প্রণয়ী পর্ব-২৬+২৭

0
15

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|২৬.| (১৮+ এল্যার্ট)
(লেখা কপি করা নিষেধ)
……….

সুন্দর সময় খুব দ্রুত কাটে। চোখের পলক ফেলতেই দিন চলে যায়। মাঝে মাঝে সুন্দর সময় গুলো কাচ বন্দী করা গেলে ভালো হতো। ইচ্ছে হলেই সেগুলো দেখে নিজেকে স্বান্তনা দেওয়া যেতো। কথায় আছে দুঃখের পরই সুখ আসে। কিন্তু কিছু মানুষের জন্য এ কথা ব্যতিক্রম। প্রিয়তা আর তার মা গত রাতে নানা বাড়ি থেকে ফিরেছে। সকাল বেলা ব্যাগ খুলে নানীর দেওয়া শাড়িটা বের করলো প্রিয়তা। নানী তাকে নিজের বিয়ের বেনারসিটা উপহার দিয়েছে। এতো বছর ধরে বেনারসিটা আগলে রেখেছিলো কাউকে ছুঁতে পর্যন্ত দেয়নি। নিজের মেয়েদেরও দেননি। তিনি সবসময় চেয়েছেন এমন কাউকে দিবেন যে বেনারসিটা আগলে রাখবে। প্রিয়তাও কখনো ভাবেনি সে এই বেনারসির মালিক হবে।

যখন প্রিয়তা ব্যাগ গোছাচ্ছিলো তখন সখিনা বেগম কক্ষে প্রবেশ করে।
‘চইলা যাবি?’

‘আবার আসবো।’

‘প্রতিবারের মতো থাকতে কইতাম কিন্তু পোলাডা তো অস্থির হইয়া যাইবো। শেষে দেখা যাইবো আবার ছুইট্টা আইছে।’
কথাগুলো বলে সখিনা বেগম খিলখিল করে হাসে। প্রিয়তা লজ্জায় নুইয়ে যায়।

মেকি রাগ দেখিয়ে প্রিয়তা বলে,’নানী কী সব যা তা বলছো!সরো তো।’

‘প্রেমিক কিন্তু ভালোই ভাও করছস। আমার তো অনেক পছন্দ হইছে।’

‘আস্তে নানী মা শুনে ফেলবে।’

‘তোর মারে তো আমি ডরাই! ওয় কেন ওর বাপে শুনলেও আমার কিছু যায় আসে না।’

‘তুমি ভয় পাও না আমি নাই।’

‘ভয় ডর রাখ তোর সাথে আমার কথা আছে।’

‘আচ্ছা কী বলতে আসছো বলো।’
কাপড় রেখে সোজা হয়ে বসে প্রিয়তা। সখিনা বেগম প্রিয়তার সামনে বসে। পিছন থেকে সেই লাল টুকটুকে বেনারসিটা বের করে। প্রিয়তা হা করে তাকিয়ে থাকে। এতকাল মায়ের কাছে এই বেনারসির গল্প শুনেই এসেছে কিন্তু কখনো দেখার সৌভাগ্য হয়নি। নানী তার ট্রাঙ্কে তালা মেরে রেখে দিয়েছিলো এটা এতোকাল।

সখিনা বেগম বেনারসিটার উপর হাত ছুঁইয়ে বলে,’এটা বিয়ের সময় আমার মা দিছিলো। ওনার দেওয়া শেষ স্মৃতি এটা। এই বেনারসি পইড়া বিয়ে করে নতুন জীবনে পা দিছিলাম। এরপর আর পড়ি নাই। কত বছর কাটাইলাম,কত শাড়ি পিনলাম তবুও এই বেনারসির মায়া ছাড়তে পারি না। আমার মেয়েরা এইটা নেওয়ার জন্য কত কথা শুনাইছে তবুও কারো হাতে দেই নাই। এতো বছরের মায়া ত্যাগ কইরা আজকে এইটারে তোর হাতে তুলে দিলাম। নে আজকে থেকে এটা তোর আমানত।’

সখিনা বেগম প্রিয়তার হাতে শাড়িটা তুলে দেয়। প্রিয়তা বিস্ময় নিয়ে তাকিয়ে আছে। সখিনা বেগম তার মাথায় আদুরে স্পর্শ দিয়ে চুমু দেন।

‘দোয়া করি সুখি হ সবসময়। বিয়ের দিন তুই এই বেনারসিটাই পরবি। আমি চাই আমার মতো তুইও নিজের নতুন জীবন এটা পড়ে শুরু কর। এরপর এইটা যত্ন কইরা রাখবি। আমি না দেখলে পইরা আমার স্মৃতি বিচরণ করবি।’

প্রিয়তা তার নানীকে জড়িয়ে ধরে। বরাবরই নানীর সাথে তার সুসম্পর্ক। নানীকে সে ভীষণ ভালোবাসে।

‘শোন পাত্র হিসেবে যেনো তোর প্রেমিককেই দেখি নইলে তোর সাথে আমার আর কথাবার্তা নাই।’

‘তুমি ঐ লোকের মধ্যে কী এমন দেখলে?’

‘তোরে চিরকাল আগলাই রাখার জন্য ঐ পোলাই যথেষ্ট। তুই ভালো থাকবি।’

বেনারসিটা হাতে নিয়ে এতক্ষণ নানীর কথা ভাবছিলো প্রিয়তা। গত পরশু সন্ধ্যা পর্যন্ত মুশলধারে বৃষ্টি হয়। বৃষ্টি একটু কমতেই জাইন বের হওয়ার জন্য উতলা হয় কারণ প্রিয়তার মা আর মামা চলে এলে ঝামেলা হবে। আধ শুকনো পোশাকটা পরে নেয় যেগুলো প্রিয়তা ধুয়ে দিয়েছিলো। রাত আটটার দিকে সখিনা বেগমের থেকে বিদায় নিয়ে রওনা দেয়। যাওয়ার পূর্বে প্রিয়তাকে বলে যায় সে যেনো কালকেই বাড়ি ফেরে নইলে সে আবারো আসবে। যদিও প্রিয়তা জাইনকে চোখ রাঙিয়ে ধমকে না জানায় তবুও জাইন যাওয়ার পর সে ও বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে ওঠে। পরের দিনই প্রিয়তার অবস্থা বুঝে সখিনা বেগম মেয়েকে চলে যেতে বলেন। জাইনের বিষয়টাও তিনি সকলের থেকে গোপন রেখেছেন৷ এ বিষয়ে তাকে বলতে হয়নি নিজ থেকেই কাজটা করেছেন।

বেনারসিটা কাগজে মুড়িয়ে ড্রয়ারে যত্ন করে রেখে দেয় প্রিয়তা। নানী তাকে এতো ভালোবাসে জিনিসটা দিয়েছে সে যত্নে রাখবে। নিজের মাকেও জানায়নি বেনারসির বিষয়টা। এক প্রকার গোপন রেখেছে।

…….

