প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-১১

0
134

#প্রণয়ের_বাঁধন |১১|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

সন্ধ্যা পেরিয়ে রাতের আঁধার নেমেছে অনেকক্ষণ আগেই। মির্জা বাড়ির লিভিংরুমে বসে আছে শিরিন, তামান্না আর তার দুই মেয়ে। গল্পের আসর জমেছে। গমগমে অবস্থা লিভিংরুম জুড়ে। মাগরিবের নামাজ শেষে দীর্ঘক্ষণ তাসবিহ পাঠ করে জায়নামাজ ছেড়ে ধীর পায়ে হেঁটে সেখানে উপস্থিত হোন নুরজাহান বেগম। মুখে তার গম্ভীরতার ছাপ। এসে নিজের জন্য বরাদ্দকৃত রাজকীয় সিঙ্গেল সোফায় বসলেন। নিতি-নৃত্য দুই বোন ফোন স্ক্রল করছে আর একে অপরকে কিছু দেখিয়ে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। নুরজাহান অসন্তোষ চাউনিতে সেদিকে তাকালেন।

-” নামাজ-কালাম নেই। সারাক্ষণ কি একটা যন্ত্র পাইছে তাই নিয়ে পড়ে থাকে। কী যে আছে ওর মধ্যে তা আল্লাহ মালুম! আর এদের বলে কী লাভ! মায়েরা ঠিকমত শাসন করে না। দুইদিনের বাচ্চার হাতে তুলে দেয় মোবাইল। তারা তো এতে আ°স°ক্ত হবেই।”

মনেমনে আওড়ায় নুরজাহান বেগম। তন্মধ্যে ভাবনার সুতোয় টান পরে মেয়েলি কোমল স্বরের ডাকে।

-” দিদুন!”

ভাবনা থেকে বেরিয়ে পরপর পাশে তাকাতেই চায়ের কাপ হাতে দাঁড়িয়ে তনুজাকে দেখতে পায়। ভাসাভাসা শান্ত দু’টো চোখ। গোধূলির অস্তমিত সূর্যের মতোন মুখ। কত সুন্দর মায়াবী সৌন্দর্যে জড়ানো একটা মুখশ্রী। অথচ তার আড়ালে কোথাও যেন তীব্র বেদনা-বিষাদ লুকিয়ে আছে। মেয়েটা কেমন সবসময় ম্লান মুখে থাকে। বৃদ্ধার এই মেয়েটার প্রতি আলাদা একটা মায়া হয়। তবে বাইরে কাঠিন্য ভাব বজায় রাখা যেন তার ধাতে। তাই চাইলেও মমতাটা সহজেই প্রকাশ করতে পারেন না। তনুজা মিহি গলায় বলল,

-” দিদুন আপনার আদা চা।”

-” হু।” বলে হাত বাড়িয়ে কাপটা নিলেন। চায়ে চুমুক বসিয়ে শুধোলেন,

-” তা তোমার দাদির শরীর এখন কেমন? জ্বর-টর কমেছে? নাকি আছেই? ঠিকমতো ঔষধ খাচ্ছে তো?”

সকাল দশটার মধ্যেই ইভান-তনুজা চলে এসেছিলো। ইভান ত্রস্ত ফ্রেশ হয়ে অফিসে চলে যায়। তনুজা উত্তরে বলে,

-” জ্বর সেরেছে। হালকা ঠান্ডা আছে ঔষধ নিচ্ছে। এখন আলহামদুলিল্লাহ ভালো আছে।”

-” কালকে রাতে দাদুভাইকে জোর করে থাকতে বলেছিলাম। সে সাধারণত আমার কথা ফেলে না। তাই রাজি হয়েছিল। তা থাকার জন্য এই নিয়ে তোমার উপর রাগ দেখায়নি তো আবার, চোটপাট করেনি তো?”

