প্রণয়ের জলসাঘরে পর্ব-৮+৯

0
452

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ৮ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
নাহ স্যার। এসব আমার জন্য বিলাসিতা ছাড়া আর কিছুই নয়।
নিজের অজান্তেই আয়মানের হৃদয়াকাশে একদল সুখ পাখি চঞ্চল কলরবে মেতে উঠলো।
আচ্ছা এখন যাও। ঘুমাও। সুইট ড্রিম।

পিয়াসা চলে গেল। আয়মান তার ডায়রিয়া টেনে বের করল।
এই একলা রাতের সংগী তার ডায়েরিটাই। কলমের ছিপি খুলল। গালে হাত দিয়ে দেয়ালে সেঁটে থাকা মোনালিসার চিত্রকর্মটির দিকে চাইলো। পরখ করে দেখছে মোনালিসার সেই রহস্যময় হাসি।

ভাবুক মনে লিখলো,
” আমার খুব ইচ্ছে করছে এই রাতে ডাকাত হতে। তোমাকে লুটপাট করতে। কিন্তু আমি গর্দভ মনে হয় জীবনে চোর ও হতে পারবনা। লুকিয়ে যে কিছু নেওয়ার চেষ্টা করবো, সেই সামর্থ্যটুকু ও আমার নেই। আচ্ছা ছিঁচকে চোর হওয়ারও তো চেষ্টা করতে পারি। টুকটাক কিছু যদি কপালে মেলে। অন্তত তা দিয়েও বেশ কিছুদিন পার করা যাবে। এও কি আমার দ্বারা সম্ভব।

যদি তা নাই হয় তাহলে এমন লাগছে কেন আমার। এমনতো ছিলাম না আমি। একটা অজানা অচেনা অনুভূতি ক্রমশ আমার ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠছে কেন। আমাকে ঘোরে ফেলে দিচ্ছে কেন সেই স্পর্শ পাওয়ার পর হতেই। এত শিহরিত হচ্ছে কেন অন্তরটা আমার। কার জন্য। কিসের জন্য। যেন বুঝেও বুঝিনা আমি।”

ডায়েরিটা রেখে দিল আয়মান। পিয়াসার কানের দুল জোড়া বের করে নেড়েচেড়ে দেখল। দুলের উপর চুমু খেয়ে বলল,তোমার মালিক জানেনা তুমি আমার কবজায় বন্ধী। তোমার মুক্তি ঠিক সেদিন মিলবে। যেদিন তোমার মালিক আমার বাহুডোরে বন্ধী হবে। যদিও এটা কখনই হবেনা। তা নিশ্চিত। তবুও দুরাশার মাঝে ক্ষীণ আশা করতে মানা আছে নাকি। আবেগকে যে নিয়ন্ত্রণ করার কোন যন্ত্র নেই পৃথিবীতে।

সপ্তাহ ধরে রায়হানের কোন খোঁজ খবর না পেয়ে আয়মান ফোন দিল তাকে। কিরে বাসায় আসিসনা কেন? কলেজেও ক্লাস নিতে যাচ্ছিস না। কি সমস্যা?

রায়হান চুপ থেকে মনমরা কন্ঠে বলল, মন খুব খারাপরে আয়মান।

কি হয়েছে শেয়ার কর?

পিয়াসার ডিটেইলস শুনে বাসার কেউই রাজী নয় এই বিয়েতে। মা আমার জন্য নাকি বহু আগেই তার ফুফাতো বোনের মেয়ে রিক্তাকে ঠিক করে রেখেছে। তারাও সবাই রাজি। রিক্তাও। কিন্তু আমার যে পিয়াসা মেয়েটাকেই খুব ভালোলাগে। কি করব বা কি করা উচিত জানিনা। পরিবারের এতজনকে বাদ দিয়ে একজনকে নিয়েও কি সুখে থাকা যায় লাইফে।

আয়মান বলল, আমিতো পিয়াসার সাথেও কথা বলেছি। সেওতো তোকে পছন্দ করে খুব। বাট একজন মানুষ হিসেবে। স্যার হিসেবে। নো ফ্রেন্ড। নো বয়ফ্রেন্ড। নো হবু হাজব্যান্ড।

তবুও হাল ছাড়ছিনারে। শেষ চেষ্টা করে দেখব দুই সাইডেই। বেদনার্ত সুরে বলল রায়হান।

আচ্ছা হার্ডলি ট্রাই কর দোস্ত। বলল আয়মান।
_______

শুন, আলিশা কয়েকদিন ধরেই বায়না ধরেছে এই শীতে গ্রামে যাবে। আর ওরতো এখন পড়ার চাপ নেই। মাত্রই কলেজে ভর্তি হলো। তাহলে তুইও কলেজ থেকে ছুটি নে সময় করে। সপ্তাহ বেড়িয়েই চলে আসব। একদিন বিকেলে কথাগুলো আয়মানকে বলল তার মা। শুনে আয়মান একটু ভেবেই রাজী হয়ে গেল। পরক্ষণেই বলল পিয়াসাও যাবে নাকি মা?

