প্রণয়ী পর্ব-৩৬+৩৭

0
20

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|৩৬.| (১৮+ সর্তকতা)
(কপি পোস্ট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
………

‘আমার প্রিয়কে ছাড়।’
জাইন চিৎকার করে বলে।

প্রিয়তা প্রতিক্রিয়া শূন্য হয়ে তাকিয়ে আছে জাইনের দিকে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে গলায় ছুরি ধরাতে সে ভয় পাচ্ছে না। বরং তার ভয়টা জাইনকে নিয়ে। তার দৃষ্টি বিচরণ করছে জাইনের দিকে।

জাইন আশেপাশের সবাইকে উপেক্ষা করে প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাকিরা জাইনের চিৎকার শুনে ভয় পায়।

বর্ষণের পর হিম শীতল হাওয়া বয়ে যায় চারিদিকে। সেই হাওয়া শরীর মন কাঁপিয়ে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। মানুষ মাত্রাতিরিক্ত ভয় পেলে নিজের আশেপাশে সেই হাওয়ার উপস্থিতি টের পায়। নিজের চোখের সামনে প্রাণ প্রিয় প্রিয়তমার গলায় কেউ ছুরি ধরে আছে এমন দৃশ্য দেখলে যে কারো ভেতরটা কেঁপে উঠবে। জাইনকের অবস্থা এই মূহুর্তে তেমন।

জাইন এগিয়ে আসতে নিলে প্রিয়তা মাথা নাড়িয়ে না করে এগোতে। জাইনের পা থেমে যায়। দু হাত উঁচিয়ে আত্নসমর্পণের ভঙি করে। মাথা গরম করতে চাইছে না সে।

‘এই দেখ আমি এগোবো না। আমার প্রিয়কে ছাড়। তোদের কিছু বলবো না।’

কথাগুলো বলে প্রিয়তার দিকে তাকায় এরপর আবার করুন গলায় বলে,’খোদার কসম আমার প্রিয়র কিছু হলে সবাইকে জাহান্নাম দেখাবো।’

ছেলেটা তবুও প্রিয়তার গলা থেকে ছুরি সরায় না।

‘ঐ এনাকে ছাইড়া পালা। মারুফ আর শাকিল দল নিয়া আইতাছে।’
কথাগুলো বলে আরেক ছেলে সকলকে তাড়া দেয় পালানোর জন্য। জনতা দলের পোলাপান যে যেই অবস্থায় ছিলো সেই অবস্থায় উঠে দৌড় দেয়৷ যেই ছেলেটা প্রিয়তার গলায় ছুরি ধরা ও কিছু বুঝে ওঠার পূর্বেই বাকিরা তাকে ছেড়ে পালিয়েছে। ঢোক গিলে জাইনের দিকে তাকায়। জাইন শান্ত দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে। মানুষজন দূর হতে সব দেখছে কিন্তু কেউ সাহায্যের জন্য এগিয়ে আসছে না। কাজ ফেলে সকলে তামাশা দেখতে ব্যস্ত।

‘সব গুলাকে ধর রফিক৷ একটারেও জান নিয়া যাইতে দিমু না। কাইট্টা ভাসামু।’
মারুফের গলা পেয়ে প্রিয়তার গলায় ছুরি ধরে রাখা ছেলেটা প্রিয়তার গলার আরো কাছাকাছি ছুরিটা ধরে পেছাতে থাকে। এ দৃশ্য দেখে মারুফ আর শাকিল দৌড়ে আসে। তাদের সাথে রয়েছে বাঙলা দলের পোলাপান। সকলে অস্ত্র নিয়ে এসেছে। সাথে বোবা ছেলেটাও আছে যাকে জাইন বাঁচিয়েছে। ও গিয়েই সবাইকে খবর দিয়ে এনেছে।

মারুফ ছেলেটাকে উদ্দেশ্য করে বলে,’প্রিয়তাকে ছাড় নইলে তোর কপালে শনির দশা আছে।’

ছেলেটা কাঁপা কাঁপা গলায় উত্তর দেয়,’কেউ আমার দিকে এগুবি না। এগুলে মাইয়াটারে মাইরা দিমু।’

জাইন ইশারা করতেই মারুফ আর শাকিল থেমে যায়। বুঝতে পারে উত্তেজিত হলে হিতে বিপরীত কিছু ঘটবে।

শাকিল বলে,’তুই পালা আমরা তোরে ধরবো না। তুই শুধু প্রিয়তাকে ছাড়।’

ছেলেটা জোর গলায় বলে,’ছাড়ুম না। বেশি করলে এক পোস দিমু।’

ছুরিটা ধারালো হওয়াতে প্রিয়তার গলার চামড়া কেটে রক্ত বের হয়। রক্ত দেখে জাইনের দমিয়ে রাখা রাগ নিমিষেই দাউদাউ করে ওঠে। প্রিয়তা নেত্র যুগল বন্ধ করে প্রার্থনা করছে এ সময়টা যেনো দ্রুত কেটে যায়। দাঁতে দাঁত চেপে জাইন নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করার চেষ্টা করছে। আর ছেলেটা ধীরে ধীরে পেছাচ্ছে পালানোর জন্য।

হুট করে ছেলেটা কিছু বুঝে উঠার পূর্বে পেছন থেকে তাকে রফিক সহ আরো দুইজন জাপটে ধরে সরায়। জাইন দৌড়ে এসে প্রিয়তাকে সেখান থেকে সরায়। ছেলেটার হাত থেকে ছুরি কেঁড়ে নিয়ে তাকে দুই পাশ থেকে দুইজন ধরে রাখে। রফিকের হাতে সেই ছুরি। আচমকা কি হলো বুঝতে পারেনি প্রিয়তা। জাইন প্রিয়তার গলার কাটা স্থানে আঙুল ছোঁয়াতেই রক্ত তার আঙুলে লাগে। ওষ্ঠ চেপে যন্ত্রণা দমন করার চেষ্টা করে প্রিয়তা।
জাইন মারুফকে ইশারা করে প্রিয়তার পাশে থাকার জন্য। মারুফ এগিয়ে এসে দাঁড়াতেই জাইন পাঞ্জাবীর হাতা গুটিয়ে ছেলেটাকে মারতে যায়। ছেলেটার গেঞ্জি ধরে এক থাপ্পড় বসায় গালে। এরপর আরেক থাপ্পড় মারতে নিলে কেউ তার হাত ধরে আঁটকায়। চোখমুখ শক্ত করে তাকাতেই দেখে প্রিয়তা তার হাত ধরে আছে।