তনুজা ঘাড় নাড়িয়ে বলে,

-” কই না তো! তেমন কিছুই বলেনি।”

-” আচ্ছা।”

পরপর তনুজা পাস্তা, পকোড়া আর পিঁয়াজুর ট্রে এনে টি-টেবিলের উপর রাখল। শিরিন সুলতানা আর তামান্না পাশাপাশি বসে ছিলো। তনুজা নাস্তা রেখে চলে যেতে নিবে সেইসময় শিরিন আদূরে গলায় বলেন,

-” তনুজা? কোথায় যাচ্ছো? বসো তুমি।”

তনুজা হালকা হাসার চেষ্টা করে বলে,

-” আন্টি আপনারা নাস্তা করুন। আমি রুমে যাচ্ছি, একটু কাজ ছিলো।”

শিরিন অমায়িক হেসে বলেন,

-” বসতো। পরে করে নিও। এখানে সবাই আছে। একসাথে নাস্তা করো।”

অগত্যা তনুজা নিতির পাশে বসে। নুরজাহান গলা খাঁকারি দিয়ে বলে উঠলেন,

-” আন্টি কী? আমরা তো শাশুড়িদের মা ডেকেছি। আর চাচি শাশুড়িদের চাচিমা ডেকেছি। তোমার নিজের শাশুড়ি নেই। তবে ছোট বউমা ইভানের মায়ের থেকে কম নয়। ইভান তাকে মামণি বলে ডাকে। তুমিও তাই বলবা। এই কাছের মানুষদের আন্টি ডাকা কেমন যেনো পরপর ঠেকে আমার কাছে।”

কিছুক্ষণ পর,, সবাই যখন স্ন্যাকস করতে ব্যস্ত। এমন সময়। দিব্য গটগট পা ফেলে সিঁড়ি ভেঙে নামছে। আঙুলের মাথায় তার বাইকের চাবি। নিচে নামতে গিয়ে সবার মাঝে বসে থাকা তনুজার দিকে নজর পরে। কোণা চোখে তনুজাকে পরখ করে সে যাচ্ছিল। হঠাৎ দিদুনের ডাকে তার পা থেমে যায়। দিদুন হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,

-” দিব্য? দাদুভাই কোথায় যাচ্ছো?”

-” বাইরে। কাজ আছে।”

দিদুন ত্যাড়া করে বললেন,

-” বাইরে যাচ্ছো সে তো দেখতেই পাচ্ছি। তবে কাজে নয় বলো অকাজে যাচ্ছি। কাজ তো তোমার একটাই বন্ধুদের সাথে আড্ডা দেওয়া, কেনাকাটা করা, সবাইকে রেস্টুরেন্টে নিয়ে খাওয়ানো। এককথায় ফুটানি করে বেড়ানো। তা সবাইকে খাওয়াও ঠিক আছে। কিন্তু আর কতদিন বাপের টাকায় ফুটানি করে বেড়াবে। এবার নিজে কামাই- রুজি করো। তাই দিয়ে __”

এমনিতেই ইদানিং মেজাজ একটু বেশিই চটে থাকে তার। আর দিদুনের সাথে কথা বলতে গেলে হুরহুর করে মেজাজ একলাফে পাঁচগুণ বেড়ে যায়। দিব্য ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলে,

-” অন্য কিছু বলার থাকলে তাড়াতাড়ি বলো। শুধু শুধু মেজাজ বিগড়ে দিও না।”

দিব্যর উপস্থিতি টের পাওয়ার সাথে সাথেই তনুজা নিজেকে শামুকের মতো গুটিয়ে নেয়। দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ করে জড়সড় হয়ে আছে সে। নিতির দৃষ্টি আঁটকে আছে দিব্যর পানে। সাদা টিশার্ট গায়ে উপরে আকাশি রঙের শার্ট। শার্টের সবগুলো বোতাম খোলা। ফ্যানের বাতাসে শার্ট বাতাসে উড়ছে। আকাশি গ্যাবার্ডিন প্যান্ট, সাদা কেডস। নিতি যেনো পুরাই ফিদা। পলক নড়ছে না তার। দিদুন গলার স্বর কিঞ্চিৎ নামিয়ে বললেন,

-” এসো দাদুভাই নাস্তা করবে। সবাই নাস্তা করছে।”

