প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব-১২+১৩

0
424

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ১২ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
আয়মান পিছন দিয়েই পিয়াসাকে খুঁজতে রুম থেকে বেরিয়ে এলো। দেখল পিয়াসা নাক চোখ লাল করে ওয়াশরুম থেকে বের হলো।

নাটক,সিনেমা ও বাস্তব দুনিয়ায় মেয়েরা কাঁদার জন্য কেন যে ওই এক ওয়াশরুমকেই বেছে নেয়? মেয়েরা হয়তো অনেক কিছুই লুকিয়ে প্রকাশ করতে পছন্দ করে। আচ্ছা নাকি আমার প্রপোজাল করা ঠিকভাবে হয়নি। আমি আসলেই মায়ের ক্যাবলাকান্ত। আমি নাকি আবার ইংরেজি সাহিত্যে পড়াশোনা করেছি।

কতভাবেই তো ইমপ্রেস করা যেত। কি করলাম এটা। হুট করে বলে দিলাম মা বউ বানাতে চায়। আমিও বা আর কিভাবে বলতে পারি। যতবারই একটু কাছাকাছি হওয়ার চেষ্টা করেছি। উল্টো কাহীনি ঘটে যায়। অমনি সে আমাকে ভুল বুঝে। আয়মান এসব ভাবতে ভাবতে ফের নিজের রুমে চলে গেল। নিজের উপর এক পাহাড় বিরক্তি নিয়ে মাথার পিছনে ঘুষি দিল হাত মুঠি করে।

বিয়ে নিয়ে বাসায় আর কেউ কোন প্রসঙ্গই তুললনা। আয়মান মা বোনকে না করে দিয়েছে তাই। ইচ্ছের বিরুদ্ধে কাউকে রাজী করিয়ে বিয়ে সে করতে চায়না। তখন পিয়াসার মন ছাড়া দেহটাকে ভারী বস্তু ছাড়া আর কিছুই মনে হবেনা। তাই শেষ চেষ্টাটুকু করে দেখবে পিয়াসা যেন নিজ থেকেই তাকে পছন্দ করে বিয়ে করতে চায়।

আজ পিয়াসার রেজাল্ট দিয়েছে। অপত্যাশিতভাবে রেজাল্ট ভালো হওয়ায় মন খুব ভালো তার। গত রাতে টেনশনে ঘুম হয়নি বললেই চলে। আকস্মিকভাবে বাবাকে হারিয়ে ভালো প্রস্তুতি নিতে পারেনি পরিক্ষার জন্য। তাই খুব শংকায় কেটেছে তার প্রতিটি মুহুর্ত। বুকের ভিতর টিপটিপ করছিল সকাল থেকেই। আয়মান সকালে বের হয়ে যেতেই পিয়াসার রোল নাম্বার নিয়ে গিয়েছে। সে নিজেও মোবাইলে মেসেজ দিয়ে রেখেছে রেজাল্টের জন্য। বাবাকে মনে করে অঝোরে কেঁদেছে।

বিকেলে আয়মান বাসায় ফিরলো। হাতে মিষ্টির বড় একটি প্যাকেট।

ভাইয়া পিয়াসাপুর রেজাল্ট ভালো হয়েছে। তাই বুঝি মিষ্টি আনলে?

ভালো করেছিস বাবা। আজ যদি মেয়েটার বাবা মা বেঁচে থাকতো। অবশ্যই তাকে মিঠাই খাওয়াতো।

মিষ্টি আনার আরেকটি উপলক্ষ রয়েছে। আমার প্রমোশন হয়েছে মা। আমি আর স্কুলে ক্লাস নিবনা। কলেজেই সব ক্লাস নিব। অর্থাৎ তোমার ছেলে এখন থেকে কলেজের অধ্যাপক।

ওয়াও। কংগ্রাচুলেশন ভাইয়া। যাই পিয়াসাপুকে জানাই গিয়ে। আয়মান নিজের রুমে চলে গেল। ফ্রেস হয়ে এসে ভাত খেল। পিয়াসাকে ডাকতে বলল আয়মানের মা। পিয়াসা মিষ্টি হাসি দিয়ে ডাইনিং টেবিলের পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালো।