বিকাল বেলা ছাদে এসে দেখে একা একা রুমা বসে আচার চু রি করে খাচ্ছে। কেউ হয়তো রোদে দিয়েছিলো সেটাই সে সাবার করছে। প্রিয়তাকে দেখে দ্রুত আচারের বয়াম লুকায়।

জোর পূর্বক হেসে জিজ্ঞেস করে,’আপু ভালো আছো?’

প্রিয়তা জবাব দেয়,’হ্যাঁ আছি। তুমি এখানে কী করছো?’

‘কিছু না।’

‘পিছনে কী লুকিয়েছো?’

‘আচারের বয়াম। খাবা?’

‘তুমিই খাও।’

‘আচ্ছা’,বলে মাথা ঝাঁকিয়ে আবারো খেতে শুরু করে রুমা। মেয়েটার কান্ড দেখে প্রিয়তার মাথা ব্যথা করে।

চট করে রুমাকে প্রশ্ন করে, ‘তুমি আমার নানীর বাড়ির ঠিকানা কেনো দিয়েছো?’

‘কাকে? কখন?’

‘একদম ঢং করবা না সোজাসাপটা উত্তর দাও।’

রুমা ভেজা বিড়ালের মতো চুপ হয়ে যায়। প্রিয়তা ধমক দেয়।
‘কী হলো উত্তর দিচ্ছো না কেনো?’

‘রফিক আমাকে জিজ্ঞেস করে।’

‘জিজ্ঞেস করেছে আর বলে দিছো?’

‘না বলি নাই। পাশ থেকে জাইন ভাইয়া বলে ঠিকানা না বললে আম্মুকে আমার প্রেমের কথা বলে দিবে। তখন রফিকও জোর দেয় বলার জন্য। তারপরই বলে দেই।’

উত্তর পেয়ে প্রিয়তা চুপ হয়।
প্রিয়তা এরপর বলে,’তোমার পেটে একদম কথা থাকে না তাই না?’

রুমা সাথে সাথে বলে,’থাকে তো সকল গোপন কথা। এই দেখো আমি তো কাউকে বলিনি তুমি যে প্রেম করো তাও..’

‘চুপ। যাও বাসায় যাও। মুখ খুললেই ছাদ থেকে ফেলে দিবো।’

প্রিয়তার ধমকে রুমা চুপ হয়। মাথা নিচু করে হাঁটা দেয়।
পিছন থেকে প্রিয়তা ডাকে।
‘আচারের বয়াম রেখে যাও না হলে বলে দিবো।’

আচারের বয়াম রেখে রুমা ছুটে চলে যায়। রুমা যেতেই প্রিয়তা হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। মেয়েটা এতো পাকনা ওর থেকে সাবধানে থাকাই মঙ্গল।

__________

সকাল থেকে প্রিয়তাদের বাসায় রান্নাবান্নার ধুম পড়েছে। প্রিয়তা বুঝতে পারছে না কে আসবে। মিসেস মাসুমা একা হাতেই রান্না সামলাচ্ছে। গ্রামের মেয়ে হওয়াতে তার কাছে এসব কাজ কিছুই না। প্রিয়তাকে শুধু বলেছে ঘর মুছে সব গুছিয়ে রাখতে। মায়ের কথা মতো প্রিয়তা তাই করছে। কাজ শেষ করতে করতে দুপুর হয়ে যায়। গোসল করে সবেই বিছানায় বসে প্রিয়তা এমন সময় তার ফোন বেজে ওঠে। হাতে নিয়ে দেখে জাইনের কল। চুল মুছতে মুছতে কল রিসিভ করে কানে দেয়।

অপরপাশ থেকে হট্টগোল শোনা যায়। জাইন বোধহয় কোথাও গেছে। হয় সভা,না হয় সমাবেশ। দলের একটা না একটা অনুষ্ঠান থাকেই।

স্বাভাবিক ভাবে প্রশ্ন করে জাইন,’কী করছো?’

বিরক্তি নিয়ে প্রিয়তা উত্তর দেয়,’নাচতেছি।’

‘দেখবো।’

‘লাইভ এসে দেখে যান।’

‘এখন তো আসতে পারবো না। নইলে বলতে হতো না।’

‘এই হাবিজাবি অনুষ্ঠান করা ছাড়া আপনার আর কাজ নেই?’

‘আছে তো। সেই কাজ এসবের থেকেও গুরুত্বপূর্ণ।’

প্রিয়তা আগ্রহ নিয়ে প্রশ্ন করে,’কী কাজ?’

‘চোরের মতো মাঝ রাতে তোমাকে দেখতে যাওয়া।’

‘কবে জানি গন ধোলাই খান লোকের হাতে। এভাবে রাতের বেলা আর আসবেন না।’

‘আচ্ছা।’

‘আচ্ছা কী?’

‘আসবো না আর।’

‘গুড। এখন রাখছি।’

‘দুপুরে খেয়েছো?’

‘না। বাবা নাকি আজকে বাসায় খাবে তাই তার অপেক্ষা করছি।’

‘আচ্ছা জলদি খেয়ে নিও,রাখছি।’

‘আপনিও।’

জাইনের তাড়াহুড়ো থাকায় কল রেখে দেয়। সাইলেন্ট করে ফোনটা টেবিলের উপর রাখতেই মিসেস মাসুমা কক্ষে প্রবেশ করে।

‘নে এটা পরে নে। তৈরি হয়ে থাক।’

ভ্রু কুঁচকে প্রিয়তা প্রশ্ন করে,’শাড়ি কেনো? বাসায় কী কেউ আসবে? সত্যি করে বলো মা কারা আসবে?’