দিব্যর ইচ্ছে ছিলো না। তবে কেনো জানি দ্বিরুক্তি না করে এগিয়ে গেল। মায়ের পাশের ফাঁকা আসনে ধপ করে বসলো। দিব্যর ঠিক সামনাসামনি তনুজা। যেকিনা পায়ের আঙুল দিয়ে ফ্লোর খুঁটছে, আর ভেতরে ভেতরে হাঁসফাঁস করছে। দিব্য ঠোঁট কামড়ে কোণা চোখে তনুজাকে লক্ষ্য করছে। দিদুন ফের বললেন,

-” তা বলি কী দাদুভাই। ভবঘুরে জীবন যাপন না করে। তুমিও অফিসে যাও। বাপ- ভাইয়ের সাথে ব্যবসা সামলাও।”

বেশ আদুরে গলায় দীদুন বলে। উপস্থিত সবাই ভেবেছিল দিব্য রেগে যাবে, ক্ষেপে কিছু বলবে। তবে সবাইকে ভুল প্রমাণ করে দিব্য পিঁয়াজু মুখে পুড়ে নেয়। শান্ত গলায় বলে,

-” আমি বিসিএস দিবো। প্রস্তুতি নিচ্ছি। অফিসে জয়েন করা সম্ভব নয় আমার পক্ষে।”

দিদুন দীর্ঘশ্বাস ফেললেন। হঠাৎ মশকরা করে বললেন,

-” আচ্ছা যা ভালো বুঝো করো। তবে একটা কর্ম তো করতে হবে। বিয়ে-শাদি করতে হবে না। তবে দাদুভাই তোমাকে নিয়ে আমি তো চিন্তায় আছি। তোমার যে মেজাজ। তোমার রাগ-ধার সয্য করে কোন মেয়ের পক্ষে থাকা একটু নয় অনেক বেশিই অসম্ভব। তাই বলছি রাগটা একটু কমাও। তা না হলে বউ থাকবে না। আর আমাদের সময় পাওনি যে স্বামীর মুখ ঝামটা, ধ’ম’ক খেয়েও পরে থাকবে। এখনকার সময় কিন্তু পুরো আলাদা। তাই আগেই সাবধান করছি মেজাজটা ঠান্ডা রাখার চেষ্টা করো।”

দিব্যর কপালে স্পষ্ট বিরক্তির রেখা। তবে কিছু বলে না সে। নিতি উঠে গিয়ে নুরজাহানের সোফার হাতলের উপর বসে। দুইহাতে গলা জড়িয়ে ধরে বলে,

-” জানো নানুআপু। সাইকোলজি বলে, যদি কোনো ব্যক্তি ঘনঘন রেগে যায়। তাহলে বুঝতে হবে , তার জীবনে ভালোবাসার মানুষের প্রয়োজন। এইযে আমাদের ছোট মির্জা সবসময় রাগি মুডে থাকে এর একমাত্র কারন হলো, তার জীবনে ভালোবাসার মানুষের বড্ড অভাব। তাই বলছি তাকে তাড়াতাড়ি বিয়ে দিয়ে দাও। আর হ্যা একটা ধৈর্যশীল মেয়ে খুঁজে বের করতে হবে। সাত চ’ড় দিলেও যে রা করবে না। আর কোনকিছু যার গায়ে সহজে লাগে না। বকলেও হেসে উড়িয়ে দিবে, গায়ে মাখবে না।”

দিব্য নিতির দিকে চোখ গরম করে চাইল। নিতি মুখ ভেংচি কা’টে। ওদিকে নৃত্য কপাল কুঁচকে সরু চোখে তাকিয়ে বলল,

-” আপু তুমি কী ইন্ডিরেকটলি তোমার নিজের কথা বললে?”

