#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|৩৪.| (১৮+ সতর্কতা)
(কপি পোস্ট কঠোরভাবে নিষিদ্ধ)
…………
আবহাওয়ার মতো সময় দ্রুত বহমান। কীভাবে যে চলে যায় টেরও পাওয়া যায় না। জাইন প্রিয়তার ছোট্ট সংসারের এক সপ্তাহ পেরিয়ে গেছে। বিগত এক সপ্তাহ বেশ সুন্দর সময় কাটিয়েছে দু’জনে। প্রিয়তার কিছু প্রয়োজন হলে জাইনকে বলতে হচ্ছে না সে নিজেই খেয়াল করে নিয়ে আসছে। দিনদিন জাইনের এতো যত্ন দেখে প্রিয়তা আরো দূর্বল হয়ে পড়ছে তার প্রতি।
গুনগুন করে গান গাইছে প্রিয়তা আর বসে ভোরের আকাশ উপভোগ করছে। জাইন ভেতরে ঘুমাচ্ছে। আকাশ ছাড়া এখান থেকে কিছুই দেখা যায় না। পুরো ছাদের ওয়ালের উপর মোটা বাঁশ ইটের সাথে বেঁধে তাতে কালো কাপড় আর পলি দিয়ে খোলা অংশ ঢেকে দিয়েছে যাতে আশেপাশের ছাদ থেকে ছেলেরা এই ছাদে না দেখতে পায়। বাড়িওয়ালাকে বলে দিয়েছে ছাদে যাতে কেউ না আসে। এর পরিবর্তে সে ভাড়া বাড়িয়ে দিবে। এতো কিছু করার কারণ সে প্রিয়তাকে বলেছিলো এটা ছেড়ে অন্য বাসায় উঠতে কিন্তু প্রিয়তা অস্বীকৃতি জানায়। তার একটাই কথা এই চিলেকোঠা ছেড়ে সে অন্য বাসায় যাবে না। প্রিয়তা বুঝতে পারেনি
জাইন এরপর এই পদক্ষেপ নিবে। জাইনের এসব কাজে প্রিয়তা বিরক্ত হয় না বরং অবাক হয়। আশেপাশের মানুষ নিশ্চয়ই এসব নিয়ে হাসিতামাশা করে। সেদিন বাড়িওয়ালী প্রিয়তাকে ধরে বলেই ফেলেছিলো। ‘তোমার জামাইয়ের মতো আমার জামাইটাও যদি বউ পাগল হতো!’
প্রিয়তা লজ্জায় কোনো কথা বলেনি। এরপর থেকে বাড়িওয়ালী তাকে দেখলেই এসব বলে আর হাসে।
প্রিয়তার ভাবনার মাঝেই পিছন থেকে জাইন তাকে জড়িয়ে কাঁধে থুঁতনি রাখে। জাইনের হাতের উপর সে হাত রাখে।
‘কি করছো?’
‘দেখছি।’
‘কি দেখছো?’
জাইনকে জ্বালাতে প্রিয়তা বলে,’ঐ যে পাশের ছাদে এক হ্যান্ডসামকে দেখলাম উন্মুক্ত শরীরে ঘুরছে।’
জাইন প্রিয়তার কথা শুনে হাসে।
প্রিয়তা মুখ ঘুরিয়ে বলে,’আর ইউ জেলাস?’
‘ঐ ছেলে নিশ্চয়ই আমার থেকে বেশি হট না?’
‘মেলাতে হবে কে বেশি হট।’
‘আমিও উন্মুক্ত শরীরে আছি দেখে নাও।’
‘আপনাকে তো দেখেছি ঐ ছেলেকে দেখে আসি।’
প্রিয়তা উঠতে নিলে জাইন তাকে ছাড়ে না।
‘ঘরে চলো দেখাবো কে বেশি হট।’
‘একদম না।’
প্রিয়তাকে বাহুতে তুলে জাইন হাঁটা দেয়।
‘সকাল সকাল আমি আমার ব্রেকফাস্ট সারবো।’
‘আমি আবার গোসল করতে পারবো না।’
‘আমি করিয়ে দিবো।’
প্রিয়তা চেঁচায় জাইন কথা কানে নেয় না।
………..
তড়িঘড়ি করে প্রিয়তা রান্না করছে। আজকে সকলকে দাওয়াত দিয়ে খাওয়ানো হবে। রিমি আর হৈমন্তী সকালবেলা কল দিয়ে জানিয়েছে ক্লাস শেষে তারা আসবে। প্রিয়তা এখনো শেষ সেমিস্টারের ক্লাসে যায়নি। জাইনও তাকে জোর করেনি। প্রিয়তার রান্না শেষের দিকে। জাইন তাকে সকাল থেকে সাহায্য কারেছে। রান্না শেষের দিকে তাই একটু আগে সে বেরিয়েছে।
ফোন বেজে উঠতেই ওড়নাতে হাত মুছে দেখে রিমির কল। রিসিভ করতেই অপরপাশ থেকে রিমির ঝাঁঝালো গলায় পায়।
‘গেট কি খুলবি নাকি ভাঙুম?’
কল না বাড়িয়ে প্রিয়তা ছুটে দরজা খুলতে। কক্ষ হতে বেরিয়ে ছাদের দরজা খুলে। হৈমন্তী এগিয়ে এসে প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে। রিমি মুখ কালো করে দাঁড়িয়ে থাকে।
‘ও একাই তো দেখা করতে আসছে আমি তাহলে গেলাম।’
রিমির অভিমান ভরা গলায় পেয়ে প্রিয়তা হেসে হৈমন্তীতে দূরে ঠেলে দেয়।
‘সর আগে আমি আমার জানের কাছে যাই।’
প্রিয়তার কথা শুনে রিমি বলে,’ভাইয়ার সামনে জান ডাকিস না তাহলে সে দেখা যাবে জেলাস হবে।’
‘তোর মতো এতো জেলাস না সে। ঘরে চল।’
ঘরে ঢুকতেই চারিদিকে রিমি চোখ বুলায়।
‘কিরে এতো কিছু কবে কিনলি?’
