প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব-১৬+১৭

0
405

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ১৬ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
আয়মান ও পিয়াসা বেহুঁশের মতো দৌড়ে আসল। মরিয়ম ও আসল পিছন দিয়ে। নামাজ শেষে আয়মানের মা ছুটে এলো প্রবল উৎকন্ঠা নিয়ে।

আলিশা জোরে জোরে দম ফেলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার দম আটকে আটকে যাচ্ছে৷ এই শীতেও দরদর করে ঘেমে একাকার হয়ে যাচ্ছে। তাকে বেশ অস্বাভাবিক লাগছে।

আয়মান পিয়াসাকে আদেশ দিল,
তুমি ওকে নিয়ে নিচে আসো। আমি সিএনজি ঠিক করে গেটে আনছি। লেট করা যাবেনা।

আমিও যাব বলে আয়মানের মা তড়িঘড়ি করে বোরকা পরে নিল। আলিশাকে ধরে আস্তে করে নিচে নামালো। নিকটস্থ হাসপাতালে নিয়ে গেল তৎক্ষনাৎ। ভর্তি করা হলো জরুরী ভাবে। পরিক্ষা নিরিক্ষার পর ডাক্তার রিপোর্ট দেখে জানালো,
দুঃশ্চিন্তার কিছুই নেই। পেশেন্ট দীর্ঘসময় অভুক্ত ছিল মনে হয়। তাই গ্যাস্টিকের পেইন ছিল এটা। আর অতিরিক্ত টেনশনের জন্য প্রেসার হাই হয়ে গিয়েছে। মেডিসিন দিয়ে দিচ্ছি। ঠিক হয়ে যাবে। ঘাবড়ানোর কিছুই নেই।
পরেরদিন বিকেলে আলিশাকে রিলিজ নিয়ে বাসায় চলে এলো ।

আয়মানের মা মেয়েকে খুব করে বকলেন। আয়মান ও শাসালো ধমক দিয়ে। বলল,তোর আবার কিসের টেনশন আমি বুঝিনা? খাবি দাবি ফূর্তি করবি। পড়াশোনা করবি এইতো।

ওরা চলে গেলে আলিশা পিয়াসার হাত ধরে মিনতি স্বরে বলল,
আপু, শুভ স্যারকে দেখতে পেলেই আমি বেশী ভালো থাকব। ভাইয়াকে বল আমি অন্য কারো কাছে অংক ভালো বুঝবোনা।

আচ্ছা বি কুল আলিশা। এনি হাউ আমি এটা করবই। ওয়েট, বলে পিয়াসা অন্য বারান্দায় চলে গেল। তার ফোনের রিসিভ নাম্বার থেকে শুভ’র নাম্বার বের করল।

ফোন দিতেই রিসিভ হলো ওপাশে। পিয়াসা সালাম দিয়ে কুশলাদি বিনিময় করল শুভ’র সাথে।
বলল, আমার কিছু জরুরি কথা ছিল শুভ ভাই।

ফোনের বিপরীত পাশে শুভ উচ্ছল হাসি দিল। ভাবল পিয়াসা নিজেই তার সাথে বিয়েতে রাজি।

পিয়াসা, নিজের বিয়ে ঠিক হলো সে বিষয়ে বিস্তারিত জানালো শুভকে । আলিশার বিষয়েও সব খোলাসা করে জানালো। এবং পরে অনুরোধ করে বলল, প্লিইইজ শুভ ভাই আলিশার প্রতি একটু মনোযোগী হউন। ঠকবেন না বরং জিতেই যাবেন । আমার উপর ভরসা রাখুন।

এরপর পিয়াসা আয়মানকে নিজের মতো করে বুঝিয়ে রাজী করাল শুভকে আবার রাখার জন্য। কিন্তু নিজে যে আলিশার জন্য আগেই কথা বলে নিল। তা আয়মানের কাছে গোপন রাখল আলিশার কথা ভেবেই। অনুরোধ করলো, স্যার আপনি শুভ ভাইকে ফোন দিয়ে আসতে বলুন।

আয়মান বলল, যেখানে সে না করে দিল। আমিও মেনে নিলাম। এখন আবার পড়াতে বললে কেমন দেখায়।

কিসের কেমন দেখাবে? বলবেন আলিশা তোমার কাছেই অংক ভালো বোঝে। শুভ ভাই আপনার কাছে বলেই পড়া ছেড়েছে। কারণ তাকে আপনিই ঠিক করেছেন। তাই আপনি না বললেতো আর সে আসবেনা।

আচ্ছা বলছি। পিয়াসা চলে যাওয়ার জন্য পা বাড়াতেই, পিয়াসা বলে ডাক দিল আয়মান।

কেমন লাগছে তোমার ?

