প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-০৪

0
243

#প্রণয়ের_বাঁধন |৪|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

ঘর পোড়া গরু সিঁদুরে মেঘ দেখলেই ভ’য় পায়। তনুজার অবস্থাও এখন এমন হয়েছে। তনুজা ভয়েভয়ে ছিল না জানি দিব্য আর তাকে নির্জনে কথা বলতে দেখে, আবার কে কী কু/ৎসা রটনা করে বসে। একেতেই কোন দোষ না করেই তার উপর এক বদনাম হয়েছে। এখন দিব্যর কথার প্রত্যুত্তর দেওয়ার আগেই নুরজাহানের বাজখাঁই গলা কর্ণগোচর হতেই ভ’য়ে, আতংকে তনুজার হাত-পা কাঁপতে থাকে।

-” কই সে নবাব বেটি কই? কোন সময় না তারে ডাকছি। এখনো তার চাঁদ মুখের দর্শন হলো না। তা সে কী মনে করে নিজেরে!”

নুরজাহান চেঁচিয়ে তাচ্ছিল্য করে বলতে থাকে। তনুজা তড়িৎ উল্টো ঘুরে দাঁড়ায়। তনুজার বুক কাঁপছে। উফ্! উপরে আসছে দিদুন। না জানি দিব্য আর তাকে দেখে কী রিয়েকট করে বসে। তন্মধ্যে শিরিনের কণ্ঠ আসলো,

-” মা সিঁড়ি বেয়ে উপরে উঠতে গিয়ে আপনার হাঁটুর ব্যাথা বাড়বে তো। আপনি নিচেই বসুন, আমি তনুজাকে ডেকে দিচ্ছি। ”

দোতলার বারান্দায় দাঁড়িয়ে শিরিন বলে। নুরজাহান সিঁড়ির প্রথম ধাপে দাঁড়িয়ে ছিলেন। গম্ভীর স্বরে জবাব দিলেন,

-” আচ্ছা। ঠিক আছে। তাড়াতাড়ি নিচে আসতে বলো। তা তাকে ডাকার জন্য কী জনে জনে মানুষ রাখা লাগবে নাকী। যত্তসব! বাড়ির বউ কোনো দায়-দায়িত্ব নেই, কান্ড-জ্ঞান নেই। আরে বউদের কাজই থাকে সকালে উঠেই চুলোর পাশে যাওয়া।”

আপনমনে বকবক করতে করতে নুরজাহান প্রস্থান করতে থাকে। তনুজা দিব্যর দিকে ঘুরে না তাকিয়ে, ব্যস্ত হয়ে তড়িঘড়ি করে বলল,

-” বাদ দাও দিব্য। আমি চাই না আমার জন্য নতুন করে তোমাদের সংসারে কোন ঝামেলা হোক‌। আর তুমি যা বললে, সেসব এতটা সহজও নয়। এখানে তুমি একা নয়, তোমার সাথে তোমার পরিবার আছে। তারা তোমার সাথে আমাকে কখনোই আর মেনে নিবে না।আর তা সম্ভবও নয়। আর আমি অদৃশ্য শক্তিতে বিশ্বাস করি। কেউ অন্যায় করলে তার বিচার হবেই। আমার সব অভিযোগ উপরওয়ালার কাছে দিলাম। সর্বোচ্চ অথিওরিটিই আমার সাথে হওয়া অন্যায়ের বিচার করবে।”

একনাগাড়ে বলে পা চালায় তনুজা। দিব্য একহাত বাড়িয়ে ডাকে,

-” তনুজা? তনু তুমি বোঝার চেষ্টা করো। কেউ তোমার পাশে না থাকলেও আমি আছি আর আমি থাকব। অন্য কাউকে তোমাকে মেনে নেওয়ার দরকার নেই।”

তনুজা থামে না, ফিরে তাকায় না। শাড়ির আঁচল শক্ত করে মুঠো করে লম্বা পা ফেলে। তনুজার বুকটা কষ্টে ভেঙ্গে যাচ্ছে। দাঁতে দাঁত চেপে কান্না সংবরণ করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে সে। এমন সময় গম্ভীর কন্ঠ আসলো, সাথে সাথেই তনুজার পা দুটো থেমে যায়।

-” দাঁড়াও তনুজা?”

