প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-১৪

0
145

#প্রণয়ের_বাঁধন |১৪|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

-” বাড়ি চলো। আর আমার মনেহয়। আপাতত তৃষার ব্যাপারটা হাইডে রাখাই বেটার হবে। কারন তৃষা এসব করেছে সেসব তুলে ধরতে গেলে তোমাদের দুজনের বিষয়টা সবার সামনে আসবে। জানি না ভাইয়া কীভাবে নিবে! কিন্তু নানুআপু ঠিকভাবে নিবে না। তাই বলছি এখন এসবের পিছনে বুয়া আর লিমন ছিলো এতটুকুই সবাইকে জানানো ভালো হবে। পরে কোন উপযুক্ত সময়ে ধীরস্থিরভাবে ভাইয়াকে জানানো যাবে।”

তৃষার নাম কর্ণকুহরে পৌঁছাতেই দিব্যর কপালের শিরা ফুলেফেঁপে উঠে। পরপর নুইয়ে থাকা মাথাটা উঁচু হয় হাতের আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে কণ্ঠে সমস্ত ক্রোধ ঢেলে বলে ওঠে,

-” তৃ..ষা। ও চিনে না আমাকে। চিনে না সাফওয়ান দিব্য মির্জাকে। ওর কতবড় স্পর্ধা আমার বাড়ির বুয়াকে দিয়েই এতবড় নোং/রা কাজ করেছে। এর শাস্তি কতটা ভয়াবহ হতে পারে ও ভাবতেও পারবে না। তৃষাকে আমি দেখে নিবো।”

আশেপাশের মানুষের জটলা ধীরে ধীরে কমতে শুরু করেছে। ব্যস্ততায় ঠাসা নগরীর ব্যস্ত মানুষেরা যার যার কাজে ফিরতে থাকে। এই শহুরের কত রং কত ঢং। দিনদুপুরে কত কী ঘটে! এসব দেখেশুনে অভ্যস্ত তারা। রাস্তায় মা°রামা°রি হা°নাহা°নি এসব আহামরি কিছু নয়। আর নিজ কাজে প্রত্যেকে এতটাই ব্যস্ত যে সময় ন/ষ্ট করে কৌতুহলী হয়ে থাকার জো বা ইচ্ছে দুটোই খুব কমই থাকে। দিব্য যখন তৃষাকে দেখে নিবে হেনতেন বলছে সেই সময় তনুজা মুখ খোলে। রুষ্ট কণ্ঠে বলে সে,

-” ব্যাস দিব্য; ব্যাস। অনেক হয়েছে। তোমাকে এতটা প্রতিশোধ পরায়ণ হতে হবে না। অন্যকে দেখে নেওয়ার আগে, ভালো করে নিজের দিকে একবার তাকাও। তৃষা এসব এমনি এমনিই করেনি, সে কিন্তু রাগ-ক্ষোভ থেকেই এটা করেছে। হ্যা তার হিং°সা, রাগ-ক্ষোভ পুরোটাই ভুল। তবে তৃষার এই রাগ হওয়া। সেই রাগ মিটাতে ষ’ড়যন্ত্র করার জন্য পরোক্ষভাবে কেউ না কেউ দায়ী। আজকাল অহরহ পেপার-পত্রিকা, সোশ্যাল মিডিয়ায় দেখা যায়, তৃষার মতোন ষড়যন্ত্রকারীদের হাতে নিরীহ কাউকে ব’লি হতে। সবার কাছে তৃষারা যেমন অপরাধী, ঠিক তেমনি তৃষারা যার জন্য এমন হিংস্র হয় সেও সমান দায়ী। জানো দিব্য? জানো তুমি? তৃষারা এমন হয় কীজন্য? কীভাবে তারা এতটা হিংস্র হয়? পরোক্ষভাবে তাদেরকে ষ’ড়য’ন্ত্রকারী বানাই কে? জানো তুমি?”