‘আসলেই দেখতে পাবি। যা বললাম কর।’

‘পাত্রপক্ষ? আমি বিয়ে করবো না বলে দিলাম।’

‘তোর বাপকে বল।’

মিসেস মাসুমা শাড়িটা বিছানার উপর রেখে চলে যান। প্রিয়তা ভাবতে শুরু করে। বাবার সাথে একবার একান্ত কথা বলবে। এর মধ্যে তুহিনও অফিস থেকে ছুটি নিয়ে ফিরে আসে।

……….

নিজের কক্ষে পায়চারী করছে প্রিয়তা। বসার ঘরে ইতিমধ্যে মেহমান চলে এসেছে। প্রিয়তার পরনে হালকা বেগুনি রঙের সুতির শাড়ি। মিসেস মাসুমা জোর করে পরিয়ে দিয়ে গেছে। খাওয়ার সময় প্রিয়তা তার বাবাকে বললে সে জানায় বিয়ে এখন তাকে দেওয়া হবে না। সে শুধু ছেলে পক্ষকে দেখে রাখছে। পছন্দ হলে পরে কথা আগাবে। খোঁজ খবর নিতেও সময় লাগে। কোনো রকম সাজগোছ করেনি সে। চুলগুলো খোঁপা করে রেখেছে।

‘চল।’

মিসেস মাসুমার গলা পেয়ে পিছনে তাকায় প্রিয়তা।

‘না গেলে হয় না।’

প্রিয়তার কথায় পাত্তা না দিয়ে তার মাথায় আঁচল টেনে হাত ধরে হাঁটা দেয় মিসেস মাসুমা।

বসার ঘরে এসে সালাম দিয়ে চোখ তুলে তাকাতেই দেখে দু’জন অভিভাবক আর দু’জন ছেলে মেয়ে বসা। প্রিয়তাকে এক পাশে বসতে দেওয়া হয়। মিসেস পারুল উঠে প্রিয়তার পাশে বসে। নিহারিকা প্রিয়তাকে দেখে অবাক হয়। সে তো প্রিয়তাকে আগে থেকেই চিনে। দু’জনের রাস্তায় দেখা হয়েছিলো। প্রিয়তাকে তার বেশ পছন্দ হয়। নুহাশেরও প্রিয়তাকে দেখে বেশ পছন্দ হয়। বোনকে সে বিষয়ে ফিসফিস করে জানায়। আগে থেকে প্রিয়তার সাথে পরিচয় থাকায় নিহারিকা নুহাশের সামনে একটু ভাব নেয়।

বসা অবস্থায় পুরোটা সময় মাথা নিচু করে ছিলো প্রিয়তা। কে কী বলেছে তাতে তার মনোযোগ নেই। বেশ অস্বস্তিও হয় তার। এভাবে কখনোই পাত্রপক্ষের সামনে আসেনি সে। এর মধ্যে ছেলেও এসেছে কিন্তু প্রিয়তা চোখ তুলে দেখার আগ্রহবোধ করলো না। ঘন্টা খানেক পর সে মুক্তি পায়। নিজ কক্ষে এসেই দরজা লাগিয়ে ধপ করে খাটে বসে। দরজায় করাঘাত হতেই মাথায় আঁচল টেনে দরজা খুলে। মিসেস পারুল আর নিহারিকা প্রবেশ করে।
মিসেস পারুল হাসিমুখে বলে,’আমার ছেলেকে তোমার পছন্দ হয়েছে?’

প্রিয়তা কী বলবে বুঝতে পারে না।

নিহারিকা বলে,’মা ভাইয়া আসবে না?’

‘না ও তো বললো ব্যস্ত। শুনো আমার আরো এক ছেলে আছে। ও কাজে ব্যস্ত তাই আসতে পারেনি।’

মিসেস পারুলের কথায় প্রিয়তা আগ্রহবোধ করলো না। একটা চেইন বের করে প্রিয়তার গলায় পরিয়ে দেয় মিসেস পারুল। প্রিয়তা নিতে চায়নি কিন্তু পিছন থেকে মিসেস মাসুমা তাকে চোখ রাঙায়।

‘এটা সালামি হিসেবে দিলাম।’
সেই সাথে হাতে কিছু টাকাও গুঁজে দেয়। সবটা প্রিয়তার কাছে অস্বস্তি ঠেকছে।

সকলে যাওয়ার পর বিছানায় আধ শোয়া হয়ে প্রিয়তা ভাবছিলো কী করবে। বাসার পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে তার বাবার ছেলেকে পছন্দ হয়েছে। এদিকে সে বিয়ে করতে চাইছে না। আবার জাইন এসব জানলে তুলকালাম করবে। সব মিলিয়ে একদম অথৈজলে পড়ে গেলো প্রিয়তা। এখন একমাত্র সমাধান বাবার সাথে আবারো কথা বলা। শোয়া থেকে উঠে বিছানা থেকে নামে সে। গায়ের শাড়িটা বদলায়নি এখনো। ফোন হাতে নিয়ে দরজা খুলে বের হয়। দরজার পাশে আসতেই ভেতর থেকে তুহিন আর তার মায়ের গলা পায়।

তুহিন বলছে,’একবার ভেবে দেখো বাবা বিয়ে হলে তোমার মেয়ে কত সুখী হবে।’

মিসেস মাসুমাও বলছেন,’এমন সমন্ধ বারবার আসে না প্রিয়তার আব্বু। তুমি শুধু ওদেরকে পাকা কথা দাও বিয়ে না হয় পরে হবে।’

বেল্লাল হোসেম চিন্তিত হয়ে বলে,’কিন্তু প্রিয়তার মতামত নেওয়া দরকার না?’

তুহিন বলে,’ও নিজের ভালোমন্দ বুঝে নাকি? ওর আবার কীসের মতামত?’

‘ঠিক আছে আমি ভেবে দেখবো।’
বেল্লাল হোসেনের এই কথায় তুহিন আর মিসেস মাসুমা খুশি হয়। প্রিয়তা এবার কী করবে বুঝতে পারে না। বাবা যখন একবার না থেকে ভেবে দেখবো বলেছে তার মানে বিষয়টা সিরিয়াস।
আর একটুও বাসায় থাকতে ইচ্ছে করলো না প্রিয়তার। সোজা সিঁড়ি বেয়ে ছাদে চলে এলো। ছাদে এসে বেঞ্চ বসে ফোনটা পাশে রাখে। এই মূহুর্তে সে সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগছে। বাসার কথা চিন্তা করবে নাকি মনের কথায় সায় দিবে?