ধীর গলায় প্রিয়তা বলে,’বাসায় যাবো।’

সাথে সাথে জাইনের চোখমুখ বদলে যায়। ছেলেটার গেঞ্জি ছেড়ে দিতেই সে বালুর মাঝে পড়ে যায়। জাইন প্রিয়তাকে এক হাতে জড়িয়ে ধরে যেনো প্রিয়তা ছোট্ট শিশু। ওড়না দিয়ে প্রিয়তাকে ঢেকে দেয়। এরপর হাঁটা দেয়। মারুফ এগিয়ে এসে ছেলেটার গেঞ্জি টেনে তুলে।

ছেলেটা হাসতে হাসতে বলে,’আমি জীবন। আমারে কিছু করলে তোদের সবগুলার জীবন নরক বানামু।’

কথাগুলো জাইনের কান এড়ায় না। ঘাড় ঘুরিয়ে ছেলেটাকে একবার দেখে নেয়। যেনো দৃষ্টি দিয়ে গিলে ফেলবে।
প্রিয়তা চোখ তুলে জাইনের দিকে তাকায়। যতই চেষ্টা করছে এসব থেকে জাইনকে দূরে সরাতে ততই এসব তাদের জীবনে চলে আসছে। দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে প্রিয়তার ভেতর থেকে।

……….

সুন্দর সময়টা এক নিমিষে বিষাদে ভরে গেলো। দু’জনে ভেবেছিলো সময়টা সুন্দর কাটাবে কিন্তু পরিকল্পনা মাফিক কিছুই হলো না।
বাসায় ফিরেই প্রিয়তা গোসলে ঢুকেছে। আধাঘন্টা অতিক্রম হলেও এখনো সে বাথরুম থেকে বের হয়নি। জাইন কপালে হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে আছে৷ বাহির থেকে আসার পর গায়ের পোশাকও বদলায়নি৷ তার মেজাজ মাত্রাতিরিক্ত খারাপ হয়ে আছে। পুরোটা রাস্তা সিএনজিতে দু’জনের একজনও কথা বলেনি। প্রিয়তা জাইনের বুকে মাথা দিয়ে বসে ছিলো আর সে প্রিয়তার কেশে আঙুল চালিয়ে তাকে ভরসা দিয়েছে। বাসায় ফেরার পরও দু’জনের মধ্যে নিরবতা বিদ্যমান।

বাথরুমের দরজা খোলার শব্দ হতেই জাইনের টনক নড়ে তবুও চুপচাপ আগের ন্যায় শুয়ে থাকে। প্রিয়তা সর্ব প্রথম বিছানায় শুয়ে থাকা জাইনের দিকে নজর দেয়। জাইনের দিকে তাকালেই বারবার তার সেই শক্ত চোখমুখ ভেসে উঠছে। রেগে গেলে এই জাইন কেমন বদলে যায়। প্রিয়তা আয়নার সামনে বসে চুল মুছতে। আয়নাতে তার গলার ক্ষতটা স্পষ্ট দেখা যাচ্ছে। গোসল করার সময় জায়গাটা জ্বলেছিলো। ঘাড় ঘুরিয়ে আবারো জাইনের দিকে তাকায়। সে একবারো তার সাথে কথা বললো না এমনকি কাছে এসে জিজ্ঞেস ও করলো না প্রিয়তা ঠিক আছে কিনা। প্রিয়তার ভেতরে অভিমান জমে। নিঃশব্দে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
অনেকক্ষণ কোনো শব্দ না পেয়ে চক্ষু মেলে তাকায় জাইন। পুরো কক্ষে দৃষ্টি ঘুরিয়ে দেখে নেয়। না প্রিয়তা কোত্থাও নেই! লাফ দিয়ে শোয়া থেকে উঠে বিছানা হতে নামে।

প্রথমে ধীর গলায় এরপর উঁচু গলায় ডাকে।
‘প্রিয়..প্রিয়..প্রিয়..’

প্রিয়তার কোনো সাড়াশব্দ নেই। কক্ষ হতে বেরিয়ে ছাদে নজর বুলায়। এক কোণায় প্রিয়তা মাথা নিচু করে বসে আছে। শ্বাস ফেলে সেদিকে এগিয়ে যায় সে। ভেজা কেশ গুলো এলোমেলো। তোয়ালে পাশেই পাটির উপর রাখা। জাইন গিয়ে তার পাশে বসে৷ প্রিয়তা চুপচাপ বসে থাকে কোনো শব্দ করে না। তার কেশ হতে এখনো বিন্দু বিন্দু জল ঝড়ছে। জামার একাংশ ভিজে গেছে। গায়ের ওড়নাটা এক পাশে আছে অপরপাশ মেঝেতে। জাইন তোয়ালে তুলে প্রিয়তার ভেজা কেশ মুছতে শুরু করে।

‘রেগে আছো?’

মুখ ঘুরিয়ে প্রিয়তা তাকায়।

‘আজকে আমার কিছু হলে আপনি কি করতেন?’

এমন প্রশ্ন শুনে জাইন প্রিয়তার মুখ চেপে ধরে।

‘আমি থাকতে তোমার কিছুই হবে না। আমি হতে দিবো না।’

প্রিয়তা জাইনের হাত মুখ থেকে সরিয়ে দেয়।

‘আপনি এসব ছাড়লেও আপনাকে কেনো এসব ছাড়ছে না? আপনি যখন রেগে যান আপনাকে চিনতে পারি না। অন্য লোকদের চেয়ে আমার আপনাকে দেখে তখন ভয় লাগে। যেভাবে ছেলেগুলোকে মারছিলেন আমি তাকাতে পারছিলাম না।’

জাইনের হাত নিস্তেজ হয়ে যায়। চোখ সরিয়ে অন্য দিকে দৃষ্টি রাখে।

‘মারপিট আমি ভয় পাই। আমি একটা শান্তিপূর্ণ স্বাভাবিক জীবন চাই৷ জীবনে আর অশান্তি চাই না।’

জাইন সাথে সাথে প্রিয়তার মাথা নিজের বুকে চেপে ধরে। জোরে জোরে শ্বাস প্রশ্বাস চলার কারণে তার হৃদপিণ্ডটা জোরে লাফাচ্ছে। কান পেতে সেই শব্দ প্রিয়তা শুনতে পাচ্ছে।

