প্রণয়ী পর্ব-৩২+৩৩

0
18

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|৩২.|
(১৮+ সতর্কতা)
(কপি পোস্ট কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
……….

রিকশা হতে নামতেই প্রিয়তা খেয়াল করে এক বিশাল বাড়ির সামনে দাঁড়িয়ে তারা। বাড়ির দরজার পাশের দেয়ালে গোটা গোটা অক্ষরে লেখা ‘রহমান ভিলা।’ জাইন যে এতো ধনী ঘরের ছেলে সে আন্দাজ করেনি। অবশ্য জাইন কেনো তার পরিবারের আচরণ দেখেও বোঝা যায় না তারা এতো ধনী। তাদের আচরণে দাম্ভিকতা নেই। রিকশার ভাড়া মিটিয়ে জাইন প্রিয়তার হাত ধরে হাঁটা দেয়। প্রিয়তা থেমে যায়। ঘাড় ঘুরিয়ে জাইন প্রিয়তার দিকে দৃষ্টি রাখে।
প্রিয়তা প্রশ্ন করে,’এখানে আসলাম কেনো?’

‘সকলকে বিয়ের খবরটা দিতে।’

‘পালিয়ে আপনাকে বিয়ে করেছি শুনলে তারা তো আমাকে পছন্দ করবে না।’

‘এটা নিয়ে তোমার ভাবতে হবে না চলো। আম্মা দেখবা হাসিমুখে তোমাকে বরণ করবে। আব্বা একটু গড়িমসি করলেও সেটা আমি ম্যানেজ করে নিবো।’

জাইনের কথায় প্রিয়তা আশ্বস্ত হয় না।
‘চলো আগে দেখা করি। পরে তোমার ভালো না লাগলে থাকবো না এখানে।’

এবার প্রিয়তা জাইনের কথায় এগোয়। গেইটে থাকা দারোয়ান জাইনকে দেখে দ্রুত গেইট খুলে দেয়। বউ সাজে অপরিচিত মেয়েকে জাইনের সাথে দেখে ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে থাকে সে।
প্রিয়তা চোখ ঘুরিয়ে বাড়ির আশেপাশে দেখছে। বুঝাই যাচ্ছে অনেক যত্ন করে বানানো হয়েছে। বাড়ির সদর দরজায় দাঁড়িয়ে কলিংবেল দেয় জাইন। প্রিয়তা নিজেকে আড়াল করতে তার পিছনে দাঁড়ায়। তার ভেতরে অনেক অস্বস্তি হচ্ছে। হবে নাই বা কেনো! জাইনের পরিবারের সাথে তার তো সাক্ষাৎ হয়েছে অন্য ভাবে। পূর্বে সাক্ষাৎ না হলে আজকে প্রিয়তার এতে অস্বস্তি হতো না। দরজা খোলার শব্দ হয়। কে দরজা খুলে প্রিয়তা জানে না তবে জাইনের গলা শুনে আন্দাজ করে বাড়িতে কাজ করে সেই মেয়ে হবে।
‘আম্মা কই? যা ডেকে আন।’

জাইনের কথা শুনে মেয়েটা এক ছুটে ভেতরে যায়। পাঁচ মিনিটের মাথায় মিসেস পারুলকে ডেকে আনেন। মিসেস পারুলের এমনিতেই মন খারাপ। আজকে তার মান সম্মান সব গেলো। এখন আবার রাতের বেলা জাইনকে বাড়ির সদর দরজায় দেখে বুঝতে পারছেন না কি হচ্ছে।

মিসেস পারুল বিরস মুখে বলে,’ভেতরে আয় বাহিরে দাঁড়িয়ে আছিস কেনো?’

জাইন হাসি দিয়ে বলে,’তোমার জন্য সারপ্রাইজ এনেছি।’

নুহাশ আর নিহারিকাও নেমে আসে। তাদের চোখে মুকে কৌতুহল। মিসেস পারুল খেয়াল করে জাইনের পিছনে কেউ দাঁড়িয়ে আছে।
মিসেস পারুল আবারো প্রশ্ন করেন,’তোর পিছনে কে?’
জাইন একটু সরে প্রিয়তাকে টেনে পাশে দাঁড় করায়। মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে প্রিয়তা।
জাইন উত্তর দেয়,’নতুন বউ এনেছি তোমার জন্য। আমার স্ত্রী প্রিয়তা ইয়াসমিন।’

জাইনের কথা শুনে মিসেস পারুল ভীষণ চমকান। বেশি চমকেছেন বউয়ের চেহারা দেখে। যেই মেয়েকে বড় ছেলের জন্য পছন্দ করেছেন সেই মেয়েকে শেষে তার মেজ ছেলে বিয়ে করলো!
মিসেস পারুল এগিয়ে এসে বলে,’আমি ঠিক শুনলাম? তোরাও কি শুনছিস আমি যা শুনলাম?’

শেষের প্রশ্নটা পিছনে ঘুরে তিনজনের উদ্দেশ্যে করে মিসেস পারুল। বাসার কাজে সাহায্য করা মেয়ে আর নিহারিকা নুহাশ মাথা নাড়ায়।
মিসেস পারুল মাথায় হাত দিয়ে বলে,’বাবা দুনিয়াতে এতো মেয়ে থাকলে এই মেয়েকে কেনো বিয়ে করলি?’

‘ওকে আমি আগেই পছন্দ করে রেখেছিলাম। তুমিই মাঝখানে প্যাচ লাগিয়েছিলে।’
মিসেস পারুল ছেলের কথা বুঝতে পারেন না। জাইন তাকে বিষয়টা বুঝিয়ে বলে। সব শোনার পর মিসেস পারুল দুঃখ প্রকাশ করেন নিজের করা অনাকাঙ্ক্ষিত ভুলের জন্য। এরপর দুঃখ ভুলে হাসিমুখে এগিয়ে আসেন। না জেনে তিনি এক ছেলের ঘর বাঁধতে গিয়ে অপর ছেলের মন ভেঙে দিতেন আরেকটু হলেই।
প্রিয়তার মুখটা দেখে বলেন,’মা শা আল্লাহ। সুখী হ দোয়া করি।’

নিহারিকা পিছন থেকে বলে,’ভাবীকে নিয়ে ভেতরে আসে ভাইয়া। আমার তো আগে থেকেই ভাবীকে পছন্দ।’

মিসেস পারুল ও ব্যস্ত গলায় বলে,’ভেতরে আয় মেয়েটা দাঁড়িয়ে আছে।’

‘কেউ ভেতরে প্রবেশ করবে না।’
গম্ভীর গলা পেয়ে সকলেই বাড়ির ভেতরে তাকায়। রমিজউদ্দিন চোখমুখ শক্ত করে তাকিয়ে আছেন।

মিসেস পারুল বলেন,’যা বলার পরে বলবা এখন ওরা নিজেদের রুমে যাক। বিশ্রাম দরকার।’

রমিজউদ্দিন উঁচু গলায় হুংকার দেন,’না! আমি বলেছি ওরা কেউ ভেতরে আসবে না।’

‘নিজের ছেলের সাথে এমন আচরণ করবা তাও নতুন বউয়ের সামনে?’

