প্রণয়ী পর্ব-৪০ এবং শেষ পর্ব

0
21

#প্রণয়ী
লেখনীতেঃ #ঈশিতা_ইশা
|৪০.|(অন্তিম পর্ব)

(কপি পোস্ট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ)
………

‘মা এসেছিলো।’
সবেই অফিস থেকে ফিরেছে জাইন। চেয়ারে বসে জুতা খুলছিলো এমন সময় প্রিয়তা কথাটা বলে। চোখ তুলে প্রিয়তার পানে দৃষ্টি রাখে। পানির গ্লাস হাতে দরজার এক পাশে সে দাঁড়িয়ে রয়েছে।

প্রিয়তা আবারো শুধায়,’আপনার মা এসেছিলো।’

জাইন ছোট্ট করে বলে,’ওহ।’

‘সাথে নুহাশ আর নিহারিকাও এসেছিলো।’

‘ভালো।’
কোনোরকম প্রশ্ন করে এ বিষয়ে কথা বাড়ালো না জাইন। প্রিয়তা বুঝলো জাইন অন্য কিছু ভাবছে। জুতা খুলে প্রিয়তার হাত থেকে পানির গ্লাসটা নিয়ে পান করে বিছানায় বালিশে হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে বসে। কিছু ভাবছে সে। বিষয়টা প্রিয়তার নজর এড়ায়নি। এগিয়ে গিয়ে জাইনের পাশে বসে।

‘আপনার কি শরীর খারাপ লাগছে?’

চক্ষু না মেলেই জাইন উত্তর দেয়,’না।’

‘তাহলে কিছু নিয়ে দুশ্চিন্তায় আছেন?’

‘তেমন কিছু না।’

জাইনের বাম হাতের উপর ডান হাত রাখে প্রিয়তা। শীতল স্পর্শ পেয়ে চক্ষু মেলে তাকায় সে। এক হাতে প্রিয়তাকে জড়িয়ে বুকে টেনে নেয়। আর কোনো প্রশ্ন না করে প্রিয়তাও চুপচাপ রয়। বাড়তি প্রশ্ন করে জাইনকে বিব্রত করতে চাইছে না সে। এমনিতেই লোকটা সারাদিন খেটে বাসায় এসেছে এখন সে প্রশ্নে জর্জরিত করলে নিশ্চয়ই তার ভালো লাগবে না! চুপ থাকাই প্রিয়তার কাছে শ্রেয় মনে হলো।

জাইন ভাবছে অন্য বিষয়ে। বিগত কয়েকদিন ধরে এলাকার পরিবেশ একদম নিরব। কোথাও কোনো ঝামেলা নেই। এতো বছর ধরে এলাকায় থাকছে সেই সাথে রাজনীতির সাথে সে যুক্ত থাকাকালীন কখনোই সব কিছু এতো চুপচাপ দেখেনি। কোনো না কোনো ঝামেলা লেগেই থাকতো। মারুফ আর শাকিলের সাথে বিষয়টা নিয়ে কথা বললে তারা জানায় এটা নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু জাইনের কাছে বিষয়টা মোটেও স্বাভাবিক লাগছে না। তার কাছে বারবার মনে হচ্ছে জনতা দল চুপ থাকার মতো না। তারা জাইনকে এতো সুন্দর করে বাঁচতে দিবে এ তো অসম্ভব। জাইন বাঙলা দলে যুক্ত হওয়ার পর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে জনতা দলের। এলাকায় চাঁদাবাজি থেকে শুরু করে ছোটখাটো অপরাধ বন্ধ হয়ে গেছে। জাইন বর্তমানে বাঙলা দলে যুক্ত নেই ঠিকই কিন্তু তাকে প্রয়োজন হলে পরামর্শ দেয়। শত হলেও মানুষের কথা ভাবা সে একেবারে বন্ধ করতে পারছে না।
বিষয়টা নিয়ে চিন্তা করবে নাকি ঝেরে ফেলে দিবে সেটাও বুঝতে পারছে না সে।

..

