#প্রণয়ের_বাঁধন |২৯|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
কুয়াশায় ছেয়ে আছে চারিপাশ। রাস্তার পাশের ল্যাম্পপোস্টের হলদে আলো কুয়াশার জন্য ঘোলাটে দেখাচ্ছে। শীতের প্রকোপে রাত বাড়ার সাথে সাথে রাস্তায় লোক সমাগম কমে যায়। আবাসিক এলাকার শুনশান রাস্তা দিয়ে ড্রাইভ করছে তৃষা। হঠাৎ গাড়ির হেডলাইটের আলোয় আবছা দেখা যায়; অদূরে মাঝ রাস্তা বরাবর একটা কালো রঙের বাইক পথ আটকিয়ে আছে। আরেকটু এগোতেই নজরে আসে বাইকে বসা অফ হোয়াইট হুডিতে মুড়ানো কাউকে। বারবার হর্ন দেওয়া সত্বেও বাইকারের কোনো হেলদোল নেই। হুডি পরিহিত মানবের মাথাটা নিচু করা। রাগ আর বি’রক্তিতে তৃষা স্টায়ারিংয়ে ঘু/ষি দিয়ে গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়ায়। হাইহিলে খটখট আওয়াজ তুলে চোখমুখ শক্ত করে এগোয়। কয়েক কদম এগিয়ে জিন্সের পকেটে দুইহাত গুঁজে গলার স্বর চড়িয়ে প্রশ্ন করে উঠল,
-” হোয়াট’স দ্য প্রবলেম? দিস মিনস ব্লোকিং দ্য ওয়ে?”
দুই হাতের সাহায্যে মাথা থেকে হুডিটা পিছনের দিকে ছুড়ে; ঘাড় ঘুরিয়ে আ/গু/ন চোখে তাকায় বাইকে বসা যুবক। ঠান্ডা প্রগাঢ় গলায় জবাবে বলল,
-” হিউজ প্রবলেম।”
তৃষা দুইহাত বুকে গুঁজে সটান দাঁড়ায়। মুখে কুটিল হাসি ফুটিয়ে ঠোঁট বেঁকিয়ে বলে,
-” ইউ! এটিটিউড দেখে তোমাকেই ভেবেছিলাম। তা দিব্য বেইব, কেমন আছো? প্রেম বিরহে কাতর হয়ে দেশ-টেশ ছেড়েছুড়ে বিদেশ চলে যাচ্ছোই নাকি? কতদিন আর নিজের ভাইয়ের সাথে নিজের প্রেমিকার প্রেমলীলা দেখবে। সইতে খুব কষ্ট হয় ঠিক বলেছি না, বে__ইব?”
শেষের কথাটা টেনে বলে দিব্যর গালে হাত ছুঁতে নেয় তৃষা। দপ করে দিব্যর মাথায় আ/গু/ন জ্ব’লে ওঠে। দিব্য এক ঝটকায় তৃষার হাত সরিয়ে দেয়। পরপর বাইক থেকে নেমে দাঁড়ায়। দিব্যর রাগে তৃষার কথাগুলো যেন কেরোসিন তেল ঢেলে দেয়। তৃষার কথায় রাগটা মাথাচাড়া দিয়ে উঠল, রাগ-ক্রো’ধে গাঁট হয় দিব্য। যদিও ঠান্ডা গলায় হুমকি আর শাসাতে তৃষাকে ফলো করে পথ আ’ট’কিয়ে ছিলো। কিন্তু এই মেয়ে তো ঘুমিয়ে থাকা রাগি দিব্যকে জাগিয়ে দিলো। রা’গে দিব্যর চোখ দিয়ে আ’গ্নে’য়’গি’রির লা’র্ভা বেরুচ্ছে যেন। দিব্য কটমট দৃষ্টিতে চেয়ে আচমকা একহাতে তৃষার চুল মুঠি করে ধরে। অন্যহাতে তৃষার গালটা চেপে ধরে বি’শ্রী গা’লি দিয়ে উঁচু স্বরে বলল,
-” ব্লা°ডি°বি°চ! ভেবেছিলাম তোকে এলার্ট করব, নেক্সট যাতে আমার আর আমার ফ্যামেলির কারো দিকে তোর অশুভ নজর না পরে। ভুলেও যেন কোন চাল চালতে না আসিস। কিন্তু তুই তো একটা প্রো****। তোর মাইন্ড ইহজন্মেও চেঞ্জ হওয়ার নয়।”
তৃষা ”আহ!” শব্দ করে একহাতে মাথার পিছনে চুল ধরে রাখা দিব্যর হাতটা সরানোর প্রচেষ্টা করতে থাকে। অন্যহাতে গাল থেকে। কিন্তু দিব্যর শক্তির কাছে তৃষার শক্তি অতি সামান্য। দিব্যর হাত একচুলও নড়াতে পারে না তৃষা। ব্যাথায় তৃষার চোখে পানি চলে আসে। তৃষা চিল্লিয়ে বলার চেষ্টা করে,
-” আহ্! দিব্য আমার লাগছে। ছাড়ো। রাস্তায় এসব কী ধরনের অসভ্যতামি? বে°য়া°দব একটা! খুব বেশিই বে’য়া’দবি করছো তুমি।”
রাগে কাল-কেউটে সা’পে’র মত ফুঁসছে তৃষা। একটু ছাড়া পেলেই যেন ফোঁস করে ফণা তুলবে। দিব্য চুলের মুঠি শক্ত করে। গালটাও জোরে চেপে ধরে। রাগি স্বরে বলে,
-” আমি বে’য়া’দব হতে পারি। তবে তোর সাথে যেটা করছি, এটা নট বে’য়াদ’বি। এটা তো তোর জন্য দরকারি।”
কথাটা শেষ হতে না হতেই দিব্য সজোরে ঠা’সঠা’স তৃষার গালে চ-ড় মা-রে। কষিয়ে বেশ কয়েকটা চ’ড় দেয় দিব্য। তৃষার ঠোঁট কে’টে লাল তরল ঝরছে।
___________
ঘড়ির কাঁ’টা রাত এগারোটার ঘর ছুঁইছুঁই। দিব্য সবে ফিরলো। রুমে পা রাখতেই নিতিকে ডিভানে পা তুলে কোলের উপর কুশন রেখে আয়েশি ভঙ্গিতে ফোন স্ক্রল করতে দেখে দিব্য ভড়কায়। কারো উপস্থিতি টের পেতেই নিতি চোখ তুলে চায়। নিতির দিকে ভ্রু কুঁচকে তাকিয়ে অবাক হয়ে প্রশ্ন ছুঁড়ে দিব্য,
-” তুই এখানে! আমার রুমে কী করছিস?”
