প্রণয়ী পর্ব-২৮+২৯

0
15

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|২৮.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
………..

রাত বাজে দশটা। সকলেই খেয়ে নিজ নিজ কক্ষে অবস্থান করছে। প্রিয়তা খায়নি। তাকে আজকে টেবিলে খেতে ডাকা হয়েছে যায়নি খেতে। অবশ্য কেউ জোরাজুরি করেনি খেতে। বেল্লাল হোসেন একবার ডাক দিয়েছিলো তখন প্রিয়তা চুপচাপ শুয়ে ছিলো। ঘুমিয়ে গেছে ভেবে তাকে আর বিরক্ত করেনি। অন্য সময় হলে তাকে ঘুম থেকে তুলে হলেও খাবার খাইয়ে দিতো বেল্লাল হোসেন কিন্তু আজ আগ্রহবোধ করলো না। জাইনের সাথে কথা শেষ করে কল কাটার পর নিজ কক্ষেই রয়েছে সে। ঘন্টা খানেক পূর্বে জাইনের সাথে কথা বলেছে সে। এরপর তুহিন এসে ফোন নিয়ে গেছে। কথা বলার পর থেকেই এক দফা কেঁদেছে। এখন আর কান্না আসছে না তার। ভেতরটা কষ্টে বিষিয়ে গেছে।

কক্ষের বাতি বন্ধ কিন্তু দরজা খোলা তবে চাপানো। দরজা বন্ধ করলেই তুহিন চেঁচায়। বিছানার উপর চুপচাপ বসে আছে প্রিয়তা। নিজেকে বড্ড অসহায় লাগছে তার। এর আগেও তো পরিবারের জন্য কত কিছু আত্নত্যাগ করেছে কই তখন তো খারাপ লাগেনি। আজ তাহলে এতো খারাপ লাগছে কেনো? তবে কী সে জাইনে মায়ায় পড়ে গেছে? জাইনকে ওভাবে কড়া কথা আগেও শুনিয়েছে তখন বিন্দুমাত্র খারাপ লাগেনি কিন্তু আজ তার ভেতরটা ফেটে যাচ্ছে। প্রিয়তার মস্তিষ্কে এলোমেলো ভাবনা ঘুরতে থাকে। জাইন এবার কী করবে? চুপচাপ সবটা মেনে নেওয়ার ছেলে সে নয় এটা প্রিয়তা ভালো জানে। তাহলে এরপর তার পদক্ষেপ কী হবে?

ফ্ল্যাটের কলিংবেল বাজার শব্দ হলে মিসেস মাসুমা বিরক্ত হন। সবেই বিছানায় এসেছেন শুতে তিনি। নেমে এগিয়ে যান দরজা খোলার জন্য। এতো রাতে নিশ্চয়ই রুমার মা এসেছে। তিনি ছাড়া কেউ অসময়ে আসে না। রাত বিরাতে রুমার মা এটা ওটা নিতে আসেন। বেল্লাল হোসেনও শুয়েছেন। তুহিনের কক্ষের দরজা বন্ধ। তাই মিসেস মাসুমাকেই আসতে হলো।

দরজা খুলে তিনি কিছু বুঝে উঠার পূর্বেই ব্যক্তিটা তাকে সম্পূর্ণ উপেক্ষা করে গটগট পায়ে প্রিয়তার কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়।
পিছন থেকে মিসেস মাসুমা চেঁচায়,’এই ছেলে কই যাও তুমি? আমার মেয়ের ঘরে কেনো যাচ্ছো?’

মায়ের গলা পেয়ে দরজার দিকে প্রিয়তা তাকায়। হুট করে কক্ষে কেউ ঢুকে দরজা বন্ধ করে দেয়। বাহিরে মিসেস মাসুমার চেঁচামেচি শোনা যায়। ভয় পেয়ে প্রিয়তা কিছু বলবে এর পূর্বেই কক্ষের বাতি জ্বলে। অনেকক্ষণ কান্না করার ফলে বাতির আলোতে প্রিয়তার চোখ জ্বলতে শুরু করে। সাথে সাথে চোখ জোড়া বন্ধ করে ফেলে সে।
চেয়ারের শব্দে চক্ষু মেলে সামনে তাকায় প্রিয়তা। চমকে ওঠে সে। রক্তিম চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে জাইন। চেয়ারে বসা সে। প্রিয়তা খেয়াল করলো জাইনলে এলোমেলো লাগছে। ঘামে গায়ের পাঞ্জাবীটা গায়ের সাথে লেগে আছে। কপালে বিন্দু বিন্দু ঘাম দেখা যাচ্ছে। জোরে জোরে শ্বাস নিচ্ছে সে। সাধারণ মানুষ অতিমাত্রায় রেগে গেলে নিজের রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে এভাবে দ্রুত গতিতে শ্বাস নেয়। প্রিয়তা আশ্চর্য হলো নিজের কাজে। সে জাইনের প্রতিটি বিষয় পর্যবেক্ষণ করলো।
জাইন ঠান্ডা গলায় বলে,’বিছানা থেকে নামো।’

প্রিয়তার যেনো হাত পা অবশ হয়ে গেছে। ভয়ে ঢোক গিলে সে। পুরুষ মানুষ রেগে গেলে এরা বড্ড ভয়ঙ্কর হয়। নারীর রাগ খানিক সময়ের হলেও পুরুষের রাগ দীর্ঘসময়ের। জাইন প্রিয়তাকে এবার ধমক দেয়।

‘কী বলেছি শুনতে পাওনি? নামো বলছি।’

চুপচাপ বিছানা থেকে নেমে দূরত্ব নিয়ে দাঁড়ায় প্রিয়তা। তার মস্তিষ্ক এবার ফাঁকা লাগছে।
জাইন আবারো ঠান্ডা গলায় বলে,’তখন কলে যা যা বলছো রিপিট করো। একটা শব্দও বাদ দিবা না। হুবুহু তা ই বলবা।’