‘আমি তো ম রে গেলাম প্রিয়।’
জাইনের গলা পেয়ে চোখ তুলে পাশে তাকায় প্রিয়তা। বুকে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে আছে সে। মোহনীয় দৃষ্টিতে প্রিয়তাকে দেখছে। যেনো এক ভুবনমোহিনী তার সামনে বসা।

প্রিয়তা প্রশ্ন করে,’দেখা হয়েছে?’

জাইন মাথা ঝাকায়। বসা থেকে উঠে এসে জাইনের সামনে দাঁড়ায় সে।

‘দেখুন।’

‘দেখছি তো।’
প্রিয়তাকে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে শুরু করে জাইন। প্রিয়তার গায়ে সুতির শাড়িটা বেশ মানিয়েছে। সেই সাথে এই রঙটাতে তাকে অন্যরকম সুন্দর লাগছে। চুল খোঁপা করা কিন্তু ছোট ছোট চুলগুলো খোঁপার বাঁধন হতে মুক্ত হয়ে এলোমেলো ভাবে উঠছে।

হুট করে জাইন বলে,’চলো বিয়ে করে ফেলি।’

চক্ষুদ্বয় ছোট ছোট করে তার দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করে প্রিয়তা।
‘মজা করছেন?’

‘উহু আমি সিরিয়াস।’

‘তাহলে আপনার পরিবারকে বাসায় পাঠান।’

‘সেটা তো পাঠাবোই এর আগে আমরা করে ফেলি। আই কান্ট ওয়েট।’

‘পরিবারের অনুমতি ছাড়া আমি করবো না। আপনি আপনার পরিবারকে এনে আমার পরিবারকে মানান তাহলে আমার আপত্তি নেই।’

জাইন কৌতুহল নিয়ে প্রশ্ন করে,’বিয়েতে তুমি রাজি?’

‘পরিবার রাজি হলে আমি রাজি।’

প্রিয়তার কথা শুনে জাইন হাসে। মেয়েটা এখনো স্বীকার করছে না সেও জাইনকে চাইছে।
জাইন এগিয়ে এসে প্রিয়তার ডান গালে আঙুল ছোঁয়ায়। উষ্ণ স্পর্শে প্রিয়তা মৃদু কেঁপে ওঠে। দু হাত দিয়ে শাড়ির আঁচল খামচে ধরে।

ফিসফিস করে জাইন বলে,’ক্যান আই কিস ইউ?’

প্রিয়তার স্পষ্ট উত্তর,’নো।’

‘তাহলে একটু কোলে নেই?’

‘একদম না।’

‘অন্ততঃ একটু জড়িয়ে ধরি?’

‘দূরে সরুন।’

ধাক্কা দিয়ে জাইনকে সরিয়ে হাঁটা দেয় প্রিয়তা। পেছন থেকে তার শাড়ির আঁচল টেনে ধরে জাইন।
‘আঁচল ছাড়ুন বাসায় যাবো। এখন বাসায় ভাইয়া
-আব্বু সকলে আছে। আমাকে না পেলে খুঁজবে। আর কালকে আপনার পরিবারকে পাঠান না হলে আমাকে ভুলে যান।’

জাইন হতাশ গলায় বলে,’আমাকে আসতে হবে? কাল তো আমি মহা ব্যস্ত। আজও কাজ ফেলে এসেছি।’

প্রিয়তা এগিয়ে এসে জাইনের সামনে দাঁড়িয়ে বলে,’তাহলে বিয়ে ক্যান্সেল। এসব কাজ না ছাড়লে আপনাকে আমি বিয়ে করবো না।’

‘আমার কাজে খারাপ কী?’

‘সবটাই খারাপ। আমার একদম অপছন্দ আর আপনার ঐ রি ভ ল ভার সেটা যতক্ষণ না ফেরত দিবেন ততক্ষণ আমার সামনে আসবেন না।’

‘রাজনীতি ছাড়তেই হবে?’

‘আলবাত ছাড়তে হবে। হয় প্রিয়তা না হয় রাজনীতি, চয়েজ ইজ ইউরস।’

‘কঠিন অপশন দিলা প্রিয়।’

‘এই একদম প্রিয় ডাকবেন না। প্রিয়তা ডাকবেন।’

জাইন দুষ্ট হেসে বলে,’কাছে আসো প্রিয়।’

‘আবারো! না করলাম না? আপনি মহা বেয়াদব কথা শুনেন না একদম। আপনাকে আমি বিয়ে করবো না।’

প্রিয়তা যেতে নিলে তার শাড়ির আঁচল ছেড়ে হাত টেনে ধরে জাইন।
প্রিয়তা বিরক্তি গলায় বলে,’আবার কী?’

‘শুধু একটা চুমু।’

‘না মানে না।’

জাইন এক হাত দিয়ে প্রিয়তার হাত ধরে দেখেছে অপর হাত দিয়ে ছোট ছোট কেশ গুলো গুঁজে দিচ্ছে কিন্তু হাওয়া থাকাতে বারবার এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।

গলার স্বর নামিয়ে প্রিয়তা বলে,’ছাড়ুন কেউ দেখে ফেলবে।’

‘ইচ্ছে করছে না একদম। তোমাকে এভাবে দেখে আমার মাথা আউলে গেছে।’

‘প্রিয়তা! কী হচ্ছে এখানে?’
পুরুষালী গলা পেয়ো উভয়ই চমকে তাকায়। প্রিয়তার শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে যায় ছাদের দরজায় দাঁড়ানো মানবটাকে দেখে।

অস্ফুট স্বরে বলে,’ভাইয়া!’

………..
(চলবে..)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|২৭.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
……….

