প্রণয়ের মহাকাব্য পর্ব-০৬

0
2

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(৬)
প্রকৃতিতে এখন সম্পূর্ণ ভাবে শীতের আধিপত্য, এতো দিন হালকা হালকা কুয়াশা দেখা গেলেও এখন তা ঘন কুয়াশায় রূপান্তর হয়েছে, ভোর সকাল হলে এখন সামান্য দুরত্বে থাকা জিনিসও দেখা যায় না। যদিও শীতের এই সময়টা বেশির ভাগ ব্যক্তিই লেপ কম্বল জড়িয়ে ঘুমাতে ভালোবাসে তবে চীরো অলস হিয়া এই সময় টা শীতবিলাস করতে ভালোবাসে। যাকে বলে উইন্টার লাভার, সকালের এই ঠান্ডা আবহাওয়া, বেস্ত নগরীর এই ক্ষণিকের নিস্তব্ধতা তাকে খুব টানে, মুগ্ধ করে । আজও হিয়া শীতবিলাস করবে বলে সকাল সকাল উঠেই সবার আগে পা টিপে টিপে চলে আসে নিজের জন্য এক কাপ কফি করবে বলে , এটা তার আজ কাল নতুন একটা রুটিনে পরিণত হয়েছে, ধোঁয়া ওঠা এক কাপ কফির সাথে শীতের সকাল উপভোগ, উফফ অনুভূতিই অন্যরকম । ড্রয়িং রুমে এসে হিয়া উকি মারে মায়ের রুমের দিকে, মিসেস আঞ্জুমান মীর আয়েশা নামাজ শেষে বেডের হেড বোর্ডে গাঁ এলিয়ে চোখ বুজে তজবিহ পাঠ করছেন। মীর সাহেব ঘরে নেই নামাজে গেছেন, আসতে এখনও অনেক দেরী নামাজ শেষে নিয়ম করে হাঁটার অভ্যাস আছে ওনার। হিয়া লুকিয়ে রান্না ঘরে গেলো, মা দেখলে খুব বকবেন ,হিয়ার রান্না ঘরে প্রবেশ সম্পূর্ণ নিষেধ আরও প্রায় দুই বছর আগে সখের বশে রান্না শিখবে বলে রান্না করতে গিয়ে অসাবধানতায় গরম তরকারির পাতিল ফেলে গাঁ ,হাত- পা পুড়িয়ে ফেলেছিল হিয়া। মেয়ের এমন অবস্থা দেখে মীর সাহেবের সে কি ভয়ংকর রাগ, তামিমও মায়ের উপর বেশ ক্ষেপেছিল, নিজের দোষে পুড়লেও সব দোষ গিয়ে পরে মিসেস মীরের উপড়, তার বাপ ভাইয়ের কথা ছিলো, মিসেস মীর কেনো হিয়াকে রান্না ঘরে ঢুকতে দিলো? আর দিলোই যখন তাহলে কেনো চোখে চোখে রাখলো না? আয়েশা নিজেও মেয়ের ওমন অবস্থা দেখে কেঁদে কেটে ভাসিয়ে ছিলেন, ননীর পুতুলের মতো যত্ন করে পেলেছে সে মেয়েকে তার অমন করুণ অবস্থা কি তার সহ্য হয় নাকি, তাই তিনিও মেয়েকে আর আগুন তাপের ধারে কাছে আসতে দেন না । আর কিছু না পারলেও ব্ল্যাক কফি টা হিয়া ভালোই বানাতে পারে, মাকে লুকিয়ে গরম ধোঁয়া ওঠা এক কাপ কফি করে হিয়া চলে আসে তার রুমের বেলকনিতে, বেলকনিতে পা রাখতেই তাজা ফুলের সুঘ্রাণে আবেশে চোখ বন্ধ হয়ে এলো হিয়ার। হিয়ার বারান্দা টা ছোটো খাটো একটা ফুল বাগান বলা যায়,তবে আজ সুঘ্রাণ টা একটু অন্য রকম ঠেকলো হিয়া চট জলদি চোখ খুলে শিউলি ফুলের গাছ টার দিকে গেলো , আনন্দে হিয়ার চোখ মুখ জল জলিয়ে উঠলো, দু একটা ছোট ছোট শিউলি ফুল কলি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছে। হেমন্তের শিশির ভেজা ঝাঁকা ঝাঁকা শিউলি, এবং তার সুঘ্রাণ হিয়ার বেশ প্রিয় তবে শীত কালেও হিয়ার গাছে অল্প