#প্রণয়ের_বাঁধন |৩৬|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত
নিতি মুচকি হেসে ধীরে ধীরে দিব্যর তর্জনী আঙুল ধরে কফির মগে ছোঁয়ায়। আঙুলে গরম অনুভব হতেই আলোর গতিতে এক ঝটকায় দিব্য টান মে’রে হাত সরিয়ে নেয়। তড়াক শোয়া থেকে ওঠে বসে সামনে থাকা নিতির দিকে একবার তো আবার হাতের দিকে তাকায়। মূহূর্তেই মস্তিষ্ক সজাগ হতেই রাগে চোখ থেকে আষাঢ়িয়া বর্ষণের মতোন অগ্নি বর্ষণ হয়। গর্জে ওঠে বলল,
-” হোয়াট দ্য হেল? তুই কী পা/গ/ল নাকি?”
নিতি দুই হাতে কান চেপে ধরে বলল,
-” ইয়া আল্লাহ! উফ্ফ! এ কী গর্জন! সকালবেলা তৃণভোজী সিংহ জাগল নাকি..”
দিব্যর কর্কশ ধ’ম’কে নিতির মুখটা চুপসে যায়। দিব্য রাগে বড়বড় চোখে চেয়ে দাঁত চেপে বলল,
-” ইচ্ছে করছে এক চ-ড়ে তোর সবগুলো দাঁত ফেলে দিতে।”
নিতি জোর করে হাসার চেষ্টা করে বলল,
-” আরেহ তুমি রেগে কেনো যাচ্ছো? আমি তো তোমাকে জাগানোর জন্য এমন করেছি। কতবার ডাকলাম, তুমি তো সাড়া দিলেই না। তাই তো ঝট করে জাগানোর অভিনব কায়দা আবিষ্কার করে..”
দিব্যর রাগে লাল হওয়া চোখে চোখ পড়তেই কথায় দাঁড়ি টানে নিতি। ফাঁকা ঢোক গিলে নেয়। দিব্য হাতটা ঝাঁকিয়ে আঙুলের দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আমার আঙুল জ্ব’লছে? আর এর মাথা যত্তসব কু’বুদ্ধি আবিষ্কার করে চলছে।”
নিতি সহানুভূতি প্রকাশ করে বলল,
-” খুব বেশি জ্বলছে কী? দেখি দেখি..দ্যাও ফুঁ দিয়ে দেই।”
এই বলে নিতি দিব্যর হাতটা ধরে। ঠোঁট গোল করে ফুঁ দেয়। দিব্য এক ঝটকায় হাত সরিয়ে নেয়। ধ’ম’কিয়ে উঠল,
-” রাখ।”
নিতি কপাল চাপড়ে বলল,
-” আরে সামান্য গরম ছিলো। তুমিও না নাটক-ফাটক শুরু করে দিলে। ওটুকু গরম এমন কী? ইজিলি সয়ে নেওয়া যায়।”
তন্মধ্যে দিব্য বিছানার উপর থেকে কফির মগটা হাতে তুলল। ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,
-” ওয়েট তোর মুখের উপর ফেলছি, কেমন সয়ে নেওয়া যায়! দ্যাখ..”
নিতি তাড়াহুড়ো করে দু’টো হাতে মুখ ডেকে ফেলে। ভ’য়ে ওর নাভিশ্বাস উঠেছে। মন বলছে, ‘একে নিয়ে বিশ্বাস নেই, মুখের কথা সত্যি করতে দু সেকেন্ড সময় নিবে না। নিতি তুই এবার শেষ।’ কণ্ঠে এক সমুদ্দুর অসহায়ত্ব ঢেলে নিতি অনুরোধের সুরে বলল,
-” এই না না.. প্লিজ এমনটা করো না। ভুল হয়েছে, আর হবে না। পাক্কা প্রমিজ। শাস্তি স্বরূপ কান ধরে উঠবস করবো, তাও প্লিজ এটা করো না। আমার এত সুন্দর তুলতুলে মুখটা..”