তুহিনকে দেখে প্রিয়তা সরতে নিলেও জাইন তার হাত ছাড়ে না। প্রিয়তা হাত মোচড়ানো শুরু করে। জাইনের কোনো ভাবান্তর নেই। এক হাত পকেটে গুঁজে অপর হাত দিয়ে শক্ত করে প্রিয়তার হাত ধরে রেখেছে। তার এমন ভাব যেনো সে কোনো অন্যায় করেনি।
তুহিন এগিয়ে এসে দাঁড়ায়। প্রিয়তা মাথা নিচু করে ফেলে। জাইন সরাসরি তাকিয়ে আছে তুহিনের দিকে। শক্ত চোখে প্রিয়তার ধরে রাখা হাতের দিকে তুহিন তাকায়।

তুহিন রাগান্বিত গলায় বলে,’প্রিয়তা বাসায় চল।’

প্রিয়তা নিরুপায় চোখে জাইনের দিকে দৃষ্টি রাখে।

জাইন বলে,’একটু পর যাবে। আপনি চলে যান।’

তুহিন এবার ক্ষেপে যায়। প্রিয়তার অপর হাত ধরে টান দেয়।

জাইন বিরক্তি নিয়ে বলে,’হাত ছাড়ুন প্রিয়র লাগছে। বললাম তো একটু পর বাসায় যাবে।’

‘তোমার মন মর্জি মতো ও চলবে নাকি? ও আমার বোন যা বলবো তা করবে। চল প্রিয়তা।’
তুহিন প্রিয়তার হাত টেনে হাঁটা দেয় কিন্তু জাইন তার হাত না ছাড়ায় প্রিয়তা এগুতে পারে না।

গলার স্বর নামিয়ে প্রিয়তা বলে,’হাত ছাড়ুন।’

জবাবে জাইন বলে,’ভয় পেয়ো না আমি আছি।’
এরপর প্রিয়তার হাত ছেড়ে দেয়। তুহিন এক প্রকার প্রিয়তাকে টেনে ছাদ থেকে নিয়ে যায়। একবার পেছনে ফিরে জাইনকে দেখে নেয় প্রিয়তা। জাইনের চোখমুখ বদলে গম্ভীর হয়ে গেছে। একটু আগে যেই চোখমুখে ভালোবাসা দেখা যাচ্ছিলো এখন দেখা যাচ্ছে চিন্তার ছাপ। প্রিয়তা বাসায় গেলে তাকে কী করা হবে সেটা ভেবেই চিন্তা হচ্ছে জাইনের।

সদর দরজা ধারাম করে খুলে প্রিয়তাকে নিয়ে প্রবেশ করে তুহিন। এরপর তার হাত ছেড়ে দরজা লাগায়। শব্দ পেয়ে বেল্লাল হোসেন আর মিসেস মাসুমা কক্ষ হতে বের হয়।
হাতের যেখানটায় তুহিন ধরে ছিলো প্রিয়তা মালিশ করতে শুরু করে। তুহিন এতো শক্ত করে হাত ধরে রেখেছিলো যে লাল হয়ে গেছে। বেশ ব্যথা লেগেছে তার।
কেউ কিছু বুঝে ওঠার পূর্বে সজোরে প্রিয়তার গালে চড় বসায় তুহিন। বেল্লাল হোসেন এগিয়ে এসে ধরতে নিলে তুহিন চিৎকার করে।

‘একদম বাঁধা দিবা না আমাকে। ওকে আজকে মে রেই ফেলবো।’

মিসেস মাসুমা এসে তুহিনের হাত ধরে। ঝারা দিয়ে মিসেস মাসুমার হাত সরিয়ে দেয়।
মিসেস মাসুমা তবুও তুহিনকে থামানোর চেষ্টা করে।
‘তুহিন থাম। কী হয়েছে বল।’

প্রিয়তাকে ধরে এক পাশে নিয়ে যায় বেল্লাল হোসেন।
গম্ভীর গলায় বলে,’ও এমন কী অপরাধ করেছে যে তুই ওকে মারলি?’

‘তোমার গুণধর মেয়েকে জিজ্ঞেস করো।’

বেল্লাল হোসেন মেয়ের দিকে তাকায়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা।

বেল্লাল হোসেন বলে,’তুই বল ও কী অপরাধ করেছে।’

তুহিন মুখ কুঁচকে বলে,’আমার তো বলতেও রুচিতে বাঁধতেছে। তোমার মেয়ে ছাদে এক ছেলের সাথে ছিঃ! বাকিটা বলতে পারবো না।’

মিসেস মাসুমা আর বেল্লাল হোসেন অবিশ্বাস্য চোখে প্রিয়তার দিকে তাকায়।
বেল্লাল হোসেন কঠিন গলায় বলে,’দেখ তুহিন আমরা সবাই জানি প্রিয়তা কেমন মেয়ে। পরিবারের সম্মান যাবে এমন কাজ ও কখনোই করবে না।’

বেল্লাল হোসেনের কথায় তুহিন অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে।
‘তাহলে ওরে জিজ্ঞেস করো এই রাতের বেলা কই গেছিলো। কার সাথে ছিলো এতক্ষণ।’

তুহিনের কথার জোর দেখে বেল্লাল হোসেন মেয়ের দিকে তাকায়।
‘তুহিন যা বলছে সত্যি?’

প্রিয়তা কোনো উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে থাকে। মেয়ের মৌনতা বুঝতে বেল্লাল হোসেনের সময় লাগে না। তার মানে তুহিন যা বলছে সত্যি! অবিশ্বাস্য দৃষ্টিতে মেয়ের দিকে তাকিয়ে থাকে বেল্লাল হোসেন। বুকের ভেতর হঠাৎ হৃদপিণ্ডটা জোরে জোরে শব্দ করে লাফাতে থাকে। বুকের উপর হাত রেখে মেঝেতে বসে পড়ে বেল্লাল হোসেন।
তুহিন আর মিসেস মাসুমা ছুটে এসে তাকে ধরে।
মিসেস মাসুমা জিজ্ঞেস করে,’তোমার কী হলো? শরীর খারাপ লাগছে?’

প্রিয়তা এগুতে নিলে বেল্লাল হোসেন হাতের ইশারায় তাকে থামায়।
অস্ফুট স্বরে আবারো জিজ্ঞেস করে,’তুহিন যা বলছে সত্যি? তুমি ছাদে এক ছেলের সাথে ছিলে?’