‘কীসের বউ? ঐই মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে আমি মানি না। মেয়েটাকে না ছাড়লে তোমার ছেলেকে ঘর ছাড়তে হবে।’

জাইন পাল্টা জবাব দেয়,’যেখানে আমার স্ত্রী কে অসম্মান করা হচ্ছে সেখানে আমি থাকবো না।’

রমিজউদ্দিন তাচ্ছিল্য স্বরে বলে,’যাও ভালোবাসা শেষ হলে ঘুরে ফিরে এখানেই উদয় হবা।’

‘স্বপ্ন দেখতে থাকো। আমি আমার স্ত্রী কে নিয়ে চললাম।’

জাইন প্রিয়তার হাত ধরে হাঁটা দেয়।
‘সামান্য এই মেয়ের জন্য তুমি বাপের কথা অমান্য করছো?এই মেয়ে লোভী। তোমাকেও ছেড়ে চলে যাবে। যে পরিবারকে ছাড়তে পারে সে সব পারে।’

এবার জাইন ভীষণ ক্ষেপে যায়। রমিজউদ্দিনকে কড়া কথা শোনাতে ঘুরতে নিলেই প্রিয়তা তার বাহু জড়িয়ে তাকে আঁটকায়। রাগান্বিত চোখে প্রিয়তার দিকে তাকালে দেখে সে চোখের ইশারায় তাকে চুপ থাকতে বলছে।

রমিজউদ্দিন বলেন,’তোমার মতো ছেলের জন্য এই মেয়ের বাবা আমার সাথে উঁচু কথা বলেছে। তোমার পারিবারিক শিক্ষা নিয়ে কথা শুনিয়েছে। এই মেয়েকে আমি কিছুতেই মানি না।’

জাইন জবাব দেয়,’ঠিক আছে মানতে হবে না,আসি।’

রমিজউদ্দিন রাগে ফুঁসতে ফুঁসতে বলেন,’আজকে থেকে তোমাকে আমি ত্যাজ্জপুত্র করলাম। আমার পরিবার কিংবা সম্পত্তির উপর তোমার আর কোনো অধিকার রইলো না।’

জাইন ঘাড় ঘুরিয়ে বলে,’ধন্যবাদ। তোমার কোনো কিছুই আমার প্রয়োজন নেই।’

এরপর প্রিয়তার হাত শক্ত করে ধরে হাঁটা দেয়। মিসেস পারুল পিছন থেকে কয়েকবার ডাক দেয় কিন্তু সে থামে না।

মিসেস পারুল রমিজউদ্দিনকে বলে,’এটা আপনি কি করলেন? ছেলেটাকে এভাবে কেনো যেতে দিলেন?’

রমিজউদ্দিন বলেন,’পকেট খালি হলে তখন প্রেম ভূত মাথা থেকে নামবে। আর প্রেম ভূত নামতেই সুরসুর করে এই বাড়িতেই উপস্থিত হবে।’

মিসেস পারুল বলেন,’তোমার থেকে এটা আশা করিনি।’

এরপর তিনি নিজ কক্ষে চলে যান।

রহমান ভিলা থেকে বের হয়ে জাইন প্রিয়তার হাত ধরে হাঁটছে। প্রিয়তা জাইনের পানে তাকিয়ে আছে আর তার দৃষ্টি রাস্তার দিকে। রাত এতো হয়েছে যে রিকশা পাচ্ছে না। প্রিয়তা হাঁটা থামায়। কি হয়েছে বুঝতে জাইন তার দিকে তাকায়।

জাইন প্রশ্ন করে,’হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে?’

প্রিয়তা উত্তর দেয়,’আমার জন্য আপনার নিজের পরিবারের সাথে ঝামেলা হলো। আমি জানলে কখনোই এই পদক্ষেপ নিতাম না।’

‘আমার জন্যও তো তুমি তোমার পরিবারের সাথে ঝামেলা করেছো সেটা? আত্মত্যাগ তো আমি একা করিনি তুমিও করেছো।’

‘তবুও আমার আরেকবার ভাবা উচিত ছিলো।’

‘আমার উচিত ছিলো তোমাকে তুলে আনা। তাহলে তোমার বাসায় ঝামেলা হতো না।’

প্রিয়তা কিছু বলবে এমন সময় জাইনের ফোন বেজে ওঠে। পকেট থেকে ফোন বের করতেই দেখে মারুফের কল। কল রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে মারুফ নানান প্রশ্ন শুরু করে।

‘তোরা কই আছিস? আমারে বললি যা আসতেছি এরপর খবর নাই যে?’

‘বাসায় আসছিলাম।’

‘পরে নিশ্চয়ই তোর বাপে বের করে দিছে।’

‘জানিস যখন প্রশ্ন কেন করিস?’

‘তুইও জানিস তোর বাপ কেমন তাও মেয়েটারে কষ্ট দিতে নিয়ে গেলি। তোর কি মনে হয় না তোর বাপের আচরণে প্রিয়তার খারাপ লাগতে পারে?’

মারুফের কথা শুনে জাইন প্রিয়তার দিকে তাকায়। আসলেই প্রিয়তার মুখটা দেখে মনে হচ্ছে তার মন খারাপ হয়ে গেছে।

মারুফ আবারো বলে,’আমরা ঐখানেই আছি তুই জলদি আয়।’

‘আসছি।’ বলেই কল কাটে জাইন। এরপর একটা সিএনজি ডাক দেয়। দু’জনে সিএনজিতে চড়ে বসে। প্রিয়তা অবশ্য জানে না কই যাচ্ছে তারা।

সিএনজি এসে থামতেই প্রিয়তা প্রথমে নামে।গলিটা তার কাছে চেনা চেনা লাগে। প্রিয়তা ঘুরে জাইনকে প্রশ্ন করে,’আমরা এখানে আগেও এসেছি?’

ভাড়া পরিশোধ করছিলো জাইন। অমন অবস্থায় উত্তর দেয়,’হ্যাঁ।’

জাইন আসতেই প্রিয়তার হাত ধরে বিল্ডিং এর ভেতর ঢুকে। এবার প্রিয়তার মনে পড়ে এটা সেই বাড়ি যেখানে অনু আর মকবুল থাকে।
প্রিয়তা আবারো প্রশ্ন করে,’আমরা অনু আর মকবুলের বাসায় কেনো এলাম?’

‘ঘুমাতে।’

‘কিন্তু ওদের তো রুম একটা।’

‘ওরাই বলেছে আসতে। চলো গিয়ে দেখি।’
চিলেকোঠায় আসতেই দেখা যায় পাটি বিছিয়ে মারুফ,শাকিল,মকবুল আর অনু বসে আছে। অনু এগিয়ে এসে প্রিয়তার হাত ধরে। জাইন এখনো প্রিয়তার হাত ধরে আছে ছাড়ছে না।

অনু হাসি দিয়ে বলে,’ভাইয়া এবার একটু ছাড়ুন। আপুর ফ্রেশ হওয়া দরকার।’

অনুর কথা শুনে জাইন হাত ছেড়ে দেয়। প্রিয়তাকে টেনে ভেতরে নিয়ে যায় অনু। জাইন এগিয়ে এসে পাটিতে বসতেই মারুফ তার দিকে তাকিয়ে হাসে। কটি খুলে পাশে রাখে জাইন।

জাইন মারুফের হাসি দেখে বলে,’এমন ক্যাবলার মতো হাসছিস কেন?’