নিতি খুকখুক করে কেশে উঠলো। নৃত্য বিজ্ঞের মতোন মুখাবয়ব করে বলতে থাকে,

-” না মানে স্বয়ং তুমি নিজেই তো এই গুণসম্পন্ন। এই যে মাম্মা নিজেই বলে, তোমার গায়ে গন্ডারের চামড়া। হাজার ব’কে বললেও গায়ে লাগে না তোমার।

নিতি থতমত খায়। তার এই বোনটা হয়েছে আরেক পাকনা। সবকিছুতেই তার গোয়েন্দাগিরি স্বভাব। নিতি চোখ পাকিয়ে বোনের দিকে তাকায়। বোনের কান মলে দিতে ইচ্ছে করছে। ইশশ্! কী বেইজ্জতি! ক্রাশের সামনে কীনা তাকে এমন করে পঁচালো! তার নাকি গ’ন্ডা’রের চামড়া। এই রাগে-ক্ষোভে নিতির কচু গাছের সাথে ফাঁস দিতে ইচ্ছে করছে। পরপর নিতি নিজের মাথায় মনেমনে চাটি মা/রে । ফাঁস দেওয়ার জন্য সে আর গাছ পেলো না। কচু গাছ! নিতি পরপর সোজা হয়ে বসে অল্প স্বল্প কপট রাগ দেখিয়ে বলে,

-” নৃত্য! বেশি বেশি হচ্ছে কিন্তু। আমাকে বলছিস তুই নিজে কী? মাম্মা যখন তোকে ব’কে। তখন কত কী বলে? বলব বলব, এখন সবার সামনে।”

নৃত্যর মুখটা এবার চুপসে যায়। দিব্য সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে দুইহাতে শার্টের কলার টেনে ঠিক করতে করতে আয়েশ করে বসে। মুখের খাবার চিবুতে চিবুতে তনুজাকে দেখছে সে। তনুজা কতক্ষণ এদিকে না তাকিয়ে ওভাবেই দৃষ্টি নত করে থাকতে পারে সেও দেখতে চায়। দিব্যর খুব জানতে ইচ্ছে করে, তনুজা কী ইভানকে মেনে নিয়েছে? দিব্যর প্রতি তার কী আর কোনই অ্যাফেকশন নেই? এই ক’দিনেই সব দূর্বলতা উবে গিয়েছে কী? নাকি তনুজা দিব্যর থেকে পালাই-পালাই করে পরিস্থিতির জন্য।

ওদিকে তনুজার হাঁসফাঁস বাড়ছে বৈ কমছে না। তনুজার সিক্স সেন্স বলছে দিব্য তার দিকেই তাকিয়ে আছে। তনুজা বড়বড় শ্বাস ফেলে ফট করে উঠে দাঁড়ায়। জোর করে নিজেকে স্বাভাবিক রাখার চেষ্টা করে ঠোঁট আওড়ায়,

-” ইয়ে আমি তো ভুলেই গেছি। সন্ধ্যার দিকে দাদির কাছে ফোন করার কথা ছিলো। দাদি নিশ্চয় অনেকবার কল দিয়েছে। আমি আসছি।”

কতটা গুছিয়ে মিথ্যে বলতে পেরেছে তা জানে না তনুজা। তবে এখান থেকে উঠার জন্য মিথ্যে বলে প্রস্থান করে। তনুজার যাওয়া দেখে দিব্য রাগে ভেতরে ভেতরে হিসহিস করে। টেবিলের উপর থেকে পানির গ্লাস নিয়ে এক ঢোকে গ্লাস ফাঁকা করে। তারপর শব্দ করে গ্লাসটা টেবিলের রেখে হনহনিয়ে বেরিয়ে যায়। দিব্যর এহেন আচরণে কেউ অবাক হয় না। কারন মির্জা বাড়ির ছোট ছেলে সাফওয়ান দিব্য মির্জার এই স্বভাবের সাথেই সবাই অভ্যস্ত।

তামান্না ফোনের গ্যালারিতে গিয়ে একটা ছবি বের করে শিরিনের সামনে ধরে,

-” ভাবি দেখো তো ছেলেটা কেমন? নিতির সাথে কেমন মানাবে?”

