প্রণয়ের মহাকাব্য পর্ব-০৪

0
19

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(৪)
ঘড়ির কাঁটা টিক টিক করে রাত দশটার ঘরে পৌঁছাতেই সকল নিঃশব্দতা কাটিয়ে শিকদার নিবাসের লাইব্রেরী রুমের দেয়ালে আটকে থাকা ঘড়িটা আগেকার দিনের ঘড়ির মতো ডং ডং উচ্চ শব্দে বেজে উঠলো,, বেশ বড় একটা কাঠের টেবিলে চেয়ার টেনে এপাশে বসে আছে দুই জন মধ্যবয়সী গম্ভীর পুরুষ জসীম শিকদার এবং তাসাউফ মীর যদিও মীর সাহেবের মুখটা একটু বেশিই গম্ভীর দেখা গেলো। তাদের মুখোমুখি বসে আছে তাদের দুই ছেলে, সামীহ শিকদার ও আওসাফ মীর তামিম । সবাই গম্ভীর চুপচাপ থাকলেও তামীমের চোখ চঞ্চল, চোখ ঘুড়িয়ে আশেপাশে তাকাচ্ছে, আগের থেকে একটু নতুনত্ব এসেছে লাইব্রেরীটাতে ,এই লাইব্রেরী টা জসীম শিকদারের ভীষন প্রিয় এবং শখের, খুব যন্ত করে সেই স্টুডেন্ট লাইফ থেকে একটু একটু করে সাজিয়েছেন তিনি, লাইব্রেরীটা বেশ বড় গোছানো সুন্দর যার কোনায় কোনায় রয়েছে আভিয্যতের ও আধুনিকতার সংমিশ্রণের পরশ, পুড়ো শিকদার নিবাসটাই এমন আধুনিকতার চেয়ে এখানের কোনে কোনে পাওয়া যায় আগেকার দিনের আভিজাত্যের ছোঁয়া , নিস্তব্ধতা কাটিয়ে মুখ খুললেন মীর সাহেব গম্ভীর কন্ঠে বললেন,
– শর্ত ভেঙ্গে এত তাড়াতাড়ি দেশে ফিরে আসার কারণ?
– শর্ত ভেঙ্গে আমার হিয়া কে পাত্রপক্ষের সামনে রাখার কারণ?
সামির পাল্টা প্রশ্নে একটুও অবাক বা হতভম্ব হলেন না মীর সাহেব তিনি জানেন এই ছেলে ঘাড় ত্যাড়া, তাই তিনি কথা বাড়াতে চাইলেন না । গম্ভীর কণ্ঠে বললেন
– কাজের কথায় আসা যাক যা বলতে তোমাদেরকে ডেকেছিলাম আমি আর জসিম চাচ্ছি যে তুমি হসপিটালের দায়িত্ব নাও আই মিন হসপিটালের ম্যানেজমেন্ট,পরিচালনার দায়িত্ব তুমি নাও ।
– কিন্তু আমি নিজের আলাদা বিসনেস শুরু করতে চাচ্ছি, আপনি তামিমকে বলুন !
– সেই কপাল কি আমার তোমার কৃপায় আছে নাকি? নিজেতো আমাদের কথার বিরুদ্ধে গেলে,গেলে সাথে এইটাকেও সাথে নিয়ে গেলে ডক্টর না হয়ে উনি (তামিমকে উদ্দেশ্য করে) হলেন ব্যাংকার আর তুমি করলে এতদিন পরের চাকরি!
– আমার কথা শুনেছ বললেই এত অল্প বয়সে এত ভালো একটা এচিভমেন্ট হয়েছে ওর বেতন কত জানেন তো? আর আমিও যথেষ্ট স্মার্ট একটা স্যালারিতে জব করেছি। তাছাড়া,,,
শেষ করতে দিলেন না জসিম শিকদার সামীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন ,,
‘হয়েছে কাজের কথায় ফিরে আসো তোমাদের জামাই শশুরের ঝগড়া বিরোধ থামাও এবার,
বন্ধুর থেকে তেড়ে গেলেন মীর সাহেব বললেন ,,
– কিসের জামাই বিয়ে হয়নি এখনো,
– তো দিয়ে দিলেই তো পারেন,
সামীর ত্যাড়া উত্তর ,গাঁ ছাড়া ভাব ভঙ্গিমা তার মধ্যে কোনো তাড়া নেই সে শান্ত গম্ভীর ,,, এইবার ছেলের উদ্দেশ্যে মুখ খুললেন সিকদার সাহেব বললেন,,
– দেখো সামীহ যেহেতু তামিম বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত বলতে পারো, সেহেতু সে কেনো তার এতো সুন্দর পজিশনটা ছেড়ে আসবে? তুমি যেহেতু বিজনেসই করবে তাহলে তুমিই হসপিটাল সামলাও । তাছাড়া হসপিটালের প্রায় ৫৫% মালিকানা তোমার সেহেতু তোমার তো একটা দায়িত্ব আছে তাই না?