দিব্য তড়িৎ ঘাড় ঘুরিয়ে পিছনে তাকাল। তনুজা ধীরে ধীরে পিছন ঘুরে তাকায়। মুখাবয়বে অসন্তুষ্টের ছাপ নিয়ে মুখটা কালো করে শিরিন দাঁড়িয়ে আছে। পরপর এগিয়ে আসলেন। ছেলের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে আদেশের সুরে বললেন,

-” রুমে যাও দিব্য।”

দিব্যর নড়ন-চড়ন নেই। দিব্য মায়ের দিকে চেয়ে ঠাঁই দাঁড়িয়ে। এবার কন্ঠটা আরেকটু চড়িয়ে খানিকটা ধ’ম’কের সুরে বললেন,

-” কথা কানে যায়নি তোমার? রুমে যাও। নিজের রুমে যাও দিব্য।”

দিব্য দেওয়ালে ঘু/ষি মে/রে রাগটা মেটানোর চেষ্টা করে, তারপর গটগট পা ফেলে প্রস্থান করে। তনুজার চিবুক বুকের সাথে লেগে আছে। দৃষ্টি নুইয়ে তনুজা শাড়ির আঁচল আঙ্গুলের সাহায্যে মুচড়িয়ে যাচ্ছে। শিরিন তীক্ষ্ণ চাহনিতে চেয়ে শান্ত গলায় বলল,

-” আশাকরি তুমি বুঝদার হবে। তোমার থেকে অবুঝের মতো আচরণ, কাজকারবার কোনটাই কাম্য নয়। তুমি এ বাড়ির বড় বউ। নিজেকে সেভাবেই গড়ে নিবে। আর দিব্য সম্পর্কে তোমার দেবর। কথাটা মনমস্তিষ্কে গেঁথে নিবে। বিয়ের আগে অনেকের রিলেশন থাকে। বিয়ে হলে সেসব ভুলে স্বামীকে আপন করে নেওয়াই একটা ভালো মেয়ের বৈশিষ্ট্য। স্বামীকে আপন করে সুন্দর করে মন দিয়ে সংসার করাই, বুদ্ধিমানের কাজ। পিছুটান রাখতে নেই। আমি চাইবো তুমি নিজেকে দিব্যর কাছ থেকে দূরে রাখবে। তুমি যদি দিব্যকে সুযোগ না দাও, তাহলে দিব্য প্রশ্রয় পাবে না। দিব্য নিজেও দ্রুত গ্রো আপ করতে পারবে। আর শোন, যত দ্রুত সম্ভব ইভানের সাথে তোমার সম্পর্কটা স্বাভাবিক করে নাও।”

একটু থেমে,

-” যা বললাম মনে রাখবে। নেক্সট যেন তোমার আর দিব্যকে একসাথে না দেখি। আর মা ডাকছে মায়ের রুমে। তাড়াতাড়ি যাও।”

তনুজা কলের পুতুলের মতোন দাঁড়িয়ে ছিল। ঠিক পুতুলের মতোই ঘাড়টা নাড়িয়ে, মিহি স্বরে বলে,

-” ঠিক আছে।”

_____________

নুরজাহানের বড় আলিশান রুমের ঠিক মাঝখানে গুটিসুটি হয়ে দাঁড়িয়ে আছে তনুজা। নুরজাহান রুমের এককোণে থাকা পুরানো আমলের সিন্দুকের ভেতর থেকে একটা গয়নার বাক্স বের করে আনলেন। সেটা হাতে নিয়ে বিছানায় আয়েশ করে বসলেন নুরজাহান। তনুজার দিকে তাকিয়ে বললেন,

-” অ্যাই মেয়ে এদিকে আসো।”

তনুজা গুটিগুটি পা ফেলে এগোয়। নুরজাহান ইশারা করে বললেন,

-” বসো এখানে।”

তনুজা রোবটের মতোন বিছানার একপাশে সন্তর্পণে বসে। নুরজাহান গয়নার বাক্সটা তনুজার হাতে দিয়ে বললেন,

-” আজ থেকে এই গহনা গুলো তোমার। এর ভেতর একটা সিতা হার, একজোড়া ঝুমকো আর দু’টো রুলি আছে। এসব পুরনো দিনের স্বর্ণের তৈরি গহনা। একদম খাঁটি, একটুও খাদ নেই। এগুলো আমার ছিলো। আমার ইভানের বউয়ের জন্য তুলে রেখেছিলাম।”