প্রিয়তার স্পষ্ট উত্তর,’হ্যাঁ কিন্তু.. ‘

বেল্লাল হোসেন হাত উঁচিয়ে প্রিয়তাকে থামিয়ে দেয়।
‘মাসুমা আমাকে ঘরে নিয়ে চলো আর সইতে পারছি না।’
বেল্লাল হোসেনের করুণ গলা শুনে প্রিয়তার চোখে জল চলে আসে। তার বাবা সবসময় তার মাকে প্রিয়তার মা বলে ডাকতো আর আজ প্রথমবার ডাকলো নাম ধরে!
তুহিন আর মিসেস মাসুমা ধরে বেল্লাল হোসেনকে কক্ষে নিয়ে যায়। প্রিয়তা কক্ষের সামনে গিয়ে দরজা ধরে দাঁড়ায়।
ভেতর থেকে বেল্লাল হোসেন গলা উঁচিয়ে বলে,’ওকে বলে দাও আমার ত্রিসীমায় যেনো না আসে।’

প্রিয়তা তবুও ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। এবার তুহিন চেঁচায়।
‘তুই কী এবার বাবাকে খেয়ে ফেলতে চাস? যাচ্ছিস না কেনো এখান থেকে?’

প্রিয়তা শাড়ির আঁচল মুখে গুঁজে নিজ কক্ষে ছুটে যায়। কক্ষের দরজা বন্ধ করে বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে বালিশ জড়িয়ে কান্নায় ভেঙে পড়ে। সামান্য একটা ভুলে বাবার সাথে তার সম্পর্কে ফাটল ধরলো। চিরকাল পরিবার আর বাবার সম্মানের কথা আগে ভেবে এসেছে সে। এই বয়সে এসে আবেগের বশে একটা মস্ত ভুল করে ফেলেছে সে। তার বাবা এখন তাকে ভুল বুঝে দূরে সরিয়ে দিলো। বাচ্চাদের মতো ফুঁপিয়ে কাঁদতে শুরু করে সে।

____________

বিছানার উপর জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে প্রিয়তা। দু’দিন হয়ে গেলো নিজ কক্ষ হতে বেরোয়নি সে। বাসার কেউ তার সাথে কথা বলছে না ঠিক করে। বেল্লাল হোসেন তো তার নাম পর্যন্ত নিচ্ছে না। সেদিন রাতেই তুহিন প্রিয়তার ফোন নিয়ে যায়। বাসা থেকে তার বের হওয়া একদম বন্ধ করে দিয়েছে।
মিসেস মাসুমা নিয়ম করে প্রতিবেলায় খাবার দিয়ে যাচ্ছে কিন্তু প্রিয়তা ঠিকমতো খাচ্ছে না। বিছানা থেকে নেমে টেবিলের চেয়ার টেনে বসে। জানালা হতে পর্দা একটু সরিয়ে বাহিরে দৃষ্টি রাখে। রাস্তা দিয়ে মানুষ যাতায়াত করছে। ভেতর থেকে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে আসে তার। জাইনের সাথে সেই রাতেই শেষবার কথা হয়েছে। জাইন তাকে মেসেজ দিয়ে বাসার পরিস্থিতি জিজ্ঞেস করলে সে জানায় সব ঠিক আছে চিন্তার কিছু নেই। সাথে বলে দেয় এখন যেনো জাইন তার পরিবারকে না পাঠায়। পরে পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে তখন যেনো পাঠায়।

মিসেস মাসুমার গলা পেয়ে প্রিয়তা উঠে কক্ষের দরজা খুলে এক পাশে দাঁড়ায়। তুহিন বেল্লাল হোসেনকে নিয়ে ফিরেছে। সেই রাতের ঘটনার কারণে বেল্লাল হোসেন গুরুতর অসুস্থ হয়ে গেলে তাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। ডাক্তার তাকে দেখে ঔষধ দিয়ে দিয়েছিলো তবুও বুকের ব্যথাটা কমেনি বেল্লাল হোসেনের তাই আজকে আবারো নিয়ে যাওয়া হয়েছিলো।
বেল্লাল হোসেন মেয়ের দিকে এক পলক তাকায় এরপরে নিজের কক্ষে চলে যায়। প্রিয়তার ভেতরটা হু হু করে ওঠে বাবার এমন আচরণে। তবে সে সবটা মেনে নিয়েছে। অপরাধ যেহেতু করেছে সে তার শাস্তি ভোগ করছে এখন।

দরজা ছেড়ে বিছানায় এসে বসে প্রিয়তা। একটু পর মিসেস মাসুমা তাকে ডাকতে আসে।

‘তোর বাবা তোকে ডাকছে। যা বলে মাথা নিচু করে শুনবি। তর্ক করে লোকটাকে উত্তেজিত করবি না একদম।’

বেল্লাল হোসেন তাকে ডাকছে শুনে প্রিয়তা চট করে মাথা তুলে। অবশেষে বাবার সাথে ভুল বোঝাবুঝি শোধরানোর একটা সুযোগ সে পেলো। বাবা ডেকেছে শুনে বিগত দু’দিনের বিষাদ ভুলে গেলো। এক প্রকার ছুটে গেলো বাবার কক্ষের দিকে। দরজার সামনে গিয়ে থেমে যায়। বেল্লাল হোসেন বিছানায় শুয়ে আছেন। তুহিন প্রিয়তাকে দেখে এগিয়ে আসে।

তুহিন নিচু গলায় বলে,’বাবা যা বলে মন দিয়ে শুনবি। বাবার শরীর একদমই ভালো না।’
তুহিন বেরিয়ে যায়। প্রিয়তা এখনো দরজার সামনে দাঁড়িয়ে আছে।
বেল্লাল হোসেন গলা উঁচিয়ে ডাকে,’ভেতরে আসো।’

ধীর পায়ে কক্ষে প্রবেশ করে প্রিয়তা।
‘এখানে বসো।’
চেয়ারের দিকে ইশারা করে বলে বেল্লাল হোসেন।
বাবার কথা মতো চেয়ারে বসে প্রিয়তা। বাবার চেহারার দিকে তাকাতেই তার কাছে মনে হয় দু’দিনে তার বাবা শুঁকিয়ে গেছে। তার বয়সটাও মনে হচ্ছে কয়েক বছর বেড়ে গেছে।
বেল্লাল হোসেন প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তাও তার বাবার দিকে তাকিয়ে আছে।