কংগ্রাচুলেশন পিয়াসা।

থ্যাংক ইউ স্যার। আপনাকেও অভিনন্দন প্রমোশন হওয়ার জন্য।

আয়মানের মা টেবিলে উপরে থাকা মিষ্টির প্যাকেটটি খুললেন।
পিয়াসা ধরো মিষ্টি মুখ করো।

আন্টি আমি সাদা মিষ্টি কম খাই। কালো জাম পছন্দ করি।

ওহ আচ্ছা। নাও কালো জাম আছেইতো। তোমার স্যার তিনপদ মিলিয়ে এনেছে।

আমিও খাওয়াবো আপুকে। বলে আলিশা পিয়াসাকে মিষ্টিমুখ করালো।

মা আমাকে খাওয়াবেনা তোমার হাতে মিষ্টি? বলল আয়মান।

দিচ্ছিতো বাবা। এই নে হা কর।
মা তোমাকেও একটা খাওয়াই বলে আয়মান মায়ের পছন্দের মিষ্টি মায়ের গালে পুরে দিলো। সবাই সবাইকে মিষ্টি খাওয়ালো আয়মান পিয়াসা ছাড়া।

ভাইয়া আপুকে মিষ্টি মুখ করাবানা?
হুম দিচ্ছি।

আলিশা ও তার মা চলে গেল নিজেদের রুমে কাজের বাহানায়।

আয়মান একটা মিষ্টি কাঁটা চামচে গেঁথে নিলো। পিয়াসার ঠোঁটের সামনে ধরলো। পিয়াসা খেতে অনাগ্রহ দেখাচ্ছে। আয়মান বুঝতে পেরে শক্তমুখে বলল,
আমি মাকে জানিয়েছি তুমি রাজী নয়। মা বুঝতে পেরেছে। সমস্যা নেই পিয়াসা। তুমি তোমার মতই থাকো। এবার হা করো। পিয়াসা স্মিত হেসে মিষ্টি খেয়ে নিল। চলে গেল আলিশার রুমে। আয়মান ব্যথিত মনে পিয়াসার চলে যাওয়ার দিকে চেয়ে রইলো নিঃষ্পলক চাহনিতে। সে খুব চেয়েছে পিয়াসার হাতে একটু মিষ্টি খেতে।

ভার্সিটিতে ভর্তি হওয়ার সময় হয়ে গেল। পিয়াসা পছন্দমতো ভার্সিটিতে চান্স পেলনা। জগন্নাথেই ভর্তি হতে হলো অবশেষে। পিয়াসাকে নিয়ে এসব দৌড়ঝাঁপ আয়মানই করেছে। পড়াশোনার যাবতীয় কিছু আয়মান একে একে এনে দিল।

রায়হান শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়েছে। দেশের বাইরে চলে যাবে। সেখানে একটি কোম্পানিতে তার ভালো বেতনের চাকরি হয়েছে।

আজ রায়হানের গায়ে হলুদ। কাল বিয়ে। আয়মানদের সাথে তাদের পারিবারিক ঘনিষ্ঠতাও রয়েছে। তাই আয়মানের সাথে আলিশা ও পিয়াসাও গায়ে হলুদের দিন রাতে তাদের বাসায় উপস্থিত রয়েছে।

বাসার ছাদে হলুদ সন্ধ্যার আয়োজন করা হয়েছে। সবাই ছাদে যার যার মতো করে হৈ হুল্লোড়ে মেতে আছে।
রায়হানদের পুরো বাসা খালি। পিয়াসা ওয়াশরুমে যাওয়ার জন্য বাসায় এলো। বাসার গেইট খোলা। যেহেতু একটু পরপর নানা কারণে এ ও আসছে তাই। ওয়াশ রুমে থেকে বের হতেই দেখে পুরো বাসা অন্ধকার।

দেয়াল হাতড়াচ্ছে পিয়াসা। মোবাইলের আলো ফেলল। সামনে অচেনা একটি ছেলেকে দেখে পিয়াসা চমকে উঠলো।

কে আপনি ভাইয়া?