মারুফ দুঃখ নিয়ে বলে,’তোর কি কপাল রে হিংসা হয়। যারে চাইলি তারেই পাইলি।’

মকবুল হেসে বলে,’ভাইয়া চাওয়ার মধ্যে শক্তি থাকতে হয়। আর যাকে ভালোবাসেন তাকে নিজের করে পেতে বহুত সংগ্রাম করতে হয়।’

‘তুই আমাকে জ্ঞান দিচ্ছিস? ভুলে যাস না তোর বেলাও আমি হেল্প করছি।’

জাইন প্রশ্ন করে সকলকে,’আজকের পুরো পরিকল্পনা কার ছিলো?’

শাকিল উত্তর দেয়,’সেটা জেনে তুই কি করবি? তুই তোর লাইলীকে পাইছিস এবার খুশি থাক।’

শাকিলের এমন প্রশ্নের পর জাইন আর এ বিষয়ে প্রশ্ন করে না। জানে প্রশ্ন করলে উত্তর আসবে না উল্টাপাল্টা কথা শোনাবে।

প্রসঙ্গ ঘুরাতে জাইন বলে,’রফিক কই?’

মারুফ হতাশ গলায় বলে,’কই আর গেছে ওর প্রেমিকার সাথে দেখা করতে। রুমা মেয়েটাও অনেক সাহায্য করছে।’

শাকিল বলে,’তোর বাপে কি বলছে?’

জাইন থমথমে গলায় জবাব দেয়,’বের করে দিয়েছে একেবারে সেই সাথে ত্যাজ্জপুত্র করেছে আমাকে।’

জাইনের কথা শুনে তিনজনই চমকে তাকায়।
মারুফ অবাক হয়ে প্রশ্ন করে,’মানে? সিরিয়াসলি?’

‘তোর কি মনে হয় ফাইজলামি?’
মারুফ মাথা নাড়ায় অর্থাৎ বিষয়টা গুরুতর।
শাকিল বলে,’বাপেরা কত কিছু বলে। এক দুই মাস পর গিয়ে আবার উপস্থিত হবি দেখবি ঠিকই মেনে নিছে। প্যারা নিস না।’

‘তুই আমার বাপকে চিনিস না। উনি যা বলেন তা-ই করেন। অবশ্য এতে আমার মাথাব্যথা নেই। প্রিয়তাও আমার বাপের টাকা দেখে আসেনি এসেছে আমাকে দেখে। আমি ওকে আদর যত্নে রাখলেই হলো।’

জাইনের কথা শুনে সকলের চুপ করে রয়। কথাটা মন্দ বলেনি জাইন। ওরা দু’জন নিজেদের নিয়ে সুখী থাকলেই হলো।
আধাঘন্টা পর অনু কক্ষ হতে বেরিয়ে আসে। অনু আসতেই মকবুল উঠে দাঁড়ায়।
অনু বলে,’চলো।’

জাইন প্রশ্ন করে বসে,’কই যাস তোরা?’

মকবুল উত্তর দেয়,’আমরা নিচে বাড়িওয়ালাদের ফাঁকা রুমটা ভাড়া নিয়েছি। সেখানেই থাকবো।’

শাকিল আর মারুফ উঠে জাইনের দিকে তাকিয়ে মিটমিট করে হাসে। এরপর তাকে আলিঙ্গন করে কানে কানে কিছু বলে। সাথে সাথে জাইন দু’জনকে ধমকায়। হাসতে হাসতে দু’জন প্রস্থান করে। অনু আর মকবুলও চলে যায়। জাইন ছাদের দরজা লাগিয়ে কক্ষের দিকে এগিয়ে যায়। পাঞ্জাবীর পকেটে ভারী কিছু অনুভব করলে পকেটে হাত রাখে। বুঝতে অসুবিধা হয় না মারুফ কাজটা করেছে। বিরবির করে মারুফকে কয়েকটা গালি দেয়।
কক্ষের দরজা খুলে ভেতরে প্রবেশ করতেই জাইনের চোখ কপালে উঠে। সাথে সাথে সে দরজা বন্ধ করে বাহিরে দাঁড়িয়ে থাকে। বুকে হাত রেখে জোরে জোরে শ্বাস নেয়। এরপর আবারো কক্ষের দরজা খুলে। কক্ষের এক পাশে মেঝেতে পাতা বিছানায় ঘোমটা টেনে বসে আছে প্রিয়তা। তার গায়ে লাল টুকটুকে শাড়ি জড়ানো। এটা
অন্য আরেকটা শাড়ি। পুরো কক্ষে তাজা ফুল আর প্রদীপ দিয়ে সাজানো হয়েছে। পরিবেশটা চমৎকার। তার চেয়েও বেশি চমৎকার লাগছে লাল রাঙা শাড়ি পরিহিত রমণীকে। জাইন ভেতরে প্রবেশ করে দরজা বন্ধ করে দেয়। প্রিয়তা মৃদু কেঁপে ওঠে। জাইন তার দিকে এগিয়ে এসে আবার থেমে যায়। এরপর শ্বাস ফেলে কক্ষের এক কোণায় রাখা ব্যাগের দিকে যায়। ব্যাগ খুলে নিজের জামা কাপড় বের করে। এগুলো জিপেই রাখা ছিলো। সবসময় জিপে জাইনের বাড়তি কাপড় থাকে। সব নিয়ে সোজা গোসল করতে বাথরুমে ঢুকে সে।
জাইন যেতেই প্রিয়তা ঘোমটা তুলে বসে। তার কিঞ্চিত মন খারাপ হয়। তবুও বসে বসে অপেক্ষা করতে শুরু করে। সেকেন্ড কেটে মিনি, মিনিট কেটে ঘন্টা পেরিয়ে যায় জাইন বের হয় না। প্রিয়তা অভিমান করে পাশ ফিরে শোয়। বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ হয় কিন্তু সে উঠে বসে না। নেত্র যুগল বন্ধ করে জোর করে শুয়ে থাকে।
টুকটাক শব্দ হয় কিন্তু প্রিয়তা ঐভাবেই ভান ধরে শুয়ে থাকে। ফ্যান বন্ধ থাকায় সে ঘেমে গেছে। কক্ষের জানালাও বন্ধ। ভেতরে ভেতরে অভিমান হয়। যার জন্য এতো কিছু সে একবার এসে তার ঘোমটা তুলে দেখলো না। হুট করে ফ্যান চলতে শুরু করে। আর প্রদীপ গুলো একে একে নিভে যায়। প্রিয়তার হৃদমাঝারে আরো বেশি অভিমান জমে। অনুভব করে জাইন তার পাশে শুয়েছে। কিছু সময় অতিবাহিত হলে জাইন তার ঘোমটা সরাতে শুরু করে। এরপর ভেজা কেশে আলতো স্পর্শ করে।
মৃদু গলায় ডাকে,’প্রিয় ঘুমাচ্ছো?’