ওড়না খামচে দাঁড়িয়ে থাকে প্রিয়তা। তার সাহস নেই এই মূহুর্তে জাইনের সাথে তর্ক করার। জাইনের রাগান্বিত গলার শুনে তার মুখ দিয়ে আওয়াজই বের হচ্ছে না। এরিমধ্যে তুহিন আর তার বাবাকে ডেকে এনেছে মিসেস মাসুমা। তুহিন দরজায় একের পর এক আঘাত করছে। শব্দ পেয়ে প্রিয়তা দরজার দিকে তাকায়।

জাইনের ধৈর্য্যের বাঁধ ভেঙে যায়। উঠে এসে প্রিয়তার হাত চেপে ধরে। মুখ ঘুরিয়েছে চোখমুখ খিঁচে ফেলে প্রিয়তা।
‘এখন মুখ দিয়ে কথা বের হয় না কেনো? এখন বলো আমাদের মধ্যে কিছু আছে নাকি নেই?’

সাহস সঞ্চার কয়ে প্রিয়তা বলে,’কিছু নেই।’

জাইন এবার প্রিয়তার ঘাড় ধরে তার মুখটা কাছে নিয়ে আসে।
‘তাকাও আমার দিকে। এই মেয়ে তাকাও।’

চক্ষু মেলে জাইনের চোখের দিকে তাকায় প্রিয়তা।
‘এবার বলো কি বলছো।’

প্রিয়তা ওষ্ঠ চেপে কান্না আঁটকায়। জাইন এতে
আরো ক্ষেপে যায়। জাইন খেয়াল করে প্রিয়তার চক্ষু জোড়া ফুলে আছে। বুঝতে অসুবিধা হয় না সে এতোক্ষণ কেঁদেছে।

‘একদম আমাকে দূর্বল করার চেষ্টা করবা না। আমাদের মধ্যে কিছু না থাকলে এতোদিন আমার আচরণকে প্রশ্রয় কেনো দিছো? জবাব দাও।’

‘আমার পক্ষ হতে কখনোই প্রশ্রয় ছিলো না। সবটা আপনি এক তরফা করেছেন।’

‘ঠিক আছে তাহলে আরেকটা কাজ করবো এখন সেটাও এক তরফাই। তোমাকে এক্ষুণি বিয়ে করবো।’

প্রিয়তা অপর হাত দিয়ে নিজের হাত ছাড়ানোর চেষ্টা করে বলে,’এটা অসম্ভব। আপনাকে আমি বিয়ে করতে পারবো না।’

‘কেনো পারবা না?’

‘কারণ আপনি গু ন্ডা। নে শা করেন,মানুষ খু ন করেন। আরো শুনতে চান?’

‘আমি খারাপ ঠিক আছে তাহলে তুমি এতো কাছে এলে কেনো আমার?’

‘গু ন্ডার সাথে আর যা ই হোক সংসার করা যায় না। যা ছিলো টাইম পাস এর বেশি কিছু না।’

‘তারমানে তুমি নিজের চাহিদা মেটাতে আমার কাছে এসেছিলে?’

‘যেটা আপনি মনে করেন সেটাই।’

‘ঠিক আছে তাহলে দেখো আমি কী করি।’
কথাটা বলে জাইন প্রিয়তার ঘাড় হতে হাত সরায়। এরপর তার বাম হাত শক্ত করে ধরে কক্ষের দরজা খুলে বের হওয়ার জন্য। দরজায় তুহিন,বেল্লাল হোসেন আর মিসেস মাসুমা দাঁড়িয়ে। জাইন প্রিয়তাকে নিয়ে যেতে নিলে তুহিন বাঁধা দেয়।

বেল্লাল হোসেন কঠিন গলায় বলে,’এই ছেলে আমার মেয়ের হাত ছাড়ো।’

জাইন বাঁকা জবাব দেয়,’আপনার মেয়ে আমাকে ভালোবাসে তাই ওকে নিয়ে যাচ্ছি। আপনারা আপসে দিলে এমনটা করতাম না।’

তুহিন এগিয়ে এসে জাইনের পাঞ্জাবীর গলা খামচে ধরে।
‘সাহস তো কম না! আমার বাসায় এসে আমার বোনকে নিয়ে যেতে চাস। তোকে আমি পুলিশে দিবে।’

‘ডাকুন পুলিশ। আমিও দেখবো দু’জন এডাল্ট পারসনকে ভালোবাসার অপরাধে পুলিশ কী শাস্তি দেয়।’

এদিকে প্রিয়তা ভয়ে নুইয়ে গেছে। ইতিমধ্যে সে ঘামতে শুরু করেছে। বাবা ভাইয়ের সাথে জাইনের ঝামেলা হোক সে চায় না।

বেল্লাল হোসেন এগিয়ে এসে প্রিয়তার ধরে রাখা হাতটা ছাড়ানোর চেষ্টা করে। সদর দরজা খোলা থাকায় প্রতিবেশীরা ঘুম রেখে উঁকি ঝুকি মারছে৷ ঘুমের থেকেও এই কাহিনী দেখা তাদের কাছে অধিক গুরুত্বপূর্ণ।
জাইনের শক্ত করে ধরে রাখা হাতের বাঁধন বেল্লাল হোসেন ছাড়াতে ব্যর্থ। এদিকে প্রিয়তা বারবার জাইনের দিকে তাকাচ্ছে। জাইন তার দিকে একবারো তাকাচ্ছে না।

জাইন গম্ভীর গলায় বলে,’আপনারা তামাশা না করে সরে গেলে আমিও চুপচাপ ওকে নিয়ে চলে যাবো। যত তামাশা করবেন তত আপনাদের সম্মানহানি হবে। আপনারা কী তা চান?’