তনুজা অনুভূতি শূন্য হয়ে আছে। তার মধ্যে কোন ফিলিংস আসছে না। সে যেন এক জড় পদার্থ। বাক্সটা হাতে ধরে সে নিশ্চুপ আছে। সোনাদানা এসবও তার মনে এক টুকরো প্রশান্তি আনতে পারছে না। নুরজাহান পা দুটো ছাড়িয়ে বেডের হেডের সাথে হেলান দিয়ে বসে। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলেন,

-” শোন মেয়ে? ইভান আমার বংশের প্রথম প্রদীপ। আমার বড় ছেলের একমাত্র সন্তান হলো আমার বড় দাদুভাই। তাই ইভান দাদুভাই আমার অনেক আদরের। আমার দাদুভাইকে ভালো রাখা, সুখে রাখা তোমার দায়িত্ব। আমি আর ক’দিনই বাঁচবো। বাবা-মা হারা এতিম ছেলেটাকে সুখে রেখো, কখনো কষ্ট দিও না।”

শেষের কথাগুলো বলতে বলতে কঠিন হৃদয়ের নুরজাহানের গলাটা কেমন ভারী হয়ে আসলো। থামলেন একটু। তনুজা চোখ তুলে নিরেট চাউনিতে দিদুনের দিকে তাকাল। কঠিন শক্ত মনের নুরজাহানের ভেতরেও যে একটা নরম মন আছে। সেই রুপের সাথে তনুজার আজকেই প্রথম পরিচয় হয়। তনুজা ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। বড়বড় শ্বাস ফেলে নুরজাহান ফের বললেন,

-” তুমি ইভানের বউ। তাই তার অতীত সম্পর্কে তোমার জানাটা জরুরী। আর সবকিছু জেনেই একজন উত্তম জীবনসঙ্গী হয়ে তোমার স্বামীর সাথে আমৃত্যু পর্যন্ত থাকবে।”

“অতীত” শব্দটা মস্তিষ্কে ক্যাঁচ করতেই তনুজার মধ্যে জানার জন্য একটা অদৃশ্য আগ্রহ কাজ করে। তনুজা তার সমস্ত মনোযোগ নুরজাহানের কথা শ্রবণে দেয়। নুরজাহান বলতে থাকে,

-” ইভানের বয়স যখন সাত। সেইসময় তার চোখের সামনে তার মায়ের এ/ক্সি/ডেন্ট হয়। বাচ্চা ছেলেটার মনের উপর এর ব্যাপক প্রভাব পরে।”

তনুজা তৎক্ষণাৎ প্রশ্ন করে উঠল,

-” কী করে ঘটেছিল এ/ক্সি/ডেন্ট?”

-” সে আর বলো না। কী থেকে কী হয়ে গেল! উফ্! বাড়ির সবাই একসাথে ঈদের কেনাকাটা করতে গিয়েছিল। বড় বৌমা,ছোট বৌমা, তাদের বাচ্চারা আর সাথে তামান্না। কেনাকাটা শেষে বের হয়ে ইভান দাদুভাই বায়না ধরে, সে রাস্তার পাশে বিক্রি হওয়া বেলুন নিবে। একলোক রাস্তার পাশে বাচ্চাদের খেলনা নিয়ে বসে ছিল। বড় বউমা ইভানকে সাথে করে রাস্তার পাশে যায় কিনতে। সেইসময় দিব্য দাদুভাইও ওদের পিছু যায়। বড় বউমা ওদের দু’জনের ইচ্ছে অনুযায়ী একজনকে বেলুন, আরেকজন কে বল কিনে দেয়। বড় বউমা লোকটাকে টাকা দিচ্ছিল। এরমধ্যে দিব্য দাদুভাই দুষ্টামি করে ইভানের বেলুন ফাটিয়ে দেয়। ইভান রেগে গিয়ে দিব্যর থেকে বল কেড়ে নিয়ে রাস্তা বরাবর ছু/ড়ে ফেলে। দিব্য দৌড়ে বল আনতে যায়। দিব্যর বয়স তখন সাড়ে পাঁচ। ঐটুকু বাচ্চা অতো বুঝেনি। বড় বউমা টাকা দিয়ে পিছন ঘুরে তাকিয়ে দেখে দিব্য রাস্তার মাঝে চলে যাচ্ছে, আর দ্রুত গতিতে একটা ট্রাক ছুটে আসছে এদিকেই। বড় বউমা আগপিছ না ভেবে ছুটে যায়। দিব্যকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দেয়। কিন্তু তার ভাগ্যে হয়ত সেদিন ওখানেই তার মৃ/ত্যু লিখা ছিলো। নিজে সরতে পারেনি। বেপরোয়া গতিতে আসা ট্রাকের নিচে..”