মাঝরাতে জাইনকে আষ্টেপৃষ্টে জড়িয়ে গভীরতা তন্দ্রায় আচ্ছন্ন প্রিয়তা। জাইনের নেত্রে এক ফোঁটাও তন্দ্রার রেশ নেই। ছোট্ট জানালা দিয়ে মৃদু আলো আসছে যার দরুন সিলিংটা দেখা যাচ্ছে,জাইনের দৃষ্টি সেদিকেই। প্রিয়তা নড়েচড়ে জাইনকে আরো শক্ত করে জড়িয়ে তার গলায় মুখ গুঁজে দেয়। প্রিয়তার শ্বাস-প্রশ্বাসে গরম হাওয়া গলায় লাগলে জাইনের ভাবনা ভঙ্গ হয়। ডান হাত তুলে প্রিয়তার পিঠে আলতো ভাবে রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে। স্পর্শ পেয়ে তন্দ্রার মাঝে প্রিয়তা জাইনে মিশে যেতে চায়।

জাইন মৃদু গলায় বলে,’আমার ঘুম আসছে না প্রিয়। কিছু করো।’

প্রিয়তা শুনতে পায় না। একি কথা আবারো শুধায় সে। গভীর তন্দ্রায় থাকাতে এবারো ফলাফল একই। এবার হার না মেনে জাইন এক কাজ করে। প্রিয়তাকে নিজের থেকে সরিয়ে বালিশে শুইয়ে দেয়। আধোআধো চক্ষু মেলে প্রিয়তা তাকায়।

ঘুমন্ত গলায় প্রশ্ন করে,’কি হয়েছে?’

‘আমার ঘুম আসছে না। ঘুম পাড়িয়ে দাও।’

দু হাত তুলে জাইনকে কাছে ডাকে সে। সময় নষ্ট না করে প্রিয়তার বক্ষে মাথা রেখে তাকে জড়িয়ে ধরে সে। দু হাততে জাইনের গলা জড়িয়ে তার কেশে আঙুল চালাতে শুরু করে প্রিয়তা।

‘প্রিয়।’

‘হুম।’

‘আমার কেমন অস্থির লাগছে।’

‘সারাদিন অফিস করে এমন লাগছে। ঘুমালে ঠিক হয়ে যাবে।’

জাইন আর কোনো কথা বলে না। ধীরে ধীরে প্রিয়তার স্পর্শে চিন্তা গুলো কমতে শুরু করে।
ব্যস এরপর জাইন হারিয়ে যায় ঘুমের রাজ্যে। একরাশ তন্দ্রা এসে হানা দেয় তার দু নয়নে।

………..

সকাল বেলা জাইনের উঠতে দেরি হয়ে যায়। ফলে নাশতা না সেরেই তড়িঘড়ি করে বেড়িয়ে যায় অফিসের উদ্দেশ্যে। প্রিয়তা তাকে বারবার বলেছে আজ জলদি ফিরতে। জাইন মাথা নাড়িয়ে তাকে আশ্বস্ত করে গেছে। যাওয়ার পূর্বে রোজ দিনের মতো প্রিয়তার ললাটে চুমু দিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়েছে।

জাইন যেতেই প্রিয়তা নিজের হাতের কাজগুলো সারে। কাপড় মেলে ঘরে যেতে নিলে ফুলের টবটা নজরে আসে। পানি এনে আগে টবে পানি দেয়। জাইন তাকে খুশি করতে বিয়ের আগে নিরানব্বইটা ফুলের টব দিয়েছিলো গোলাপ গাছ সহ। কিছুদিন পূর্বে জাইন এই গাছ সহ টবটা এনে জানায় সে একশত গাছই কিনেছিলো। নিরানব্বইটা গাছ তাকে দিয়ে একটা নিজের কাছে রেখেছিলো। এর কারণটা অবশ্য অদ্ভুত। জাইন জানায় তার ইচ্ছে ছিলো সামনাসামনি প্রিয়তাকে এই গাছটা টব সহ দিয়ে ভালোবাসার কথা জানাবে। এর পূর্বেই তো তাদের বিয়েটা হয়ে গেলো। এতোদিন গাছটার কথা বেমালুম ভুলে বসেছিলো সে। হঠাৎ মনে হওয়াতে নিহারিকাকে দিয়ে আনিয়েছে। প্রিয়তা অবশ্য গাছটা পেয়ে বেশ খুশি। তিনটা টকটকে লাল রঙের গোলাপ ফুটেছে। একটা তো বেশ বড়। প্রিয়তা অনেক খুশি এতে। গুনগুন করে ঘরে চলে গেলো সে।

..

