প্রণয়ী পর্ব-৩০+৩১

0
15

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|৩০.|
(লেখা কপি করা নিষেধ)
………….

অফিস থেকে ফিরেই তুহিন তার বাবার কক্ষে ঢুকলো। সদ্য শুনে আসা কথাগুলো বলতে গিয়ে আঁটকে গেলো। ভেতরে ভেতরে চিন্তা করলো বলবে কিনা এরপর কক্ষ হতে বেরিয়ে যেতে উদ্যত হলো। বেল্লাল হোসেন ছেলের কান্ড দেখে গলা উঁচিয়ে ডাকে।

‘কিছু বলবি?’

‘না তেমন কিছু না।’

‘পাত্র পক্ষ কবে আসবে?’

‘কালকে আসবে জানালো।’

‘ঠিক আছে তাহলে সব ব্যবস্থা কর।’

‘করবো সমস্যা নেই।’

‘তোর সাথে আমার কথা আছে।’

‘বলো শুনছি।’

প্রিয়তা এতক্ষণ কক্ষে বসে বইখাতা গুলো নেড়েচেড়ে দেখছিলো। বেল্লাল হোসেন বাসায় ফিরেছেন একটু আগে। প্রিয়তা শব্দ পেয়েছে। তার বাবার সাথে গুরুত্বপূর্ণ কথা আছে এক্ষুণি বলতে হবে। গত রাত থেকে ভেবে রেখেছে কথাগুলো বলবে। ওড়না মাথায় দিয়ে চুপচাপ নিজ কক্ষ হতে বের হয় সে। বাবার কক্ষের দরজার সামনে যেতেই অবাক হয় সে। দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। সাধারণত বেল্লাল হোসেনের কক্ষের দরজা সবসময় খোলা থাকে আজ হঠাৎ করে এই সময় কেনো বন্ধ তা বুঝতে পারছে না প্রিয়তা। ভেতর থেকে তুহিনের গলা পায়। দরজার ফাঁকায় কান পাতে। আশ্চর্য ভেতরে মিসেস মাসুমাও রয়েছে! প্রিয়তা এবার কৌতুহলী হয় জানার জন্য ভেতরে কী চলছে।
প্রথমে বেল্লাল হোসেনের গলা পায় সে কিছু বলছে এরপর তুহিনের গলা পায়। দু’জনের কথাবার্তা শুনে প্রিয়তার শরীর ছেড়ে দেয়। মূহুর্তেই তার চোখমুখ বিষাদ নেমে আছে। ইচ্ছে করে তাদের সামনে গিয়ে প্রশ্ন করতে যা এতক্ষণ বলেছে সবটা সত্যি কীনা? ওড়নার শেষাংশ দিয়ে মুখ চেপে কান্না আঁটকায় সে। যা শোনার শুনে নিয়েছে আর শুনতে ইচ্ছে করলো না। আরেকটু দাঁড়ালে ঐ খানেই কাঁদতে শুরু করবে। এক ছুটে নিজের কক্ষে গিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয় সে।

হাত পা মেলে মেঝেতে বসে পড়ে। কথা বলার শক্তি সে হারিয়ে ফেলেছে। দুই হাত দিয়ে মাথা চেপে বসে থাকে। ফুঁপিয়ে কেঁদে ওঠে সে। কান্নার বেগ এতো বেড়ে গেছে যে এবার তার হুঁশ নেই সে শব্দ করে কাঁদছে। ভেতর থেকে বেরিয়ে আসছে আহাজারি।
তুহিন আর মিসেস মাসুমা বেল্লাল হোসেনের কক্ষ হতে বের হয়েছে। তুহিনের কানে প্রিয়তার কান্নার শব্দ আসতেই সে এগিয়ে যায়। মিসেস মাসুমাও এগিয়ে যায়।
‘কিরে তুই কাঁদছিস কেনো? দরজা খোল।’
মিসেস মাসুমা দরজায় করাঘাত করে বলে। প্রিয়তা দরজা খুলে না। কান্নার বেগ কমে এসেছে। হাতের উল্টোপিঠে অশ্রু মুছে নেয়। এ
ধীরে ধীরে কান্নার শব্দ এবং বেগ উভয়ই কমে যায়।

তুহিন বলে,’ছাড়ো পরে বের হবে। অনেক কাজ আছে চলো।’
তুহিন চলে যায় নিজ কক্ষের দিকে। কয়েকবার কড়াঘাত করে মিসেস মাসুমাও চলে যায়।
দুই পা একত্রে করে তাতে মাথা রেখে ঐ ভাবেই বসে থাকে প্রিয়তা। এই সময়টা তার জন্য বড্ড অভিশপ্ত। দোয়া করতে থাকে দ্রুত যেনো সময়টা কেটে যায়।

____________

অনেকদিন পর ছাদে বসে আছে প্রিয়তা। তার গায়ে শোভা পাচ্ছে সুতির নীল রাঙা একখান শাড়ি। আঁচলটা মাথার উপর দিয়ে রাখা হয়েছে। ফুল গাছ গুলোর দিকে এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে। সবার মতো এতোদিন প্রশ্নটা উদয় না হলেও আজ ঠিকই প্রশ্নটা উদয় হচ্ছে।’আচ্ছা জাইন কেনো নিরানব্বইটা গাছ এনেছে একশত টা কেনো নয়?’
নিজের করা প্রশ্নের উত্তর নিজেই হাতরে খুঁজতে থাকে। কিন্তু উত্তর নেই তার কাছে। ছাদে বসে আজ সব কিছুই দেখত তার ভালো লাগছে। এতদিন ঘরের কোণায় থেকে এক প্রকার অতিষ্ঠ হয়ে গেছিলো সে।
‘উহুম।’
কাশির শব্দে প্রিয়তার চোখ তুলে পাশে তাকায়। কালো রঙের কোর্ট প্যান্ট পরিহিত এক যুবক দাঁড়িয়ে আছে। ভেতরে সাদা রঙের শার্ট। চুলগুলো জেল দিয়ে সেট করা। লোকটাকে দেখে বুঝা যাচ্ছে সে বেশ গোছালো। প্রিয়তা বেঞ্চ থেকে নেমে রেলিং এর কাছে গিয়ে দাঁড়ায়। রেলিং এর দু পাশে হাত রেখে আবারো লোকটার দিকে তাকায়। লোকটার বয়স তিরিশের অধিক। কত হবে আন্দাজ করতে পারছে না এই মূহুর্তে। এই তেত্রিশ কিংবা চৌত্রিশ হবে নিশ্চয়ই! আরো কম বেশিও হতে পারে। তাকে যুবক বলে সমন্ধ করবে নাকি অন্য কিছু বুঝতে পারছে না।
অপরপাশ থেকে কোনো প্রশ্ন না করাতে প্রিয়তাই প্রথমে প্রশ্ন করে।
‘আপনার বয়স কত?’
জারিফ থতমত খায় এমন প্রশ্ন।
‘জি?’

প্রিয়তা বিরক্তি নিয়ে আবারো বলে,’শুনতে পান না? আপনার বয়স কত?’

‘জি তেত্রিশ।’

‘এতোদিন বিয়ে করেননি কেনো?’

‘সময় পাইনি। কাজে ব্যস্ত থাকি।’

‘এখন সময় পেয়েছেন?’

‘জি।’

‘গুড। মাসে কত কামান?’

প্রিয়তার প্রশ্ন শুনে জারিফ চমকাচ্ছে। তার মা বলেছিলো মেয়ে একদম চুপচাপ। বাড়তি কথা বলে না কিন্তু এখন দেখছে সম্পূর্ণ উল্টো।

‘কী হলো উত্তর দিচ্ছেন না কেনো?’

‘ছয় ডিজিটের সংখ্যা।’

‘বাহ্! তাহলে তো আপনি বিলাসবহুল জীবন যাপন করেন।’

‘না তেমন কিছু না।’

প্রিয়তা এবার সিরিয়াস গলায় বলে,’নিচে গিয়ে বলবেন আপনার আমাকে পছন্দ হয়নি। ওকে?’

‘এটা কেনো বলবো?’