প্রিয়তা জবাব দেয় না। জাইন আবারো ডাকে,’এই প্রিয়।’

প্রিয়তা শুধু ‘হু’ বলে সাড়া দেয়।

‘তোমার শরীর খারাপ লাগছে?’

‘হ্যাঁ।’

‘আচ্ছা ঘুমাও। শুনো আমি বাহিরে গেলাম তুমি ঘরে ঘুমাও।’

প্রিয়তা সাথে সাথে নেত্র যুগল মেলে তাকায়।
‘কেনো?’

‘বাহিরে ঘুমাবো তাই। থাকো তুমি।’

জাইন উঠতে নিলে প্রিয়তা ঘুরে তার গেঞ্জি টেনে ধরে। প্রিয়তার অপ্রত্যাশিত কাজে জাইন ভীষণ অবাক হয়।
পুরো কক্ষে ঘুটঘুটে আঁধার। এ আঁধারে একে অপরকে দেখতে পাচ্ছে না তবে নিশ্বাসের শব্দ স্পষ্ট।

জাইন গলার স্বর নামিয়ে বলে,’ছাড়ো প্রিয়।’

প্রিয়তা থমথমে গলায় বলে,’না।’

‘কেনো?’

‘এখানে ঘুমাবেন।’

জাইন শ্বাস ফেলে। প্রিয়তাকে বুঝাতে পারছে না তার ভালোর জন্যই সে বাহিরে শুতে চাচ্ছে।

‘আচ্ছা কালকে।’

‘কিন্তু আজকে রাতটা চলে গেলে তো আমি আর পাবো না।’

‘এমন রাত হাজারো আসবে। আজ তুমি ক্লান্ত, ঘুমাও।’

প্রিয়তা জাইনের কথা কানে না নিয়ে দু হাত দিয়ে তার গলা জড়িয়ে ধরে ঘাড়ে মুখ গুঁজে। জাইন প্রিয়তাকে সরাতে চাইলেও পারে না। তার শ্বাস দ্রুত ওঠানামা করছে।

‘আজ না প্রিয়।’

‘আজই।’

প্রিয়তার কাজে জাইন হার মানে। বাহুডোর আগলে নেয় প্রিয়তাকে।

ফিসফিস করে বলে,’তুমি শিওর তো?’

প্রিয়তা জাইনের গলায় ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। অনুমতি পেতেই জাইন প্রিয়তার কোমড় আঙুল স্লাইড করে। এরপর প্রিয়তাকে বিছানায় ফেলে গায়ের গেঞ্জি খুলে ছুঁড়ে দেয়। প্রিয়তার গলায় ওষ্ঠ ছোঁয়াতে শুরু করে। ধীরে ধীরে জাইনের আলতো স্পর্শ গাঢ় স্পর্শে পরিণত হয়। এক সময় তা কামড়ে পরিণত হয়।
একটু পরেই জাইন থামে। মাথা রাখে প্রিয়তার বক্ষে। দু’জনেই হাঁপাচ্ছে।
জাইন মাতাল কন্ঠে বলে,’আই লাভ ইউ প্রিয়।’

প্রিয়তা জবাব দেয় না। জাইন মুখ তুলে কিন্তু আঁধারে প্রিয়তাকে দেখা যাচ্ছে না। বেশ বিরক্ত হয় সে। এরপর একটা কাজ করে বসে। উঠে কক্ষের দরজা খুলে। এরপর চট করে এসে প্রিয়তাকে বাহুতে তুলে নেয়। ঘটনা এতো দ্রুত ঘটেছে প্রিয়তা বুঝে উঠতে পারেনি। প্রিয়তাকে নিয়ে কক্ষ হতে বের হয় জাইন। তার শাড়ির আঁচল মেঝেতে গড়াগড়ি খাচ্ছে। প্রিয়তা লজ্জা জাইনের বুকে মুখ লুকায়।

‘বাহিরে মানুষ আমি যাবো না।’

‘এতো রাতে কেউ নেই তুমি আর আমি ছাড়া।’
প্রিয়তা চোখ তুলে দেখে সত্যিই কেউ নেই। জাইন তাকে এনে পাটিতে শুইয়ে দেয়। এরপর প্রিয়তার পাশে শোয়। আধশোয়া অবস্থায় থেকে তার দিকে তাকিয়ে থাকে। আজকে না পূর্ণিমা না আমাবস্যা। প্রিয়তা মুগ্ধ নয়নে গগণের পানে তাকিয়ে রয়। কি সুন্দর লাগছে রাতের গগণ! এরপর চোখ সরাতেই দেখে জাইন তাকিয়ে আছে। এগিয়ে এসে জাইনকে জড়িয়ে তার বুকে মাথা রাখে।

জাইন হুট করে বলে,’আমার বিশ্বাস হচ্ছে না তুমি আমার বুকে। এমন কিছু করো যাতে বিশ্বাস হয় এটা স্বপ্ন না সত্যি।’

প্রিয়তা লম্বা শ্বাস নিয়ে জাইনের ওষ্ঠের দিকে তাকায়। জাইন অপ্রস্তুত হয়ে কিছু বলতে নিতেই প্রিয়তা তার ওষ্ঠ নিজ স্পর্শে বন্দী করে ফেলে। একটু পর প্রিয়তা সরে আসতে নিলে জাইন তার কোমড় জড়িয়ে আরো কাছে টেনে নেয়।

………..
(চলবে..)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|৩৩.| (১৮+ সতর্কতা)
(কপি পোস্ট কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
………..
মাঝ রাতে জানালা দিয়ে কক্ষে আলো আসছে। আবছা আলোতে সব স্পষ্ট না হলেও খানিকটা দেখা যাচ্ছে। দু’হাতে প্রিয়তাকে জড়িয়ে গভীর তন্দ্রায় তলিয়ে আছে জাইন। প্রিয়তা জাইনের কেশে আঙুল চালাচ্ছে আর তার তন্দ্রাচ্ছন্ন মুখটা দেখছে। জাইনের এই মায়াবী মুখটা তাকে আঁটকে ফেলেছে। সে না চাইতেও এতো জলদি বন্দী হয়ে গেছে জাইন নামক মানুষটাতে। প্রিয়তার কখনো এতো সুখ সুখ অনুভব হয়নি যতটা হয়েছে জাইন তার আশেপাশে থাকার কারণে। প্রথম প্রথম জাইনের পাগলামি গুলো বিরক্ত লাগতো কিন্তু এরপর সে খেয়াল করতে শুরু করলো জাইনের পাগলামি গুলো অহেতুক না তাতে ভালোবাসা মিশ্রিত। যখনই জাইনকে একটু ভালো লাগতে শুরু হয় তখনই পরিবারে জানাজানি হয়ে ঝামেলা হয়। প্রিয়তা ভেবেছিলো এবার অন্ততঃ জাইন অন্যদের মতো ঘুরে যাবে। তাকে মিথ্যে প্রমাণ করে দিয়ে জাইন নিজের ভালোবাসা পেতে তার বাসায় উপস্থিত হয়। সেই রাতে জাইনের অসহায় মুখটা প্রিয়তাকে পুরো রাত্রি কষ্ট দিয়েছে। তারপর তো প্রিয়তা নিলো এক কঠিন সিদ্ধান্ত।