নিতি পা দু’টো নামিয়ে স্যান্ডেল গলিয়ে নেয়। পরপর জবাব দেয়,
-” আমি তোমার রুমে কী করছি? সেটা আমাকে জিজ্ঞেস না করে তোমার দিদুনকে জিজ্ঞেস করো।”
দিব্য ফোনটা বেডে ছুঁ’ড়ে ফেলে। তারপর হাতঘড়িটা খুলতে খুলতে নিতির দিকে আড়চোখে চেয়ে শুধালো,
-” আমার দিদুন তোর কী হয়? সরাসরি নানুআপু বলতে প্রবলেম কোথায়?”
নিতি এগিয়ে আসতে আসতে বলল,
-” প্রবলেম আমার নয়। প্রবলেম তোমার দিদুনের। সেই তো তোতাপাখির মতো আমাকে শিখিয়ে-পড়িয়ে দিচ্ছে। এখন এই বাড়িতে আমার সবচেয়ে বড় পরিচয় আমি তোমার বউ। তোমার পরিচয়েই পরিচিত হতে হবে। তার ভাষ্যমতে বিয়ে হয়েছে আলাদা থাকা ঠিক নয়। হেনতেন বলে আমাকে এই রুমে শিফট করে ছেড়েছে।”
দিব্য এ ব্যাপারে আর কিছু বলতে ইন্টারেস্ট দেখায় না। দিদুন মান্ধাতার আমলের মানুষ। তাই তার দ্বারা এমনই হবে। দিব্য দীর্ঘশ্বাস ফেলে ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। এমন সময় নিতির চোখ যায় দিব্যর গায়ের অফ হোয়াইট হুডিতে। হুডিতে জায়গায় জায়গায় লাল ফোঁটা ফোঁটা র°ক্তে°র দাগ। নিতি বিস্ময়ে ঠাসা নজরে চেয়ে আলোর গতিতে প্রশ্ন করে উঠল,
-” এই ওয়েট ওয়েট! তোমার গায়ে ব্লা/ড না? কীসের…. কীভাবে?”
দিব্য অপ্রস্তুত হয়। এড়িয়ে যেতে বলে,
-” তেমন কিছু নয়।”
নিতি সামনাসামনি দাঁড়াল। সন্দেহভাজন চাহনিতে চেয়ে বলল,
-” তেমন কিছু নয় মানে? স্পষ্ট ব্লা’ডের দাগ দেখছি।”
দিব্য জড় গলায় বলল,
-” এক ফ্রেন্ড এ’ক্সি’ডেন্ট করেছে। ওকে হসটপিটালে নিয়ে যেতে গায়ে লেগে যায়।”
দিব্য কথাটা শেষ করেই ওয়াশরুমের দিকে পা চালায়। নিতি পিছন থেকে কয়েকটা প্রশ্ন করে, দিব্য উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। নিতি বিছানার একপাশে পা ঝুলিয়ে বসে ভাবতে থাকে। নিতির ভাবনার চরকায় টান পরে। আলমারি খোলার শব্দে। ফ্রেশ হয়ে কালো রঙের টিশার্ট গায়ে জড়িয়েছে দিব্য। দিব্য পরপর আলমারি থেকে একটা সিঙেল কম্বল হাতে নেয়। অতঃপর বিছানা থেকে একটা বালিশ তুলে নিয়ে ডিভানে শুয়ে পরে। নিতি দুইহাত বিছানায় ঠেস দিয়ে বসে আড়চোখে সবটা অবলোকন করছে। রাগে মনেমনে ফুঁসছে। বিড়বিড় করে বলে,
-” আহা! মনে হচ্ছে ওপার বাংলার সিরিয়ালের স্যুটিং চলছে।”
দীর্ঘশ্বাস ফেলে আরো আওড়ায়,-” ইয়া আল্লাহ! এ কোন গ্রহের এলিয়েন এটা!”
দিব্য গায়ে কম্বল জড়িয়ে ঘাড়টা কিঞ্চিৎ উঁচু করে বলল,
-” নিতি লাইট নিভিয়ে দিস। লাইট অন থাকলে আমার ঘুম আসে না।”
নিতি হা-হু কিছুই উত্তর দেয় না। রাগে লুচির মতো ফুলছে ও। কিছুক্ষণ পর রাগটা একটু মিইয়ে আসতেই উঠে দাঁড়ায় নিতি। পরপর দিব্যর সামনে দাঁড়ায়। দিব্যর চোখদুটো বোজা। নিতি সন্তর্পণে একটা হাত দিব্যর মুখের থেকে কয়েক ইঞ্চি উঁচুতে নাড়ে। বিড়বিড় করে বলে,
-” শায়েখ ঘুমেশে পড়েছেন?”
দিব্যর সাড়াশব্দ না পেয়ে নিতির মেজাজ খা’রা’প হয়। খা’টা’শটা শোবার সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়েছে নাকি! নিতির মাথায় এক দুষ্টু বুদ্ধি আসে। সেন্টার টেবিলের উপর থেকে কাঁচের জগটা হাতে তুলে গ্লাসে পানি ঢেলে নেয়। আলতোপায়ে ডিভানের সামনে দাঁড়ায়। উদ্দেশ্য হাতের উপর পানি নিয়ে কয়েক ফোঁটা পানি ঘুমন্ত রাগি মির্জার উপর ছিটিয়ে ভূ’ত তাড়ানোর মতো রাগ তাড়াবে। দিব্যর মুখের উপর বরাবর হাতটা ধরে গ্লাস থেকে হাতের উপর একটু পানি ঢালতে নেয় নিতি। কিন্তু ভাগ্য বোধহয় আজ নিতির সহায় ছিলো না। সামান্য পানি ঢালতে গিয়ে গপ করে গ্লাসের অর্ধেক পানি পরে যায়। শীতের দিনে ঠান্ডা পানি চোখ মুখের উপর পড়তেই দিব্য ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে। সবেমাত্র চোখদুটো বুঁজে ছিলো। ঠান্ডা পানি পড়তেই মনে হয় হিমালয়ের বরফ যেন ঢালা হচ্ছে ওর উপর। একহাতে চোখমুখের পানি মুছে সামনে তাকাতেই দিব্যর মেজাজের ভোল্টেজ আকাশ ছুঁইয়ে যায়। নিতির হাত-পা থরথর করে কাঁপছে। দিব্যর রাগি দৃষ্টিতে নিতির রুহু অধবি কাঁপছে। নিতি ভীতুগ্রস্থ মুখশ্রীতে ফাঁকা ঢোক গিলে নিয়ে তৎক্ষণাৎ দুইহাত স্বীয় গালে রাখে। আতংকে আড়ষ্ট হয়, এই বুঝি ঠাস করে দাবাং মার্কা চ-ড় পড়ল নরম তুলতুলে গালে। তাও আবার লোহার মতো শক্ত হাতে। দিব্য একটানে গা থেকে কম্বল সরিয়ে উঠে দাঁড়ায়। দিব্যর মুখটা রাগে পাথুরে শক্ত বনে যায়। নিতির দিকে কড়া চোখে তাকিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। সফেদ দন্তপাটি কটমট করে বলল,
-” এটা কী হলো? এসব কী ধরণের অ’সভ্যতামি?”