‘কারণ আমার আপনাকে পছন্দ হয়নি তাই।’

‘তাহলে সেটা আপনি বলুন।’

‘আমি বললে পরিবার শুনবে না তাই আপনি আমাকে রিজেক্ট করবেন, বুঝেছেন?’

জারিফ মাথা নাড়ায় যার অর্থ সে বুঝেছে।

প্রিয়তা গুনগুন করতে করতে ছাদের সিঁড়ি বেয়ে নেমে গেলো। জারিফ ও তার পিছন পিছন নামলো। বসার ঘরে সবাই আলাপ করছে। জারিফ ঢুকে তার বাবার পাশে বসলো। প্রিয়তা নিজ কক্ষে চলে গেছে কিন্তু দরজায় কান পেতে রেখেছে।
জারিফ তার বাবার কানে কানে কিছু বলে। রমিজউদ্দিন স্ত্রী কে ইশারা করে। মিসেস পারুল মুচকি হেসে বলে,’আলহামদুলিল্লাহ আমার ছেলের আপনাদের মেয়েকে পছন্দ হয়েছে। আর কোনো আপত্তি নেই আমাদের। আপনারা মেয়েকে নিয়ে আসুন।’

মিসেস পারুলের কথা শুনে প্রিয়তার মাথায় চক্রর দেয়। মিসেস মাসুমা হাসিমুখে প্রিয়তার কক্ষের দিকে যায়। প্রিয়তা চুপচাপ মাথা নিচু করে বসার ঘরে তার মায়ের সাথে যায়।

রমিজউদ্দিন বলে,’মেয়ের মতামত জানতে চাই।’

তুহিন বলে,’ও ছোট মানুষ ও আবার কী বলবে। বাবা যা বলবে তাই ওর সিদ্ধান্ত।’

রমিজউদ্দিন বলে,’তবুও শুনতে চাই। তোমার কী মতামত বলো মা।’

প্রিয়তা স্বাভাবিক গলায় বলে,’আমি এই বিয়েতে রাজি।’

কিছু পড়ার ধপ করে শব্দ হলে সকলে চমকে দরজার দিকে তাকায়। ফ্ল্যাটের দরজা খোলাই ছিলো। দরজায় জাইন দাঁড়িয়ে আছে। মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে সদ্য হাত থেকে পড়ে ভেঙে যাওয়া দইয়ের হাঁড়ি।

প্রিয়তা জাইনের দিকে তাকিয়ে বলে,’এই শুক্রবারই বিয়ে হোক।’

জাইনের চোখে মুখে অবিশ্বাস্য চাহনি। শুধু জাইন না তুহিন,বেল্লাল হোসেন,মিসেস মাসুমা সহ জারিফেরও একই অবস্থা। জারিফ ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে আছে। মেয়েটা তার সাথে চালাকি করলো! কেউ কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই জাইন দ্রুত বড় বড় কদম ফেলে নেমে যায়। প্রিয়তা জাইনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে রয়। তার প্রতিক্রিয়া বুঝা গেলো না। তুহিন,বেল্লাল হোসেন,মিসেস মাসুমার এতোক্ষণ যেনো শ্বাস আঁটকে ছিলো। জাইন যেতেই একে অপরের দিকে তাকায়। রমিজউদ্দিন ছেলের এমন আচরণে অখুশি হয়।
বেল্লাল হোসেন কী বলবেন বুঝতে পারছেন না। এর পূর্বেই রমিজউদ্দিন মুখ খুলে।

‘আমার মেজ ছেলের আচরণে কিছু মনে করবেন না। হাঁড়িটা পড়ে ভেঙে গেছে তাই হয়তো লজ্জা পেয়ে চলে গেছে।’

জাইন রমিজউদ্দিনের ছেলে শুনে বেল্লাল হোসেন চমকে তুহিনের দিকে তাকায়। তুহিন কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। সে তো গতকালকেই বিষয়টা জেনে কিন্তু বাবাকে জানায়নি যদি জানার পর বিয়েটা ভেঙে যায় সেটা ভেবে। মিসেস মাসুমারও একই অবস্থা। বেল্লাল হোসেন বুঝতে পারে তুহিন সবটা জানতো।

মিসেস পারুল পরিস্থিতি ঠিক করতে উঠে এসে প্রিয়তার হাত ধরে।
‘ও আজকেই বাসায় ফিরেছে। ঘুম হয়নি তো। বাহিরে কাজে ছিলো। জোর করে অনেক বলে তারপর ওকে আসতে বলেছিলাম। হয়তো বাসায় ঘুমাতে চলে গেছে। আমরা আমাদের কথাবার্তা সেরে ফেলি।’
প্রিয়তা মিষ্টি হেসে বলে,’সমস্যা নেই। যার সাথে বিয়ে সে থাকলেই হবে।’

মিসেস মাসুমা মেয়ের দিকে অবিশ্বাস্য চোখে তাকায়। যেই মেয়ে বিয়ে করবে না বলে খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছে সে এখন রাজি। ঘটনা কিছুতেই তার মাথায় ঢুকছে না। মিসেস পারুল বাক্স থেকে একটা আংটি বের করে প্রিয়তার অনামিকা আঙুলে পরিয়ে দেয়।
প্রিয়তার মাথায় হাত বুলিয়ে কপালে চুমু দেয়।
‘দোয়া করি অনেক সুখী হও।’

প্রিয়তা বলে,’আমিন।’
নিহারিকা এগিয়ে এসে প্রিয়তার হাত ধরে তার কক্ষের দিকে যায়। প্রিয়তা নিহারিকাকে বলে নুহাশকেও ডাকতে। তিনজনে গিয়ে প্রিয়তার কক্ষে বসে।

রমিজউদ্দিন বলে,’তাহলে তারিখ পাকা করি।’

বেল্লাল হোসেন বলে,’আগে আমি একটু ভেতর থেকে কথা বলে আসি।’

তুহিন হাসি দিয়ে বলে,’স্যার একটু ফ্যামিলি মিটিং।’

রমিজউদ্দিন হেসে দেয়।
‘অবশ্যই, গো এ্যহেড।’

বেল্লাল হোসেন,তুহিন,মিসেস মাসুমা কক্ষে প্রবেশ করে দরজা চাপিয়ে দেয়।

বেল্লাল হোসেন বলে,’এই ঘরে মেয়ে বিয়ে দিবো না।’

‘কেনো বাবা? সমস্যা কী?’

‘ঐ ছেলের ভাই হয়।’

‘তাতে কী? ভাই ভাইয়ের জায়গায় আর বিয়ে হয়ে গেলে ও কী ভাবীকে বিরক্ত করবে নাকি! তুমি রাজি হয়ে যাও।’

মিসেস মাসুমা বলে,’প্রিয়তা কীভাবে রাজি হলো!’

‘যেভাবেই হোক। শুক্রবার বিয়েটা পড়িয়ে রাখো এরপর ওকে তুলে দিবো। বাবা এই সুযোগ ছেড়ো না। এমন সুযোগ বারবার আসে না।’

‘কিন্তু.. ‘

‘যা বলছি শুনো। আর ঝামেলা করলে আমার চাকরি নিয়ে টানাটানি লাগবে।’

বেল্লাল হোসেন তুহিনের বলা কথাগুলো ভাবতে শুরু করে। কক্ষ হতে সকলে বেরিয়ে আসে।

বেল্লাল হোসেন বলেন,’তাহলে শুক্রবার ছোট করে পরিবার নিয়ে বিয়ে পড়িয়ে রাখি।’

রমিজউদ্দিন জবাব দেন,’না না বিয়ে হবে বড় করে।’

তুহিন হেসে বলে,’তা তো হবেই কিন্তু প্রিয়তা চায় ছোট করে আপাততঃ বিয়েটা হোক।’

মিসেস পারুল সায় দেয়,’সমস্যা নেই তাই হবে। পরে বড় করে অনুষ্ঠান করবো।’

নিজ কক্ষে বসে সবটা শুনে প্রিয়তা। টেবিলের উপর থাকা ক্যালেন্ডারের দিকে তাকিয়ে দেখে আজ বুধবার। তার মানে কাল বাদে পরশু বিয়ে। তার হাতে যথেষ্ট সময় আছে নিজেকে গুছিয়ে বিয়ের জন্য তৈরি করার।
নিহারিকার হাত ধরে জিজ্ঞেস করে,’তারপর আমাকে ভাবী হিসেবে তোমার কেমন লাগে ননদিনী?’