‘গত সপ্তাহে।’
‘আমিও পালিয়ে বিয়ে করতে চাই। আত্মীয়স্বজন খাওয়াবো যেই টাকা দিয়ে সেই টাকা দিয়ে ফার্নিচার কিনে ঘরে ভরানো যাবে।’
হৈমন্তী টিপনি কেটে বলে,’আগে দেখ তোর বিয়ে হয় কিনা।’
রিমি মন খারাপ করে বলে,’তাও ঠিকরে। আমার জীবনে একটা কাউয়াও আসে না।’
প্রিয়তা বলে,’আসবে আসবে। সঠিক সময়ে আসবে। আমি কি ভেবেছি হুট করে কিছুদিনের পরিচয়ে বিয়ে করে ফেলবো? যখন সে আসবে কেউ বিয়ে আটকাতে পারবে না।’
‘মা তো বলেই দিয়েছি গ্রাজুয়েশন শেষ কর তারপর দেখি কি করা যায়।’
প্রিয়তার ফোন বেজে উঠলে দেখে জাইনের কল। এগিয়ে যায় দরজা খুলতে। দু’দিন আগে জাইন ফোন আর সিম কিনে দিয়েছে তাকে।
‘আসসালামু আলাইকুম বেয়াইন সাহেবা। ভালো আছেন?’
মারুফের গলা পেয়ে রিমি ঘুরে বসে।
‘ওয়ালাইকুমুস সালাম।’
মারুফ আফসোসের স্বরে বলে,’আপনি আমার উপর এখনো রেগে আছেন?’
‘না তো রাগ কেনো করবো?’
‘এই যে আপনার কথায় রাগের আভাস পাচ্ছি।’
‘আমার কথাবার্তাই এমন।’
‘কি যে বলেন না! আপনার কাউয়া সরি কোকিলের স্বরে এমন রাগী কথা মানায় না।’
রিমি চোখ বড় করে তাকিয়ে বলে,’কি বললেন?’
মারুফ হেসে বলে,’সরি বেয়াইন সাহেবা ইট ওয়াজ স্লিপ অফ টাং।’
প্রিয়তা বলে,’ভাইয়া বসেন।’
রফিক,শাকিল আর মারুফ চেয়ার টেনে বসে। হৈমন্তী গিয়ে বিছানায় রিমির পাশে বসে। জাইন এতক্ষণ বাহিরে ছিলো। প্রিয়তা রান্নাঘরে যেতেই সেও পিছন পিছন যায়।
মারুফ শিস বাজায় আর গান গায়,’মেরে সামনে ওয়ালী খিড়কি পে এক চান্দ কা টুকরা রেহেতাহে…’
গান শুনে রিমি তার দিকে তাকায়।
মারুফ হাসিমুখে বলে,’গান গাচ্ছিলাম। আরো গাইবো?’
‘থাক গান গেয়ে আপনার অতো সুন্দর গলাকে কষ্ট দিতে হবে না।’
‘আরে কষ্ট কীসের! আপনার জন্য গান গাইতে আমার কষ্ট হবে না। তা আপনার বয়ফ্রেন্ড ভালো আছে?’
‘অনেক ভালো আছে। আপনি নিজের চরকায় তেল দিন।’
‘সেটা তো রোজই দেই। বলছিলাম যে সে কোন চিপায় থাকে? না মানে তাকে তো আপনার সাথে দেখি না।’
‘সে বিদেশ থাকে।’
‘ওহ! আপনারা নিশ্চয়ই স্বামী বিদেশে কথা বলেন?’
‘মানে?’
‘ঐ যে ইমু। ইমুর আরেক নাম স্বামী বিদেশ।’
‘এইসব ফালতু কথা আপনার কাছ থেকেই শুনলাম।’
‘তাহলে ভালো কিছু বলি?’
রিমি কানে ইয়ারফোন গুঁজে বসে থাকে। মারুফ অসহায়ের মতো শাকিলের দিকে তাকায়। তার অবস্থা দেখে মারুফ হাসে।
রান্নাঘরে প্রিয়তা দেখতে থাকে সব কিছু ঠিকঠাক আছে কিনা।
‘আমাকেও একটু দেখো।’
‘সরেন ব্যস্ত আছি।’
‘এদিকে আমি যে ঘেমে একাকার হয়ে আছি দেখছে না কেউ।’
জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা ঘুরে ওড়নার এক অংশ দিয়ে কপালে থাকা ঘাম মুছতে থাকে।
‘প্রিয়!’
‘হুম।’
‘আমার সাথে তুমি সুখী তো?’
প্রিয়তার হাত থেমে যায়।
‘কি মনে হয়?’
‘উত্তর দাও।’
‘দেখে মনে হয় আমি অসুখী?’
‘তবুও বলো।’
‘আমি অনেক অনেক সুখী।’
জাইন প্রিয়তার হাত টেনে বুকের উপর রাখে।
‘তোমাকে এই চিলেকোঠায় রাখছি তোমার তো কষ্ট হচ্ছে। গরমের মধ্যে। চলো আমরা নিচে কোথাও বাসায় নেই।’
‘একদম না। এখানেই আমার ভালো লাগে। আর আপনি যতদিন না ঐ রাজনীতির ছাইপাঁশ বাদ দিয়ে চাকরিবাকরি করবেন ততদিন এখান থেকে নড়ছি না।’
‘রাজনীতি ছাড়া এতো সহজ না। জানো তো এটা ভুলভুলাইয়ার মতো। একবার ঢুকলে বের হওয়ার পথ পাওয়া যায় না।’
প্রিয়তা ঘুরে রাগান্বিত গলায় বলে,’যা খুশি করুন।’
জাইন কথা বাড়ায় না ঘরে চলে যায়। কথা বাড়িয়ে এখন সে ঝগড়া করতে চাইছে না।
কিছুক্ষণ পর অনু আর মকবুল আসে। সকলে একত্রিত হতেই মেঝেতে পাটি বিছিয়ে খাবার সাজানো হয়। প্রিয়তা করতে নিলে অনু তাকে আঁটকায়। অনু সকলকে খাবার বেড়ে দেয়। জাইন এক পাশে বসে খাচ্ছিলো আর প্রিয়তাকে খাইয়ে দিচ্ছিলো। কাজ করে সে অনেক ক্লান্ত।
খাওয়াদাওয়া শেষ হতেই বিকাল পর্যন্ত সকলে আড্ডা দেয়। এরপর যে যার যার গন্তব্যে চলে যায়। জাইন মারুফ রফিক আর শাকিলের সাথে বের হয়। অনু প্রিয়তার সাথে থাকে গল্প করার জন্য।
………..