– কিন্তু আমার জানামতে হসপিটালের ২০% শেয়ার আমি নিয়েছি তাহলে ৫৫% হলো কিভাবে?
মুখ বাঁকিয়ে উত্তর দিলেন মীর সাহেব_
‘ হতে না বাপ এতো হতে না যদি আমার মেয়েকে অন্য জাগায় বিয়ে দেওয়ার সুযোগ তুমি রাখতে সে গুড়ে তো বালি ঢেলে দিয়েছে তাই না? তাই আমার মেয়ের জামাই হিসেবে জসিমের ছেলে হিসেবে তুমি প্রায় ৩৫% মালিকানা পেয়েছো আর তোমার নিজের ২০% সব মিলিয়ে তোমার আধিপত্ই বেশি,,
একটু থেমে আবারো বললেন তবে এই পর্যায়ে মীর সাহেবের কন্ঠ একটু নরম হলো,
– এখন তুমি নিজে আলাদা ভাবে কিছু করতে চাইলে করতেই পারো তবে তোমাকে, তোমাদের (তামিমের দিকে চেয়ে) অবশ্যই দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা আর কত দেখব ? আমাদের বয়স বেড়েছে, এখন আমরা এতো দিক সামলাতে পারছি না, তোমরা বড় হয়েছো এবার তোমরা এইদিক সামলাও আমরাতো আছি তোমাদের সাহায্য করার জন্য তবে দায়িত্ব তোমাদেরকেই নিতে হবে। আশা করি আগামীকাল থেকেই জয়েন হবে।
আর কথা বাড়ালো না সামী শুধু গম্ভীর মুখে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো।

°°°°°°°°°°°°°°°°
আজ কাল বিকেল পড়লেই হালকা হালকা ঠান্ডা অনুভব হয় দিনটাও ছোটো হয়ে আসছে, প্রকৃতিতে ছড়িয়ে পড়ছে শীত আসার পূর্বাভাস, সেইটা হিয়া খুব ভালো করে টের পেলো পরীক্ষার হলে বসে, তার সিট পড়েছে তাদের কালেজের সবচেয়ে পুরাতন ভবনে ভবনটা কলেজের পুকুর পাড়ের কাছে হওয়ায় ঠান্ডা বাতাসে হিয়ার শরীরে কাপন ধরে গেলো , আজ তার বাংলা প্রথম পত্র পরীক্ষা ছিল, মোটামুটি ভালোই কমন পড়েছে। তাই পরীক্ষটাও তার মোটামুটি ভালোই গেল, খাতা জমা দিয়ে ফাইল নিয়ে অলস ভঙ্গিতে হল ছেড়ে বেরিয়ে এলো হিয়া, আজ আর তার কোন তারা নেই। শুধুমাত্র এই পরীক্ষার সময় এলেই হিয়ার মনে হয় কোন দুঃখে যে কমার্স নিতে গেল। বিজ্ঞান ও মানবিক শাখার পরীক্ষা হয় সকালে আর ব্যবসা শিক্ষায় শাখার পরীক্ষা হয় বিকালে, যেহেতু তাদের বন্ধু মহলের শুধুমাত্র হিয়াই ব্যবসায় শিক্ষা শাখার ছাত্রী তাই এখন সে একাই এই বিকাল সময় পরীক্ষা দিতে এসেছে। বন্ধুদের কথা ভেবেই একটু মন খারাপ হলো বটে, আনমনে মাঠ পেরিয়ে প্রথম গেট পেরোতেই হুট করে তার চোখ আটকে গেল এক সুদর্শন পুরুষের দিক,পরনে তার ফরমাল পোষাক পেছন ফিরে ফোনে কারো সাথে কথা বলছে, লোকটাকে দেখে হিয়ার পরিচিত মনে হলো কিন্তু শিকদার সাহেব এইসময় এখানে কেনো আসবে? হিয়া নিজের মাথায় নিজেই মারলো চোখের ভুল মনে করে পা বাড়াতে যাবে ঠিক তখনই সামী পিছন ফিরে হিয়াকে দেখে ফোন কেটে পকেটে ঢুকিয়ে