নিতি তার সরু ভ্রু দু’টো কুঞ্জিত করে তনুজার পানে চেয়ে। দিব্য নির্বোধের মতোন চেয়ে, তনুজা কী বলতে চাইছে তা তার বোধগম্য হচ্ছে না। তনুজা মনেমনে তাচ্ছিল্য হাসল। পরপর দিব্যর দিকে আঙুল তাক করে বলল,

-” তোমার মতো দিব্যরা। তোমার মতো প্রতারণাকারী দিব্যরা, সমাজে তৃষাদের তৈরি করে। নিজ ভাইয়ের সাথে প্রতারণা করে, ভাইয়ের এক্সয়ের সাথে রিলেশনে যায়। এখানেই শেষ নয়। কাহানী তো আরো বাকি আছে, তারা তো রিলেশনটাকে টাইমপাস হিসেবে নেয়। আজ এর সাথে টাইম পাস, কাল ওর সাথে টাইম পাস। আজ একে ভালো লাগল রিলেশনে গেলাম, তো কাল আরেকজনকে ভালো লাগল। নাও ব্রেকাপ। তারপর আরেকজনের সাথে রিলেশন তৈরি করা। সুন্দর অভিনয় করা।”

তনুজার তাচ্ছিল্য করে বলা প্রত্যেকটা কথা দিব্যর বুকে ছু/রির মতো বিঁধছে। ক্ষত-বিক্ষত হচ্ছে তার হৃদয়টা। দিব্য চোখ দু’টো বন্ধ করে নেয়। তারপর পলক তুলে শুণ্য দৃষ্টিতে উপরের দিকে তাকায়। অন্য সময় হলে, দিব্য জোর গলায় বলতো,

-” বিশ্বাস করো তনু। তুমি কখনোই আমার টাইমপাস ছিলে না। বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে তোমাকে প্রেমে ফেলতে গিয়ে আমি নিজেই তোমার প্রেমে পড়ে যাই। হ্যা আমি এর আগেও রিলশনে গিয়েছি। কিন্তু তৃষার প্রতি আমার কোনদিনও তেমন ফিলিংস আসেনি। এছাড়াও বন্ধুদের সাথে ঘুরতে ফিরতে গিয়ে অনেকসময় মেয়েদের সাথে ফ্লার্টিং করেছি। কিন্তু তাদের কারো প্রতি আমি ভালোবাসা অনুভব করিনি। কখনো কারো জন্য উতলা হইনি, কাউকে একপল দেখার জন্য একফোঁটা ছটফট করেনি আমার হৃদয়। তাদের কারো জন্য অস্থির হইনি আমি। কিন্তু তোমার জন্য পা/গলামী করেছি আমি। কনকনে শীতের সকালে ঘুম থেকে জেগে কুয়াশার চাদরে মুড়িয়ে রাখা দেড় ঘন্টার পথ বাইক চালিয়ে ফুল নিয়ে গিয়েছি তোমার জন্য। শুধু তোমার জন্য। তোমাকে আমার প্রতি দুর্বল করতে গিয়ে তোমার আগেই আমি তোমাতে বিমোহিত হয়েছিলাম। আকাশ-বাতাস কাঁপিয়ে জোর গলায় বলতে পারব, আমি তোমার সাথে চিট করিনি। আমি সত্যিই তোমাকে ভালোবাসি। এখানে একফোঁটা মিথ্যে নেই।”

তবে আজ কেনো জানি নিজের হয়ে, নিজের ভালোবাসার জন্য সাফাই গাইতে ইচ্ছে করলো না দিব্যর। সম্পর্কের জটিল সমীকরণ এসে দাঁড়াল তাদের মধ্যে। এতদিন দিব্য ইভানকে দায়ী করতো। কিন্তু আজ মার্বেলের মতো স্বচ্ছ আর পরিষ্কার হয়ে গেল বিষয়টা। ইভান নয় এসবের পিছনে ছিলো তৃষা। এতদিন ইভানের উপর রাগ-ক্ষোভ, জিদ নিয়ে তনুজাকে ফের নিজের করে পাওয়ার স্বপ্ন দেখলেও। আজ মূহুর্তেই ফিরে পাওয়া, প্রতিক্ষায় থাকা মন কেমন মিইয়ে আসে দিব্যর। দিব্য ভগ্ন, অপরাধী মন নিয়ে মাথাটা নুইয়ে ফেলে। তনুজা বড়বড় শ্বাস ফেলে নিতির দিকে তাকাল। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল,

-” নিতি আমার মনেহয় সত্যিটা বলে দেওয়াই বেটার। কোন কিছু লুকানো ঠিক নয়। পাছে গিয়ে সমস্যা হতে পারে। দিদুন যেভাবে নেয় নিবে। তারপর উনিও যেভাবে নেয় নিবে। তবে আমি কোন মিথ্যে, ছলনার মধ্যে নিজেকে রাখতে চাই না। কোনকিছু লুকাতে, আড়াল করতে চাই না।”

