মধ্যে কোথায় যাবেন? বৃষ্টি থামুক তারপর যান।’

‘আমার জন্য তোমার চিন্তা হলে প্রথমেই ভেতরে আসতে বলতে।’

‘আপনি না জানিয়ে এসেছেন কেনো?’

‘ভয় হচ্ছিলো তাই।’

‘কীসের ভয়?’

‘তোমাকে হারানোর।’

সখিনা বেগম বলে ওঠে,’কীসের এতো পিনুর পিনুর করতেছিস প্রিতুউ? পোলাডার গা গতর ভিজা জলদি লুঙ্গি দে বদলাক। জ্বর আসলে অসুস্থ হইয়া যাইবো।’

‘কার লুঙ্গি দিবো?’

‘তোর নানার নতুন লুঙ্গি আছে খুঁজে দে।’

এক পলক জাইনের পানে তাকিয়ে ভেতরে যায় প্রিয়তা। অ্যালোমিনিয়ামের পুরাতন আলমারি ঘেঁটে একটা লুঙ্গি বের করে। সেই সাথে নানার একটা নতুন গেঞ্জিও খুঁজে পেয়। সেগুলো হাতে নিয়ে আলমারি লক করে ঘুরতেই দেখে জাইন দাঁড়িয়ে। আরেকদফা চমকায় সে।

‘আপনি এমন ভূতের মতো যেখানে সেখানে উদয় হন কেনো?’
‘তোমাকে চমকে দিতে ভালো লাগে তাই।’

‘ঢং রাখুন। ভেজা কাপড় বদলে এগুলো আপাততঃ পড়ে নিন।’
জাইনের হাতে কাপড় গুলো দিয়ে যেতে নিলে জাইন তার ডান হাত চেপে ধরে।

‘কী সমস্যা? অসভ্যতা কেনো করছেন?’

উত্তর না দিয়ে প্রিয়তার উষ্ণ হাত নিজের শীতল গালে চেপে ধরে জাইন। প্রিয়তার কাছে মনে হয় সে বরফে হাত ছুঁইয়েছে এতো বেশি ঠান্ডা। চোখে মুখে এখনো বৃষ্টির জলের ফোঁটা বিদ্যমান। প্রিয়তা জানতো গোসলের পর মেয়েদেরকে সবচেয়ে বেশি সিন্ধ লাগে কিন্তু আজকে সেটা মিথ্যে প্রমাণ করে দিলো জাইন।

‘কীরে কই গেলি?’
সখিনা বেগমের আওয়াজ পেয়ে প্রিয়তার হাত ছেড়ে দেয়। দ্রুত কদম ফেলে বেরিয়ে যায় প্রিয়তা।

‘বলো নানী।’

‘পোলাডা কে রে?’

‘আমি কী জানি?’

‘মিথ্যা কইস না। তুই চিনস। তোর বয়ফ্রেন্ড লাগে?’

সখিনা বেগমের কথা শুনে প্রিয়তা আহাম্মক বনে যায়।

‘আরে না নানী কী সব আবোলতাবোল বলছো!’

‘হ এবার বুঝলাম আমার সন্দেহ সঠিক। চুল তো আর বাতাসে পাকাই নাই।’

‘তোমার চুল বাতাসেই পাকছে।’

‘ঝগড়া করছিস নাকি? এই বৃষ্টির মধ্যে চইলা আইলো যে?’

‘না নানী অমন কিছু না। ওনার মাথায় একটু সমস্যা আছে।’

‘হ হ এইগুলা বুঝি। বয়স তো পাড় কইরা আইছি জানি সবই।’

‘কচু জানো তুমি।’

সখিনা বেগম হাতের ইশারায় প্রিয়তাকে ডাকে। প্রিয়তা কাছে যেই কানে কানে বলে,’পোলাডা সুন্দর আর উঁচা লম্বা আছে। এইটারেই তোর নাগর বানা।’

প্রিয়তা চোখমুখ খিচে বলে,’ছিঃ! নানী কী সব যাতা বলছো। বললাম তো অমন কিছু না।’

‘আমার তো অনেক পছন্দ হইছে।’

‘তোমার পছন্দ হলে তুমি শাদী করো,যত্তসব।’

‘এই ছেমরি আমার বয়স থাকলে ঠিকই করতাম।’

‘এখন করো কেউ না করে নায়।’

কথাটা বলে প্রিয়তা যেতে নিলে সখিনা বেগম পিছু ডাকে।
‘শোন।’

‘আবার কী?’