কালো-সাদা শার্ট প্যান্ট ইন করে পড়া। উপরে সাদা এপ্রোন গলায় স্টেথোস্কোপ ঝুলানো। লম্বা-চওড়া বেশ সুদর্শন এক যুবকের ছবি। শিরিন মৃদু হেসে বলে,

-” বাহ্, সুন্দর তো। নিতির সাথে বেশ মানাবে।”

তামান্নার মুখের হাসি প্রশস্ত হলো।

-” নিতির বাবার বন্ধুর ছেলে। ছেলে সদ্য এমবিবিএস পাশ করেছে। কিছুদিন পর ইউকে যাবে। ফ্যামেলি ব্যাকগ্রাউন্ড ভালো। ওনারা নিতিকে চেনে। নিতির বাবাকে নাকি বলেছে ছেলের জন্য নিতিকে দেখতে আসবে। ছেলের বিদেশে যাওয়ার আগেই বিয়েটা দিতে চান।”

পূর্ণিমার চাঁদে যেনো গ্রহণ লাগলো। নিতির ফর্সা মুখে তৎক্ষণাৎ অন্ধকার নামে। সে উঠে দাড়িয়ে কাটকাট গলায় বলে,

-” ওহ্! মাম্মা আমি এক্ষুনি বিয়ে করতে পারব না। আমি মাস্টার্স শেষ করবো, দেন বিয়ে-শাদি তার আগে নয়। সেখানে এখনো আমার অনার্সই শেষ হয়নি। তাই তাদেরকে নিষেধ করে দাও।”

এই বলে নিতি বড়বড় কদম ফেলে চলে যেতে থাকে। পিছুন থেকে কানে আসে,

-” মেয়ে যা তা না বলে। বিয়ের আগে এরকম বলেই। দিন যাচ্ছে বয়স তো কমছে না বাড়ছেই। ছেলে ভালো হলে জামাইকে কথা বলতে বল।”

নানুআপু মা’কে আরো উস্কাতে থাকে। নিতির ফুরফুরে মেজাজটা হুট করেই দিব্যর মতো খা’রা’প হয়ে গেলো। নিতি ভাবতে থাকে, তার কী দিব্যর ছোঁয়া লাগলো নাকি! তার তো হুটহাট রাগ হয় না। দিব্যর রেগে যাওয়া ব্যামোতে সেও আক্রান্ত হলো নাকি!

___________

পরেরদিন..সকাল সাড়ে আটটা বাজে। শাওয়ার নিয়ে আয়নার সামনে দাঁড়িয়ে শার্টের হাতা ফোল্ড করতে ব্যস্ত ইভান। তনুজা ত্রস্ত পায়ে রুমে আসে। আয়নায় দু’জনের চোখে চোখ পরে। স্কাই কালারের শার্ট আর কালো প্যান্ট ইনকরে পড়া। পরপর তনুজা দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়। তনুজা কিচেনে ছিলো হঠাৎ নৃত্য গিয়ে বলল,

-” ভাইয়া তোমাকে ডাকছে।”

তনুজা যারপরনাই অবাক হয়। ডাকছে? কিন্তু কেনো? তনুজা হাতের কাজ চালিয়েই যাচ্ছিলো। সেইসময় শিরিন তাড়া দিয়ে তনুজাকে উপরে যেতে বলে। তনুজা এখন কী বলে শুধাবে! ভেবে পাচ্ছে না। কীজন্যই বা ডেকেছেন? এই ভেবে দিশেহারা তনুজা। এরমধ্যে কালো হাতঘড়িটা হাতে পরতে পরতে ইভান বলে,

-” রেডি হয়ে নাও।”

তনুজা চোখ কপালে তুলে জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকায়। আমতা আমতা করে শুধোয়,

-” র রেডি হবো? কিন্তু কেনো? কোথায় যেতে হবে।”

ইভান নির্বিকার কণ্ঠে বলল,

-” কলেজে।”

তনুজা বোকা বোকা চোখে ইভানের পানে তাকিয়ে রয়। ইভান ম্যান পারফিউমটা পুশ করে গায়ে মাখছে। কিছু সময় নিয়ে তনুজা নির্বোধের মতো বলে ওঠে,

-” কলেজে মানে। কিন্তু কেনো?”