নিতির চোখের পলক কাঁপছে ভ’য়ে। কথা বলতে গলাটাও কাঁপল ঢের,
-” স-স্যরি।”
দিব্য আঙুল মুষ্টিবদ্ধ করে উচ্চ কণ্ঠস্বরে বলল,
-” স্যরি মাই ফুট।”
ধ’ম’কে নিতির হৃদপিন্ডটা ভূমিকম্পের মতন কেঁপে উঠল। সামনের টেবিলে জগের দিকে নজর পড়তেই দিব্য এগিয়ে হাতে তুলে নেয়। এই দেখে নিতির বোঝা সারা। নিতি দৌড় লাগায়। দিব্য জগ হাতে পিছু। নিতি ঘরময় ছুটছে। ঘাড় ফিরিয়ে দিব্যর দিকে চেয়ে আকুতি-মিনতির সুরে বলল,
-” স্যরি! আর হবে না। প্লিজ ভিজিয়ে দিও না।”
দিব্যর একহাতে জগ অন্যহাতে নিতির হাতটা খপ করে ধরে ফেলে। নিতির মাথায় পানি ঢালবে এমন সময় ফাঁকা মুক্ত হাতটা দিয়ে জগটা ধরে ফেলে নিতি। দু’জনের টানাহেঁচড়ায় জগের পানি সব ফ্লোরে পরে। দিব্য কটমট চাহনিতে নিতির দিকে তাকিয়ে হাতের জগ ছুড়ে মা’রে। জগের কাঁচ শব্দ তুলে গুঁড়ো গুঁড়ো হয় খানিকটা দূরে। নিতি দুইহাত কানে ধরে। সাউন্ড প্রুফ রুম হওয়ায় বাইরে শব্দ যায় না। ঘরময় শব্দ প্রতিধ্বনিত হতে থাকে। দিব্য মোটামোটা চোখে তাকিয়ে শাসিয়ে বলে,
-” নেক্সট যেনো এরকম ফা’জলামি না হয়।”
নিতি থুতনিটা বুকে ঠেকিয়ে বাচ্চা শিশুর মতোন একপাশে ঘাড় নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক বলে। দিব্য তপ্ত নিঃশ্বাস ফেলে পা বাড়াতে নেয়, ফ্লোর পানিতে ডুবে ছিলো; আচমকা দিব্য পিছলে যায়। টাল সামলাতে না পেরে সামনের দিকে ঝুঁকে পরে; পরে তো পরে সামনে থাকা নিতিকে নিয়ে ধপাস সোজা জমিনে। নিতির গায়ের উপর পরে। কোইনসিডেন্সলি দিব্যর ছোট ছুঁয়ে যায় নিতির ঠোঁটে। আকস্মিক ঘটনায় দু’জনে স্তব্ধ বুনে যায়। নিতির টানাটানা চোখজোড়া বিস্ময়ে পাখির ডিমের আকার ধারণ করে। কোমড়ের ব্যাথা, গায়ের উপর সত্তর কেজি ওজনের ভারী সবটাই ক্ষীণ মনে হয় নিতির। প্রথম কোনো মেয়ের এতটা কাছে থেকে দিব্যর হার্টবিট বেড়ে যায়। নিতির কুর্তির গলার পাশ ঘেঁষে ফর্সা গায়ে কালো তিলটা উঁকি দিচ্ছে। সেদিকে আচমকা নজর থামে দিব্যর। চোখদুটো হঠাৎ মা’দ’কের ন্যায় টানছিলো। দিব্য ফাঁকা ঢোক গিলে নেয়। পরপর মস্তিষ্ক সচল হতেই দৃষ্টি সরিয়ে তড়িৎ গতিতে উঠে দাঁড়ায়। নিতিও অপ্রস্তুত ভঙিতে দুইহাতে কোমড় চেপে ওঠে দাঁড়ায়। একপল দিব্যর দিকে তাকিয়ে দৃষ্টি ঘুরাল নিতি। তন্মধ্যে অজান্তেই নিতির হাতের আঙুল স্বীয় গোলাপি পাতলা ঠোঁট ছোঁয়। মনে হচ্ছে এখনো কাংখিত শখের পুরুষের স্পর্শ লেগে আছে।
___________
প্রহেলিকার চাদরে মুড়ানো নিস্তব্ধ রজনী। শিশির ভেজা আর্দ্র রাত্রিতে ঝিঁঝিঁ পোকার শব্দ ছাড়া আর কোন প্রাণীর টু শব্দটি অবধি শোনা যাচ্ছে না। বাইরে শীতল কনকনে হিমেল বইছে। ব্যালকনিতে থাকা দোলনায় বসে ইভান। ফোন স্ক্রল করছে। দরজা দিয়ে আসা আলোয় ব্যালকনি মৃদু আলোকিত। সেই আলোয় আবছা অবয়ব দেখা যায় স্পষ্ট। গায়ে অলিভ কালারের শাল চাদর জড়ানো, একহাতে ধোঁয়া উঠা কফির মগ নিয়ে আলতো পায়ে হেঁটে তনুজা সামনে এসে দাঁড়ায়। ইভানের দিকে বাড়িয়ে বলল,
-” আপনার কফি।”
ইভান তনুজার দিকে না তাকিয়ে কফির মগ নিয়ে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়ায়। বাতাসে বেশ শীত অনুভব হচ্ছে। ইভানকে পরখ করে তনুজা। গায়ে ডেনিম জ্যাকেট। তবুও এই শীতের রাতে এভাবে ব্যালকনিতে বসে ঠান্ডা বাঁধিয়ে বসবে; তাই ভেবে কিছুপল পর তনুজা মিহি স্বরে বলল,
-” শীতের সময় এখানে এভাবে বসে ঠান্ডা বাঁধিয়ে ছাড়বেন দেখছি। রুমে গিয়ে ফোন স্ক্রল করুন।”
ইভান ত্যাড়া জবাব দিলো,
-” রুমে বউয়ের গোমড়া মুখ দেখতে ভালো লাগে না। তাই এখানে থাকাই বেটার।”
-” আমাকে দেখা লাগবে না। ফোন স্ক্রল করবেন। তাহলেই তো হয়।”