প্রিয়তার মুখে ননদিনী শুনে নিহারিকা লজ্জা পায়।
‘অনেককক ভালো লাগে। তুমি অনেক সুইট এজ লাইক ক্যান্ডি।’

নিহারিকার কথা শুনে প্রিয়তা হাসে। মেয়েটাকে তার মনে ধরেছে। নুহাশ তো লজ্জায় নড়ছেও না চুপচাপ বসে আছে। প্রিয়তা তাকে সহজ করতে কথা বলার চেষ্টা করে কিন্তু নুহাশ তার প্রতিটি কথার জবাব নিহারিকার কানে কানে দেয়। বিষয়টা প্রিয়তার কাছে অনেক মজা লাগে। প্রিয়তা নুহাশকে প্রশ্ন করছে আর নুহাশ নিহারিকার কানে কানে উত্তর বলছে। নিহারিকা আবার সেই উত্তর প্রিয়তাকে বলছে।
দুই ভাই-বোনের কান্ড দেখে প্রিয়তা হাসছে। নয়নের কোণায় এক ফোঁটা অশ্রু এসে জমা হয়। কনিষ্ঠ আঙুল দিয়ে অশ্রু মুছে নেয় প্রিয়তা। তুহিন আর তার সম্পর্কটা এমন হলো না কেনো?
_____________

রুমাদের বাসার কলিংবেল বাজতেই রুমার মা দরজা খুলে দেখে মিসেস মাসুমা হাসিমুখে দরজায় দাঁড়িয়ে। রুমার মা মুখ কালো করে ফেলে। এতো চেষ্টা করলো তবুও বিয়েটা আটকাতে পারলো না সে। গতকালকে এসে মিসেস মাসুমা একগাদা মিষ্টি দিয়ে তাকে জ্বালিয়ে গেছে। তাহলে আজকে আবার কেনো এলো? আবারো নিশ্চয়ই তাকে জ্বালাতে এসেছে? মিসেস মাসুমার হাতে এক বাটি পায়েস।

‘ভাবী কালকের জন্য রান্না করেছি খেয়ে দেখেন কেমন হলো আর রুমাকে প্রিয়তা ডাকছে। হুট করে বিয়ে হচ্ছে তো তাই কোনো আত্নীয়কে আসতে বলতে পারিনি। আপনারাই এখন সব।’

রুমার মা বাটিটা হাতে নেয়। রুমা কক্ষ হতে বের হলে মিসেস মাসুমা তাড়া দেয় তাকে।

‘প্রিয়তার কাছে যাও। আজকে কালকে তুমি আমাদের বাসাতেই থাকবা।’
মিসেস মাসুমা হেসে হেসে কথাগুলো বললেও রুমার চোখমুখ অন্ধকার। সে ভাবতেও পারছে না প্রিয়তা আপু বিয়েটা করছে।

বিছানার উপর রাখা জিনিসগুলো প্রিয়তা দেখতে আর গুনগুন করে গান গাইছে।
‘ভ্রমর কইয়ো গিয়া রে
শ্রীকৃষ্ণের বিচ্ছেদের অনলে
আমার অঙ্গ যায় জ্বলিয়া রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া..’

দরজায় দাঁড়িয়ে প্রিয়তার গুনগুন করা গান শুনছে রুমা। প্রিয়তার আচরণ দেখে মনে হচ্ছে না এ বিয়েতে তার আপত্তি আছে।
রুমা হঠাৎ ডাক দেয়,’আপু।’

চোখ তুলে দরজার দিকে তাকায় প্রিয়তা।
‘ভেতরে আয় দেখ কী কী আনছে।’

রুমা এগিয়ে এসে বিছানার দিকে তাকায়। শাড়ি,চুড়ি সহ অনেক কিছু আনা হয়েছে প্রিয়তার জন্য। সব কিছু দেখার আগ্রহবোধ করলো না রুমা।
প্রিয়তা আগ্রহ নিয়ে বলে,’মা আর ভাইয়া পছন্দ করে এনেছে,কেমন লাগলো?’

রুমা বিরস মুখে বলে,’সুন্দর।’

‘মেহেদী ও এনেছে। তুই না মেহেদী পরাতে পারিস। আমাকে মেহেদী পরিয়ে দে। একদম দুই হাতের দুই পিঠ ভরে লাগিয়ে দিবি। সুন্দর লাগে যাতে।’

প্রিয়তার আনন্দ দেখে রুমা বিস্ময়ের উপর বিস্ময় হচ্ছে।

‘আপু তুমি ঠিক আছো?’

‘ঠিক না থাকার কী হয়েছে?’

‘ না মানে বিয়েতে মনে হচ্ছে তুমি খুশি তাই জিজ্ঞেস করলাম।’

রুমার গাল টেনে দেয় প্রিয়তা।
‘যেটা বলেছি কর। বসলাম আমি।’
বিছানায় বালিশ টেনে প্রিয়তা বসে। অনিচ্ছা সত্ত্বেও রুমা প্রিয়তার সামনে বসে মেহেদী পরিয়ে দিতে। প্রিয়তা আবারো গুনগুন করে গান ধরে।

‘ভ্রমর রে
কইয়ো কইয়ো কইয়ো রে ভ্রমর
কৃষ্ণেরে বুঝাইয়া
মুই রাধা মইরা যামু রে
কৃষ্ণহারা হইয়া রে
ভ্রমর কইয়ো গিয়া।’

….

মাঝ রাতে জানার পাশে বসে আছে প্রিয়তা। রুমা তার বিছানায় বেঘোরে ঘুমাচ্ছে। গালে হাত দিয়ে গগণে থাকা তারার পানে তাকিয়ে থাকে প্রিয়তা। এই তারা তার একমাত্র সঙ্গী। যখনই একা লাগে মাঝ রাতে এই তারার সাথে সে খেজুরে আলাপ জুড়ে দেয়। কাল তার বিয়ে ভেবেই ভেতরে শিহরণ বইছে। একটা খাতা বের করে খসড়া লিখতে শুরু করে। কি লিখবে প্রথমে বুঝে উঠতে পারে না। এরপর কলম কামড়ে চিন্তা করে। ধীরে ধীরে লিখতে শুরু করে।

_________

সকাল সকাল রিমি আর হৈমন্তী কল পেয়ে ছুটে এসেছে। প্রিয়তা যখন বলেছে আজ তার বিয়ে তখন একজনও বিশ্বাস করেনি। প্রথমে ভেবেছে প্রিয়তা মজা করছে কিন্তু পরক্ষণেই বুঝতে পারে এটা মজা না সিরিয়াস কথা ছিলো।
প্রিয়তার কক্ষে ঢুকতেই রিমি দেখে প্রিয়তা খাচ্ছে আর তার পাশে হৈমন্তী বসা। এক পাশে রুমাও বসা

রিমি রাগান্বিত গলায় প্রশ্ন করে,’কীরে তুই ফোনে কি সব বলছিস?’
প্রিয়তা উত্তর দেয়,’এতো সব আয়োজন দেখেও তোর মনে হচ্ছে আমি মজা করছি?’

প্রিয়তার কথা মতো রিমি আশেপাশে তাকায়। সত্যিই তো! ফুল দিয়ে প্রিয়তাদের বাসার দরজা সাজানো হয়েছে। পুরো ফ্ল্যাটে ও বিভিন্ন রকম কাঁচা ফুল দিয়ে সাজানো হচ্ছে। রিমি কাঁদোকাঁদো অবস্থায় প্রিয়তার কাছে গিয়ে বসে। হৈমন্তীরও একই অবস্থা। প্রিয়তা আরমাসে খেয়ে হাত ধুডে চলে যায়।

রিমি হৈমন্তীর কাঁধে মাথা রেখে বলে,’ওর কী হইছে? ও বিয়ে কেন করতাছে?’

হৈমন্তী দীর্ঘশ্বাস ফেলে জবাব দেয়,’জানি না রে। আমাকে কল দিয়ে বললো,ভালো জামা পরে আয় আজকে আমার বিয়ে। এরপর কল কেটে দেয়। আমি কোনো মতে ছুটে আসছি।’

‘জাইন ভাই এসব জানে?’

