প্রণয়ের বাঁধন পর্ব-৩৭+৩৮

0
92

#প্রণয়ের_বাঁধন |৩৭|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

রোদ ঝলমলে শ্রাবণের সকাল, নিস্তব্ধ ঘরে ধীরে ধীরে ঘুম ভাঙল নিতির। চোখের পাতায় তখনও ঘুমের আবেশ, যেন স্বপ্নের তাজা রেখা মুছে ফেলার আগেই প্রকৃতি তাকে স্বাগত জানাতে আসছে। কাঁচের জানালার ফাঁক গলিয়ে সোনালি রোদ্দুর রুমে প্রবাহিত হয়ে উষ্ণতা ছড়িয়ে দিচ্ছিল। একফালি রোদ চোখে পড়তেই নিথর ঘুমে আচ্ছন্ন নিতির চোখদ্বয় ধীরে ধীরে খোলার প্রস্তুতি নেয়। কিন্তু ঘুমের মাঝেই এক অদ্ভুত অনুভব, কোমড়ে শক্ত এক বাঁধন। নিতি চট করে চোখ মেলে তাকিয়ে দেখে, ঘুমে আচ্ছন্ন দিব্য তার কোমড় একহাতে শক্তভাবে আঁকড়ে ধরে, গায়ের সঙ্গে মিশে শুয়ে আছে। বিস্ময়ে নিতির চোখদুটো বড়বড় হয়ে যায়। নিতি হতভম্ব হয়ে তাকিয়ে রয়। রোজকার দিনের মতো ভারত-পাকিস্তান সীমারেখা টানতে কাজে আসা কোলবালিশটি আজ হঠাৎ উধাও! আর কীকরে দিব্যর এতটা কাছে এসেছে? প্রশ্নগুলো মস্তিষ্ককে ঘুরপাক খাচ্ছে। কিন্তু উত্তর অজানা! কেবল আকাশছোঁয়া বিস্ময়। নিতি তড়িঘড়ি করে দিব্যর হাতটা কোমড় থেকে সরানোর চেষ্টা করে। কিন্তু দুই হাত দিয়ে চেষ্টা করেও কিছুতেই সফল হলো না। অতঃপর কণ্ঠে কঠোরতা টেনে বলল,

-” ছাড়ো! ছাড়ো বলছি।”

দিব্যর কপাল কুঁচকে যায়। যেন খুব বিরক্তি ভর করেছে ওর উপর। একটু নড়েচড়ে চায় দিব্য। চোখের ভারী পাতা টেনেটুনে তুলে ঘুমঘুম কণ্ঠে বলল,

-” কী হয়েছে?”

নিতি অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। আচমকা মুখ থেকে বেরিয়ে আসে,

-” তুমি আমার এত কাছে কী করে?”

দিব্য যেন আকাশ থেকে পরে। এক ঝটকায় এদিক-ওদিক তাকিয়ে অবাক হওয়ার ভান ধরে বলল,

-” আমি! আমি নই তুই আমার কাছে। আমি তো নিজের বালিশেই আছি। বরং দ্যাখ তুই জায়গা ছেড়ে আমার জায়গায় চলে এসেছিস।”

দিব্যর হাতের বাঁধন ঢিল হতেই নিতি তড়িঘড়ি ওঠে বসে। কপালে গভীর ভাঁজ ফেলে বলে,

-” আমি কখন?”

-” ঘুমের মধ্যে।”

-” অ্যা!”

দিব্য উঠে বসতে বসতে বলল,

-” হ্যাঁ, ‌ঘুমের ঘোরে শুধু জড়িয়েই ধরিসনি। আরো কত কী..।”

দিব্যর কথা শুনে নিতির মুখটা থমথমে হয়ে যায়। কাঁদো কাঁদো মুখ করে বলল,

-” আরো কত কী মানে? অসম্ভব! মিথ্যে বলছো।”

শেষের কথাগুলো বড়বড় চাউনীতে চেয়ে চেঁচিয়ে বলে ওঠে নিতি। দিব্য ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে শোয়া থেকে ওঠে বসে। একহাতে একটা বালিশ কোলের উপর বসিয়ে মুখটা ইন্নোসেন্ট বানিয়ে বলে,

-” তোর মনেহয় আমি এ ব্যাপারে মিথ্যে বলব? সবচেয়ে বড় কথা, আমি নিজ থেকে তোকে কাছে টানবো? এ-ও তোর কাছে বিশ্বাসযোগ্য!”

শেষের কথাটা নিতির গায়ে লাগে। কিছুটা অপমানিত বোধ করে। তবে দিব্যর কথাও পুরোপুরি অবিশ্বাস্য ঠেকছে না। নিতি আর এ ব্যাপারে টু শব্দটি করতে চায় না। মুখ বেঁকিয়ে বেড ছেড়ে নামতে নেয়, তন্মধ্যে দিব্য ফিচেল হেসে বলল,

-” কিসব বাচ্চাদের মতো গেঞ্জি পরে ঘুমোস। আজকের পর থেকে এসব বাদ দিয়ে বড়সড় ড্রেস পরে ঘুমোবি, ক্যামন?”

নিতি ঘাড় ঘুরিয়ে দিব্যর দিকে তাকায়। দুইহাত নিজের গায়ের দিকে ধরে দাঁত চেপে বলল,

-” এটা গেঞ্জি নয়। এটা লেডিস টিশার্ট, ক্লিয়ার?”

-” যা ফিনফিনে, শরীরের অবয়ব স্পষ্ট বোঝা যায়। তবে তুই যদি আমাকে সিডিউস করতে এসব পড়িস। তাহলে বলবো, আচ্ছা ঠিক আছে।”

নিতির চোখদুটো বিস্ফোরিত হয়। তৎক্ষণাৎ দুইহাতে টেনেটুনে টিশার্ট ঠিক করতে ব্যস্ত হয়ে পরে, ত্রস্ত হাতে প্লাজু টেনে দেয় গোড়ালি অবধি। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে জড় গলায় বলে উঠল,

-” ই-ইউ রং। আমার বইয়ে গিয়েছে তোমাকে সিডিউস করতে। গরমের মধ্যে এটা পরে ঘুমুতে কমফোর্টেবল ফিল করি। তাই, হু।”

কথা শেষ করেই নিতি চপল পায়ে ওয়াশরুমে ঢোকে। দিব্য ধপ করে বিছানায় শরীর এলিয়ে দেয়। রোদের তীক্ষ্ণ আভা থেকে বাঁচতে আলতো করে চাদর টেনে নেয় মুখের ওপর।

_______

ডাইনিং টেবিলে নাস্তার তোড়জোড় চলছে। ধোঁয়া ওঠা খিচুড়ি, বেগুন ভাজা, ইলিশ মাছ ভাজা, ডিমের ঝুরি, মুরগির কষা আরো গরম গরম ফুলকো রুটি আর পরোটা সাজানো টেবিলজুড়ে। নিতি তনুজার পাশে দাঁড়িয়ে সাহায্য করছে, প্লেটে খাবার গুছিয়ে রাখতে। তন্মধ্যে নৃত্য প্রাণবন্ত হাসি নিয়ে পাশে এসে দাঁড়িয়ে বলল,

-” গুড মর্নিং এভরিওয়ান!”

তনুজা ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি টেনে জবাব দেয়,

-” গুড মর্নিং ননদিনী।”

নৃত্য বিনিময় প্রশস্ত হাসলো। চেয়ার টেনে বসতে গিয়ে আচমকা নৃত্যের চোখ নিতির দিকে আটকালো। কপাল কুঁচকে সরু চোখে চেয়ে নিতিকে উদ্দেশ্য করে প্রশ্ন করল,

-” আপু! তোমার গলায় কীসের দাগ?”

নিতি বি’র’ক্ত মুখে তাকিয়ে বলল,

-” কই! কোথায়?”

নৃত্য আঙুল তুলে দেখিয়ে বলল,

-” এইযে এখানে? কেমন কালচে হয়ে আছে?”