বেল্লাল হোসেন বলে,’তোমার মতো ছেলেদের ভালো করে চেনা আছে। দু’দিন পরপর একেক মেয়েকে নিয়ে ঘুরে বেড়াও। আমার মেয়েটাকে ভুলিয়ে ভালিয়ে নিজের জালে ফাঁসিয়েছ।’

‘ফাঁসিয়েছি বলেই নিয়ে যেতে চাইছি। আর শালামশাই আপনার বয়স আর আমার বয়স কাছাকাছি। এভাবে পাঞ্জাবী টেনে ধরে রাখলে কিছু বলবো না কিন্তু আমাদের পথে বাঁধা দিলে আপনাকেও আমি ছাড়বো না।’

মিসেস মাসুমা এবার মুখ খুলে,’তুমি কোন অধিকারে আমার মেয়েকে নিয়ে যেতে চাও?’

‘প্রেমিকের অধিকারে। আপনার মেয়েকে আমি ভালোবাসি। ওকে সুখে রাখার মতো আমার ক্ষমতা আছে। আর প্রিয় ও আমার সাথেই যেতে চায়।’

জাইনের কথা শুনে সকলে প্রিয়তার দিকে তাকায়। প্রিয়তা মাথা নিচু করে ফেলে। তুহিন জাইনের পাঞ্জাবী ছেড়ে দেয়।
বেল্লাল হোসেন বলেন,’বেশ তবেই ও বলুক ও কী চায়। প্রিয়তা যেটা বলবে সেটাই। একটা রাস্তার ছেলেকে সে বেছে নিবে নাকি নিজের পরিবারকে সেটাই দেখার বিষয়।’

প্রিয়তা চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
তুহিন বলে,’প্রিয়তা চুপ থাকিস না জবাব দে।’

ধীর গলায় প্রিয়তা বলে,’আমি কোথাও যেতে চাই না। আমার পরিবার যা বলবে আমি তাই শুনবো। আমার কাছে আমার পরিবার আগে।’

প্রিয়তার উত্তর শুনে জাইন নিরাশ হয়।মেয়েটা তাকে চাইছে সেটা সে বুঝতে পারছে তবে কেনো এখন সে অস্বীকার করছে? প্রিয়তা কেনো এমনটা বললো? হাত ছেড়ে প্রিয়তার বাহু ধরে ঝাঁকায় জাইন।

‘কী সমস্যা তোমার? স্বীকার কেনো করছো না তুমি যে আমাকে চাও? তোমার পরিবারকে ভয় কেনো পাচ্ছো? লুক এট মি প্রিয়।’

প্রিয়তা জাইনের প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে মাথা নিচু করে থাকে। তুহিন এগিয়ে এসে প্রিয়তাকে জাইনের হাত থেকে ছাড়ায়। মিসেস মাসুমা মেয়েকে নিজের আড়ালে লুকিয়ে ফেলেন। জাইন প্রিয়তার কাছে যেতে নিলে তাকে তুহিন আর বেল্লাল হোসেন মিলে বাঁধা দেয়।
গলা উঁচিয়ে জাইন বলে,’বের হয়ে আসো প্রিয়। এই বাসায় তোমার থাকতে হবে না। কথা কানে যাচ্ছে না আমার? তুমি আমার সাথে যাবা এক্ষুণি। আসো বলছি।’

তুহিন বলে,’বের হবি এখন তুই।’

তুহিন দরজার বাহিরে থাকা ছেলেদের ডাক দেয় সাহায্যের জন্য। তারাও এগিয়ে এসে জাইনকে টেনে বের করার চেষ্টা করে। জাইন কিছুতেই প্রিয়তাকে না নিয়ে বের হবে না। সে চিল্লাপাল্লা করে চলেছে।

‘প্রিয় তুমি ভুল সিদ্ধান্ত নিচ্ছো। এখনো সময় আছে চলে আসো। তুমি যদি না আসো আমি আমার চেহারা আর কখনোই তোমাকে দেখাবো না।’

প্রিয়তা মনে পাথর চেপে বলে,’আপনাকে আমি ঘৃণা করি। আমাকে আর আপনার চেহারা দেখাবেন না।’

জাইন থমকে যায় প্রিয়তার কথা শুনে। প্রিয়তা দু হাত দিয়ে কান চেপে ধরে রাখে। এরপর কী ঘটেছে জাইন জানে না। তার কানে শুধু প্রিয়তার বলা শেষ কথা গুলো বাজছে। জাইনকে টেনে হিঁচড়ে ফ্ল্যাটের বাহিরে নিয়ে যাওয়া হয়। এরপর তাকে জোর করে বিল্ডিং হতে নামিয়ে দেওয়া হয়। এতো গুলো মানুষ একত্রে আক্রমণ করাতে জাইন বুঝে উঠতে পারেনি। একে তো মানসিক ভাবে সে দূর্বল হয়ে গেছে ফলে শারীরিক দূর্বলতাও অনুভব করছে। বিল্ডিং এর নিচে রাস্তার ধারে ধপ করে বসে পড়ে সে। ফোনটা বের করে মারুফকে কল দেয়।
‘কীরে কই তুই?’

‘প্রিয়র বাসার নিচে।’

জাইনের দূর্বল গলা শুনে মারুফের বুকে মোচড় দেয়।
‘কী হইছে তোর? তুই ঐখানেই থাক আমরা আইতাছি।’

জিপ রেখে বাইক নিয়েই ছুটে মারুফ। শাকিল আর রফিক জিপে করে পিছনে রওনা দেয়।
মারুফ এসে আগে পৌঁছায়। দূর হতে জাইনকে রাস্তার ধারে বসা দেখে বাইক ফেলেই দৌড়ে আসে।
মাথা নিচু করে বসে ছিলো জাইন। মারুফ এসে ধরতেই জাইন তাকে জড়িয়ে ধরে।
‘কী হইছে তোর? হঠাৎ না বলে বের হইছিস। প্রিয়তা কিছু বলছে?’