‘সবাই সব জানে। বিয়েটা হচ্ছে তারই বড় ভাইয়ের সাথে।’
রিমি প্রশ্নটা হৈমন্তীকে করেছিলো যার জবাব প্রিয়তা দেয়।
রিমি চমকে প্রশ্ন করে,’মাননে? কী বললি?’

প্রিয়তা বিরক্তি নিয়ে জবাব দেয়,’যা বলছি শুনছিস না? ফারদার প্রশ্ন করবি না। আমি এখন তৈরি হবো। নামাজের পর বর পক্ষ আসবে। আস্তেধীরে তৈরি হবো যাতে আজকে আমাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দরী বধূ লাগে।’

রিমি প্রিয়তার কাঁধ ঝাঁকিয়ে প্রশ্ন করে,’প্রিয়ু তোর হয়েছিটা কী?’

‘হয়নি হবে,বিয়ে। এই নে মিষ্টি খা।’

রিমির মুখে একটা মিষ্টি পুরে দেয় প্রিয়তা। হৈমন্তীর সাথেও একই কাজ করে।
দু’জনেই প্রিয়তার কাজে আহাম্মক বনে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়তা সব কিছু বের করে তৈরি হওয়ার জন্য। আজ সে সাজবে নিজের মন মতো।

……..

পড়ন্ত বিকাল বেলা। রৌদ্র কমে গেছে কিছুটা। নদীর পাড়ে অবশ্য গরম নেই। প্রচন্ড হাওয়া।
নদীর পাড়ে জাইন বসে আছে। তার চোখে অশ্রু। এ অশ্রু লুকাতেই এখানে ছুটে আসা। পুরুষ মানুষ খুব বেশি কষ্ট না পেলে কাঁদে না। আজ জাইনের কষ্টের বাঁধ ভেঙে এ অশ্রুর আগমন। যাকে সবচেয়ে বেশি চেয়েছে তাকে নিজের করে পাওয়া হলো না এ জীবনে। পানিতে পা ভিজিয়ে জাইন বসে। জিন্সের প্যান্টটা সহ পাঞ্জাবীর নিচের অংশ ভিজে গেছে সেদিকে তার খেয়াল নেই। এক ধ্যানে নদীর জলের পানে চেয়ে আছে সে। ফোনটা বন্ধ করে রেখেছে যাতে বাড়ির লোকজন তাকে কল দিয়ে না পায়। সকলের আড়ালে থাকতে চায় আপাততঃ সে। এরপর কী করবে তা জানা নপই তার। কাছ থেকে প্রিয়কে বউ সাজে দেখলে নিশ্চয়ই নিজেকে সামলাতে পারবে না তাই তো দূরে চলে আসা। প্রিয় ভালো থাকুক সে-ও চায়।

‘এক্সকিউজ মি আমি কি এখানে বসতে পারি? আপনার পাশে,সারাজীবনের জন্য?’
জাইন চমকে চোখ তুলে তাকায়।

………..

(চলবে..)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|৩১.| (১৮+ সতর্কতা)
(লেখা কপি করা সম্পূর্ণ নিষেধ।এরপরও যদি কপি পোস্ট করেন বুঝবো আপনার পারিবারিক শিক্ষার অভাব আছে।)
………..

তাজা ফুল দিয়ে প্রিয়তাদের পুরো ফ্ল্যাট সাজানো হয়েছে। ফ্ল্যাটের সামনে থেকে শুরু করে পুরো সিঁড়িতে লাল রঙের কাপের্ট বসানো হয়েছে। সিঁড়ির হাতলে শোভা পাচ্ছে গাদা ফুলের মালা। বিল্ডিং এর প্রবেশ পথে ছোটখাটো করে সাজানো হয়েছে।
জুম্মার পর বরপক্ষ এসেছে। বরপক্ষ বলতে মিসেস পারুল, রমিজউদ্দিন,নিহারিকা,নুহাশ,জারিফ আর তার কয়েকজন বন্ধু। মিসেস পারুল আত্মীয়দের জানাননি। একজনকে জানালে অপরজন রাগ করেন তাই। জাইনের ফোন বন্ধ। এটা নিয়ে মিসেস পারুল চিন্তিত থাকলেও রমিজউদ্দিন চিন্তিত না বরং সে বিরক্ত। বড় ভাইয়ের বিয়ের দিন মেজজন ফোন বন্ধ করে নিরুদ্দেশ বিষয়টা অদ্ভুত। কনেপক্ষ এ বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে কীভাবে এড়িয়ে যাবেন সেটাই ভাবছেন।

সকলে মহা ব্যস্ত। একটা বিয়ে বাড়িতে তো আর কম কাজ থাকে না। আর যেহেতু হুট করেই বিয়ে তাই নিজেদেরই সকল কাজ করতে হচ্ছে। বরপক্ষ আসার সময় সকলের জন্য উপহার এনেছে সেগুলো গাড়ি থেকে নামিয়ে ছেলেপেলে দিয়ে বাসায় আনিয়ে রাখছে তুহিন। প্রিয়তা বায়না করেছিলো বিয়ের কেনাকটা যাতে এই বাড়ি থেকেই দেওয়া হয়। বরপক্ষের কাছ থেকে সে এখন কিছু নিতে চায় না। তার কথা মাফিকই হয়েছে। তবুও মিসেস পারুল তার জন্য নানান জিনিস এনেছেন।
বেল্লাল হোসেন কাজীর সাথে বসে মেয়ের তথ্য গুলো সঠিকভাবে লেখাচ্ছেন। মিসেস মাসুমাকে তুহিন বলে প্রিয়তাকে আনতে। মিসেস মাসুমা মাথা ঝাঁকিয়ে প্রিয়তার কক্ষে যায়। কক্ষের দরজা ভেতর থেকে বন্ধ। তিনি কয়েকবার দরজায় আঘাত করতেই রুমা দরজা খুলে। কক্ষের ভেতরে তাকিয়ে দেখে প্রিয়তা নেই।
‘প্রিয়তা কই?’

‘আপু তো বাকি দুই আপুর সাথে ছাদে ছবি তুলতে গেছে। আমি পোশাক বদলাচ্ছিলাম।’

মিসেস মাসুমা রুমার কথা শুনে রেগে যান। তবুও রাগ সংযত করেন।
রুমা আরো বলে,’আপনাকে তো বলে গেছিলো আপনি খেয়াল করেননি আন্টি।’

এমন সময় হাঁপাতে হাঁপাতে ফ্ল্যাটের দরজা দিয়ে প্রবেশ করে রিমি আর হৈমন্তী।
রিমি হাঁপাতে হাঁপাতে বলো,’প্রিয়তা ছাদের দরজা বন্ধ করে দিয়েছে।’

রিমির কথা শুনে উপস্থিত সকলে বিস্ময় নিয়ে তাকায়।
তুহিন প্রশ্ন করে,’মানে কী? মা প্রিয়তা কই?’