দিব্য বলল,
-” আমি থ্রি পর্যন্ত কাউন্ট করবো। আমার কাউন্ট করা শেষ হওয়ার আগেই তুই কান ধরে একপায়ে দাঁড়িয়ে থাকা শুরু করবি। আর এটা চলবে, পুরো থ্রি আওয়ার্স।”
মুখের উপর থাকা হাতের আঙুল ফাঁক করে পিটপিট চোখে দিব্যর দিকে চায় নিতি। এমন শাস্তির কথা শুনে আত্মাটা শুকিয়ে আসে। মুখে বলল,
-” অ্যা….থ্রি আওয়ার্স।”
-” অ্যা নয় হ্যাঁ। হ্যা থ্রি আওয়ার্স।”
কথাটা শেষ করে বাঁকা হেসে দিব্য হাতের মগের দিকে তাকায়। মূহুর্তেই ভ’য়ে নিতির ভেতরটা ভূমিকম্পের মতন কেঁপে উঠল। নিতি উপায়ান্তর না দেখে রাজি হয়। দুই হাত কানে চেপে দৃষ্টি ফ্লোরে নিবদ্ধ করে বাম পা টা জমিন থেকে একটু তুলে নিতি দাঁড়িয়ে। দিব্য গুনগুনিয়ে গান গেয়ে নিতির সামনে দিয়ে টাওয়েল নিয়ে ওয়াশরুমের দিকে যায়। ওয়াশরুমের দরজা খুলে ঘাড় ঘুরিয়ে সতর্কবার্তা ছুঁ’ড়ে,
-” একদম চিটিং করবি না। আমি কিন্তু মাঝে মাঝেই লক্ষ্য করবো। চিটিং করছিস দেখলেই আবার নতুন করে টাইম কাউন্ট শুরু হবে। সো বি কেয়ারফুল।”
নিতির ভীষণ কান্না পাচ্ছে। খা’টা’শ বুঝলো কী করে? মাত্রই ওর অনুপস্থিতর সুযোগ লুফে নিতে চাইছিলাম। মনেমনে এসব বলে নিতি। মুখটা কাঁদো কাঁদো করে কণ্ঠ খাদে নামিয়ে ফের অনুরোধ স্বরুপ বলল,
-” সময়টা একটু কমিয়ে দাও না, প্লিজ। যতই হোক বউ হই তোমার, এইজন্য হলেও তো একটু-আকটু মার্সি করাই যায়।”
-” নো নেভার।”
দিব্য কাটকাট গলায় বলে শিষ বাজিয়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। নিতি মাঝে মাঝে পা চেঞ্জ করছে। সাথে তওবা পাঠ করছে। অনেক শিক্ষা হয়েছে, আর না। আর কস্মিনকালেও রাগি মহারাজের সাথে ফা’জ’লামি করতে যাবে না। আধা ঘন্টা পর ওয়াশরুমের দরজা খোলার শব্দ হয়। শব্দ শুনে চকিতে নিতি সতর্ক হয়। কিছুপল পর নিতি ভেংচি কে’টে বিড়বিড় করে বলে, ‘ দ্যাখো মেয়েদের মতো ঘণ্টা ধরে সময় নিয়ে শাওয়ার নিয়ে বেরুচ্ছে। বডিওয়াশ, শ্যাম্পুর ঘ্রাণ রুমময় ম-ম করছে। ছেলে মানুষ পাঁচ মিনিটে গোসল সারবি। না, ঘন্টা ধরে। এখন তো আবার ঘণ্টা ধরে বডি স্প্রে করবে। ও আল্লাহ এ কখন রুম থেকে বেরোবে? আর আমার একটু স্বস্তি মিলবে।” মনেমনে দুঃখের প্রলাপ করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিতি। অতঃপর কিছু ভেবে চোখেমুখে নিদারুণ কষ্ট আর ক্লান্তির ছাপ ফুটিয়ে তোলে নিতি। দিব্য টাওয়েল দিয়ে চুল মুছতে মুছতে নিতির দিকে আড়চোখে চায়। নিতি চোখ তুলে দিব্যর দিকে তাকিয়ে নিম্নস্বরে ডাকল,
-” শোনো না?”