‘প্রিয় নাকি আমাকে চায় না। ও বলে দিয়েছে ওর কাছে পরিবার আগে।’

‘চল তুই ওকে তুলে নিয়ে যাবো। দেখি কে আঁটকায়।’

‘প্রিয় নিজেই আসতে চায় না রে। ও আমাকে ঘৃণা করে।’

মারুফ চুপ হয়ে যায়। কী বলবে বুঝতে পারছে না। প্রিয়তা না চাইলে জাইন কিছুতেই তাকে জোর করবে না এটা জানে মারুফ। শাকিল আর রফিকও এসে পৌঁছায়। এরপর জাইনকে টেনে গাড়ির কাছে নিয়ে যায়। শেষবার প্রিয়তার কক্ষের জানালার পানে তাকায় জাইন। এরপর জিপে উঠে বসে। জিপ স্টার্ট দেয়।
জাইন বলে,’আমার ভালোবাসা দেখেছো প্রিয় এবার দেখবে ঘৃণা।’

প্রিয়তাকে কক্ষে এনে ইতিমধ্যে মিসেস মাসুমা কয়েকটা চড় থাপ্পড় দিয়েছেন। রাগ না কমায় হাতের কাছে থাকা স্কেল দিয়ে কয়েক ঘা পিছে বসিয়েছেন। প্রিয়তা চুপচাপ সবটা সয়ে যাচ্ছে। না কাঁদছে না প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। সে যেনো এক পাথর। তুহিন আর বেল্লাল হোসেন এক পাশে দাঁড়িয়ে সবটা দেখছে। যেই মেয়ের গায়ে কখনো একটা আঁচড় বেল্লাল হোসেন দেননি তাকে এভাবে মারা হচ্ছে দেখেও তার মধ্যে দুঃখের ছিটেফোঁটাও দেখা গেলো না।
তুহিন বলে,’দেখছো বলছিলাম তোমার মেয়ে এক রাস্তার ছেলের সাথে ফষ্টিনষ্টি করছে এতোদিন। মান সম্মান যা ছিলো সব শেষ।’

বেল্লাল হোসেন বলেন,’কত কষ্ট করে মানুষের কাছে সম্মান আদায় করেছিলাম সব এক ঝটকায় গেলো। এই দিন দেখার আগে আমার মরণ কেন হইলো না।’

মিসেস মাসুমা বলেন,’আগে যদি জানতাম এমন মুখ পুড়ি হবি তাহলে ঐ দিনই তোরে মে রে ফেলতাম। মায়া করে তোকে পালন করার শাস্তি ভোগ করতেছি।’

তুহিন চিন্তিত হয়ে বলে,’বাসায় তো এরে রাখা যাবে না। ঐ ছেলে তো আবারো এসে আ ক্র ম ণ করতে পারে।’

বেল্লাল হোসেন হুট করে বলে,’ওকে বিয়ে দিয়ে দে। পাত্র পক্ষকে কল দিয়ে কালকেই আসতে বলে। এরে যত দ্রুত পারিস বিদায় কর ঘর থেকে।’

বাবার কথা শুনে প্রিয়তা চমকে তাকায়। সবাই এতো কিছু বলছে তা প্রিয়তা গায়ে মাখছে না কিন্তু বেল্লাল হোসেনের কথা তার গায়ে কাঁটার মতো বিধলো।

তুহিন ফোন বের করে বলে,’আমি সকালেই ওদের সাথে কথা বলবো সমস্যা নেই। মা তুমি আজকে এই রুমেই ঘুমাও। যতদিন না ওর ব্যবস্থা হচ্ছে ওরে একা ছাড়বা না একদম। চোখে চোখে রাখবা সব সময়।’

বেল্লাল হোসেন কক্ষ হতে বের হওয়ার পূর্বে বলেন,’যা সম্মান যাওয়ার গেছে এবার শুধু ওকে বিদায় করলেই বাঁচি। মানুষের সামনে এবার থেকে মাথা নিচু করে চলতে হবে আমার। কোন পাপ করেছিলাম জীবনে যার এমন ভয়ঙ্কর শাস্তি সৃষ্টিকর্তা দিলো! এমন মেয়ে আর কারো না হোক।’

কথাগুলো বলেই বেল্লাল হোসেন প্রিয়তার কক্ষ হতে বেরিয়ে যায়। প্রিয়তা বাবার যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। যে বাবা এতকাল তাকে নিয়ে গর্ব করতো সে আজ তাকে এই কথাগুলো বলে গেলো! প্রিয়তার ইচ্ছে করে ম রে যেতে। এমন কলঙ্ক নিয়ে বেঁচে থাকার চেয়ে ম রে যাওয়া তার কাছে অধিক শ্রেয়।

………..
(চলবে..)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|২৯.| (১৮+ সতর্কতা)
(কপি পোস্ট নিষেধ)
………

তিনদিন হয়ে গেলো জাইনের কোনো খোঁজ খবর নেই। মিসেস পারুল চিন্তায় অসুস্থ হয়ে গেছেন। ছেলের ফোন বন্ধ এমন কী তার বন্ধুরাও জানে না সে কোথায়। রমিজউদ্দিন ইতিমধ্যে পুলিশের সাথে যোগাযোগ করেছেন। যেহেতু জাইন রাজনীতির সাথে যুক্ত তাই পুলিশ সন্দেহ করছে তার কোনো শত্রু তাকে গুম করে দিয়েছে। রমিজউদ্দিনের কানে কিছু কথা হাওয়ায় ভেসে এসেছে। জাইন নাকি কোন মেয়ের বাসায় গিয়ে তাকে তুলে আনতে চাইছিলো এরপর সেখান থেকে অসফল হয়ে বের হয়। তারপর থেকেই জাইন নিরুদ্দেশ। রমিজউদ্দিন অবশ্য এসব বিশ্বাস করেন না। তার নিজের সন্তানের প্রতি যথেষ্ট ভরসা আছে। তিনি মনে করেন লোকে গুজব ছড়াচ্ছে। আর যা ই হোক জাইন এসব করবে না সেটা সে বিশ্বাস করে।

একা হাতে ছেলের খোঁজ করছেন অপরদিকে মিসেস পারুল অসুস্থ হয়ে গেছে এতে রমিজউদ্দিনের দিশেহারা অবস্থা। জারিফের জন্য যেই পাত্রী দেখে এসেছে তাদের পরিবার বলেছে তারা পাকা কথা বলতে চায়। অজুহাত দিয়ে আপাততঃ তাদের কাছ থেকে সময় চেয়ে নিয়েছেন। তিনি চান না জাইনের বিষয়টা পাত্রীর পরিবার জানুক। সবটা গোপন রেখেছেন।

তুহিন অফিসের জন্য তৈরি হয়ে বসার ঘরে আসে। মিসেস মাসুমা তাকে খেতে দেয়। বেল্লাল হোসেনও খেতে বসেছে। খাবারের টেবিলে শুধু প্রিয়তা অনুপস্থিত।
বেল্লাল হোসেন প্রশ্ন করে,’পাত্র পক্ষের সাথে কথা বলছিস?’