বুঝিনি। কি কেমন লাগছে স্যার?

এই যে দুদিন পরে বধু সাজবে। সেই অনুভূতি জানতে চাচ্ছি।

এটা জানা কি খুব জরুরী?

হ্যাঁ জরুরী। জীবনের এমন
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বিষয়গুলো মানুষকে আনন্দ দেয়। পরিপূর্ণতা দান করে । কন্ঠে শীতলতা এনে বলল আয়মান।

হুম বুঝলাম।

তাহলে বল প্লিজ।

অনুভূতি মিশ্র এলোমেলো। এই বলেই পুলকিত হাসি ছড়িয়ে পিয়াসা চলে গেল।

আয়মান মনে মনে বলছে,

” তুমি ছিলে মেঘে ঢাকা চাঁদ
এ বুকে ছিল বড় সাধ।
একবার তোমাকে দেখার
একবার তোমাকে পাওয়ার। ”

আয়মান শুভকে ফোন দিয়ে বলার পর সে আলিশাকে পড়াতে আসল বিকেলে। আজ আলিশা একদম চুপ। জমে আছে বরফের মতো। পড়ার প্রসঙ্গ বাদে অতিরিক্ত কোন কথাই বলছেনা শুভ স্যারের সাথে। সে বুঝতে চায় শুভ স্যার তার প্রতি কতটা আন্তরিক। আবার লজ্জাও লাগছে শুভ স্যারের চোখাচোখি হতে। লেখিকা রেহানা পুতুল এর সাথে যুক্ত হউন দারুণ স্বাদের গল্প পেতে হলে।

শুভ অবাক হলো আলিশার নিরবতা দেখে। ভাবল যে মেয়ে আমাকে গোপনে ভালোবাসে। আমার অনুপস্থিতিতে রীতিমতো অসুস্থ হয়ে গেল। সেই মেয়ে আমাকে সামনে পেয়ে এত শান্ত দিঘির জল হয়ে আছে কিভাবে। সত্যিই সেলুকাস কি বিচিত্র!

শুভ আলিশার খাতায় অংকের নিচে শুধু লিখল,
কেমন আছ তুমি এখন ?

এর বেশীকিছু লিখা তার হাত দিয়ে বের হলনা। শুভ মনে করে মার্জিত শালীন আচরণের মাঝে অন্যরকম সৌন্দর্য আছে। যেমনি আছে লজ্জার ও সুমিষ্ট সৌন্দর্য।

আলিশা উৎফুল্ল হয়ে গেল মনে মনে। এ বাক্যটির অপেক্ষায় ছিল এতক্ষণ। একরাশ ভালোলাগা তার মনে দোল দিয়ে গেল। ভালোবাসা বুঝি এমনি। সামান্য সাধারণ একটি বাক্যও ঝিমিয়ে পড়া অন্তরকে উজ্জীবিত করে তুলতে পারে। অসাধারণ সুখ দিতে পারে।প্রশান্তি এনে দিতে পারে দুর্নিবার।

রিপ্লায় দিল। আলহামদুলিল্লাহ স্যার। এখন বেশী ভালো আছি। আপনি কেমন আছেন?

হুম আমিও ভালো আছি। নিজের প্রতি যত্ন নিবে। নিজের জীবন নিয়ে তামাসা করার অধিকার কাউকেই স্রস্টা দেননি।

আলিশা চেয়েছিল স্যার তাকে জিজ্ঞেস করুক এখন বেশী ভালো থাকার কারণ? তার প্রতিত্তোর সে আগেই তৈরি করে রেখেছে ফুলদানিতে সাজিয়ে গুছিয়ে রাখার ফুলের ন্যায়। মনটা কিঞ্চিৎ ভার হয়ে গেল আলিশার। কিন্তু তা শুভকে টের পেতে দিলনা।

আচ্ছা স্যার মনে থাকবে। অংক করতে করতে সম্মতি জানাল আলিশা।

মাঝখানের যে কয়দিন পড়া গ্যাপ গিয়েছে। তা ফিলাপ করার জন্য শুভ এই সপ্তাহে পরপর তিনদিন এসেছে। তার একান্ত ইচ্ছে ছিল পিয়াসাকে বিয়ে করার। কিন্তু তা সম্ভব হয়নি বলে মনে ছোট্ট একটা ধাক্কা খেল। তা সামলিয়ে স্বাভাবিক হতে একটু সময় লেগে যাচ্ছে। তাই আলিশার প্রতি আলাদা কোন অনুভূতিই কাজ করছেনা শুভ’র মনে।