জনতা দলের কিছু ছেলেপেলে কৌশলে বাঙলা দলে ঢুকে গেছিলো। এই তথ্য গত সপ্তাহেই জাইনের কানে এসেছে। এতোদিন সুক্ষ্ম চোখে সকলকে সে পর্যবেক্ষণ করেছে। কয়েকজনকে সন্দেহ হচ্ছিলো। অবশেষে বুঝতে পেরেছে কারা। এরা জনতা দল থেকে বাঙলা দলে এসে ভেতরকার খবরাখবর পাচার করছিলো। আজকে সব গুলাকে ধরবে জাইন।
সিরিয়াল ধরে সবাইকে দাঁড়া করানো হয়। চেয়ারে পায়ের উপর পা তুলে বসে আছে জাইন। মোটা লাঠি তার হাতে। মারুফ আর শাকিল এক পাশে দাঁড়িয়ে আছে। মারুফ ফোনে গেমস খেলছে তার মাথা ব্যথা নেই। সে জানে একটু পর তান্ডব হবে।
‘চুপচাপ সামনে এগিয়ে আয় আমি কিছু বলবো না ছেড়ে দিবো। কিন্তু আমি যদি নাম ধরে ডাক দেই তাহলে একেক জনের পিঠের চামরা তুলে লবণ লাগাবো।’
সবাই ভয়ে ঢোক গিলে। কি হয়েছে কেউ বুঝতে পারছে না। জাইনকে সবাই জমের মতো ভয় পায়। তার হাতে একবার মাইর খেলে সেটা আজীবন মনে থাকে।
একজন সাহস করে বলে,’ভাই কি হইছে?’
জাইন উঠে দাঁড়ায়। লাঠিটা হাতে নিয়ে ঘুরাতে থাকে।
‘কিছু জনতা দলের সাহসী ছেলে বাঙলা দলে ঢুকছে। কত সাহস দেখ। আমি থাকা অবস্থায় তারা এই কাজ করে।’
ছেলেটা বলে,’এইগুলাকে ধরে কঠিন শাস্তি দেন।’
‘কি শাস্তি দিবো বল তো।’
‘আপনার যা ইচ্ছা।’
জাইন পকেট থেকে একটা কাগজ বের করে রফিকের হাতে ধরিয়ে দেয়।
রফিক একে একে চারজনের নাম ধরে ডাক দেয়। যাদের নাম ডাকা হয় তারা বাদে বাকিদেরকে কক্ষ হতে বের করে দেওয়া হয়। ছেলেগুলোর মধ্যে একজন সাহস দেখিয়ে গলা উঁচু করে।
‘আপনি আমগো গায়ে টোকা দিলে আপনার হাড্ডি আস্তা থকবো না।’
জাইন হাসি দিয়ে পাঞ্জাবীর হাতা গুটায়।
‘তাই বুঝি? রফিক ওর হাতে লাঠি দে একটা। দেখি কেমন হাড্ডি ভাঙতে পারে।’
রফিক ছেলেটার হাতে লাঠি দেয়। দুই হাতে লাঠি ধরে ছেলেটা জাইনের দিকে এগিয়ে আসে। আঘাত করতে নিলে এক হাতে ধরে ফেলে সে।
‘কীভাবে মারতে হয় তা তো জানিস না। আয় দেখাই।’
এরপর ছেলেটাকে লাথি মেরে মেঝেতে ফেলে দেয়। হাতে পায়ে সমানে আঘাত করে। পুরো কক্ষ ছেলেটার আহাজারিতে ভারি হয়ে ওঠে। বাকি তিনজন একে অপরকে ধরে কাঁপতে শুরু করে। এমন বেধারক মার খেলে তাদের পরিণতি কি হবে তা ভেবেই কাঁদছে তারা।
জাইনের ফোন বেজে উঠলে মারুফ দেখে প্রিয়তার কল।
‘প্রিয়তা কল দিছে।’
লাঠি ফেলে জাইন সোজা হয়ে দাঁড়ায়। মারুফের হাত থেকে ফোনটা নেয়।
‘আপনি কোথায়? এখনো ফিরছেন না কেনো?’
হাতের উল্টো পিঠে কপালের ঘাম মুছে নেয় জাইন।
‘এই তো রিকশাতে আছি আর দশ মিনিট লাগবে।’
‘এতো রাত হয়ে গেছে এখন বলছেন আর দশ মিনিট। দেরি করলে কিন্তু দরজা খুলবো না।’
‘এই তো চলে এসেছি। তোমার জন্য কি আনবো?’
‘আইসক্রিম ম্যাংগোটা।’
‘আচ্ছা আনবো। ছাদে কয়েকটা চক্রর দাও দেখবা চলে আসছি।’
কল কেটে জাইন দেখে সকলে তার দিকে তাকিয়ে আছে।
মারুফ বলে,’বুঝলাম বাপেরও বাপ আছে। তুই তোর বউকে ভয় পাস।’
জাইন চুলগুলো পিছনে ঠেলে বলে,’ভয় পাই না ভালোবাসি। ভালোবাসে প্রিয়র কাছে নিজেকে আত্মসমর্পণ করতে লজ্জা নেই আমার।’
শাকিল বলে,’তুই তাহলে বাসায় যা। আমরা এদিকটা সামলে নিবো।’
লাঠি ফেলে জাইন বেরিয়ে যায়। মারুফ আড়মোড়া ভেঙে ছেলেগুলোর উদ্দেশ্যে বলে,’জাইনের মতো কঠিন মাইর দিতে পারুম না কিন্তু এমন মাইর দিবো হাসপাতালে তো ভর্তি থাকবিই।’
এরপর শুরু হয় আঘাতের পর আঘাত।
আইসক্রিম হাতে রিকশায় চড়ে বাসায় ফিরছে জাইন। দশ মিনিট বলেছিলো এখন বিশ মিনিট পেরিয়ে গেলোও সে বাসায় ফেরেনি। রাতের বেলা দেরি করে বাসায় ফিরলে প্রিয়তা নিশ্চয়ই রাগ করবে। তাই তো একটার জায়গায় তিনটা আইসক্রিম নিয়েছে প্রিয়তার রাগ ভাঙাতে। একবার ভেবেছে কল দিবে কিন্তু পরক্ষণেই মনে হলো একেবারে বাসায় গিয়েই পরিস্থিতি বুঝবে।
রাতের বেলা রাস্তা প্রায় ফাঁকা বলা যায়। রিকশা আরামসে টেনে চলছে। হুট করে একটা গাড়ি অনেক স্পিডে এসে রিকশাকে ধাক্কা দেয়। সাথে সাথে রিকশা চালক সহ জাইন ছিটকে রাস্তার এক পাশে পড়ে যায়। রিকশা চালকের মাথা ফেটে রক্ত বের হয়। রাস্তা লাল রক্তে ভেসে যায়। জাইন দু হাতে মাথা আগলে রাখায় শুধু কপালের এক পাশে কেটেছে। নিজের ব্যথা ভুলে মাথা উঁচিয়ে দেখছে রিকশা চালকের কি অবস্থা।
গাড়িটা ঘুরে এসে জাইনের পাশে থামে। চালকের পাশের আসনের জানালার কাচ নামিয়ে এক লোক জাইনের দিকে তাকিয়ে হাসে।
‘এটা ট্রেলার। বেশি বাড়াবাড়ি করলে সোজা উপরে পাঠামু।’
জাইন চোখমুখ শক্ত করে লোকটার দিকে তাকিয়ে থাকে। এরপর গাড়ি টেনে তারা চলে যায়। রাস্তা থেকে উঠার শক্তি নেই। পকেট থেকে ফোন বের করে মারুফকে কল লাগায়। এরপর মধ্যে পথচারীরা ছুটে আসে সাহায্য করতে।
…….