নিতি অস্থির চিত্তে বলল,

-” তুমি আমার কথাটা একটু রিলাইজ করার চেষ্টা করো; ভাবিমণি। দ্যাখো দিদুনকে তো তুমি চিনোই। বড্ড পুরানো আমলের ধ্যান ধারণা তার। তোমার আর ছোট মির্জার কথা জানলে প্রচন্ড অসন্তোষ হবেন। এবার আসি ভাইয়ার কথায়, ভাইয়ার মনমানসিকতা সম্পর্কে পুরোপুরি না হলেও আমি অল্প স্বল্প অবগত আছি। ছোট্ট থেকে ভাইয়াকে দেখছি। আমার মনেহয় তোমাদের রিলেশনের কথা জানলে ভাইয়া এই সম্পর্কটা স্বাভাবিক রাখতে পারবে না। যেহেতু তোমাদের বিয়ে হয়েই গিয়েছে, এখান থেকে ফেরার উপায় নেই।”

তনুজা তৎক্ষণাৎ বলে উঠল,

-” নিতি তুমি ভুল বুঝছো। আমি ফিরে আসার কথা আজ পর্যন্তও বলিনি। প্রথম প্রথম ওনাকে দায়ী করলেও আমি এটা তখনও বলিনি। আর আজও আমি ফেরার কথা বলছি না।”

দিব্য আড়ালে তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলল। নিজেকে স্বাভাবিক করে বলে,

-” নিতি তুই ঠিক বলেছিস। আপাতত তৃষাকে হাইডে রাখ। দিদুন ভুল বুঝে উল্টাপাল্টা কিছু করতে পারে। আর একবার সোসাইটিতে যেটা রটেছিলো, ফের ওরকম কিছু রটালে। ইভানের সমস্যা হবে। ও মানসিকভাবে ফের অসুস্থ হতে পারে। এইজন্য হলেও সবটা প্রকাশ করার দরকার নেই।”

সমাজের লোকের কানে একবার কথাটা গেলে, আলোর গতিতে ছড়িয়ে দিবে। মির্জা বাড়ির বড় ছেলের বউয়ের তাদের ছোট ছোট ছেলের সাথে সম্পর্ক ছিলো। এইভেবে দিব্য কাটকাট গলায় বলল। দিব্যর বলা ইভানের মানসিক ট্রমার কথাশুনে তনুজা এবার একটু দমে যায়। আর কিছু বলে না। দিব্য নিতিকে উদ্দেশ্য করে বলে,

-” সন্ধ্যা হয়ে আসছে। নিতি তুই ত..”

থেমে যায় দিব্য। তনুজার নাম সম্পূর্ণ করে না। মস্তিষ্ক সজাগ হয়। তনুজার বলা কথাটা পরপর স্মরণ হয়। দুই সেকেন্ড পর ম্লান স্বরে বলল,

-” নিতি তুই ওনাকে নিয়ে বাড়ি চলে যা।”

নিতি শুধিয়ে ওঠে,

-” তুমি যাবে না? তুমিও চলো। তোমার সাথেই তো যাওয়া যাবে।”

দিব্য এদিক-ওদিক তাকাল।

-” আমার কাজ আছে। আমি পরে যাব।”

তারপর একটা রিকশা দেখে হাত উঁচিয়ে ডাকল,

-” এই খালি।”

পরপর রিকশা আসতেই দিব্য ভাড়া মিটিয়ে দেয়। একপল তনুজার দিকে চাইল। তড়িৎ নজর সরিয়ে নিতিকে বলল,

-” যা বললাম তাই কর। আর হ্যাঁ; বাসায় পৌঁছে মেসেজ দিস।”

নিতির মুখটা মলিন হয়ে আসলো। বুকের ভেতরটায় কষ্ট অনুভব হচ্ছে। তবে বাইরে প্রকাশ করছে না সে। সেদিন রাতে দিব্য যখন নিতিকে তনুজার থেকে শুনতে বলেছিলো। তারপর দিব্যর তনুজার দিকে তাকানো। তনুজার দিব্যকে এড়িয়ে যাওয়া। সবটাই নজরে আসে নিতির। সে অনুমান করেছিলো। তবে একদম শিওর ছিলো না। আজ যখন নিজ কানে শুনল। সেই মূহূর্তে চিনচিনে ব্যথা হয় বুকে। এখন দিব্যর মলিন মুখটা দেখে নিতির মায়া হচ্ছে। ইশশ্! সবাই কেমন ভুল জায়গায় গিয়ে ফেঁসে যায়। তাদের বাড়ির ছেলেমেয়েদের ক্ষেত্রেই কেনো এমন হচ্ছে? নিতি উত্তর খুঁজে পায় না।