কথা শেষ করেই প্রস্থান করবে স্থির করে তনুজা। এরমধ্যে তড়িঘড়ি করে ইভান এক চুমুকে কফির মগ খালি করে পাশে নামায়। হুট করে তনুজার হাত ধরে এক টান দিয়ে নিজ কোলের উপর বসায়। আচমকা টানে তনুজা চমকায়। ভ’য়ে খিচিয়ে চোখ বুঁজে নেয়। খামচে ধরে ইভানের বাহুর কাছের জ্যাকেট। ইভান একহাতে তনুজার পিঠ পেঁচিয়ে আগলে নেয়। মৃদু আলোয় তনুজার মুখটা বড্ড বেশিই আকর্ষণীয় লাগছে। ইভানের শান্ত শীতল নজরজোড়া তনুজার মুখাবয়বে স্থির হয়। ইভান তৃষ্ণার্ত চোখে নির্নিমেষ অপলক চেয়ে চেয়ে দেখে তনুজাকে। চোখ তুলে চাইতেই ইভানের চোখের তারায় চোখ পড়তেই তনুজার ভেতরটা ধ্বক করে ওঠে। হৃদস্পন্দন ক্রমাগত বাড়ছে বৈকি। ইভানের নে’শা’ক্ত চোখের দিকে বেশিক্ষণ তাকাতে পারল না তনুজা। কেমন বিব্রত অস্বস্তি হয়। লজ্জায় তনুজার সত্তা গাঁট হয়। ইভানের উষ্ণ নিঃশ্বাস ভারী হচ্ছে। আঁছড়ে পড়ছে তনুজার লাজরাঙা মুখশ্রীতে। ইভান কাতর স্বরে বলল,
-” তোমার থেকে আর দূরত্ব ভালো লাগছে না। প্লিজ আর…আর অভিমান পুষে রেখো না।”
মৃদু কনকনে হাওয়ায় তনুজার চাদরের আস্তিন দুলছিলো। তনুজার হালকা শীত করছিলো। ও থেকে থেকেই কাঁপছিলো। ইভান টের পেতেই যত্ন সহকারে তনুজার গায়ে চাদরটা পেঁচিয়ে দেয়। বিড়াল ছানার মতো তনুজাকে নিজ বুকের মাঝে জড়িয়ে নেয়। ইভানের এতটা কাছে থাকায় তনুজা ইভানের হার্টবিট অনুভব করতে পারে। ইভানের হৃদস্পন্দন উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের মতোন বেপরোয়া চলছে। ইভানের উষ্ণ স্পর্শে তনুজার তনুমন শিহরিত হয়। ইভানের এতটা ভালোবাসা, যত্ন উপেক্ষা করার সাধ্যি তনুজার হলো না। মেকি অভিনয় আর করতে পারল না। ইভানের ভালোবাসায় মন সিক্ত হয়। অভিমানের বরফ গলতে থাকে। ইভান আলতো স্বরে বলে,
-” তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, যখন আমি জানি তুমি বাড়িতে যাওনি। তারপর ফোন সুইচড অফ বলছে। আমি কতটা ঘাবড়ে গিয়েছিলাম। প্রতিটা ক্ষণেক্ষণে আমার মনে হচ্ছিলো এই বুঝি তোমাকে হারিয়ে ফেলেছি। তুমি বোধহয় চিরতরে আমার থেকে আলাদা হয়ে গেলে।”
তনুজা ইভানের চোখের দিকে তাকিয়ে আলতো হেসে বলল,
-” ভাগ্য যাদের এক করেছে, তাদের আলাদা তো কেবল মৃ/ত্যুতেই। এছাড়া যতই ঝড় হোক, তুফান হোক, সুনামি বয়ে গেলেও সৃষ্টিকর্তা না চাইলে কারোর ক্ষমতা নেই, সাধ্য নেই; আমাদের প্রণয়ের বাঁধন ভাঙার। আমাদের আলাদা করার।”
-” তনুজা কখনো ভুল হলে, ভুল করেও হারিয়ে যাওয়ার কথা ভাববে না। একবার সত্যি কারের কারো মায়ায় জড়ালে তাকে ছাড়া বাঁচা অসম্ভব হয়ে পরে। আমি নিজেকে তোমার মায়ায় হারিয়ে ফেলেছি। তুমি হারিয়ে গেলে, আমার অস্তিত্ব বিলীন হয়ে যাবে।”
তনুজা ইভানের বুকে মাথা রেখে বলে,
-” আপনি আগলে রাখলে, আমার সাধ্যি নেই দূরে সরার।”
ইভানের অধরে একফালি সন্তুষ্টির হাসির ঝিলিক দেখা যায়। ইভানের হাস্যজ্জ্বল মুখ দেখে তনুজা বুক ভরে শ্বাস নেয়। ওর চিত্ত প্রশান্তিতে ভরে উঠে। এই সুন্দর মূহুর্তটাকে আরো সুন্দর করতে মনটা নেচে ওঠে তনুজার। যাকে সবার আগে খবরটা জানাবে বলে এখনো কাউকে জানায়নি। এই সুন্দর ভালোবাসার চাদরে সিক্ত ক্ষণে খুশির খবরটা জানাতে উদ্ধত হয় তনুজা। মৃদুস্বরে বলল,
-” ইভান। আপনাকে কিছু বলতে চাই। সবার আগে জানাতে চাই আপনাকে। শুধুই আপনাকে।”
তনুজার কথা ইভানের বোধগম্য হয় না। ইভানের কপালে ভাঁজের উদয় হয়। কপালে ভাঁজ ফেলে তনুজার দিকে নিটোল চাহনিতে চায়। হঠাৎ তনুজার বুকের ধুকধুকানি বাড়ল। কেমন লজ্জায় দুইগাল গাঢ় লাল হয়ে আসছে। রীতিমত বুক কাঁপছে। কাঁপাকাঁপা হাতটা ইভানের রুক্ষ হাতের উপর রাখল। পরপর ইভানের হাতটা ধরে আলগোছে স্বীয় পেটের উপর রাখে তনুজা। তনুজার দম বন্ধ হয়ে আসার জো হয়েছে। বুক ভরে শ্বাস টেনে নেয়। মাথাটা কিঞ্চিৎ উঁচু করে ইভানের কানের পাশে নেয়। ফিসফিসিয়ে বলে,
-” ইভান আপনি বাবা হতে যাচ্ছেন। আপনার অংশ বেড়ে উঠছে আমার গর্ভে।”
ইভানের কানে কথাটা বাদ্য যন্ত্রের সুরের ন্যায় রিনিঝিনি বারকয়েক বাজতে থাকে। ইভানের শিড়দাড়া বেয়ে হিম শীতল স্রোত বয়। ইভান আকস্মিক ঘটনায় বাকশুণ্য স্তব্ধ। প্রতিক্রিয়াহীন কিছুপল কা’টে। ইভানের নিশ্চুপ, নিরবতা দেখে তনুজার কপালে চিন্তার রেখা দেখা যায়। সেকেন্ডে মনেহয়, -‘ তবে কী ইভান খুশি নয়? এত তাড়াতাড়ি হওয়ায় ও অসন্তুষ্ট নয় তো!”