রাতের জন্য রান্নাবান্না করতে ব্যস্ত প্রিয়তা। আজ দ্রুত কাজ সারছে সে। জাইন ফিরলে তাকে চমকে দিবে। ইতিমধ্যে ঘর সাজিয়ে ফেলেছে। সে আর জাইন বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়েছে যার এক মাস পেরিয়েছে। দেখতে দেখতে চোখের পলকে একটা মাস চলে গেলো। এই রকম হাজারো দিন জাইনের সাথে কাটাতে চায় সে। এক মাস উপলক্ষে ছোট্ট করে আয়োজন করেছে। জাইনকে খুশি করতে তার সামান্য চেষ্টা। আসরের আজান দিতেই প্রিয়তা আরো দ্রুত হাত চালায়। রান্না শেষে শাড়ি পড়ে তৈরি হবে।

গোসল সেরে ভেজা কেশ গুলো মেলে ফ্যানের নিচে বসে আছে। ইতিমধ্যে আসরের আজান শেষ হয়েছে বহুক্ষণ পূর্বে। শাড়ি পড়ে পরিপাটি হয়ে জাইনের অপেক্ষায় সে। হুট করে জাইন তাকে এভাবে দেখলে নিশ্চয়ই চমকে যাবে। চমকে গিয়ে হয়তো নিজেকে আর সামলাতে পারবে না। কথাগুলো ভেবেই লজ্জায় দু হাত দিয়ে মুখ ঢেকে ফেলে প্রিয়তা। ছোট্ট একটা কালো টিপ ললাটের মাঝে বসিয়ে দেয়। গাঢ় করে কাজল টানে। নিজেকে বারবার আয়নাতে দেখছে আর ভাবছে লিপস্টিক কোন রঙের পড়বে।

মাগরিবের আজান দিতেই প্রিয়তার অপেক্ষার অবসান কমতে শুরু করে। কিছুক্ষণের মধ্যেই জাইন ফিরবে। বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে প্রহর গুনতে শুরু করে। রাতের বেলা রিমি,হৈমন্তী, অনু,মারুফ,শাকিল,মকবুল সকলে আসবে। প্রিয়তা কল দিয়ে তাদেরকে ডেকেছে। অবশ্য তারাও জানে না প্রিয়তা কেনো ডেকেছে। বহু দিন পর সকলকে একত্রে দেখার তর আর সইছে না। সময়টা দীর্ঘ মনে হচ্ছে।
হঠাৎ ছাদের দরজায় পরপর আঘাত করার শব্দ হয়। ঘড়ির দিকে এক পলক তাকিয়ে প্রিয়তা ছুটে ছাদের দরজা খুলতে। নিশ্চয়ই জাইন ফিরেছে। বুক ভরা শ্বাস নিয়ে শাড়ির আঁচল ঠিক করে মাথায় ঘোমটা টেনে হাসিমুখে দরজা খুলে। দরজা খুলে হাসিমুখে প্রশ্ন করে,’কাকে চান?’

…..

অফিস থেকে বেরিয়ে ফুলের দোকান থেকে বেলিফুলের মালা আর গোলাপ কিনেছে জাইন। বিয়ের এক মাস পূর্ণ হয়েছে সেইজন্য আজ এগুলো প্রিয়তার জন্য কিনে নিয়ে যাচ্ছে। প্রিয়তাকে এগুলো দিয়ে চমকে দিতে চায় সে।
হুট করেই গর্জন করে ওঠে গগণ। সিএনজি ডেকে তাতে চড়ে বসে। ফোন বের করে প্রিয়তাকে কল দেয়। ফোনে কল ঢুকে কিন্তু প্রিয়তা রিসিভ করে না। জাইনের আর তর সয় না৷ কখন বাসায় যাবে আর কখন প্রিয়তাকে চমকে দিবে সেটা ভাবছে। ফুলগুলো দেখে যখন প্রিয়তা হাসিমুখে তাকাবে তখন জাইনের কষ্ট স্বার্থক হবে। মাস খানেক পূর্বে সে ভাবতেও পারেনি প্রিয়তাকে সে নিজের করে পাবে। তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ একটা অংশ হয়ে উঠবে প্রিয়তা। মেয়েটাকে ছাড়া তার জীবন অসম্পূর্ণ রয়ে যেতো। মেয়েটা কীভাবে এসে তাকে রাঙিয়ে দিলো। আজ সবকিছু একদিকে আর প্রিয়তা এক দিকে। দিন শেষে প্রিয়তাকে ছাড়া সে ঘুমাতে পারে না।
সিএনজি থামতেই জাইনের দৃষ্টি যায় মানুষের জটলার দিকে। নর-নারীর জটলা পাকিয়ে কিছু কানাঘুষা করছে।
ভাড়া মিটিয়ে বিল্ডিং এর দিকে যেতে নিলে বুুঝতে পারে অনেক মানুষ এখানে ভীড় করেছে। বিল্ডিং এর নিচে এতো মানুষজন দেখে ভ্রু কুঁচকে সেদিকে তাকায় সে। ধীরে ধীরে জাইন সামনে এগুতে থাকে।
সকলে রাস্তার দিকে তাকিয়ে আছে। কিছু একটা কানাঘুষা করছিলো যা এড়ায়নি জাইনের কর্ণ। বুকের ভেতর হুট করে ধক করে উঠলো। ভীড় ঠেলে সামনে এগুতে চেষ্টা করে সে। বিল্ডিং এর কয়েকজন ভাড়াটিয়া তাকে দেখে চিনে ফেললো। সকলকে বললো জায়গা করে দিতে। বাড়িওয়ালা কানে ফোন ধরে দাঁড়িয়ে আছে। সে জাইনকেই কল দিচ্ছিলো। ফোন বেজে উঠলো কিন্তু জাইনের হুঁশ নেই সেদিকে। মানুষের জটলা সরতেই হাত পা অবশ হয়ে এলো। যত্ন করে আনা হাত থেকে পুষ্পগুলো পড়ে গেলো পাকা রাস্তায়। নিমিষেই বিষিয়ে উঠলো সময়টা।

