প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-০৭

0
137

#প্রণয়ের_বাঁধন |৭|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

ঘড়ির কাঁটায় সকাল নয়টা পঁয়ত্রিশ বাজে। মির্জা বাড়ির ডায়নিংয়ে বসে নাস্তা করছে দিব্য। বাকিরা খানিকক্ষণ আগেই নাস্তা পর্ব শেষ করছে। ইভান অফিসে গিয়েছে। শিরিন সুলতানা নিজের রুমে আছেন। নিতি আর নৃত্য দুইবোন সোফায় বসে ফোনে লুডু খেলছে। কালকে বিকেলে হোস্টেল থেকে বোন আসছে। বোনের সাথে গল্প-গুজব করবে বলে মায়ের ব/কু/নি শুনেও স্কুলে যায়নি নৃত্য। সিঙ্গেল সোফায় বসে পান চিবুচ্ছে নুরজাহান। তনুজা কিচেন থেকে আলতো পায়ে হেঁটে আসলো। নুরজাহানের থেকে খানিকটা দূরত্বে দাঁড়ায়। নিতি হাস্যজ্জ্বল মুখে তনুজার দিকে তাকাল। মিষ্টি হেসে বলে,

-” ভাবিমণি! তুমি তো ফ্রি আছো। আমাদের সাথে জয়েন করো। চলো লুডু খেলি।”

‘ভাবিমণি’ ডাকটা শোনার সাথে সাথে দিব্য মাথা তুলে তাকায়। ডাইনিংয়ে বসেই ঘাড় ঘুরিয়ে তনুজাকে একপল দেখে দিব্য। তনুজা কিছু বলার আগেই নৃত্য উৎফুল্ল হয়ে বলে উঠে,

-” ওহ্! ভাবিমণি! খেলবে আমাদের সাথে।”

তনুজা শুকনো হেসে কোমল স্বরে বলে,

-” ইয়ে মানে, তোমরা খেলো।”

দুইবোন একসাথে বলে উঠে,

-” ওকে।”

তনুজা নুরজাহানকে উদ্দেশ্য করে ভ’য়ে ভ’য়ে একদম মিহি স্বরে বলে,

-” দিদুন। বলছিলাম যে।”

নুরজাহান কপাল কুঁচকে তাকালেন। মুখে গম্ভীরতার ছাপ টেনে বলেন,

-” হ্যা বলো।”

তনুজা দৃষ্টি নুইয়ে আছে। ওভাবে নত মস্তিষ্কে দাঁড়িয়েই মিনমিনে স্বরে বলে,

-” দিদুন আজকে একবার কলেজে যেতে চাইছি। কলেজে যাওয়া খুব জরুরী ছিলো। ক’দিন বাদেই ইনকোর্সের এক্সাম আছে। তাই নোট কালেক্ট করতে__”

নুরজাহান তনুজাকে থামিয়ে দেয়। মুখটা অন্ধকার করে কর্কশ স্বরে বলেন,

-” ছোটো বউমা তোমাকে কিছু বলেনি। তাকে যে বলেছিলাম তোমাকে বলতে, পড়াশোনা সব বাদ দিতে। সে বলেনি তোমায়?”

তনুজা কিছু বলে না, নিরুত্তর থাকে সে। দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ করে শাড়ির আঁচল আঙ্গুলে পেঁচাতে থাকে। নুরজাহান গলা খাঁকারি দিয়ে ফের বলেন,

-” আচ্ছা, আমিই বলছি। পড়াশোনা বাদ দাও। পড়াশোনার কথা বাদ দিয়ে মন দিয়ে ঘর-সংসার করো। তাড়াতাড়ি ছেলেপুলে নাও। স্বামী সংসার সামলাও। তুমি তো আর চাকরি-বাকরি করে আমার নাতিকে খাওয়াবে না। তাই অতো শিক্ষিত, জ্ঞানী হতে হবে না। যেটুকু পড়েছো ঐ দিয়ে ছেলেপুলে মানুষ করতে পারলেই চলবে।”

দিব্য খাবার প্লেটে পানি ঢেলে হাত ধুয়ে নেয়। সবটুকু খাবার খায় না সে। দিদুনের কথা শুনে তার মেজাজ চারশো হয়ে যায়। দিব্য চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলে,

-” এটা কেমন কথা দিদুন! পড়াশোনা কী শুধু মানুষ চাকুরীর জন্য করে? পড়াশোনা করলে জানাশোনা বাড়ে, জ্ঞান বাড়ে। আর তনুজাকে তুমি পড়াশোনা বাদ দিতে বলছো কেনো? আমার মাথায় ধরছে না। আশ্চর্য!”