তনুজার দিকে ঘুরে দাঁড়ায় ইভান। দুই ভ্রুয়ের মাঝে ভাঁজ ফেলে বলে,

-” কলেজে কেনো যায় মানুষ?”

-” পড়াশোনার জন্য।”

-” তো তুমিও সেইজন্য যাবে।”

তনুজা এতক্ষণে বুঝল। তবে কিছু ভেবে সে দ্বিধায় পড়লো। ঠোঁট আওড়ালো,

-” ইয়ে মানে আপনার দিদুন তো কলেজে যেতে বারণ করেছেন। পড়াশোনা বাদ দিতে বলেছেন।”

-” দিদুন কী করেছে, কী বলেছে সেসব শুনতে চাইছি না। তুমি পড়াশোনা করতে চাও কীনা তাই বলো?”

বিস্ময়ে তনুজার চোখ কোটর থেকে বেরিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছে। সে তো পড়তেই চায়। কিন্তু তারজন্য এ বাড়িতে অশান্তি হোক তা সে চায় না। না জানি দিদুন আবার কী বলে! এই নিয়ে তার এক রাজ্যসমান ভয়ডর। দ্বিধাদ্বন্দ্বে থাকা তনুজা তাও সরল স্বীকারোক্তি দেয়। ঘাড় নাড়িয়ে হ্যা সম্মতি দেয়। ইভান তাড়া দেখিয়ে বলল,

-” দ্রুত রেডি হয়ে নাও। আমার সময় নেই। তোমাকে নামিয়ে দিয়ে আমাকে অফিসে যেতে হবে।”

-” আপনার দিদুন? উনি যদি রাগ করেন। না মানে উনাকে না বলেই। আগে একবার বলে নিলে ভালো হতো না!”

ইভান রুম থেকে বেরিয়ে যেতে যেতে বলে,

-” দিদুনের সাথে এ নিয়ে কথা হয়েছে আমার। তোমাকে অতো চিন্তা করতে হবে না। তুমি রেডি হয়ে নাও।”

তনুজা তাজ্জব বনে যায়। উনি কখন কথা বললো! আর যেচে নিজ থেকে! কীকরে সম্ভব!

সেদিন রাতে পড়াশোনা নিয়ে তনুজার দাদির কথা ইভান শুনেছিলো। তখন থেকেই মনেমনে ভেবেছিলো। বাড়িতে গিয়ে দিদুনকে বুঝাবে। সে চায় না, একটা মেয়েকে সংসারের ঘানি টানিয়ে পড়াশোনা বাদ দিতে জোর করা। একজন এডুকেটেড মানুষ কখনো এটাকে সাপোর্ট করবে না। তাই ইভান কাল রাতে বাড়ি ফিরে দিদুনের সাথে কথা বলে। সে তো সহজে রাজি হচ্ছিলো না। তবে অনেক করে বুঝিয়ে-সুঝিয়ে বলার পর রাজি হয়েছে। তবে শর্তারোপ করেছে, বাড়ির বউ বাসে ট্রামে করে যেনো যাওয়া আসা না করে। বাড়ির গাড়ি বা স্বয়ং ইভান যেনো তাকে পৌঁছে দেয়। ইভান অগত্যা রাজি হয়েছে।

.

খাওয়ার টেবিলে বসে নিতি আর নৃত্য দুইবোন কানেকানে ফিসফাস করছে। তাই দেখে নুরজাহান বেগম একটা ধ’ম’ক দিলেন। নিতি সোজা হয়ে বসে। নিতির মনে হচ্ছে বোন সত্যিই খুব বুদ্ধিমতি। আর বোন একজন ভবিষ্যত সিআইডি অফিসার হচ্ছে কনফার্ম। ঐ টুকো মাথাতে বোনের এত বুদ্ধি আসলো কই থেকে! তারা দুইবোন গোপন মিশনে নেমেছে। মিশনে সাকসেস হলে সবার সামনে পর্দা উন্মোচন করবে। এক্ষেত্রে পুরো ক্রেডিট আসলে নৃত্যর।