‘আমি তোমাকে দেওয়া কথা রাখতে পারনি এখনো। আমার ব্যর্থতা এটা। তোমাকে বলেছিলাম কোনো রকম কষ্ট দিবো না,আদরে মুড়িয়ে রাখবো কিন্তু আমি ব্যর্থ। তবে এবার সব ঠিক করে ফেলবো। ভালো একটা চাকরিতে ঢুকবো এরপর তোমাকে নিয়ে এখান থেকে দূরে চলে যাবো যেখানে কেউ আমাদের চিনবে না। আমাদের সংসার সাজাবো আর সুখে-শান্তিতে থাকবো।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায়। চক্ষু বন্ধ করে প্রিয়তার কপালে ওষ্ঠ ছুঁইয়ে পরশ দেয় সে। আবেশে প্রিয়তা চক্ষু বন্ধ করে ফেলে।

মৃদুস্বরে জাইন বলে,’আই লাভ ইউ প্রিয়। লাভ ইউ এ লট। তুমি আমার সর্বত্র বিচরণ করছো।’

প্রিয়তা চক্ষু মেলে তাকিয়ে বলে,’লাভ ইউ টু।’

জাইন প্রিয়তাকে টেনে জড়িয়ে ধরে।
‘আমার সাথে থাকতে তোমার কষ্ট হচ্ছে তাই না?’

‘উহু।’

‘বাড়ির লোকদের মিস করছো?’

প্রশ্ন শুনে প্রিয়তা ঢোক গিলে।
‘না।’

‘একটু গুছিয়ে নেই তারপর তোমার বাড়ি যাবো আমরা।’

‘না দরকার নেই।’

জাইন চুপ হয়ে যায়। বুঝতে পারে প্রিয়তার মন খারাপ।

‘ঘরে চলো খেয়ে ঘুমাবো।’

প্রিয়তা জাইনকে ছেড়ে বলে,’খাবার তো নেই৷ আপনি বলেছিলেন বাহির হতে খেয়ে আসবো।’

প্রিয়তা বলায় জাইনের মনে পড়ে। মাথা চুলতে চিন্তা করে কি করবে এতো রাতে। রাত বারোটার বেশি বাজে। উঠে কক্ষের দিকে যায়৷ প্রিয়তা তাকিয়ে দেখে। এরপর জাইনের কানে ফোন দেখতে পায়। কারো সাথে কথা বলছে সে। দৃষ্টি সরিয়ে গগণের পানে তাকায় সে৷ বাড়ির লোকদের রোজ মনে পড়ে তার। প্রতি রাতে তার বাবা ফেরার সময় তার জন্য কিছু না কিছু খাবার নিয়ে আসতো। মা যতই বকাবকি করুক না কেনো সে ছোট বেলায় প্রিয়তার অনেক যত্ন করতো। খাবারের সময় সকলে টেবিলে বসে খেতো আর খোশগল্প করতো যা প্রিয়তা ভীষণ মিস করে। তার জানতে ইচ্ছে হয় সকলে কেমন আছে। মাঝে একদিন রফিকের কাছ থেকে রুমার নাম্বার নিয়ে কল দিয়েছিলো। রুমার কাছ থেকে বাড়ির লোকদের খবর নেয়। রুমা জানায় বাড়ির পরিবেশ বদলে গেছে। তার বাবা আর আগের মতো কারো সাথে কথা বলে না৷ সবসময় গম্ভীর হয়ে থাকে। তার মা আগের মতো কারো ঘরে যায় না। তবে তুহিনের গলা আগের মতোই শোনা যায়। সে চেঁচামেচি করে এখনো। সকলে নিজ জীবনে ফিরছে। কথাগুলো জাইনকে জানায়নি প্রিয়তা। তার মনে হয়েছে এসব জানালে জাইন বুঝে যাবে সে পরিবারের জন্য কষ্ট পাচ্ছে। পরে দেখা গেলো জাইন নিজেকে সবটার জন্য অপরাধী ভেবে বসলো।

কেউ না জানুক প্রিয়তা তো জানে সে একাই এক রাতে সিদ্ধান্ত নিয়েছিল জাইনের সাথে অপরিকল্পিত ভবিষ্যৎ গড়ার। কেনো জানি সেই মূহুর্তে এই সিদ্ধান্ত নেওয়াটাই তার কাছে সঠিক মনে হয়েছে। আচ্ছা জাইন যদি কখনো সত্যিটা জানে তাহলে কি তাকে ছেড়ে চলে যাবে? নাকি ভুল বুঝবে। প্রশ্নগুলো মস্তিষ্কে এলেই প্রিয়তার নিজেকে পাগল পাগল লাগে। কীভাবে সবটা বলবে বুঝতে পারছে না৷ আবার মনে হয় প্রয়োজন নেই বলার। যেমন চলছে চলুক। বাকি জীবনটা জাইনের বক্ষে মাথা রেখে কাটাতে চায় সে।

‘কী ভাবছো?’
প্রিয়তার এলোমেলো চিন্তা গুলো কিছুক্ষণের জন্য বন্ধ হয় জাইনের প্রশ্ন।

‘কিছু না। আপনি পোশাক বদলে আসেন।’

‘তাকিয়ে দেখো।’

প্রিয়তা তাকিয়ে দেখে জাইন গোসল সেরে এসেছে। কতটা সময় বসে বসে চিন্তা করছিলো ঠাওর করতে পারলো না।

জাইন শ্বাস ফেলে বলে,’কিছু একটা নিয়ে গভীর চিন্তায় মত্ত ছিলে তাই না? তুমি অস্বীকার করলেও আমি বুঝতে পারছি। আমি জানি তুমি কি নিয়ে এতো চিন্তা করছো।’

জাইনের শেষের কথাটা শুনে প্রিয়তা ভয়ার্ত দৃষ্টিতে তাকায়।

‘তোমার কি মনে হয় আমি এসব বুঝি না? অনেকদিন ধরে লক্ষ করছি কিন্তু কখনো বলিনি কিছু।’

প্রিয়তা প্রশ্ন করে,’কী বলছেন বুঝতে পারছি না।’

‘তুমি পরিবারের লোকদের মিস করছো তাই না?’