নুরজাহান নাক মুখ সিঁটকিয়ে বলেন,

-” তোমার জ্ঞানের কথা রাখো দাদুভাই। তোমার মতো লেখাপড়ার জ্ঞান আমার না থাকলেও, সংসারের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা আমার অনেক বেশি আছে। এই চুলগুলো এমনি পাকেনি। সংসার করতে গিয়ে কালো চুলগুলোয় পাক ধরেছে। তাই আমার অভিজ্ঞতা থেকেই বলছি। বিয়ে হয়েছে এবার ঘর-সংসার করে খাক।”

নিতি সরু চোখে চেয়ে নানু আপুর কথা শুনছে। অনেক কষ্টে সে হাসিটা চেপে রেখেছে। ফিক করে হেসে ফেললে আবার মহাবিপদ হবে। নানুআপু অসন্তুষ্ট হবে, সাথে ফ্রিতে এত্ত প্যাঁচাল ধরবে। দিব্য বি’র’ক্ত হয়ে বলল,

-” দিদুন বাদ দাও তো তোমার সেকালে ধ্যান ধারণা। আর তনুজা কলেজে যাবে। সামনে ওর পরীক্ষা। তাই শুধু শুধু তনুজাকে..”

নুরজাহান একটু ধ’ম’কের সুরে বলে,

-” আর এইযে দাদুভাই তুমিই বা কিসের লেখাপড়া করেছো। যদি তোমার মধ্যে আদব-কায়দাই না থাকে। সে পড়ালেখার এক পয়সার দাম থাকলো। এইযে বারবার আমি একটা জিনিস লক্ষ্য করছি। তুমি তনুজা..তনুজা বলছো। বড় ভাইয়ের বউকে কেউ এভাবে সম্বোধন করে। বলো আমায়?”

থেমে। শাসানোর সুরে ফের বলেন,

-” আর যেনো তোমাকে কখনো তনুজা..তনুজা বলে নাম ধরে ডাকতে না শুনি। বয়সে ছোট হলেও ও তোমার সম্মানে বড়। তাই এখন থেকে তুমি ওকে ভাবি বলে ডাকবা।”

দিব্যর রাগ তরতরিয়ে আকাশসম হলো। রা”গ করে চেয়ারের পায়ায় লাথি দিয়ে সে হনহনিয়ে সিঁড়ি ভেঙে উপরে উঠতে থাকে। চেয়ারের শব্দ কিছুক্ষণ চতুর্দিকে ছড়াতে থাকল। দিব্যর উপর রুষ্ট হয়ে নুরজাহান আফসোস করে বলেন,

-” দুই দু’টো নাতীর একটাও মনের মতো হয়নি। একজন তো হয়েছে রোবট। অরেকজন হয়েছে রাগের খনি। কিছু বললেই তিনি ভাং/চুর শুরু করে দেয়। উফ্!”

তনুজা পাথর বনে দাঁড়িয়ে আছে। তনুজা আর ‘রা’ শব্দটিও করে না। সে অসাড়ের মতো শরীর নিয়ে উপরে যায়। করিডোর দিয়ে যাচ্ছিল তনুজা এমন সময় পিছুন থেকে ডাক আসলো,

-” তনুজা?”

তনুজার পা দু’টো থেমে যায়। তবে তনুজা পিছন ফিরে তাকায় না। আর কোন সাড়াও দেয় না। দিব্য অস্থির চিত্তে বলল,

-” তনু আমার তোমার সাথে কিছু কথা আছে। তুমি সবসময় আমার থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছো। তোমার সাথে কথা বলার স্কোপই পাচ্ছি না। তুমি আমাকে খুলে বলো। সেদিন একচুয়েলি কী হয়েছিল! আমি শুরু থেকে শেষটা শুনতে চাই। তোমার যতটুকু মনে আছে ততটুকুই বলো। দেখি কোনো ক্লু পাওয়া যায় কীনা।”

দিব্যর দিকে পিঠ করে উল্টো দাঁড়িয়ে তনুজা । দীর্ঘশ্বাস ফেলে প্রত্যুত্তরে বলে,

-” কী দরকার এখন আর এসব জেনে! কী লাভই বা! যা ক্ষ/তি হওয়ার তা তো হয়েই গিয়েছে। এখন আসল হাজারটা সত্যি সামনে এলেও এই ক্ষ/তি তো পুষাবে না। এই অসুস্থ সম্পর্ক থেকেও তো আর বেরুনো যাবে না। তাই বাদ দাও।”