প্রিয়তার ভাবনার মাঝে জাইন নড়ে ওঠে। তার গলায় মুখ গুঁজে। প্রিয়তা মৃদু কেঁপে ওঠে।জাইনের ঘনঘন নিঃশ্বাসে তার সুরসুরি লাগছে। সরানোর চেষ্টা করলে জাইন তাকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। ঘুমের মাঝেই জাইন বিরবির করে। একটু খেয়াল করতেই প্রিয়তা বুঝতে পারে সে কি বিরবির করছে। ‘আমাকে ফেলে চলে গেলে মে রে ফেলবো তোমাকে প্রিয়।’
প্রিয়তা হেসে দেয়। সামান্য সরানোর চেষ্টা করতেই ঘুমের মাঝে তাকে এতো বড় হু ম কি দিলো আর যাওয়ার চিন্তা করলে তো নিশ্চিত কিছু একটা করবে। প্রিয়তা আলতো স্পর্শে জাইনের ছোট বড় এলোমেলো কেশ গুলো আরো এলোমেলো করে দেয়।

______________

সকাল বেলা পুরো বাসার পরিবেশ থমথমে। বেল্লাল হোসেন গম্ভীর মুখে বসে আছেন। পাশেই চেয়ার ধরে দাঁড়িয়ে আছে মিসেস মাসুমা। বাসার পরিবেশ থমথমে থাকার কারণ হলো তুহিন পুলিশ ডেকেছে। সে জাইনের বিরুদ্ধে অপ হ র ণের মা ম লা করেছে। অবশ্য এটা করার পূর্বে সে রমিজউদ্দিনের সাথে গতকালকে কথা বলতে গিয়েছিলো। সে তাকে দিয়েছে এক ধমক। পরে কোনো এক মাধ্যমে জেনেছে জাইনকে তার বাবা ত্যাজ্জপুত্র করেছে। ব্যস এবার তো পেয়ে গেলো তুহিন সুযোগ। নিজের চাকরির পরোয়া না করে ঠুকে দিলো মা ম লা। বেল্লাল হোসেনের এই বিষয়ে কোনোরকম মতামত নেই। যেই মেয়ের জন্য তার মান সম্মান সব গেছে সেই মেয়েকে তিনি কিছুতেই আর ঘরে তুলবেন না।
পুলিশ যেতেই তুহিন নিজ কক্ষের দিকে পা বাড়ায়।

‘যে চলে গেছে তাকে নিয়ে এতো বাড়াবাড়ি করার কি আছে?’

বেল্লাল হোসেনের গম্ভীর গলা পেয়ে তুহিন দাঁড়ায়।

‘ও নিজ ইচ্ছায় যায়নি ওকে ফুসলিয়ে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। যখন ও নিজের ভুল বুঝতে পারবে তখন অনেক দেরি হয়ে যাবে তাই ভাই হিসেবে আমার এই মূহুর্তে যা করা দরকার তাই করছি।’

‘একটা কথা আমি স্পষ্ট বলে দেই। ঐ মেয়ের জন্য আমার ঘরের দরজা চিরকালের মতো বন্ধ। তোমরা যদি আমার কথা অমান্য করে তাকে ঘরে তুলো তাহলে আমার মরা মুখ দেখবা।’

কথাগুলো বলে বেল্লাল হোসেন উঠে বেরিয়ে যান।

মিসেস মাসুমা বলে,’উনি এমনিতেই অসুস্থ আর তোরা কি নাটক শুরু করলি। ও তো চলে গেছে থাকুক না নিজের মতো। পচুক,গলুক তাতে আমাদের কি! তুই এসব ভুলে যা।’

মিসেস মাসুমাও নিজ কক্ষে চলে যান।

তুহিন বিরবির করে বলে,’এতো সহজে তো ওদেরকে আমি সুখে থাকতে দিবো না। যেই মেয়ে আমার কথা ছাড়া এক পা নড়তো না সেই মেয়ের এতো সাহস কি করে হলো তা আমি জানতে চাই। এর শেষ দেখে তবেই ছাড়বো।’

_________

কাপড় চিপড়ে দড়িতে মেলে দিচ্ছে জাইন। প্রিয়তা ঘরের মধ্যে দরজা ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জাইন কাপড় মেলছে আর একটু পরপর বাম পাশের ছাদে তাকাচ্ছে। তার চোখেমুখে বিরক্তি স্পষ্ট। প্রিয়তা হাসছে জাইনের অবস্থা দেখে। তার বিরক্তির কারণ হলো বাম পাশের ছাদে ব্যাচেলর ছেলেরা আড্ডা দিচ্ছে। প্রিয়তা প্রথমে খেয়াল না করেই কাপড়ের বালতি নিয়ে এসেছিলো। ছেলেগুলো প্রিয়তাকে দেখে হা করে তাকিয়ে ছিলো। তারা প্রিয়তার মনোযোগ আকর্ষণে শিস দেয়। সেই সময় জাইন ঘর থেকে বের হয়। প্রিয়তাকে পাশের ছাদে তাকাতে দেখে সেও তাকায়। সাথে সাথে তার মেজাজ খারাপ হয়ে যায়। এগিয়ে এসে প্রিয়তাকে আড়াল করে দাঁড়ায়। আর ছেলেগুলোকে ধমকায়। ছেলেগুলো চুপচাপ সরে গিয়ে অন্য পাশে বসে। ইশারায় প্রিয়তাকে বলে ভেতরে যেতে। বাধ্য মেয়ের মতো প্রিয়তা ভেতরে চলে আসে। এরপর জাইনই কাপড়গুলো মেলতে শুরু করে।
কাপড় মেলা হলে পুরো ছাদে তাকিয়ে জাইন কিছু একটা চিন্তা করে। এরপর চিন্তিত মুখে কক্ষে প্রবেশ করে। কি হয়েছে জানার জন্য কাছে যেতেই প্রিয়তাকে কাছে টেনে নেয়।

‘কি ভাবছেন?’

‘কিছু না।’

প্রিয়তার দু হাত টেনে নিজের গলা জড়িয়ে নেয় সে।

‘আমি না থাকলে ঘর থেকে বের হবা না।’

‘আচ্ছা।’

‘দরকার হলে নিচে গিয়ে অনুর ঘরে বসে থাকবা।’

‘আর কিছু?’

‘কাপড়চোপড় আমিই মেলে দিবো। ছাদ ঝাড়ুও আমি দিয়ে দিবো।’

‘তাহলে আমি কি করবো?’