তুহিন উত্তর দেয়,’ওনারা বললো একটু ব্যস্ত। তবে দু এক দিনের ভেতর আসবে নিশ্চিত। স্যারের কত বড় বড় ব্যবসা। বুঝোই তো ব্যস্ত থাকে। এতো বড় ব্যবসায়ী সে। তাদের পরিবারে প্রিয়তা গেলে রাজরানী হয়ে থাকবে।’

বেল্লাল হোসেন বলেন,’বিয়েটা একদম ঘরোয়া ভাবে হবে। কাউকে জানানোর দরকার নাই।’

‘চিন্তা কোরোনা সবটা আমি ম্যানেজ করে নিবো।’

মিসেস মাসুমা বলে,’প্রিয়তা তো একদম খাওয়াদাওয়া বন্ধ করে দিছে। এইরকম চললে তো ও অসুস্থ হয়ে যাবে।’

বেল্লাল হোসেন বলে,’জোর করে খাওয়াও। আমি রাতে এসে ওর সাথে কথা বলবো।’

মিসেস মাসুমা সাহস নিয়ে বলে,’আচ্ছা বিয়েটা আপাততঃ না দিলে হয় না? মেয়েটাকে এখন বিয়ে দিলে যদি উল্টাপাল্টা কিছু করে। ওর যা জেদ।’

বেল্লাল হোসেন গম্ভীর গলায় বলে,’যা সম্মান ছিলো তা তো শেষ করেই দিয়েছে। এখন ওরে ঘরে রাখলে লোকে আরো কথা রটাবে। পরে বিয়েই দিতে পারবো না।’

তুহিন বলে,’মা তুমি এসবে ঢুকো না। আমাদেরকে বুঝতে দাও।’

মিসেস মাসুমা বলে,’আমার মনে হয় প্রিয়তার দোষ নেই এখানে। ছেলেটাই হয়তো ওকে বিরক্ত করতো। শুধু শুধু মেয়েকে ভুল বুঝতেছি আমরা।’

মিসেস মাসুমার কথা শুনে বেল্লাল হোসেন চোখ তুলে তাকায়।
মিসেস মাসুমা আরো বলেন,’ও হয়তো বুঝতে পারেনি ছেলেটা এমন কিছু করবে। বুঝলে আমাদেরকে আগেই জানাতো। মেয়েটার সাথে বসে খোলাখুলি কথা বলো। মেয়েটা না ঠিকমতো খাচ্ছে না ঘুমাচ্ছে। রাতের বেলা ঘুম ভাঙলে দেখি জানালার পাশে বসে থাকে।’

‘ঠিক আছে বিষয়টা আমি দেখছি।’
বেল্লাল হোসেনের কথায় মিসেস মাসুমা খানিকটা আশ্বস্ত হয়।

………..

দুপুর বেলা প্রিয়তা জামাকাপড় ভাজ করছিলো এমন সময় বাসার কলিংবেল বাজে। মিসেস মাসুমা রান্নাঘর থেকে বেরিয়ে দরজা খুলে। রুমার মা ভেতরে প্রবেশ করে।
‘ভাবী ব্যস্ত আপনি?’

মিসেস মাসুমা বিরস মুখে জবাব দেয়,’না ভাবী বলেন।’

‘আমি একটু হাসপাতালে যাবো আমার এক আত্নীয়কে দেখতে। রুমার তো পরীক্ষা নেইলে ওরেও নিতাম। বাসায় একা থাকলে তো পড়বে না তাই ভাবলাম আপনার বাসায় দিয়ে যাই।’

‘ঠিক আছে ভাবী।’

‘আপনার মেয়েটা কিন্তু অনেক ভালো ভাবী। একটা সামান্য ভুল করছে তাতে কী মেয়ে তো ভালো।’
রুমার মায়ের খোঁচা মারা কথা মিসেস মাসুমা চুপচাপ হজম করে নেন। মহিলা দরকারে ছুটে আসে আবার সুযোগ পেয়ে ঠিকই খোঁচা মেরে কথা শোনাচ্ছে। যেহেতু এখন খারাপ সময় চলছে তাই প্রিয়তার মা চুপচাপ থাকে রুমার মাকে পাল্টা জবাব দেয় না।

‘আপনি রুমাকে পাঠিয়ে দেন আমি রান্নাঘরে কাজ করতেছি তো।’

রুমার মা প্রিয়তার কক্ষের দিকে উঁকি দেন।
‘ভাবী প্রিয়তা বাসায়?’