চিনবেনা তুমি। একটু এদিকে আসতো বলে পিয়াসার হাত ধরে টেনে বিছানায় নিয়ে চিৎ করে শুইয়ে দিল। ছেলেটির বলিষ্ঠ বাহুড়োরে পিয়াসা আটকে গেল পেরেকের মতো। হলুদ শাড়িতে হলুদ সাজে হলদে রানী সেজে বসে আছ কার জন্য?

ছাড়েন বলছি। বেয়াদব। আমি চিৎকার দিব কিন্তু।

ওহ নো। তাই নাকি বলে ছেলেটা পিয়াসার ব্লাউজের রশি টেনে খুলে ফেলল। পেটের উপর থেকে কাপড় সরিয়ে নাভিতে মুখ ডুবিয়ে দিলো।

পিয়াসা ছেলেটির চুল খামচি দিয়ে সরিয়ে দিল। ছেলেটি পিয়াসার দুই কাঁধ থেকে ব্লাউজের হাতা সরিয়ে উদাম করে দিল। অধরের মৃদু ছোঁয়া দিতে দিতে ঘাড়ের একপাশ থেকে আরেকপাশে গেল।

বুকের উপর থেকে শাড়ির আঁচল সরিয়ে নিলো। ব্লাউজের বোতাম একটা খুলে ফেলতেই তার কানে এলো আয়মানের কন্ঠস্বর। তীব্রগতিতে উঠে পালিয়ে চলে গেল ছেলেটি।

এদিকে আয়মান পিয়াসাকে ছাদে না দেখে নিচে খুঁজতে এলো। আলিশা হলুদ ডালা সাজানো নিয়ে ব্যস্ত বলে আসতে পারেনি।

পিয়াসা কোথায় তুমি? কি ব্যাপার বাসা অন্ধকার কেন? কারেন্ট তো যায়নি বলেই আয়মান রায়হানদের বাসার সব লাইট জ্বালিয়ে দিলো।

একি তুমি বিক্ষিপ্ত অবস্থায় বিছানায়? ঘাড়ের রগ ফুলে গেল আয়মানের। সমস্ত শিরা উপশিরা ছুটাছুটি করতে লাগল।

পিয়াসা নিরব বাসায় আয়মানের বুকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। যেন আয়মান তার এক পৃথিবী নির্ভরতা ও আশ্রয় । উদভ্রান্তের মতো কাঁদতে লাগলো।

আড়ভাঙা ভেজা গলায় বলল,
স্যার আপনি অনেক ভালো। অনেক অনেক। অনেক পছন্দ করি আপনাকে। আপনি এখন না এলে আমার সব শেষ হয়ে যেত স্যার। আয়মানের বুকে পিয়াসা মুখ ঢলতে লাগল।

আয়মান স্তব্দ হয়ে রইলো। পিয়াসার মাথায় হাত দিয়ে নিজের বুকের সাথে মিশিয়ে নিল। ব্লাউজের ফিতা লাগিয়ে দিল। দুই হাতা টেনে উদাম কাঁধ ঢেকে দিল। বলল উপরের বোতামটা লাগাও।
ছেলেটাকে দেখলে চিনবে?

হুম চিনব। পিয়াসার হাত ধরে ছাদে নিয়ে গেল। শিকারী চোখের মতো অনেক খুঁজেও সেই ছেলেকে আর খুঁজে পেলনা।

স্যার আমি বাসায় চলে যাব। খুব খারাপ লাগছে।
আচ্ছা আসো তাহলে।
আয়মান রিকসাযোগে পিয়াসাকে বাসার নিচে দিয়ে আবার রায়হানদের বাসায় চলে গেল।

পিয়াসা সব চেঞ্জ করে নিল। নিজেকে ধাতস্থ করল সময় নিয়ে। পড়ার টেবিলে বসে মাথা নিচু করে ঝিম হয়ে রইলো। মার্কার পেন খুঁজতে আয়মানের রুমে গেল পিয়াসা।

আয়মানের টেবিলে বেখেয়ালবশত চোখ গেল একটি ডায়রির উপরে। আজ পিয়াসা এমনিতেই আয়মানের উপর ভীষণ প্রসন্ন। বাহব্বা! স্যার ডায়েরি ও লিখে আজকাল। দেখিতো বলে পিয়াসা আয়মানের ডায়রিটা একের পর এক পাতা উল্টিয়ে পড়তে লাগলো। বিস্ময়ে পাগল পাগল দশা পিয়াসার।