-” হুম।”
দিব্য ভেজা চুল মুছতে মুছতেই রসকষহীন গলায় জবাব দেয়। নিতি কপট অসুস্থতার ভনিতা করে। মিথ্যা বলে,
-” আমার না মাথা ঘুরছে। যখন-তখন সেন্সলেস হয়ে যেতে পারি। প্রচন্ড মাথা ঘুরছে। চারিদিকটা দুলছে। ইয়া আল্লাহ, ইয়া মাবুদ রক্ষে করো।”
দিব্য নিতির দিকে দু’কদম এগোয়। বাঁকা চোখে চাইল। নিম্নাষ্ঠে দাঁত বসিয়ে বলল,
-” এখন মাথা ঘুরে পরে সেন্সলেস হলে, মাথায় পানি ঢেলে সেন্স ফিরিয়ে আবার প্রথম থেকে শুরু করা হবে। তুই ভাব, এখন কীভাবে মাথা ঘুরে সেন্সলেস হওয়া আটকাবি। অলরেডি এক ঘণ্টা হয়েছে। আবার নতুন করে শুরু করা হলে, এই ঘণ্টাটা কিন্তু অ্যাড করা হবে না।”
রাগে নিতির নাকটা কিঞ্চিৎ ফুলে ওঠে। রাগে মনেমনে দিব্যকে হাজারটা গা/লি দিতে থাকে। দিব্য সময় নিয়ে রেডি হয়। বাইকের চাবিটা জিন্সের পকেটে ঢুকিয়ে নিয়ে নিতির দিকে তাকিয়ে বলল,
-” আমি ব্রেকফাস্ট সেরে উপরে আসবো। সো নো চালাকি।”
নিতির এবার ভ্যাঁ ভ্যাঁ করে কেঁদে দিতে ইচ্ছে করছে। হঠাৎ বাম পায়ের দিকে দৃষ্টি যেতেই নিতির চোখদুটো চকচক করে ওঠে। পাশ দিয়ে টিকটিকি যাচ্ছিল। নিতি সাহস যুগিয়ে নিখুঁত অ্যাক্টিং করে, এক লাফে দু’কদম এগিয়ে দুম করে দিব্যকে জড়িয়ে ধরে। আচমকা দিব্য টাল সামলাতে না পেরে দু’পা পিছিয়ে যায়। ব্যালেন্স রাখতে একহাতে নিতির কোমড় পেঁচিয়ে ধরে। নিতি দিব্যর বুকে মুখ গুজে। দিব্য কপালে বিরক্তির ছাঁট ফেলে কিছু বলতে নেয়, এমন সময় নিতি এক হাত দিয়ে ইশারা করে দেখিয়ে বলল,
-” ঐ যে দ্যাখো দ্যাখো টিকটিকি।”
দিব্য ফ্লোরে তাকিয়ে টিকটিকি দেখে বিরক্তির সাথে দম ফেলে। নিতি বলতে থাকে,
-” টিকটিকিকে আমার ভীষণ ভ’য় হয়। রুমে এটা আছে। আজ তো আমি এ রুমে থাকতেই পারব না। এইরুমে থাকতে গেলেই টিকটিকির কথা মনে উঠবে আর ভয়ে আমার জান বেরোনোর জোগাড় হবে।”
নরম দু’টো হাতে দিব্যকে জড়িয়ে ধরেছে নিতি। বুকে গুঁজেছে মাথা। নিতিকে ছাড়িয়ে নিতে গিয়ে আচমকা দিব্যর হাত থেমে যায়। আচানক নিতির আলিঙ্গনে দিব্যর বুকের ভেতর যেন একসঙ্গে হাজারটা ঢেউ দৌড়ে চলেছে। হৃদপিন্ড ছন্দহীন বাজছে। দিব্যর গোটা শরীর শিহরিত হয়ে উঠল, তবে মনটা টলটলে সরোবরের জলের মতো শান্ত রইল। মনের দক্ষিণা দুয়ারে ঝিরিঝিরি শীতল হাওয়া বয়ে চলল নীরবে নিভৃতে। অবাধ্য মনটা শক্ত করে জড়িয়ে ধরতে চাইল বুকের উপর থাকা মেয়েটাকে। মনের আস্কারাকে পাত্তা দেয় না দিব্য। অনুভূতির জোয়ারে মন না ভাসিয়ে নিজেকে তটস্থ করল ও। অতঃপর একহাতে নিতিকে নিজের থেকে ছাড়িয়ে নেয়। নিতি মুখটা কাঁদো কাঁদো করে বলল,