বেল্লাল হোসেন বলেন,’দেখো আমি সব সময় চেয়েছি তোমাদের দুই ভাই-বোনকে মানুষের মতো মানুষ করতে। যখন তোমরা বড় হলে আমি রাস্তা দিয়ে বুক ফুলিয়ে হাঁটতে পারতাম কারণ তোমরা দু’জনেই এমন সন্তান হয়েছো যেমনটা সকল বাবা-মা চায়। তোমার ভাই একটু জেদী তবুও সে আমার অসম্মান হয় এমন কিছু করেনি। তুমিও এতো বছর ধরে খেয়াল রেখেছো যাতে আমার সম্মান সবসময় বজায় থাকে। যেই বয়সে ছেলেমেয়েরা ভুল করে সেই বয়সে তুমি কঠোর ছিলে। সব কিছু করার পূর্বে আমার অনুমতি চাইতে। সেই তুমি এমন কিছু করবে আমি কল্পনাতেও ভাবিনি। জেনে হোক না জেনে হোক,বুঝে হোক না বুঝে হোক একটা বিশাল অপরাধ তুমি করে ফেলেছো। এতো বছর যা সম্মান দিয়েছো এক নিমিষে সব ধুলো হয়ে গেছে। আমি চাইলে তোমার থেকে এখনো দূরত্ব রাখতে পারি কিন্তু যেহেতু এটা তোমার করা প্রথম ভুল তাই তোমাকে আরেকটা সুযোগ দিতে চাই।’

কথাগুলো বলে বেল্লাল হোসেন থামেন। প্রিয়তা এখনো তার বাবার পানে তাকিয়ে আছে।

‘তোমার করা প্রথম ভুলটা মস্ত বড়। এতো সহজে ভুলতে পারবো না। তবুও সুযোগ দিচ্ছি আরেকটা। ঐ ছেলেকে ভুলে যাও। অমন ছেলেকে আমি মেয়ে জামাই করবো না। তুহিন খোঁজ নিয়ে জানিয়েছে এমপির চামচামি করে বেড়ায় সে। কাজ কাম কিছুই করে না তার উপর মা দ কা স ক্ত। এমন ছেলের হাতে তো আমি একমাত্র মেয়েকে তুলে দিতে পারি না। লোকে যেহেতু জানে না তাই চুপচাপ বিষয়টা মিটমাট করে ফেলি। এতে আমাদের সকলের মঙ্গল। আবেগের বশে যা করেছো ওখানেই থেমে যাও।’

কথাগুলো বলে বেল্লাল হোসেন মেয়ের দিকে তাকায়। প্রিয়তা এক ধ্যানে বাবার সকল কথা শুনে।

‘কী বলেছি বুঝেছো?’

মাথা নাড়িয়ে প্রিয়তা উত্তর দেয়,’জি।’

‘আশা করি তুমি এ ভুল থেকে শিক্ষা নিয়েছো। জীবনে আর কখনোই এই রকম ভুল করবা না।’

প্রিয়তা আবারো মাথা নাড়ায়। বেল্লাল হোসেন হাত তুলে প্রিয়তার মাথায় রাখেন।

‘শুনলাম সকালে খাওনি। ঠিকমতো খাওয়াদাওয়া করছো না কেনো?’

বাবার প্রশ্নের জবাবে প্রিয়তার চোখে অশ্রু এসে হানা দেয়।

‘যাও খেয়ে দেয় বিশ্রাম করো। ঠিকমতো না খেলে অসুস্থ হয়ে যাবা।’

প্রিয়তা উঠে দাঁড়ায়। এরপর নিজ কক্ষের দিকে যায়। কক্ষে এসে চোখের কোণে থাকা অশ্রু ফোঁটা মুছে নেয়। বেল্লাল হোসেনের বলা কথাগুলো মোটেও স্বাভাবিক ছিলো না। প্রিয়তা বুঝতে পারে সে এখনো রেগে আছে হয়তো। কিন্তু বাবার কথা সে কখনোই অমান্য করেনি। আজও করবে না।

……..

বিকাল বেলা হঠাৎ রিমি এসে প্রিয়তাদের বাসায় উপস্থিত হয়। প্রিয়তা রিমিকে দেখে স্বাভাবিক থাকার চেষ্টা করে। রিমি প্রিয়তাকে দেখে আন্দাজ করে কিছু একটা হয়েছে।

প্রিয়তার হাত টেনে বিছানায় বসে রিমি এরপর একের পর টক প্রশ্ন করে।
‘তোর ফোন কই? তোরে কল দিলে পাই না যে।’

‘ফোনে একটু সমস্যা হয়েছে ভাইয়ার কাছে ঠিক করতে দিয়েছি।’

রিমি একবার কক্ষের দরজার দিকে তাকায়। বাসার পরিবেশ তার কাছে অদ্ভুত লাগছে। প্রিয়তা কক্ষের দরজা বন্ধ করছে না আবার প্রিয়তার মা একটু পর পর এসে ঘুরে যাচ্ছে।

‘প্রিয়ু সত্যি বলতো বাসায় কোনো সমস্যা হয়েছে?’

‘না রে সব ঠিক আছে।’

রিমি ফিসফিস করে প্রশ্ন করে,’ভাইয়ার সাথে ঝগড়া করেছিস?’

প্রিয়তা না বোঝার ভান করে বলে,’কোন ভাইয়া?’

‘আরে জাইন ভাইয়া।’

‘না ওনার সাথে ঝগড়া কেনো করবো?’

‘গতকালকে আমি দোকানে যাই সেখানে তার বন্ধু মারুফ উপস্থিত হয়। সে আমাকে তোর বিষয় জিজ্ঞেস করে। তুই ফোন ধরছিস না সেই বিষয়ে।আমি তো অলরেডি চিন্তায় ছিলাম। সে যখন জিজ্ঞেস করলো তোর সাথে কথা হচ্ছে কিনা তখন আরো চিন্তায় পড়ে যাই। মারুফ ভাই আমাকে অনুরোধ করে তোর বাসায় এসে যেনো খোঁজ নেই। আমি ভাবলাম হয়তো তুই জাইন ভাইয়ার উপর রাগ করে আছি বা ঝগড়া হয়েছে দু’জনের।’

‘না রে তেমন কিছু না।’

এমন সময় মিসেস মাসুমা কক্ষে প্রবেশ করে। দু’জনেই চুপ হয়ে যায়। একটু পর মিসেস মাসুমা গেলে রিমি আবারো শুরু করে।

‘জাইন ভাইয়াকে কল দিয়ে কথা বলিস। উনি চিন্তা করছে। আর তোর বাসায় সত্যি সব ঠিক আছে? আমার কাছে কেমন অদ্ভুত লাগছে।’

‘সব একদম ঠিক আছে চিন্তা করিস না আর আমি কল দিয়ে কথা বলবো ফোন ঠিক হলেই। তুই বলে দিস আমি ঠিক আছি।’

প্রিয়তার কথায় রিমি আশ্বস্ত হয় না তবুও মেনে নেয়। সন্ধ্যার দিকে রিমি বিদায় নিয়ে চলে যায়।

রাতের বেলা চুপচাপ টেবিলে বসে আঁকিবুঁকি করছিলো প্রিয়তা এমন সময় তুহিন কক্ষে প্রবেশ করে। শব্দ পেয়ে পিছনে তাকায় সে।

তুহিন জিজ্ঞেস করে,’বাবার অসুস্থতা সম্পর্কে জানিস?’