সে পড়তে শুরু করল,

” আমিতো আজন্ম অন্তর্মুখী মানুষ। নিজের অনুভূতিটুকুও প্রকাশ করতে পারিনা তোমার কাছে। সেদিন ফুল পা দিয়ে চেপে ধরেছি কারণ আমি চাইনি আমি ছাড়া অন্য কারো ভালোবাসার ফুল হাতে নাও তুমি । যেদিন তোমাকে হাতে মেরেছি। ঠিক সেদিনই তোমাকে ভালোবেসে ফেলেছি। তোমার টকটকে লাল হওয়া সরু হাতের তালু, তোমার আঁখিকোন বেয়ে গড়িয়ে পড়া অভিমানী অশ্রু, তোমার প্রতিবাদহীন আহত চোখের নিরব ভাষা আমার হৃদয়টাকে নিংড়ে দিয়েছে কেশবতী।

সেদিন যখন তুমি আমার লেপ গায়ে দিয়েছিলে। কি যে ভালো লেগেছে বোঝাতে পারবোনা। কারণ সেই লেপের প্রতি ভাঁজে ভাঁজে তোমার শরীরের প্রতি ভাঁজের স্পর্শ আর গন্ধ মিশেছিল। কিন্তু তুমি উল্টো বুঝলে।

কলমের ভাষা ছাড়া আমার অনুভূতি প্রকাশ করার আর উপায় যে নেই। তুমি আমার সাত জনমের কেশবতী। তুমি আমার গহন বনের স্বপন। তুমি আমার প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে।
” রুহে রুহ মেশে,গন্ধ তোলে ঢেউ
হৃদয়ে কাঁপন তোলে তোমার মতো কেউ।”

ডায়েরির প্রতিটি লেখার উপরে পিয়াসা বেহুঁশ হয়ে চুমু খেতে লাগল। আস্তে করে উচ্চারণ করল,
আয়মান স্যার আমাকে ভালোবাসে? রায়হানের আগে থেকেই?
আমিওতো স্যারকে সেই কবে থেকে গোপনে ভালোবাসি। ডুবে ডুবে ভালোবাসি।

চলবেঃ ১২

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ১৩ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
গোটা ডায়েরিটা যত্নের সাথে আরো কিছুক্ষণ দেখল ও পড়ল পিয়াসা।

শেষের এক পৃষ্ঠাতে লেখা পেল,
” জানো কেশবতী তোমাকে নিয়ে কত যে স্বপ্নে হারাই। বালুচরে ঘর বাঁধি। সাজাই আমার প্রণয়ের জলসাঘর। যেই জলসাঘরে তুমি ছাড়া দ্বিতীয় কোন নারীর আসন হবেনা। যেই জলসাঘরে আমি বেহুঁশ হয়ে তোমার উছলে পড়া রূপসুধা পান করবো। তোমার পায়ে পরাবো ঘুঙুর। কোমরে রূপোর বিছা। খোঁপায় থাকবে বকুল মালা। তোমার প্রণয় নৃত্য অবলোকন করব আমি বুঁদ হয়ে নেশাতুর নয়নে। তুমি আমার অপ্রতিরোধ্য আকর্ষণ কেশবতী। তুমি আমার প্রণয়ের জলসাঘরের রূপজান, রূপমাধুরী, মধুবালা,অঙ্গনা, লীলাবতী, চন্দ্রমুখী। ”

পিয়াসা ঝিরিঝিরি বৃষ্টির মতো হেসেই সারা। নিশ্চিত হলো আয়মান স্যারের কেশবতী সে ছাড়া আর কেউই নয়। মনে পড়ল গ্রামে দাদীকে বলছিল আয়মান,
কেশবতীকে না পেলে আর কাউকেই বিয়ে করবোনা। বিয়ে বাড়িতে ঘটে যাওয়া বিষয় নিয়ে যতটা বিষাদে বিরক্তিতে ছেয়ে গিয়েছে পিয়াসার মন। তার চেয়েও কয়েকগুণ বেশী ভালো হয়ে গিয়েছে এই ডায়েরিটা পড়ার পর।

পিয়াসা ডায়েরিটা যেভাবে ছিল ঠিক সেভাবেই রেখে দিল। মনে মনে ঠিক করল,
কিছুতেই বুঝতে দিবনা আমি যে বুঝেছি। দেখি মদনে কি করে। এবার জমবে প্রণয়ের জলসাঘর। এমন নাচান নাচাবো বান্দরের মতো। কলা ঝুলিয়ে রাখব মুখের সামনে। কিন্তু খেতে দিবনা। হুহু!