প্রিয়তা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলে।
জাইন এগিয়ে এসে প্রিয়তার মুখটা দুই হাতের মাঝে রাখে।

ধীর গলায় বলে,’আমাকে মিথ্যে কেনো বলছো? আমিও তো আমার পরিবারকে মিস করি। আমারো ইচ্ছে করে তোমাকে নিয়ে পরিবারের সঙ্গে থাকি৷ একা একা তোমার কত কষ্ট হয়। এই জন্য আমার চাকরি নিতেও ইচ্ছে করে না।’

‘যতক্ষণ আপনি আমার সাথে আছে ততক্ষণ যত দূরেই যান না কেনো মনে হয় আমার আশে পাশে আছেন। দূরত্ব তখন আর মনে হয় না। শারীরিক দূরত্ব থাকলেও মনের দূরত্ব মিটে যায়।’

জাইন না বুঝেই তাকায়। প্রিয়তা জাইনের হাত ধরে টেনে দাঁড় করায়।
‘আসেন আপনাকে একটা ম্যাজিক দেখাই।’

জাইনের হাত সোজা করে তাকে দাঁড় করায়।
‘চোখ বন্ধ করে লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ছাড়ুন।’
প্রিয়তার কথা মতো জাইন চক্ষু বন্ধ করে। এরপর লম্বা একটা শ্বাস নিয়ে ছাড়ে।

‘আবারো শ্বাস নিন আর ছাড়ুন। এভাবে তিনবার করুন। আর আমার কথা চিন্তা করুন।’
পরপর তিনবার শ্বাস নেয় আর ছাড়ে। এরপর প্রিয়তার নামটা মাথায় আনতেই প্রিয়তার চেহারে চোখের সামনে ভেসে ওঠে। ধীরে ধীরে জাইনের নিজেকে হালকা লাগে। হঠাৎ করে মৃদৃ হাওয়া তাকে আলতো ছুঁইয়ে যায়।

প্রিয়তা ফিসফিস করে বলে,’যেই হাওয়াটা আপনাকে ছুঁইয়ে যাবে সেই হাওয়াটা আমি। আমাদের মাঝে শারীরিক দূরত্ব থাকলেও যখন আমাকে অনেক মিস করবেন তখন এভাবে আমার কথা চিন্তা করলে আমি এসে আপনাকে ছুঁইয়ে যাবো৷ তখন মনে হবে সবসময় আমি আছি আপনার আশেপাশে।’

প্রিয়তার কথা শুনে চক্ষু মেলে জাইন তার দিকে তাকায়। হাসিমুখে প্রিয়তা তার দিকে তাকিয়ে আছে। বাহির থেকে আসা হলদে বাতির আলোতে প্রিয়তাকে মোহনীয় লাগছে। হুট করে জাইন প্রিয়তার ওষ্ঠে চুম্বন দেয়। অপ্রস্তুত থাকায় প্রিয়তার জাইনের গেঞ্জির গলা মুঠো করে ধরে ভারসাম্য বজায় রাখতে।
একটু পর প্রিয়তাকে ছেড়ে জাইন বলে,’এক মূহুর্তের জন্য ও তুমি আমার থেকে দূরে থাকবা না৷ সবসময় আমার সাথেই থাকবা। আর আমি তোমাতে বিচরণ করে নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখবো।’

জাইনের কথা শুনে প্রিয়তা তার গালে হাত রাখে। আলতো হেসে গলা দু হাতে জড়িয়ে ধরে। দেরি না করে জাইন আবারো প্রিয়তার ওষ্ঠে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়।
ছাদের দরজা কেউ শব্দ করে আঘাতে করলে প্রিয়তার হুঁশ ফেরে। জাইনকে সরানোর চেষ্টা করলে সে আরো শক্ত করে তাকে চেপে ধরে।

দরজার অপর পাশ থেকে আঘাত করতে থাকে মারুফ। জাইন কল দেওয়াতে খাবার কিনে এনেছে সে। বিরক্ত হয়ে জাইনের নাম্বার ডায়াল করে কিন্তু সে রিসিভ করে না। গলা উঁচিয়ে কয়েকবার ডাকও দেয়।

‘ঐ শালা দরজা খোল। আমি বাসায় যামু।’
কারো কোনো সাড়াশব্দ নেই। রাগে খাবারটা দরজার সামনেই রেখে হাঁটা দেয় সে।

‘খাবার রেখে গেলাম কেউ নিয়া খাইলে আমি দায়ভার নিমু না।’

মারুফ যেতেই জাইন প্রিয়তাকে ছাড়ে।

প্রিয়তা বলে,’মারুফ ভাইয়া এসেছে দরজা খুলেন।’

জাইন ঘোর লাগা স্বরে বলে,’এখন দরজা বন্ধ হবে। আমাদের রুমের।’

‘কিন্তু আমার খিদে পেয়েছে।’

‘আমারো।’

‘খাবারটা নিয়ে আসেন খাই।’

জাইন ফিসফিস করে বলে,’উহু এখন না পরে। এখন এখানে এখানে আর এখানে উষ্ণ স্পর্শ দিবো।’

জাইনের নজরে গলার ক্ষতটা আসে। আলতো চুমু দেয় সেখানে। এরপর ক্ষতের আশেপাশে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। মুখ তুলে তাকাতেই প্রিয়তা করুণ চোখে তাকায়। জাইন সে দৃষ্টি উপেক্ষা করে তাকে বাহুতে তুলে নেয়।

‘সবেই গোসল করলাম।’

‘আজ রাতে আরো দু’বার গোসল করবা।’

প্রিয়তা চক্ষু জোড়া ছোট ছোট করে জাইনের বুকে কিল দেয়।

‘আরো কয়েকটা দাও। বিছানায় গেলে তো সুযোগ পাবা না। তখন শুধু স্পর্শ নিবা। উষ্ণ স্পর্শ।’
………
(চলবে..)

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|৩৭.|
(কপি পোস্ট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
………..