নাস্তা করার সময় তনুজা আড়ালে নুরজাহান বেগমের দিকে চাইল। দিদুনের মুখটা বেশ গম্ভীর। তনুজা বুঝতে পারলো দিদুন মন থেকে রাজি হয়নি। নির্ঘাত ইভান জোর করে রাজি করিয়েছে। নুরজাহান মুখটা অন্ধকার করে বলেন,

-” শোনো মেয়ে! পড়াতে দিচ্ছি বলে আবার সাপের পাঁচ পা দেখো না। তুমি এবাড়ির বড় বউ। এবাড়ির মানসম্মান তোমার সাথে জড়িয়ে আছে। এমন কিছু কখনো করো না যাতে করে মানসম্মান খুইয়ে যায়। কলেজে যাচ্ছো যাও। তবে কোন বে/ল্লেপনা করেছো এসব খবর যেনো ভুলেও কানে না আসে। সাবধান করে দিলাম। আর হ্যা দাদুভাই অফিস যাওয়ার পথে দিয়ে আসবে। আর ছুটির আগে কল করো বাড়ির গাড়ি বা দাদুভাইই গিয়ে নিয়ে আসবে।”

_____________

অনেকদিন পর কলেজের ক্যাম্পাসে পা দিয়ে প্রাণ ভরে শ্বাস নেয় তনুজা। প্রিয় বান্ধবীর সাথে ক্লাসে যেতে থাকে সে। পরপর দুইটা ক্লাস শেষ হয়। আর একটা ক্লাস আছে। শেষ ক্লাস নেয় নতুন জয়েন করা মিস। রুপা এক্সাইটেড হয়ে বলতে থাকে,

-” জানিস তনু! মাইকোলজি নিউ মিস না খুব স্মার্ট। সুন্দরী। এক্কেবারে ডানাকাটা পরীর মতোন। ছেলেরা তো একেকটা মিসের উপর ক্রাশ খেয়ে বসে আছে। পড়া বুঝা বাদ দিয়ে অধিকাংশ ছেলেরা হা করে তাকিয়ে থাকে। তবে মিসের ড্রেসআপ মার্জিত নয়। এছাড়া আমার ভালোই লাগে।”

সময় হতেই রুপার বলা নিউ মিস তৃষা চৌধুরীর আগমন হয়। উঁচু হিলের খটখট আওয়াজ তুলে। একহাতে শাড়ির কুচি ধরে হাঁটছেন। তনুজা রুপার কথার সাথে মিলালো। হ্যা সত্যিই দেখতে দর্শনধারী। তনুজা পাশের বেঞ্চে বসা ছেলেদের লক্ষ্য করলো। ছেলেরা হা করে ড্যাবড্যাব চোখে তাকিয়ে আছে। তাদের মুখে পোকামাকড়, মশা মাছি তো ঢুকবেই, সাথে অনায়েসেই একটা লাড্ডুও ঢুকে যেতে পারে।

.

মধ্য দুপুর। মাথার উপর সূয্যিমামা। কাঠফাঁটা রোদ্দুর। তনুজাকে নিতে আসছে ইভান। পরপর গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায় ইভান। গাড়ির দরজার উপর একহাত রাখা, আরেক হাত প্যান্টের পকেটে ঢুকিয়ে দাঁড়িয়ে। তনুজার জন্য অপেক্ষা করছে। সবকিছুতেই দিদুনের বাড়াবাড়ি একলা গেলে কী সমস্যা! এই রোদে ইভানের দিদুনের উপর রাগ হচ্ছে। এখন তাকে একটা মেয়ের জন্য কলেজের সামনে অপেক্ষা করতে হচ্ছে। তনুজা তো বলেছিলো ক্লাস সাধারণত এই টাইমে শেষ হয়। কই সে? সে টাইম তো পেরিয়ে যাচ্ছে এদিকে তার দেখা নেই। রাস্তার পাশের টং দোকানে বসে কয়েকটা ছেলে। তারমধ্যে একজনের হাতে গিটার। ছেলেগুলো কলেজের তা দেখেই বুঝা যাচ্ছে। পরপর ভেসে আসলো,