রিমি উত্তর দেয়,’আমি বলছি। প্রিয়ু বললো ছবি তুলবো তাই ছাদে নিয়ে যাই ওরে। আন্টিকে বলে গেছি। ছবি তোলার পর বললো ও পানি খাবে। আমি পানি নেওয়ার জন্য নামতেছিলাম তখন হৈমন্তীকে বলে বরপক্ষ এসেছে কিনা দেখতে। না বুঝে হৈমন্তীও ছাদ থেকে বের হয়। এমন সময় প্রিয়তা ছাদের দরজা বন্ধ করে দেয়। এতক্ষণ ডাকাডাকি করলাম প্রিয়তা সাড়া দিচ্ছে না। আমার তো ভয় করছে প্রিয়তা না কিছু করে বসে।’

কথাগুলো বলেই রিমি কান্না করে দেয়। হৈমন্তী তার পিঠে হাত বুলায়। তুহিন সাথে সাথে ছাদে ছুটে যায়। বরপক্ষের সকলে কেমন প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝতে পারছে না। একে একে বাকিরাও ছাদে ছুটে। নিচে শুধু রয়ে যায় রিমি,হৈমন্তী আর রুমা। সকলে যেতেই রুমা একটা ব্যাগ এনে রিমির হাতে দেয়। রিমি চোখ মুছে ব্যাগ তুলে হৈমন্তীকে নিয়ে হাঁটা দেয়। দ্রুত সিঁড়ি বেয়ে নেমে যায়।

……

টকটকে লাল রঙের বেনারসি গায়ে জড়ানো। আঁচলটা মাটিতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। খোঁপা করে রাখা কেশগুলে খানিকটা এলোমেলো হয়ে গেছে। দুই হাত ভর্তি কাঁচের রেশমি চুড়ি। কপালের ঠিক মাঝে কালো রঙের টিপ। চোখে মোটা করে কাজল টানা। ঠোঁটে শোভা পাচ্ছে হালকা রঙের লিপস্টিক। গায়ে নেই কোনো আলাদা গহনা। বাচ্চারা বউ সাজার জন্য বায়না করলে মা যেভাবে সাজিয়ে তাদের আবদার মেটায় প্রিয়তাকে ঠিক সেই রকম লাগছে। পাক্কা বাঙালি ছোট্ট মিষ্টি বউ। শুধু মাথায় ঘোমটা দিলে আর কিছু বাদ থাকবে না।
প্রিয়তাকে কনের সাজে দেখে জাইন মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে। কিছু সময়ের জন্য ভুলে যায় পূর্বের সকল কথা।

প্রিয়তা এগিয়ে এসে জাইনের পাশে বসতে নিলে সে উঠে যায়। দৌড়ে আসার কারণে হাঁপাচ্ছে প্রিয়তা। তার শ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে। জাইন উঠে দাঁড়াতেই সেও উঠে দাঁড়ায়।

জাইন আশেপাশে তাকালে কাউকে দেখতে পায় না। গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে,’এখানে কী করছো?’

‘আপনি এতক্ষণ যা করছিলেন তা।’

প্রিয়তার উত্তর শুনে জাইন পাল্টা প্রশ্ন করে,’মানে?’

‘এই গরমে নদীর ধারে মানুষ হাওয়া খেতে আসে। আমিও তাই এসেছি। যেই গরম শাড়ি পরে ঘাম ছুটে যাওয়ার উপক্রম।’
আঁচল দিয়ে বাতাস করার ভঙ্গি করে প্রিয়তা।

‘বিয়ে ফেলে এখানে কী?’

‘সেটার জন্যই তো এলাম। বর ছাড়া বিয়ে হয় নাকি?’

‘জারিফ ভাইয়া পৌঁছায়নি?’

‘জারিফ কে?’

‘যার সাথে বিয়ে হচ্ছে তার নাম জানো না?’

‘জানি তো। কিন্তু আপনি ভুল বলেছেন। ওটা জারিফ না জাইন রহমান হবে।’

‘বিয়ে ভেঙে এসেছো কেনো?’

‘ভেঙে আসিনি। নায়িকাদের মতো পালিয়ে এসেছি। এখন আপনি গ্রহণ করলে বিয়েটা সম্পূর্ণ হবে।’

পিছনে ফিরে জাইন বলে,’অসম্ভব। ফিরে যাও। একবার যখন বলেছো ভাইয়াকে বিয়ে করবা করো। এতে তোমার পরিবারও খুশি তুমিও খুশি থাকবা।’

‘আপনি আমাকে ফিরিয়ে দিলে নদীতে ঝাপ দিয়ে প্রাণ দিবো।’

‘যা খুশি করো।’
কথাটা বলে জাইন হাঁটা দেয়। হঠাৎ নদীতে কিছু পড়ার শব্দ পায়। সাথে সাথে নদীর পানিতে যেখানটায় শব্দ হয়েছে সেখানে তাকায়।
ভয়ার্ত কন্ঠে ডাকে,’প্রিয়।’

সাড়াশব্দ না পেয়ে এগিয়ে যায় নদীর পানির দিকে।
‘জাইন।’
প্রিয়তার গলা পেয়ে জাইন থেমে যায়। এই প্রথম প্রিয়তা তাকে নাম ধরে ডাকলো। জাইনের শ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে। হৃদপিণ্ড নামক যন্ত্রটায় হাতুরি পেটা হচ্ছে। মনে মনে প্রস্তুতি নেয় প্রিয়তাকে কঠিন কথা শুনাবে। পিছনে ঘুরেই তার মুখ বন্ধ হয়ে যায়।

প্রিয়তা হাঁটু গেঁড়ে জাইনের সামনে বসে। তার হাতে ছোট্ট একটা ঘাসফুল।

‘ম্যারি মি প্লিজ। এই দুনিয়াতে আমার কেউ নেই আপনি ছাড়া।’
প্রিয়তার ব্যাকুল কন্ঠ শুনে জাইন আর নিজেকে ধরে রাখতে পারে না। ভুলে যায় সকল অভিমান। এগিয়ে এসে প্রিয়তার হাত ধরে তাকে উঠায়। সে কি বলবে বুঝে উঠতে পারছে না। প্রিয়তার মায়া ভরা মুখটা সে কিছুতেই এড়াতে পারে না।

‘আমি কি একটু আপনাকে জড়িয়ে ধরতে পারি? শুধু এক মিনিটের জন্য।’
প্রিয়তার আবদার শুনে জাইন সাথে সাথে তাকে জড়িয়ে ধরে। জাইনের বুকে মাথা রেখে চক্ষুদ্বয় বন্ধ করে ফেলে প্রিয়তা। জাইনের চোখে অশ্রু এসে হানা দেয়। এ অনুভূতি ব্যক্ত করার কোনো ভাষা তার কাছে নেই।

মুখ তুলে প্রিয়তা বলে,’জড়িয়ে ধরলে শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে হয় যাতে বাহুতে আবদ্ধ থাকা মানুষটা না পালাতে পারে।’

জাইন প্রিয়তাকে শক্ত করে জড়িয়ে তার ললাটে ওষ্ঠ চেপে ধরে। দু’জনেরই নেত্র যুগল বন্ধ। জাইন সময় নিয়ে ললাটে গভীর চুম্বন দেয়। প্রিয়তা পুরোটা স্পর্শ অনুভব করে। জাইন প্রিয়তার ললাট ছেড়ে তার বদ্ধ চক্ষুদ্বয়ের দিকে দৃষ্টি রাখে। শ্রাবণের মতো অশ্রু পড়ছে প্রিয়তার বদ্ধ চক্ষু হতে। জাইনের চোখেও অশ্রু। এ অশ্রু প্রাপ্তির অশ্রু। এক মূহুর্ত পূর্বে ঝরছিলো বেদনার অশ্রু আর এখন ঝরছে প্রাপ্তির অশ্রু। আহা জীবন কত বৈচিত্র্যময়! কখন সৃষ্টিকর্তা আপনার ঝুলিতে সুখ ঢেলে দিবে আপনি জানবেনও না। সঠিক সময়ে আপনি আপনার প্রাপ্য পেয়ে যাবেন। সেইজন্যই সৃষ্টিকর্তার উপর সবসময় ভরসা রাখতে হয়।

জাইন প্রিয়তার দুই গালে হাত রেখে বলে,’তুমি আমার প্রিয়,শুধুই আমার। তোমাকে আমি আগলে রাখবো পুরো পৃথিবী থেকে।’

প্রিয়তা অশ্রুসিক্ত নয়নে জাইনের পানে তাকায়। জাইন প্রিয়তার দু গালে হাত রাখতেই প্রিয়তা ওষ্ঠ চেপে কান্না আটকায়।

জাইন ভাঙা গলায় বলে,’তুমি যখন কান্না আটকাও তোমাকে মারাত্মক সুন্দর লাগে। ইচ্ছে করে আদর করি।’
জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা হেসে দেয়। বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে অশ্রু মুছে দেয় জাইন।

জাইন বলে,’আরেকবার বুকে আসবা? লোভ হচ্ছে খুব।’

প্রিয়তা হেসে জাইনের গলা জড়িয়ে ধরে। জাইনও প্রিয়তাকে শক্ত করে জড়িয়ে খানিকটা উঁচু করে তুলে ধরে। এরপর ঘুরতে শুরু করে।

জাইন হেসে প্রশ্ন করে,’প্রিয়তা ইয়াসমিন তবে অবশেষে জাইন রহমানে ফাঁসলো?’