-” সত্যি কিন্তু টিকটিকিকে আমার ভয় লাগে। এখন ভ’য় কাটানোর জন্য হলেও বাড়ির সবার সাথে থাকা আমার জরুরী। এইজন্য হলেও আজকের মতো প্যানিশমেন্ট মওকুফ করো।”
মাথাটা কিঞ্চিৎ নিচু করে নিতির দিকে ঝুঁকে দিব্য। নিতির অসহায় চোখে চোখ রাখে। নিতির কপালের উপর থাকা বেবি হেয়ার ফুঁ দিয়ে সরিয়ে দেয়। নিতি চোখ বুঁজে নিতে নিতে পলক তুলে চায়। দিব্য চোখেমুখে একরোখা হাসি নিয়ে বলল,
-” রিডিউস দ্য ড্রামা ডিয়ার।”
কথাটা শেষ করে দিব্য আর সময় বিলম্ব করে না। সিল্কি ঘনচুলে হাত বুলিয়ে গটগট করে রুম থেকে প্রস্থান করতে নেয়। নিতি হাত-পা ছুঁড়ে বিড়বিড় করে,
-” ধ্যাত! ভাল্লাগে না। নিখুঁত অ্যাক্টিং করেও লাভ হলো না। এ ঠিক ধরে নিলো।”
হঠাৎ কানে পৌঁছায় দিব্যর কণ্ঠস্বর। দরজার ওপাশ থেকে উল্টোদিক হয়েই আদেশের সুরে বলল,
-” ফাইভ মিনিটসের মধ্যেই ডায়নিংয়ে উপস্থিত হোস। আর হ্যা নেক্সট ফা’জ’লামি করলে, নো মার্সি। কথাটা মনে রাখবি।”
___________
গভীর রাত। আকাশজুড়ে মেঘের চাদর, জোৎস্নার আলো ঢাকা পড়ে আছে। বাতাস ভারী হয়ে আছে অদৃশ্য বেদনায়, যেন চারপাশের নিস্তব্ধতা কোনো অজানা অভিমান বয়ে বেড়াচ্ছে। দূরে ঝিঁঝিঁ পোকার এক ঘেয়ে ডাক, মাঝে মাঝে গলির কোণে কুকুরের হালকা ডাক শোনা যায়। ব্যালকনির কোণে রাখা দোলনায় বসে আছে তনুজা। গায়ে ঢিলেঢালা শাড়ি, এলোমেলো চুল, চোখদুটো অন্ধকারের গভীরতা মেপে নিচ্ছে। দোলনা ধীরে ধীরে দুলছে, কিন্তু মন পড়ে আছে অতীতের কষ্টের বেদনার স্মৃতিতে, যেখানে রয়েছে গভীর এক শূন্যতা। হঠাৎ কাঁধে উষ্ণ হাতের স্পর্শ টের পায় মেয়েটা। এ হাতের স্পর্শ চেনা, এই হাতের মালিক কে তা সেকেন্ডেই বুঝে নেয় তনুজা। ঘাড় ফিরিয়ে ইভানের মুখের দিকে তাকিয়ে মিহি স্বরে বলল,
-” আপনি এখনো ঘুমাননি?”
তনুজার পাশে ফাঁকা জায়গায় বসে ইভান। উত্তরে বলে,
-” ঘুম ভেঙে দেখি তুমি পাশে নেই। কী হয়েছে? মন খারাপ? নাকি আবার দুঃস্বপ্ন দেখেছো?”
মৃদু আলোয় তনুজার মুখশ্রী বড্ড বেশিই ম্লান লাগছে। তার থেকেও বেশি মলিন স্বরে বলল,
-” স্বপ্ন নয়, এমনিই ঘুম আসছিলো না। ভালো লাগছিলো না। তাই এখানে এসে বসেছি।”
ইভান অভিযোগ করে বলল,
-” এতরাতে একা একা এখানে বসে আছো। আমাকে ডাকতে পারতে। বলতে পারতে।”
-” মাত্রই আসছি।”
কিছুক্ষণ নীরবতা চলে। নীরবতা ভেঙে ইভান বলল,
-” তনুজা?”