‘টেবিলে খাবার বাড়তেছি। পোলাডার হইলে নিয়া আয়। বারবার পোলাডা বলতেও কেমন লাগে। ওর নাম কি?’

‘জাইন।’

‘খালি জাইন? আগে পিছে কিছু নাই?’

‘জাইন রহমান।’
জাইনের গলা পেয়ে প্রিয়তা পিছনে তাকায়। তার পিছনে দাঁড়িয়ে গামছা দিয়ে মাথা মুছছে জাইন। লুঙ্গিতে তাকে বেশ অদ্ভুত লাগছে। গায়ে নানার সাদা রঙের হাতা ওয়ালার স্যান্ডো গেঞ্জি। এ অবস্থায় জাইনকে খারাপ লাগছে দেখতে নাকি ভালো লাগছে প্রিয়তা বুঝে উঠতে পারে না।

‘তোমার মতো তোমার নামও ঢকের। আমি ভাত বাড়তেছি আসো।’
সখিনা বেগম চকি থেকে নেমে ভেতরে যায়। প্রিয়তা পিছনে ঘুরেই জাইনের দিকে রাগান্বিত দৃষ্টিতে তাকায়।

‘আপনার কী মাথার ভেতর কিছু নেই? এভাবে মানুষ না বলে আসে?’

‘আছে তো।’

‘কী আছে?’

‘তুমি আছো।’

প্রিয়তা থতমত খায় প্রশ্নের উত্তর শুনে।

‘আপনার মাথায় বুদ্ধি থাকলে এভাবে হুট করে চলে আসতেন না। বাড়িতে লোকজন থাকলে কী হতো বুঝতে পারছেন?’

‘নেই তো কিন্তু থাকলে মন্দ হতো না। নানা বাড়ির সকলের সাথে দেখা হয়ে যেতো।’

‘এই আপনার মাথার তার কী কয়েকটা কাটা নাকি? এমন পা গ লের মতো এসব করেন কেনো? কী প্রমাণ করতে চান এসব করে?’

‘ভালোবাসি সেটা।’

‘আপনার কী মনে হয় এসব করলে আমি গলে যাবো?’

‘গলে তো গেছো কবেই। এখন শুধু স্বীকার করা বাকি।’

‘আপনার সাথে তর্ক করাটাই বেকার। খেয়েদেয়ে বৃষ্টি কমলে চুপচাপ চলে যাবেন।’

‘তোমায় নিয়ে যাবো।’

‘কোন অধিকারে?’

এবার জাইন থামে। সত্যিই তো তার তো প্রিয়র উপর কোনো রকম অধিকার নেই। মাথার ভেতরটা ধপ করে জ্বলে ওঠে।

‘প্রণয়ীর অধিকারে।’

‘মানে?’

‘আমি তোমার প্রণয়ী। প্রণয়ী মানে কি জানো? প্রেমিক,আমি তোমার পাগলাটে প্রেমিক। প্রেমিকের একটা অধিকার তো আছে।’

‘আর আপনাকে আমার প্রেমিকের স্বীকৃতি কে দিলো?’

‘তুমি।’

‘আমিই! কখন?’

‘প্রথমবার যেদিন আমার কথা রাখতে ছাদে এসেছিলে সেদিন।’

‘পা গ লা মি বন্ধ করুন। আমি ফেরার পর আপনার সাথে এ বিষয়ে বিস্তারিত কথা বলবো। এর আগে আপনি চুপচাপ থাকবেন।’

‘থাকবো না। তোমার কথা আমি কেনো শুনবো?’

‘ঠিক আছে শুনতে হবে না। যা খুশি করুন।’

‘যা খুশি? পরের রাগ করবা না তো?’