হাতে পায়ে ব্যান্ডেজ নিয়ে বিছানায় আধ শোয়া অবস্থায় আছে জাইন। অমসৃণ রাস্তা হওয়াতে কপালের সাথে এক হাত থেতলে গেছে আরেক হাত ছিলে গেছে। জিন্সের প্যান্ট পরিধানে থাকায় পা ছিলেনি শুধু আঘাত পেয়েছে। পিঠও ছিলেছে সেই সাথে আঘাত পেয়েছে। এখন রাত দেড়টা বাজে। মরুফ আর শাকিল হাসপাতাল থেকে একটু আগে তাকে বাসায় দিয়ে গেছে।
প্রিয়তা রান্নাঘর থেকে হটব্যাগে গরম পানি ভরে নিয়ে আসে। ব্যাগটা জাইনের পিঠের পিছনে দিয়ে উঠে দাঁড়ায়। আরেকটা তোয়ালে ভিজিয়ে এনে শরীর মুছে দেয়। প্রিয়তার মুখটা থমথমে। জাইন শুধু প্রিয়তাকে দেখছে। সে ফিরেছে পর থেকে প্রিয়তা তার সাথে ভালো মন্দ কোনো কথাই বলেনি। এমনকি কথার জবাবও দেয়নি।
আবার এসে শুকনো এক গামছা দিয়ে জাইনের মুখ মুছে দেয় এরপর উঠতে নিলে জাইন তার হাত টেনে ধরে।
‘বুকে আসো আর কিছু করতে হবে না।’
প্রিয়তা চুপচাপ জাইনের বুকে মাথা রাখে। এক হাতে প্রিয়তাকে জড়িয়ে নেয়।
‘রেগে আছো?’
প্রিয়তা জবাব দেয় না। তার ভেতরে ভীষণ অভিমান জমেছে।
‘প্রিয়! এই প্রিয়।’
‘একদম আমাকে এই নামে ডাকবেন না।’
‘তাহলে কাকে ডাকবো?’
‘যে আপনার এসব সহ্য করবে তাকে।’
‘তুমিই তো সহ্য করো আর কেউ করবে না। আর আমার তো অন্য কাউকে লাগবে না।’
প্রিয়তা মুখ তুলে বলে,’আপনার রি ভ ল বারটা কই?’
জাইন ভীত গলায় প্রশ্ন করে,’কেনো?’
‘আমার লাগবে।’
‘কি করবা?’
‘আপনার বুকের এখানে গু লি করবো। এখানে মাথা রাখলেই আমার রাগ নিমিষেই গলে যায়।’
প্রিয়তার কথা শুনে জাইন হাসে।
‘ক্লাবে আছে কাল এনে দিবো।’
‘আপনি এরপরও এইসব ছাড়বেন না?’
জাইন দীর্ঘশ্বাস ফেলে।
‘আপনি যদি এসব না ছাড়েন আমি চলে যাবো।’
‘আমাকে ফেলে তুমি কোথায় যাবা?’
‘যেখানে দু চোখ যায়। সত্যি সত্যি চলে যাবো।’
‘যাওয়ার আগে আমাকে মেরে যেও না হলে তুমি তো যেতে পারবা না।’
প্রিয়তা দু হাতে জাইনের গলা জড়িয়ে কাঁধে মাথা রাখে। কষ্ট হলেও জাইন সয়ে নেয়।
‘আপনি আমাকে ভালোবাসেন না।’
‘এমন কেনো মনে হলো?’
‘এই যে আমার কথা শুনেন না।’
‘সময় দাও সব হবে।’
প্রিয়তা মুখ তুলে জাইনের গালে চুম্বন দেয়। এরপর ওষ্ঠের দিকে তাকায়। জাইন প্রিয়তার ওষ্ঠে ছোট্ট করে উষ্ণ পরশ দেয়।
‘আজ আদর করতে পারবো না প্রিয়। বুকে আসো ঘুম পাড়িয়ে দেই।’
প্রিয়তা বুকে মাথা রাখতেই তার কেশে আঙুল চালাতে শুরু করে। ধীরে ধীরে গভীর তন্দ্রায় তলিয়ে যায় প্রিয়তা। ঘুমন্ত প্রিয়তার দিকে মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে জাইন।
‘মরেছি আমি তোর প্রেমে, বুঝিস না কেনো?
তুই বুকে না থাকলে এ প্রেমিক হয়ে যাবে শূন্য।’
……..
(চলবে..)
#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|৩৫.|
(লেখা কপি পোস্ট নিষিদ্ধ)
……….