-” হুম।”
কথাটা বলবে কী না ভেবে কূল হারিয়েছে ইভান। দ্বিধা দ্বন্দ্বের দোলাচল থেকে বেরিয়ে পরপর বলে উঠল,
-” তনুজা তোমার দাদি আজ ফোন দিয়েছি__”
কথাটা সম্পূর্ণ করতে দেয় না তনুজা। কথার মাঝেই বলল,
-” প্লিজ ইভান এটা বাদ দিন। আমার ভালো লাগছে না ওই মানুষটাকে নিয়ে কিছু শুনতে।”
ইভান দুই আঙুলে কপাল স্লাইড করে বলল,
-” আমি জোর করবো না তোমাকে। শুধু বলবো, রাগ-ক্ষোভ নিয়ে এমন কিছু করো না; যাতে ভবিষ্যতে কোন এক মূহুর্তে একটু হলেও আফসোসের সৃষ্টি হয়।”
-” ওনাকে নিয়ে কোনো কালেই আফসোস করার মতো কিছু থাকবে না।”
ইভান একহাতে আগলে নেয় তনুজাকে। রয়েসয়ে মোলায়েম স্বরে বলল,
-” তনুজা আমি জানি তোমার এই রাগ-ক্ষোভ, অভিমান ভুল নয়। তবে কেউ যদি তার ভুল স্বীকার করে ক্ষমা চায়, তাকে ক্ষমা করা উত্তম নয় কী? তুমি তো যথেষ্ট বুঝদার মেয়ে। তুমি কেনো এমন অবুঝপনা করছো বলো তো?”
-” ইভান আপনি জানেন না। হয়তো বা কিছু জানেন। জানা আর দেখা আলাদা। আলাদা ইভান অনেক আলাদা। আমি দেখেছি ওনার খারাপ রুপ। আমি চাইলেও ভুলে যেতে পারব না। মস্তিষ্কের কিছু
স্মৃতি ডিলেট করার অপশন থাকলে আমি ওই মানুষটার কৃতিকলাপের স্মৃতি মুছে দিতাম। এবার বলুন, তাকে ক্ষমা করা কী সহজ আমার জন্য?”
-” উনি ওনার পা’পে’র শাস্তি পাচ্ছে তো। উনি ওনার ভুলের জন্য জীবনের শেষ পর্যায়ে এসে অনুতপ্ত। অনুশোচনায় দ/গ্ধ। তোমার দাদি আমাকে ফোন দিয়ে বলছে, উনি একবার তোমাকে দেখতে চায়। তোমার কাছে ক্ষমা চাইবেন।”
তনুজা তাচ্ছিল্য হাসল। বলল,
-” এখন যখন ম”র”ণ”ব্যা”ধি কা’মড়ে ধরল, তখন এসে ভুল বুঝল। এখন পা’পমোচন করতে চাইছে। এতই সোজা!”
তনুজার বাবার কয়েকমাস আগে ক্যান্সার শনাক্ত হয়। আগে থেকেই শরীরে ক্যান্সারের জীবাণু বাসা বেঁধেছিল। ঠিকঠাক চিকিৎসা নেওয়া হয়নি। তারপর বেপরোয়া চলা ফেরা। রোগটা ধরা পড়ার পর থেকেই দিনদিন অবস্থা খুব ভয়ানক অবনতি হতে থাকে। অল্প দিনেই শয্যাশায়ী হয়ে পরে। ইভান বলল,
-” তনুজা যতই হোক উনি তোমার বাবা হোন। জীবনের শেষ প্রহরে দাঁড়িয়ে আছেন। ডক্টর বলেছেন যখন-তখন কিছু একটা হতে পারে। তুমি একবার ঠান্ডা মাথায় ভেবে দ্যাখো।”
-” আমার ভীষণ কষ্ট হয়, আমার বায়োলজিক্যাল ফ্যাদারের ভেতর নুন্যতম মনুষ্যত্ব ছিলো না। তিনি একজন মনুষ্যত্বহীন। আর কোনো মনুষ্যত্বহীন লোকের অন্তিম মুহূর্তেও তার জন্য আমার ভেতরে বিন্দুমাত্র কষ্ট হবে না। একটা খারাপ লোকের জন্য আমার হৃদয় কাঁদে না।”
তনুজার মাথায় একহাত বুলিয়ে ইভান মৃদুস্বরে বলল,