কপাল ভাঁজ করে তার মা বলল,তুই আসলেই একটা বলদ ছেলে আমার। একা বাসায় একটা জোয়ান মেয়েকে রেখে যাব নাকি। পিয়াসাও যাবে আমাদের সাথে। পাশে থেকে আলিশা ধেই ধেই করে নেচে উঠলো। টেবিল চাপড়ে বলল আমার প্রস্তাব হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে। হ্যাঁ জয়যুক্ত হয়েছে। খেজুরের রসের পায়েস আর ক্ষীর খাওয়া এবার মিস হবেনা। দৌড়ে রুম থেকে বেরিয়ে গেল আলিশা। পরক্ষণেই পিয়াসার হাত ধরে টেনে নিয়ে এলো আয়মান ও তার মায়ের সামনে।

এই যে পিয়াপুকেও নিয়ে আসলাম। আয়মান চোরাচোখে পিয়াসাকে দেখল। তার মা পিয়াসার দিকে চেয়ে, হাওয়া বদল হলে তোমার ও মন মেজাজ ফ্রেস হবে মা। নিয়তির উপর কারো হাত নেই। এতদিন হয়ে গেল। আজো তুমি বেজার হয়ে থাক। মুখে হাসি ফোটার নামমাত্র নেই।

আয়মানকে উদ্দেশ্য করে তিনি বললেন, আমার আছে এক বুড়া ছেলে। বাসাতেও স্যার স্যার ভাব নিয়া থাকস। আর পিয়াসা তো এখন আর তোর কলেজেও নেই। একটু গল্প গুজব করবি মেয়েটার সাথে। রায়হান ও তো এই কয়দিন আসছেনা। তোদের মতিগতি বুঝিনা বাপু।

আয়মান বিব্রতবোধ করলো। মা এসব কি বলছ আজেবাজে কথা?

হারামজাদা কিসের আজেবাজে বলছি আমি। বলে তার মা চোখ রাঙাতেই পিয়াসা ফিক করে হেসে ফেলল।

তা দেখে আয়মান বলল,দেখলে তোমার কথা শুনে ও হেসে ফেলল আমাকে নিয়ে।

বেশ করেছে। এই পিয়াসা জামাকাপড় ইস্ত্রি করা লাগলে করে নিও। ও ছুটি নিলেই আমরা যাব গ্রামে।

আন্টি আমি যাবনা। আপনারা যান। আমি সেই মিনা আন্টির বাসায় গিয়ে থাকব। আপনারা আসলে আবার চলে আসব।

আজব মেয়েতো তুমি। যাবেনা কেন? কারণ কি?

পিয়াসা দোনোমোনো করাতে তিনি কিছু বুঝে চুপ রইলেন। পরে সুযোগ বুঝে ছেলেমেয়েকে বললেন, ওর ভালো জামাকাপড় নেই বলেই যেতে যাচ্ছেনা। আমি বুঝতে পেরেছি। তোরা তোদের কথা বলে তাকে নিয়ে শপিং এ যাবি। পরে কয়টা ড্রেস কিনে দিস।

আয়মান, তাই হবে বলে মায়ের কথার সম্মতি জানাল।

দুইদিন পর পিয়াসাকে নিয়ে আয়মান ও আলিশা শপিং এ গেল। যদিও পিয়াসা প্রবল আপত্তি করেছিল যেতে। কিন্তু আলিশা আহ্লাদীপানা করে রাজি করিয়ে নিলো। আয়মান মিউচুয়াল মূল্যের ভিতরে তিনটা রেডিমেড থ্রিপিস কিনে দিল পিয়াসাকে। এর মধ্যে একটা পিয়াসার পছন্দের। একটা আলিশার পছন্দের। আয়মান পছন্দ করে দিল আকাশি রঙের একটা ড্রেস। আকাশি রঙ তার প্রিয় ছোটবেলা থেকে।

আজ পিয়াসার মন কিছুটা ভালো। জীবনে এই প্রথম একসাথে নতুন তিনটা ড্রেস চোখে দেখল। সন্ধ্যার পরে পিয়াসা নিজ থেকেই বলল, আন্টি রোজ আপনি বানান চা। আজ আমি বানাই। আমাদের বাসায় আব্বু সবসময় আমার হাতের চা পছন্দ করতো।

ওমা। তাই নাকি। তাহলে বানাও দেখি। আয়মান ও বাসায় আছে। তার জন্যও বানিও।

আচ্ছা আন্টি। ঝটপট নিয়ে আসছি গরম গরম ধোঁয়া উঠা চা। আলতো হেসে চা বানাতে রান্নাঘরে চলে গেল পিয়াসা।

চা নিয়ে এসে ড্রয়িংরুমে দিলো আলিশা ও তার মাকে। জিজ্ঞেস করলো, আন্টি স্যারের চা কে নিয়ে যাবে?