____________

মির্জা বাড়ির লিভিংরুম জুড়ে পিনপিনে নীরবতা বইছে। তনুজা আর নিতি বাড়ি ফেরার পরপরই ইভান, আর শিরিন সুলতানা আসেন। নিতির নম্বর থেকে মিসড কল ওঠে আছে দেখে মিটিং শেষে ইভান ব্যাক করে। এদিকে রিসিভ করে না। এরমধ্যে শিরিন সুলতানা ইভানের অফিসরুমে এসে বাসায় ফিরার কথা বলেন। নুরজাহান বেগম ফিরে নৃত্যর থেকে সবটা শুনে বউমাকে ইভানকে সাথে নিয়ে তাড়াতাড়ি আসতে বলেন। ইভান দুই হাত প্যান্টের পকেটে গুঁজে সটান দাড়িয়ে। নুরজাহান বেগম গম্ভীর মুখে বসে আছেন। ওনার পায়ের কাছে মেঝেতে বসে বুয়া কেঁদে চলছে সেই আসার পর থেকে। তনুজাসহ বাকীরা দাঁড়িয়ে। নিতি পরপর সবটা বলে। বুয়া কীভাবে কী করেছে, আর কার কথামতো। নুরজাহান বেগম গম্ভীর গলায় শুধোলেন,

-” তা ঐ ছেলে। কী নাম যেনো বললে? ও হ্যা; মনে পড়েছে লিমন। তো সে কেনো এরকম করেছে? তার সাথে নাতবউয়ের কীসের শত্রুতা? আর নাতবউকে চিনেই বা কীভাবে?”

তনুজা দৃষ্টি নত করে দাঁড়িয়ে। ইভান কোণা চোখে তনুজাকে পরখ করছে। তনুজার মুখশ্রী ভীতু সন্ত্রস্ত লাগছে। তনুজা কী জবাব দিবে ভেবে পাচ্ছে না! তন্মধ্যে নিতি হড়বড় করে বলে ওঠে,

-” আরে নানুআপু এখনকার সময় কাউকে চেনা আবার ব্যাপার নাকি! কলেজে যাওয়া আসার পথেই দেখেছে হয়তো। আর ঐ ছেলে ভাবিমণিকে প্রপোজ করেছিলো। ভাবিমণি ঠাস করে চ’ড় মে/রে রিজেক্ট করেছিলো, সেই প্রত্যাখ্যান মেনে নিতে না পেরেই এই ষড়যন্ত্র করে। এবার বুঝলে?”

নুরজাহান বেগম ভেতরে ভেতরে একটু খুশিই হলেন। মনেমনে সন্তুষ্ট হন। যাজ্ঞে নাতবউ চড়টড় মে/রেছিলো ভালোই করেছিলো। তবে উপরে মুখটা গম্ভীর করে রাখলেন। ইভানের মনে কিছু প্রশ্ন জাগছে। তবে এখানে সবার মাঝে তনুজাকে প্রশ্ন করে বিব্রতকর অবস্থায় ফেলতে চায় না সে। আর নাতো সবার মাঝে কোনভাবে ছোট করতে। তাই আপাতত প্রশ্নগুলো মনের এক কোণে ঠেসে রাখে। নুরজাহান ফের জিজ্ঞাসা করলেন,

-” দিব্য কই? সে ফিরলো না। ছেলেটাকে কী খুব বেশিই মে/রেছে?”

-” শুধু বেশি। খুব বেশি, হুম। কয়েকটা দাঁত পরে যাবে আমি শিওর। ঠোঁট কে/টে যা তা অবস্থা। ইশশ্! র/ক্ত-টক্ত দেখে শেষে গিয়ে আমার একটু মায়াই হলো। আর অকালেই বেচারার কয়েকটা দন্ত অক্কা পাবে এই দেখে তো রীতিমত আমার মায়া হলো। আহারে! এই ফোকলা রে কোন মেয়ে বিয়ে করবে।”

নৃত্য সশব্দে হেসে উঠল। নুরজাহান দুইবোনের দিকে চোখ গরম করে তাকাল। নিতি জিভে কা’মু’ড় দিয়ে থেমে যায়। শিরিন সুলতানা বললেন,