নিতি ঢের বি’র’ক্তি নিয়ে অতীষ্ঠ চোখে চেয়ে বলল,

-” এইযে এখানে এখানে করছে..আমি মনেহয় দেখতে পাচ্ছি।”

নৃত্য ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে নিতির কাঁধ ধরে বেসিনের সামনে এনে দাঁড় করায়,

-” আমার কথা বিশ্বাস হচ্ছিল না তো। এবার আয়নায় নিজেই দ্যাখো।”

নিতির চোখ আয়নায় পড়তেই ফর্সা গলায় জমাট বাঁধা কালচে দাগ স্পষ্ট হয়ে ওঠে। মূহুর্তেই কপালে ভাঁজ পরে। কিছু বুঝে ওঠার চেষ্টা করে। কিছুপল পর নির্বোধের মতোন চেয়ে পরপর বলল,

-” কী জানি বুঝতে পারছি না। পিঁপড়ে-টিপড়ে কা’ম’ড়েছে হয়তো।”

নৃত্য অবাক হয়ে বলল,

-” পিঁপড়ে! পিঁপড়ে আসবে কোত্থেকে? আমি তো ভেবেছিলাম তোমার মে বি এলার্জি হয়েছে।”

ওদিকে তনুজা মিটমিট করে হাসছিল। তনুজার মুখের অভিব্যক্তি দেখে নিতির মস্তিষ্ক সজাগ হয়। কপালের ভাঁজ মিলিয়ে যায়। মনে মনে দিব‌্যকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। এদিকে তনুজার হাসি দেখে নিতির লজ্জা অস্বস্তি হয়। নিতির সমস্ত রাগ-ক্ষোভ গিয়ে বর্তাল নৃত্যর উপর। দাঁত কিড়মিড় করে বলল,

-” আনারসের শরীরের মতো শখানেক চোখ নিয়ে ঘুরিস নাকি? কারো চোখে ধরা না পড়লেও তোর চোখের আড়াল হয় না কিছু।”

নৃত্য তাজ্জব বনে যায়। সে আবার কী করল? যার দরুণ নিতির এরুপ তিরস্কার! নৃত্য আঙুল দিয়ে চোখের চশমাটা ঠিক করে ঠোঁট উল্টে বলল,

-” আমার চোখের আবার কী দোষ? বুঝলাম না তো।”

তিরিক্ষি গলায় নিতি বলল,

-” বুঝতে হবে না তোর।”

এরমধ্যে তনুজা আলতো গলায় বলল,

-” নৃত্য তোমার স্কুলের টাইম হয়ে যাচ্ছে তো। তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট সেরে নাও। নইলে ফুপি এসে আবার ব’ক’বে।”

দুইবোনের কথা কা’টা’কা’টি মিমাংসা করতে তনুজা তাড়া দেখিয়ে বলে নৃত্যকে। তনুজার দিকে তাকিয়ে স্মিত হেসে বলে নৃত্য,

-” থ্যাংকিউ ভাবিমণি।”

তনুজা কিচেনে যায়। নিতির চুলগুলো মাথার উপর ঝুঁটি করে বাঁধা ছিলো। গলা ঘেঁষে কাঁধের উপর দিয়ে চুলগুলো সামনে রাখে, দাগটা আড়াল করতে। ডাইনিংয়ে এখনো বড়রা আসেনি। এরমধ্যে আজ সকাল সকাল দিব্যর আগমণ দেখে নিতির ভ্রু কুঁচকে যায়। হালকা ভেজা চুল। মনে হচ্ছে শাওয়ার নিয়ে সোজা চলে এসেছে। চুলের ভেজাভাব এখনো শুকায়নি। নীলচে ডেনিম জিন্স, পারফেক্ট ফিট, সাথে সাদা টিশার্ট। শরীরের সাথে একটু ঢিলেঢালা, কিন্তু এতেই যেন বেশি স্টাইলিশ লাগছে। দিব্য চুলে আঙুল চালিয়ে সামনে এল। নিতির দৃষ্টি থমকে গেল। নিজেকে সামলে পরপর দৃষ্টি সরিয়ে নেয় নিতি। দিব্য কোনোদিকে না তাকিয়ে সোজা চেয়ার টেনে বসতে নেয়, সেই মূহূর্তে নিতি দিব্যর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে হালকা কাশে,

-” এহেম এহেম।” শব্দ করে। দিব্যর হাত দু’টো চেয়ারের পিঠে থেমে যায়‌‌। ভ্রুকুটি করে নিতির দিকে চাইল। নিতি রাগি দৃষ্টি নিক্ষেপ করে দিব্যর দিকে। একহাত কানের পাশে নিয়ে চুলকানোর ভঙি করে। তারপর গলার কাছে আঙুল ছুঁইয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,

-” এসবের মানে কী? ঘুমের মধ্যে আমি তোমার কাছাকাছি যায়নি, এটা স্পষ্ট প্রমাণ। বরং তুমিই আমার ঘুমের সুযোগ নিয়েছো।”

দিব্য নির্লিপ্ত, নির্বিকার। ভ্রুদ্বয়ের ভাঁজ মিলিয়ে শান্ত গলায় বলল,

-” আগে তোর একটু-আকটু মাথা খারাপ ছিলো। তবে ইদানিং দেখছি পুরোটাই খা’রাপ হয়েছে। তা পাবনায় পাঠানোর ব্যবস্থা করবো নাকি?”

স্বীকার তো করলোই না, উল্টো ঘুরিয়ে ফিরিয়ে পা/গ/ল বলে ছাড়ল। নিতির মেজাজ চ’টে যায়। কিছু বলার আগেই দিব্য নিম্নস্বরে বলল,

-” তোর ঘুমের সুযোগ নিবো! যেখানে শুরু থেকেই হাজারো সুযোগ তুই দিয়ে এসেছিস। কখনো সুযোগ লুফে নেওয়ার চেষ্টা করেছি? বল…তুই বল?”

-” আগের কথা আর এখনকার কথা এক নয়। ইদানিং আবহাওয়ার মতো থেকে থেকেই চেঞ্জ হচ্ছে তোমার মুড। যা আমি স্পষ্ট বুঝতে পারছি।”

-” ইউ টোটালি রং।”

নিতি বিড়বিড় করে বলে,’ যতদিন মুখ ফুটে স্বীকার না করছো, তুমি আমাকে ভালোবাসো। ততদিন তোমার প্রতি হওয়া আমার অনুভূতিগুলো প্রকাশ করবো না। আর তোমাকে একটু শা’স্তি দেওয়ার জন্য, নিজে থেকে ধরা না দেওয়া, এন্ড নিজেকে দূরেদূরে রাখা। কিন্তু তুমি তো তুমিই! এক আচ্ছা ধূর্ত! ধূরন্দর লোক! দূর্বলতা প্রকাশ করবে না, আরো উল্টো ঘোল খাইয়ে ছাড়বে। উফ্!’

এসব কথা মনে মনে ভেবে পিছু ঘুরতে নেয়, কাঁধের উপর দিয়ে সামনে থাকা চুলের গাছি ইচ্ছে করে পিছুনে বারি মা’রে, যা দিব্যর মুখের উপর গিয়ে পরে। ঘাড় ফিরিয়ে দিব্যর দিকে তাকিয়ে ভাব নিয়ে চেয়ার টেনে পরপর বসতে নেয় নিতি। ওদিকে দিব্য রাগল না, শান্ত থাকল। মুখে বাঁকা হাসি নিয়ে মনে মনে শয়তানির ফন্দি আঁটে । ঠিক যখন নিতি বসতে নিচ্ছে, তখনই দিব্য পিছুন থেকে নিঃশব্দে চেয়ারটা সরিয়ে নেয়।

-” ধপাস!”

শব্দ করে নিতি সোজা ফ্লোরে পরে। তৎক্ষণাৎ কোমড়ে হাত রেখে চোখমুখ ব্যাথায় কুঁচকে মৃদু আর্তনাদ করে ওঠে,

-” আহ্!”

ওদিকে দিব্য নির্বিকার ভঙ্গিতে নিজের চেয়ারে বসতে থাকে। মুখে এক চিলতে ফিচেল হাসি। ওপাশের চেয়ারে বসে খাবার খাচ্ছিল নৃত্য, এ দৃশ্য দেখে মিটমিট করে হাসতে থাকে। তন্মধ্যে শিরিন ডাইনিংয়ে আসতে গিয়ে নিতিকে দেখে চমকে ওঠে শুধালেন,

-” ওমা! সেকি নিতি পড়লি কী করে!”

নিতি দাঁতে দাঁত চেপে কটমট চোখে দিব্যর দিকে চেয়েছিলো। শিরিনের কথা কানে পৌঁছতেই উঠে বসতে নেয়। এরমধ্যে শিরিন তড়িঘড়ি করে কাছে আসে। উদ্বিগ্ন কণ্ঠে প্রশ্ন করলেন,

-” কোথাও লাগেনি তো? আর পড়লি কীভাবে?”

-” তোমার আদরের ধন গুনধর পুত্রকে সেটা জিজ্ঞেস করো?”

নিতির এটা বলতে ইচ্ছে করলেও মুখে এটা না বলে নিশ্চুপ থাকে। এরমধ্যে শিরিন দিব্যকে উদ্দেশ্য করে ধ’ম’কের সুরে বললেন,

-” মেয়েটা পরে গিয়েছে, কোথায় টেনে তুলবি। তা না আরাম করে বসে আছিস।”

দিব্য নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,

-” দেখেশুনে না চললে তো পড়বেই। মাম্মা তুমি আমাকে না বলে, যে পড়েছে তাকে বরং দেখেশুনে চলতে-ফিরতে বলো।”

বিস্ময়ে নিতির চক্ষু কোটর ছাড়ার জোগাড়। কী ডাহা মিথ্যা! আগে হলে নিতি শিরিনের কাছে নালিশ করতো। মামী তোমার ছেলে এহেন কর্ম করে কী সুন্দর অবলীলায় মিথ্যে বলছে! তবে আজ শুধু মামী নয় শ্বাশুড়িও। তাই বলতে গিয়েও বলল না। বরং পরে দিব্যকে দেখে নিবে বলে চুপচাপ রইল। হাত দু’টো ঝেরে চেয়ারে বসল।

এরমধ্যে তামান্না উপস্থিত হয়। তনুজা কিচেন থেকে এদিকেই আসছিলো হঠাৎ শিরিন ডাকল,

-” তনুজা?”