প্রিয়তা মাথা ঝাকায়।
‘বাবার হার্টে সমস্যা আছে। হার্টে একটা ফুটো হয়ে আছে।’

তুহিনের কথা শুনে প্রিয়তা চমকায়। এতো বড় খবরটা সে জানতো না!

‘বাবা ঢাকা গিয়ে ডাক্তার দেখানোর পর বিষয়টা জানে। সে আমাদের কাউকে এটা জানায়নি। সেদিন অসুস্থ হয় পর ডাক্তারের কাছে গিয়ে জানলাম। এমন অবস্থায় ডাক্তার নিষেধ করেছে বাবাকে উত্তেজিত করতে। তোর কাহিনীর কারণে আরেকটু হলেই বাবা সিরিয়াস অসুস্থ হয়ে যেতো।’

তুহিনের কথা শুনে প্রিয়তা মাথা নিচু করে ফেলে।

‘যা হয়েছে ভুলে যা। বাবা তোকে মাফ করে দিয়েছে। এখন তোর কাজ হলো নিজের ভুল শুধরে বাবার কথা মানা। এই নে তোর ফোন। ছেলেটা সকাল সন্ধ্যা কল মেসেজ দিচ্ছে। তুই ওকে ফোন দিয়ে বুঝিয়ে বল যাতে আর তোকে বিরক্ত না করে। আশা করি বাকিটা বলতে হবে না।’
তুহিন প্রিয়তার হাতে ফোনটা দিয়ে চলে যায়। ফোন হাতে নিয়ে প্রিয়তা কতক্ষণ ঠায় দাঁড়িয়ে রয়। তার মস্তিষ্ক কাজ করছে না। এরপর ধীর পায়ে গিয়ে কক্ষের দরজা বন্ধ করে দেয়। কক্ষের বাতি বন্ধ করে জানালার পাশে গিয়ে দাঁড়ায়। ডায়াল করে জাইনের নাম্বার। রিং হওয়ার সাথে সাথে জাইন কল রিসিভ করে। যেনো সে এই কলের অপেক্ষায় ছিলো।

ব্যস্ত গলায় জাইন শুধায়,’প্রিয় তুমি ঠিক আছো?’

‘হ্যাঁ।’

‘এই দু’দিন আমার কল ধরনি কেনো? বাসার সব কিছু ঠিক আছে?’

‘ফোনে সমস্যা হয়েছিলো ঠিক করতে দিয়েছিলাম।’

‘আমার প্রশ্নের জবাব দিলে না।’

‘বাসার পরিবেশ ঠিক আছে।’

‘তাহলে আম্মাকে কালকে পাঠাবো?’

‘না।’
প্রিয়তার কঠোর গলা শুনে জাইন চমকায়।
‘কেনো? কী সমস্যা?’

‘আমি এখন বিয়ে করবো না।’

‘আচ্ছা বিয়েটা পরে করবো এখন পাকা কথা হয়ে থাক?’

‘না বললাম তো। আপনি আমার বাংলা কথা বুঝেন না?’

‘রেগে যাচ্ছো কেনো? তুমিই তো সেদিন বললে।’

‘হ্যাঁ বলেছিলাম কিন্তু মজা করে। আসল কথা হলো আমার আপনাকে ভালো লাগে না। বিয়ে তো দূর আপনার সাথে কোনো রকম সম্পর্কে জড়াতে চাই না।’

‘তুমি রেগে আছো আমরা পরে কথা বলবো।’

‘আপনার সাথে আজ এখন এই মূহুর্তে আমার শেষ কথা হবে।’

‘আমার ধৈর্য্যের পরীক্ষা নিও না প্রিয়।’

‘আমাকে ভুলে যান। আর বিরক্ত করবেন না।’

জাইন দাঁতে দাঁত চেপে বলে,’এতো সহজে! তুমি বললে আর আমি তোমাকে ভুলে যাবো? তুমি আমাকে চিনো না। তোমার চৌদ্দ গুষ্ঠি সহ তোমাকে তুলে নিয়ে আসবো। তাই ভালোয় ভালোয় বলছি আমাকে চেতিয়ো না পরিণাম খারাপ হবে।’

‘হ্যাঁ পারেন তো খালি হু ম কি দিতে। শুনেন এই রকম লোককে আমি বিয়ে করবো না যে জোর জবরদস্তি করে। আপনার মতো বেত্তুমিজ লোক আমার চাই না।’

জাইন চমকে প্রশ্ন করে,’আমি তোমার সাথে জোর জবরদস্তি করি?’

‘অবশ্যই করেছেন। সবসময় হু ম কি দিয়ে দেখা করতে বলেন। অসভ্যের মতো হাত ধরেন,কাছে চলে আসেন। নিজের পছন্দকে আমার উপর চাপিয়ে দিতে চাচ্ছেন। আপনার আমাকে পছন্দ হতে পারে কিন্তু আমার আপনাকে পছন্দ না।’

‘প্রিয় শুনো..’

‘আমি আপনার সাথে আর কোনো ধরনের কথাবার্তা বলতে চাই না।’

‘তাহলে এতোদিন আমাদের মধ্যে কী ছিলো?’

‘কিচ্ছু ছিলো না।’

‘কিচ্ছু না সত্যি তো?’

‘ভালো থাকবেন,বায়।’

ফট করে কলটা কেটে দেয় প্রিয়তা। সাথে সাথে জাইন কল দেয় কিন্তু কল রিসিভ করে না প্রিয়তা। কল কেটে যেতেই ফোনটা বন্ধ করে বিছানায় ছুঁড়ে দেয়। জানালার পাশে হাঁটু মুড়ে বসে কাঁদতে শুরু করে।
কান্নারত অবস্থায় বলে,’আই এম সরি। আমি নিরুপায়।’

……….
(চলবে..)