দেয়ালে আয়মানের দাঁড়ানো একটি বাঁধাই করা ফ্রেমে বন্ধী ছবি দেখতে পেল। এ রুমে খুব দরকার না হলে আসাই হয়না। তাই দেখতে পায়নি এতদিন। পিয়াসা ছবিটির সামনে দাঁড়ালো কোমরে দুইহাত দিয়ে।

বিড়বিড়িয়ে গাইলো,
” হিরো হিরো হিরো,তুমি আমার হিরো।
তুমি ছাড়া জীবনটা আস্ত একটা জিরো। ”

আই লাভ ইউ আয়মান। এই যে হ্যালো.. মিস্টার আয়মান শেখ, বুকের ভিতরে এত উথাল-পাতাল প্রেম নিয়ে ঘুমাও কি করে। উপর দিয়ে দেখলে মনে হয় সাধু। ভাজা মাছটিও উল্টো খেত জাননা। এখন তো দেখি ভাগে পেলে শুধু মাছ নয়,মাছের কাঁটাও হজম করে ফেলবে।

সেই স্কুলে থাকতেই তোমাকে লাইক করি। কলেজ শেষ দিলাম। ভার্সিটিতে উঠে গেলাম। প্রেমটাই হলনা আমাদের। আচ্ছা বলতো হ্যান্ডসাম পুরুষ। এভাবে চলতে থাকলে আমরা যে বুড়ো-বুড়ি হয়ে যাব। তো প্রেম করব কখন? বিয়ে করব কখন? পয়দা করব কখন? তুমি ছেলে মানুষ। তোমাকেই প্রপোজ করতে হবে। আর সেই পথ আমিই তৈরি করে দিব। হিঃহিঃহিঃ করে পিয়াসা কিটকিটিয়ে হেসে ফেলল।

ভালোবাসা মানুষকে মহান করে। ঔদার্য হতে শেখায়। বুকে জমে থাকা সকল ব্যথা যন্ত্রণা ঘৃণা দূর করে দেয়। পরিশুদ্ধ করে শ্রাবণ ঢলে ধুয়ে দেওয়া পথ ঘাটের মতো। তার প্রতি আয়মানের অনুরাগ, নিবেদন দেখে সে ভুলেই গেল এই রাতেই তার সাথে ঘটে যাওয়া বিশ্রী ঘটনাটি।

ঘড়ির কাঁটা রাত একটা ছুইঁ ছুইঁ।
আল্লাগো যে কোন সময় আমার মদন প্রেমিক এসে যাবে। চলে যাই।

পিয়াসা আয়মানের রুমের লাইট দরজা অফ করে আলিশা ও তার রুমে রুমে চলে গেল। চোখ বন্ধ করে ঘুমানোর মিথ্যে চেষ্টায় ক্লান্ত তার চঞ্চল দুটি আঁখি।

এদিকে বিয়ে বাড়ির ঘটনা রায়হানকে বলার পরে সে বুঝে নিল এটা কার কান্ড। তার ছোট ফুফুর জায়ের ভার্সিটি পড়ুয়া লম্পট ছেলে এটা করেছে পিয়াসাকে দেখেই। দাওয়াত না দিলেও এই ছেলে দূরাত্মীয়দের অনুষ্ঠানগুলোও মিস করেনা মেয়েদের লোভে। প্রতিটি পরিবারেই এমন বাজে চরিত্রের দুই একজন মানুষ থাকে। এরা নারী দেহ পেলেই হলো। কে, কি হবে, সম্পর্কে এগুলো যাচাই করার ও হিতাহিত জ্ঞান থাকেনা। রায়হান তাকে মেরে বের করে দিয়েছে। এবং আর কখনো যেন তাদের বাসায় না আসে আল্টিমেটাম দিয়ে দিয়েছে।