ইশশ্! কঠিন মনের নুরজাহান বলতে বলতে হঠাৎ ঝরঝরিয়ে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠল। তনুজার গাল বেয়ে নীরব অশ্রু গড়িয়ে পড়তে থাকে। তনুজা শুধালো,

-” আন্টি, তামান্না আন্টি ওনারা সেইসময় পাশে ছিলেন না।”

নুরজাহান কাপড়ের আঁচল দিয়ে চোখ দু’টো মুছে নিলেন,

-” তামান্না গাড়িতে ছিল। আর ছোটো বউমাও গাড়ির কাছে ছিল। ঘটনা স্থলেই বড় বউমার প্রাণ চলে যায়। আর দিব্যর হাত-পা ছিলে, আর কপালে হালকা আঘাত লাগে।”

থেমে,

-” এখানেই সব শেষ হয় না। এখান থেকেই শুরু হয় ইভান দাদুভাইয়ের কষ্টের জীবন। বছরখানেক পরে ইভানের বাবাকে আমিই জোরকরে বিয়ে দেই। ছেলে মানুষ এভাবে একলা কীভাবে থাকবে! তারপর বাচ্চা ছেলেটার দেখাশোনার জন্য বিয়ে দেই। ইশতিয়াক নতুন বউ আর ইভানকে নিয়ে চট্টগ্রাম থাকত ব্যবসার জন্য। পর কখনো আপন হয় না, কথাটা যথার্থ। সত্যিই হয় না। হয়নি ইভানের সৎ মা আপন। হয়নি। ইশতিয়াক ব্যবসার কাজে ব্যস্ত থাকত। এদিকে সৎ মা আদর স্নেহ করত না, যত্ন নিতো না। বরং অবহেলা, অত্যাচার করত। মায়ের মৃ/ত্যুর পর থেকে চঞ্চল ইভানের স্বভাব পাল্টে যায়। আগের মতো কারো সাথে মিশতো না, খেলতো না। সবসময় একলা থাকত। বছরে এক বার চট্টগ্রাম গিয়ে ইভানকে দেখে আসতাম। আমার উপস্থিতিতে ইভানের সৎ মা বুঝতে দিতো না ইভানের উপর করা অবহেলা, অযত্ন। ইভানকে নিষ্প্রভ দেখে ভাবতাম, মায়ের জন্য হয়তো এমন হয়েছে। সময় গেলে ঠিক হয়ে যাবে। কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিলো। ছেলেটা আদর-যত্ন পেলেই আগের মতো চঞ্চল হতো, স্বাভাবিক হয়ে যেতো। বুঝলাম! বুঝলাম ঠিকই। কিন্তু অনেক দেরিতে। খুব বেশি দেরি হয়ে যায়। ইভান যখন ক্লাস এইটে পরে সেইসময় ইশতিয়াক স্ট্রোক করে। একসাইড প্যারালাইসড হয়ে শয্যাশায়ী হয়ে যায়। তখন নতুন বউয়ের আসল রুপ জানতে পারি। আমার অসুস্থ ছেলেকে রেখে ক’মাস পরেই টাকা-পয়সা, গহনা গাটি নিয়ে নতুন বউ পালিয়ে যায়। দিনের পর দিন ছোট্ট ছেলেটা তার বাবার উপর অযত্ন, অবহেলা দেখেছে। সাথে নিজেও অত্যাচারিত হয়েছে। তারপর ইভান আর তার বাবাকে এখানে নিয়ে আসি। ইভানের পড়াশোনা এক বছর গ্যাপ যায়। এখানে দিব্যর স্কুলে একসাথে ভর্তি করি ইভানকে। অল্প দিনের ছোটবড় হওয়ায় ইভান- দিব্য ছোটবেলা থেকেই তুই তোকারি করে নাম ধরেই ডাকত। একসাথে দু’জনে পড়তে থাকে। ইভান ইন্টারে পড়াকালীন তার বাবাও না ফেরার দেশে পাড়ি দেয়। অনার্স পাশ করার পড়েই ইভানকে আমিই অফিসে বসতে বলি। ইভান মাস্টার্স পড়তো আর চাচা- চাচির সাথে অফিসে ব্যবসাও সামলাতো। চলছিল মোটামুটি সবকিছু। এরমধ্যে কিছুদিন পরেই ইভানের বিয়ের কথা বলতেই, ইভানের নিজস্ব পছন্দ আছে তা জানায়। যদিও আমি প্রেম-প্রীতি এসব সম্পর্ক পছন্দ করি না। ইভান দাদুভাই এতিম ছিলো বিধায়ই আমি একবাক্যে রাজি হয়েছিলাম। দাদুভাইয়ের বাগদান হলো। বিয়ের দিন আসলো। জানি না কী হলো বিয়ের দিন কনে পালালো! পার্লার থেকে কনে কমিউনিটি সেন্টারে আর ফেরেনি। কী একটা চিরকুট লিখে সে মাইয়া উধাও হয়ে গেল। এরপর থেকে ইভান একদম পাল্টে যেতে থাকে।”