পড়ার ফাঁকে ফাঁকে কলম দেওয়া নেওয়ার সময় আলিশা ও শুভ’র আঙ্গুলের টুকটাক ঠোকাঠুকি হয়। আলিঙ্গনও হয় উষ্ণতার। শুভ প্রশ্রয় দেয়না নিজের অনুভবকে। কিন্তু আলিশা গোপনে অস্থির হয়ে উঠে। শুভ ‘র বলিষ্ঠ আঙ্গুলের তাপ বয়ে যায় তার কোমল হৃদয়ের সমস্ত অলিগলিতে।

আড়চোখে শুভকে দেখে। চোখে মুখে থাকে দুষ্ট মিষ্ট ভাব। তার মাঝে ফিরে এসেছে আগের ন্যায় অস্থিরতা। যেন চঞ্চল চড়ুই।

আজ আলিশা ধৈর্য হারা হয়ে গিয়েছে। মনে মনে বলল, এটা কোন কথা। রোবট নাকি। ইনিয়ে বিনিয়েতো কতভাবেই বোঝালাম ভালোলাগে। ভালোবাসি। প্রণয় অনুভব করি। কিন্তু নিজের থেকে কোন রেসপন্স দিচ্ছেনা কেন। মন চায় হাতুড়ি দিয়ে তার মাথা ফাটিয়ে দিই। অংকের করা শেষ হলে নিচে দিয়ে আলিশা লিখল,

স্যার আপনার প্রিয় দুইটি যেকোন বাংলা গানের কলি লিখেনতো।

শুভ মুখে বলল , এমন করলে তুমি অংকে খারাপ করবে। স্টপ ইট আলিশা।

আলিশা গোমড়া মুখে গাল ফুলিয়ে উত্তর দিল, ভুল স্যার ভুল। এসব দুষ্টমি করতে পারলেই আমার অংকের রেজাল্ট ও ভালো হবে। আমিও ভালো থাকব খুব।
মন ভালো না থাকলে কোন কিছুতেই মন বসানো যায়না। যে যেভাবে ভালো থাকতে চায়, তাকে সেভাবেই থাকতে দেওয়া মানুষ হিসেবে আপনার নৈতিক দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।

শুভ কি আর করবে। সায়সারা হয়ে খাতা টেনে নিজের সামনে আনল। লিখল,
১/ ” অলির ও কথা শুনে বকুল হাসে… কই তাহার মতো তুমি আমার কথা শুনে হাসোনাতো।”

২/” ভালোবেসে সখী নিভৃতে যতনে
আমার নামটি লিখো..তোমার
মনের মন্দিরে।
আমার পরানে যে গান বাজিছে
তাহার তালটি শিখো– তোমার
চরণও মঞ্জীরে..।
ধরিয়া রাখিয়ো সোহাগে আদরে
আমার মুখর পাখি– তোমার
প্রাসাদপ্রাঙ্গণে।
……
আমার মনের মোহের মাধুরী
মাখিয়া রাখিয়া দিয়ো– তোমার অঙ্গসৌরভে।”

খাতাটি আলিশার দিলে ঠেলে দিয়েই শুভ উঠে চলে গেল। আলিশা কিছু বলতে গিয়েও বলতে পারলনা।

মাঝ রাতে শুভ’র ফোনে মেসেজ এলো।
শুভ মেসেজ পড়ল,
“স্যার অজস্র ধন্যবাদ। এত চমৎকার গান শেয়ার করার জন্য। আমার ও ভীষণ প্রিয় এ দুটো গান। পনেরোবার করে ত্রিশবার শুনা হয়ে গিয়েছে স্যার। তবুও এ ভালোলাগা ফুরাবার নয়। আশ্চর্যের বিষয় হলো কি স্যার জানেন। আমার দুচোখে গড়িয়ে বিরতিহীনভাবে অশ্রুরা গড়িয়ে পড়ছে।
আমার কল্পলোকে কেবলই মনে হচ্ছে কোন এক নির্জনতার রাত্রিতে কুঞ্জ ছায়ায় বসে আপনিই আমাকে এই গান দুটো গেয়ে শোনাচ্ছেন। আরও অনেক কিছুই মনে হচ্ছে স্যার। তবে বলা যাবেনা। বাই। আমাদের দেখা হবে। আপনার অনুরাগী আলিশা। ”

নির্জন নিশুতি রাত। ধরনীর বুকে জেগে আছে কত জোড়া জোড়া নিদ্রাবিহীন আঁখি। কত রঙিন স্বপ্নে বিভোর সেই আঁখিগুলো। তন্দ্রাঘোরে ডুবেও তারা সুখবোধ করে সেই স্বপ্নের মায়াজালে আটকে গিয়ে।