সর্বশক্তি দিয়ে চিৎকার করে উঠলো জাইন নামক পুরুষটি।
‘প্রিয়ওওও..’

নীল বর্ণের শাড়িটা গায়ে জড়িয়ে রাস্তার মাঝে উপুড় হয়ে পড়ে আছে প্রিয়তার দেহ। কাজল রাঙা নেত্রগুলো খোলা তবে পলক পড়ছে না। এক ধ্যানে তাকিয়ে আছে সামনের দিকে। ওষ্ঠদ্বয়ের মাঝে ফাঁকা হয়ে সামনের দু’টো ধবধবে সাদা দন্ত চিকচিক করছে। কাঁচের চুড়িগুলো ভেঙে হাতে গেঁথে আছে। মাথা ফেটে লাল বর্ণের রক্তে রাস্তা ভিজে গেছে। নিহর দেহ অথচ কি সিন্ধ!
ছুটে গিয়ে প্রিয়তার নিথর দেহটাকে টেনে বুকে জড়িয়ে নেয় জাইন। কয়েকবার ঝাঁকি দিয়ে তার গালে আলতো থাপ্পড় দেয়।

‘প্রিয়..এই প্রিয়। তাকাও আমার দিকে। প্রিয় তাকাও না।’

প্রিয়তা নড়লো না। নিষ্প্রাণ দেহটা বস্তুর মতো পড়ে রইলো।

‘এই প্রিয় তাকা আমার দিকে। তাকাস না কেন? কথা বল। প্রিয় তাকা না।’

বিলাপ করতে করতে কান্নায় ভেঙে পড়ে জাইন। প্রিয়তার দেহকে জড়িয়ে লেপ্টে বসে থাকে। জাইনের বিলাপের সাথে গর্জন করে ঝিরিঝিরি বর্ষণ নামে ধরণীর বুকে। ধীরে ধীরে বর্ষণের গতি বাড়তে শুরু করে। বর্ষণ হতে বাঁচতে অধিকাংশ মানুষ ছুটে। রয়ে যায় গুটি কয়েকজন। তাদের মধ্যে রিমি হৈমন্তী অন্যতম। হৈমন্তীকে জড়িয়ে রিমি চোখের জল ফেলছে। শেষবার নিজের প্রাণ প্রিয় বান্ধবীকে এভাবে দেখবে কখনো কল্পনাও করেনি। হৈমন্তী ওড়না মুখে গুঁজে নিজেকে সামলানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে।
প্রিয়তার মাথাকে বুকের মাঝে শক্ত করে ধরে গগণের দিকে তাকায় জাইন।

‘এইটা কেন করলা তুমি? কেন আমার প্রিয়কে নিয়া গেলা? আমার প্রিয়কে ফিরাইয়া দাও। আমি কেমনে থাকুম আমার প্রিয়রে ছাড়া? হে আল্লাহ আমার প্রিয়রে ফিরাইয়া দাও নইলে আমার মরন দাও।’
বর্ষণের সাথে ধীরে ধীরে জাইনের কান্নার বেগ বাড়তে থাকে। উপস্থিত সকলে চোখ মুছছে আর সবটা দেখছে। এক পাশে মকবুলকে জড়িয়ে চোখের জল বিসর্জন দিচ্ছে অনু। মকবুল চুপচাপ অনুকে শান্তনা দিচ্ছে। সময়টা দীর্ঘ।