এই মেয়ে বাসায় কিসের স্যার? ভাইয়া বল।

নাহ আন্টি। স্যার বলেই অভ্যেস তো। মুখ দিয়ে অন্যকিছু আসতে সময় লাগবে।

পাশ থেকে আলিশা বলল,চা তুমিই দিয়ে আস। আমি সিরিজ দেখছি। ক্লাইমেক্স এসে গিয়েছে। মিস করা যাবেনা।

আচ্ছা বলে পিয়াসা চা নিয়ে গেল আয়মানের রুমে। সে পিসিতে কাজ করছে। পিয়াসা দরজায় দাঁড়িয়েই স্যার আসতে পারি বলে অনুমতি চাইলো।

আয়মান ব্যস্ততার জন্য পিয়াসার দিকে না তাকিয়েই বলল, আসো ।

পিয়াসা তার পিছনে চা নিয়ে মাত্রই দাঁড়িয়েছে। আয়মান তার একহাত আলসেমি ভঙ্গিতে পিছনে আনতেই পিয়াসার হাতে লাগল। চায়ের কাপ কেঁপে কিছুটা গরম চা পিয়াসার বুকে পড়ে গেল। সে উহু মা বলে কুঁকিয়ে উঠেই চায়ের কাপ টেবিলে রাখল। আয়মান চট করেই উঠেই দাঁড়িয়ে গেল।

প্রচন্ড বিচলিত হয়ে,
ওহ সিট! সিট! খুব খুব স্যরি। তোমার হাতে চা জানতামনা।

পিয়াসা দ্রুত বের হয়ে যাচ্ছে,অমনি আয়মান তার হাত ধরে বেসিনে নিয়ে গেল। চোখ মুখ খিঁচে পিয়াসার বুকে জামার উপরে হাত দিয়ে পানি মেরে দিল দূরত্ব বজায় রেখে। ওড়না জামা অনেকখানি ভিজে গিয়েছে। পিয়াসা পা চালিয়ে বের হয়ে গেল। অন্য ওয়াশরুমে গিয়ে ভেজা জামা ওড়না চেঞ্জ করল। আয়মান চা শেষ করেই একটা মলম নিয়ে আলিশার রুমে গেল।

ওড়না খাটের উপর রেখে পিয়াসা ঠোঁট নামিয়ে বুকে ফুঁ দিচ্ছে। জামার গলা নামানো। আবার বরফের টুকরো ও ঢলছে। উহু আহ করছে। বুকের খোলা অংশে আয়মান লুকানো দৃষ্টি নিক্ষেপ করল। উদ্দেশ্য চা বুকের কতটুকু স্থানে পড়েছে বুঝতে পারা। জামার উপরে খোলা অংশ যতটুকু দেখা যাচ্ছে,
তাতে দেখলো পিয়াসার ধবধবে বুকটা টকটকে লাল হয়ে আছে রক্ত গোলাপের মতন। বরফ পানিতে জামা ভিজে লেপ্টে আছে বুকের ফুটন্ত কোমল দুটি ফুলের উপর। আয়মান মলম টা পিয়াসার হাতে দিল। প্রেমময় চাহনিতে বলল, ধরো এটা বেশী করে লাগাবে। পিয়াসা বিছানার উপর থেকে ওড়না টেনে নিতেই আয়মান ওড়না চাপ দিয়ে ধরল। বলল, আমি চলে যাচ্ছিতো। আয়মান চলে গেল নিজের রুমে। অনুতাপের অনলে পুড়ছে তার অন্তরখানি। গোপনে বলল, শুরু থেকেই চাচ্ছি কি আর হচ্ছে কি।

আয়মানের মা ও আলিশা এসে পিয়াসার বুক দেখে আয়মানকে বকল। আয়মান তা গায়েও মাখলনা। বরং তার কেমন পুলক পুলক লাগছে।

পরে সবাই পিয়াসার চায়ের খুব প্রশংসা করলো। আয়মান ও বলল,রোজ আমরা পিয়াসার হাতের গরম গরম চা খাব। পিয়াসা মিষ্টি হেসে,
আচ্ছা স্যার ঠিকাছে।

পরেরদিন সন্ধ্যায় পিয়াসা আবার চা তৈরি করলো। আয়মানের রুমে ঢুকেই স্যার আসতে পারি? আপনার চা।

আয়মান হোঃহোঃ করে প্রাণখোলা হাসি দিয়ে, আসো। মুখ ঘুরিয়ে পিয়াসাকে দেখল। শুনো বালিকা আমার রুমে আসতে কখনো তোমার অনুমতির প্রয়োজন নেই। মনে থাকবে?