শুভ নামের একটি যুবকের মুঠোফোনে বার্তা হয়ে এলো আলিশা নামের এক অষ্টাদশী তরুণীর অব্যক্ত প্রণয়গাঁথা। যুবক মন খানিক পুলকিত ও রোমাঞ্চিত অনুভব করা অবাঞ্চনীয় নয়। বরং এটাই যুক্তিসংগত। শুভ’র মনজমিনে উল্কার মতো খসে পড়ল আলিশা নামের মেয়েটি। এই প্রথম অসীম ভালোলাগা কাজ করলো তার প্রতি। এই প্রথম তাকে নিয়ে অতল ভাবনায় ডুব দিলো শুভ। ঠিক করলো তবে বুঝতে দেওয়া যাবেনা। প্রশ্রয় দেয়াও যাবেনা আলিশাকে। নয়তো পরিক্ষা খারাপ হতে পারে।

শুভ পড়াতে এলে আয়মানের মা তার সামনে এলো দেখা করতে । আলিশার পড়াশোনার বিষয়ে জিজ্ঞেস করলে বলল,
আন্টি ও মনে হয় মাঝে মাঝে অমনোযোগী হয়ে যায়।

তুমি একটু বাকি বিষয়গুলোর ব্যাপারে ওর থেকে খোঁজ খবর নিও বাবা। তার পর আয়মানের বিয়ের কার্ড দিয়ে দাওয়াত দিল। বলল গায়ে হলুদেও এসো । তোমার এলাকার মেয়ের বিয়ে কিন্তু।

আন্টি অবশ্যই আসব। একদম মিস হবেনা।

শুভ যে পিয়াসাকে বিয়ে করতে উম্মুখ ছিল। এটা আলিশা ও তার মা জানেনা। কিছু কিছু বিষয় সবার জানাটা গুরুত্বপূর্ণ নয়। বরং জেনে গেলে পরবর্তী জীবনে তা হিতে বিপরীত কিছু ঘটার সম্ভাবনা প্রবল থাকে।

আয়মানের মা চলে গেলে আলিশা আহ্লাদী স্বরে জিজ্ঞেস করল,
আমি কোন বিষয়ে অমনোযোগী? আপনি যে আম্মুর কাছে নালিশ দিলেন আমার নামে?

তুমি একটা বিষয় ছাড়া আর দ্বিতীয় কোন বিষয়ে মনোযোগী একবার বলতো? সিরিয়াস মুডে জিজ্ঞেস করলো শুভ।

আমি কোন বিষয়ে মনোযোগী?

তা তুমিই আমার চেয়ে ভালো জানো।
নাহ! যেহেতু আপনি বলছেন। তার মানে আপনি ও জানেন আমার এই বিষয়টা। বলেন?

টপিক চেঞ্জ আলিশা অংক করো বলছি।

নাহ করবোনা এটার উত্তর না দিলে । আগে খাতায় লিখে দেন। দেন অংক করছি। অধিকারসুলভ ভঙ্গিতে বলল আলিশা।

এই একরোখা মেয়েকে নিয়ে আর পারা যায়না। শুভ খাতা টেনে লিখল,
তুমি প্রেমের বিষয়ে খুব মনোযোগী।

আলিশা গোপনে কেঁপে উঠলো। লিখল,
কিভাবে মনে হলো স্যার ?

কেন রাতে কার মোবাইলে প্রেমের প্যারাগ্রাফ দিয়েছ জাননা?

আলিশা ভীষণ লজ্জা পেয়ে গেল। স্যার সরাসরি এভাবে বলতে পারলো। হঠাৎ করে বাসায় বিদ্যুৎ চলে গেল অন্ধকার হয়ে গেল। আলিশা উঠে যাচ্ছে চার্জের লাইট আনতে। চেয়ারের সাথে ধাক্কা খেয়ে পড়ে যেতে লাগলে শুভ আলিশার কোমরে হাত দিয়ে শক্ত করে ধরে ফেলে। আলিশা হাত ছাড়িয়ে সরে যায়। শুভও অস্বস্তিবোধ করে চেয়ার ছেড়ে উঠে চলে যায়।

আজ পিয়াসার গায়ে হলুদ। বাসা জুড়ে সাজ সাজ রব। নিকটস্থ আত্মীয়দের উপস্থিতি পুরো বাসাকে মুখরিত করে তুলেছে। ডাইনিং টেবিল সরিয়ে গায়ে হলুদের স্টেজ করা হয়েছে। আয়োজন চলছে ঘরোয়াভাবে৷