পুলিশের গাড়ি আর এম্বুলেন্স এসে থামতেই জাইন শক্ত চোখে সেদিকে তাকায়। ছাতা মাথায় থানার ওসি গাড়ি থেকে নেমে কনস্টেবলদেরকে ইশারা করে। কনস্টেবলরা এগিয়ে এলে জাইন তাদেরকে মাথা নাড়িয়ে এগুতে নিষেধ করে। তবুও কনস্টেবলরা এগিয়ে এসে তার কাছ থেকে প্রিয়তার দেহ সরানোর চেষ্টা করে। লেডি কনস্টেবলরা প্রিয়তার দেহ সরিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করে অপর দিকে পুরুষ কনস্টেবলরা জাইনকে ধরে সরাচ্ছে। জাইন কিছুতেই সরতে চাইছে না। সর্ব শক্তি দিয়ে কনস্টেবলদের থেকে ছোটার চেষ্টা করছে। ছয়জন মিলে তাকে সরায়। প্রিয়তার নিথর দেহ পড়ে রয় রাস্তার মধ্যে। মৃত দেহকে তুলে স্টেচারে রাখা হয়। যখন স্টেচারটা তুলে নিয়ে যাচ্ছিলো জাইন অসহায়ের মতো প্রিয়তার মৃত দেহের দিকে তাকিয়ে রয়। বর্ষণের জল এসে প্রিয়তার গাল,চোখ,মুখ বেয়ে পড়ছে। এক সেকেন্ডের জন্য জাইনের মন হয় প্রিয়তার খোলা নয়ন জোড়া তার দিকে তাকিয়ে আছে। সে হাত পা ছুঁড়তে শুরু করে। ফলে ছাড়া পেয়ে যায় কনস্টেবলদের কাছ থেকে। ছাড়া পেয়েই ছুটে এম্বুলেন্সের দিকে। ততক্ষণে এম্বুলেন্সে মৃত দেহ রেখে দরজা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। এম্বুলেন্সের দরজায় জোরে জোরে আঘাত করে সে। দরজা খুলে না বরং এম্বুলেন্স চলতে শুরু করে। জাইন কিছুতেই এম্বুলেন্সকে আটকাতে পারে না। এম্বুলেন্সের পিছু পিছু কিছু দূর ছুটে। গতি বাড়িয়ে এম্বুলেন্স স্থান ত্যাগ করে। দুই হাঁটু গেঁড়ে রাস্তার মধ্যে বসে পড়ে জাইন। নিঃশব্দে অশ্রুপাত ঘটে। শাকিল আর মারুফ এসে পৌঁছায় অনেক দেরিতে। তারা এসেই জাইনকে দু পাশ থেকে জড়িয়ে ধরে। এই মূহুর্তে জাইনের হুঁশ নেই। তার মাথায় শুধু ঘুরছে প্রিয়তাকে পুলিশ নিয়ে গেছে ফিরিয়ে আনতে হবে। প্রিয়তাকে ছাড়া সে কি করে বাঁচবে?

__________

প্রিয়তা নেই আজ দু’দিন। পুলিশ প্রিয়তার মৃতদেহ পোস্টমর্টেম করার জন্য নিয়ে গিয়েছিলো। খবর পেয়ে রমিজউদ্দিন থানায় যায়। শেষ পর্যন্ত প্রিয়তার মরদেহ অক্ষত অবস্থায় ফেরত আনা হয়। পুরোটা সময় জাইন ছিলো চুপচাপ৷ কারো সাথে কোনোরকম বাক্য বিনিময় করেনি। লাশ দাফনের পর মাত্র ফিরেছে চিলেকোঠায়।

চিলেকোঠার চাবিটাও পুলিশের কাছ থেকে আজই পেয়েছে। দরজা খুলে কক্ষে প্রবেশ করে সে। পুরো কক্ষে ঘুটঘুটে অন্ধকার। রাতও হয়েছে বেশ। সুইচ চাপ দিতেই পুরো কক্ষ আলোকিত হয়। জাইনের কাছে মনে হয় এক্ষুণি হাসিমুখে রান্নাঘর থেকে ওড়নায় হাত মুছতে মুছতে প্রিয়তা এসে তার সামনে হাজির হবে। আর শাসিয়ে তার কাছ থেকে এখন দূরে থাকতে বলবে। মিনিট খানেক সময় অতিবাহিত হলো কিন্তু এমন কিছুই ঘটলো না। জাইন জানে প্রিয়তা নেই কিন্তু এই সত্যিটা তার মস্তিষ্ক মেনে নিতে চাইছে না। বিছানার উপর ধপ করে বসে দু হাতে মাথা চেপে চুপ করে রইলো। কারো আলতো স্পর্শে চোখ তুলে তাকায়। মিসেস পারুলকে পাশে দেখে তাকিয়ে রইলো। জাইনের টকটকে লাল বর্ণের চক্ষু জোড়া দেখে মিসেস পারুল নিজেকে আঁটকে রাখতে পারলেন না। ছেলেকে জড়িয়ে ধরলেন। ছেলেটা গত দু দিনে আর কাঁদেনি এমনকি ঘুমায়ওনি। জোর করে তাকে বাড়িতে নিয়ে গিয়েছিলো সকলে মিলে। মিসেস পারুল সারা রাত-দিন ছেলের পাশেই থেকেছেন। আজ চিলেকোঠার চাবি পাওয়াতে তাকে আর আঁটকে রাখতে পারেনি বাড়িতে।
ফোন বেজে উঠলে জাইন কল রিসিভ করে না। কয়েকবার কল বেজে কেটে যায়। শেষে মিসেস পারুল কল রিসিভ করে কথা বলেন। জাইনের সেদিকে কোনো আগ্রহ নেই। মিসেস পারুল তার কানে ফোন ধরে। তার কানে ফোন ধরতেই অপরপাশ থেকে প্রিয়তার বাবা বেল্লাল হোসেনের গলা ভেসে আসে।