-” হ্যা মামনি।”

-” ইভানকে দেখছি না। এখনো নিচে নামেনি যে।”

-” একেবারে রেডি হয়ে আসছে হয়তো। চলে আসবে এক্ষুনি।”

-” সবাই বসেছে, ছেলেটা এখনো নামল না।”

তনুজা আলতো হেসে বলল,

-” আমি দেখছি মামণি।”

শিরিন ইতস্তত গলায় বলল,

-” আবার কষ্ট করে উপরে উঠবে। বুয়া ডেকে..”

কথার মাঝেই তনুজা নম্র স্বরে বলল,

-” সমস্যা নেই মামণি। আমি এমনিতেই এখন উপরেই যাচ্ছিলাম ফ্রেশ হতে।”

শিরিন অমায়িক হেসে বলল,

-” ওহ্ ঠিক আছে।”

তনুজা রুমে যাবে বলে পা বাড়াতে গিয়ে থেমে যায়। পরপর বুয়াকে ডেকে বলল,

-” দিদুনের খাবার গুছিয়ে রেখেছি। রুমে দিয়ে এসো।”

বুয়া -“আইচ্ছা ভাবীমণি” বলে খাবার নিয়ে পা বাড়ায়। তনুজা উপরে যেতে থাকে। নুরজাহানের কোমড়ের ব্যাথা বেড়েছে বিধায় বেড রেস্টে আছেন। বাড়ির সকলের প্রতি তনুজার দায়িত্ব পালন দেখে শিরিন ক্ষণেক্ষণেই মুগ্ধ হোন মেয়েটির উপর। মেয়েটার সব দিকে কত সুন্দর নজর! লক্ষীমন্ত একটা মেয়ে। মনেমনে বলে আলতো হেসে হাতের কাজে মনোযোগ দেয় শিরিন সুলতানা। ফ্রুটস জেলির কৌটা আর ব্রেড দিব্যর দিকে এগিয়ে দিতেই দিব্য বলল,

-” এটা রাখো। খিচুড়ি দাও। ওটাই খাব।”

দিব‌্যর সকালের নাস্তায় আজ হঠাৎ পরিবর্তন দেখে শিরিন খানিকটা বিস্মিত হলেন। দিব্যর প্লেটে ইলিশ মাছ ভাজি আর বেগুনের চাক ভাজি তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলেন,

-” দিব্য আজ এত তাড়াতাড়ি ব্রেকফাস্ট টেবিলে। কোনো কাজ আছে?”

দিব্য ছোট করে বলে,

-” হুম।”

নিতি ভেংচি কে’টে মনেমনে বলে,’ এর আবার কাজ। ঐতো গিয়ে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিবে। সাথে এটা-ওটা ঝামেলা পাকাবে। এছাড়া আর কী? হুঁ!”

এসব ভেবে মাথা ঝাড়া দিয়ে খাবার মুখে তুলে নেয় নিতি। খাবার চিবুতে চিবুতে আড়চোখে দিব্যর দিকে তাকায়। সবার অগোচরে দিব্যর দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

-” কী যেনো এক কথায় প্রকাশ ছিলো, ও হ্যা মনে পড়েছে। আমিষের অভাব; যাকে এককথায় বলে নিরামিষ। তা নিরামিষ থেকে নিজেকে কনভার্ট করে আমিষে রুপান্তরিত হচ্ছো নাকি? সেইজন্য আজকে ব্রেকফাস্টে বেডের জায়গায় আমিষ খাচ্ছো।”

দিব্য একহাতে পানির গ্লাস তুলে নিয়ে ঢকঢক করে পুরো গ্লাস সাবাড় করে গ্লাসটা টেবিলে নামায়। নিতি কোনো উত্তর না পেয়ে খাওয়ায় মনোনিবেশ করে। এরমধ্যে হঠাৎ পায়ে স্পর্শ পেতেই নিতির সারা শরীর কেঁপে উঠল। পুরো শরীর জুড়ে বিদ্যুতের ঝলকানির মতো শকড খায়। দিব্য পা দিয়ে নিতির পায়ে স্লাইড করে। দিব‌্যর চোখে চঞ্চল ভঙ্গি। ঠোঁটে রহস্যময় হাসি। নিতির পায়ের উপর পা দিয়ে স্লাইড করতে করতে নিতির দিকে ঝুঁকে ফিসফিসিয়ে বলল,

-” তোর কথা ভেবে ভেজিটেরিয়ান থেকে নন-ভেজেটেরিয়ান হতে পারছি না। একবার নন-ভেজ হলে তোকে আর খুঁজে পাওয়া যাবে না। আমাকে সামলাতে হিমশিম খাবি। আমার স্পর্শে সেন্সলেস হয়ে না পড়িস সেই ভয়ে, আজীবন ভেজই না থাকতে হয়।”

নিতির গাল লজ্জায় পাকা টমেটোর মতো লাল হয়ে উঠল। তবে কণ্ঠে লজ্জার লেশমাত্র নেই। নিজেকে সামলে গভীর চোখে তাকিয়ে, দৃঢ় স্বরে বলল,

-” তুমি যদি ভেবে থাকো আমি দূর্বল। তবে ভুল ভাবছো। তুমি ঝড় হলে, আমি পাহাড়। তোমার দাপট সামলানোর শক্তি আছে আমার।”

কথাটা বলতে বলতে নিতি নিরাপদ দূরত্বে পা সরিয়ে নেয়। দিব্য নিতির চোখে গভীর দৃষ্টি রাখল। ঠোঁটের কোণে চিরচেনা বাঁকা হাসি। কণ্ঠে রহস্য মিশিয়ে ফিসফিস করে বলল,

-” ইউ থিংক ইউ আর আ মাউন্টেন? উই’ল সী। টুনাইট, ইউ উইল হ্যাভ টু প্রুভ জাস্ট হাও স্ট্রং ইউ রিয়েলি আর অ্যাগেইনস্ট মাই স্টর্ম।”

এক চিলতে দুষ্টুমি হাসি ছুঁড়ে মুখ ফিরিয়ে নেয় দিব্য। যেন কথাগুলো বাতাসে মিশে রইল। রাতের প্রতিক্ষায়। এদিকে নিতি শুকনো ঢোক গিলল। ওতো মজার ছলেই অমন করে বলেছিলো। কিন্তু দিব্য যে সিরিয়াসলি নিবে তা ঘূর্ণাক্ষরেও টের পায়নি নিতি।

__________

ঘড়ির কাঁ’টা রাত বারোটার ঘর পেরিয়ে, এক পা এক পা করে চলে যাচ্ছে গভীর রাত্রির দিকে। বাইরে রাতের আকাশে মেঘের ঘনঘটা, দমকা হাওয়া যেকোনো মুহূর্তে ঘূর্ণির মতো ছুটে আসবে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির শব্দ এক অন্যরকম আবহ তৈরি করেছে, যেন এক মনোরম সুরে প্যাঁচানো। বিছানার হেডের সাথে হেলান দিয়ে শুয়ে দিব্য‌। পরনে ব্লু টিশার্ট আর এ্যশ কালারের ট্রাউজার। এক পায়ের সাথে অন্য পা মেলে শুয়ে ফোন স্ক্রল করছে। আর মাঝে মাঝে ধোঁয়া ওঠা কফির মগে চুমুক দিচ্ছে।

রুমের একপাশে থাকা কুশনে বসে নিতি। গায়ে হালকা রঙের সুতির কুর্তি। কোমল সিল্কি চুল পিঠজুড়ে ছড়িয়ে। নিতি ফোনে কথা বলছিলো বান্ধবীর সাথে। ফোনে বান্ধবীর সাথে গল্প করতে করতে, হাসি ঠাট্টার মাঝে এক অদ্ভুত আনন্দে ডুবে যাচ্ছিল নিতি। সকালবেলায় নাস্তার টেবিলে বসে দিব্যর বলা কথা বেমালুম ভুলে বসেছে। দিনভর ব্যস্ততার মাঝে সকালের কথা এখন অবধি মাথায় আসেনি। নিতি ভেবে নিয়েছে দিব্যও তার মতোই ফাজলামি করেই বলেছে। ভিডিও কলে কথা বলছে আর কফি খাচ্ছে নিতি। অনেকক্ষণ গল্প শেষে ফোনের ওপাশ থেকে রিয়া বড় করে হামি দিয়ে বলল,

-” ঘুম পাচ্ছে রে। অনেক রাত হয়েছে। রাখি।”

নিতি বলল,

-” আচ্ছা।”

ফোন কাটতে গিয়ে রিয়া হঠাৎ টিপ্পনি কে’টে বলল,

-” এই যাহ্! এত সুন্দর বৃষ্টির রাতে এত সময় ফোনালাপ করে তোদের রোমান্টিক মূহুর্তটা ন’ষ্ট করে ফেললাম না তো! তুই মুখে বলতে পারছিলি না, তবে মনেমনে নিশ্চয় বেজায় চটেছিস আমার উপর। স‌্যরি রে দোস্ত! বিষয়টা আমার মাথায়ই ছিলো না।”