থাকবে স্যার। কিন্তু কেন?

এক সপ্তাহের বেশী কোথাও থাকলে সে আর অতিথি নয়। মুসাফির ও নয়। সে হয়ে যায় পরিবারের একজন। আর পরিবারের মানুষ সবাই সবার অতি প্রিয়জন। প্রিয়জনরা যে কোন সময়েই অনুমতি না নিয়ে প্রবেশ করতে পারে।

তোমার গলাটা দেখি? লালচে ভাবটা গিয়েছে। ভদ্রতার জন্য আয়মান বুক বলতে পারলনা। পিয়াসা লাজুক হেসে জানাল হুম সেরেছে স্যার। দেখতে হবেনা।

আয়মান আর বিশেষ ঘাটালোনা।
চায়ে চুমুক দিয়েই আয়েশী ঢংয়ে বলল,জাস্ট ওয়াও। তোমার হাতের দুধ চা হেব্বি মজা পিয়াসা। এইই রিফিল হবে?

পিয়াসা কিছু না বলে চলে গেল। আরেক কাপ চা নিয়ে এসে আয়মানের সামনে টেবিলে রাখল। আয়মান নিজের কাপ শেষ করে দ্বিতীয় কাপ হাতে নিল।

আচ্ছা তুমি খেয়েছো?
নাহ। পরে খাব।

গরম জিনিসের স্বাদ যত দ্রুত নেওয়া যায় ততই মজা লাগে। যাও খাও।

আমার কাপ আপনাকে দিলাম যে। পিয়াসার মুখ ফুসকেই কথাটি বের হয়ে গেল।

ওহ নো! কি বল। নাও তুমিই খাও।

নাহ স্যার। আপনার মন চেয়েছে আপনিই খাবেন।

মনতো কত কিছুই চায় পিয়াসা।

কিছু বললেন স্যার?

নাহ। আচ্ছা এক কাজ করি শেয়ার করে পান করি আসো।

নাহ স্যার প্লিজ।

আয়মান একরোখা হয়ে বলল,আগে তুমি একটু খেয়ে দিবে, দেন বাকিটুকু আমি খাব। নয়তো না। চা জুড়িয়ে শরবত হোক।

পিয়াসা উপায়ন্তর না দেখে চায়ের কাপে ঠোঁট চুবিয়ে কয়েক চুমুক খেয়ে রাখল। আয়মান নিমিষেই বাকি চা টুকু শেষ করে ফেলল। সুখ নিঃস্বাস ছেড়ে উচ্চারণ করলো ‘ আহ অমৃত। ‘

শুনে পিয়াসা রোমাঞ্চিত অনুভব করার বদলে স্তম্ভিত হয়ে গেল। চোখে মুখে রাশি রাশি অনুযোগ ফুটে উঠলো আয়মানের উপর। তার ভীষণ ইচ্ছে করছে আয়মানের কলার চেপে ধরতে। জিজ্ঞেস করতে,
আজ আমার ঠোঁট চুবানো চা আপনার কাছে অমৃত লাগছে। আর সেদিন সামান্য সহজ সুন্দর তিনটি শব্দ দেখেই রগচটা হয়ে উঠলেন। এমন ভাব নিলেন যেন আপনি তিন মসজিদে খতিব। পাক্কা পরহেজগার মুসল্লী।
এখন তো মনে হচ্ছে আপনিই আমাকে ডুবে ডুবে ভালোবাসেন। হুহু। এবার আমি পাক্কা নারী মুন্সি মাওলানা সাজবো । দেখাব মজা আপনাকে। আগে শিউর হই আপনার বিষয়টা।

গটগট পায়ে পিয়াসা চলে গেল। আয়মান তব্দা খেয়ে গেল। তার ধারণা ছিল পিয়াসা নিজ থেকেই একটু সহজ হবে তার প্রতি এমন হাবভাব দেখে।

আয়মান,পিয়াসা, আলিশা, তার মা আজ বিকেলে তাদের গ্রামে চলে গেল। শহর থেকে কেউ গেলে আশেপাশের ঘরগুলোর সবাই ভীড় করে।