‘তোমাকে শান্তনা দিতে চাইনা শুধু দোয়া করি এই শোক সামলে উঠো। আমার মেয়েটা ভাগ্যবতী সে তোমার মতো বর পেয়েছে। যা হয়েছে তার জন্য আমি তোমাকে দোষী করবো না বরং আমি দোষী এতে। আমি যদি মেয়েটাকে বদদোয়া না দিতাম তাহলে আজ এ দিন দেখতে হতো না। আমাকে মাফ করে দিও বাবা।’

‘প্রিয়কে যেই আদর ভালোবাসা দিয়েছেন তার জন্য চিরকাল কৃতজ্ঞ থাকবো। প্রিয় ভালো আছে নিশ্চয়ই। আমার মনে হয় ও খুশি নিজের বাবা-মায়ের কাছে যেতে পেরে।’

জাইনের কথা শুনে বেল্লাল হোসেন কান থেকে ফোনটা নামিয়ে রাখে দ্রুত। কল কাটতেই মিসেস পারুলের কোলে মাথা রেখে হাঁটু ভাজ করে শোয় জাইন। বেল্লাল হোসেন ফোনটার দিকে তাকিয়ে রয়। যেদিন এসবের খবর সে পায় সেদিন মেয়ের শোকে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ছিলেন। তবুও অসুস্থ অবস্থায় যান প্রিয়তাকে শেষবার দেখতে। মিসেস মাসুমা তো এখনো স্বাভাবিক হননি৷ সারাদিন প্রিয়তার কক্ষে বসে কাঁদেন। অসুস্থ শরীর নিয়ে বিছানায় পড়ে আছেন বেল্লাল হোসেন। তুহিন এখন অনেকটা চুপচাপ৷ সে কখন বাসায় আসে আর কখন যায় কেউ জানে না। এতোদিন মেয়েটা দূরে থাকলেও কখনো এতো খারাপ লাগেনি। তিনি রেগে ছিলেন ঠিকই তবে ভেতরে ভেতরে সবটা মেনে নিয়েছিলেন। জাইনের কথা শুনে খারাপলাগাটা দ্বিগুণ বেড়ে গেলো। তাহলে কি জাইন সবটা জানে?

মায়ের স্পর্শে নয়ন জোড়া বন্ধ করে চুপচাপ শুয়ে আছে জাইন। তার চোখের সামনে শুধু প্রিয়তার মুখটা ভাসছে। মেয়েটাকে সে সুখী করতে চেয়েছিলো। দিতে চেয়েছিলো পৃথিবীর সকল ভালোবাসা যা সে পায়নি। মনে পড়ে যায় সেই রাত্রির কথা যখন প্রিয়তা তাকে বলেছিলে নিজের জীবনের সত্যিটা। কথাগুলো এখনো জাইনের কর্ণে ভাসে।
প্রিয়তার কাছ থেকে জাইন জেনেছিলো সে তার জীবনের একমাত্র সত্যিটা।