-” আমি সত্যিটা বের করতে চাই। ইভানের মুখোশ উন্মোচন করতে চাই। তুমি আমায় হেল্প করো তনু।”

তনুজা মনে মনে তাচ্ছিল্য হাসে। ধরে আসা গলায় বলে,

-” এই বিয়েটা হওয়ার আগে তোমার এসব বলা উচিত ছিলো। এখন হাজারটা সত্যি সামনে আসলেও এই বিয়েটা মিথ্যে হয়ে যাবে না। তাই আমি আর এসব নিয়ে কিচ্ছু ভাবতে চাই না। আর দিব্য তোমাকে রিকোয়েস্ট করছি, তুমি যখন-তখন এভাবে আমার সামনে এসো না। সেদিন আন্টি তোমার সামনেই তো বলল। আর যে কেউ দেখলে আমাকে দোষারোপ করবে। সব দোষ তো হয় মেয়েদের। ছেলেদের তো কোনই দোষ থাকে না।”

দীর্ঘশ্বাস ফেলে তনুজা। থেমে থেমে বলতে থাকে,

-” জানি না আমি নিজেকে কতটা গুছিয়ে নিতে পারব। তবে চেষ্টা করব। আর দিব্য একজন শুভাকাঙ্ক্ষী হিসেবে বলছি, প্লিজ আমায় ভুলে যাও। গ্রো আপ করো। জীবন কখনো থেমে থাকে না। সময়ের সাথে সাথে জীবন তার নিজস্ব ছন্দে চলতে থাকে। তুমি আমার থেকেও বেটার কাউকে ডিজার্ভ করো। হয়তো তোমার জন্য সামনে ভালো কিছুই আছে। তাই অযথা আমাকে নিয়ে ভেবে সময় ন’ষ্ট না করে, নিজেকে গুছিয়ে নাও। সুন্দর একটা ভবিষ্যতের প্রত্যাশা রাখো।”

দিব্যকে আর কোন কথা বলার সুযোগ না দিয়ে তনুজা লম্বা কদম ফেলে প্রস্থান করে। রুমে গিয়ে দরজা বন্ধ করে অমনি নিচে বসে পরে। আটকানো কান্নারা এবার বাঁধ ভাঙ্গে। মৃগ আঁখি জোড়া থেকে নোনতা জলের ফোয়ারা নীরবে ঝরতে থাকে।

__________

কে’টেছে আরো একটা দিন। আজ শুক্রবার। তনুজা-ইভানের মধ্যে কোনো কথাই হয় না বলা চলে। রোজকার মতো রাত করে বাড়ি ফেরে ইভান। তনুজা ঘুমিয়ে পরে। সারাদিন তো সে বাড়িতেই থাকে না।

আজকে অফ-ডে হওয়ায় সারাদিন ইভান বাড়িতে আছে। সকালের কাজ শেষে ও রুমটাতে ইভান থাকায়, রুমে সময় কাটাতে তনুজার কেমন অস্বস্তি লাগছিলো। ইভান বিছানায় শুয়ে-বসে ছিলো সেই সময়টায় তনুজা বেশিটা সময় ব্যালকনিতে কাঁটায়।

এখন বিকেল। তনুজা নিতি আর নৃত্যর সাথে লিভিংরুমে বসে। রুমে ইভান আছে বিধায় তনুজা এখন এখানে আছে। তাছাড়া কাজের সময়টা ছাড়া সে রুমেই একলা থাকে বেশি। নৃত্য সিরিয়াল দেখছে। নিতি নেইল কা°টা°র দিয়ে নখগুলো খুব যত্ন সহকারে কা°ট°ছে। আর মাঝেমধ্যে তনুজার সাথে কথা বলছে।

-” ভাবিমণি তুমি এবার কোন ইয়ারে? আর কোন ডিপার্টমেন্টে?”