প্রিয়তা জাইনের কথা শুনে তার দিকে তাকায়। না না এসব বললে জাইন আবার সত্যিই যা খুশি করে বসবে।
প্রিয়তা কিছু বলবে এরিমধ্যে সখিনা বেগম ডাক দেয়। প্রিয়তা সেদিকে হাঁটা দেয়। জাইনও তার পিছু পিছু যায়।

খাবারের টেবিলে জাইন বসতেই সখিনা বেগম তার পাতে ভাত তরকারি বেড়ে দেয়।
‘শুনো পোলা ঝগড়াঝাটি যা হইছে আমি মিটমাট করাই দিমু। তুমি নিশ্চিন্তে খাও। ও তো ওর ভাই আর মায়ের মতো ত্যাড়া। তুমি চিন্তা কইরো না ত্যাড়া হইলেও ও আমার কথা অমান্য করে না।’

‘নানী এবার কিন্তু বেশি বেশি হচ্ছে।’

‘তুই চুপচাপ খেতে বস।’

সখিনা বেগমের কথা শুনে চেয়ার টেনে হারিকেনের আলোতে খেতে বসে প্রিয়তা। জাইন বেশ খুশি হয় সখিনা বেগমের আপ্যায়নে। প্রিয়তার নানী সখিনা বেগম সরল সোজা নারী। সারাজীবন স্বামী সন্তানদের জন্য নিজেকে বিলিয়ে দিয়েছেন। তাকে কেউ কখনো রাগ করতে দেখেনি। সবসময় হাসি মুখে থাকেন তিনি। প্রিয়তার নানা আবার উল্টো। ওনার মেজাজ সবসময় খিটখিটে থাকে। প্রিয়তার মা পেয়েছেন তারই স্বভাব আর প্রিয়তার মামা আবার সখিনা বেগমের মতো শান্ত মেজাজের।

খাওয়া শেষ হতেই বসার ঘরের চকিতে এসে বসে সখিনা বেগম। জাইন চেয়ারে বসে আছে। প্রিয়তা এখনো ভেতরে কাজ করছে। জাইন বারবার ভেতরের দিকে তাকাচ্ছে।

সখিনা বেগম প্রশ্ন করে,’তা তোমরা কয় ভাই-বোন?’

‘চার।’

‘বইন আছে?’

‘হ্যাঁ একজন।’

‘তোমার বাবা কী করে?’

‘বাবার ব্যবসা আছে।’

‘তুমি বাবার ব্যবসা দেখো?’

‘না আমি অন্য কাজ করি।’

‘অন্য বলতে?’

‘রাজনীতির সাথে আছি।’

‘ওহ ভালো।’

সখিনা বেগম থামে এরপর আবার প্রশ্ন করে।
‘প্রিতুউ তোমার কী লাগে?’

‘প্রেমিকা।’

জাইনের কথা শুনে সখিনা বেগম হাসে।
‘এখানে আসলা যে? তোমরা এক এলাকায় থাকো না?’

‘ওকে দেখতে আসছি। কানে খবর এসেছে ওকে নাকি বিয়ে দিতে ওর মা নিয়ে এসেছে তাই আসলাম।’

জাইনের কথা শুনে সখিনা বেগম খিলখিল করে হাসে।
‘বিয়া হইয়া গেলে কী করতা?’

জাইন মুচকি হেসে বলে,’বরকে মে রে ওকে নিয়ে যেতাম।’

‘সব কিছুর উপর জোর খাটানো গেলেও প্রিতুউর উপর জোর খাটানো যায় না। ও যদি না চায় তুমি ওরে নিতেই পারবা না।’

‘জানি তবুও ওকেই আমার লাগবে। আপসে হোক কিংবা জোর করে।’

‘প্রিতুউর বাসায় জানে এইগুলা?’

‘উহু বলিনি এখনো? ভাইয়ার বিয়ের পর মা যাবে ওর পরিবারের সাথে কথা বলতে।’

‘শুনো একটা কথা বলি। তোমারে আমার পছন্দ হইছে নাত জামাই হিসেবে। ক্ষমতা থাকলে ওরে তোমার হাতেই তুলে দিতাম। মন থেকে দোয়া করি তোমরা সুখে থাকো আর প্রিতুউরে সুখে রাখো। মেয়েটা আজীবন পরিবারের কথাই চিন্তা করে পাড় করলো। ওর জীবনে একটু সুখ দরকার।’

‘আমি আছি সবসময় ওর জন্য, সারাজীবন।’

দরজার আড়াল থেকে দু’জনের কথোপকথন সবটা শুনে প্রিয়তা।

………..
(চলবে..)