প্রিয়তা খিলখিল করে বাচ্চাদের মতো হাসতে শুরু করে। প্রিয়তার হাসি দেখে জাইন থামে। প্রিয়তাকে মাটিতে নামায়। দু’জনই হাঁপাচ্ছে। উভয়ের চেহারাতে খুশির ঝলকের দেখা মিলছে।

একে অপরের কপাল ঠেকিয়ে জোরে জোরে শ্বাস নিতে শুরু করে। জাইন প্রিয়তার ওষ্ঠের পানে চেয়ে আছে। প্রিয়তার দৃষ্টি মাটির দিকে। বৃদ্ধাঙ্গুল দিয়ে প্রিয়তার ওষ্ঠ বুলিয়ে দেয় সে।

‘চলো বিয়েটা সেরে নেই তারপর তোমাকে বুকে নিয়ে অনেক উষ্ণ স্পর্শ দিবো। ইউ নো কঠিন উষ্ণ স্পর্শ। ছটফট করলেও তোমার ঠোঁট ছাড়বো না।’

প্রিয়তা চোখ তুলে জাইনের দিকে তাকায়।

জাইন দুষ্ট স্বরে বলে,’এখন বলো অসভ্য।’

প্রিয়তা বিরবির করে বলে,’অসভ্য।’

জাইন প্রিয়তার গালে শব্দ করে চুম্বন দিয়ে বলে,’তোমার জন্য আমি বারংবার অসভ্য হতে চাই প্রিয়। আই লাভ ইউ। লাভ ইউ এ লট।’

প্রিয়তা হেসে বলে,’আই ডোন্ট লাভ ইউ।’

দুষ্ট স্বরে জাইন বলে,’আপাততঃ বিয়েটা হলেই হলো পরে না হয় ভালোবাসিয়ে নিবো।’

‘চলেন সবাই অপেক্ষা করছে।’

‘সবাই আবার কে?’

‘গেলেই দেখতে পাবেন।’

প্রিয়তা যেতে নিলে জাইন তার হাত টেনে ধরে। হাসিমুখে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায় প্রিয়তা।

‘হে সখী তোর জন্যে মোর ভেতর আনচান করে ঘুম আসে না রাইতে।
তোকে দেখার জন্যে ছুটে বেড়াই দিবানিশি তবু তুই কেনো আসিস না ছাদে?
দেখলি না মোর প্রেম,দেখলি না মোর উতলা,দেখলি না কিছুই।
হে সখী যাস না মোরে ছেড়ে,যাস না মোর প্রাণ খালি করে।
চিরকাল রয়ে যা মোর এই শীতল বুকে।’

জাইনের অনুভূতি ব্যক্ত করা শুনে প্রিয়তা মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে থাকে।
প্রিয়তার বাম হাত নিজের ডান হাতে তালু বন্দী করে ফেলে জাইন। এরপর হাতের উল্টো পিঠে চুমু দেয়। এরপর প্রিয়তার হাত ধরে হাঁটা শুরু করে। প্রিয়তা অনুভব করে তার বেশ ফুরফুরে লাগছে। সে যে বিয়ে বাড়ি থেকে পালিয়েছে একটুও খারাপ লাগছে না। বরং মনে হচ্ছে এতো বছরে একটা সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছে সে। জাইন রাস্তার দিকে না তাকিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে হাঁটছে। কল্পনায় প্রিয়তাকে লাল বেনারসিতে যতটা সুন্দর লাগছিলো এখন সামনাসামনি তার চেয়ে বহুগুণ সুন্দর লাগছে। মেয়েটা এতো সুন্দর কেনো?

মারুফ,শাকিল আর রফিক জিপের সামনে অবস্থান করছে। মারুফ পায়চারি করছে আর শাকিল ফোনে গেমস খেলছে।

মারুফ একটা গালি দিয়ে বলে,’শালারে কি প্রিয়তা খুঁজে পাইছে? মেয়েটা তো একা ছুটলো কিন্তু আদোও জানি না শালায় এইখানে আছে কিনা।’

শাকিল জবাবে বলে,’প্রিয়তাই তো বললো এইখানে একবার খুঁজে দেখতে। তাই তো এলাম। আমার মনে হয় ওদের দেখা হইছে।’

রফিক কান থেকে ফোন নামিয়ে বলে,’জান ভাইয়ের ফোন এখনো বন্ধ। আমার তো ভয় করতেছে। ভাবী যে একলা গেলো এই জায়গাডা ভালো না। আমগো উচিত একবার গিয়া দেখা।’

মারুফও সায় দেয়। শাকিলকে বলে,’তুই থাক আমরা গেলাম।’

মারুফ রফিককে নিয়ে হাঁটা দিলে দেখে জাইন আর প্রিয়তা হাত ধরে হেঁটে আসছে। দু’জনেই একে অপরের দিকে তাকিয়ে আছে হাসিমুখে। শাকিলের হাতে ফোন থাকায় সে তাড়াতাড়ি ভিডিও করতে শুরু করে। প্রিয়তা উষ্ঠা খেয়ে মাটিতে পড়তে নিলে জাইন তাকে আঁকড়ে ধরে। এরপর সোজা নিজ বাহুতে তুলে নেয়। জাইনের গলা জড়িয়ে প্রিয়তা হাসে।
দূর হতে হা করে এসব দেখতে থাকে তিনজন। জাইন আর প্রিয়তাকে দেখে মনে হচ্ছে জনম জনমের প্রেমিকযুগল তারা।
জিপের সামনে আসতেই মারুফ কাশি দেয়। প্রিয়তা ইশারা করে নামানোর জন্য কিন্তু জাইন নামায় না।

জাইন মারুফকে ধমকে বলে,’কাশি না দিয়ে দরজা খোল।’

বিরস মুখে মারুফ এগিয়ে জিপের দরজা খুলে দেয়। প্রিয়তাকে নিয়ে জিপের পিছনের সিটে বসায় জাইন। জিপের দরজা বন্ধ করেই তিনজন তাকে ঘিরে ধরে। মারুফ আর শাকিল জাইনকে কিল ঘুষি দেয়। জানালার কাচ নামিয়ে প্রিয়তা বলে,’ভাইয়া আমার পক্ষ হতে দুইটা বেশি দেন।’

মারুফ গালি দিয়ে বলে,’শালা কই হারাস তুই? তোরে তো আজকে খাইছি রে।’

মারুফ বলে,’তোর সাথে অনেক হিসাব বাকি। বিয়েটা হোক তারপর বুঝামু। গাড়িতে উঠ।’

জাইন হেসে প্রিয়তার পাশে উঠে বসে। শাকিল আর মারুফ সামনে উঠে বসে। রফিক জানায় সে জিপে যাবে না। সকলে বুঝতে পারে জাইন আর প্রিয়তার সাথে বসতে রফিক লজ্জা পাচ্ছে। জাইন ধমক দিতেই চুপচাপ রফিক তার পাশে উঠে বসে।

শাকিল জিপ স্টার্ট দেয়। মারুফ বোতাম চেপে রেডিও চালু করে। জাইন প্রিয়তার হাত শক্ত করে ধরে বসে আছে।

তিরিশ মিনিট পর জিপ থামে কাজী অফিসের সামনে। মারুফ নেমে জিপের দরজা খুলে প্রিয়তাকে স্বাগত জানায়। প্রিয়তা হেসে বের হয়। জাইন ও তার পিছনে বের হয়। প্রিয়তার পিছন পিছন কাজী অফিসের ভেতর জাইন যেতে নিলে মারুফ আর শাকিল তাকে আঁটকায়।

মারুফ জাইনের হাত ধরে প্রশ্ন করে’তুই কই যাস?’

জাইন না বুঝে উত্তর দেয়,’আমি না গেলে বিয়ে হবেটা কীভাবে?’

শাকিল হতাশ গলায় বলে,’এই ফকিরের বেশে বিয়ে করবি? পালিয়ে বিয়ে করলেও একটা সম্মান আছে না? বিশ তিরিশ বছর পর বাচ্চাদেরকে নিজের বিয়ের কাহিনী শুনিয়ে ছবি দেখাবি তখন তারা যদি প্রশ্ন করে,তুমি অমন ফকিরের বেশে কেনো বিয়ের দিন? কি বলবি?’