নুরজাহান হতাশার নিঃশ্বাস ফেলল।

-” হতচ্ছাড়ি ঐ মাইয়ার জন্য আমার দুই দাদুভাইয়ের সম্পর্ক খারাপ হয়। ইভান দাদুভাই দিব্য দাদুভাইরে দোষ দেয়, ঐ মাইয়া রে পালাতে দিব্য সাহায্য করেছে। কিন্তু কথা হলো, ঐ মাইয়া কী ছোটো খুকি। অতবড় মাইয়ারে কাউরে ফুসলানো লাগে। সব দোষ ঐ হতচ্ছাড়ির সামনে পেলে শিল পাটায় ফেলে পিষতাম। অ/সভ্য মেয়ে মানুষ কোথাকার! তুই যদি বিয়ে করবিই না তার জন্য তোর বিয়ের দিন পর্যন্ত আসা লাগে। আগেই তো বলতে পারতিস বিয়ে করবি না। আর আগে রং ঢং করছিস ক্যান?”

এতক্ষণের বেদনার্ত নীল মুখটা মূহুর্তেই রাগে লাল হয়ে আসে নুরজাহানের। যেভাবে বলছে মনে হচ্ছে সামনে থাকলে কাঁচাই চিবিয়ে খেয়ে ফেলত। যাতে করে একটু হলেও রাগ মিটতো। তনুজার অবচেতন মন আওড়ায়,

-” তারমানে লোকটা এইজন্য মেয়েদের ঘৃ/ণা করে, সৎ মায়ের অত্যাচার, সৎ মা বাবাকে অসুস্থ রেখে পালিয়ে গেছে। আবার উনার ভালোবাসার মানুষটিও হঠাৎ বিয়ের দিন পালিয়েছে। তবে কী এটাই সত্যি উনি আমাকে দয়া দেখিয়েই বিয়ে করেছে? তাহলে ওনার আর আমার সাথে ঘটে যাওয়া এই বাজে ঘটনার পিছনে কার হাত আছে? কে সে? আর তার উদ্দেশ্যই বা কী ছিল? আমাকে এসব প্রশ্নের উত্তর জানতেই হবে।”

তনুজার ভাবনা ভাঙ্গে নুরজাহানের কর্কশ গলার আওয়াজ শুনে,

-” অ্যাই মেয়ে? অ্যাই এতক্ষণ তোমার কাছে এসব বলার মানে নিশ্চয় তুমি বুঝতে পেরেছো? ইভান দাদুভাইয়ের সকল কষ্ট ধুয়েমুছে সাফ করে দেওয়ার দায়িত্ব তোমার। মেয়ে মানুষ চাইলে সব পারে। ইভান কী ছাইপাশ খায়। এইজন্য ডাক্তার দেখিয়েছি, কাউন্সিলিং করা হয়েছে তবুও ওসব না গিলে সে থাকতে পারে না। ডাক্তার বলেছেন, অতিরিক্ত ম/দ এভাবে খেতে থাকলে শরীরের জন্য ক্ষ/তি হবে। বড়সড় ব্যাধি বাঁধতে পারে। এখন তোমার কাজ স্বামীর দেখভাল করা, ওসব ছাইপাশ ছাড়ানো। আমি বুদ্ধি দেই, তাড়াতাড়ি বাচ্চা নাও। বাচ্চা নিলে সংসারের প্রতি টান, মহব্বত হবে, তখন এই সুন্দর পৃথিবীতে আরো দীর্ঘদিন বাঁচতে ইচ্ছে হবে। নিজের প্রতি যত্নবান হবে। আর তুমিও বাচ্চার কথাটথা বলে কয়ে ওসব ছাড়তে বলবে। বুঝেছো?”