‘হ্যা বাসায় আছে। চাইলে গিয়ে দেখতে পারেন।’

‘না ভাবী আমি মানুষের ঘরে উঁকি ঝুকি দেই না একদম। আমি গেলাম ভাবী দেরি হয়ে যাবে নইলে আসতে।’

রুমার মা যেতেই প্রিয়তার মা ভেংচি কাটে। বিরবির করে বলে,’সুযোগসন্ধানী মহিলা।’

রুমার মা ওকে বুঝিয়ে রেখে চলে যান। ঘরের দরজা বন্ধ করে মিসেস মাসুমা রান্নাঘরে ছুটেন। রুমা আস্তে আস্তে প্রিয়তার কক্ষের দিকে যায়। দরজার বাহির থেকে দেখে কাপড় হাতে নিয়ে অন্যমনষ্ক হয়ে দাঁড়িয়ে আছে প্রিয়তা। তাকে দেখে মনে হচ্ছে কাপড় ভাজ করছিলো। রুমা প্রিয়তার ধ্যান ভাঙতে দরজায় টোকা দেয়। শব্দ পেয়ে চমকে তাকায় প্রিয়তা। রুমাকে দেখে চোখ সরিয়ে ফেলে। তার চেহারা দেখে মনে হচ্ছে সে গভীর ভাবে কিছু ভাবছিলো।
রুমা সাহস করে বলে,’আপু ভেতরে আসবো?’

‘আসো,বসো।’

রুমা ভেতরে প্রবেশ করে বিছানার এক পাশে বসে। বইগুলো পাশে রাখে। প্রিয়তা দ্রুত কাপড় গুলো সরানোর চেষ্টা করে।
প্রিয়তা বলে,’হঠাৎ এলে যে?’

‘মা হাসপাতালে গেছে রুগী দেখতে তাই।’

‘ওহ,তোমার পরীক্ষা কবে?’

‘সামনের মাসে।’

প্রিয়তা ততক্ষণে কাপড়গুলো সরিয়ে ফেলেছে।
রুমা হুট করে প্রশ্ন করে,’জাইন ভাইয়ের খবর জানো?’

জাইনের নাম শুনে পিছন ফিরে প্রিয়তা তাকায়। এগিয়ে এসে দরজা চাপিয়ে দেয়।
‘কী হয়েছে?’

‘ভাইয়ার কোনো খোঁজ নেই উনি নিরুদ্দেশ।’
রুমার কথা শুনে প্রিয়তার বুকের ভেতর ধক করে ওঠে।

রুমাকে হালকা ধমকে বলে,’কী যা তা বলছো? নিরুদ্দেশ কেনো হবে? কাজে হয়তে ব্যস্ত।’

‘না আপু ভাইয়া নিরুদ্দেশ। রফিক,শাকিল ভাই,মারুফ ভাই হন্য হয়ে তাকে খুঁজছে।’

প্রিয়তা উতলা হয়ে প্রশ্ন করে,’কতদিন হলো?

‘তিনদিন কেটে গেছে।’
প্রিয়তা ঢোক গিলে।

রুমা প্রশ্ন করে,’তুমি সত্যি জাইন ভাইয়াকে রেখে অন্য জায়গায় বিয়ে করবে?’

‘এ কথা তোমায় কে বললো?’

‘মা আর পাশের আন্টি এসব নিয়ে বলাবলি করছিলো। বলছিলো তুমি নাকি প্রেম করে ধরা খেয়ে এখন আরেকজনের গলায় ঝুলে পড়তে চাইছে।’

‘তোমারও কী তাই মনে হয়?’

‘মনে হলে তো বলতাম না। তোমাকে আমার ভালো লাগে। জাইন ভাইয়া আর তোমাকে একত্রে সুন্দর লাগে।’

রুমার কথা শুনে প্রিয়তা মৃদৃ হাসে।

‘আপু তুমি জাইন ভাইয়াকে ছেড়ো
না। তোমাকে সে অনেক বেশি ভালোবাসে।’

প্রিয়তা রুমার মাথায় হাত রাখে। মেয়েটাকে যতটা খারাপ ভেবেছিলো ততটা সে খারাপ নয় বরং বেশ ভালো। ওর মায়ের চরিত্রের সাথে ওর মিল নেই।

‘রুমা আমার একটা কথা রাখবা?’

‘কী কথা?’

‘আগে বলো রাখবা।’

‘আচ্ছা।’

‘আমার বিয়ের বিষয়ে রফিককে কিছু বলেছো?’

‘না আপু ও জাইন ভাইকে খোঁজায় এতে ব্যস্ত যে আমাদের কথাই হয় না।’

‘আমার বিয়ের কথা কাউকে বলবা না। রফিককেও না। রফিক জিজ্ঞেস করলে বলবা মিথ্যা।’

‘কিন্তু আপু।’

‘তুমি আমাকে কথা দিয়েছো রুমা।’

‘ঠিক আছে আপু।’
রুমার মন খারাপ হয়ে যায়। প্রিয়তার মনে উদয় হয় জাইনের চিন্তা। জাইন কোথায় আছে কেমন আছে একবার জানতে পারলে শান্তি পেতো। হঠাৎ মনে হয় রুমার তো ফোন আছে। আর জাইনের নাম্বার সে লিখে রেখেছিলো।
‘রুমা রাতে তুমি আমার সাথে থাকবা প্লিজ।’
প্রিয়তার প্রস্তাবে রুমা চমকায়।

‘তোমার ফোন নিয়ে আসবা কিন্তু কেউ যাতে না জানে। আর শুনো থাকার জন্য তুমি বায়না করবা। আমি বললে সবাই সন্দেহ করবে।’

প্রিয়তার কথায় রুমা মাথা ঝাকায়। প্রিয়তা এবার ভাবে কীভাবে কি করবে।

…..

রুমার মা বাসায় ফিরে সন্ধ্যার পর। রুমাকে নিতে আসলে সে জানায় আজকে প্রিয়তার ঘরে বসেই পড়বে। একা একা তার পড়া হচ্ছে না।
রুমার মা প্রথমে না করলেও পরে মেয়ের জেদের কাছে হার মানে। প্রিয়তার বাসার কেউ বিষয়টা অন্য ভাবে নেয় না। রুমা প্রিয়তার পড়ার টেবিলে বসে অংক কষছে আর প্রিয়তা বিছানায় বসা। এমন সময় মিসেস মাসুমা তাকে ডাকতে আসে।
‘তোর বাবা তোকে ডাকছে।’

রুমাকে অংকটা বুঝিয়ে দিয়ে বাবার কক্ষের দিকে অগ্রসর হয় সে। কক্ষের দরজার সামনে দাঁড়ায়।
নিচু গলায় বলে,’ডেকেছো?’