পাশের বাড়ির দু’ একজন মহিলা পিয়াসাকে দেখেই,
মাশাল্লাহ ভাবি আয়মানের বউতো সুন্দর আছে। পিয়াসা লজ্জায় তেতে গিয়ে ঘরের পিছনের রুমে চলে গেল। আয়মান ও দারুণভাবে অপ্রস্তুত হয়ে গেলো। আলিশা মুচকি হেসে দিল।

চলবেঃ ৮

#প্রণয়ের_জলসাঘরে
#পর্বঃ৯ #লেখনীতে_রেহানা_পুতুল
পিয়াসা লজ্জায় তেতে উঠে ঘরের পিছনের রুমে চলে গেল। আয়মান ও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ে গেল। আলিশা মুচকি হেসে দিল।

আয়মানের মা বিরক্তিকর স্বরে, আন্দাজে কথা বলেন কেন আপনারা? বউ ছাড়া আর কেউ হতে পারেনা? আমার ভাগনী হয় সম্পর্কে সে।
তারা মুখে কুলুপ এঁটে চলে গেল।

______
সবুজ পল্লীর শান্ত সন্ধ্যাকে বিদায় জানিয়ে ধরনীর বুকে নেমে এলো শীতের সুদীর্ঘ হিম ঝরানো থমথমে রাত। হেমন্তের সোনালি ডানায় ভর করে হিমেল হাওয়া সাথে নিয়ে, কুয়াশার চাদর জড়িয়ে এলো শীতকাল। যেটা গ্রামে না এলে টেরই পেতনা শহর থেকে আসা এই চারজন মানুষ।

আয়মানের চাচাতো দাদী থাকে তাদের ঘরে সবসময়। তার সাথে এদের বন্ধন ঠিক নিজের দাদীর মতই। আপন দাদা দাদী বেশ কয়বছর আগেই গত হয়েছে। আলিশা ও পিয়াসা বেশ সময় ধরে দাদীর সাথে খোশগল্পে মেতে রইল। দুজনেরই মাথা ও পিঠ চাদর মুড়ি দিয়ে ঢাকা। দাদী ও মা ঘুমিয়ে গেলে তারা উঠে গেল।

আলিশা গিয়ে আয়মানকে বলল,
এই ভাইয়া আমি আর পিয়াসাপু একটু বের হবো। তুমি একটু আসনা। বাইরে ভীষণ অন্ধকার। একেবারে ভুতুড়ে পরিবেশ।

বের হবি কেন তোরা?

ব্যাঙের ডাক শোনার জন্য।

কিইই! সো বিরক্তিকর বলে আয়মান ভ্রু কুঁচকালো। এটা কার ইচ্ছেরে ?

আমাদের দুজনেরই। বলল আলিশা।

কি অরুচিকর ইচ্ছে তোদের। হাহ! মা, দাদী ঘুমিয়ে গিয়েছে?

কব্বেই? তাইতো সুযোগ পেয়েছি। নইলে আম্মু বের হতে দিত?

চল বলে আয়মান তার শালটা জড়িয়ে নিল গায়ে।
আস্তে করে দরজা খুলে বের হলো তারা তিনজন । আয়মান মোবাইলের টচের আলো ফেলছে সামনে। সেই আলোকে সঙ্গী করে পিয়াসা ও আলিশা এগিয়ে যাচ্ছে। গ্রামে রাতের ক্ষীণ আওয়াজ ও প্রকট হয়ে কানে বাজে। পুরো বাড়ির সব ঘর গুলোতে মিটমিট আলো জ্বলছে।

বাড়ির সামনের দিকে যেতেই ঝোপঝাড়ের ভিতর থেকে অনেকগুলো ব্যাঙের ডাক শুনতে পেল তারা।
পিয়াসা ভয়ার্ত কন্ঠে ফিসফিস করে আলিশাকে বলল,
এই খড়ের স্তুপের পাশ থেকে সাপের ফোঁসফোঁস শব্দ শোনা যাচ্ছে। আলিশা তীক্ষ্ণভাবে কান পেতে শুনল। ঠিক তাই। সে আয়মানকে বলল।

আয়মান মোটা গলায়,
কি বলিস তোরা? দেখিতো বলে অতি সাবধানী হয়ে চোরের মতো দুকদম পা এগিয়ে নিল। টচের আলো ফেলল আওয়াজ আসা স্থানটাতে।

পিয়াসা ও আলিশা গলাগলি করে আয়মানের পিছনে দাঁড়িয়ে আছে৷

চোখে আলো পড়াতেই ভয় পেয়ে দাঁড়িয়ে গেল একটি তরুন ছেলে।
আয়মান চোখ বড় করে, কে রে তুই আমাদের বাড়িতে? কি করছিস এখানে?