নিতি প্রত্যুত্তরে বলল,

-” আরেহ না না! তুই যেমন ভাবছিস ওমন মোটেই নয়।”

-” আচ্ছা দোস্ত ভালো থাক। গুড নাইট।”

-” গুড নাইট।”

ফোন কা’ট’তে কা’ট’তে মুখ ফস্কে বলে ফেলে নিতি,

-” সবাই কী ভাবে! অথচ তারা তো আর জানে না, আমার তিনি হলেন এক তৃণভোজী..।”

বিছানার দিকে যেতে যেতে কথাটা বলে নিতি। সামনে তাকাতেই দিব্যর চোখে চোখ পরে। দিব্য এদিকেই চেয়েছিলো। দিব‌্যর দৃষ্টি দেখে নিতির মুখটা হা হয়ে যায়। মনেমনেই কপাল চাপড়ায় নিতি। সাথে নিজেকে হাজারটা গা/লি দেয়। কথাটা আগে এত বলতো যে নিতির মুদ্রাদোষ হয়েছে। সময় অসময়ে মুখ ফস্কে বেরিয়ে পরে। বেডের পাশে বেড-টেবিলের উপর নিতি ফোনটা নামিয়ে রাখে। দিব্য তড়াক পা দু’টো ঝুলিয়ে বসল। কণ্ঠে মেকি আক্ষেপ জড়িয়ে বলল,

-” ওপসসস! আমি তো ভুলেই গিয়েছিলাম।”

নিতির কণ্ঠ কেঁপে ওঠে, ফাঁকা ঢোক গিলে অস্ফুটে বলে,

-” ক-কী?”

দিব্য ধীরসুস্থে উঠে দাঁড়ায়। কফির মগে শেষ চুমুক বসিয়ে নিতির দিকে ঝুঁকে সুর তোলে,

-” উফ্ কিয়া রাত আয়া হ্যায় মোহাব্বাত রাঙ লাইয়ে হ্যায়। হাম জাশনা মানায়েঙ্গে, সাগার ঝালকায়েঙ্গে, না হোশ মে আয়েঙ্গি।”

এতটুকু বলে আচমকা ভান করে নিতির গায়ের দিকে ঢলে পরে। দিব্যর উষ্ণ গাল ছুঁয়ে যায় নিতির নরম-কোমল ত্বক । মূহুর্তেই বিদ্যুৎ শিহরণ বয়ে যায় নিতির শরীর জুড়ে। বুকের ভেতর দম বন্ধ অনুভূতি। নিতি ধাক্কা দিয়ে দিব্যকে সরিয়ে দিয়ে পাশ কাটিয়ে যেতে নেয়। দিব্য চট করে নিতির হাত চেপে ধরে। নিজের কাছে টেনে আনে। নিতির বুকটা দুরুদুরু কাঁপছে। দিব্য একহাতে নিতির মুখের উপর থাকা একগাছি চুল সযত্নে কানের পিঠে গুঁজে দেয়। নিতি ঠোঁট নেড়ে কিছু বলবে, তার আগেই দিব্য বলল,

-” অ্যাম আই হারবিভোরাস অর কার্নিভোরাস? কাম, লেট সো ইউ প্র্যাকটিক্যালি।”

দিব্যর দৃষ্টি নিতির মুখের দিকে নিবদ্ধ। নিতির ঠোঁট তিরতির করে কাঁপছে। কণ্ঠনালী শুকিয়ে চৌচির। জিভ দিয়ে ঠোঁট ভিজিয়ে কোনো রকমে বলল,

-” আমি তো মজার ছলে বলেছিলাম। তুমি…।”

নিতির ভীতু মুখশ্রী। তারপর কাঁপা কাঁপা চোখের পল্লব। কম্পিত ওষ্ঠ। দিব্যর দৃষ্টিকে সম্মোহিত করে। দিব্যর চাহনি অন্যরকম। মা’দকতা ছড়িয়ে আছে আজ ও চোখেতে। এক আঙুল নিতির ঠোঁটের উপর রাখে দিব্য। বলে,

-” আ’ম সিরিয়াস। আ’ম নট জোকিং এ্যট অল।”

দিব্যর আঙুল সরিয়ে দেয় নিতি। অতঃপর নিতি দু’পা পিছাতেই বেডে গিয়ে ঠেকে। একটু থমকিয়ে পিছুন ফিরে তাকায়। তারপর ধপ করে বসে পরে। চোখেমুখে গাম্ভীর্য ভাব টেনে মিছেমিছে রাগ দেখিয়ে বলল,

-” মাথা ঠিক আছে তোমার! আমি তো সকালে মজার ছলেই বলেছিলাম।”

দিব্য পাশে বসে নির্ভার ভঙিতে সটান শুয়ে পরল। পা দুটো বেড ছাড়িয়ে বাইরে দুলছে। হাত দু’টো ভাঁজ করে মাথার নিচে রেখে শুণ্য দৃষ্টিতে তাকিয়ে বলল,

-” রোজ রোজ সিডিউস করে, মাথা যদি কেউ খা’রা’প করে, তাহলে এতে আমার দোষ কোথায় বলতো?”

কথা শেষ করেই আচমকা নিতির হাত ধরে হেঁচকা টান দেয় দিব্য। ভারসাম্য হারিয়ে নিতি দিব্যর গা ঘেঁষে কাছাকাছি পরে। দিব্য নিতির দিকে ঝুঁকে এলে, নিতি শোয়া থেকে ওঠে বসতে চায়। কিন্তু তার আগেই দিব্য নিতির হাত দু’টো বিছানার সাথে শক্ত করে ধরে আঁটকে ফেলে। নিতি কপট রাগি দৃষ্টিতে চেয়ে বলল,

-” এসবের মানে কী? ছাড়ো।”

দিব্য নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল,

-” মানে সিম্পেল।”

নিতি পূর্ণ দৃষ্টিতে দিব্যর দিকে চাইল। নিষ্প্রভ গলায় বলল,

-” আমি জাস্ট মজার ছলে তোমাকে রাগাতে অমনটা বলে এসেছি। আমি জানি তুমি নিজ ইচ্ছায় বিয়েটা করোনি। তাই বলব..”

নিতিকে থামিয়ে দেয় দিব্য। ছোট শ্বাস ফেলে নিতির চোখের দিকে চেয়ে গভীর স্বরে বলল,

-” নিতি তুই শুরু থেকে সব জানিস। তাই কিছু লুকানো, আড়াল করার নেই। আর আমি চাই-ও না কোনো কিছু গোপন করতে। সত্যি বলতে, বিয়েটা পরিস্থিতির কারণে হলেও; ইদানিং তোর অভিমান, তোর ছোট ছোট জ্বালাতন, তোর ফ্রেন্ডের সঙ্গে তোকে নিয়ে আমার ঈর্ষা। সব মিলিয়ে আমি ডে বাই ডে তোর প্রতি দূর্বল হয়ে পড়ছি।”

নিতি স্তব্ধ হয়ে শুনছে। মেয়েটার চোখে বিস্ময়। সাথে মনজুড়ে বয়ে চলে অদ্ভুত অনুভূতি। দিব্য নিতির হাত আরেকটু শক্ত করে ধরে বলল,

-” আমি জানি তুই আমাকে ভালোবাসিস। আর আমি চাই না, তোর সেই পবিত্র ভালোবাসাকে অবহেলা, উপেক্ষা করতে। যা কিছু পেছনে ফেলে এসেছি, সব ভুলে নতুন করে শুরু করতে চাই। তোর সাথে, শুধুই তোর সাথে।”

নিতির বুকের ভেতরটা কেমন মোচড় দিয়ে উঠল। হতবিহবল চোখে দিব্যর দিকে চেয়ে রইল নির্নিমেষ। অথচ একটিও শব্দ বের হলো না মুখ থেকে। অনুভূতির প্রবল ঢেউ নিতিকে আচ্ছন্ন করে রেখেছে। কণ্ঠ রুদ্ধ, শরীর অসাড়। দিব্য নিজেও বিভ্রান্ত! সে কি নিতিকে ভালোবাসে? নাকি কেবল অনিবার্য আ’স’ক্তি। তবে প্রণয়ের বাঁধনে জড়িয়ে বেশ কয়েকটি মাস পেরিয়ে যাওয়ার পর টের পায়, অদৃশ্য একটা টান তৈরি হয়েছে। দিনদিন নিতি দিব্যর আ’স’ক্তিতে পরিণত হয়েছে।