-” শুধু বলো ফোন দিও না রাতে, আম্মু পাশে থাকে, ভাইয়া বারান্দাতে।
কথা বলতে পারব না।
আমার কানে আসে সবই, কার সাথে খাও কফি।
বলে দাও সত্যি, কীসের এতো ভ’য়।
আমার মা বলেছিলো খোকা তুই প্রেম করিস না।
ভালো ছেলেদের কপালে ভালো মেয়ে জোটে না।”

গানের কথাগুলো শুনে আজ হঠাৎ ইভানের তৃষার কথা মনে পড়লো। কথাগুলো যদিও সবার ক্ষেত্রে সত্যি হয় না। তবে কারো কারো ক্ষেত্রে সত্যি হয়। সেই কারোর মধ্যে ইভান নিজেকে খুঁজে পেলো। পুরানো কিছু কথা মনে পড়তেই ইভান আনমনে তাচ্ছিল্য হাসে। তারপর দুই আঙুলের সাহায্যে কপালে জমা ঘামটুকু মুছে ফেলে। এমন সময় গেট বরাবর তাকাতেই তার নজর যায়, গায়ে পাতলা জর্জেট কলাপাতা রঙের শাড়ি। ঠোঁটে লাল লিপিস্টিক। ব্রাউন কালার করা চুলগুলো কাঁধের একপাশ দিয়ে একগাছি সামনে আনা। শাড়িটা পাতলা হওয়ার দরুণ মেদহীন পেট সাথে নাভী দৃশ্যমান।

-” ওটা তৃষা? নাকি চোখের ভ্রম!”

ইভান বিড়বিড়ায়। পরপর তৃষারও নজর যায় গাড়ির সাথে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা ইভানের দিকে। ঘর্মাক্ত ক্লান্ত মুখটা খুব আকর্ষণীয় লাগছে। কপালে, খোঁচা খোঁচা দাঁড়ির মধ্যে বিন্দু বিন্দু ঘাম মুক্তোর মতোন চকচক করছে। সেদিন জ্যামে থাকাকালীন তৃষা ইভানকে দেখলেও ইভান দেখেনি। ইভানকে দেখে তৃষা মনে মনে খুশি হয়। তৃষা কপাল কুঁচকে ভাবে,

-” ইভান? ইভান এখানে! ও কী করে জানলো আমি এখানে জব করি? ও নিশ্চয় জেনেছে আমি দেশে এসেছি। তবে ও কী আমার সাথে দেখা করার জন্যই এখন এখানে আসছে? ইভান কী আবার আমাকে ওর জীবনে ফিরে পেতে চায়? জানতাম। জানতাম ইভান কখনো তনুজাকে মেনে নিবে না। জাস্ট চাপে পড়েই সে বিয়েটা করেছে।”

আকাশ-কুসুম ভেবে তৃষার মনপ্রাণ আনন্দে আত্মহারা হয়ে উঠলো। তনুজা আর রুপা আসছিলো। খানিকটা দূরত্বে থাকা ইভানকে দেখতে পায় সে। ইভানের দৃষ্টি অনুসরণ করে তনুজার নজর পরে তৃষার দিকে। ইভানকে তৃষার দিকে তাকিয়ে দেখে হঠাৎ তনুজার কেমন যেনো ঠেকলো। তার অবচেতন মন সেকেন্ডেই ভেবে বসে,

-” পুরুষ মানুষ হলো সুন্দরের পূজারী।”

আচমকা এমন ভাবনা নিজ মনসপটে আসায় তনুজা নিজের উপর নিজেই অবাক হয়। লোকটা সুন্দরী একটা মেয়ের দিকে তাকিয়ে আছে তাতে তার কী? ক্লাসের কত ছেলেই তো হা করে তাকিয়ে ছিলো মিসের দিকে। কই তখন তো এরকম ভাবনা আসেনি! তার ভেতর খা’রা’পও লাগেনি। তাহলে এখন কেনো তার কোথাও একটা লাগছে! এই কেনোর উত্তর তনুজার কাছে অজানা। হয়তো পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ সেই থেকেই।

#চলবে