‘যেদিন রাতে আপনি আমার বাড়িতে গিয়ে হাঙ্গামা করলেন সেই রাতে অনুভব করলাম আমি আপনার উপর দূর্বল। ভেবেছি বাবাকে সবটা জানাবো কিন্তু সাহস হয়নি। তারা পাত্র নিয়ে হাজির হলেন আমার বিয়ের জন্য। জেদ করে আমিও রাজি হলাম৷ জেদ ভাঙলো পরে মনে হলো বাবাকে একবার আপনার কথা বলে দেখি। বিয়েটা ঠিক যেহেতু আপনার ভাইয়ের সাথে করেছে সেখানে আপনাকে মেনে নিতে অসুবিধে হবে না। বিয়ের আগের রাতে বাবার ঘরের দিকে গেলাম। ভেতর থেকে দরজা বন্ধ ছিলো। ঘরের ভেতর ভাইয়া আর মা ও ছিলো। কান পাততেই শুনতে পেলাম আমার জীবনের গোপন এ অধ্যায়। আমি আমার বাবা-মায়ের সন্তান নই। আমাকে তারা পালতে এনেছিলো।
আমার জন্ম হয় খুবই নিম্ন গরীব পরিবারে। আমার জন্মদাতা পিতার মাথায় ঋণের বোঝা ছিলো। মেয়ে জন্মের সাতদিনের মাথায় তারা এ ঋণের বোঝা আর জীবনের বোঝা সইতে না পেরে আ ত্ন হ ত্যা করে। ছোট মেয়েকে ফেলে দু’জনই পরপারে পাড়ি জমান। একবারো মেয়ের কথা চিন্তা করেননা।
সখিনা বেগম মানে আমার পালক মায়ের মা ছোট্ট শিশুটিকে মায়া করে বাড়ি নিয়ে আসেন। শিশুটির নাম পিতামাতা রেখে গিয়েছিলো প্রিয়তা ইয়াসমিন। সেই নামটি আর পরিবর্তন করেনি কেউ। বেল্লাল হোসেন আর মিসেস মাসুমা ছোট্ট প্রিয়তাকে দেখে নিজেদের সামলাতে পারেনি। ঠাই দেন নিজেদের পরিবারে। এতো বছরে কখনো বুঝতে দেননি আমি তাদের সন্তান নই। এই জন্যই বোধহয় ভাইয়া আমাকে অপছন্দ করে। করারই কথা। উড়ে এসে তাদের পরিবারে ভাগ বসিয়েছি। তাই তো তাদের মুক্তি দিতে অজানা উদ্দেশ্য যেতে চেয়েছিলাম। ভাবলাম ভাগ্য যেমন আছে থাকুক আমি আপনাকে একটা সুযোগ দিয়ে দেখি। আপনি যদি সেদিন আমায় বিয়ে না করতেন তাহলে আ ত্ম হ ন ন করা ছাড়া আমার উপায় ছিলো না। আমার কেউ নেই এই সত্যিটা নিয়ে আমি বাঁচতে পারতাম না। এ দুনিয়াতে আপনিই আমার একমাত্র আশ্রয়স্থল। আমি চিরকাল আপনার ছায়াতে বাঁচতে চাই।’

প্রিয়তার বলা শেষ দু’টি কথা জাইনের কর্ণে বারবার বাজতে থাকে। সেই রাতে প্রিয়তাকে শক্ত করে বুকে জড়িয়ে নিয়েছিলো। আজও ইচ্ছে করছে শক্ত করে জড়িয়ে মিশে যেতে। এ ইচ্ছে অপূর্ণ রয়ে যাবে। আর হবে না দেখা এ জন্মে। অপূর্ণ ইচ্ছে নিয়ে জাইনকে বাঁচতে হবে।

_____________

বছর খানেক পর…
কালে ক্রমে সময় যাচ্ছে। এক বর্ষাকাল পেরিয়ে আরেক বর্ষাকাল চলে এলো। বিকালের দ্বিতীয় প্রহরে গগণ থম মেরে রইলো। কালো বর্ণের পাঞ্জাবী গায়ে কবরস্থানে প্রবেশ করে এক পুরুষ।
কবরের উপর থেকে শুকনো পাতাগুলো সরিয়ে পরিষ্কার করে দেয়। কবরের পাশে লাগানো গাছে এক বিশাল গোলাপ ফুটেছে। টকটকে লাল বর্ণের গোলাপটা যে কারো মনোযোগ আকর্ষণ করতে যথেষ্ট। দু হাত তুলে কবর জিয়ারত করে।

‘কেমন আছো তুমি? নিশ্চয়ই ভালো আছো। আমি তোমার জন্য নিয়মিত নামাজ আদায় করি। তাহাজ্জুদে তোমার পরকালের জীবন শান্তিময় হোক সেই দোয়া করি সবসময়। আমি কেমন আছি জিজ্ঞেস করবা না?’