-” থার্ড ইয়ারে। বোটানি।”

-” ওও। তাহলে তো তুমি আমার থেকেও বয়সে ছোট। আমি ফাইনাল ইয়ারে। আর আমি বাংলার ছাত্রী।”

-” ও তাই! ভালো।”

-” তোমাকে একটা কথা বলি। নানুআপু যাই বলুক না কেনো। তুমি ইভান ভাইয়াকে বলো। আমার মনেহয় ভাইয়া রাজি হবে, ভাইয়া অনেক ব্রিলিয়ান্ট স্টুডেন্ট ছিলো। সে মনেহয় তার দিদুনের বিরুদ্ধে গিয়েও তোমার পড়াশোনা কনটিনিউ করতে বলবে। তুমি নানুআপুর কথায় কান না দিয়ে ভাইয়ার সাথে ডিসকাস করো, কেমন?”

তনুজা হ্যা-হু কিছুই বলে না। এরমধ্যে তামান্না এসে সোফায় বসে অর্ডার করলেন,

-” তনুজা! এক কাপ চা আনো তো।”

তনুজা তৎক্ষণাৎ উঠে কিচেনে চলে যায়। সিরিয়ালে কাজের বুয়ার চু/রির একটা সীন চলছিল। সেই সময় আচমকা নৃত্য নিতির দিকে তাকিয়ে বলে,

-” মাম্মা তো পরশু আমাকে সবার সামনে ধ’ম’ক দিলো বলে আর বলা হলো না। এখন এই সীনটা দেখে আমার আবার মনে পড়ল।”

নিতি বিরক্ত হয়ে বলে,

-” এতো কাহিনী বাদ দিয়ে কী বলবি বল। জলদি বল। এতো দৃশ্যপট টানা লাগবে না। সরাসরি বলে ফ্যাল।”

এবার নিতির দিকে আরেকটু চেপে বসে নৃত্য। ফিসফিসিয়ে বলে,

-” জানো আপু, সেদিন আমি কোচিং থেকে ফিরছিলাম। আমাদের বুয়াকে দেখি একটা জুয়েলারি শপ থেকে বেরুতে।”

নিতির কপাল এবার বি’র”ক্তিতে আরো কুঁচকে আসলো।

-” তোহ! হয়েছে টা কী? তার কী জুয়েলারি শপে যাওয়া বারণ আছে নাকি!”

মাছি তাড়ানোর ভঙ্গিতে বলে নৃত্য,

-” ধূর! আরে পুরো কথা তো শোনো আগে। আগের দিন বুয়াকে জুয়েলারি শপ থেকে বেরুতে দেখলাম। তারপর পরের দিনই দেখি তার গলায় মোটা স্বর্ণের চেইন চকচক করছে। এখনো লক্ষ্য করে দেখবা বুয়ার গলায় মোটা স্বর্ণের চেইন। যা কীনা এর আগে দেখিনি।”

কাঁধ ঝাঁকিয়ে নিতি বলে,

-” কিনেছে। সিম্পল।”

নৃত্য নাকমুখ কুঁচকে বলল,

-” মোটেও সিম্পল নয়। ক’দিন আগেই। তিন সপ্তাহ খানেক হবে মেবি। ছেলের সামান্য একটা অপারেশনের জন্য পনের হাজার টাকা চেয়ে মামীর কাছে কেঁদে পড়লো বুয়া। চোখের জল, নাকের জল এক করে সে কি কান্না। মামী বেতন ছাড়াও বুয়াকে অপারেশনের পুরো টাকা দিলো। এখন স্বর্ণের যে দাম, জানোই তো। তাহলে এখন চেইন কেনার টাকাটা পেলো কোথায়!”

নিতি ভাবুক ভঙ্গিমায় বলে,

-” তুই কী বলতে চাইছিস, বুয়া নিজের টাকায় চেইন কিনেনি। অন্যের টাকায়, ইউ মিন চু/রি -টুরি করেছে।”

-” হয়তো! ডাল ম্যা কুচ কালা হে!”

নিতি ছোট বোনের মাথায় চা’টি দিয়ে বলে,

-” সিরিয়াল দেখতে দেখতে সব সময় শুধু আ’জা’ই’রা চিন্তা ভাবনা তোর মাথায় ঘুরপাক খায় । তোর তো কিছু চু/রি হয়নি। হয়নি তো? তাই এসব আলতু-ফালতু চিন্তা বাদ দে। আর বুয়ার গুছানো টাকা থাকতেই পারে।”

নৃত্য মুখ ভেঙিয়ে সিরিয়াল দেখায় মনোযোগ দেয়। তন্মধ্যেই তনুজা চায়ের কাপ এনে তামান্নার দিকে বাড়িয়ে দেয়,

-” ফুপি আপনার চা।”