রাত যতই গভীর হতে থাকে, আকাশ ভেঙে ততোই বর্ষণ নামতে থাকে। আকাশও যেন তার সমস্ত আবেগ ঢেলে দিচ্ছে ধরণীর বুকে। জানালার কাঁচ বেঁয়ে জলের ধারা গড়িয়ে পরছে। রুমের ভেতরও যেন তার প্রতিধ্বনি বাজছে। নিতির বুকের ধড়ফড় ক্রমশ বাড়ছে। হৃদস্পন্দন দ্রুত, নিঃশ্বাস গাঢ়। দিব্যর চোখে এক ধরণের মা’দ’ক’তা, গভীর আকুলতা। বর্ষার শীতল বাতাস জানালার পর্দা গলে রুমে প্রবাহিত হয়। মূহুর্তেই রুমে দিব্যর গরম নিঃশ্বাসের বর্ষণের সাথে মিলেমিশে একাকার হয়। দিব্য ধীরে ধীরে নিতির দিকে ঝুঁকে আসে। নিতির ঠোঁটে আঙুল ছোঁয়ায়। বাইরের বিদ্যুৎ চমকানোর সাথে সাথে স্পর্শের বিদ্যুৎতে কেঁপে ওঠে নিতির পুরো কায়া। নিতি কাঁপা কাঁপা গলায় বলল,

-” সরো।”

দিব্য নির্লিপ্ত। দিব্যর বাহুবন্ধন থেকে ছাড়া পেতে নিতি মিথ্যা বলার প্রয়াস চালায়। অস্ফুট স্বরে বলল,

-” আ’ম ফিলিং ভেরি স্লিপি।”

নিতির গালে গাল ছুঁইয়ে দিব্য হাস্কি স্বরে বলল,

-” আ’ম ফিলিং রোমান্টিক।”

থেমে নিতির ঠোঁটে বৃদ্ধা আঙুল রেখে বলল,

-” ইউর লিপস আর ড্রাইভিং মি ক্রেজি। আই রিয়েলি ওয়ান্ট টু টেস্ট দেম।”

কথা শেষ হতেই আচমকা দিব্য নিতির ঠোঁটে ঠোঁট ডুবায়। প্রথমে ছটফট করলেও পরক্ষণেই নিতি থেমে যায়। আবেশে চোখ বুজে নেয়। কোমল একটা হাত দিব্যর চুলের ভাঁজে চলে যায়। মুঠো করে ধরে দিব‌্যর মাথার পিছনের চুল। কয়েক মিনিট পর ছাড়া পেতেই নিতি বড়বড় শ্বাস টানে। লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে চোখ বুজে থাকে। দিব্য নিতির কানের পাশে মুখ নিয়ে বলে,

-” লেট’স মেক টুনাইট আনফরগেট্যাবল। মে আই?”

নিতির নীরব থাকাকেই মৌন সম্মতি ধরে নেয় দিব্য। নিতির কপালে প্রগাঢ় চুম্বুন এঁকে মোলায়েম স্বরে বলল,

-” আই ওয়ান্ট দিস নাইট, দিস মোমেন্ট , দিস ওয়ার্ম টাচ টু নেভার ইন্ড।”

কথাটা শেষ করেই নিতির গলায় মুখ গুঁজে দিব্য। নিতি আলতো করে জড়িয়ে ধরে দিব্যকে। ঘরময় ভালোবাসার উষ্ণতা সময়ের সাথে বাড়তে থাকে। ভালোবাসার আবেগময় অনুভূতি সম্পন্ন মূহুর্তে একে অপরের কাছে গভীর হয়। যেখানে ভাষার থেকেও বেশি কথা বলে স্পর্শ আর অনুভূতি।

#চলবে

#প্রণয়ের_বাঁধন |৩৮|
#লেখনীতে_মুসতারিন_মুসাররাত

সূর্যের কোমল আলো জানালার ফাঁক গলে রুমে প্রবেশ করছে, সফেদ পর্দায় পড়ে মৃদু দোল খাচ্ছে। পুরো ঘরময় এক শান্ত মায়াবী আবহ, সময় যেন থমকে আছে। বিছানায় এলোমেলো চুলে শুয়ে থাকা নিতি ধীরে ধীরে চোখ মেলে, অনুভব করে শরীরে এক নতুন ব্যাথা। কিন্তু সে ব্যাথায় ক্লান্তি নেই। বরং মিশে আছে এক মধুর সুখের পরশ। কিঞ্চিৎ মাথা তুলে পাশে শুয়ে থাকা দিব্যর দিকে তাকায় নিতি। শান্ত নিঃশ্বাস ফেলে গভীর ঘুমে বিভোর মহাশয়। দিব্যর দিকে তাকাতেই নিতির মুখ লজ্জার আভায় রঙিন হয়ে ওঠে, ঠোঁটের কোণে খেলে যায় এক চপল হাসি। নতুন দিনের সাথে জীবনের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। শরীরজুড়ে এখনো রাতের উষ্ণতা বইলেও, মন নাম না জানা প্রশান্তির স্রোতে ভাসছে।

বিছানার পাশ থেকে চুলের ক্লিপটা তুলে নিয়ে আস্তে আস্তে উঠে বসে নিতি। এলোমেলো চুল গুছিয়ে ক্লিপ দিয়ে আটকিয়ে নেয়। তারপর ওয়াশরুমের দিকে পা বাড়ায়। কিছুক্ষণ পর….

হেয়ার ড্রায়ার দিয়ে চুল শুকিয়ে নিয়ে সিল্কি হালকা ব্রাউন কালার করা চুল পিঠজুড়ে খোলা রাখে। পরপর ঠোঁটে লিপবাম লাগিয়ে ড্রেসিংটেবিলের থেকে নেলপলিশটা হাতে নিয়ে বসে নখে লাগাতে থাকে। এমন সময় খট শব্দ তুলে ওয়াশরুমের দরজা খোলার আওয়াজ হয়। ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে, সাদা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে দিব্য এগিয়ে আসছে। ঘুম থেকে ওঠার পর এখনো দু’জনের মধ্যে কোনো কথা হয়নি। দু’জনের কারো মুখেই কোনো কথা নেই, রাতের নীরবতা যেন এখনো রুমের কোণে লেগে আছে। নিতি ভেতরে ভেতরে লজ্জায় আড়ষ্ট হলেও, দিব্যর মধ্যে নেই কোনো অস্বস্তি। যেন সবকিছু স্বাভাবিক। দিব্যর নির্লিপ্ততা তারপর কিছু মনে হতেই নিতির মনের কোণে অজানা অভিমান জেগে ওঠে। ফর্সা মুখটা ধীরে ধীরে বিবর্ণ হয়ে আসে। চুল মুছতে মুছতে দিব্য একপলকে নিতির দিকে তাকায়। কপালে ভাঁজ ফেলে ডান ভ্রু বাঁকিয়ে বলল,

-” এরপর থেকে নখগুলো ছোট ছোট করে রাখবি। নখ দিয়ে আমাকে আহত করে ছেড়েছিস।”

নিতি মূহূর্তেই লজ্জায় অস্বস্তিতে পড়ে গেলেও বাইরে থেকে নিজেকে দৃঢ় রাখে। এবার যেন নিতি কথা বলার একটা মুখ্য স্কোপ পেয়ে বসল। ওর মনের গহীনে জমে থাকা অভিমান এবার ক্ষীণ স্বরে বেরিয়ে আসে,

-” তুমি কিন্তু এখন অবধি মুখ ফুটে আমাকে ভালোবাসো বলোনি। এখনো তোমার ভালোবাসা প্রকাশ করোনি। আর ভালোবাসা বি..”

কথা শেষ হওয়ার আগেই দিব্য ভ্রু তুলে গম্ভীর কণ্ঠে বলল,

-” রাতে কী প্রকাশ করলাম?”

লজ্জা অস্বস্তিকে একপাশে ঠেসে নিতি অভিমানি কিশোরীর মতো গাল ফুলাল। মুখ শক্ত করে বলল,

-” ভালোবাসা ছাড়া স্পর্শের মূল্য নেই, নেই কোনো অর্থ। যতদিন হৃদয় থেকে ভালোবাসতে না পারবে ততদিন তোমার এই স্পর্শ আমি মানি না, হু।”

দিব্য ফিচেল হেসে বলে,

-” মানিস আর না মানিস, যা খুশি কর। কিন্তু এই নিয়ে শাহবাগে আন্দোলনে নেমে যাস না আবার।”

নিতি কটমট চোখে চাইল। দিব্য ডোন্ট কেয়ার ভঙ্গিতে চুলে ব্রাশ চালাতে লাগল। বডি স্প্রে করতে করতে নিতির রাগি মুখের দিকে চেয়ে দিব্য ফের বলল,

-” ওহ্ আই সী! তোর আবার শাওয়ার নেওয়ার ইচ্ছে হয়েছে, রাইট? এত ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে না বলে সরাসরি বলতে পারিস। তুই চাইলে ডোর-উইন্ডো লকড করে এই রৌদ্রজ্জ্বল দিনটাকে মাঝরাত বানিয়ে ফেলতে পারি।”

নিতি রাগে গজগজ করতে করতে হাতের নেলপলিশের কৌটা দিব্যর দিকে ছুঁড়ে মা’রে। দিব্য একহাত দিয়ে ক্যাঁচ ধরে নিখুঁত ভঙ্গিতে। নিতি ক্ষুব্ধ কণ্ঠে বিড়বিড় করে,’ অ’স’ভ্য, ফা’জি’ল কোথাকার! সবসময় ধূর্তের মতন কথা ডাইভার্ট করে।’ মৃদু গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