-” এই পৃথিবীতে সবাই সমান হয় না। ভালো-মন্দ মিলেই এই পৃথিবী। যেমন ভালো মানুষও আছে আবার খারাপ মানুষও। ভালোর সংখ্যা সীমিত। আর যার যার কৃতকর্মের ফল, ইহলোকে না পেলেও পরলোকে পাবেই। উনি ওনার কর্মের ফল পাচ্ছেন। তুমি যেহেতু ওনার মেয়ে। মেয়ে হিসেবে তোমার দায়িত্বটা তো তোমাকে পালন করতে হবে। সে যতই খারাপ হোক।”
তনুজার এবার কেনো জানি কান্না পাচ্ছে। ভেজা গলায় বলল,
-” ইভান এই পৃথিবীতে হাজারো মানুষ থাকতে আমারই কেনো ওমন একটা খা’রা’প মানুষের ঘরে জন্ম হলো! বুদ্ধি হওয়ার পর যখন কেউ আমাকে উদ্দেশ্য করে বলত, ঐযে মা’তা’ল খারাপ চরিত্রের লোকের মেয়ে। এই মেয়েকে কোনো ভালো ঘরের লোকজন তো তুলবেই না। সেইসময় আমার ম/রে যেতে ইচ্ছে করতো।”
শেষের কথা বলতে গিয়ে ঝরঝরিয়ে কেঁদে উঠল তনুজা। তনুজার মাথাটা বুকে চেপে ধরে ইভান। দুই হাতে ইভানের পিঠের টিশার্ট আঁকড়ে ধরে বুকে মুখ গুঁজে সশব্দে ঝরঝরিয়ে অশ্রু বিসর্জন দেয় তনুজা। ইভান বাঁধা দেয় না। কান্না করলে হালকা লাগবে, ভেতরে জমা কষ্টের পাথরটা বুক থেকে আলগা হবে। কিছুক্ষণ পর, তনুজা ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকে। ইভান তনুজার মুখটা স্বীয় বুক থেকে তোলে। দুই হাতে আঁজলে ধরে। অস্ফুট স্বরে বলে,
-” তনুজা তাকাও, তাকাও আমার দিকে।”
তনুজার ফুপানোর শব্দ ফের বাড়তে থাকে। ইভান এবার প্রগাঢ় স্বরে বলল,
-” তনুজা তাকাও আমার চোখের দিকে।”
পদ্ম পাতার মতন চোখের ভেজা পাপড়ি তুলে চায় তনুজা। ইভান আঙুল দিয়ে তনুজার চোখের কোল ঘেঁষে পরা অশ্রুবিন্দু ফেলে দেয়। মুখে বলল,
-” হুঁশ..আর কান্না নয়। আর একফোঁটাও অশ্রু বিসর্জন দিবে না। অনেক কান্না করেছো আর নয়। ভুলে যাও অতীতের তিক্ত বিষাদ স্মৃতিকে।”
তনুজা ঠোঁট কামড়ে ধরে কান্না সংবরণের চেষ্টা করে। ইভান বলতে থাকে,
-” তোমার মুখের হাসি আমার পৃথিবী। তোমার অশ্রুসজল নয়ন আমার অন্তর পোড়ায়। আমি কথা দিচ্ছি, যতদিন বেঁচে আছি, তোমার পাশে থাকব। তোমার মুখে হাসি ফোটাব।”
এক সেকেন্ড থেমে লম্বা দম ফেলে ফের বলল,
-” আমি প্রতিজ্ঞা করছি, জীবনের প্রতিটি ধাপে তোমার হাত ধরে রাখব, কষ্টের আর এক ফোঁটা অশ্রুও তোমার চোখে আসতে দিবো না।”
ইভান কথাটা শেষ করে তনুজার কোলের উপর থাকা নরম হাতটার উপর রুক্ষ হাতটা রাখে। তনুজা ইভানের বুকের উপর মাথা রাখে। ইভানের বুকের উপর মাথা রেখে চোখদুটো বুঁজে নেয় তনুজা। ইভান একহাতে তনুজার পিঠ পেঁচিয়ে ধরে। বুক ভরে নিঃশ্বাস নেয়। প্রশান্তিতে ভরে ওঠে তনুমন। এভাবে অনেকক্ষণ থাকতে থাকতে তনুজা ঘুমিয়ে পরে। অতঃপর আলগোছে তনুজাকে কোলে তুলে নেয় ইভান। পরপর ধীরে ধীরে বেডে শুয়ে দেয়। মুখের উপর থেকে চুলগুলো একহাতে সরিয়ে দিয়ে কপালে অধরজোড়া ছোঁয়ায় ইভান। অতঃপর চাদরটা গায়ে টেনে তনুজাকে বুকে টেনে নেয়। আলতো করে জড়িয়ে ধরে অস্ফুট স্বরে বলল,