তামান্না হাতে নিয়ে চায়ের কাপে চুমুক দিয়ে থু থু থু করে উঠলেন। নাক মুখ কুঁচকে ফেলেন সে। চায়ের কাপটা সামনের কাঁচের টি-টেবিলের উপর শব্দ করে নামায়। উতলিয়ে কিছু চা কাপের গা ভেসে টেবিলে পরে। তামান্না রুঢ় স্বরে বলেন,

-” এটা কী বানিয়ে এনেছো তুমি, হ্যাঁ? তুমি জানো না, আমি চিনি ছাড়া চা খাই। আমার সুগার আছে। চিনি দেওয়া চা আমি খাইনা।”

মায়ের এহেন বিহেভে দুই বোন হতাশ হলো। তনুজার মুখটা একদম মলিন হয়ে যায়। দিঘির জলের মতো শান্ত স্বচ্ছ চোখ দু’টো ছলছল করে উঠে। তনুজা ম্লান স্বরে আওড়ায়,

-” স্যরি! আসলে আমি জানতাম না। আমি আবার বানিয়ে আনছি।”

-” যত্তসব! কোনো কাজেরই না।”

তামান্না মুখ কালো করে বলে। সামান্য একটা বিষয়। এভাবে না বলে একটু সুন্দর করেও তো বলা যেতো। এটাভেবে তনুজার বড্ড অসহায় ঠেকলো। তনুজা ভগ্ন হৃদয় নিয়ে টেবিল থেকে চায়ের কাপ হাতে তুলতে থাকে। এমন সময় গম্ভীর গলার আওয়াজ শুনে মাথা তুলে তাকায় তনুজা।

-” তনুজা? আমি নিচে ওয়েট করছি, তুমি জলদি রেডি হয়ে আসো। কুইক।”

সিঁড়ির নিচের ধাপে দাঁড়িয়ে ইভান। নীল রঙের ডেনিম প্যান্ট, সাদা আর কালোর দাগকাটা টিশার্ট পরনে। হাত দু’টো প্যান্টের পকেটে গুঁজে সটান দাড়িয়ে। বাইরে যাবে বলে নিচে নামছিলো। সিঁড়ি দিয়ে নামতে গিয়ে ফুপির কথা আর আচরণ সবটাই নজরে পরে তার। ইভানের এই একটা জিনিস খুব খা°রা°প লাগে। সে একদম সয্য করতে পারে না। সে যেই হোক না কেনো। কাউকে অবহেলা করা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য করা। তনুজার সাথে নিজের ফুপির এহেন বা’জে আচরণে ইভানের প্রচন্ড রাগ হয়। ফুপির উপর অসন্তুষ্ট হয়। ফুপির বদমেজাজ স্বভাবের জন্য শ্বশুর বাড়িতে মিলেমিশে থাকতে পারে না। তাই তো বিয়ের কয়েক বছর পর থেকেই এবাড়িতে ঘাঁটি গেড়েছে। তবে ফুপাটা অমায়িক স্বভাবের। ফুপার জীন মেয়ে দুইটা পেয়েছে। যার দরুণ দুই বোনের ব্যবহার অমায়িক আর মিষ্টি। তনুজা ঘাড় ঘুরিয়ে ইভানের দিকে বোকা বোকা চোখে তাকায়। সে প্রশ্ন করে উঠল,

-” র রেডি হয়ে আসবো! মানে?”

ইভান নির্লিপ্ত কণ্ঠে বলল,

-” শপিংয়ে যাবো। দিদুন পরশু বলল। আজ আমি ফ্রি আছি তাই এক্ষুনি চলো।”

তনুজা বিরোধীতা করে বলে,

-” লাগবে না কিছু। আছে সব কিছু।”

-” কি আছে, কী নেই? আমি সেসব শুনতে চেয়েছি? এতো কথা বলা বাদ দিয়ে, আমি যা বললাম ফাস্ট তাই করো।”

তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে হাতে থাকা কাপের দিকে একবার তাকায়। ফের খানিকটা দূরত্বে দাঁড়ানো ইভানের দিকে তাকিয়ে বলে,

-” ফুপিকে চা দিয়ে আসছি।”

ইভান জলদগম্ভীর স্বরে বলে,

-” বুয়া আছে, সে দিবে। আর নয়তো যার যেমনটা পছন্দ তেমন করে নিজেই বানিয়ে নিবে। হাতের কাপ ওখানেই নামিয়ে রাখো তুমি। আমার হাতে সময় নেই। তুমি ফাইভ মিনিটসের মধ্যে রেডি হয়ে আসো।”