-” মা! তাইলে আমি পু/লিশকে ফোন করি। বুয়াকে এসে নিয়ে যাক। এভাবে ঘুমের ঔষধ আর ক্লোরোফর্ম দিয়ে অচেতন করা দণ্ডনীয় অপরাধ। যদি বড়সড় অঘটন ঘটতো! তখন কী হতো! তাই ওকে সাজা পেতে হবে। সাথে ঐ ছেলের নামেও ডায়েরী করব।”

পু/লিশের নাম শুনতেই আবার হাউমাউ করে কেঁদে উঠে বুয়া। নুরজাহান বেগমের দুই পা জড়িয়ে ধরে বিলাপ করতে থাকে। নুরজাহান ‘চ’ শব্দ উচ্চারণ করে একহাতে ছাড়াতে ছাড়াতে বলেন,

-” আহ্! ছাড়ো তো। আর থামো। কানটা ঝালাপালা করে দিলে তো দেখছি। আর এখন কাঁদছো আগে মনে ছিলো না! সেইজন্য কখনো অন্যায় করতে হয় না। আজ নাহয় কাল ধরা পড়তেই হয়। স্বচ্ছ থাকতে হয়। আর কিছু হোক বা হোক দিনশেষে নিজের কাছে নিজে স্বচ্ছ আমি ভালো আছি বলে গর্ব বোধ করা যায়।”

শিরিন মোবাইল বের করে ডায়াল করতে যাবেন সেই সময় নুরজাহান ব্যগ্র কণ্ঠে বললেন,

-” দাঁড়াও ছোটো বউমা। পু/লিশে কল করার দরকার নাই।”

সবাই বেশ অবাক হয়। নুরজাহান ফের বলতে থাকেন,

-” ঐ ছেলের শাস্তি তো ছোটো দাদুভাই নিজ হাতে দিয়েছেই। আর বাকি রইলো বুয়া। তার ঘরে ছেলেমেয়ে আছে। জেলে গেলে মেয়েদের বিয়ে-থা দেওয়া সমস্যা হয়ে যাবে। আর আমাদের দ্বারা কারো ক্ষ/তি হোক চাই না। তাই পু/লিশে দিতে চাচ্ছি না। এক কাজ করো তুমি, এই মাসে যে ক’দিন কাজ করেছে হিসেব করে সেই টাকাটা ওকে দিয়ে দাও। আর এক্ষুনি একে আমার চোখের সামনে থেকে দূর হতে বলো। কোনদিনও যেনো আমার সামনে আর এ বাড়ির ত্রিসীমানায় না দেখি।”

নৃত্য চোখেমুখে বিস্ময় নিয়ে বলে,

-” নানুআপু; তুমি বুয়াকে এমনি ছেড়ে দিচ্ছো! তাও আবার টাকা দিয়ে।”

-” ও কাজ করেছে ওটা ওর হক। সেটা তো আমরা মে/রে খেতে পারি না। আর ক্ষমা করা খা’রাপ নয়। তাই ক্ষমা স্বরুপ ও জেল হাজত থেকে বেঁচে গেলো। আর ওরা চেয়েছিলো ষড়যন্ত্র করে খারাপ করতে। কিন্তু ওদের পরিকল্পনা তো ভেস্তে গেলো। আমি আমার দাদুভাইয়ের জন্য লক্ষীমন্ত একটা বউ পেলাম। যা আমার দীর্ঘদিনের স্বপ্ন ছিলো। সেইজন্য এ যাত্রায় ওকে ছাড় দিলাম।”

থেমে,

-” যাও; তোমরা রুমে যাও। ইভান দাদুভাই রুমে গিয়ে ফ্রেশ হয়ে নাও। নাতবউ যাও। আর ছোটো বউমা তুমি দিব্যকে ফোন করে আসতে বলো। আর সবশুনে একটা জিনিস ভালো লাগলো, দিব্যর ইভানের জন্য টানটা দেখে। কথায় আছে না, র/ক্তের সম্পর্ক কখনো ধুয়ে যায় না। পানি কাটলে দুই হয় না।”

খুব গর্ব করে বললেন নুরজাহান। বলতে গিয়ে দু’চোখ তার চিকচিক করে ওঠে। নিতি হালকা হাসার চেষ্টা করে বলল,

-” যাই। রুমে গিয়ে রেস্ট নিবো। মাথাটা ভীষণ ধরেছে। কালকে তো আবার হোস্টেলে ফিরতে হবে। সামনের মাস থেকেই সেমিস্টার ফাইনাল। উফ্! মাম্মা আমি আজ এক্ষুনি ঘুমিয়ে পড়বো। তাই ডিনারের জন্য ডেকে প্লিজ ডিস্টার্ব করো না, কেমন?”