বেল্লাল হোসেন মেয়ের দিকে না তাকিয়ে জবাব দেয়,’হ্যাঁ। তোমার সাথে কথা আছে।’

‘বলো শুনছি।’

‘পাত্রপক্ষ এলে তোমার মতামত জানতে চাইতে পারে। পাত্রকে দেখে ভালো লাগুক আর না লাগুক তুমি বলবা তোমার পছন্দ হয়েছে।’

প্রিয়তা তাচ্ছিল্য স্বরে প্রশ্ন করে,’বিয়েটা তবে দিয়েই দিচ্ছো?’

‘বাবা হিসেবে এখন আমার যা করা উচিত তা করছি। আর যেটা বললাম মাথায় রেখো। এখন যাও।’
প্রিয়তাকে আর কোনো কথা বলার সুযোগ দেওয়া হয় না। প্রিয়তা এখন এগুলো স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে। চলে আর না দাঁড়িয়ে নিজ কক্ষে চলে যায়। বেল্লাল হোসেন তাকে খাবারদাবারের বিষয়ে কিংবা সে কেমন আছে জিজ্ঞেস করার প্রয়োজনবোধ করলো না।

রাতের বেলা খাওয়াদাওয়া শেষে বিছানায় বসে রুমা৷ কক্ষের দরজা লাগিয়ে প্রিয়তাও এসে সামনে বসে। ছোট্ট ব্যাগ থেকে নিজের লুকায়িত ফোনটা বের করে রুমা। ফোনটা হাতে নিয়ে জাইনের নাম্বার তুলে ডায়াল করে। প্রিয়তার ভেতরে ধুকপুকানি হচ্ছে ভীষণ। কলের অপরপাশ থেকে জানায় ডায়ালকৃত নাম্বারটি বন্ধ। কল কেটে আবারে ডায়াল করে। প্রতিবার একই উত্তর ‘আপনার ডায়ালকৃত নাম্বারটি এই মূহুর্তে বন্ধ আছে।’

কান থেকে ফোন নামিয়ে হতাশ চোখে তাকায় প্রিয়তা। রুমা বুঝতে পারে প্রিয়তার মনের অবস্থা। এবার সত্যি জাইনের জন্য অনেক বেশি চিন্তা হচ্ছে প্রিয়তার। রুমা এগিয়ে এসে প্রিয়তার পিঠে হাত রাখে। প্রিয়তা আবেগী হয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে। রুমার বুঝে উঠতে পারে না এই সময়টাতে কীভাবে প্রিয়তাকে স্বান্তনা দিবে। তার মনে পড়ে সে কাঁদলে তার মা তার মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়৷ কিন্তু প্রিয়তা তো কাঁদছে না তাহলে কী করবে? সেও হাত তুলে প্রিয়তার মাথায় রাখে। আস্তে আস্তে বুলাতে শুরু করে।


পাশ ফিরে শুতেই প্রিয়তার নাকে তীব্র তামাকের গন্ধ আসে। সবেই চোখটা লেগেছিলো তার। তামাকের গন্ধে শুয়ে থাকতে পারলো না। চক্ষু মেলে সামনে তাকালো। বারান্দা হতে আসা আলোতে দেখতে পায় বিছানায় সটানভাবে কেউ শুয়ে আছে। মস্তিষ্ক সচল হতেই দ্রুত উঠে বসে প্রিয়তা। পুরো কক্ষে চোখ বুলালে রুমাকে দেখতে পায় না সে। বিছানা থেকে নামতে নিলেই তার হাত আঁকড়ে ধরে। ভয়ে প্রিয়তা মূর্তি হয়ে যায়। তার বাম হাতের আঙুলের ভাঁজে নিজের ডান হাতের আঙুলগুলো যত্ন করে ডুবিয়ে দিচ্ছে লোকটা। এরপর প্রিয়তার সেই ধরে রাখা হাতটা টেনে বুকের উপর রাখে।
ঠান্ডা গলায় প্রশ্ন করে,’ডিড ইউ মিসড মি?’

প্রিয়তা কোনো উত্তর দেয় না। সে এখনো পিছনে ফিরে আছে। ঘুরে আরেকবার তাকানোর সাহস নেই তার।

আবারো শুনতে পায়,’আই মিসড ইউ। তাই তো বেহায়ার মতো আবারো চলে এসেছি।’

প্রিয়তার হাত এনে গালে ঘষা দেয় জাইন। দাঁড়ির সংস্পর্শে মৃদু ব্যথা পায় প্রিয়তা। এরপর হাতের উল্টো পিঠে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে উষ্ণ পরশ দেয় জাইন।

‘তুমি আমাকে পা গ ল,বেহায়া প্রেমিক বানিয়ে দিয়েছো। এখন বলো কীভাবে এই প্রেমিককে সামলাবা।’

প্রিয়তার কাছ থেকে জবাব না পেয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে। প্রিয়তার হাত না ছেড়েই তার পিছনে একটু খানি দূরত্ব রেখে বসে। অপর হাত দিয়ে পিঠে ছড়িয়ে থাকা উন্মুক্ত কেশগুলো যত্ন করে এক পাশে সরিয়ে দেয়।
প্রিয়তার কানের কাছে ওষ্ঠ নিয়ে ধীর গলায় প্রশ্ন করে,’আমি তোমার কী হই প্রিয়?’

বাস্তবতায় ফিরতেই প্রিয়তা বিছানা থেকে উঠে দাঁড়ায় কিন্তু জাইন এখনো তার হাত ধরে রেখেছে।
প্রিয়তা ভীতু গলায় প্রশ্ন করে,’আপনি এখানে কীভাবে এলেন? কেউ দেখতে পেলে কেলেঙ্কারি হয়ে যাবে।’

জাইন ঐভাবেই হাত ধরে রেখে বিছানায় বসে বলে,’আমার প্রশ্নের উত্তর দাও।’

‘যেই প্রশ্নের কোনো ভিত্তি নেই সেই প্রশ্নের উত্তর কীভাবে দিবো? আমাদের মধ্যে কখনোই কিছু ছিলো না।’

‘কিছু না থাকলে বুঝি কিছু হওয়া যায় না?’