তনুজা আইগুই আইগুই করতে থাকে। ইভান গলার স্বর চড়িয়ে বলল,

-” বাংলা কথা বুঝতে পারোনি? এখনো ওভাবে দাঁড়িয়েই যে আছো। হাত থেকে কাপটা ওখানেই নামাও। এন্ড গো ফাস্ট।”

তনুজা এবার একটু কেঁপে উঠল। তামান্না মনেমনে অপমানিত বোধ করে। ওরা দুইবোন না শোনার ভান ধরে আছে। নিতি নখে নেইলপলিশ লাগাচ্ছে আর মিটমিট করে হাসছে। তনুজা কাঁপা কাঁপা হাতে চায়ের কাপ টি-টেবিলে নামিয়ে রাখে। তারপর রুমে যায়। তামান্না রাগে সাপের মতো ফুঁসছে। ইভান কী তার বউয়ের দিয়ে কাজ করতে দিবে না বলে নীরব প্রতিবাদ জানালো। ভাইপোর বউয়ের প্রতি আদিখ্যেতা দেখে পিত্তি জ্ব’ল’তে থাকে তামান্নার।

তনুজার সাথে তামান্নার এরুপ বিহেভ দেখে ইভানের মেজাজটা খা’রা’প হয়। বাড়ির কারো, কোনো ব্যাপারেই সে মাথা ঘামায় না। কিন্তু আজ তনুজার সাথে রুঢ় আচরণ দেখে নিজেকে দমিয়ে রাখতে পারল না। তনুজার আর তার সম্পর্কটা স্বাভাবিকও নয়। সরাসরি কিছু বলে ডাকতেও পারছিলো না ইভান। তাই শপিংয়ে যাওয়ার কথা বলে তনুজাকে দ্বিতীয়বার চা বানানোর সুযোগ দেয় না ইভান। এটা ছিলো তার দিক হতে ফুপির প্রতি নীরব প্রতিবাদ।

ইভান সিঙ্গেল সোফায় পায়ের উপর পা তুলে বসে ফোন স্ক্রল করছে। তনুজা রেডি হয়ে এসে দাঁড়াতেই ইভান বসা থেকে উঠে দাঁড়ায়। কিছু না বলেই পা চালায় সে। তনুজা বিরস মুখাবয়ব করে পিছুপিছু যেতে থাকে। নিতি মাত্র নখে দেওয়া নেলপলিশে ঠোঁট গোল করে ফুঁ দিয়ে ওদের দুজনকে একপল দেখে। তনুজার গায়ে অলিভ কালারের শাড়ি। বেশ দারুণ লাগছিলো। নিতি পিছন থেকেই চেঁচিয়ে বলে,

-” ওয়াও! দারুণ লাগছে ভাবিমণি! তোমাদের দু’জনকেই। তোমরা তো দেখছি দারুণ শ্যাম কাপল! সুন্দর!”

অন্দর মহলের মেইন ফটক দিয়ে ঢুকতেই ইভান আর তনুজাকে দেখতে পায় দিব্য। ইভানের পিছনে তনুজা। দেখেই বোঝা যায়, কোথাও যাচ্ছে হয়তো। রা’গি দিব্যর রাগ মূহুর্তেই আকাশ ছুঁইয়ে যায়। তারপর নিতির কথা কানে যেতেই মেজাজ আরো তিরিক্ষি হয় তার। পরপর আঙুলের ডগায় থাকা বাইকের চাবি হাতের মধ্যে মুষ্টিবদ্ধ করে নেয় দিব্য। ইভান দিব্যকে দেখেও না দেখার মতোন তাকে পাশ কাটিয়ে চলে যেতে থাকে। তনুজা একবার ডানদিকে তাকায়। দিব্যর চোখে চোখ পড়তেই তড়িৎ মাথা নিচু করে নেয়। সাথে পায়ের গতি বাড়িয়ে দেয়। দিব্য ঘাড় ঘুরিয়ে একদৃষ্টে তাকিয়ে ওদের দু’জনের যাওয়া দেখতে থাকে। রাগে-ক্ষোভে ফেটে পরে দিব্য। দিব্যর রাগি-জেদি মনমস্তিষ্ক তৃষার কথা মনে করিয়ে দেয়। সে কী করবে ভাবতে থাকে! ইভানের পুরানো ক্ষ/ত দগদগে করার জন্য সে কী তৃষাকে এই বাড়িতে আনবে!

#চলবে