পিয়াসার জন্য রায়হানের মনের অন্তঃপুরে প্রণয় এখনো বহমান বহতা নদীর মতো। তার খুব ইচ্ছে করেছে হলদে সাজে পিয়াসাকে একটু ছুঁয়ে দেখতে। কিন্তু সময় ও পরিবেশ তার বিপক্ষে ছিল।

কিছুক্ষণ পর মোবাইলের নাম্বারে মেসেজের টুং করার আওয়াজ শুনে চোখ মেলল পিয়াসা । কোন অসভ্যরে তুই। এত রাতে মেসেজ দিলি।
আয়মানের নাম্বার দেখেই ঠোঁটের একপাশ কামড়ে ধরল পিয়াসা।

” কলিংবেলের আওয়াজে মার ঘুম ছুটে যাবে। গেট খোলো। ”

ওমাগো আমার যে কি শরম লাগছে। এই বলে পিয়াসা উঠে গিয়ে গেট খুলেই প্রায় দৌড় দিল রুমের দিকে। তা দেখেও আয়মান কোন বিশেষ হেলদোল দেখালোনা। সে বুঝে নিল সদ্য ঘটে যাওয়া ঘটনার জন্য পিয়াসা বিব্রতবোধ হচ্ছে তার সামনে। সেই বিষয় টেনে সে নিজেও পিয়াসাকে আড়ষ্টতায় ফেলে দিতে চায়না।

আজ বাইরে থেকে এসেই আয়মান পিয়াসাকে ফেসবুকে মেসেজ দিল। আমার রুমে আসো। পিয়াসা তিড়িংবিড়িং করে নাচতে নাচতে রুমের সামনে গিয়ে থামলো। চোখ মুখের দুষ্ট দুষ্ট ভাব লুকিয়ে ফেলল। ভিতরে ঢুকে দাঁড়ালো। মুখে কিছুই বলছেনা।

কেন ডেকেছি জিজ্ঞেস করবেনা?

কেন জিজ্ঞেস করব? আপনি
ডেকেছেন। আমি আসলাম। এবার কারণটাতো আপনিই বলবেন স্যার।

আয়মান উঠে দরজা ভিড়িয়ে দিল। লুকিয়ে রাখা একটি তাজা লাল গোলাপের তোড়া পিয়াসার দিকে বাড়িয়ে ধরলো নিবেদিত চোখে।

উচ্ছ্বল হাসি দিয়ে বলল,
শুভ জন্মদিন পিয়াসা। সুন্দর থেকে আরো সুন্দর হও।

পিয়াসা হকচকিয়ে গেল। উচ্ছ্বাস মাখা হাসি দিয়ে,
আমার জন্মদিন কিভাবে জানলেন?

জুকার বার্গের কল্যাণে ফেসবুক থেকে।

থ্যাংক ইউ স্যার। আমি যাই এবার?

তোমার ভালো লাগছে গোলাপ পেয়ে?
খুউব ভালো লাগছে। ফুল আমার ভীষণ প্রিয়।

তাহলে আমি যদি তোমাকে রোজ একটি করে গোলাপ এনে দিই। কেমন হবে?

দারুণ হবে স্যার।

তাহলে তুমি আমাকে কি দিবে?

পিয়াসা হাসি মুখ বিবর্ণ করে ফেলল। বলল,যারা বিনিময় আশা করে তাদের থেকে ফুল নিবইনা আর। পিয়াসা পা চালিয়ে চলে গেল।

পিয়াসা শুন প্লিজ…রাগ করোনা বলছি।
শিট। আমার কপালটাই খারাপ। ভাব জমাতেই পারছিনা। আবার প্রেম। বলি একটা মিন করে। বুঝে নেয় আরেকটা। আয়মান নিজের কপাল নিজেই ঠোকাতে লাগল।