আলিশা ঠিক করেছে আজ শুভ স্যারকে সরাসরি বলবে
‘ ভালবাসি স্যার ‘ আপনার জন্য সাজিয়েছি প্রণয়ের জলসাঘর। আপনার মতো কারো জন্য অপেক্ষার সীমানায় দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুনব অনন্তকাল। যে কালের কোন শেষ নেই। কিন্তু সময় গড়িয়ে যাচ্ছে। শুভ স্যার কেন এখনো আসছেনা।

চলবেঃ১৬

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ১৭ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
‘ ভালবাসি স্যার ‘ আপনার জন্য সাজিয়েছি আমার ছোট্ট হৃদয়ের চিলেকোঠায় প্রণয়ের জলসাঘর। আপনার মতো কারো জন্য অপেক্ষার সীমানায় দাঁড়িয়ে প্রতিক্ষার প্রহর গুনব অনন্তকাল। যে কালের কোন শেষ নেই। কিন্তু সময় গড়িয়ে যাচ্ছে শুভ স্যার কেন এখনো আসছেনা।

আলিশার মন খারাপ হতে লাগল ক্রমশ। বারবার শুভকে কল দিয়েও পাচ্ছেনা। সুইচড অফ। মেসেজ দিল। বাট নো রিপ্লাই। বাথরুমে ঢুকে আলিশা লুকিয়ে কাঁদল। সে কিন্তু কাঁদতে চায়নি। কিন্তু কেন যে চোখ ভিজে ভরা বর্ষার মতো টইটুম্বুর হয়ে গেল। তাহলে কি সে আসলেই অনেক বেশী ভালোবেসে ফেলছে শুভ স্যারকে। হ্যাঁ তাইতো দেখতে পাচ্ছে।

গায়ে হলুদের প্রায় মাঝামাঝির দিকে কলিংবেল বেজে উঠলো। শুভ এলো। আলিশা খুশীতে পাগল পাগল দশা।

নাও তোমার জন্য এটা।

আলিশা হাত বাড়িয়ে গোলাপগুচ্ছটি ধরলো। খুশীতে টগবগিয়ে উঠল সে। আগে বলেন লেট হলো কেন?
ইচ্ছে করেই। মুচকি হেসে জবাব দিল শুভ।

অনেক ধন্যবাদ স্যার। এটা কেমন কথা হলো। ইচ্ছে করেই। গাল ফুলিয়ে জিজ্ঞেস করলো আলিশা।

আরেহ নাহ। ফুলের তোড়া দুটো রেডি করতেই দোকানে লেট হলো । লম্বা সিরিয়াল। আলিশার দিকে চেয়ে মৃদু হেসে বলল শুভ। তোমাকে দূর বনের মায়াবিনীর মতো লাগছে।

পিয়াসার অন্তর নেচে উঠল পেখম তোলা ময়ুরের মতো। বলল,আপনাকেও পাঞ্জাবীতে দারুণ লাগছে ৷
ধন্যবাদ আলিশা।
ফুল ওগুলো আপুর জন্য?

হ্যাঁ। ওর জন্য নিতে গিয়েই ভাবলাম তোমার জন্যও নিই । বলেই শুভ পিয়াসার সামনে গিয়ে রজনীগন্ধা ফুলের ফুলের তোড়াটি এগিয়ে ধরলো। কংগ্রাচুলেশন পিয়াসা৷

পিয়াসা ফুল হাতে নিয়ে হাসিমুখে ধন্যবাদ জানালো শুভকে। আয়মান পাশাপাশি বসা ছিল তার গায়ে হলুদের স্টেজে। বাঁকা চোখে দেখল পিয়াসাকে। বিশেষ খুশী হলোনা পিয়াসা খুশী হলো বলে। ওর মন চাচ্ছে ঠিক সেদিনের মতো এই ফুলগুলোকে পায়ের নিচে ফেলে দুমড়েমুচড়ে দিতে। কিন্তু তা এখন সম্ভব নয়।
মনে মনে বলল, আগে আমার হও একবার। তখন ফুল কেন গাছের পাতাও কেউ তোমাকে দিতে পারবেনা। এখন হজম করি নিলাম কাশির সিরাপের মতো। আয়মানকে সবাই হলুদ দেয়া শেষ করলে সে উঠে চলে গেল। পিয়াসা উদাস চোখে বসে রইলো গায়ের হলুদের স্টেজে ।

রায়হান উপস্থিত নেই আজ। সে শিক্ষকতার পেশা ছেড়ে দিয়ে দেশের বাইরে চলে গিয়েছে। পিয়াসার রায়হান স্যারের কথা মনে হলো। বাবার কথা মনে হলো। স্কুল কলেজের গ্লু বাহিনী নামের বন্ধুদের কথা মনে হলো। ভার্সিটিতে গিয়ে একেকজন একেকদিকে ছিটকে গিয়েছে। তারা কাছে থাকলে এখন খুব ভালো লাগতো পিয়াসার।