এটা ভাবতেই তনুজার পৃথিবীতে অমানিশা নামে। মুখটা ম্লান হয়ে আসে। পরপর সম্বিৎ ফিরে পেতেই; নিজেকে ধাতস্থ করে ইভান। তনুজার পেটের উপর থাকা হাতের স্পর্শ প্রগাঢ় করে ইভান। অন্যহাতে তনুজাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে। আনন্দে আত্মহারা ইভান কীভাবে রিয়েকশন দিবে ভেবে পাচ্ছে না! ওর চোখমুখে খুশি উপচে পড়ছে। এক সমুদ্দুর আনন্দ উচ্ছ্বাস তরঙ্গের ন্যায় ঢেউ তুলল ইভানের কণ্ঠে। বলল,
-” রিয়েলি? আমার তো বিশ্বাসই হচ্ছে না। সবটা কেমন স্বপ্ন-স্বপ্ন লাগছে। মনে হচ্ছে আমি কোনো ঘোরের মধ্যে আছি।”
উফ্! এতক্ষণে তনুজার মাথার উপর থেকে চিন্তার পাহাড়টা দূরীভূত হয়। এত দ্রুত ঘটায় তনুজা কিঞ্চিৎ চিন্তিত ছিলো। ইভান উৎফুল্ল কণ্ঠে ফের বলল,
-” এটা আমার লাইফের সেরা গিফট। আমি বাবা হবো। আমার-তোমার ভালোবাসার অংশ আসছে এই পৃথিবীতে। আমার নিজেকে সব থেকে হ্যাপিয়েস্ট ম্যান মনে হচ্ছে। কী যে ভালো লাগছে! সেটা ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না!”
কথাটা শেষ করে বুকের সাথে থাকা তনুজাকে দৃঢ় বাঁধনে চেপে ধরে ইভান। নিজের সাথে মিশিয়ে নেয় মেয়েটাকে। নিস্তব্ধ নিশীথে দু’জনে কিছুপল নিরবতায় কাটায়। ভালোলাগার আবেশে দু’জনের সময়ই থমকে যায়। অনুভূতির তান্ডবে ভাসা দু’জনেই নিশ্চুপ রয়। নিরবতাকে দীর্ঘ করতে দেয় না ইভান। পরম যত্নে আলতো হাতে তনুজার মুখটা আঁজলে ধরে ইভান। আনন্দে ইভানের দু’চোখ টলমল করে ওঠে। সজল নয়নে আবেগপ্রবণ হয়ে মৃদুস্বরে বলে ইভান,
-” তনুজা তুমি দেখে নিও, আমি একজন বেস্ট বাবা হবো।”
তনুজার দু’চোখও অশ্রুসিক্ত। তবে আজকের অশ্রু দুঃখ-কষ্টের নয়। অতিশয় আনন্দে টলটল করছে আঁখিজোড়া। সজল নয়নে চেয়ে ভেজা স্বরে প্রত্যুত্তরে দেয় তনুজা,
-” আমি জানি। আমি জানি ইভান। সবচেয়ে আগে আপনি একজন ভালো মানুষ। তারপর একজন ভালো স্বামী। যেমন কেয়ারিং , ভালোবাসায় মুড়িয়ে রাখা একজন স্বামী সব মেয়েরা চায়। স্বপ্ন দেখে, আপনি ঠিক সেই স্বপ্নের মতো একজন স্বামী! এমনই স্বপ্নের রাজ্যের মতোই একজন ভালো বাবাও হবেন আপনি। আমি এটা বিলিভ করি।”
ইভান তনুজার মাথাটা বুকে চেপে ধরে। শীতল কণ্ঠে বলে,
-” ভাগ্য করে আমি তোমাকে পেয়েছি। আমি সত্যিই খুব লাকি। ইউ আর দ্য লাইট অফ মাই লাইফ। আই ডো’ন্ট ওয়ান্ট লস ইউ। ইউর প্রেজেন্স গিভ পীস টু মাই সোল। আই লাভ ইউ তনুজা।”
তনুজা স্মিত হেসে বলে,
-” ইউ আর দ্যা স্পেশাল পার্সন টু হুম, আই ওয়ান্ট টু স্পেন্ড মাই হোল লাইফ। আই লাভ ইউ টু।”
তনুজাকে আলগোছে পাশে বসিয়ে পরপর ইভান হাঁটু ভেঙে নিচে বসে। তনুজার সামনাসামনি বসে পেটের উপর ঠোঁট ছোঁয়ায় ইভান। চোখেমুখে একরাশি আনন্দ, খুশি নিয়ে আদুরে গলায় বলল,
-” আই লাভ মাই বেবি। লাভ ইউ সোনা। পাপা তোমার প্রতিক্ষায়।”
কথা শেষ করে ফের গাঢ় চুম্বন আঁকে পেটে। তনুজা নিঃশব্দে হাসে। তনুজার একটা হাত ইভানের চুলের ভাঁজ গলিয়ে যায়। ইভান উঠে তনুজার পাশে বসে। তনুজা হামি দিয়ে বলল,
-” ঘুম পাচ্ছে।”
ইভানের চোখেমুখে দুষ্টুমি খেলে যায়। তনুজার কানের পাশে মুখ নিয়ে ফিসফিস করে কিছু বলে। তনুজার গাল দু’টো লজ্জায় পাকা টমেটোর মতো টসটসে লাল হয়। তনুজার মৌন সম্মতি ইভানের ধৈর্য্যর বাঁধ নিমিষেই ভেঙে দেয়। ইভান চট করে তনুজাকে কোলে তুলে নেয়। নিজেকে শুণ্যে আবিষ্কার করে তনুজা ইভানের বুকে মুখ লুকায়। তনুজার মাথা বালিশে ঠেকল। রুমের আলো নিভে মৃদু আলো জ্ব’ল’তে থাকে। ইভান তনুজার দিকে ঝুঁকে মা’দ’কতা মিশ্রিত গলায় বলে,
-” আমাকে সারপ্রাইজড করার জন্য থ্যাংকস। এই সুন্দর রাতটা স্মরণীয় রাখার জন্য আরো স্পেশাল করতে; তোমাকে ভালোবাসায় সিক্ত করে, আদরের চাদরে মুড়িয়ে রাখতে চাই।”
উত্তাল সাগরের ঢেউয়ের মতো দু’জনেই অনুভূতিতে টালমাটাল। সামনে হালাল নারী। ইভানকে চূড়ান্ত বে’সামাল করে। ডুব দেয় ভালোবাসার জোয়ারে। তনুজার ঠোঁটে ঠোঁট রাখে ইভান। দীর্ঘক্ষণ চুম্বনে আরক্ত হয় দু’জনে। পরপর তনুজার গলায় মুখ ডুবায় ইভান। স্বর্গীয় সুখে দম বন্ধ হয়ে আসছে তনুজার। আরো একটি ভালোবাসায় শিহরিত হয়ে সিক্ততায় রাত কা’টে পবিত্র প্রণয়ের বাঁধনে আবদ্ধ হওয়া দম্পতির।
#চলবে