‘অবশ্যই না।’

‘কিন্তু আমি তো অন্য কিছু জানি।’

‘কী?’

জাইন বিছানা থেকে নেমে প্রিয়তার সামনে দাঁড়ায়। হাতটা টেনে নিজের হৃদপিণ্ডর উপর রাখে।
‘অনুভব করছো কিছু? স্বাভাবিক ভাবে যতটা ওর লাফানো উচিত সে তার দ্বিগুণ স্পিডে লাফাচ্ছে। কেনো বলো তো? তুমি কাছে আছো তাই।’

প্রিয়তা খেয়াল করে দেখে জাইন ঠিকই বলছে ধুকপুক করে হৃদপিণ্ডটা দ্বিগুণ বেগে লাফাচ্ছে। জাইনের শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে গেছে। চোখ তুলে প্রিয়তা জাইনের দিকে তাকায়। প্রিয়তা দৃষ্টি সরিয়ে ফেলে। সে জানে বেশিক্ষণ ঐ দৃষ্টিতে তাকালে নিজেকে সামলাতে পারবে না। জাইন প্রিয়তার চিবুক ধরে আবারো নিজের দিকে ফেরায়।

আদুরে গলায় জাইন বলে,’তাকাও আমার দিকে।’

প্রিয়তা জাইনের দৃষ্টিতে দৃষ্টি মেলায়।
‘কী দেখতে পাচ্ছো?’

আনমনে প্রিয়তা উত্তর দেয়,’আমাকে।’

‘শুধু আমার দৃষ্টিতে না,তুমি বিচরণ করছো আমার শিরায় উপশিরাতে। তোমাকে কীভাবে ভুলে যাবো বলো। আমি তো এখন একটা মূহুর্তের জন্যও তোমার নাম মাথা থেকে সরাতে পারি না। বিগত তিনদিন অনেক চেষ্টা করেছি কিন্তু পারিনি।’

কথাগুলো বলে জাইন থামে। প্রিয়তা জাইনের দৃষ্টিতে নিজের জন্য একরাশ ভালোবাসা দেখতে পায়।

‘কী করবো বলে দাও। কী করলে তোমায় ভুলতে পারবো বলো। আমি সব করবো তোমায় ভুলতে। তবুও তুমি আমার কারণে কষ্ট পেয়ো না।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তার গলা ধরে আসে। ইচ্ছে করে এক্ষুণি জড়িয়ে জাইনের কষ্ট কমিয়ে দিতে। নিজেকে আঁটকে ফেলে সে।

প্রিয়তা অস্ফুটে স্বরে বলে,’আম সরি। আপনি কষ্ট পাবেন জেনেও অমনটা করেছি।’

জাইন প্রিয়তার ওষ্ঠে আঙুল রেখে তাকে থামায়।
‘হুঁশশ একদম সরি বলবা না। আমি পা গ লা মি না করলে এতো ঝমেলা হতো না। আমার জন্য মুখ বুঁজে সবটা সহ্য করছো না বললেও তা জানি আমি।’

প্রিয়তা অশ্রুসিক্ত নয়নে জাইনের পানে দৃষ্টি রাখে।
জাইন স্বাভাবিক গলায় বলে,’আরেকটু সহ্য করো। পরিস্থিতি ঠান্ডা হলে আমি বাবা-মাকে নিয়ে আসবো। তারা তোমার পরিবারকে বুঝাবে। জোর জবরদস্তি করে কিছু করবো না। তোমার বা তোমার পরিবারের অসম্মান হয় এমন কিছু জাইন রহমান করবে না।’

‘আমার একটা অনুরোধ রাখবেন?’

‘আমি জানি তুমি কী অনুরোধ করবা। তোমায় ভুলে যেতে,আর কখনোই তোমার সামনে না আসতে। তাই তো?’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা চমকায়। জাইন মৃদু হাসে প্রিয়তার প্রতিক্রিয়া দেখে।

‘বেশ তাহলে তা-ই হোক। আজকের পর থেকে আমি জাইন রহমান কথা দিচ্ছি তোমাকে আর বিরক্ত করবো না। তোমাকে দেখার তৃষ্ণায় ছটফট করবো তবুও তোমার কাছে ছুটে আসবো না।’

কথাগুলো বলে জাইন মুখটা প্রিয়তার কানের কাছে নেয় এরপর ফিসফিস করে বলে,’তোমাকে দেখার তীব্র তৃষায় পু ড়ে ছারখার হয়ে আমার ম র ণ হোক। আর এই প্রেমিকের করুণ অবস্থা দেখে তোমার ভেতরে চিরকাল আহাজারি হোক। আই লাভ ইউ প্রিয়। লাভ ইউ এ লট।’

জাইনের বলা প্রতিটি কথা প্রিয়তাকে ভেতর থেকে মুচড়ে দিচ্ছে।
‘ক্যান আই কিস ইউ?’

প্রিয়তা কোনো উত্তর দেয় না। মৌনতা সম্মতির লক্ষ্মণ ভেবে জাইন প্রিয়তার গালে ওষ্ঠ রেখে শব্দ করে চুম্বন দেয়।
সাথে সাথে প্রিয়তার তন্দ্রা ভেঙে যায়। হুড়মুড়িয়ে শোয়া থেকে উঠে বসে সে। পাশে তাকাতেই দেখে রুমা বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। পুরো কক্ষে চক্ষু বুলালে দেখে কোত্থাও জাইন নেই। তারমানে জাইনকে নিয়ে ভাবতে ভাবতে এতক্ষণ স্বপ্ন দেখেছে সে!

……..
(চলবে..)