এমপি খালেকুজ্জামান গুরুত্বপূর্ণ মিটিং এ ছিলেন। বাহির থেকে তার পিওন নক করে জানায় জাইন দেখা করতে এসেছে। খালেকুজ্জামান খানিকটা চিন্তিত হন। হঠাৎ না বলে জাইন দেখা করতে সোজা অফিসে চলে এলো মনে হচ্ছে বিষয়টা গুরুত্বপূর্ণ অনেক।
‘আমরা দশ মিনিটের বিরতি নেই। আপনারা পাশের কেবিনে চা খেতে বসেন।’
খালেকুজ্জামানের কথায় সবাই উঠে পাশের কেবিনে চলে যায়।
‘ডাক দাও জাইন রহমানকে।’
‘আচ্ছা স্যার।’
দরজা টেনে পিওন বাহিরে আসে। পাশাপাশি চেয়ারে প্রিয়তার হাত ধরে বসে আছে জাইন। প্রিয়তা দৃষ্টি ঘুরিয়ে আশেপাশটা দেখছে। মাথায় টেনেছে লম্বা ঘোমটা। আর জাইন দেখছে প্রিয়তার অস্থিরতা। মুখে স্বীকার না করলেও প্রিয়তা যে সবটা নিয়ে চিন্তা করছে তার বেশ বুঝতে পারছে জাইন।
‘স্যার আপনাকে ভেতরে যেতে বলছে।’
কথাটা বলে পিয়ন চলে যায়।
‘তুমি বসো আমি যাবো আর আসবো।’
প্রিয়তা জাইনের হাত ছাড়েনা। নেত্রযুগল ছোট ছোট করে তাকায়।
‘আমাকে নিয়ে যান। এখানে একা বসতে পারবো না।’
‘স্যারের কেবিনে নেওয়া তো সম্ভব না।’
‘আমি বাহিরে অপেক্ষা করবো।’
‘এখানেই বসো।’
‘না।’
প্রিয়তা নাছোড়বান্দা। তার জেদের কাছে হার মানে জাইন।
‘আচ্ছা চলো।’
হাত ধরে হাঁটা দেয়। কেবিনের সামনে আসতেই দরজার পাশে প্রিয়তাকে চুপচাপ দাঁড়িয়ে থাকতে বলে সে ভেতরে প্রবেশ করে। প্রিয়তাও তার কথা মেনে নেয়।
খালেকুজ্জামান জাইনকে দেখে হাসিমুখে কুশল বিনিময় করে। জাইন সালাম প্রদান করে তার খোঁজ খবর নেয়।
‘তোমার উপর যারা হামলা করেছিলো ওদের খোঁজ পেয়েছো?’
‘পাইনি এখনো।’
‘আমি আরো লোকজনকে বলে দিচ্ছি দ্রুত খোঁজ পেয়ে যাবা। চিন্তা করো না।’
জাইন আর কিছু বলে না।
‘শুনলাম তুমি নাকি বাসা থেকে পালিয়ে বিয়ে করেছো? আমি ম্যানেজারকে বলেছি তোমাদের জন্য একটা ফ্ল্যাট বুক করতে। আরামসে থাকবা। যতদিন আমি বেঁচে আছি টাকা পয়সা নিয়ে চিন্তা করবা না। তোমাদের দু’জনের দায়িত্ব আমার।’
‘আমি স্যার কিছু গুরুত্বপূর্ণ কথা বলতে এসেছি।’
‘হ্যাঁ বলবা তো আগে চেয়ার টেনে বসো।’
পাঞ্জাবী উঠিয়ে কোমড়ে গুঁজে রাখা রি ভ ল ভা রটা বের করে টেবিলের উপর রাখে জাইন। খালেকুজ্জামান আন্দাজ করতে পারছেন এবার কি ঘটবে।
‘আমি আজ থেকে এসব ছাড়ছি। বাঙলা দল,রাজনীতি সব কিছু।’
খালেকুজ্জামান চমকালো না। তার অভিব্যক্তি দেখে মনে হলো সে এসব আগেও দেখেছে।
‘হঠাৎ এই সিদ্ধান্ত?’
‘আমার স্ত্রী এর জন্য। ও চায় না আমি এসবে আর থাকি। আমাকে নিয়ে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে চায়।’
‘করো কোনো সমস্যা নেই আমি তো বাঁধা দেইনি। তুমি দলে কম সময় দাও। তোমার উপর কাজের বোঝাও কমিয়ে দিবো।’
‘আমি আমার স্ত্রীকে অনেক ভালোবাসি। আমার উপর বিশ্বাস করে সে নিজের পরিবার ছেড়েছে তার এইটুকু চাওয়া আমি অপূর্ণ রাখবো না।’
‘আমি তো জানতাম তুমি রাজনীতি করো না মানবসেবা করো।’
‘করতাম কিন্তু আজ থেকে নিজের স্ত্রীর দিকে সব সময়,মনোযোগ দিবো। আমাকে নিয়ে ও সবসময় আতংকে থাকে। আমি ওকে আর কোনোরকম টেনশন দিতে চাইনা।’
খালেকুজ্জামান হাসে জাইনের কথা শুনে।
‘আমিও নিজের পছন্দে বিয়ে করেছি কিন্তু কখনো স্ত্রীকে প্রশ্রয় দেইনি।’
‘স্ত্রীকে আমাদের জীবনে ভালোবাসা দিয়ে রাখতে হয় শাসনে না। ঐ যে দেখুন আমাকে একা ছাড়বে না বলে সেও সাথে এসেছে। সে ভয় পাচ্ছে একা ছাড়লে আবার কারো সাথে ঝামেলায় জড়াবো।’
খালেকুজ্জামান তাকিয়ে দেখে গ্লাসের অপর পাশে কামিজ পরিহিত এক যুবতী দাঁড়িয়ে আছে।
জাইন শ্বাস ফেলে বলে,’মানুষের জন্য কাজ করতে আমি ভালোবাসি কিন্তু এর থেকেও বহুগুণ বেশি আমার স্ত্রীকে ভালোবাসি।’
খালেকুজ্জামান চেয়ার ছেড়ে উঠে এসে জাইনের কাঁধে চাপড় দেয়।
‘আমি জানতাম তুমি ভালো ছেলে আজ দেখলাম ভালো স্বামীও। যাও তুমি। সুন্দর করে সংসার সাজাও। আর ফ্ল্যাটের চাবি পাঠিয়ে দিবো।’
‘লাগবে না স্যার দোয়া করবেন।’
‘আমার পক্ষ হতে বিয়ের ছোট্ট উপহার ভেবে নিও।’
‘আমি নিলেও আমার স্ত্রী নিবে না। ও যা বলে যেভাবে বলে আমি সেভাবেই করার ও চলার চেষ্টা করি।’
খালেকুজ্জামান হেসে মাথায় হাত বুলিয়ে দেয়। বিদায় নিয়ে জাইন বের হয়। এতক্ষণ প্রিয়তা মাথা ভর্তি চিন্তা নিয়ে দাঁড়িয়ে ছিলো। জাইন বের হতেই তার দিকে প্রশ্নবোধক দৃষ্টিতে তাকায়।
জাইনের কাছে জবাব না পেয়ে সে প্রশ্ন করে,’কি বললো?’