পিয়াসার জন্মদিন উপলক্ষে কেক কাটা হবে সন্ধ্যায়। এই আয়োজন করেছে আলিশা। আয়মান কেক এনে দিয়েছে। কেক কাটা হলে সবাই সবাইকে খাওয়ালো। আয়মানের হাতে পিয়াসা কেক খেল। কিন্তু নিজে খাওয়ালোনা। আয়মান কিছুটা রাগ হয়ে চলে গেল। পিয়াসা বুঝেও না বোঝার ভান করে রইলো।

আয়মানের মা পিয়াসার পিঠে হাত দিয়ে নিজের রুমে নিয়ে গেলেন। সাথে আলিশাও গেল। তিনি বললেন,
মা তোমার কাছে একটা আবদার করবো। রাখবে?

পিয়াসা বুঝল ব্যাপারটা। বলল আপনাকে মায়ের মতো ভালোবাসি আন্টি। আপনার আবদার আমার শিরোদার্য।

তুমি না শুনেই বললে ?

হুম বললাম। বলেন আন্টি। আয়মানের মায়ের হাত ধরে অনুনয়ের ভঙ্গিতে বলল পিয়াসা।

আমি আয়মানের সাথে তোমার বিয়ে দিতে চাই। তোমার আপত্তি থাকলে চাইনা।

পিয়াসা চুপ করে রইলো।

আপু স্পষ্ট করে বল। এ যুগের মেয়ে হয়ে এত গুটিয়ে থাকা মানায়না।

আমার কোন আপত্তি নেই আন্টি।

ইয়েহ! আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। বলে ধেই ধেই করে হাত পা ছোড়াছুড়ি করতে লাগল আলিশা।

পিয়াসা মাথা নামিয়ে লজ্জাবনত চোখে তার রুমে চলে গেল। দরজা বন্ধ করে দিল। পিছন দিয়ে আয়মানের মা ও আলিশা আয়মানের রুমে গিয়ে,
পিয়াসা বিয়েতে রাজি জানালো।

আয়মান বিষ্পোরিত নয়নে মা বোনের মুখের দিকে বারবার চাইলো।

কিরে এমন ভাবে তাকাচ্ছিস কেন? অবিশ্বাস্য কিছু মনে হচ্ছে নাকি তোর কাছে?

আমার কান ঠিক আছেতো মা ? গোল গোল চোখে জানতে চাইলো আয়মান।

পাশ থেকে আলিশা বলল,তার মানে তুমি আপুর সাথে এমন কোন আচরণ করেছ,যার দরুন সে রাজী হওয়ার কথা নয়। এম আই রাইট ব্রো?

আয়মান নিরুত্তর রইলো চিন্তাগ্রস্ত মনে।

এরা চলে গেলে আয়মান পিয়াসাকে মেসেজ দিল। প্লিজ এক্ষুনি আমার রুমে আসো।
পিয়াসা এলনা। এরপর আয়মান উঠে গিয়ে পিয়াসার হাত ধরে টেনে নিজের রুমে নিয়ে আসল। দরজা বন্ধ করে দিল।

পিয়াসার দুই বাহুর উপরে হাত দিয়ে ধরে এনে খাটে বসালো। অল্প দূরত্ব বজায় রেখে সেও বসল।

মা আর আলিশা যা বলল তা কি সত্যি?

পিয়াসা থম মেরে আছে।

চুপ থাকা কোন সমাধান হতে পারেনা। মুখ দিয়ে উচ্চারণ করে বল সত্যিই?

হ্যাঁ সত্যি।
কারণটা জানতে পারি ?

আপনি যে কারণে রাজী হয়েছেন। ঠিক সেই একই কারণে আমিও রাজি হয়েছি।

তার মানে আমি যেমন মায়ের কথা ফেলতে পারিনি। তুমিও আমার মতো ফেঁসে গিয়েছ। মায়ের কথা ফেলতে পারনি। এইতো?

ঠিক তাই। বলল পিয়াসা।

এভাবে কি ভালো থাকা যায়?

খুব যায়।

ইম্পসিবল। যে তুমি আমাকে তোমার জন্মদিনের একটু কেক খাইয়ে দিলেনা। রেজাল্টের দিনে আনা মিষ্টি খাইয়ে দিলেনা। তাহলে আমি কি বুঝিনা তোমার মাঝে আমার স্থান কতটুকু?