-” এভাবেই আমার ভালোবাসার উষ্ণ স্পর্শের চাদরে মুড়িয়ে সারাজীবন রাখব তোমায়। তোমার প্রতিটি রাত শেষ হোক আমার বুকে মাথা রেখে স্বপ্ন দেখার মধ্য দিয়ে।”
_________
রোদ ঝলমলে দিন। ঘড়ির কাঁটা নয়টার ঘর পেরিয়েছে। নিতি তাড়াহুড়ো করে ধপধপ পা ফেলে সিঁড়ি দিয়ে নামছে। একহাতে ব্যাগ অন্যহাতে ওড়নাটা কাঁধের একপাশে নামিয়ে ঠিক করতে করতে লিভিংরুম পেরিয়ে ত্রস্ত পায়ে যাচ্ছিল নিতি। এমন সময় পিছু ডাকে ফিরে চায়,
-” হ্যা রে নিতি, সকাল সকাল কই যাচ্ছিস?”
বৃদ্ধা নুরজাহান সোফায় বসে পান চিবুতে চিবুতে হাঁক ছেড়ে ডাকলেন। নিতি জবাবে বলল,
-” ভার্সিটিতে। ক্লাস শুরু হয়েছে।”
নুরজাহান কয়েক সেকেন্ড নিশ্চুপ থাকলেন। ডায়নিং টেবিলে বসা দিব্যর দিকে একপল তাকিয়ে ফের নিতির দিকে তাকিয়ে বললেন,
-” ছোট কর্তা তো এখনই বেরোবে। একসাথে যা। পৌঁছে দিবে।”
দিব্য ঢকঢক করে পানি খেয়ে উঠে দাঁড়াতে দাঁড়াতে বলল,
-” আমার কাজ আছে।”
নুরজাহান শুনলেন না। এক প্রকার জোর করেই নিতিকে দিব্যর সাথে পাঠিয়ে দিলেন। বাইক জ্যামে আটকা পরেছে। এমন সময় নিতির কল আসে। রিসিভ করতেই পুরুষালি কণ্ঠ ভেসে আসে। ওপাশের ভয়েজ অল্প স্বল্প শুনতে পায় দিব্য। নিতির সেই ছেলে ফ্রেন্ড এটা টের পেতেই দিব্যর রাগ হয়। কপালের শিরা দপদপ করতে থাকে। ছেলেটা নিতি আসছে কী না, জিজ্ঞেস করছে। নিতি ফোন রাখতেই দিব্য দাঁত কটমট করে শুধাল,
-” তোর ঐ রোগা পাতলা ছেলে ফ্রেন্ড কী যেন নাম?”
নিতি ঝটপট বলল,
-” তুষার! তুষারের কথা বলছো?”
-” হ্যা। ওকে একটু বেশি করে খেয়ে-দেয়ে স্বাস্থ্যবান হতে বলিস।”
নিতি এরুপ কথা শুনে অবাক বনে যায়। বিস্মিত হয়ে বলল,
-” হঠাৎ ওর স্বাস্থ্য নিয়ে পড়লে যে। বুঝলাম না!”
-” তোকে বুঝতে হবে না। স্বাস্থ্যবান হতে এইজন্য বললাম, যাতে দিব্যর হাতের একটা চ’ড় খেয়েই অক্কা না পায়। যে পাটকাঠির মতো শরীর, আমার হাতের একটা ঘু’ষি খেলে পটল তুলবে নো ডাউট।”
দিব্যর কথা বুঝতে নিতির ঢের সময় লাগে। নিতি মনে মনে আওড়ালো,
-” তবে কী রাগি রাজা জেলাস? এরুপ কথার কারন, কোনো ভাবে তুষারকে নিয়ে জেলাসি ফিল করছে? এমন হলে মন্দ হয় না। ইশশ্! আরেকটু জেলাস ফিল করানোর জন্যে নিতি তুই ঝটপট কিছু ভেবে ফেল।”
#চলবে