এই বুঝি জীবন। এই বুঝি জীবন নামক খেলা ঘর। এই ভালো এই মন্দ। এই হাসি এই কান্না। এই প্রণয় এই বিষাদ। এই মিলন এই বিরহ।

নিজের জীবনের ভগ্নদশা অতীতের কথা মনে হলো তার । দুই আঁখিকোন ভিজে উঠলো। আয়মানের মা হলুদ দেয়া শেষে পিয়াসার চোখের কোন নিজের শাড়ির আঁচল দিয়ে মুছে দিল।

বলল, এ অশ্রুর ভাষা আমি বুঝি মা। ভাগ্যের উপরে কারো হাত নেই। এখন বিয়ের সময়। এমন মনমরা হয়ে থেকনা। একটু হাসিখুশি থাকার চেষ্টা করো।
গায়ে হলুদের সামনের চেয়ার গুলোতে বসে গানের কলি খেলছে আলিশার কাজিনেরা । সেখানে যোগ দিল আলিশা ও শুভ।

আলিশা বলল, এই গান কি শুধু বাংলায় হবে? নাকি মিক্স ?

কেউ বলল বাংলা গান। কেউ সজোরে বাধা দিল। বলল না মিক্স।

শুভ গলা তুলে জিজ্ঞেস করলো, আচ্ছা গান কি বিয়ের গান হতে হবে? নাকি যে কোন রকম হলেই হবে?

আপনি চাইলে বিরহের গান ও গাইতে পারেন। কিটকিটিয়ে হেসে বলল আলিশার এক ভাবি।

যার যা ইচ্ছে বলল কেউ একজন।

সুখ সুখ গলায় বলল আলিশা। ওক্কে গাইস। শুরু হউক গায়ে হলুদের অন্যতম আকর্ষণীয় পর্ব গানের কলি খেলা। যে বর্ণে গিয়ে গান শেষ হবে। ঠিক সেই বর্ণ বা আদ্যাক্ষর দিয়েই পরেরজন পরবর্তী গান গাইবে।

শুভ লুকিয়ে লুকিয়ে নেশাতুর চাহনিতে আলিশাকে দেখছে। চোখের কোণে দুষ্টময় হাসি খেলে যাচ্ছে ৷
এভাবে শাড়ি পরা আর কখনোই দেখেনি আলিশাকে । শাড়িতে মেয়েদের এত আবেদনময়ী লাগে এই প্রথম শুভ উপলব্ধি করতে পারলো। আলিশা ও আড়চোখে শুভকে দেখছে। ইসসস! কি রোমান্টিক প্রেমিক পুরুষ লাগছে আমার শুভ স্যারটাকে।
আচ্ছা স্যার জানে আমি তাকে পছন্দ করি। কিন্তু তবুও সে কেন আমাকে ভালোবাসতেছেনা। আমি কি দেখতে কিছুতেই কম নাকি। আগে একবার পটাই ভালো করে। পরে মজা দেখাব। আনমনা হয়ে গেল আলিশা। শুভ’র সাথে চোখাচোখি হতেই লজ্জায় লাল হয়ে গেল। অন্যকিছু দেখার বাহানায় ঘাড় ঘুরিয়ে অন্যদিকে চাইলো।

গান শুরু করলো আলিশার মামাতো বোন,
” যদি বউ সাজোগো… তবে সুন্দর লাগবেগো…
বলো.. বলো..আরো বলো.. ”

‘ ল ‘ দিয়ে শুরু করতে হবে এনি ওয়ান। বলল আলিশার খালাতো বোন মিতু।

‘” লে যায়েঙ্গে লে যায়েঙ্গে , দিলওয়ালে দুলহানিয়া লে যায়েঙ্গে।”
গানটি গাইলো শুভ। সবাই পুলকিত চোখে শুভ’র দিকে চেয়ে বলল,
এই ভাইয়া আপনিতো ভালোই গান দেখি।

শুভ হেসে বলল। শুকরিয়া শুকরিয়া। আপকা বহত বড়া শুকরিয়া

এবার ‘ গ ‘ দিয়ে কে বলবে?