তনুজার চোখদুটো বড়বড় হয়ে যায়। ভাসাভাসা চোখদুটোয় কালো মনি স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে বোকার মতো। তনুজা হ্যা বা না কিছুই বলে না। তনুজা থ মে/রে নির্বাক থাকে।

_____________

তনুজা রুমে যায়। মুখটা তার মলিন হয়ে আছে। জীবন তাকে কোথায় এনে দাঁড় করাল। সে ভাবতে পারছে না এখন কী করবে? তনুজা হাতের বাক্সটা রাখল। ওয়াশরুম থেকে পানির শব্দ আসছে। তনুজা দাঁড়িয়ে কিছুক্ষণ জীবনের মোড় কোথায় তাকে আনলো সেসব ভাবায় মগ্ন হয়। তন্মধ্যেই ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হয়। শব্দ শুনে ভাবনা থেকে বেরিয়ে তনুজা সামনে তাকায়। ইভানের পরনে সাদা টাওয়েল হাঁটু অব্দি। বুকের লোমগুলো ভিজে লেপ্টে আছে। কপালের উপর থাকা চুলগুলো থেকে টপটপ পানি ঝরছে। ইভানের শ্যামবর্ণ মুখটা সদ্য গোসল নেওয়ায় স্নিগ্ধ লাগছে। ইভান সামনে তাকাতেই দু’জনের চোখাচোখি হয়। ইভানের চোখে চোখ পড়তেই তনুজা দৃষ্টি নামিয়ে নেয়। তনুজার হঠাৎ অস্বস্তি ঠেকছে। ইভান ওর মতো সোজা কেবিনেটের সামনে এসে দাঁড়ায়। তারপর পোশাক বের করে বিছানায় রাখে। তনুজা ব্যালকনিতে যাবে বলে তড়িঘড়ি করে পা বাড়ায়। হঠাৎ ফ্লোরে থাকা কার্পেটে পা বেছে উস্টা খায় তনুজা। আর এদিকে ইভান শার্ট প্যান্ট বিছানায় রেখে আয়নার সামনে দাঁড়াবে বলে এগোচ্ছিল এমন সময় তনুজা উস্টা খেয়ে তার গায়ের উপর পরে। আচমকা পড়ায় ইভান ব্যালেন্স রাখতে না পেরে তনুজার কোমড় একহাতে ধরে দু’জনেই ফ্লোরে ধপাস পড়ে যায়।

তনুজার কোমড় একহাতে ধরে আছে ইভান। উন্মুক্ত কোমড়ে ঠান্ডা হাতের স্পর্শ অনুভব হতেই তনুজার গা শিরশির করে উঠে। কেমন একটা অদ্ভুত শিরশিরানি বয়ে যায়। তনুজার পেলব শরীর মৃদু কেঁপে উঠে। ইভানের উন্মুক্ত বুকের উপর পরে আছে তনুজা। তনুজার নিঃশ্বাস ভারী হয়ে আসলো। রীতিমত তনুজার বুক কাঁপছে। ইভান তার গায়ের উপরে থাকা তনুজার ভীতু ফেস, আর মায়াভরা চোখের দিকে কপাল কুঁচকে তাকিয়ে রয়। তনুজা জিভ দিয়ে নিচের ঠোঁট ভিজিয়ে নিয়ে মিহি স্বরে আওড়ায়,

-” হাতটা সরান।”

ইভানের হুঁশ হয়। তড়িৎ সে তনুজার কোমড় থেকে হাতটা সরিয়ে নেয়। তনুজা দ্রুত উঠে দাঁড়ায়। ইভান নিজেও অপ্রস্তুত হয়। পর পর ইভান উঠে দাঁড়িয়ে অপ্রস্তুত কণ্ঠেই শুধায়,

-” ঠিক আছো তুমি? কোথাও লাগেনি তো?”

তনুজা উল্টোদিক ঘুরে দাঁড়িয়ে আছে। পায়ের নখ দিয়ে ফ্লোর খুঁটছে সে। তনুজা মিনমিনে স্বরে জবাবে বলে,

-” ঠিক আছি আমি। লাগেনি। ”

ইভান নিজেই নিজের করা প্রশ্নে বিস্মিত হয়। বাহবা! সে যেচে কোন মেয়ের খোঁজ নিচ্ছে। তার আ/ঘা/ত লেগেছে কীনা জানতে চাইছে! আচমকা নিজের করা এহেন প্রশ্নে ইভান তাজ্জব বনে যায়!

#চলবে