#প্রণয়ের_বাঁধন |৩০|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
কুহেলিকার চাদরে মুড়ানো নিস্তব্ধ নিশীথ। হাড়কাঁপানো শীতে জনজীবন স্থবির। শীতের দরুণে রাত বাড়ার সাথে সাথে জনজীবন ঢলে পরে নিদ্রাপুরিতে। রাত্রি গভীর। ঘুমে বি’ঘ্ন সৃষ্টি হচ্ছে দিব্যর। একে তো ডিভানে শুয়ে আরাম মতো ঘুমানো দায়। পা দু’টো টানটান করা যাচ্ছে না। জড়সড় হয়ে গুটিয়ে শোবার অভ্যাস না থাকায় বেচারা বেজায় বেকায়দায় পড়েছে। তারউপরে বেশি সমস্যা হচ্ছে সিঙেল কম্বলে শীত যাচ্ছে না। শুয়ে-শুয়ে একবার এপাশ তো ওপাশ করছে। রাত্রির দীর্ঘ প্রহর এভাবে কাটিয়ে অবশেষে হার মেনে উঠে বসে দিব্য। অবচেতন মন আওড়ায়,
-” নাহ! এভাবে শান্তি মতো ঘুমানো দায়। বেড ছাড়া সাধের ঘুমটা মাটি হবে কনফার্ম।”
ভাবতে ভাবতে উঠে বেডের দিকে পা বাড়ায়। ওদিকে কমফোর্ট গায়ে জড়িয়ে প্রশান্তির সহিত ঘুমুচ্ছে নিতি। ঘুমন্ত নিষ্পাপ ফেসটা দেখে দিব্যর কঠোর মনে একটু দয়ার সঞ্চার হলো বোধহয়! তাই তো নিতিকে ডেকে ওপাশে সরতে বলবে ভেবেও কথাটা গিলে নেয় দিব্য। নিজেই বেডের ওপাশে শুয়ে পরে। এপাশটা জানালার সাথে লাগোয়া। মাত্র ঘুম নেমেছে দিব্যর চোখে, তন্মধ্যে গায়ের উপর ভারী-ভারী কিছু অনুভব হতেই ঘুম হালকা হয়। চোখদুটো মেলে চায়। দিব্যর গায়ের উপর হাত তুলে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছে নিতি। দিব্যর অস্বস্তি প্লাস রাগ হলো। তবে ঘুমের মধ্যে ভেবে রাগটা একটু মিইয়ে পড়ল। বি’র’ক্তি’ক’র মুখাবয়ব করে নিজের থেকে নিতিকে সরিয়ে দিয়ে আরেকটু দূরত্ব বজায় রেখে ওপাশটা ঘেঁষে শোয়। ঘুমের ঘোরে নিতি ফের দিব্যর গা ঘেঁষে শোয়। ঘুমের অতল গহ্বরে তলিয়ে থাকা দিব্যর ঘুম পাতলা হয় শেষ রাত্রিতে। পাশ ঘুরতে নিয়ে যেন চিপায় পরে। চোখ খুলে মস্তিষ্ক সচল হতেই একপাশে নিতিকে গা ঘেঁষে অপরপাশে দেওয়াল দেখে দপ করে মেজাজটা চ’ট’ল। রা’গে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ঝট করে উঠে বসে আকাশ পাতাল কাঁপিয়ে চেঁচিয়ে উঠল,
-” নিতি? হোয়াট’স দ্য প্রবলেম?”
দিব্যর কর্কশ বজ্রকণ্ঠে ঘুমের মধ্যে ধড়ফড়িয়ে উঠে বসে নিতি। হাতের উল্টো পাশ দিয়ে চোখ ডলতে ডলতে চাইল। দিব্য দাঁত কটমট করে কড়া চাউনিতে চেয়ে হাত নাড়িয়ে দেখিয়ে বলল,
-” ওপাশে দু’জন মানুষের শোবার জায়গা রেখে আমাকে তো বেডের একপাশে চিপায় ফেলেছিস। মনে হচ্ছে একদম পুরান ঢাকার গলির চিপায় পড়েছি।”
নিতি ঘুমুঘুমু চোখে নির্বোধের মতোন খানিকক্ষণ ফ্যালফ্যাল করে চেয়ে রইল। মস্তিষ্ক সজাগ হতেই দিব্যকে বেডে দেখে এলিয়েন দেখার মতো চমকায়। চোখদুটো রসগোল্লার আকার করে বিস্মিত কণ্ঠে বলল,
-” ত-তুমি এখানে? আমার পাশে! কী করছো শুনি?”
নিতির কথা শুনে আকাশ থেকে পড়ার মতো অবাক হয় দিব্য। আচমকা মুখ ফস্কে বেরোয়,
-” কিছুই করিনি। বরং শুরু থেকেই তুই জ্বা’লি’য়ে যাচ্ছিস।”
প্রত্যুত্তরে জড়তা নিয়ে প্রশ্ন ছুঁ’ড়ে নিতি,
-” ক-কীভাবে?”
দিব্য দাঁত কিড়মিড়িয়ে বলল,
-” একটু আগেই তো বললাম। ওপাশে ভূ’ত-প্রেতের জন্য জায়গা রেখে আমাকে পুরান ঢাকার গলির চিপায় ফেলেছিস। না পারছিলাম সরতে-নড়তে, না তো পাশ ফিরতে।”
নিতি বড় করে হামি দেয়। গা ছাড়া ভাবে ভেংচি কে’টে বলল,
-” ইয়া আল্লাহ! রাত-বিরাতে এইজন্য এতো চিল্লাচিল্লি করছো। বাড়িতে চো’র-ডাকাত পড়লেও তো মানুষ এত রাতে এমন চিল্লাচিল্লি করে না। যত্তসব! ঘুমটা দিলে তো ভেঙে। সবে একটা স্বপ্ন দেখছিলাম।”
থেমে দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকায়। ডিম লাইটের আলোয় সময়টা পরখ করে। তীব্র আফসোসের সুরে বলে,
-” শুনেছি ভোর রাতের স্বপ্ন সত্যি হয়। ধ্যাত! ভাল্লাগে না। মিষ্টি একটা রোমান্টিক স্বপ্ন দেখছিলাম। সহ্য হলো না তো তোমার। অমনি ভিলেনগিরি করে ছাড়লে। স্বপ্নটা ভেঙে দিলে, কিসিং সীনটা পূর্ণতা পেলো না।”
নিতি মুখটা ভারী করে ঠোঁট উল্টে রইল। দিব্য আহাম্মক বনে চাইল। পরপর সম্বিৎ ফিরে রা’গে ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে বলল,
-” উফ্! তোকে কী সাধে আমি এলার্জি বলি! পুরো ইরিটেট গার্ল। একটা কথা বললে, পিছনে হাজারটা আ’জা’ই’রা বকবকানি ধরিস। ও মাই গড! এই এলার্জিকে সারাজীবন সহ্য করবো কী করে?”