” গভীর রাতে জেগে খুঁজি তোমারে।
দূর গগনে প্রিয় তিমির-পারে
গভীর রাতে জেগে খুঁজি তোমারে।

জেগে যবে দেখি হায় তুমি নাই কাছে।
আঙিনায় ফোঁটা ফুল ঝরে পড়ে আছে।
আহত এ মম তব লুটায়ে লুটায়ে কাঁদে আঁধারে। ”

ওমা কি জটিল গাইলে আলিশা। কবে থেকে প্রণয় সঙ্গীতের চর্চা করিস তুই? চাচাতো ভাই রিমন জিজ্ঞেস করল চোখ বড় বড় করে।
আলিশা চোখের ইশারায় ধমক দিয়ে থামালো তাকে।

এবার র বা এ দিয়ে শুরু হোক।
শুভ একটু ঘুরে বসল আলিশার দিকে। মুখোমুখি চেয়ে গাইলো,
” এই ভালোবাসা তোমাকেই পেতে চায়।
ওই দুটি চোখ যেন কিছু বলে যায়।
কবে তুমি নাম ধরে ডাকবে?
কবে তুমি হাতে হাত রাখবে? ”

সবার হাততালিতে মুখরিত হলো আয়মান পিয়াসার হলুদ সন্ধ্যা। আলিশা বিমোহিত শুভ স্যারের মুখে এমন প্রণয়মাখা রোমান্টিক গান শুনে। তার খুব ইচ্ছে করছে শুভ’র হাতে একটু হাত রাখতে।

অনুষ্ঠান শেষ হয়ে গেল। সবাই একসাথে ডিনার করলো। বিফ তেহারি ছিল আয়োজনে। আলিশা ঘুরেফিরে শুভ’র কাছাকাছি যাচ্ছে একটু সান্নিধ্য পাওয়ার জন্য। শুভ তা বুঝে মিটমিট করে হাসছে। চলে যাওয়ার সময় আলিশা সিঁড়িতে নেমে স্যার বলে ডাকল।
শুভ মুখ তুলে, কিই বল?
কিছু বললেন না যে?

শুভ বিষম খাওয়ার ভান করলো অনুধাবন করতে পেরেও। বলল ও হ্যাঁ। তেহারিটা দারুণ টেস্টি হয়েছে। বাবুর্চিকে অসংখ্য ধন্যবাদ। আর রসগোল্লাটাও বেশ তুলতুলে ছিল।

আলিশা অনিমেষ চেয়ে রইলো শুভর পানে।
শুভ আলিশার বাম গালে তার চার আঙুলের পিঠের আদুরে ছোঁয়া বুলিয়ে দিয়ে নেমে গেল সিঁড়ি ভেঙ্গে। শুভ’র চলে যাওয়ার পিছন দিয়ে আলিশা মনে মনে বলল পঁচা শামুক তুমি।

আজ পিয়াসার বিয়ে। চোখ ধাঁধানো হরেক রকম বাতি দিয়ে সাজানো হয়েছে বাড়ির উপর থেকে নিচ পর্যন্ত। বিয়ে হয়েছে পাশের
‘ বধু বরণ ‘ কমিউনিটি সেন্টারে। সাধ্যের ভিতরে সাজ সজ্জার কমতি রাখেনি আয়মান ও তার মা। পিয়াসা যেন নিজের বিয়ে নিয়ে কোন আক্ষেপ না থাকে। যদিও কিছু ধারদেনা করতে হয়েছে তাদের।

বিয়ের আনন্দ জীবনে একবারই আসে। তাই সেভাবেই সবকিছুর ব্যবস্থা করা হয়েছে। ছবি তোলা, ফটোগ্রাফার দিয়ে ভিডিও করা কিছুই বাকি থাকেনি। পিয়াসাকে ব্যয়বহুল বিউটি পার্লার থেকে গায়ে হলুদের মত করেই বউর সাজে সাজানো হয়েছে। দুই হাত ভর্তি মেহেদীর আলপনা আঁকা হয়েছে। পরানো হয়েছে লাল টুকটুক রক্ত জবার মতো কাতান শাড়ি। বাসর ঘর সাজানো হয়েছে মনোরম করে।

আয়মান অন্যদিকে কাজ নিয়ে ব্যস্ত। পিয়াসাকে আলিশা ও তার কাজিনেরা মিলে আয়মানের রুমে বাসর ঘরে নিয়ে বসালো। তার আগে পিয়াসা বাসায় ঢুকেই শ্বাশুড়ির পা ধরে সালাম দিল। তিনি পিয়াসাকে বুকে জড়িয়ে নিলেন। ভেজা গলায় বললেন, আজ যদি তিনি বেঁচে থাকতেন কত খুশী হতেন তোমার মতো মেয়েকে পুত্রবধূ হিসেবে পেয়ে ৷ পিয়াসাকে মিষ্টি মুখ করালেন। পিয়াসা ও শ্বাশুড়িকে মিষ্টি খাওয়ালো। ননদ আলিশাকে ও খাওয়ালো।