শাকিলের কথা শুনে জাইন মাথা চুলকায়। আসলেই পুরো এলোমেলো হয়ে আছে সে।

মারুফ বলে,’লাইলীর শোকে মজনু হইছিলি এখন তো লাইলীকে নিজের করে পাবি এখন একটু গেটাপ দরকার না? প্রিয়তা তুমি ভেতরে যাও ওরে আমরা মানুষ বানাইয়া নিয়া আসতেছি।’

জাইন প্রিয়তাকে কিছু বলতে চায় কিন্তু প্রিয়তা চোখের ইশারায় ওদের সাথে যেতে বলে।

শাকিল জাইনকে ঘুষি দিয়ে বলে,’শালার আর তর সয় না!’

শাকিলের কথা শুনে জাইন হেসে দেয়। পিছন থেকে মকবুল শপিং ব্যাগ হাতে উপস্থিত হয়। জাইনকে ধরে তারা নিয়ে যায় পাশের সেলুনে।

কাজী অফিসে প্রবেশ করে প্রিয়তা দেখে রিমি,হৈমন্তী আর অনু বসে অপেক্ষা করছে। প্রিয়তাকে দেখে অনু ছুটে এসে জড়িয়ে ধরে।

অনু খুশিতে বলে,’আমি আমার খুশি ভাষায় প্রকাশ করতে পারবো না আপু। আমার যে কী খুশি লাগছে।’

‘তোমরা না থাকলে কিচ্ছুই হতো না।’

রিমি পিছন থেকে মুখ কালো করে বলে,’ওহ আমরা তো কিছু করিনি তাই না? মনে হচ্ছে আমরা কিছু না করে ঢ্যাং ঢ্যাং করে বিয়ে খেতে আসছি।’

রিমির কথা শুনে বাকি তিনজন হেসে দেয়।
হৈমন্তী বলে,’রিমি যা কান্নার অভিনয় করেছে তুই দেখলে ওখানেই হেসে গড়াগড়ি খেতি। আমি বুঝলাম না ঐ বিলাই কান্না সকলে বিশ্বাস করলো কীভাবে!’

রিমি হৈমন্তীর বাহুতে চড় দিয়ে বলে,’আমার বিলাই কান্নার জন্যই আসতে পারছিস না হলে বেঁধে রাখতো।’

প্রিয়তা প্রশ্ন করে,’ঐদিকের কী খবর?’

হৈমন্তী উত্তর দেয়,’জানি না রে। সবাই ছাদে ছুটতেই আমরা পালিয়েছি। রুমার সাথে কথা হয়েছে বললো পুলিশ ডেকেছে তোর ভাই। এরপর বেশি কথা বলতে পারিনি। রুমা বললো রাতে কল দিবে।’

প্রিয়তা ‘ওহ’ বলে চুপ থাকে।

অনু চেয়ারে রাখা ব্যাগ থেকে একটা দোপাট্টা বের করে আনে।

‘অনু এটার দরকার নেই।’

‘বিয়েতে বসবা দোপাট্টা ছাড়া! না না বসো আমি সেট করে দেই। এটা আমার লাকি দোপাট্টা। এটা পরেই আমি বিয়ে করেছিলাম মনে নেই তোমার?’

প্রিয়তা হেসে জবাব দেয়,’আলবাদ মনে আছে।’

অনু প্রিয়তাকে বসিয়ে মাথায় ওড়নাটা সেট করতে শুরু করে।

কাজী ককর্শ গলায় বলে,’আপনারা কী আজকের দিন পাড় করবেন না কি? এতো সময়ে আমি কয়েকটা বিয়ে পড়াই।’

রিমি কাজীর কথার জবাবে বলে,’প্রয়োজনে সারাদিন রাত বসে থাকবেন চুপ করে। আমার বান্ধবীর জীবনের এতো গুরুত্বপূর্ণ একটা দিনে কি আপনার জন্য আমরা তাড়াহুড়ো করবো নাকি!’

কাজী বলে,’আমার বিয়ে পড়াতে যেতে হবে।’

‘আমার বান্ধবীর বিয়ে পড়িয়ে তারপর যেখানে মন চায় যান।’

‘কী বেয়াদব মেয়েরে বাবা! শোনো মেয়ে এমন চটাং চটাং কথা বললে কপালে বর জুটবে না।’

‘বর না জুটলে আপনার গলায় ঝুলে পড়বো।’

রিমির কথা শুনে কাজী কাঁশতে শুরু করে। হৈমন্তী রিমিকে ধমকে নিয়ে আসে।
অনু নিজের ব্যাগ থেকে নাক ফুল বের করে প্রিয়তাকে দেখায়। প্রিয়তা তাকিয়ে দেখে এটা সেই নাক ফুল যেটা সে অনুকে বিয়ের দিন দিয়েছিলো। প্রিয়তাকে ফেরত দিতে চাইলে সে চোখ রাঙায়। অনেক জোরাজুরি করেও অনু তাকে সেটা ফেরত দিতে পারেনি।

হঠাৎ রিমির ডাকে চোখ তুলে দরজার দিকে তাকায় প্রিয়তা। এরপর বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। শুভ্র রঙের পাঞ্জাবী তার উপর নেভি ব্লু রঙের নকশা করা কটি গায়ে জড়ানো। পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে রেখেছে। হাতে শোভা পাচ্ছে একটা ব্রেসলেট। সেই সাথে জাইনের ওষ্ঠে দেখা যাচ্ছে মাতাল করা হাসি।
প্রিয়তা হৈমন্তী আর রিমিকে ফিসফিস করে প্রশ্ন করে,’আমার হবু বর হ্যান্ডসাম না?’

দু’জনেই উত্তর দেয়,’অনেক।’

প্রিয়তা শাসিয়ে বলে,’একদম নজর দিবি না।’

জাইন এসে প্রিয়তার সামনে দাঁড়ায়। প্রিয়তা এগিয়ে এসে পাঞ্জাবীর খোলা বোতাম দু’টো বন্ধ করতে উদ্যত হয়।

কাজী অধৈর্য্য হয়ে বলে,’আপনারা এসব পরে করেন আগে বিয়েটা সারেন।’

জাইন কাজীর দিকে অসন্তোষ দৃষ্টিতে তাকায়।
মারুফ কেশে বলে,’শালা বিয়েটা কর আগে। প্রিয়তার বাড়ির লোক চলে এলে আম ছালা সব যাবে।’

দু’জনে একত্রে চেয়ার টেনে কাজীর সামনে বসে। শুরু হয় রেজিস্ট্রি বিয়ের প্রক্রিয়া। জাইনের কাগজপত্র মারুফ নিয়ে এসেছে আর প্রিয়তার গুলো রিমি এনেছে। কাজী চাইতেই সব বের করে দেয়। সব তথ্য পূরণ শেষে সাইন করার জন্য দেওয়া হয়। জাইন কয়েক সেকেন্ডের মাথায় সই করে দেয়। এরপর কলমটা প্রিয়তার দিকে এগিয়ে দেয়। কলম হাতে নিতেই প্রিয়তার বুকের ভেতর ধুকপুক শুরু হয়। এতক্ষণ খারাপ না লাগলেও এখন পরিবারের কথা মনে হতে থাকে। প্রিয়তা সই করছে না দেখে জাইন তার কাঁধে হাত রাখে।
প্রিয়তা বলে,’আমি শুনেছি অভিভাবকের অনুমতি ছাড়া বিয়ে বৈধ হয় না।’

জাইন ধীর গলায় প্রশ্ন করে,’তাহলে বিয়েটা ক্যান্সেল?’

‘বাবার সাথে কথা বলবো।’
রিমি সাথে সাথে বলে,’প্রিয়ু তুই কী পাগল হয়ে গেছিস? আঙ্কেল জানতে পারলে কত বড় সমস্যা হবে জানিস?’