আমি পাশের বাড়ির সুজন। প্রেমিকার লগে কথা কই আয়মান ভাই।

তারা তিনজন বুঝতে বাকি রইলোনা এই ছেলেটার সর্দি। তাই নাক টেনে টেনে কথা বলছে। আর নির্জন রাত বলে আওয়াজটা সাপের ফোঁসফোঁস শব্দের মতো মনে হলো।

আরেব্বাস! কি কঠিন প্রেম তোর সুজন। এই কনকনে ঠান্ঠা গায়ে মেখেও প্রেমিকার সাথে কথা বলছিস। তোর প্রেমের জয় হোক। এখন চলে যা।

পিয়াসা মুখ চেপে হুঃহুঃহুঃ করে রিনিঝিনি শব্দে হেসে ফেলল সুজনের এমন কান্ডে। আয়মান মুখকে একপাশ করে সমস্ত ইন্দ্রিয় দিয়ে পিয়াসার হাসি শ্রবণ করল। এই প্রথম সে পিয়াসার প্রাণোচ্ছল হাসি শুনতে পেল। তার গোপন চিত্ত বিমোহিত। মোহাচ্ছন্ন। এমন শীতল করা হিমেল রাতেও তার হৃদয় উষ্ণতায় মাখামাখি হলো।

সুজন কে ডাক দিল নিজের কাছে। কাল বিকেলে বাজারে আমার সাথে দেখা করিস।

কেন ভাইজান? আমার কোন ভুল?

আরেহ নাহ। তোর প্রেমিকার জন্য একটা গিফট দিব। সুজন অপ্রস্তুত হয়ে গেল। আচ্ছা ভাই। স্থান ত্যাগ করল সুজন ।

এই ভাইয়া জ্বিন ভূতে ধরেছে নাকি তোমাকে? আজাইরা সুজনকে কেন গিফট দিবা? আমাকেই দিও সেটা। সওয়াবের পাল্লা ভারী হবে।

আয়মান আলিশার মাথায় হালকা টোকা মেরে, অবশ্য তুই ও পাওনা। আচ্ছা তোকেও দিব।

পিয়াসাপু পাওনা নয়?
নাহ। সে কি উপকার করেছে আমার?

ওরা ঘরে ফিরে আসে। আয়মান তার রুমে শুয়ে যায়। আলিশা গিয়ে তার মায়ের পাশে শুয়ে পড়ে। পিয়াসা তার জন্য বরাদ্দকৃত স্থান দাদীর পাশে গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়ে পড়ে।

আয়মানের চোখের কোনে ঘুমের লেশ মাত্র নেই। ঘুমেরা যেন হাওয়াই মিঠাইর মতো কোথায় মিলিয়ে গিয়েছে। তন্দ্রাহীন বিনিদ্র রজনী পার করছে। শীতার্ত বিছানায় এপাশ ওপাশ করছে। ধীরে ধীরে রাত গভীর হচ্ছে । পাশের উঠানে কুকুরগুলাে ঘেউ ঘেউ করে ডেকে যাচ্ছে। পাশের কোনাে মসজিদ থেকে হামদে নাত ও নাতে রাসুল গজলের প্রাণ জুড়ানো সুর ভেসে আসছে।

এদিকে পিয়াসার এক ঘুম হয়ে গিয়েছে। তার বড্ড পানির তেষ্টা পেয়েছে। উঠতে হবে পানি খেতে। পাতায় পাতায় টুপ্ টুপ্ করে শিশির খসে পড়ছে। মনে হয় যেন অনেকগুলো ভূত পা টিপে টিপে চলছে । ভয়ে পিয়াসার শরীর কাঁটা দিয়ে উঠল। রাত ও শেষ প্রহরে এসে পৌঁছাল। পিয়াসা নিঃশব্দ পায়ে বিছানা থেকে উঠে মাটিতে পা রাখল। সারা ঘর অন্ধকার। পানি যে কোথায়। খোলা দরজার একপাশে দাঁড়িয়ে পিয়াসা আয়মানের রুমে উঁকি দিল।

আবছা আলোতেও আয়মান পিয়াসাকে দেখতে পেল । চট করে উঠে জিজ্ঞেস করল। পিয়াসা কি সমস্যা বল?