-” তুমি ইচ্ছে করে আমার কথা এড়িয়ে যেতে আ’জে’বা’জে বলছো। আমি এক বলছি, আর তুমি প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিচ্ছো।”

দিব্য উত্তর দেওয়ার প্রয়োজন বোধ করলো না। একহাত জিন্সের পকেটে গুঁজে অন্যহাত ভেজা চুলে চালনা করে ঠান্ডা স্বরে বলল,

-” এত গবেষণা বাদ দিয়ে কাজ কর। ব্রিং মি ব্লাক কফি কুইকলি। সার্ভ ইয়োর হাজব্যান্ড।”

ঠান্ডা স্বর অথচ আদেশ স্বরুপ শেষের কথা বলে দিব্য। আদেশ দেখে নিতি তাজ্জব বনে যায়। পরপর নিজেকে স্বাভাবিক করে ত্যাড়ামির সুরে বলল,

-” পারব না। নিচে গিয়ে খেয়ে আসো।”
.
.
ব্যালকনির দোলনায় আসন পেতে নিতি একমনে দুলছে। চোখদুটো চেয়ে আছে রৌদ্রজ্জ্বল ঝলমলে আকাশের দিকে, সেথায় যেন লুকিয়ে আছে ওর মনের কথার পসরা। ভাবনার অথৈ সাগরে ডুব দিয়ে অবচেতনে আওড়ায় নিতি,

-” জানি, একদিন তোমার চোখে ঠিকই আমার জন্য সত্যিকারের ভালোবাসার ছোঁয়া দেখব। চোখে হারাবে আমায়। কিন্তু তুমি জানো? জানো কী? উঁহু জানো না, আমিই বলছি; তুমি আকাশের বিশালতার মতো ভালোবাসলেও, আমার ভালোবাসার গভীরতার কাছে তা ক্ষীণ মনে হবে। কারন, আমি জানতাম তোমার মনে অন্যকেউ আছে, তবুও তোমাকে ভালোবেসেছি নিঃস্বার্থভাবে।”

চোখদুটো বুঁজে ছোট করে দীর্ঘশ্বাস ফেলে নিতি। মনে মনে বলে,

-” আমি বরাবরই বিশ্বাস করেছি, যা আমার তকদিরে নেই, তা কখনোই আমার হবার নয়। আর যা সৃষ্টিকর্তা আমার জন্য বরাদ্দ রেখেছেন, তা কেউ চাইলেও কেড়ে নিতে পারবে না। আমার বিশ্বাস টলেনি। সময়ের সাথে হয়েছে প্রমাণিত। জানি না আজকাল কী হয়েছে আমার! কেনো জানি অদ্ভুত এক অনুভূতি জেঁকে বসেছে আমার মাঝে। নিজের অনুভূতি প্রকাশে অনীহা জাগে। মনেহয় আমার রাগি রাজার কাছে আমায় ত্যাড়ামির রানিতেই মানায়।”

নিতির ঠোঁটের কোণ প্রশস্ত হয়। আকাশের দিকে চেয়ে আনমনে হেসে বিড়বিড় করে বলে,

-” ভালোবাসি আমার রাগি রাজাকে। দিন গুনছি, ব্যাকুল হয়ে প্রতিক্ষায় আছি; কবে শুনবো তোমার মুখ থেকে সেই পরম আকাঙ্ক্ষিত শব্দ– ‘লাভ ইউ টু’।”

নিতির ভাবনার সুতো ছিঁ’ড়ে হঠাৎ উষ্ণ বাতাস চোখেমুখে লাগাতে। নিজেকে ধাতস্থ করে তাকাতেই দেখে, কফির মগ হাতে কপাল কুঁচকে দিব্য চেয়ে আছে। ভ্রু উঁচিয়ে শুধোয়,

-” এভাবে বসে কোথায় হারিয়ে গিয়েছিস? ভাবলাম দিনদুপুরে শ্যাওড়া গাছের পেত্মী ভর করেছে তোর উপর! তাই দোয়া পড়ে ফুঁ দিলাম।”

নিতি কটমট করে তাকায়। দিব্য পাশে ধপ করে বসে কফির মগে ছোট ছোট চুমুক দেয়। নিতি বুকের উপর হাত রেখে বলে,

-” ইয়া আল্লাহ! তুমি আর মানুষ হবে না! অন্যমনস্ক ছিলাম। চমকে গিয়েছিলাম তো! আরেকটু হলে অ্যাটাক ফ্যাটাক হয়ে যেতো।”

দিব্য মগে ঠোঁট ছোঁয়ায়, চোখ সরু করে নিতির দিকে চেয়ে থাকে। তারপর কফির মগটা বাড়িয়ে বলে,

-” চমকে গেলে এখন এক চুমুক খেয়ে স্বাভাবিক হয়ে যা।”

নিতি নাক সিঁটকে বলল,

-” অ্যা! এঁটো! ভাবলে কী করে তোমার এঁটো খাবো?”

দিব্য ঠান্ডা স্বরে বলল,

-” রাতে তো ঠিকই কিস করলাম। ঠোঁটে ঠোঁট ডুবালাম। তখন কী…?”

নিতির মুখে গোলাপি আভা পরে। কান দু’টো ঝাঁ ঝাঁ করে ওঠে। এখানে থাকলে দিব্য আরো কী বলবে কে জানে! লজ্জায় লাল হওয়ার থেকে দ্রুত এখানটা প্রস্থান করাই শ্রেয়। এইভেবে নিতি তড়াক উঠে দাঁড়ায়, বেরিয়ে যাওয়ার জন্য পা বাড়ায়। ঠিক তখনই দিব্য আলগোছে বাম পা-টা টেনে দেয় সামনে। নিতি বেঁধে হোঁচট খেয়ে পড়ে যেতে নেয়, কিন্তু ঠিক সেই মুহূর্তে দিব্য ওর হাত ধরে নিজের দিকে টেনে নেয়। নিতি গিয়ে সোজা দিব্যর বুকের উপর পড়ে। নিতি খিচে চোখ বুঁজে ফেলে। বড় করে শ্বাস নেয়। অতঃপর তাকিয়ে বলল,

-” তুমি খুব খারাপ। এভাবে..”

কথার মাঝেই, দিব্য কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল,

-” বাররে আমি আবার কী করলাম? নিচে পরে কোমড় ভাঙার থেকে তোকে সেভ করলাম। তার বদলে থ্যাংকস তো দিলি না, উল্টো খারাপ বলছিস।”

-” তুমি ইচ্ছে করে পা বাড়িয়ে ফেলে দিয়েছো। আবার থ্যাংকস আশা করছো।”

দিব্য হাতের মগটা নামিয়ে উঠে দাঁড়িয়ে টিশার্ট দুইহাতে টেনেটুনে ঠিক করে বলল,

-” তুই দেখেছিস আমি ফেলেছি তোকে?”

-” দেখতে হয় না। বোঝা যায়। আমার স্পষ্ট মনে হচ্ছে তোমার পা-টা তুমি আমাকে ফেলতে ইচ্ছে করে বাড়িয়েছিলে।”

-” এইযে যেমন বলছিস; দেখতে হয় না, বোঝা যায়। ঠিক তেমনি আমিও বলছি; সবকিছু মুখে বলতে হয় না। অনুভব করে নিতে হয়।”

কথা শেষ করেই কালবিলম্ব করে না দিব্য। গটগট পা ফেলে প্রস্থান করে। নিতি গালে হাত দিয়ে ভাবুক ভঙিতে দিব্যর কথার মর্মার্থ বোঝার চেষ্টা করে।

__________

স্কয়ার হাসপাতালের সুসজ্জিত করিডোর ঝকঝকে সাদা আলোয় ভেসে যাচ্ছে। দেয়ালে নরম নীল রঙের শেড, আর এখানে-ওখানে সবুজ গাছের টব রাখা। সি-সেকশন অপারেশন থিয়েটারের বাইরে ওয়েটিং চেয়ার থাকলেও ইভান বসতে পারছে না। অস্থির চিত্তে পায়চারি করছে, বারবার ঘড়ির দিকে তাকাচ্ছে। তনুজার লেবার পেইন ওঠার সাথে সাথে হসপিটালে এডমিট করা হয়। কিছুক্ষণ দেখার পর ডক্টর সি-সেকশনের কথা বলে। তনুজা এখন ভেতরে, বাইরে দাঁড়িয়ে ইভানের সময় যেন থমকে গিয়েছে দুশ্চিন্তায়। শিরিন সুলতানা চেয়ারে বসে উদ্বিগ্ন হয়ে দোয়া-দরুদ পড়ছেন। পাশে বসা নিতি দুইহাতে মুখ চেপে ধরে বিড়বিড় করে দোয়া পড়ছে। সবার চিন্তা সবটা যেনো ভালো হয়। শিরিন ইভানের পাশে গিয়ে দাঁড়ালো। ইভানের কাঁধে হাত রাখে। ইভান এতটাই তনুজার চিন্তায় বিভোর ছিলো যে শিরিনের স্পর্শে চমকে তাকালো। শিরিন আশ্বাস দিতে বললেন,