গ্রীষ্মকাল পেরিয়ে এখন চলছে বর্ষাকাল তবে ঋতুর ক্যালেন্ডার পরিবর্তন হলেও এখনো প্রকৃতির ক্যালেন্ডার বদলায়নি। কোথাও বর্ষণের ছিটেফোঁটা নেই। গগণকে দেখে মনে হচ্ছে রাগ করে থম মেরে আছে। গরমে জনজীবন অতিষ্ঠ। সকলের প্রার্থনা একটু বর্ষণ হোক।

এমন আবহাওয়াতে জাইনের ইচ্ছে করছে না চাকরির ইন্টারভিউ দিতে যেতে কিন্তু প্রিয়তা সে তো ভোরে উঠে তার জন্য নাশতা বানিয়েছে। জাইনকে জোর করে ঘুম থেকে তুলে গোসল করতে পাঠিয়েছে৷ এরপর পোশাক বদলে নাশতা খেতে বসিয়ে দিয়েছে। খাবার নিয়ে জাইন বসে আছে আর প্রিয়তা চুল আঁচড়ে নিচ্ছে। সে-ও তৈরি হচ্ছে। আজকে অনেকদিন পর ভার্সিটিতে যাবে। শেষ সেমিস্টারের ক্লাস চলছে যা সে ইতিমধ্যে অনেকগুলো মিস করেছে। বাকিগুলো মিস করতে চাইছে না।
প্রিয়তা তৈরি হতেই জাইন রুটি ডিম পেঁচিয়ে তার মুখের সামনে ধরে। কোনো রকম কথা না বলে প্রিয়তা খেয়ে নেয়। খাওয়া শেষ হতেই জাইন তাড়া দেয় বের হওয়ার জন্য। প্রিয়তাকে ভার্সিটিতে রেখে এরপর সে ইন্টারভিউ দিতে যাবে।
বাসা থেকে বের হওয়ার পূর্বে প্রিয়তা খেয়াল করে জাইনের শার্টের বোতাম সবগুলো লাগায়নি। ইন্টারভিউ দিতে যাবে তাই প্রিয়তার কথা মতো শার্টটা কিনে এনেছিলো। প্রিয়তাই পছন্দ করে দিয়েছে। এগিয়ে এসে শার্টের বোতামগুলো লাগাতে শুরু করে প্রিয়তা। কাজ শেষ করে জাইনের দিকে শুকনো মুখে তাকায়।

‘আজকে আপনি আপনার বেস্টটা দিবেন। কিছুতেই মাথা গরম করবেন না। যা প্রশ্ন করে উত্তর জানা না থাকলে বিনয়ী হয়ে সরি বলবেন।’

জাইন চুপ করে ছোট বাচ্চার মতো প্রিয়তার উপদেশ শোনে। প্রিয়তা জাইনের দুই গালে হাত রাখে। এরপর জাইনের ললাটে ওষ্ঠ ছোঁয়ায়। নেত্র যুগল বন্ধ করে উভয়ই সেই স্পর্শ উপভোগ করে। জাইনের গালে হাত রেখেই প্রিয়তা বলে,’আপনার মায়ের আর আমার দোয়া সবসময় আপনার সাথে থাকবে। বেস্ট অফ লাক।’

প্রিয়তার কথা শুনে সাথে সাথে জাইন তাকে জড়িয়ে ধরে। আজকের দিনটা সত্যিই তার জন্য গুরুত্বপূর্ণ। প্রিয়তার আশা ভরসা তাকে রাখতেই হবে।

…….

ভার্সিটির সামনে সিএনজি থামতেই প্রিয়তা নামে। দু’কদম সামনে এগিয়ে গিয়ে আবার ফেরত আসে। জাইন প্রশ্নবোধক চাহনি দেয়।

জাইনের এলোমেলো কেশগুলো হাত দিয়ে ঠিক করে দেয় সে।
‘সাবধানে যাবেন। পৌঁছে মেসেজ দিবেন আর ইন্টারভিউ শেষ হতেই আমাকে কল দিবেন।’

নিরবতা ভেঙে জাইন বলে,’আই লাভ ইউ প্রিয়।’

প্রিয়তা জাইনের দিকে মোহনীয় দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। তার কেমন সুখ সুখ লাগছে। মনে হচ্ছে আশেপাশে শত প্রজাপতি ডানা মেলে উড়ছে।
‘আই লাভ ইউ টু।’

প্রিয়তা সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে হাত নেড়ে বিদায় জানায়। সিএনজি স্টার্ট দিতেই জাইন মাথা বের করে সে-ও হাত নাড়ায়। যতক্ষণ পর্যন্ত সিএনজি দেখা যাচ্ছিলো প্রিয়তা হাত নাড়ায়। এরপর সিএনজি অদৃশ্য হতেই ভার্সিটিতে প্রবেশ করে।

অনেকদিন পর ভার্সিটিতে আসাতে প্রিয়তার কাছে কেমন কেমন লাগছিলো। গাছতলা পাড় হওয়ার সময় রকি এবং তার বন্ধুদের খেয়াল করে। রকিকে দেখে মাথা নিচু করে হাঁটছিল প্রিয়তা। রকি তাকে খেয়াল করে। ডাক না দিয়ে সোজা তার সামনে গিয়ে দাঁড়ায়।

‘কি খবর প্রিয়তা? ভালো আছো?’

খানিকটা বিরক্ত হলেও প্রিয়তা জবাব দেয়,’জি ভালো।’

‘শুনলাম পালিয়ে বিয়ে করছো তা-ও এলাকার বড় ভাইকে?আইমিন জান ভাইকে।’

এমন অযাচিত প্রশ্ন শুনে প্রিয়তা হাঁটা দেয়।
রকি পেছন থেকে বলে,’শালায় একবার তোমারে পছন্দ করি দেখে ডেকে হুমকি দিছিলো। তখন ক্ষমতা ছিলো ওর তাই কিছু বলি নাই কিন্তু সুযোগ পাইলে এবার ছাড়ুম না। আমি না হয় ভালো না কিন্তু যারে চুজ করছো সে কতটা ভালো? সে তো অস্ত্র নিয়া ঘুরে। আবার শুনলাম সে নাকি সব ছেড়ে দিছে?’

প্রিয়তা ঘুরে উত্তর দেয়,’যাকে আমি বেছে নিয়েছি সে খাঁটি কষ্টিপাথর। সিরিজ কাগজ দিয়ে যতই ঘষি বদলাবে না। আর হ্যাঁ অস্ত্র ছাড়া সে ততটাই ভয়ঙ্কর যতটা সে অস্ত্র সমেত। আপনার জন্য মঙ্গল হবে এসব আজেবাজে চিন্তা বাদ দিয়ে নিজেকে নিয়ে চিন্তা করুন।’

কথাগুলো বলে প্রিয়তা হাঁটা দেয়। রকির সাথে ছেলেগুলো এগিয়ে এসে তার পাশে দাঁড়ায়।
একজন বলে,’এই মেয়ের দেমাগ কমলো না।’

রকি বাঁকা হেসে বলে,’কমবে কমবে সবুর কর একটু।’

…….