প্রিয়তা জাইনের দিকে তাকিয়ে অনুরোধ করে,’প্লিজ একবার।’

রিমি আরো কিছু বলতে নিলে জাইন হাত উঁচিয়ে তাকে থামিয়ে দেয়। এরপর ফোন বের করে প্রিয়তার ভাইয়ের নাম্বারে কল দেয়। প্রিয়তার ভাইয়ের নাম্বার তার কাছে কো থেকে এলো সেটা জানার আগ্রহ কারো নেই। প্রিয়তার চোখেমুখে বিষণ্ণতা। জাইন ফোন কানে দিয়ে প্রিয়তার দিকে তাকাচ্ছে। কল রিসিভ হয়।

‘হ্যালো বেল্লাল হোসেনকে কলটা দেন।’

‘আপনি কে?’

‘আপনার বোন প্রিয়তার খোঁজ পাওয়া গেছে ওনাকে কলটা দিন।’

‘আমাকে বলুন প্রিয়তাকে কোথায় দেখেছেন?’

‘আপনি ওনাকে কল না দিলে বলবো না।’

তুহিন ফোন নিয়ে তার বাবার কাছে ছুটে। স্পিকারে দিয়ে ফোনটা তুলে দেয় বাবার হাতে। জাইন ফোনটা প্রিয়তার দিকে এগিয়ে দেয়। ফোন কানে দিতেই অপরপাশ থেকে বেল্লাল হোসেনের গলা পায়।

‘হ্যালো কে?’

‘বাবা।’

প্রিয়তার গলা পেয়ে বেল্লাল হোসেন বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়।

প্রিয়তা কান্না আঁটকে বলে,’বাবা আমি বিয়ে করছি আমাকে অনুমতি দাও।’

বেল্লাল হোসেন শক্ত গলায় বলে,’আমার কোনো মেয়ে নেই। যে ছিলো আজ থেকে সে মৃত। আমি আমার মৃত মেয়ের নামে মিলাদ পড়িয়ে দিবো।’

এটা শুনে প্রিয়তা চোখ বন্ধ করে পেলে। তার চোখের কোণে বেয়ে এক ফোঁটা অশ্রু ঝরে। জাইন সাথে সাথে ফোনটা কেঁড়ে নেয় প্রিয়তার অবস্থা দেখে। ফোন কানে দিতেই বেল্লাল হোসেনের কথা শুনতে পায়।

‘আজ থেকে আমার একটা মাত্র ছেলে। আমি ভুলে যাবো কোনো কালে আমার মেয়ে ছিলো। চারদিনের দিন মিলাদ পড়িয়ে দিবো মৃত মেয়ের জন্য।’

জাইন রাগ সংযত করে বলে,’আমরা বিয়ে করছি এটা জানাতেই আপনাকে কল দেওয়া। আমাদের জন্য দোয়া করবেন পারলে আর না পারলে চুপ থাকবেন অন্ততঃ বদদোয়া দিয়ে আমাদের অমঙ্গলের কারণ হবেন না।’
কথাগুলো বলে কল কেটে দেয় জাইন। প্রিয়তা এখনো ঐভাবেই আছে। জাইন তার হাতের উপর হাত রাখে। চোখ মেলে তার দিকে তাকায় প্রিয়তা। জাইনের অসহায় দৃষ্টি।

চোখ মুছে কলম হাতে নেয় প্রিয়তা। সই করার জায়গায় ‘প্রিয়তা’ লিখে থেমে যায়। এরপর জাইনের দিকে তাকায়। জাইনের চোখেমুখে এখনো আতংক।

‘ইয়াসমিন লিখবো নাকি রহমান?’

জাইন জোরপূর্বক হেসে বলে,’দু’টোই লেখো।’

গোটা গোটা অক্ষরে কাবিননামা প্রিয়তায় লিখে ‘প্রিয়তা ইয়াসমিন রহমান।’

সই শেষ হতেই সকলে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে। এরপর তাদের বিয়ে পড়ানো হয়। মোনাজাত শেষ হতেই কাজী হাঁপ ছেড়ে বাঁচে। উনি নিজেও আতংকে ছিলেন শেষে বিয়েটা হবে কিনা!

প্রিয়তা আর জাইন চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াতেই মকবুল দু’টো ফুলের মালা এনে দু’জনের হাতে দেয়।

শাকিল বলে,’পুরো বিয়েটা সিনেম্যাটিক হলো এবার একটু মালা বদল না হলে হয় না।’

মারুফ বলে,’বিয়ে দেখলাম নাকি থ্রিলার মুভি সেটা এখনো বুঝতাছি না। বাপরে কি সাসপেন্স! এখনো কইলজা কাঁপতাছে। ঐ রফিক পানি আন।’

প্রথমে প্রিয়তাকে মালা পরিয়ে দেয় জাইন এরপর প্রিয়তা মালা পরিয়ে দিতে গেলে পায়ে ভর দিয়ে উঁচু হতে হয়। এমনটা দেখে জাইন এক কান্ড করে বসে। হাঁটু গেঁড়ে প্রিয়তার সামনে বসে। হেসে মালাটা জাইনের গলায় পড়ায়। এরপর জাইন উঠে দাঁড়িয়ে প্রিয়তার দুই হাত টেনে উল্টোপিঠে চুম্বন দেয়।

রফিক মিষ্টি এনে মারুফের হাতে দেয়। মারুফ সকলকে মিষ্টি দেয়। কাজীকে আলাদা করে দু কেজি মিষ্টি দেওয়া হয়েছে। সকলকে মিষ্টি দেওয়া শেষে রিমির সামনে আসতেই তার হাতে মিষ্টি না দিয়ে খাইয়ে দেওয়ার চেষ্টা করে।
রিমি গম্ভীর গলায় বলে,’হাতে দেন।’

মারুফ জবাবে বলে,’আজকে থেকে আমরা বেয়াই-বেয়াইন তাই এই খুশিতে একটু মিষ্টি মুখ করি। হা করেন।’

রিমি বলে,’ও তাই! আপনি হা করেন আগে আপনাকে খাইয়ে দেই।’

রিমির কথা শুনে মারুফ সত্যি সত্যি হা করে। রিমি একটা মিষ্টি তুলে নেয় এরপর বাম হাতে থাকা টিস্যু গুলো তার মুখে দলা করে গুঁজে দেয়।
মারুফ বলে,’আপনার বিয়ের দিন আপনার বরকে আমি মিষ্টির বদলে ইট খাওয়াবো।’

‘এ্যা শখ কত।’
রিমি ভেংচি কাটে।

বিয়ের সমস্ত কাজ শেষ করে সকলে কাজী অফিস থেকে বের হয়। ততক্ষণে রাত নেমে গেছে। মারুফ জানায় রেস্টুরেন্টে সে খাবারের আয়োজন করেছে আজকে রাতের। এরপর একদিন প্রিয়তা-জাইনের বাসায় তাদের দাওয়াত।

সকলেই মারুফের প্রস্তাবে সম্মতি দেয়। চলে যায় রেস্টুরেন্টে ভোজন করতে। খাওয়াদাওয়া শেষে বিদায় নিয়ে রিমি আর হৈমন্তী চলে যায়। অনু আর মকবুল রয়ে গেছে। ওরা যাবে সাথে। জিপের সামনে আসতেই প্রিয়তা থেমে যায়।
জাইন প্রশ্ন বোধক দৃষ্টিতে তাকায়।

প্রিয়তা উত্তর দেয়,’গাড়ি করে যাবো না।’

‘তাহলে?’

‘রিকশাতে যাবো।’

প্রিয়তার আবদার শুনে জাইন রিকশা ডাক দেয়। এরপর পাশাপাশি রিকশাতে উঠে বসে। বাকিরা জিপে করেই রওনা দেয়। রিকশায় উঠে প্রিয়তা জাইনের বাহু জড়িয়ে মাথা ঠেকায়। চোখ তুলে জাইনকে দেখতে থাকে। জাইন ভ্রু উঁচিয়ে তাকাতেই প্রিয়তা মৃদু হাসে। চোখে মুখে আঁচড়ে পড়া ছোট ছোট কেশ গুলো যত্ন করে কানের পিছনে গুঁজে দেয় জাইন। এরপর প্রিয়তার ওষ্ঠে আলতো চুমু দেয়।
রিকশা নিয়ে চলছে এক জোড়া সদ্য বিবাহিত যুগলকে তাদের নতুন জীবনে।

…………
(চলবে..)