অনেকক্ষণ ধরে নিজের সাথে যুদ্ধ করে সবার মাঝে মুখে হাসি টেনে দাঁড়িয়ে ছিলো নিতি। ওদিকে ভেতরটা আজ তার বড্ড ক্লান্ত! নিতির একলা থাকতে ইচ্ছে করছে। কয়েকটা শব্দ গুছিয়ে সুন্দর করে মিথ্যে বলে রুমে চলে যায়। হ্যা তবে এটা সত্যি কালকে সে হোস্টেলে যাচ্ছে। তার ছুটি শেষ।

.

রুমে গিয়ে ক্লান্ত শরীরটা নিয়ে বিছানায় ধপ করে বসে তনুজা। হাত দু’টো বিছানায় ঠেস দিয়ে দৃষ্টি মেঝেতে নিবদ্ধ করে নিশ্চুপ রয়। ইভান রুমের মাঝে দাঁড়িয়ে। শার্টের হাতার কাছের বোতাম খুলতে খুলতে তনুজার দিকে চাইল। দাঁত দিয়ে ডান পাশের নিম্নোষ্ঠ চেপে ধরে কিছুপল তনুজাকে দেখল। পরপর গম্ভীর স্বরে শুধোয়,

-” তুমি ঠিক আছো?”

তনুজা মাথাটা তুলল। ক্লান্তিতে ভারী হয়ে আসা ঘন পল্লব তুলে পূর্ণ দৃষ্টিতে ইভানের দিকে তাকায়। দু’জনের চোখে চোখ পরল। ইভান ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

-” না মানে তোমাকে কেমন জানি লাগছে? অসুস্থ ফিল করছো কী?”

তনুজা আরেক দফা বিস্মিত হয়। সত্যি তার কেমন অস্থির অস্থির লাগছে। মাথাটা ঝিমঝিম করছে, সাথে কোনকিছুই ভালো লাগছে না। মিহি স্বরে জবাব আসলো,

-” না ঠিক আছি আমি।”

ইভান শার্টের বাটন খুলতে খুলতে বলল,

-” ওহ্! আচ্ছা।”

ভেতরে থাকা প্রশ্নটা এবার বেরিয়ে আসতে চাইল। ইভান জিজ্ঞাসা করল,

-” আচ্ছা একটা কথা বলো তো। লিমন কীভাবে তোমায় চিনে? নিতি যেটা বলল, কেমন জানি মনে হলো।”

তনুজার শ্বাস প্রশ্বাস বেড়ে গেল। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে আমতা আমতা করে বলে,

-” ক-ক-কেমন জানি মানে! কী মনে হলো?”

ইভানের কপালে খাঁজ পরে। সে বলে,

-” না তেমন কিছু না। তুমি কিন্তু আমার প্রথম প্রশ্নের উত্তর দিলে না।”

তনুজা বসা থেকে ঝট করে উঠে দাঁড়ায়। কথাটা এড়িয়ে যায়।

-” মাথা ধরেছে ফ্রেশ হবো।”

পরপর লম্বা পা ফেলে ওয়াশরুমে ঢুকে তনুজা। বেসিনের সামনে দাঁড়ায়। ট্যাপটা ছেড়ে দুইহাতে পানি নিয়ে চোখেমুখে ছিটায়। মূহুর্তেই মুখে থাকা পথের আলগা ধূলো ধূয়েমুছে সাফ হয়ে যায়। ইশশ্! এমনি করেই যদি কিছু মূহূর্ত আর পুরোনো স্মৃতি; মুখে জমে থাকা আলগা ধূলোর মতোন সাফ করা যেতো। তাহলে বেঁচে থাকাটা সহজ হতো। নিজেকে হালকা লাগতো। তবে তনুজা দৃঢ় প্রত্যয় নেয়, সে নিজেকে দ্রুতই গুছিয়ে নিবে।

.