বিয়ের রাতে মিষ্টি বেশী করে খাইয়ে দিয়ে পুষিয়ে দিব। নরম সুরে বলল পিয়াসা।

তুমি মায়ের জন্য রাজী হয়েছে। বুকের ভিতরে ঠিকই না ভালোলাগাটা পুষে রেখেছ।

সেইম কথা কি আমিও বলতে পারিনা আপনাকে?

খুব পারো। হাজারবার পারো। তাহলে আস আমরা বিয়ের আগেই সহজ হওয়ার প্র‍্যাক্টিস করি।

কিভাবে?

আয়মান হাত দিয়ে তার মাথার পিছনে চুলকাতে চুলকাতে, নাহ কিছুনা।

তাহলে আমি যাই? আরেকটি রিকুয়েষ্ট রাখবেন?

রাখব। মেঘকালো মুখে বলল আয়মান।

বিয়ের আগ পর্যন্ত যতটুকু সম্ভব দূরে দূরে থাকবেন আমার থেকে।

একটু বসবে পাশে?

কোন দুঃখে বলে পিয়াসা চলে গেল৷

আয়মান কল্পনা করতে লাগল বিয়ের সাথে পিয়াসাকে কিভাবে কেমন করে ভালোবাসবে। গোপনে রোমাঞ্চকর অনুভব করল।
আবার ভাবল,আমাকে দিয়ে কি সত্যিই কিছু হবে? কিন্তু কিছু একটাতো করতেই হবে।

বাসায় বিয়ের প্রস্তুতি চলছে। আলিশা কলেজে যাওয়া আসা করছে নিয়মিত। পিয়াসাও তার মতো করে ভার্সিটিতে যাচ্ছে আসছে। কলেজে ভর্তি হওয়ার পর হতেই আলিশার জন্য অংকের টিচার রাখা হয়েছে বাসায়। সে অংকে তুলনামূলক কাঁচা। সপ্তাহে তিনদিন আসে তার শিক্ষক। নাম শুভ। এই শিক্ষকের প্রতি আলিশা অনুরক্ত। একা হলেই শুভ স্যারের জন্য সে প্রণয় অনুভব করে। আজ শুভ যখন তাকে পড়াতে আসল বিকেলে। সে ভয়ানক এক কান্ড করে বসল। শুভ তাকে অংক করতে দিলো। সে অংক করে নিচে লিখে দিল।

” স্যার আপনি কি কাউকে লাভ করেন?”
শুভ না দেখার ভান করে রইলো। পড়া শেষে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ালে আলিশা শুভর দিকে চেয়ে,

স্যার আমার অংকে কি কোন ভুল ছিল?

শুভ শান্ত মেজাজে বলল,
ভুল হলে বলতাম আলিশা।

স্যার এক মিনিট ওয়েট প্লিজ।

পিয়াসার সাথে ঘটনাক্রমে শুভ’র আজ অবধি দেখা হয়নি। কারণ যেই তিনদিন যে সময়ে শুভ আলিশাকে পড়াতে আসে। ঠিক ওই সময়ে পিয়াসা বাইরে থাকে ক্লাসের জন্য। শুভ চলে গেলেই পিয়াসার আসা হয়। এ নিয়ে আলিশার মনে খুব আক্ষেপ। কেন তার শুভ স্যারকে দেখাতে পারছেনা পিয়াসাপুকে।

আজ পিয়াসা ভার্সিটি যায়নি বাসায় রয়েছে। সুযোগ হাতছাড়া করা যাবেনা। আলিশা পিয়াসাকে হাত ধরে নিয়ে এলো।

স্যার আমার পিয়াসাপু। পিয়াসা সালাম দিয়ে চোখাচোখি হতেই থমকে তার শুভ। আটকে যায় তার দৃষ্টি।

তুমি জলিল কাকার মেয়ে পিয়াসা না?

হ্যাঁ। আপনি শুভ ভাই না? বিস্ময়ভরা চোখে জিজ্ঞেস করল পিয়াসা।

তোমাকে খুঁজে খুঁজে এই শহরে আমি। বলল শুভ।

চলবেঃ ১৩