-” ইভান বাবা বসো। আর টেনশন করো না। সব ঠিক হবে ইন শা আল্লাহ।”

ইভান নিজেকে স্বাভাবিক দেখাতে বলল,

-” আমি ঠিক আছি মামণি। তুমি দাঁড়িয়ে কেনো, বসো।”

এরমধ্যে দরজা খোলার শব্দ হতেই ইভান ত্রস্ত এগোয়। দরজা খুলে সাদা অ্যাপ্রোন গায়ে নার্স বেরিয়ে আসে। মনে হচ্ছে নার্সের হাতে ছোট্ট তুলতুলে পুঁচকে প্যাকেট। নরম সাদা মখমলের টাওয়েলে মোড়ানো একরত্তি শিশুকে ধরে আছে নার্স। উজ্জ্বল হাসিতে বলল,

-” কনগ্রাচুলেশন! আপনার ছেলে হয়েছে।”

ইভান অস্ফুটে আওড়ায়,

-” আলহামদুলিল্লাহ।”

শিরিন এগিয়ে আসে পরপর নিতি উঠে আসে। নার্স একবার ইভানের দিকে তাকায় তো আবার শিরিনের দিকে কার কাছে দিবে বুঝতে পারছে না। শিরিন আলতো হাসি মুখে টেনে ইশারায় ইভানের কাছে দিতে বলে। নার্স বাচ্চাটাকে ইভানের দিকে বাড়িয়ে দেয়। ইভানের হাত দু’টো কাঁপছে, বুক ধুকপুক করছে। কাঁপাকাঁপা হাতে কোলে নেয়। জীবনে এতটা আবেগ একসাথে অনুভব হয়নি ওর। ইভানের চোখদুটো আনন্দে ছলছল করছে। বাচ্চাটা ড্যাবড্যাব চোখে চেয়ে আছে। কালো মিচমিচে চোখের মণি, গোলাপি গাল, কুঁচকে আছে ছোট ছোট আঙুলগুলো, পাতলা তুলার মতো ফিনফিনে চুল। নিখুঁত ছোট্ট প্রাণটাকে দেখে টপ করে দুফোঁটা অশ্রু গাল বেয়ে পড়ে ইভানের। ইভান আলতো করে আঙুল ছুঁয়ে দেয় ছেলের মুষ্টিবদ্ধ হাতে। মূহুর্তেই বাচ্চাটি যেন বাবার আঙুল শক্ত করে চেপে ধরে। এমনভাবে আঙুল ধরেছে মনে হচ্ছে, এটাই ওর নিরাপত্তা আর ভালোবাসার আশ্রয়। ইভান ছোট প্রাণটির কপালে চুমু খায় ফিসফিস করে বলে,-” আমার ছেলে। আমার অংশ।”

নিতি ব্যস্ত কণ্ঠে বলল,

-” দেখি দেখি কেমন হয়েছে?”

ইভান পরপর মাথা তুলে নার্সের দিকে চেয়ে উদ্বিগ্ন গলায় বলল,

-” সিস্টার তনুজা? তনুজা কেমন আছে? ও সুস্থ আছে তো?”

নার্স আশ্বস্ত করে,

-” পেশেন্ট ভালো আছেন। কিছুক্ষণ পরেই ওনাকে কেবিনে শিফট করা হবে। গাইনি ম্যাম বেরুলে, ম্যামের থেকে জেনে নিয়েন।”

ইভান মাথা নাড়িয়ে বলল,

-” শিওর। থ্যাংকস।”

ইভান গভীর শ্বাস ফেলে। অতঃপর ছেলের হাতের মুষ্টিতে চুমু খায়। একরাশ ভালোবাসা মিশে দেয়। নতুন এক জীবন এসেছে, কিন্তু তনুজার সুস্থতা না জানা অবধি, তনুজাকে কাছ থেকে না দেখা অবধি পুরোপুরি শান্তি হবে না। ইভানের সব অপেক্ষা সেই মূহূর্তের জন্য। যখন তনুজার হাত ধরে বলতে পারবে, – ধন্যবাদ! আমাদের জীবনের সবচেয়ে সুন্দর উপহারটি দেওয়ার জন্য।”

বাচ্চা একহাতের দুইটা আঙুল একসাথে মুখে পুরে ‘চপচপ’ শব্দ করে চুষতে থাকে। নিতি চট করে বলে উঠল,

-” এইরে বাবা সোনার বোধহয় ক্ষুধা পেয়েছে।”

বাচ্চা এরমধ্যে নড়াচড়া শুরু করে দিলো। শিরিনের দিকে চেয়ে ইভান বলল,

-” মামণি তুমি ধরো, এত ছোটো আমার ভয় হচ্ছে হাতের ভেতর থেকে বেরিয়ে যাবে।”

কোল বদল করতেই গলা ফাটিয়ে -” উঙা উঙা উঙা ” করে কান্না শুরু করে দিলো বেবি। শিরিন দুই হাতে জড়িয়ে ধরে থামানোর চেষ্টা করে। বলল,

-” তনুজাকে বেডে দিলে ফিড করাতে হবে।”

নিতি পাশ থেকে বলল,

-” ওলে ওলে বেবিটা একদম কাঁদে না।”

হঠাৎ কান্না থেমে যায়। নিতি চোখ বড়বড় করে চেয়ে বলল,

-” বাহবা! ফুপির কথা তো খুব শুনলে।”

নিতির কথাশুনে শিরিন হেসে ফেলে। ইভানও মেপে স্বল্প হাসে।
.
.

কেবিনজুড়ে আনন্দের জোয়ার বয়ে যাচ্ছে। পুরো পরিবেশ মুখরিত, যেন খুশির রঙ ছড়িয়ে পড়েছে চারিদিকে। কিছুক্ষণ আগেই তনুজাকে বেডে শিফট করা হয়েছে। স্যালাইনের নল হাতে লাগানো। তবুও চোখেমুখে মাতৃত্বের শান্তির ছাপ স্পষ্ট। পাশে টুলে বসে শিরিন। কোলের মধ্যে বাচ্চাটিকে জড়িয়ে রেখেছে পরম মমতায়। এই তো একটু আগে দিব্যর সাথে নৃত্য এসেছে। বাচ্চাকে দেখবে বলে বায়না ধরেছিল। নৃত্য এক দৃষ্টিতে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বাচ্চাকে দেখছে, আর কৌতূহলী চোখে এটাসেটা বলছে।

দিব্য সবার জন্য খাবার নিয়ে এসেছে। এখনো ওরা কেউ খাবার মুখে তোলেনি। ভোররাতে তনুজাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। আটটায় ওটি হয়। এখন এগারোটা বাজতে চলছে। দিব্য ইভান দু’জনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে ছিলো। দিব্য জিন্সের পকেটে দুইহাত গুঁজে দাঁড়িয়ে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল,

-” দিদুন তো বাচ্চাদের মতো বায়না ধরেছিলো। এখন হসটপিটালে দেখতে আসবে। আমি তাড়া দেখিয়ে চলে আসছি।”

-” আমি একটু আগে দিদুনকে ভিডিও কল দিয়ে দেখিয়েছি। আর বুঝিয়ে বলেছি, শুধু শুধু অসুস্থ মানুষ আসার কী দরকার! সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে পরশুই রিলিজ দিবে।”

-” অনেক বেলা হয়েছে তোরা তো কেউ এখনো খাসনি। আগে খেয়ে নে।”

ইভানের কপালের উপর এলোমেলো হয়ে কিছু চুল পরেছিলো। একহাতে কপাল থেকে চুলগুলো পিছুনে ঠেলে সটান দাড়িয়ে বলল,

-” আমি বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আসবো। মামণি আর নিতি না খেয়ে আছে, ওরা বরং খেয়ে নিক।”

শিরিনকে উদ্দেশ্য করে ইভান বলল,

-” মামণি তুমি আর নিতি খেয়ে নাও। আমার একটু কাজ আছে। কাজ সেরে বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে খেয়ে আসবো।”

শিরিন ইতস্তত গলায় বলল,

-” খেয়ে গেলে বেটার হতো না।”

ইভান নম্র স্বরে বলল,

-” প্রবলেম নেই। তোমরা খেয়ে নাও।”

এরমধ্যে নিতি বাচ্চাকে কোলে তুলে এনে দিব্যর সামনে ধরে বলে,

-” ভালো করে দেখে বলো তো, ভাইপো কেমন হয়েছে দেখতে?”

দিব্য ছোট্ট মুখটির দিকে তাকিয়ে একহাতে গাল ছুঁয়ে দেয়। কোলে নেওয়ার ইচ্ছা হলেও, এত ছোট কীভাবে ধরবে? এইভেবে কোলে নেওয়া হয় না। গাল থেকে দিব্যর হাতটা বাচ্চার নরম হাত ছুঁলো। আদুরে গলায় বলল,

-” বাবাটা একেবারে তুলতুলে। সো কিউটেস্ট!”