নিতি মুখটা শক্ত করে কপাল কুঁচকে চাইল। হাত দু’টো বুকে ভাঁজ করে ভাব নিয়ে বলল,
-” তোমার কোনো একটা ভালো কাজের ফল আমি। জীবনে একটা হলেও ভালো কাজ করেছিলে মে বি। সেইজন্য আমার মতো মিষ্টি দেখতে, ভালো মনের, সর্ব গুণ সম্পুর্ন একটা মেয়ে জুটেছে। তাছাড়া তোমার যে ব’দমেজাজ একটা কচুপাতাও জুটতো না, হুঁ। কোনো এক পুণ্যের জন্য আমাকে বেটার হাফ হিসেবে পেয়েছো। এইজন্য তো তোমার উচিত আমাকে পেয়ে ধন্য-ধন্য করা। জীবন সার্থক বলা।”
নিতির একনাগাড়ে বলা কথাগুলো শুনে দিব্যর বদনখানিতে থাকা বিরক্তিকর ছাঁট নিমিষেই মাত্রা ছাড়ায়। সাথে দিব্যর চাহনি অতিষ্ঠ হয়। কড়া চাহনিতে চেয়ে বালিশটা দু’হাতে তুলে নিতির পাশে ছুঁ’ড়ে ফেলে দিব্য। চোখ পাকিয়ে দাঁতে দাঁত চেপে বলল,
-” হয়েছে..হয়েছে? হয়েছে তোর নিজের গুণগান করা? শেষ হলে শুয়ে পড়। নিজে না ঘুমালেও আমাকে অন্তত ঘুমুতে দে এবার। ওই যে বালিশ দিয়ে সীমারেখা টেনে দিলাম। বালিশের এপাশটা তোর। ওপাশটা আমার। আর আল্লাহর ওয়াস্তে মুখটা একটু বন্ধ রাখ।”
কথা শেষ করে সেকেন্ড সময় ব্যয় করে না দিব্য; এক নিমিষেই নিতিকে ডিঙিয়ে কর্ণারে চলে আসে। নিতি বিড়বিড় করে দিব্যর চৌদ্দগুষ্টি উদ্ধার করতে থাকে। দিব্য কমফোর্ট টেনে মাথাটা ঢেকে নেয়। নিতি মুখ বাঁকিয়ে উল্টোদিক হয়ে শুয়ে পরে।
__________
পুব আকাশে উঁকি দিচ্ছে সূর্য্যিমামা। রাতের অন্ধকার শেষে সূচনা হয়েছে নতুন দিনের। শিশিরভেজা সবুজ ঘাসের উপর সূর্যের আলো চিকচিক করছে। জানালার সফেদ পর্দার ফাঁকফোকর দিয়ে সকালের এক টুকরো নরম-কোমল রোদ ঘরময় লুটোপুটি খাচ্ছে। কমফোর্টের নরম উষ্ণতা সাথে প্রিয় মানুষটির গায়ের ওম মিলেমিশে একাকার। এ যেন এক অনন্য দারুণ আবহ। উষ্ণতায় আবেশে আবেশিত হয়ে দীর্ঘ হয় তনুজার ঘুম। ঘুম ভাঙতেই ইভানের উন্মুক্ত বুকে নিজেকে আবিষ্কার করে তনুজা। লজ্জায় গাঁট হয় ওর গোটা সত্তা। ধীরে ধীরে বুক থেকে মাথাটা তুলে ইভানের দিকে চায়। বালিশে কনুই ঠেকিয়ে হাতের উপর মাথাটা রেখে ইভানের দিকে ঝুঁকে নির্নিমেষ অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে চেয়ে দেখে। ঘুমের মধ্যে মানুষটাকে ইন্নোসেন্ট লাগছে। বেশ আকর্ষণীয় আর স্নিগ্ধ লাগছে। তনুজার একটা হাত আপনাআপনি ইভানের চুলের ভাঁজ গলিয়ে যায়। আলতো করে হাত বুলায়। ইভানের ঘুম যেনো গাঢ় হলো। নিঃশ্বাসের শব্দ প্রগাঢ় শোনাল। আচমকা তনুজা অধরজোড়া ইভানের ললাটে ছোঁয়ায়। ছোট্ট করে চুম্বন আঁকে ঘুমন্ত ইভানের কপালে। অতঃপর আনমনে আলতো লাজুক হাসি মুখে নিয়ে এলোমেলো শাড়ির আঁচলটা ঠিক করে উঠে বসে। অবিন্যস্ত খোলা চুলগুলো হাত খোঁপা করে নেয় চটজলদি। বিছানা ছেড়ে নামতেই কানে আসে গম্ভীর দৃঢ় স্বর,
-” গিজার অন করে নিও।”
তনুজার গোটা শরীর লজ্জায় এই শীতল আবহাওয়ার মতোই জমে কুলফি হয়ে যায়। ইভান জেগে আছে? এটা ভাবতেই আড়ষ্ট হয় মেয়েটা। তনুজা পিছু ফিরে চায় না। উল্টোদিক পিঠ করে শাড়ির আঁচল মুঠে পুরে জড়তা নিয়ে বলল,
-” সমস্যা নেই। লাগবে না। এমনিতেই বেশ দেরি হয়েছে। ওসব করতে বেশি সময় যাবে। তারচেয়ে চট করে এ_”
তনুজার কথায় লম্বা দাড়ি বসায় ইভান। কথাটা সম্পূর্ণ না শোনেই গাঢ় স্বরে আদেশ বাণী নামলো,
-” তোমার সমস্যা না থাকলেও আমার আছে। আমার বেবির জন্য। এখন তুমি একা নও। তোমার ঠান্ডা বাঁধলে বেবির জন্য প্রবলেম হবে। যেকোন ক্ষেত্রে ছাড় দিলেও, আমার বেবির ক্ষেত্রে নো এসকিউজ, নো কম্প্রোমাইজ, এন্ড নো মার্সি। সো যা বলছি তাই করো।”
তনুজা দীর্ঘশ্বাস ফেলে। মাথা নাড়িয়ে হ্যাঁ সূচক উত্তর দেয়। ইভান শব্দহীন স্বল্প হেসে চোখদুটো বুঁজে নেয়।
___________
মির্জা বাড়িতে যেন ঈদ লেগেছে। আনন্দ উচ্ছ্বাসে উদ্ভাসিত পুরো বাড়ি। বাড়ি ভর্তি মিষ্টির সমারোহে। যেন মিষ্টি-মিঠাইয়ের দোকান তুলে আনা হয়েছে। অনেক বছর পর বাড়িতে বাচ্চা-কাচ্চা আসতে যাচ্ছে। তারউপর এ বাড়ির বড় ছেলের ঘর আলো করে সন্তান জন্ম নিবে। আনন্দ উচ্ছ্বাস যেন একটু বেশিই। খুশির আমেজ মূহুর্তেই ছড়িয়ে পরে। ইভান সর্ব প্রথমে সুখবরটা দিদুনকে দিয়েছে। ইভানের মা-বাবা হীন জীবনে দিদুনের আদর-যত্ন, ভালোবাসার অবদান অনস্বীকার্য। দিদুন যেন চোখে হারায় বড় নাতিকে। ওদিকে ইভানও যথেষ্ট শ্রদ্ধা, সমীহ করে দিদুনকে। একটু আগের কথা…
হঠাৎ ড্রাইভারের হাত ভর্তি মিষ্টির প্যাকেট দেখে নুরজাহান অবাক চাউনিতে চেয়ে শুধায়,
-” হঠাৎ এত মিষ্টি-টিষ্টি! ব্যাপার-স্যাপার কী? কোন কুটুম এলো? এত উপঢোকনাদি নিয়ে!”