মিসেস পারুল উদাস হয়ে নিজ কক্ষে বসে আছে। জারিফ কক্ষে প্রবেশ করতেই তার নজরে মায়ের উদাস চেহারা পড়ে।

জারিফ বলে,’ডেকেছো?’

মিসেস পারুল চোখ তুলে তাকায়।
‘এখানে এসে বস।’

জারিফ এগিয়ে এসে তার পাশে বসে।
‘তোর বাবার সাথে কথা হয়েছে?’

‘বাবা এ বিষয়ে কথা বলতে নারাজ। সে তার কঠরতা ভাঙছে না।’

‘জাইন নিশ্চয়ই মেয়েটাকে নিয়ে কষ্ট করছে। মা হয়ে এসব আমি মানতে পারছি না।’

‘তোমার ছেলে এমন কাজ না করলে আজকে এ দিন আসতো না।’
রমিজউদ্দিনের গলা পেয়ে মিসেস পারুল আর জারিফ চমকে তাকায়। রমিজউদ্দিন এতোক্ষণ দরজার বাহিরে দাঁড়িয়ে মা ছেলের কথা শুনছিলো।

জারিফ বলে,’আমার মনে হয় জাইনকে একটা সুযোগ দেওয়া উচিত। ও তো একা না সাথে মেয়েটাও কষ্টে আছে। আমি শুনেছি ওরা চিলেকোঠায় এক রুমে থাকে। এই গরমে চিলেকোঠায় থাকাটা খুবই কষ্টকর। মেয়েটার কথা চিন্তা করে জাইনকে মাফ করে দাও।’

রমিজউদ্দিন কঠোর গলায় বলে,’যেই মেয়ে নিজের পরিবারের কথা চিন্তা করে না তার কথা আমাদের চিন্তা করার প্রয়োজন নেই। আর তাছাড়া আমি তো ঘোষণা করেই দিয়েছি আমার দুই পুত্র আর এক কন্যা।’

মিসেস পারুল উঠে এসে রমিজউদ্দিনের সামনে দাঁড়ায়।
এরপর প্রশ্ন করে,’আমার ছেলে কষ্ট করছে আর আপনি বাবা হয়ে এই রকম করছেন? আপনার একটুও খারাপ লাগে না ছেলেটার জন্য?’

রমিজউদ্দিন উত্তর দেয়,’ছেলেটা এতো সাহস পেয়েছে তোমার লাই আর ভালোবাসা পেয়ে। ছোটবেলা থেকেই ওকে লাই দিয়ে মাথায় তুলেছো এগুলো তারই প্রতিদান।’

মিসেস পারুল বলে,’আপনি থাকেন আপনার জেদ নিয়ে। একদিন আমি এসব ছেড়ে আমার ছেলের কাছে চলে যাবো তখন দেখবো কি করেন।’

মিসেস পারুল কথাগুলো বলে বিছানায় গিয়ে বসে। রমিজউদ্দিন বলে,’বেশ যা ইচ্ছে করো।’

রমিজউদ্দিনের কথা শুনে মিসেস পারুল অবিশ্বাস্য চোখে তাকায়। রমিজউদ্দিন কক্ষ হতে বেরিয়ে যায়। জারিফ কি করবে বুঝে উঠতে পারে না। পারিবারিক ঝামেলা হতে সবসময় সে দূরেই থাকে। এবার মায়ের অনুরোধে এলো এই সমস্যার সমাধান করতে কিন্তু রমিজউদ্দিনের সাথে তার কথা বলে মনে হয়েছে সে কিছুতেই জাইনকে আর এ বাড়িতে থাকতে দিবে না। মাথা নিচু করে কক্ষ হতে সে ও বেরিয়ে যায়৷ মিসেস পারুল উদাস হয়ে বসে থাকে আগের ন্যায়।

…….

ক্লাস শেষ করে রিমি হৈমন্তীর সাথে ক্যান্টিনে বসে আছে প্রিয়তা। অনেকদিন পর প্রিয়তাকে পেয়ে রিমির গল্প যেনো শেষই হচ্ছে না। প্রিয়তাও মনোযোগ দিয়ে রিমির সকল কথা শুনছে।

রিমি হাসি থামিয়ে বলে,’জানিস তারপর কি হলো? মামা সেই মেয়েটার বাবার সামনে গেলো অনেক প্রস্তুতি নিয়ে। কাগজে তার মনের কথাগুলোও লিখে নিয়েছিলো,আমি আপনার মেয়েকে পছন্দ করি,বিয়ে করতে চাই। মেয়ের বাবার সামনে যেতেই সে আর কিছু বলতে পারলো না। তার হাঁটু কাঁপতে শুরু করলো।’

হৈমন্তী প্রশ্ন করে,’তারপর?’

রিমি উত্তর দেয়,’মেয়ের বাবা প্রশ্ন করলো,তোমার নাম কী? মামা উত্তর দেয় করিম উদ্দিন যা ছিলো তার বাবার নাম।’

রিমির কথা শুনে প্রিয়তা আর হৈমন্তী শব্দ করে হেসে ওঠে। সেই সাথে প্রিয়তার ফোন বাজে। ব্যাগ থেকে ফোন বের করে দেখে রুমার কল। দেরি না করে কল কেটে কল ব্যাক করে।

রুমা বলে,’হ্যালো আপু।’

‘কিরে তোর কি খবর?’

‘আমার খবর রাখো। এদিকে খবর জানো?’

রুমার প্রশ্ন শুনে প্রিয়তা ঢোক গিলে।
‘না তো। কি হয়েছে?’

‘আঙ্কেল তো অসুস্থ তিনদিন ধরে। দোকান খুলতে পারছে না ঘরেই আছে।’

‘কি হয়েছে বাবার?’