গাড়ির সাথে হেলান দিয়ে দাড়ায়। আজ দুই পর দেখলো লোকটাকে সেই যে কোলে করে বাড়ী নিয়ে গেলো তার শুধু খাওয়ার টেবিলেই একনজর দেখেছিল, তারপর আজকে দুই দিন পর দেখলো লোকটাকে, বিকেলের ঠান্ডা বাতাসে সামীর সিল্কী চুল গুলো এলোমেলো হচ্ছে,ফরমাল পোশাকে সামীকে যেনো ভয়াবহ সুদর্শন ঠেকলো হিয়ার চোখে, এই গম্ভীর পুরুষ কে দেখলেই সব কেমন ধোঁয়াশা ধোঁয়াশা লাগে হিয়ার যেনো এই লোক ছাড়া দুনিয়াতে আর কেউ নেই,, হিয়া নিজেকে সামলালো এভাবে চেয়ে থাকলে কখন জানি গোমড়ামুখো টা চেঁচিয়ে উঠে! হিয়া দ্রুত পায়ে এগিয়ে যায়, কৌতুহল কন্ঠে জিজ্ঞেস করে ,
– আপনি এই সময় এখানে যে? সোহান সোহানার তো সকালেই পরীক্ষা শেষ তাহলে?
– তোকে নিতে এসেছি, বাসায় ফিরতে ফিরতে তো সন্ধ্যা হয়ে যাবে ওদের সবার এক্সাম সকালেই শেষ তুই একা সন্ধ্যা বেলা ফিরবি তাই তামীম আমাকে পাঠালো, ওর অফিসে জরুরি কাজ আছে চাইলেও আসতে পারছে না।
গম্ভীর হয়ে বলল সামী, হিয়ার অবশ্য এতো কিছু জানার ছিলো না শিকদার সাহেব তাকে নিতে এসেছে এতেই সে অনেক খুশি , যার প্রতিক্রিয়া সুরূপ জল জল করে উঠল তার চোখের তারা। সামী চোরা চোখে চাইলো হিয়ার মুখের দিক পরপরই মৃদু কেশে হিয়াকে বলল,,
– জলদি উঠ, ক্যাম্পাসে এভাবে বেশিক্ষণ দাড়িয়ে থাকা ঠিক হবে না সন্ধ্যা হয়ে আসছে।
হিয়া মাথা নাড়িয়ে উঠে বসলো, সিট বেল্ট লাগিয়ে সামীর দিকে তাকিয়ে আবারও কৌতুহলী হয়ে জিজ্ঞেস করে,
– এই গাড়িটা কার? এটাকে আগে তো দেখিনি?
– আমার,গতকালই কিনেছি
সামীর উত্তরে হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকায় , তার চোখের তারা আবারও জল জল করে উঠল, বলল,,
– এক্সাম টা শুধু শেষ হোক আমিও হসপিটাল জয়েন করবো, দুই দিনেই গাড়ি বাবাগো আমি তো কয়েক দিন যাবো তাহলে অনেক কিছুই কিনতে পারব বলুন?
– তোর মাথা পারবি আমার গাড়ি তোর বাপ, আর আমার বাপের হাসপাতাল চালাই বলে সেই টাকায় কেনা না আমেরিকায় আমি বেকার ছিলাম না, এমন আরও গাড়ি কেনার যথেষ্ট সামর্থ্য আমার আছে,
বলেই হুট করে গাড়ির ব্রেক কষলো সামিহ, হটাৎ ব্রেক কসায় হিয়া জিজ্ঞেস করল
– কি হলো হুট করে গাড়ি থামলেন যে?
– কিছু খাবি? সন্ধ্যা হয়ে গেছে নিশ্চয়ই খিদে পেয়েছে?
হিয়া একটু অবাক হলো সত্যিই তার খুদা পেয়েছে, দুপুরে এক্সামের পড়া কমপ্লিট করতে করতে তেমন একটা খাওয়া পড়েনি । সামী বিষয় টা ভেবেছে , যদিও কথাটা তিতা করলার মত গম্ভীর করে জিজ্ঞেস করেছে তবুও হিয়ার ভালো লাগছে সামীর এই একটু আধটু কেয়ার তার দিকে আরও বেশি টানে,

#চলবে,,