পানির মগ খুঁজে পাচ্ছিনা স্যার।

ভিতরে আস। পানির এনে দিচ্ছি।

আমিই পারব। মগ কোথায় বলেন।

নাহ। তুমি নতুন এ ঘরে। খুঁজতে গেলেই এটা ওটার সাথে হোঁচট খাবে। আর সবাই হুড়মুড়িয়ে চোর বলে চেঁচিয়ে উঠবে।

পিয়াসা দু’ পা বাড়িয়ে আয়মানের রুমে প্রবেশ করল।

আয়মান পিয়াসার পাশ কেটে উঠে গেল। এক গ্লাস পানি এনে দিল পিয়াসার হাতে। পিয়াসা চেয়ারে বসে গ্লাসটি দুইহাত দিয়ে যত্নের সাথে ধরে পুরোগ্লাসের পানি সব খেয়ে নিল।

আর খাবে পানি? খুব পিপাসা লেগেছে বুঝি?
হুম স্যার।

তুমি নিজেই ত আজলা আজলা জল। টেনে টেনে নেশাতুর চোখে বলল আয়মান। তোমার নামটা সুন্দর। কিছুটা কাব্যিক।

ও হ্যাঁ। মা সবাইর কাছে তোমার পরিচয় দিয়েছে ভাগনি হিসেবে। সেখানে তুমি যদি ভাইয়া না বলে এভাবে স্যার স্যার বল। মা মিথ্যাবাদী হয়ে যাবেনা সবার কাছে? বল?

সম্মতি পোষণ করে পিয়াসা বলল,আন্টিকে ছোট করবনা। বিষয়টা মাথায় গেঁথে রাখলাম।

পিয়াসা চলে গেল। ভাবছে, আয়মান স্যার ও কি আমাকে ভালোবাসে নাকি। কথাবার্তার সুর তেমন কিছুইতো ইঙ্গিত দিচ্ছে। এটা কিভাবে সম্ভব। উনিতো পুরাই কাঠখোট্টা টাইপের বান্দা। নাকি দুই বন্ধু চ্যালেঞ্জ নিয়েছে আমাকে জয় করার। কিন্তু আমার মাঝে এমন কিইবা আছে।

ভোর হয়ে গেল। দাদী আর মা তাড়াতাড়ি উঠে গেল। বড় এক হাঁড়ি রস উঠানে নিয়ে এলো রইসউদ্দীন। দাদী আগেই বলে রেখেছে খেজুরের রসের জন্য তাকে। খেজুর গাছের খাঁটি
রস বহুদিন পরে তারা দেখেছে। রান্নাঘরে মাটির চুলায় আগুন জ্বালিয়ে দিল তাদের ঘরের কাজে সাহায্যকারী পাশের বাড়ির দরিদ্র করিমন চাচী।

আলিশা ও পিয়াসা কাচা রস বাটিতে নিয়ে একটু খেল। চোখ চকচক করে উঠল দুজনের। একে অপরের দিকে চেয়ে। উফফস! কি মজা! অথেনটিক স্বাদ।

কাউন চাল দিয়ে ক্ষীর রান্না হবে এখন। মাটির চুলার একটু দূরে উঁচু কাঠের পিঁড়িতে বসে আছে আলিশা ও পিয়াসা। তার দাদী পানের বাটা নিয়ে বসেছে। একটু পর পর খিলি পান বানিয়ে মুখে পুরে দিচ্ছে। পিয়াসা বলল দাদীর তো পান খেয়েই পেট ভরে যাচ্ছে। নাস্তা খাবেন কিভাবে?

পান ভর্তি মুখে দাদী রসিয়ে রসিয়ে জবাব দিলো। নালো নাতনি নাহ। নাস্তা ঠিকই খাইতে পারুম। পান হইলো আমার কাছে নেশার জিনিসের মতন। যত পাই। তত খাই। আরো চাই। দিল ও ভরেনা। পেট ও ভরেনা।
ব্যাটা ছেলেরা যে একটা না শ্যাষ হইতেই আরেকটা বিড়ি ফুঁকে। ক্যামনে কও। ওই যে নেশা।

দাদী কি যে জোস একটা কথা বলছ তুমি। নেশার বস্তু যত পাই তত চাই। ভাললাগছে শুনে। বিপুল শান্তি পেলাম। রান্নাঘরের বেড়ার পাশে ব্রাশ করতে করতে বলল আয়মান।

মাথা উঁচিয়ে আয়মানের দিকে চাইল পিয়াসা ও আলিশা। দাদী বলল তুই ও শুনলি তাইলে?

এত মজার কথা শোনা থেকে বঞ্চিত হব নাকি বুড়ি?