‘তা তো জানি না। মা তোমাদের বাসায় যেতে দেয় না৷ পাশের বাসার আন্টির সাথে মা বলাবলি করছিলো তখন শুনেছি।’

‘ঠিক আছে কল রাখছি।’

প্রিয়তা কল কেটে উঠে দাঁড়ায়।
রিমি বলে,’কই যাস? একটু পরই পরের ক্লাস শুরু হবে।’

প্রিয়তা জবাব দেয়,’বাবা অসুস্থ।’

হৈমন্তী বলে,’তুই এখন সেখানে যাবি? আমার মনে হয় তোর একা যাওয়া উচিত হবে না।’

‘জাইন ইন্টারভিউ দিতে গেছে। আমি বাবাকে দেখে বাসায় ফিরে যাবো। জাইনকে তোরা কিছু বলিস না।’

রিমি রাগ করে বলে,’যারা তোরে এতো অপমান অপদস্ত করলো তুই এখনো তাদের কথা ভাবিস?’

প্রিয়তা ব্যাগ কাঁধে নিয়ে বলে,’কারণ আমি তাদের ভালোবাসি। তাদের বিপদে আমার পাশে থাকা উচিত।’

কথাগুলো বলে প্রিয়তা বেরিয়ে যায়। রিমি আর হৈমন্তী একে অপরের দিকে তাকিয়ে নিরবে বসে থাকে।

……

জাইন বসে আছে ইন্টারভিউ বোর্ডে। তার সামনে পাঁচজন কর্মকর্তা বসা। প্রত্যেকে তার চেয়ে বয়সে বড় হবে। তবে একজনকে দেখে মনে হলো তার চেয়ে ছোট বা তার বয়সী হবে। জাইনের সিভি দেখে কর্মকর্তাদের মধ্যে কানাঘুষা চলছে। জাইন বুঝতে পারছে তারা কি নিয়ে নিজেদের মধ্যে কথা বলছে। সে এ ও জানে তাকে প্রথম প্রশ্ন কোনটা করা হতে পারে। মস্তিষ্কের ভেতর কথাগুলো সাজিয়েও নিয়েছে।

আলাপ আলোচনা শেষে সকল কর্মকর্তা চুপচাপ বসে নিজ আসনে। এরপর একজন প্রশ্ন করে।
‘আপনার সম্পর্কে কিছু বলেন।’

‘আমার সম্পর্কে সিভিতে দেওয়াই আছে তবুও এর বাহিরে যদি কিছু জানতে চান তাহলে বলবো বলার মতো কিছু নেই।’

‘ওকে ফাইন। তো জাইন রহমান আপনার নাম রাইট?’

‘জি।’

‘আপনার বাবার নামের জায়গায় লেখা রমিজউদ্দিন। আমার প্রশ্ন হলো ইনি কি রহমান টেডার্সের কর্ণধার রমিজউদ্দিন?’

জাইন স্বাভাবিক গলায় বলে,’জি।’

কর্মকর্তারা বিস্ময় নিয়ে জাইনের দিকে তাকায়।

‘আপনার বাবার এতো বড় ব্যবসা থাকতে আপনি চাকরি কেনো করতে চাইছেন?’

‘সত্যি বলবো নাকি মিথ্যে?’

‘ওয়েল সত্যিটাই বলুন।’

‘আমি ভালোবেসে বিয়ে করেছি। বাবা মেনে নেয়নি। আমার স্ত্রী চায় আমি নিজের পায়ে দাঁড়াই,একটা ভালো চাকরি করি। তাই এখনে আজকে আপনাদের সামনে বসে আছি।’

‘তারমানে আজকে এখানে আসার পিছনে আপনার স্ত্রী অনুপ্রেরণা দিয়েছে?’

‘অনুপ্রেরণা বলেন আর পুশ বলেন সবই ও করেছে। আমার থেকে ইন্টারভিউ নিয়ে বেশি চিন্তিত সে।’

‘দ্যাটস ইম্পেসিভ কিন্তু আপনি এই পদের জন্য উপযুক্ত কিনা সেটা আমাদের দেখতে হবে।’

‘শিওর।’

‘আপনি কেনো মনে করেন আপনি আমাদের কোম্পানিতে এই পদের জন্য উপযুক্ত?’

‘আমি মনে করি আপনারা যাকে খুঁজছেন সে-ই আমি।’

জাইনের উত্তর শুনে কর্মকর্তারা একে অপরের দিকে তাকায়।

প্রশ্ন কর্তা গলা পরিষ্কার করতে কাশি দেয়।
‘ঠিক আছে আপনি আসতে পারেন। আধাঘন্টা পর আপনাকে জানানো হবে আমাদের সিদ্ধান্ত। ততক্ষণ বাহিরে অপেক্ষা করুন।’

কাগজপত্র নিয়ে জাইন বেরিয়ে যায়। শুরু হয় ইন্টারভিউ বোর্ডের কর্মকর্তাদের মধ্যে আলোচনা। একেকজনের একেক মতামত৷ শেষ পর্যন্ত কি হয় তা ই দেখার পালা। জাইন বাহিরে গিয়ে বাকিদের সাথে বসে। তার মতো আরো একাত্তর জন এই পদের জন্য ইন্টারভিউ দিতে এসেছে। ফোন বের করে প্রিয়তাকে কল দেওয়ার জন্য। পরক্ষণেই মনে হয় সিদ্ধান্ত জানার পর কল দিবে। ফোনটা আবার পকেটে রেখে দেয়।

……

রিকশা থেকে নেমেই প্রিয়তা বিল্ডিং এর দিকে তাকায়। ছাদে নজর গেলেই জাইন আর তার পুরনো স্মৃতি মনে পড়ে। দু’জন প্রেম করেনি অথচ বিয়ের আগে তাদের কতশত স্মৃতি জমেছে। ফোন বের করে সময়টা দেখে নেয়। ভর দুপুর বেলা এখন। জাইন নিশ্চয়ই ইন্টারভিউ দিয়েছে বা দিবে৷ ফোনটা শক্ত করে হাতের মুঠোয় নিয়ে বিল্ডিং এর দিকে হাঁটা দেয়। সিঁড়ি বেয়ে উঠতে গিয়ে বিল্ডিং এর ভাড়াটিয়াদের সাথে দেখা হয়। প্রিয়তাকে তারা চোখ ঘুরিয়ে
খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখছে। প্রিয়তা সেদিকে পাত্তা না দিয়ে সিঁড়ি বাইতে থাকে। চারতলায় এসে থেমে ফ্ল্যাটের বন্ধ দরজার দিকে তাকায়। বুকের ভেতর ধুকপুক করছে। দরজার সামবে দাঁড়িয়ে ভাবছে কি করবে। দরজার উপর হাত রেখে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। এরপর কলিংবেলের সুইচ চাপ দেয়। প্রথমবার কলিংবেল চাপার পর ভেতর থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসে না তাই প্রিয়তা আবারো কলিংবেলের সুইচ চাপে।