‘এই যে তোমার জানকে আদর করবা আর ভালোবাসবা।’

প্রিয়তা হেসে বলে,’জান ভাইকে আদর করতে হবে?’

জাইন প্রিয়তার কোমড় শক্ত করে জড়িয়ে বলে,’কীসের ভাই? আমি তোমার জান হই। একমাত্র জান।’

‘উহু জান ভাই হন।’

‘তাই না? গতরাতে তো এই জান ভাইকে ছাড়তেই চাইছিলে না। বুকে পিঠে কতগুলো আঁচড় কেটেছো এখনো জ্বলছে।’

লজ্জায় প্রিয়তার কান গরম হয়ে যায়।
‘ছিঃ! অসভ্য কোথাকার। ছাড়ুন।’

‘আগে একটু উষ্ণ স্পর্শ দাও তারপর ছাড়বো।’

‘চুল ভেজা ঝারতে হবে সরুন।’

‘সরি সরি আমি কিছু দেখিনি।’
মেয়েলী গলা পেয়ে দু’জনে চমকে যায়। সাথে সাথে দু’জন দু’জনকে ছেড়ে দাঁড়ায়। অনু এক হাত দিয়ে চোখ ঢেকে উল্টো দিকে ফিরে দাঁড়িয়ে আছে। প্রিয়তা লজ্জায় জাইনের দিকে কড়া দৃষ্টিতে তাকায়। জাইন নিজেই বুঝতে পারছে না হলোটা কি!

প্রিয়তা বলে,’ভেতরে আসো অনু।’

অনু আগের ন্যায় দাঁড়িয়ে বলে,’আসলে আমি খাবার দিতে আসছিলাম আপু। বুঝতে পারিনি।’

‘আরে তুমি ভেতরে আসো।’
প্রিয়তা এগিয়ে গিয়ে অনুকে টেনে ভেতরে নিয়ে আসে। জাইন চলে যায় কক্ষের বাহিরে।

অনু অপরাধীর ন্যায় বলে,’সরি আপু তোমাদের কোয়ালিটি টাইম নষ্ট করে দিলাম।’

‘দূর কি যে বলো না। এসবে আমি কিছু মনে করিনি। কষ্ট করে খাবার আনতে গেলা কেনো?’

‘তোমাদের তো নতুন সংসার এখনো কিছু কিনোনি তাই। আর বাহিরের খাবার খেলে অসুস্থ হয়ে যাবা। যতদিন সব কিছু কেনা হবে না ততদিন আমাদের বাসায় খাবা।’

‘মকবুলের চাকরি হয়েছে?’

অনু হেসে বলে,’জি আপু। জাইন ভাইয়া চাকরির ব্যবস্থা করে দিয়েছে তার বাবার কোম্পানিতে।’

‘সেই জন্যই তুমি খাওয়াতে চাইছো?’

‘না আপু। তোমরা না থাকলে আমরা কিছুতেই এক হতে পারতাম না। যত কিছুই করি না কেনো তোমাদের ঋণ এই জন্মে শোধ করা অসম্ভব।’

‘তোমরা সুখে থাকো সবসময়।’

অনু প্রিয়তার হাত ধরে বলে,’জানো আপু আমি প্রথমে বুঝিনি জাইন ভাইয়া তোমাকে পছন্দ করে। সেইবার তুমি আমাদের বাসায় এলে আর তোমার অনেক জ্বর হলো। তুমি তো জানোই না কি হয়েছে। ভাইয়া পুরো অস্থির হয়ে গেছিলো। কি করবেন কিছুই বুঝতে পারছিলো না। ডাক্তার ডেকে আনেন এরপর তোমার মাথায় জলপট্টি দিয়ে দেন। তুমি যতক্ষণ চোখ মেলোনি তোমার পাশে বসে ছিলো। মনে হচ্ছিলো অসুস্থ তুমি না সে। তার অবস্থা দেখে আমার আর বুঝতে অসুবিধা হয়নি সে তোমাকে কতটা ভালোবাসে। তুমি ভাইয়ার হাত ধরে সঠিক সিদ্ধান্ত নিয়েছো। এমন পুরুষ হারালে সারাজীবন আফসোস করতা।’

অনুর কথাগুলো শুনে প্রিয়তা অবাক হয়। যতই সে জাইনের ভালোবাসার গভীরতা জানছে ততই অবাক হচ্ছে। লোকটা তাকে এতো কেনো ভালোবাসে? মাঝেমাঝে তো প্রিয়তার নিজেকেই হিংসে হয়।

‘অনু আমার প্রিয়কে ছাড়বা কখন?’
জাইনের গলা পেয়ে অনু উঠে দাঁড়ায়।

‘আসলে ভাইয়া খাবার দিতে আসছিলাম। চলে যাচ্ছি।’

অনু আর দাঁড়ায় না। সাথে সাথে বেরিয়ে যায়। জাইন কক্ষ প্রবেশ করে দরজা আঁটকে দেয়।
প্রিয়তা ভ্রু কুঁচকে বলে,’এভাবে কেনো বললেন? অনু কি ভাবলো?’

‘অনু কি ভাবলো তাতে আমার কিছু যায় আসে না। আমি যখন ঘরে থাকবো তখন আরেকজনের সাথে তুমি গল্প করবা এটা তো ঠিক না। আমি না থাকলে যত খুশি গল্প করবা কোনো সমস্যা নাই।’

‘মেয়েটা খাবার নিয়ে এলো আর আমি তাকে বলবো চলে যাও?’

জাইন শ্বাস ফেলে প্রিয়তাকে টেনে বিছানায় শোয়। প্রিয়তার মাথা জাইনের বুকে।

‘হারাতে হারাতে তোমাকে পেয়েছি এ কষ্ট তো তুমি বুঝবা না। এখনো প্রতি মূহুর্তে ভেতরে অজানা ভয় গ্রাস করে আমাকে।’

প্রিয়তা মুখ তুলে বলে,’তাহলে নিজের ভাইয়ের বউ হতে কেনো ফেলে এসেছিলেন?’

‘তুমি তো বলেছিলে বিয়েতে তুমি রাজি।’

‘সেইজন্য ফেলে আসবেন? কিছু করবেননা?’

‘ফেলে আসতাম না তুলে আনতাম যদি তুমি সেই রাতে আমায় প্রত্যাখ্যান না করতে। জেদ হয়েছিলো আর অভিমান জমেছিলো তোমার উপর। ভেবেছিলাম আর কখনোই তোমার সামনে যাবো না।’

‘আচ্ছা বিয়েটা করে নিলে এখন আমায় কি ডাকতেন? ভাবী?’

জাইন চোখ রাঙায়। প্রিয়তা হাসে।

‘বিয়েটা করে নিলেই পারতাম।’

‘করেছো তো এই যে জাইন রহমানকে। আরেকবার করতে চাও? ঠিক আছে করবো যতবার চাও ততবার।’

প্রিয়তা জাইনের কপালে,চোখেমুখে বাচ্চাদের মতো আঙুল ছোঁয়ায়। জাইন চুপচাপ প্রিয়তার কান্ড সহ্য করে।

‘প্রিয়!’