সকালের নাস্তা পর্ব শেষ হয়েছে সবেমাত্র। বাড়ির সদস্যরা সবাই নিচেই প্রায়। তনুজা আর শিরিন টেবিল গুছাচ্ছে। নিতি-নৃত্য দুইবোন সোফায় বসে। ইভান কয়েক কদম হেঁটে দিদুনের কাঁধ জড়িয়ে ধরল। মোলায়েম স্বরে বলল,
-” চলো। আগে মিষ্টি মুখ করো। তারপর বলছি কোন
মেহমান আসতে চলেছে।”
বৃদ্ধা বুঝলো না। কপালে কিঞ্চিৎ ভাঁজ ফেলে প্রশ্নাত্মক চোখে চাইল। ইভান স্মিত হেসে তনুজাকে ডাকল,
-” তনুজা একটা মিষ্টির প্যাকেট নিয়ে এসো।”
এদিকে তনুজা ইভানের অভিপ্রায় বুঝে নেয়। বেচারি লজ্জায় মিইয়ে আছে। লজ্জাবতী গাছের পাতার ন্যায় নিজেকে জুবুথুবু করে রেখেছে। তনুজা আড়ষ্টতায় গাঁট হয়ে দৃষ্টি জমিনে নিবন্ধ করে প্যাকেট হাতে এগোয়। ইভান নিজ হাতে একটা মিষ্টি তুলে নেয়। নুরজাহানের দিকে বাড়িয়ে বলে,
-” মিষ্টি মুখে মিষ্টি খবর। তোমার দাদুভাই পাপা হতে চলেছে। মির্জা বাড়িতে নতুন মেহমান আসছে।”
বৃদ্ধা কেবল মুখে পুড়েছিলেন মিষ্টির এক টুকরো। খুশিতে আত্মহারা হয়ে চিবুতে ভুলে যান। শিরিন অবাক হয়ে চাইলেন। নিতি -নৃত্য বিস্ময়ে একসাথে চেঁচিয়ে উঠল,
-” কিহ! নতুন মেহমান। তারমানে..”
দু’জন চট করে পাশে আসে। তনুজা লজ্জায় আর অস্বস্তিতে মূর্ছা যাওয়ার ন্যায় হয়েছে। নখ দিয়ে ফ্লোর খুঁটছে। আনন্দে বাকহারা নুরজাহানের চোখে জলেরা ভিড় করে। আনন্দের আতিশয্যে সজল নয়নে আবেগপ্রবণ হয়ে চাইলেন। একবার তনুজার মাথায় আদর-মমতার হাত বুলালেন, অতঃপর ইভানের মাথায় হাতটা থামিয়ে বললেন,
-” আমার দাদুভাই বাবা হবে! আমি খুব করে চাইতাম; আমি যেন আমার দাদুভাইয়ের সন্তান নিজ চোখে দেখে যেতে পারি। এখন দেখতে না পারলেও আমার আর কোন আফসোস থাকবে না। শুনে যেতে তো অন্তত পেরেছি।”
ইভান ইমোশনাল হয়ে পরে। দিদুনকে জড়িয়ে বলে,
-” ও দিদুন। এভাবে বলো না প্লিজ। তুমি সবটা দেখে যাবে ইন শা আল্লাহ। তুমি আমাদের সাথেই রবে। তোমাকে ছাড়া তো আমার চলবেই না। তোমার কড়া শাসন। আড়ালে তুলতুলে আদর আমার অলওয়েজ চাই।”
নুরজাহান আলতো হেসে ইভানকে আদেশ করলেন তনুজার পাশে দাঁড়াতে। তনুজা-ইভানের দিকে ছলছল নয়নে চেয়ে মনেমনে সৃষ্টিকর্তার কাছে ওদের জন্য প্রার্থনা করলেন। একগাল হেসে বললেন,
-” এভাবেই জীবনের অপূর্ণতার খাতা পূর্ণতায় ভরে উঠুক। সারাজীবন হেসে-খেলে পার করো। তোমাদের ভবিষ্যত সুন্দর সুখকর হোক এই দোয়াই করি। নতুন অতিথির আগমনে তোমাদের বন্ধন আরো দৃঢ় মজবুত হোক। নির্ঝঞ্ঝাট জীবন পার করো। ভালো থেকো।”
শিরিন সুলতানাও এগিয়ে এসে মন থেকে দোয়া করলেন। নিতি- নৃত্য এখনই বেবির নামধাম রাখা নিয়ে গবেষণা শুরু করে দেয়। ছেলে বেবি হলে, এর নামের সাথে। মেয়ে বেবি হলে…দুইবোন জল্পনা কল্পনা করতে থাকে। এরমধ্যে সিঁড়ি ভেঙে নিচে নামছিলো দিব্য। নুরজাহান বেগম হাঁক ছেড়ে ডাকলেন,
-” ছোট দাদুভাই?”
দিব্য এগিয়ে আসতেই নুরজাহান বললেন,
-” একজনের সুখবর তো শুনে যেতে পারছি। তা ছোট কর্তার সুখবর শুনবো কবে?”
নিতি জোরসে ঝটকা খায়। মনে মনে আওড়ায়,
-” ব্যাটা যে তৃণভোজী প্রাণী। সুখবর কেনো! কোনো খবরই ইহজন্মেও সম্ভব নয়।”
দিব্য নির্বোধের মতোন নুরজাহানের দিকে চাইল। নুরজাহান হাস্যজ্জ্বল মুখে বললেন,
-” বাড়িতে নতুন অতিথি আসছে। কাকা হতে যাচ্ছো তুমি। নাও মিষ্টি খাও।”
কথাটা শেষ করেই দিব্যর মুখে একটা কালোজাম পুরে দেয় নুরজাহান। দিব্য গলাধঃকরণ করে নেয়। অতঃপর জোর করে মুখে হাসি হাসি ভাব ফুটিয়ে তোলে। পরপর ইভানের দিকে হাত বাড়িয়ে বলে,
-” কনগ্রাচুলেশন!”
ইভান হাত মিলিয়ে বলে,
-” থ্যাংকস।”
#চলবে