ভেতর থেকে জিজ্ঞেস করে,’কে?’
মিসেস মাসুমার গলা পেয়ে প্রিয়তা জবাব দিতে গিয়েও থেমে যায়। দরজা খুলেই মিসেস মাসুমা প্রিয়তার দিকে স্তব্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকে। প্রিয়তার গায়ে সুতির কামিজ। মাথার চুল ওড়না দিয়ে ঢাকা। কাঁধে ব্যাগ। চোখমুখ দেখে মনে হচ্ছে বেশ চিন্তিত সে। বিয়ের আগে ভার্সিটিতে সে যেভাবে যেতো এখন তাকে ঠিক তেমনই লাগছে।

মিসেস মাসুমা গম্ভীর গলায় প্রশ্ন করে,’এখন এখানে কি চাস? নাকি দেখতে এসেছিস আমরা বেঁচে না মরে গেছি?’

‘না মা আমি তো শুধু বাবাকে দেখতে এসেছি।’

‘লোকটাকে জীবিত অবস্থায় মেরে আবার তাকে দেখতে এসেছিস? লজ্জা করে না তোর? সে দেখার আগে ভালোয় ভালোয় দূর হ এখান থেকে। তোর মতো মেয়ে দরকার নেই আমাদের।’

‘এভাবে বলো না। একবার বাবাকে দেখে চলে যাবো।’

বেল্লাল হোসেন গলা উঁচিয়ে মিসেস মাসুমাকে ডাকে।
‘মাসুমা কে এসেছে?’

মিসেস মাসুমা জবাব দেয়,’কেউ না।’

বেল্লাল হোসেন আবারো বলে,’যে এসেছে চলে যেতে বলো।’

মিসেস মাসুমা প্রিয়তার দিকে তাকিয়ে বলে,’শুনলি তো? এবার যা এখান থেকে।’

প্রিয়তা অনুরোধের স্বরে বলে,’মা একটাবার শুধু দূর থেকে বাবাকে দেখবো তারপর কথা দিচ্ছি আর কখনোই আসবো না।’

‘মাসুমা তোমাকে কি বললাম? বাসার দরজা লাগাও।’
বেল্লাল হোসেনের গলা পেয়ে প্রিয়তা বাসার ভেতরে তাকায়। দূর্বল শরীর নিয়ে বেল্লাল হোসেন দাঁড়িয়ে আছে। অনেকটা শুঁকিয়ে গেছে সে। একটু পর পর কাশি দিচ্ছে সে। প্রিয়তা বেল্লাল হোসেনকে দেখে নিচ্ছে অথচ সে একবারো প্রিয়তার দিকে তাকাচ্ছে না।

প্রিয়তা আবেগে ডাক দেয়,’বাবা..’

বেল্লাল হোসেন গম্ভীর গলায় বলে,’আমার মেয়ে সেদিনই মরে গেছে যেদিন সে এক ছেলের জন্য আমাদের ছেড়ে চলে গেছে। এখন শুধু আমার ছেলে জীবিত আছে। মাসুমা একে দ্রুত যেতে বলো না হলে ঘাড় ধাক্কা দিয়ে বের করে দিবো।’

বেল্লাল হোসেনের কথা শুনে প্রিয়তা অশ্রুসিক্ত নয়নে তাকায়। এতো কঠোর কথা বেল্লাল হোসেন কখনোই বলেনি তাকে।

‘মাসুমা কি বললাম?’
কথাটা শেষ করতেই বেল্লাল হোসেন জোরে জোরে কাশি দেয়। মিসেস মাসুমা এগিয়ে যায় তাকে ধরতে। প্রিয়তাও দ্রুত এগোয় কিন্তু বেল্লাল হোসেন হাত উঁচিয়ে নিষেধ করে। এরপর হুংকার দেয়।

‘কতবার বলবো আমার মেয়ে মরে গেছে। মাসুমা এরে আমার সামনে থেকে দূর হতে বলো। আমি মরলেও যেনো আমার লাশ ও দেখতে না পায়।’

বেল্লাল হোসেনের কথা শুনে প্রিয়তা বলে,’এমন ভাবে বলো না বাবা। সৃষ্টিকর্তা এমন দিন না আনুক। আমি আমার এই চেহারা আর কখনোই তোমাদের দেখাবো না। আমাকে মাফ করে দিও।’

কথাগুলো বলে ওড়না দিয়ে মুখ চেপে দ্রুত ফ্ল্যাট হতে বেরিয়ে যায় প্রিয়তা। রুমার মা সহ অন্যান্য ফ্ল্যাটের মহিলারা উঁকি মেরে এতোক্ষণ তামাশা দেখছিলো। মিসেস মাসুমা ফ্ল্যাটের দরজা বন্ধ করে দেয়। বেল্লাল হোসেন ধপ করে চেয়ারে বসে পড়ে।

বিল্ডিং হতে নেমে প্রিয়তা ছুটছে। কোথায় যাচ্ছে তা তার অজানা। দু নয়ন হতে অশ্রুপাত হচ্ছে বর্ষণের মতো। নিজেকে ধরে রাখা এই মূহুর্তে অনেক কঠিন হয়ে গেলো তার জন্য। হাতের ফোনটাও বেজে ওঠে। সেদিকে প্রিয়তার মনোযোগ নেই। ধাক্কা লেগে হাতে ফোনটা রাস্তায় পড়ে খন্ড হয়ে যায়।

ফোন কানে দিয়ে বসে আছে জাইন। তার চোখমুখে চিন্তার আভাস৷ এতোক্ষণ কল ঢুকলেও এখন ফোন বন্ধ বলছে।

‘মিস্টার জাইন রহমান আপনাকে ভেতরে ডাকছে। দ্রুত আসুন।’

অনিচ্ছা সত্ত্বেও ফোনটা পকেটে ঢুকিয়ে উঠে যায় জাইন। তার মন বলছে কোনো কিছু ঠিক নেই। দ্রুত তাকে ফিরতে হবে।

………..
(চলবে..)