রাত্রি এগারোটা পেরিয়েছে। রাস্তার পাশে থাকা ল্যাম্পপোস্টের হলদে বাতিগুলো টিমটিম করে জ্বলছে। ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে ইভান। দুইহাত ট্রাউজারের পকেটে গুঁজে সটান দাড়িয়ে। আজ আর বাইরে যায়নি সে। কেনো জানি ইচ্ছে করলো না। তনুজা ধোঁয়া উঠা কফির মগ হাতে রুমে আসে। রুমে চোখ বুলিয়ে ইভানকে দেখতে না পেয়ে ব্যালকনিতে যায়। দিদুন খানিকক্ষণ আগেই বলেছিলো,

-” দাদুভাই আজ বাড়িতেই রাতের খাবার খেলো। বাইরে যাইনি, এটা খুব ভালো। আর অ্যাই যে মেয়ে! সব সময় তো দেখি কেমন মুখ ভার করে থাকো। যতো অমাবস্যা, গ্রহণ যা আছে সব তো নিজের মুখে লাগিয়ে রাখো। স্বামীর সামনে সবসময় হাসিমুখে থাকতে হয়। আর সেজেগুজে। তোমার তো এসবের বালাই নেই। আগে দাদুভাই রাতে কফি খেতো। কড়া করে বানানো। তা আজ তুমি নিজে বানিয়ে নিয়ে দিবা। আবার আগের মতোন হোক সে। ওসব ছাইপাশ গিলার অভ্যেস বাদ ছাদ দিয়ে সুন্দর করে বাঁচতে শিখুক।”

আরো হেনতেন বলতে থাকে। তনুজা কথামতো কফি বানিয়ে আনে। রেলিংয়ে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে ইভান। তনুজা খানিকটা দূরত্বে দাঁড়িয়ে হালকা কেশে নিজের উপস্থিতি জানান দেয়। পরপর কাছে গিয়ে কফির মগ বাড়িয়ে বলল,

-” আপনার কফি।”

ইভান কিছু না বলে তনুজার মুখের দিকে তাকিয়ে রয়। তনুজা অপ্রস্তুত হয়। ঢোক গিলে বলে,

-” দিদুন পাঠিয়েছে।”

তনুজার মুখ নিঃসৃত রোবটের মতোন শেষোক্ত কথাটা ইভানের কাছে ভালো লাগল না। ইভানের অবচেতন মন কেনো জানি শেষোক্ত কথাটায় বিরক্ত হয়। প্রথমে তনুজাকে কফি হাতে দেখে একটু অবাক হলেও শীতল বাতাসের ছোঁয়ার মতোন মনের কোণে শীতলতা অনুভব হয়। ইভান হাতটা বাড়িয়ে কফির মগ ধরতে গিয়ে তনুজার আঙুলে ছোঁয়া লাগে। ইভান পরপর কফির মগে চুমুক বসায়। তনুজা রুমের দিকে অগ্রসর হয়। এমন সময় ঠান্ডা গলার স্বর আসলো,

-” রোজরোজ তোমায় কোলে তুলে আমার হাত দু’টো ব্যাথা হয়ে গিয়েছে। তাই বলছি সোজা বিছানায় শুয়ে পড়বে।”

তনুজার দুই গাল লজ্জায় লাল হয়ে যায়। কান দিয়ে উষ্ণ ধোঁয়া বেরোয়। সে কী ইচ্ছে করে এমন করেছে নাকি! জাগতে গিয়েই তো কাল চেয়ারে ঘুমিয়ে পড়েছিলো। তনুজা লম্বা পা ফেলে রুমে চলে যায়। ইভান ছোট করে কফির মগে চুমুক দিয়ে আকাশপানে তাকায়। সে ভাবতে থাকে কী করবে! জীবনটাকে সবার মতো গুছিয়ে নিবে কী? আগে তনুজার সাথে কথা বলা জরুরী। মেয়েটা আসলেই লাজুক! নাকি ভেতরে রহস্য আছে কোনো? মেয়ে মানুষকে বিশ্বাস করতে ইভানের বড্ড বেশিই ভয় হয়। আবার যদি সে ঠকে যায়! এখন যেভাবে চলছে দু’জন দু’জনের মতো। দায়িত্ববোধ আর লোক দেখানো সব। দু’জনের কারোরই টান মহব্বত নেই। যা হচ্ছে এই নামে মাত্র বিয়ের দায়িত্ব থেকে। ইদানিং মেয়েটা তাকে আকর্ষিত করে, তবে ঠকে যাওয়া, প্রতারিত হওয়ার ভয়ে আড়ষ্ট হৃদয় বাঁধা হয়ে দাঁড়ায়। মেয়ে জাতিকে বিশ্বাস করা মানেই চরম ভুল। এই ভুল কী আর একটিবার করবে ইভান? উত্তর প্রস্তুত করতে পারছে না সে। বড় বেশিই দ্বিধা আর দ্বন্দ্বে ভুগছে। দুনোমনে আছে সে।