‘বাহিরে চলো বলছি।’
প্রিয়তার চিন্তার মাত্রা বেড়ে যায়। সে নাছোড়বান্দা।
‘না এখনই বলেন।’
জাইন প্রিয়তার হাত ধরে বলে,’এখন থেকে তুমি যা চাইবে যেমন চাইবে তেমনটাই হবে। সবকিছু ছেড়ে দিয়েছি।’
নেত্রযুগল ছোট ছোট করে প্রিয়তা প্রশ্ন করে,’সত্যি?’
‘তিন সত্যি।’
প্রিয়তা খুশিতে জাইনকে জড়িয়ে ধরে। জাইন ভ্যাবাচ্যাকা খায়। মাঝে মাঝে প্রিয়তা এমন কিছু অপ্রত্যাশিত কাজ করে বসে। সব কাজ ছেড়ে দেওয়াতে প্রিয়তা এতো খুশি হবে ভাবতে পারেনি সে।
_____________
‘কেমন আছিস তোরা?’
মিসেস পারুলের প্রশ্ন শুনে জাইন প্রিয়তার দিকে তাকায়।
ছাদের এক পাশে গোসল সেরে ভেজা চুলগুলো ঝারছে প্রিয়তা।
‘আলহামদুলিল্লাহ অনেক ভালো আছি।’
‘তোর বাবা কালকে খুলনা যাচ্ছে তুই এই ফাঁকে প্রিয়তাকে নিয়ে আয়।’
‘আমি গেলেও তোমার বউমা যেতে রাজি হবে কিনা তা সন্দিহান।’
‘তুই কিচ্ছু বলবি না। চুপচাপ নিয়ে আসবি। বিয়ের পর মেয়েটাকে না এক বেলা কাছে পেলাম না একটু আদর যত্ন করতে পারলাম! সব মেয়েরই তো কত স্বপ্ন থাকে শ্বশুড়বাড়ি নিয়ে।’
‘তুমি একদিন এসে ঘুরে যাও।’
‘তোরা আয় তারপর যাবো। আর মেয়েটাকে একা ছাড়িস না। নিজের সবাইকে ছেড়ে ও তোর হাত ধরেছে। এখন তুই ওর সব কিছু।’
জাইন প্রিয়তার দিকে আবারো তাকায়। চুল ঝারা শেষে কাপড়গুলো মেলতে ব্যস্ত সে।
‘কি বললাম শুনেছিস?’
‘চিন্তা করো না মা। এই যে হাত ধরেছি আমৃত্যু ধরে রাখবো। এক মূহুর্তের জন্য ও ছাড়বো না।’
‘দোয়া করি সুখী হ সবসময়।’
কল কেটে প্রিয়তার দিকে এগিয়ে যায় সে। প্রিয়তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে তার ভেজা চুল গুলো যত্ন করে সরাতে শুরু করে। জাইনের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি একটা হাসি দেয় প্রিয়তা।
‘প্রিয়।’
প্রিয়তা জবাব দেয় না।
‘এই প্রিয়।’
ভ্রু উঁচিয়ে প্রশ্নসূচক দৃষ্টিতে তাকায় প্রিয়তা। জাইন অধৈর্য্য হয়ে এগিয়ে এসে দু হাতের মাঝে প্রিয়তার মুখটা ধরে রাখে।
‘তুমি আমার কথার জবাব দিচ্ছো না কেনো?’
‘শুনছি বলেন।’
‘আমার খিদে পেয়েছে ভীষণ।’
জাইনের খিদের কথা শুনে প্রিয়তা ব্যস্ত হয়ে যায়।
‘চলেন খাবার দেই।’
জাইন গলার স্বর নামিয়ে বলে,’এটা অন্য খিদে।’
প্রিয়তা জাইনের কথা শুনে ভ্রু কুঁচকে ফেলে।
‘সময় নষ্ট করার আমার হাতে সময় নেই। সরুন কাজ করতে দিন।’
‘আমি করে দিলে হবে না?’
‘না আমাকেই করতে দিন। সকালে রুটি ভাজতে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলেছেন তাই এখন সাহায্য লাগবে না,ধন্যবাদ।’
এরপর হাত ঝারা দিয়ে আবারো কাপড় মেলায় মনোযোগ দেয়। জাইন প্রিয়তার বিপরীতে দাঁড়িয়ে আবারো তার চুল নিয়ে বাচ্চাদের মতো আঙুলে পেঁচাতে শুরু করে।
‘সিভি দিয়েছিলেন?’
‘হুম।’
‘ইন্টারভিউ এর জন্য কবে ডাকবে?’
‘হুম।’
প্রিয়তার কথায় জাইনের খেয়াল নেই। প্রিয়তা বিরক্তি নিয়ে তাকায়।
‘কি প্রশ্ন করেছি আপনাকে?’
‘কি?’
‘ইন্টারভিউ এর জন্য কবে ডাকবে?’
‘কালই ডেকেছে।’
‘কই আমাকে তো জানালেন না!’
‘যাওয়ার আগে বলে যেতাম।’
‘কালকে কখন ইন্টারভিউ?’