বউ শুনো তোমার পোলারে সাদি করাইয়া দিবা। মনে হয় লাইন মারে কোন মাইয়ার লগে।

আয়মান উঁকি দিয়ে মাকে দেখেই জিব কামড় দিল লজ্জায়। দ্রুত পুকুর ঘাটে চলে গেল।

আয়মানের মা বড় একটি নতুন হাঁড়িতে রস নেড়ে নেড়ে জ্বাল দিচ্ছে। করিমন চাচী চুলোর আগুন কন্ট্রোল করছে। দাউদাউ করে জ্বলতে থাকা আগুনে অল্পসময়েই খেজুর রসের ক্ষীর তৈরি হয়ে গেল।

রসের ম – ম সুঘ্রান সারা রান্নাঘরে ছড়িয়ে পড়ল। পিয়াসা, আলিশা বায়না ধরল ঘরে গিয়ে টেবিলে খাবেনা নাস্তা। রান্নাঘরের মাটিতে বসেই খাবে। অরজিনাল গ্রামের আবহ অনুভব করতে চায় তারা।

বেতের একটি সুন্দর পাটি বিছানো হলো। নাস্তার বাটি চামচ ধুয়ে আনা হলো। আয়মানের মা একে একে সবাইকে বেড়ে দিল খেজুরের রসের ক্ষীর। নিজের জন্যও নিলেন। করিমন চাচীকেও দিলেন। একটু জুড়িয়ে গেলে বাটি হাতে নিল সবাই।

আয়মান এসেই চিলের মত ছোঁ মেরে পিয়াসার জুড়ানো বাটি হাতে নিল। গপাগপ খাওয়া শুরু করলো।
জাস্ট ওয়াও মা। অস্থির মজা হয়েছে।

পিয়াসা হা হয়ে চেয়ে রইলো আয়মানের দিকে।

আরেহ ভাইয়া তুমি কার ক্ষীর খেয়ে ফেলছ?

কার আবার? নাম লিখা আছে নাকি?

পিয়াসাপুর জুড়ানো বাটি খাচ্ছ। বেকুব।

আয়মান অর্ধেক শেষ করা বাটি পিয়াসার হাতে ধরিয়ে দিল। নিজের বাটি নিয়ে খাওয়া শুরু করল।

পিয়াসা গরম খাবার খেতে পারেনা। আবার খাওয়ার লোভ ও সংবরণ করতে পারছেনা। অগত্যা নিরুপায় হয়ে আয়মানের খাওয়াটাই খেয়ে পরে আরও নিল।

করিমনকে নিয়ে তার মা রান্নাঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল পিছনের বাগানে কচুক্ষেতের দিকে।

পিয়াসা সর‍্যি তোমার টা খাওয়ার জন্য।
সমস্যা নেই ভাইয়া। পিয়াসা স্মিত হেসে বলল।

আলিশা গাল টিপে হেসে ফেলল।

দাদী তুমি ঢাকায় বেড়াতে যেতে চাওনা কেন? বলল আয়মান।

হ যামু। তোগো ভাই বোনের বিয়ার কালে।

দাদী আমার টা বাদ দেও। সিরিয়ালে ভাইয়া এগিয়ে আছে।

আমি বিয়ে করবনা। বলল আয়মান।

কেন নাতি? তুই কি হি**ড়া?

আয়মান কিঞ্চিৎ রেগে গেল। দাদী তুমি আগের মতই ফাজিল আছো। আমি কেশবতী নামে একটা মেয়েকে ভালোবাসি অনেকদিন ধরেই। তাকে না পেলে দ্বিতীয় কাউকে চাইনা। আয়মান উঠে গেল কলতলায় হাত ধোয়ার জন্য।

পিয়াসা নিশ্চিত হলো কিছু। বুঝে নিল তার মানে আয়মান স্যার বহু আগেই কোন ললনার জন্য প্রণয়ের জলসাঘর সাজিয়ে রেখেছে হৃদয়ের অন্তপুরে।

পিয়াসার ফোন বেজে উঠলো। রায়হান ফোন দিয়েছে।
পিয়াসার সব কুশলাদি জেনে নিয়ে বলল,
পিয়াসা আর চাইবনা তোমাকে। এই শেষ চাওয়া। তুমি রাজী থাকলে আমি বিয়ের প্রস্তুতি নিব। শীতের মধ্যেই তোমাকে একান্তভাবে নিজের করে পেতে চাই।

পিয়াসা থম মেরে রইলো। ওপাশ থেকে রায়হান বলল, মৌনতাই সম্মতির লক্ষন। আমি বুঝে নিলাম তোমার আপত্তি নেই আমার ছায়া হয়ে বাঁচতে। অকুন্ঠ ভালোবাসা তোমার জন্য।

চলবেঃ ৯