____________

রাত একটা বাজতে চলছে। মাত্র বাড়ি ফিরেছে দিব্য। মা ফোনের পর ফোন দিয়ে অতিষ্ঠ করে ফেলেছিলো। অবশেষে বাধ্য হয়ে কেবল আসলো সে। ডিনারের কথা বলতেই সোজা “খাবে না, ক্ষুধা নেই” বলে দেয়। দিব্য বিছানায় বসে মাথা নিচু করে। পাশে শিরিন কান্না ভেজা চোখ নিয়ে বসে। ছেলের মলিন মুখ দেখে ভেতরটা হুহু করে কেঁদে উঠছে। গিলে নেওয়ার শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। দু’চোখ বেয়ে ঝরঝরিয়ে অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে। আচমকা দিব্য মায়ের কোলের উপর মাথা রেখে শুয়ে পড়ল। দুইহাতে কোমড় জড়িয়ে পেটে মুখ গুঁজে বলল,

-” মাম্মা আমায় একটু আদর করবে? আমার না ভীষণ কষ্ট হচ্ছে। আমায় একটু আদর করো না মাম্মা।”

ইশশ্! ছেলেটা আজ এভাবে বলছে। ওর ভেতরে কতোই না কষ্ট হচ্ছে। শিরিনের ভেতরটা মুষড়ে উঠল।দাঁত দিয়ে ঠোঁট কামড়ে ধরে নিঃশব্দে কেঁদে উঠলেন। হাতটা ছেলের চুলের ভাঁজে চলে যায়। মুখে কিছুই বলতে পারলেন না। কিছু সময় নীরবে কা/টে। অতঃপর দিব্য বলে,

-” মাম্মা তোমার ছেলে খুব খারাপ। খুব খারাপ। তার দ্বারা ভালো কিছুই হয়নি। সে যা করেছে সব রং ছিলো। কোনোদিন ভালো কিছুই করেনি। তোমার ছেলে বদমেজাজি, রাগি, তারপর বাজে চরিত্রের। আমি খুব বেশিই খারাপ তাই না মাম্মা?”

শিরিন সুলতানা নাক টেনে নেন। দিব্যর চুলের থেকে হাতটা সরিয়ে দুইহাতে ছেলের মুখটা উঁচু করে ধরলেন। কপালে সারা মুখে চুমু দিয়ে বললেন,

-” মোটেই আমার ছেলেটা খারাপ নয়। আমার ছেলে আমার কাছে বেস্ট। আমার সোনা বাচ্চা আমার আদরের মানিক। আমার বাচ্চা তো খুব ছোট। কতটুকুই তার বুদ্ধি, তাই এই বয়সে একটু আধটু ভুল করলেও সে এতটা খারাপ হয়ে যায়নি। আর তোমার রাগ, জিদে আমি কখনোই বিরক্ত হইনা দিব্য। এইযে এখন তুমি কেমন চুপচাপ, মিইয়ে আছো। এইভাবে তোমাকে মানাচ্ছে না। তুমি রাগবে, জিদ করবে তাতেই আমার কাছে তোমায় মানায়। আমার সোনা বাচ্চাটা, তুমি সবটা ভুলে যাও। নতুন করে শুরু করো। দেখবে সব ঠিক হয়ে যাবে।”

-” মাম্মা প্রকৃতির বিচার কথাটা মিথ্যে নয়।”

-” দিব্য সোনা আমার তুমি তো খুব স্ট্রং। তাহলে আজ কেনো এভাবে বলছো? আর তুমি এমন কোনো বড় অন্যায় করোনি। তুমি না জেনেই হয়তো ইভানের উপকার করেছো। তৃষা কখনোই ইভানের বউ হওয়ার যোগ্য ছিলো না।”

দিব্য থামিয়ে দিয়ে বলে,

-” মাম্মা আমার পাসপোর্ট তো তোমার কাছে। কালকে সেগুলো আমাকে দিয়ে দিও।”

পাসপোর্টের কথা শুনে বুকের ভেতর ধ্বক করে ওঠে শিরিনের। তবে কী দিব্য বাইরে চলে যাওয়ার ডিসিশন নিয়েছে?

#চলবে