‘হুম।’

‘বিকেলে বের হবো।’

‘কই যাবেন?’

‘কেনাকাটা করতে। একা যাবো না তুমিও যাবা।’

‘বের হতে আমার ভালো লাগে না।’

‘কি ভালো লাগে?’

‘আপনার বুকে ঘুমাতে।’

‘বেশি সময় লাগবে না। যাবো আর প্রয়োজনীয় জিনিস গুলো কিনে আনবো।’

‘আচ্ছা।’

…………..

বিকাল বেলা দু’জনে বেরিয়েছিলো তাদের নতুন সংসারের জন্য কেনাকাটা করতে। প্রিয়তা বাসা থেকে এক কাপড়ে বেরিয়েছিলো সাথে কিছুই আনেনি। অনু তাকে দু’টো শাড়ি উপহার দিয়েছে সেগুলোই পরেছিলো। জাইন আগে প্রিয়তার জন্য কেনাকেটা করে। সব কেনাকাটা সেরে বাসায় ফিরতে ফিরতে রাত ন’টা বেজে যায়।

ক্লান্ত শরীরে প্রিয়তা ছাদের এক কোণায় বসে আছে। ভেতরে লোকজন নতুন খাট সেট করছে। জাইনের কড়া নির্দেশ যতক্ষণ না লোকজন চলে যাবে ততক্ষণ এখানেই বসে থাকতে হবে। একটু পরপর জাইন এসে জিজ্ঞেস করছে তার কিছু লাগবে কিনা। প্রিয়তা জবাব না দিয়ে চুপচাপ বসে আছে। লোকজন চলে গেলে প্রিয়তা সোজা চলে যায় বাথরুমে। শাড়ি বদলে সুতির কামিজ পরে নেয়। হাতমুখ ধুয়ে বাথরুম থেকে বের হয়। জাইন বিছানায় বসে ফোনে কথা বলছিলো। প্রিয়তা এসে তার সামনে দাঁড়ায়। কথা শেষ হতেই জাইন উঠে দাঁড়ায়।
ফোনের দিকে তাকিয়ে বলে,’আমি ঘন্টা দুয়েক পর ফিরবো। দরজা লাগিয়ে শুয়ে থাকো। আর না হয় অনুকে ডেকে দিচ্ছি।’

‘কোথায় যাচ্ছেন?’

‘এলাকায় গ্যাঞ্জাম হয়েছে যেতে হবে।’

‘আপনাকে না বলেছি এসব বাদ দিতে?’

‘দিবো। এখন যেতে দাও।’

‘না যেতে হবে না। বাকিরা বুঝে নিবে।’

‘বুঝার চেষ্টা করো। আমি সভাপতি এখন। আমি যদি না যাই তাহলে কে সামলাবে বলো?’

প্রিয়তা মুখ কালো করে বিছানায় বসে। তার মন খারাপ হয়ে গেছে ইতিমধ্যে। জাইন এগিয়ে এসে হাঁটু ভাজ করে প্রিয়তার সামনে বসে। প্রিয়তার হাত জোর করে টেনে নেয়।

‘রাগ করেছো? বললাম তো এসব ছেড়ে দিবো। আজ শুধু যেতে দাও। মারুফ শাকিল একা সামলাতে পারছে না।’

প্রিয়তা কোনো জবাব দেয় না। মুখ ঘুরিয়ে ফেলে।

জাইন হতাশ গলায় বলে,’এই প্রিয় কথা বলছো না কেনো? আচ্ছা যাবো না।’

প্রিয়তা তাও কথা বলে না। জাইন মাথা উঁচু করে প্রিয়তার গালে চুমু দেয়। তখনই শব্দ করে জাইনের ফোনটা আবারো বেজে ওঠে। ফোন বের করে কানে দিতেই জাইনের চোখমুখ বদলে যায়। প্রিয়তাকে ছেড়ে উঠে দাঁড়ায়। ফোন কানে দিয়ে দরজা খুলে দ্রুত বেরিয়ে যায়। প্রিয়তা আহাম্মকের মতো তাকিয়ে রয়। মনে মনে ঠিক করে আজ জাইন ফিরলে তার আশেপাশে ঘেষবে না সে।

……..

কক্ষের বাতি বন্ধ করে ছাদের সামনের দিকটায় বসে আছে প্রিয়তা। এই ছাদে রেলিং এর পরিবর্তে দেয়াল দেওয়া। এক পাশে ঘর থাকায় ছাদটা ছোট হয়ে গেছে।
হঠাৎ ছাদের দরজা কেউ আঘাত করে। মাথায় ওড়না টেনে প্রিয়তা এগিয়ে যায় খুলতে। দরজা খুলতেই অনুকে হাঁপাতে দেখে।

‘আপু ভাইয়াকে পুলিশ ধরছে।’

অনুর কথা শুনে প্রিয়তা কি প্রতিক্রিয়া দিবে বুঝতে পারে না।

‘মকবুল নিচে আছে আপনি যান ও আপনাকে নিয়ে যাবে।’
প্রিয়তা দিক দিশা ভুলে ছুটে। নিচে নামতেই দেখে সিএনজি দাঁড়িয়ে আছে। সব ভুলে প্রিয়তা সিএনজিতে উঠে বসে। মকবুল চালকের পাশে বসে। দ্রুত সিএনজি টানা হয়। ঘেমে একাকার হয়ে গেছে প্রিয়তা। তার চক্ষু অশ্রুসিক্ত। একটু পরপর নানান প্রশ্ন করছে মকবুলকে।

‘আর কতক্ষণ লাগবে? একটু দ্রুত চালান প্লিজ।’

‘ভাবী বেশিক্ষণ লাগবে না। আপনি শান্ত হয়ে বসুন।’

‘ওনাকে একটু দ্রুত চালাতে বলুন ভাইয়া।’

‘এই তো পৌঁছে যাবো।’

প্রিয়তা তাও শান্ত হয় না। পুরোটা পথ বিরক্ত করে।
থানার সামনে সিএনজি থামতেই দরজা খুলে সে ভেতরে ছুটে। কনস্টেবল তাকে আটকানোর পূর্বেই সে ভেতরে ঢুকে যায়। অশ্রুসিক্ত নয়নে চারিপাশে তাকাতেই দেখে পায় এক পাশে গম্ভীর মুখে জাইন দাঁড়িয়ে আছে। পুলিশের সাথে তার বাকবিতন্ড চলছে। আর কিছু না দেখেই প্রিয়তা ছুটে গিয়ে জাইনকে জড়িয়ে ধরে। জাইনকে জড়িয়ে ধরতেই এতক্ষণ আঁটকে রাখা অশ্রু গুলো টপাটপ ঝরতে শুরু করে। জাইন গম্ভীর চেহারা এখন বদলে গেছে বিস্ময়ে। প্রিয়তাকে এক হাতে জড়িয়ে নেয়।