নিতি হাসল। বলল,

-” ও কিন্তু আমাদের কাছ থেকে ডাবল আদর পাবে।”

নিতির এহেন কথায় দিব্যর ভ্রু কুঁচকে যায়। নিতি বলতে থাকে,

-” এইযে আমি ওর ফুপি প্লাস কাকিমা। তাহলে তুমি ওর চাচ্চু প্লাস ফুপা। তাহলে ডাবল সম্পর্কের জন্য ডাবল আদর।”

ইভানের দিকে তাকিয়ে নিতি শুধোয়,

-” ঠিক বলেছি না ভাইয়া?”

ইভান বিনিময় স্মিত হাসে। দিব্য বিরক্ত চোখে নিতির দিকে চায়। বলল,

-” ফুপার থেকে চাচ্চুর সম্পর্ক আগে। এটা র’ক্তে’র তাই আমার কাছে এই পরিচয়ই আগে। আর আদরের কথা যদি বলিস? তাহলে বলব; আমার ভাইপো, আমাদের বাড়ির প্রথম সন্তান তারজন্য তো হাজারগুন আদর থাকবে।”

শিরিনকে ডেকে বলে দিব্য,

-” মাম্মা? আমি এখন আসছি। কোনো দরকার হলে ফোন দিও, ক্যামন?”

শিরিন বলল,

-” আচ্ছা।”

কিছু মনে পড়ার ভঙিতে বলল,

-” ও হ্যা, একটু আগে নিতি বলছিলো বাসায় যাওয়ার কথা। নিতিকে বাসায় পৌঁছে দে। আর নৃত্য আছে ও নাকি থাকবে। সন্ধ্যা পর্যন্ত থাক। তুই সন্ধ্যায় নিতিকে নিয়ে আসিস। মেয়েটা সেই ভোররাত থেকে এখানে। থেকে ক্লান্ত দেখাচ্ছে। বাসায় গিয়ে ফ্রেশ হয়ে বিশ্রাম নিয়ে সন্ধ্যায় আসবে না হয়।”

দিব্য ছোট করে ‘ঠিক আছে’ বলে। নিতি বাচ্চাকে আলগোছে তনুজার ফাঁকা হাতটার উপর শুয়ে দেয়। পরপর বিদায় নিয়ে দিব্যর সাথে বেরিয়ে যায়।

শিরিনের কল আসায় ব্যালকনিতে যায়। নৃত্য কেবিন থেকে বেরিয়ে করিডোর ধরে হাঁটছে। হাসপাতালটা মনোযোগ দিয়ে দেখছে। উৎসুক চোখে এক এক করে সব ঘুরে দেখছে। এদিকে এতক্ষণে ইভান একটু ফাঁকা স্পেস পেল। তনুজার পাশে গিয়ে বসে আলতো স্বরে জিজ্ঞাসা করল,

-” তনুজা, কোনো প্রবলেম হচ্ছে?”

তনুজা মাথা নাড়িয়ে বলল,

-” নাহ। ঠিক আছি।”

তনুজার বুকের সাথে লেপ্টে ছোট্ট শিশুটা শান্তভাবে শুয়ে আছে। ওর নিঃশ্বাসের মৃদু স্পন্দন যেন পৃথিবীর সবচেয়ে স্নিগ্ধ সুর। ইভান একটু ঝুঁকে তাকায় বাচ্চার দিকে, মুখে বিস্ময় আর আবেগের মিশেল। অতঃপর তনুজার হাতের উপর হাত রেখে বলল,

-” মাই বিগেস্ট গিফট ইন লাইফ ইস আওয়ার বেবি। থ্যাংকিউ। থ্যাংকিউ সো মাচ তনুজা।”

তনুজা বিনিময় প্রশস্ত হাসলো। ইভান আনন্দময় প্রফুল্ল চিত্তে বলল,

-” আই ফিল লাইক দ্য হ্যাপিয়েসট পার্সন ইন দ্য ওয়ার্ল্ড। আমার অনুভূতি ভাষায় প্রকাশ করতে পারছি না।”

তনুজা আবেগাপ্লুত হয়ে বলল,

-” ইভান জানেন? ও যখন ভূমিষ্ঠের পর প্রথম কেঁদে উঠল। ওর কান্নার শব্দ আমার কানে পৌঁছাতেই মনে হলো নতুন একটা সূর্য উঠল আমার বুকে। সেই মূহূর্তে আমার আনন্দে কান্না পাচ্ছিল।”

আরো কিছু কথাবার্তা শেষে ইভান বাচ্চার মুখে কয়েকটা চুমু খায়, অতঃপর টুপ করে তনুজার কপালে চুমু আঁকে। তনুজা নাক কুঁচকে সরু চোখে চায়। ইভান মুচকি হেসে বলল,

-” প্রথমে মাই প্রিন্স কে বাই জানালাম। তারপর তার মা’কে। তার মায়ের আদরে এখন থেকে সে ভাগ বসাল।”

তনুজা হাসতে গিয়ে পেটের স্ট্রিচে টান পরে কপাল কুঁচকে নেয়। পরপর স্বাভাবিক হয়। ইভান ছেলের গাল ছুঁয়ে ‘বাই’ বলে বিদায় নেয়।

_____________

ঋতুতে শরৎকাল চলছে। তনুজাকে গতকালই বাসায় আনা হয়েছে। সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা বাজে, নিচে লিভিংরুমে বসে নিতি-নৃত্য দুইবোন পায়েস খাচ্ছে আর গল্প করছে। নৃত্য বলল,

-“চারদিন হয়ে গেলো, বাচ্চার নাম তো ঠিক করা হয়নি এখনো।”

-“ভাইয়া বলেছে, সাতদিনে আকিকা দিয়ে নাম রাখবে।”

নৃত্য কয়েক চামুচ খেয়ে হাতের বাটিটা কিচেনে রাখতে যায়। ঠিক তখনই দিব্য নিচে আসে, ডায়নিং থেকে ফলের ঝুড়ি থেকে একটা আপেল তুলে বাইট দিয়ে এগিয়ে আসে। সিঙ্গেল সোফায় বসে নিতির দিকে একপল চায়। নিতির হাতে পায়েসের বাটি আর পাশে বিসিএস প্রিলিমিনারি পরীক্ষার প্রস্তুতি গাইড। দিব্য ত্যাড়া করে বলে,

-” যেভাবে সারাক্ষণ বই নিয়ে বেড়াচ্ছিস, মনে হচ্ছে প্রথমবারেই তোর ক্যাডার হওয়া কেউ আটকাতে পারবে না।”

নিতি একটু বিরক্ত হয়ে ঠোঁট বাঁকিয়ে বলল,

-“হতেও তো পারে।”

দিব্য আপেলে বাইট দিতে থাকে। হঠাৎ নিতির গালে পায়েসের কিচমিচ পড়ে। নিতির একদম ভালো লাগে না। গালে পড়ার পরই ওর গা গুলিয়ে ওঠে। কোনো রকমে গলাধঃকরণ করে গা ঝাঁকি দেয়। দিব্য কপাল কুঁচকে চায়। নিতি হাতের বাটি সামনের টি-টেবিলে নামিয়ে রেখে সোফায় কাঁধটা এলিয়ে দেয়। দিব্য কপালে ভাঁজ ফেলে শুধোয়,

-“সামথিং হ্যাপেন্ড?”

নিতি ওড়নার আঁচল দিয়ে কপাল আর গলা মুছতে মুছতে সোজা হয়ে বসে বলল,

-” ইদানিং মাথা ঘুরছে। কেমন বমি বমি পায়। এই তো, মাত্র বমি হয়ে বন্যা বয়ে যাচ্ছিল প্রায়।”

দিব্যর কপালে গভীর ভাঁজ পড়ে। সন্দিহান চোখে নিতির দিকে চেয়ে থাকে। নিতি দিব্যর দিকে তাকিয়ে ইশারা করে কিছু বোঝায়। দিব্যর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ফাঁকা ঢোঁক গিলে অপ্রস্তুত হয়ে বলল,

-“রিয়েলি? তুই ঠিক বলছিস?”

নিতি সোজা হয়ে বসে বলল,

-” মুখের এক্সপ্রেশন এমন করছো, মনে হচ্ছে ইন্নোসেন্ট বাচ্চা তুমি। এমন কিছু হওয়ার চান্স নেই।”

দিব্যর চোখ বিস্ময়ে ড্যাবড্যাব হয়ে যায়। গালে থাকা আপেল চিবুতে ভুলে যায়। থ মে’রে চেয়ে রয়। নিতি খিলখিলিয়ে হেসে বাম চোখটা টিপে বলল,

-“জাস্ট প্রাঙ্ক করলাম। তুমি আমার মজাকে সত্যি ধরেছো নাকি?”

দিব্য দাঁত কটমট করে মনেমনে বলে,

-” সাধে কী আর আমি একে এলার্জি বলি। এমন বিষয় নিয়েও কেউ প্রাঙ্ক করে? এই এলার্জি নিতিকে না দেখলে জানতাম না। ওহ্ গড!”

#চলবে

[ রিচেক দেওয়া হয়নি, ভুলত্রুটি ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখবেন। ]