‘সকাল দশটায়।’
প্রিয়তা মনে মনে হিসাব কষে নেয়। এরপর কাপড় গুলো রেখে জাইনের দিকে ফিরে তাকায়। তার কথা মতো সব ছেড়ে চাকরি করতে রাজি হয়েছে জাইন। বিভিন্ন জায়গায় সিভি দিয়েছে চাকরির জন্য। মাঝে মাঝে প্রিয়তা বুঝতে পারে না জাইন তাকে এতো কেনো ভালোবাসে। তার প্রতিটি কথা অক্ষরে অক্ষরে মেনে নিচ্ছে।
‘আমার একটা প্রশ্নের উত্তর দিন তো।’
‘একটা প্রশ্ন করবা কেনো? বেশি করো।’
‘একদম উল্টোপাল্টা কথা বলে আমাকে কনফিউজড করবেন না।’
প্রিয়তার কথা শুনে জাইন হাসে। ছোট ছোট কথায় প্রিয়তাকে ক্ষেপাতে তার বেশ লাগে।
‘আচ্ছা যে ক’টা ইচ্ছে প্রশ্ন করো।’
‘আপনি আমার কথা অক্ষরে অক্ষরে কেনো পালন করছেন?’
‘এটার উত্তর আমি দিবো না। তুমি খুঁজে নাও। খিদে পেয়েছে ঘরে গেলাম জলদি আসো। আর হ্যাঁ ভাত খাবো এখন অন্য কিছু না।’
জাইন কক্ষের দিকে হাঁটা দেয়। প্রিয়তা জাইনের যাওয়ার পানে তাকিয়ে থাকে। আপন মনে বিরবির করে বাকি কাপড়গুলো মেলে দেয়।
……..
রিকশা থেকে নামতেই প্রিয়তা জাইনের হাত চেপে ধরে।
‘আমরা আবার এখানে এলাম কেনো?’
‘আম্মা তোমার সাথে দেখা করতে চেয়েছে।’
‘আপনার বাবাও তো আছে। সে দেখলেই তো ঝামেলা করবে।’
‘আমরা ভেতরে যাবো না।’
জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা চমকায়।
‘তুমি এখানে দাঁড়াবা আমি আম্মাকে ডেকে আনবো।’
প্রিয়তা কোনোরকম প্রশ্ন করার পূর্বেই জাইন তাকে আঁটকে দেয়।
‘তোমার অসম্মান হয় এমন কোথাও তোমাকে আমি নিবো না। আব্বা সম্মানে তোমাকে ঘরে তুললে তবেই এই বাড়ির ভেতর তুমি যাবা এর আগে না। আম্মার কথা তো ফেলতে পারি না তাই দেখা করতে নিয়ে এলাম।’
জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা চোখ তুলে তার দিকে তাকায়। যতই জাইনকে দেখছে তত বেশি মুগ্ধ হচ্ছে। জাইন নিজের কার্যকলাপে তাকে সবসময় মুগ্ধ করে ফেলছে।
‘আমি যাবো আর আসবো দাঁড়াও।’
প্রিয়তা গেইটের পাশে দাঁড়ায়। জাইন ভেতরে প্রবেশ করে। পাঁচ মিনিট এরপর দশ মিনিট কেটে যায় জাইন ফেরে না। প্রিয়তা কিঞ্চিত চিন্তিত হয়ে ভেতরে উঁকি দিতে নিলেই ধাক্কা খায়। মাথা তুলে দেখে জাইন তাকে দু হাতে আগলে নিয়েছে।
‘বললাম মেয়েটাকে নিয়ে বাড়ির ভেতরে আয় কিন্তু কে শুনে কার কথা। বাপের মতো হয়েছে ছেলেগুলো।’
মিসেস পারুলের গলা পেয়ে প্রিয়তা জাইনকে ছেড়ে দাঁড়ায়। মিসেস পারুল এসেই প্রিয়তাকে জড়িয়ে ধরে।
‘তোমাকে মেয়ে হিসেবে আমার এমনিতেই পছন্দ। বাড়ির বউ হয়েছো তাও বাড়ির ভেতরে নিতে পারছি না। এটা যে আমাকে কত কষ্ট দিচ্ছে বলে বোঝাতে পারবো না।’
জাইন বলে,’তোমার বর ঝামেলা না করলে আমরা দ্রুতই আসবো।’
মিসেস পারুল নিজের হাতের বালা জোড়া খুলে প্রিয়তাকে পরিয়ে দেয়। প্রিয়তা নিতে চায় না সে জোর করে।
‘আম্মা এগুলোর দরকার নেই। প্রিয় এসব পরবে না শুধু শুধু দিচ্ছো।’
‘এগুলো আমার শ্বাশুড়ি আমাকে দিয়েছিলো আজকে প্রিয়তাকে দিলাম। জাইনের বংশের চিহ্ন এগুলো। রেখে দাও। হাত থেকে খুলবা না।’
‘কিন্তু..’
প্রিয়তা কিছু বলতে নিলে মিসেস পারুল তাকে ধমকায়।
‘কোনো কিন্তু না রাখো। এগুলো আমার দোয়া। সবসময় সুখী হও আর একত্রে থাকো।’
প্রিয়তা জাইনের দিকে তাকালে সে ও ইশারা করে রাখার জন্য।
মিসেস পারুল চেষ্টা করে দু’জনকে ভেতরে নেওয়ার কিন্তু জাইন রাজি হয় না। কিছুতেই রমিজউদ্দিনের অনুপস্থিতিতে তার অনুমতি ছাড়া সে প্রিয়তাকে নিয়ে ভেতরে যেতে চায় না। শেষে মিসেস পারুল হার মানে। দেখা শেষ হলে বিদায় নিয়ে মার্কেটের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়।
পথিমধ্যে বালুর মাঠে সাপ্তাহিক মেলা দেখে প্রিয়তা বায়না করে ভেতরে যাওয়ার। জাইন তার কথা মতো মেলার ভেতরে নিয়ে যায়। চুড়ির দোকান দেখেই প্রিয়তা সেদিকে ছুটে। একের পর এক চুড়ি বের করে হাতে পরে দেখতে থাকে। জাইন পাশে দাঁড়িয়ে প্রিয়তার কান্ড দেখছে। এক ডজন চুড়ি প্রিয়তার বেশ ভালো লাগে। চুড়ি গুলো এনে জাইনের হাতে দেয় পরিয়ে দেওয়ার জন্য।
‘হাত এগিয়ে আনো।’
প্রিয়তা হাত এগিয়ে দেয়। যত্ন করে চুড়ি পরাতে শুরু করে জাইন।
‘তোমার মনে আছে একবার মেলা থেকে চুড়ি নিয়েছিলে?’
‘হ্যাঁ কেনো?’
চুড়ি পরানো বন্ধ করে জাইন প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে হাসে।
প্রিয়তা না বুঝে প্রশ্ন করে,’এটা হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন কেনো?’