অপরপাশ থেকে কোনো উত্তর এলো না। নিরবতা বিরাজমান।

‘আমি ভালো নেই। ক্ষণে ক্ষণে মনে হয় মরে যাই। তুমি ছাড়া বেঁচে থাকা আমার জন্য শাস্তিস্বরূপ। তুমি তো চলে গেলে আর আমায় দিয়ে গেলে এক বিশাল শাস্তি।’

কথাগুলো বলে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে। পরক্ষণেই নিজেকে সামলে নেয়।

‘নিশ্চয়ই বাকিরা কেমন আছে জানতে চাও? তোমার আমার দু’জনেরই পরিবারের সকলে ভালো আছে। শুধু তোমার বাবা অসুস্থ হয়ে শয্যাশায়ী। তুহিন বিয়ে করেছে। আমার বড় ভাইও ঘরে বউ তুলেছে। বাবা আর আমার উপর রেগে নেই। নিজ থেকে কল দিয়ে খোঁজ খবর নেন। নিহারিকা আর নুহাশ আগের মতোই দুষ্টামি করে। মা কল দিয়েই আমাকে বাড়ি যাওয়ার জন্য জোর করে। ওহহো তোমায় তো বলা হয়নি আমি আজ সকালেই ঢাকা থেকে ফিরেছি কাজটা শেষ করে। কি কাজ সেটা পরে বলছি আগে মজার কথা শুনো। রুমা আর রফিকের ব্রেকআপ হয়ে গেছে। শুনেছিলাম রিমি মারুফের মধ্যে কিছু একটা আছে। হয়তো শীঘ্রই বিয়েটাও করবে। হৈমন্তী বিয়ে হয়েছে বর্তমানে সে মা হতে চলেছে। আর কার কথা জানি বলবো! হ্যা মনে পড়েছে। অনু আর মকবুলের কথা বলা হয়নি। ওরা অনেক ভালো আছে। ওদের সংসার আলো করে কন্যা সন্তান এসেছে। অনু মেয়ের নাম রেখেছে প্রিয়তা। আমি সকালেই দেখলাম। সকলের কথা বলা শেষ। আর কেউ বাকি আছে কিনা এই মূহুর্তে মনে পড়ছে না। আরেকটা কথা শুনে রাগ করবা না। আমি সিগারেটটা ছাড়তে পারিনি। মাঝে মাঝে খাই যখন নিজেকে সামলাতে পারিনা। হয়তো ছাড়তেও পারবো না।’

কথাগুলো শেষ করে জাইন থামে। কিঞ্চিত ভাবনায় মত্ত্ব হয়।

‘এবার কাজের কথা বলি। কোন কাজ সেরে ঢাকা থেকে ফিরলাম সেটা বলবো। মনে আছে তোমার কবরের মাটি ছুঁয়ে কথা দিয়েছিলাম যারা তোমাকে আমার থেকে কেঁড়ে নিয়েছে তাদের ছাড়বো না? তাদের এক জনকেও ছাড়িনি। খুঁজে খুঁজে শাস্তি দিয়েছি। এমন মরণ যন্ত্রণা দিয়ে দুনিয়া হতে বিদায় করেছি যা অকল্পনীয়। আমি জানি তুমি আমার এ কাজে খুশি নও কিন্তু তুমি তো জানোই আমি তোমার জন্য সব কিছু করতে পারি। তবুও এ জন্মে তোমায় এতো জলদি হারিয়ে ফেললাম। এক মাসের সংসারে শত শত স্মৃতি তুমি দিয়ে গেছো। সেই সকল স্মৃতি নিয়েই বেঁচে আছি। আমি থাকবো বেঁচে তোমার স্মৃতি নিয়ে,শুধু তোমার জন্য। একটা আশ্রম খুলেছি যেখানে পিতামাতাহীন সন্তানরা আশ্রয় পাবে। ওদের অভিভাবক হবো আমি। সকলকে ভালোবাসা যত্ন দিয়ে বড় করবো।’

চোখের কোণে আসা অশ্রু গুলো পাঞ্জাবীর হাতার উল্টো পাশে মুছে নেয়। ধুলো জমা সাইনবোর্ডটায় নজর গেলে পাঞ্জাবীর হাতা দিয়ে মুছতে শুরু করে। সাইনবোর্ডটা মুছে সেখানে দাঁড়ায়। গোটা গোটা অক্ষরে লেখা,মরহুম প্রিয়তা ইয়াসমিন। তার নিচে লেখা,স্বামী:জাইন রহমান।

‘কেউ মরে গিয়ে বেঁচে যায় আর কেউ বেঁচে থেকে মরে যায়।’
বিরবির করে কথাটা বলতেই এক দমকা হাওয়া জাইনের সর্বাঙ্গ ছুঁয়ে যায়। নেত্র যুগল বন্ধ করে সে হাওয়ার প্রতি স্পষ্ট অনুভব করে সে। ওষ্ঠে দেখা যায় মুচকি হাসি।
প্রিয়তা আছে জাইনের মাঝে। যতদিন জাইন আছে ততদিন প্রিয়তার অস্তিত্ব এ দুনিয়াতে রবে।

_______

(সমাপ্ত)