তারা চলে গেল দরজা চাপিয়ে দিয়ে। পিয়াসা সীমাহীন লজ্জায় শেষ হয়ে যাচ্ছে। বুকের ধুকপুকানি ক্রমাগত বেড়েই যাচ্ছে। আয়মানের ও কেমন যেন লাগছে। এদিক ওদিক ঘুরছে রুমে ঢুকছেনা। তা দেখে তার কাজিন আর ভাবিরা মিলে তাকে রুমের ভিতরে ঠেলে দিল।

আয়মান দরজা বন্ধ করে দিল ভিতর থেকে । গলা খাঁকারি দিয়ে বিছানার একপাশে গিয়ে বসল। পিয়াসা কিছুই বলছেনা। চুপটি হয়ে বসে আছে ঘোমটার ভিতরে। আয়মান পিয়াসার হাতের পিঠে উষ্ণ চুমু খেল। বলল, অনেক ভালোবাসি প্রণয়ীনি ।

সে চাচ্ছে পিয়াসাও বলুক অনেক ভালোবাসি। কিন্ত পিয়াসা কিছুই বলছেনা। আয়মান বলল, কিছু একটা বল।

পিয়াসার বুকের ভিতর টিপটিপ করছে৷ তার অনুভূতি কেমন যেন উড়ুউড়ু হয়ে গেল। ঠিক বুঝতেছেনা। তবুও ছোট্ট করে মিষ্টি গলায় বলল,
একটা ধাঁধা বলব। উত্তর দেন পারলে ” চারদিকে কাঁটা বেত। মাথায় মুকুট। খান সাহেবের নাম কি? ”

আয়মান ফিক করে হেসে ফেলল। বাসর করে আর কথা খুঁজে পেলেনা তুমি? আমি শুনছি বাসর ঘরে স্বামী স্ত্রীর গল্প ফুরোয়না। কিন্তু রাত ফুরিয়ে যায়। আর তুমি কি হাবিজাবি ধাঁধা নিয়ে আসছ। ফাজিল কোথাকার।

নাচতে না জানলে উঠান বাঁকা। পারেন না সেটা বলেন।

পারিনা নাহ? বলে আয়মান পিয়াসার হাত ধরে উল্টো দিকে মোচড় দেওয়ার মতো করে জিজ্ঞেস করলো,
আগে বল সেদিন বইয়ের ভিতরে পাওয়া চিরকুটে ডুবে ডুবে ভালোবাসি কার উদ্দেশ্য নিয়ে লিখছ?

আহ লাগছেতো। ধাঁধা পারেন না?
না পারার কি। এটা কাঁঠাল। এবার বল।

জানিনা।
বল। নইলে ব্যথা দিব এভাবে।
আপনার জন্য লিখছি।

ইয়েহ! বলে আয়মান খুশীতে আত্মহারা হয়ে উঠলো। খুশীর ফল্গুধারার ভেসে যাচ্ছে তাদের দুজনের দুটি হৃদয়। পিয়াসার মুখের দুপাশে তার দুহাত দিয়ে চেপে ধরলো। মোহাচ্ছন্ন দৃষ্টিতে ঠায় চেয়ে রইলো পিয়াসার দিকে। নড়োনা তুমি প্লিজ। মন ভরে দেখতে দাও আমার প্রণয়ের জলসাঘরের মধুবালাটাকে । লেখিকা রেহানা পুতুল এর সাথেই যুক্ত হোন দারুণ স্বাদের সব গল্প পেতে।

আয়মান পিয়াসার কোলে মাথা রাখল। পিয়াসা মাথায় হাত বোলাতে লাগল। এক অপার্থিব ভালোলাগায় আয়মানের আঁখিপল্লব বুঁজে এলো।

পিয়াসা বলল। নিজে ঘুমালে হবে? আমি ঘুমাবনা?

আয়মান শাড়ির উপর দিয়ে পিয়াসার পেটের উপর নাকমুখ ঘষতে ঘষতে বলল,
কিসের ঘুম? এতদিন ঘুমাওনি? আজ তোমার মাঝে গচ্ছিত থাকা সব নতুনের খুশবু নিব আমি। নিঃশ্বাস ভরে প্রাণ উজাড় করে। তুমি শুধুই আমার। একান্তই আমার। তোমার সমস্তটা আমি দখল করবো বীরদর্পে।

” ফুলের বনে দারুন খরা, চাই অনেক বৃষ্টি।
শুদ্ধ জলে চাই ভিজাতে কামনারই দৃষ্টি। ”

পিয়াসা আপ্লুত স্বরে জানতে চাইলো আয়মানের কাছে ,
এত প্রেম , এত অনুরাগ, এত নিবেদন,এত আরাধনা, হৃদয় কুঠিরে পুঞ্জীভূত রেখে এতদিন কিভাবে ছিলেন আপনি ?

চলবে ঃ ১৭