নিজের ডান হাতে টান অনুভব করে প্রিয়তা। মুখ তুলে তাকাতেই দেখে তুহিন তার হাত ধরে টানছে।

‘দেখছেন স্যার বলছিলাম না ওর কাছে আমার বোন সুখী না। জোর করে আমার বোনকে আঁটকে রাখছে। এখন রিমান্ডে যাওয়ার ভয়ে ওকে নিয়ে আসছে। প্রিয়তা চলে আয় ওর শাস্তি আইন দিবে।’

প্রিয়তা এক হাতে জাইনের পাঞ্জাবী খামচে বলে,’আমি কোত্থাও যাবো না ওকে ছেড়ে।’

তুহিন প্রিয়তাকে চড় মারতে উদ্যত হতেই জাইন তার হাত ধরে ফেলে।

‘উহু চিন্তাও করবেন না শালা সাহেব। প্রিয় আপনার বোন ছিলো এখন আমার স্ত্রী। আপনি প্রিয়র ভাই না হলে যেই হাত তুলেছিলে মারার জন্য সেই হাত ভেঙে গুঁড়ো করে দিতাম।’

‘দেখলেন স্যার আপনার সামনে আমাকে মারার হু ম কি দিলো।’

এসপি বলে,’আপনারা কি যে তামাশা শুরু করলেন বুঝতে পারছিনা। আমি মেয়ের বয়ান নিবো আর ম্যারেজ সার্টিফিকেট দেখবো। মেয়ে যদি নিজ ইচ্ছায় বিয়ে করে তাহলে আমাদের কিছু করার থাকবে না।’

‘কিন্তু স্যার..’

এসপি তুহিনকে থামিয়ে দেয়।
‘মেয়ে নিজ ইচ্ছায় গেলে আপনি যত কেস করেন না কেনো লাভ নেই। এই মেয়েকে ভেতরে নিয়ে আসো।’

এসপি ভেতরে চলে যায়। একজন মহিলা কনস্টেবল এগিয়ে যায় প্রিয়তাকে নিতে। প্রিয়তা জাইনকে এখনো জড়িয়ে রেখেছে ছাড়ছে না।

‘প্রিয় একটু যাও ওরা তোমার বয়ান নিবে।’

‘আপনাকে রেখে যাব না আমি।’

‘বয়ান না দিলে এই ঝামেলা বন্ধ হবে না।’

‘আপনিও চলুন সাথে।’

‘আমি তো যেতে পারবো না। তুমি না লক্ষী মেয়ে। তোমার বয়ান দেওয়া হলেই আমরা বাসায় ফিরবো।’

প্রিয়তা মুখ তুলে তাকায়। জাইন তার অশ্রু গুলো যত্ন করে মুছে দেয়।
‘যা যা জিজ্ঞেস করে সঠিক জবাব দিও তাহলে দ্রুত আমরা বাসায় যেতে পারবো।’

‘আপনি এখানেই দাঁড়িয়ে থাকবেন নড়বেন না।’

‘এখানেই আছি আমি।’

অবশেষে প্রিয়তা জাইনকে ছাড়ে। মহিলা কনস্টেবলের সাথে ভেতরে যায়। সবটা নির্বিকার হয়ে তুহিন দেখে। সে বিশ্বাসই করতে পারছে না প্রিয়তা জাইনকে ছেড়ে নড়তেও চাইছিলো না।

প্রিয়তা যেতেই জাইন গম্ভীর মুখে মারুফকে প্রশ্ন করে,’প্রিয়কে কেনো এখানে এনেছিস? আমি না নিষেধ করছিলাম?’

মারুফ মাথা নিচু করে ফেলে।
‘আমি তো শুধু মকবুলকে খবরটা দিছি।’

মাকবুল ভীত স্বরে বলে,’আমি বুঝতে পারি নাই ভাই।’

জাইন আর কিছু বলে না। চাতক পাখির ন্যায় এসপির কক্ষের দরজার দিকে তাকিয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে ভয় হচ্ছে। প্রিয়তা আগে কখনোই এসবের মুখোমুখি হয়নি তাই তো তাকে এতো জেরা করার পরও সে প্রিয়তাকে আনতে অস্বীকার জানিয়েছিলো। সে তো জানে এসবের মুখোমুখি যারা না হয় তারা সহজে নার্ভাস হয়ে উল্টোপাল্টা উত্তর দেয়।
একটু পর এসপি ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে। পিছন পিছন কনস্টেবলের সাথে প্রিয়তাও বের হয়। প্রিয়তা এসেই জাইনের পিছনে পাঞ্জাবী ধরে দাঁড়ায়।

এসপি বলে,’মিস্টার তুহিন আপনার বোন প্রাপ্ত বয়স্ক। সে বয়ান দিয়েছে নিজ ইচ্ছায় বাসা ছেড়েছে সে। প্রাপ্ত বয়স্ক নরনারী নিজ ইচ্ছায় বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে আমাদের কিছু করার থাকে না। আর বিয়ের কাগজপত্র দেখলাম সবই ঠিক আছে। মিস্টার জাইন রহমান আপনি যেতে পারেন। হয়রানির জন্য আমি আন্তরিকভাবে দুঃখিত।’

‘ইট’স ওকে অফিসার। আসি তাহলে।’
এসপির সাথে হাত মিলিয়ে নেয় জাইন। প্রিয়তাকে এক হাতে জড়িয়ে থানা থেকে বের হয়। তার সাথে বাকিরাও বের হয়।

এসপি বলে,’মিস্টার তুহিন জাইন রহমান কিন্তু ছেলে হিসেবে খারাপ নন তাকে আমরা চিনি। আপনার বোনকেও দেখলাম সেও নিজের হাসবেন্ডকে ছাড়তে চাইছিলো না। আপনাদের উচিত তাদের মেনে নেওয়া।’

‘ধন্যবাদ স্যার আপনার সাহায্যের জন্য।’

এরপর তুহিন থানা থেকে বেরিয়ে যায়।

সিএনজিতে জাইনের বুকে মাথা রেখে তার পাঞ্জাবীর বোতাম একবার খুলছে আবার বন্ধ করছে প্রিয়তা। একবার সবগুলো বোতাম খুলে দিচ্ছে আবার সবগুলো বোতাম বন্ধ করছে।

জাইন মৃদু গলায় ডাকে,’প্রিয়!’

‘হুম।’

‘ডু ইউ লাভ মি?’

প্রিয়তা মুখ তুলে বলে,’নো।’

‘তাহলে আবারো থানায় যাচ্ছি। গিয়ে বলি এই মেয়েটাকে অ প হর ণ করেছি বিক্রি করে দিবো।’

প্রিয়তা জাইনের বুকে কিল দেয়। জাইন হেসে প্রিয়তার হাত ধরে ফেলে।
কানে কানে ফিসফিস করে বলে,’একবার বাসায় যাই তারপর শোধ তুলবো। ইউ নো উষ্ণ স্পর্শ।’

প্রিয়তা গলা উঁচিয়ে বলে,’অসভ্য।’

…………..
(চলবে..)