‘আমি সেবার কাজে মাঠে এসেছিলাম। এসে দেখি তুমি দোকানদারের সাথে দাম নিয়ে ঝগড়া করছো।’
জাইনের কথা শুনে প্রিয়তার মুখ ফ্যাকাসে হয়ে যায়। প্রিয়তা কিছু বলতে নেয় এর মধ্যে এক ছেলে তাদের মাঝে মুখ থুবড়ে চুড়ির টেবিলের উপর পড়ে। কিছু চুড়ি ভেঙে ছেলেটার মাথায় আর মুখে লাগে। প্রিয়তা ভয়ে দু পা পিছিয়ে যায়। জাইনের চোখমুখ মূহুর্তেই শক্ত হয়ে যায়। চোখ তুলে পাশ ফিরে তাকাতেই দেখে এক দল ছেলে হাতে হকিস্টিক নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। যেই ছেলেটাকে মেরেছে সেই ছেলেটাকে জাইন ভালো করেই চিনে। বাঙলা দলে থাকতে ছেলেটা জাইনের সকল ফরমায়েশ শুনতো।
‘কিরে এটা আমাদের এলাকার বাঙলা দলের সভাপতি না?’
‘সভাপতি ছিলো এখন সে এসব দল করবে না।’
‘তেইলে এক্স সভাপতি?’
কথাগুলো বলেই ছেলেগুলো একে অপরের দিকে তাকিয়ে অট্টহাসিতে ফেটে পড়ে। প্রিয়তা দ্রুত এগিয়ে এসে জাইনের হাত ধরে। জাইনের মেজাজ খারাপ হয়ে গেছে।
‘তাহলে এক্স সভাপতি নিজের এক্স দলের ছেলেকে মাইরের হাত থেকে বাঁচাবে না?’
যেই ছেলেটা মার খেয়েছে সে জাইনকে দেখে ভরসা পায়। উঠে জাইনের দিকে এগোয় সাহায্যের আশায়। পিছন থেকে জনতা দলের এক ছেলে এসে তার শার্টের কলার ধরে টেনে নিয়ে যায়। ছেলেটা সাহায্যের জন্য দু হাত দিয়ে জাইনের দিকে ইশারা করে। প্রিয়তা জাইনের হাত ধরে হাঁটা দেয়। পেছন থেকে মাইরের শব্দ হয়। জাইন থেমে যায়। প্রিয়তা জাইনের হাত ধরে টান দেয় কিন্তু শক্তির সাথে পেরে উঠে না। এসব ঝামেলায় প্রিয়তা থাকতে চাইছে না।
জাইন হুট করে বলে,’ছেলেটা বোবা। ওকে যতই মারুক শব্দ করবে না।’
জাইনের এহেন কথা শুনে ঘাড় ঘুরিয়ে প্রিয়তা তার দিকে দৃষ্টি রাখে। জাইনের চোখমুখ দেখে আঁতকে ওঠে সে।
‘এমন একটা ছেলেকে ফেলে আমাদের যাওয়া উচিত?’
জাইনের প্রশ্ন শুনে প্রিয়তা তার হাত ছেড়ে দিয়ে শান্ত চাহনি দেয়।
জনতা দলের একজন বলে,’ঐ সভাপতি তো যায় না। সভাপতিরে বাহির কর আর সাথে তার ভাইগা আসা প্রেমিকারেও।’
দু’জন ছেলে হকিস্টিক হাতে এগিয়ে আসে। পেছন থেকে প্রিয়তাকে আঘাত করতে নিলে জাইন এসে ঠেকায়।
জাইন ঐ অবস্থায় প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলে,’তুমি বললে ছেড়ে দিবো এদের। একজনকেও টোকা দিবো না। আর না বাঁধা দিলে সবগুলাকে এখানেই পুঁতে দিবো।’
প্রিয়তা কিছু না বলে পিছিয়ে যায়। এই মূহুর্তে তার কি বলা উচিত সে বুঝতে পারছে না। সে একদমই চায় না জাইন এসব মারপিটে জড়াক। হুট করে বাম বাহুতে কিছুর আঘাত লাগে এরপর তীব্র ব্যথা অনুভব করে। অপর হাত দিয়ে বাহু চেপে মাটিতে বসে পড়ে সে। কয়েক সেকেন্ড তার বুঝতে সময় লাগে কি হলো। একটু পর পাশে গোঙ্গানির শব্দ পায়।
চোখ তুলে তাকিয়ে দেখে ছেলেটার গলা চেপে ধরে আছে জাইন। হাতের হকিস্টিকটা ছিটকে এক পাশে পড়ে আছে। প্রিয়তা নিজের ব্যথা ভুলে দ্রুত উঠে জাইনের হাত ধরে আটকানোর চেষ্টা করতে থাকে।
জাইন হুংকার দিয়ে বলে,’তোর সাহস কি করে হয় আমার প্রিয়কে আঘাত করার?’
প্রিয়তা জাইনকে টেনে বলে,’ছেড়ে দেন আমি ঠিক আছি।’
জাইন প্রিয়তার কথায় কান না দিয়ে বলে,’আয় এখন ওরে ছুঁয়ে দেখা।’
জনতা দলের ছেলেগুলো ঢোক গিলে পেছাতে থাকে। যেই ছেলেটা প্রিয়তাকে আঘাত করেছিলো সেই ছেলেটা উঠতে নিলে জাইন ছেলেটার হাতের উপর পা রেখে ডলতে শুরু করে। ছেলেটা ব্যথায় আর্তনাদ করে। এই ফাঁকে বাঙলা দলের সেই ছেলেটা উঠে পালায়।
‘সভাপতি তোর সাথে আমাদের শত্রুতা নাই সরে যা নইলে খারাপ হবে।’
জাইন চিৎকার করে বলে,’কি করবি কর। আয় কলিজা থাকলে দেখি কত পারিস।’
‘পিছনে তো দেখ একবার।’
ছেলেটার কথা শুনে জাইন পিছনে তাকায়। সাথে সাথে তার শিরদাঁড়া বেয়ে শীতল কিছু নেমে যায়।
জনতা দলের এক ছেলে প্রিয়তার গলায় ছুরি ধরে আছে। প্রিয়তার চোখমুখে ভয়ের ছাপ স্পষ্ট।
………
(চলবে..)