স্বল্প ফুল আসে, হিয়ার বানারদাটা সে বেশ সখ করে সাজিয়েছে, বারান্দা টা তার শীত কালীন ফুলে ফুলে ভরে উঠেছে আর সেই ফুল গুলোর মিষ্টি সুঘ্রাণে সকাল টা আরো অতুলনীয় করে তুলেছে। হিয়া এগিয়ে গেলো বারান্দার গ্রিলের একাংশ ধরে দূরে তাকিয়ে থাকলো ঘন কুয়াশায় দূর দূরান্তে যতদূর চোখ যায় সব শুধু ধোঁয়াশা আর ধোঁয়াশা , ঠাণ্ডা বাতাসে তার শরীরে কাঁপন ধরে গেলো, হিয়া গায়ে জড়িয়ে থাকা চাদরটা আরও শক্ত করে শরীর পেঁচিয়ে ধরলো। চোখ বন্ধ করে বেশ বড় করে শ্বাস নিলো, ফুলের মিষ্টি সুঘ্রাণ যেনো তার নাকে সুরসুরি দিলো, হিয়া চোখ বন্ধ করেই খিলখিলিয়ে হেসে উঠলো। তখনই সে একটা দিবা স্বপ্ন দেখে বসলো, একটা সুন্দর স্নিগ্ধ শীতের সকাল চারিপাশে ঘন কুয়াশা ঠেলে পাশাপাশি এগিয়ে যাচ্ছে এক প্রেমিক যুগল, ছেলেটির মুখ থমথমে তার অনুভূতবোঝা দায় এক হাতে প্রিয় নারীর জুতো অন্য হাতে ধরে রেখেছে সখের নারীর হাত, তবে মেয়েটি চঞ্চল চোখে মুখে তার তৃপ্তির আবেশ,প্রিয় পুরুষের হাত ধরে খালি পায়ে শিশিরে ভেজা নরম ঘাসের উপর দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে। হঠাৎই হাত ছেড়ে মেয়েটি নরম ঘাসের উপর দিয়ে দু হাত দুপাশে মেলে দিলো দৌড় তখনই পেছন থেকে ভেসে এলো গম্ভীর এক পুরুষালী কণ্ঠের হুমকি,,
– আস্তে পড়ে যাবি, এইবার পড়ে ব্যাথা পেলে এখানেই ফেলে চলে যাবো!
সঙ্গে সঙ্গে চোখ খুলে ফেলে হিয়া কন্ঠটা তার বেশ পরিচিত ঠেকল দিবা স্বপ্ন এতো বাস্তব অনুভব হয়? তার অবচেতন মন কি তাহলে চায় শিকদার সাহেবের সাথে এমন একটা সুন্দর সময় কাটুক! কন্ঠ টা শিকদার সাহেবের যখন ভারী গম্ভীর গলায় কিছু বলে ঠিক তেমন শুনালো অবশ্য এই লোক মিষ্টি করে কথা বলতে জানে নাকি? নিজের চিন্তায় নিজেই হাসলো হিয়া সত্যিই কি সে শিকদার সাহেবের প্রেমে মজেছে? পরক্ষনেই তার মন যেনো বলে উঠলো,” না তুই প্রেমে পরিসনি মরেছিস!”
________________
নির্বাচনী পরীক্ষা শেষে শীত কালীন ছুটি চলছে হিয়াদের কলেজে ,তাই সারাদিন কাটে সোহান আর হিয়ার শুয়ে বসে ফোন ঘেটে , গ্রুপ কলে আড্ডা দিয়ে, আর সোহানা পড়ে যার জন্য সোহান অবশ্য তার স্পেশাল কিছু গালিও দেয়।নিরব ঢাকাতে কলেজে হোস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে তাই ছুটি পেয়ে সে বাড়ি চলে গেছে। ইরা গেছে নানুর বাসায় বেড়াতে আর প্রীতি গেছে কাজিনের বিয়েতে, তাই বর্তমানে গ্রুপ কলে শুধু হিয়া, সোহান আর সোহানাই যদিও সোহানা পড়ার ফাঁকে ফাঁকে দু একটা কথা বলে, কিন্তু সোহান আর হিয়া কথা বলে, তাদের কথার কোনো যুক্তি নেই তাই সোহানা ও তাদের কথার পাত্তা দেয় না। কথার এক পর্যায়ে সোহান বলল_
– আচ্ছা দোস্ত এই তুই ভাইয়া কে পছন্দ করিস, এখন যদি ভাইয়া অন্য কাওকে পছন্দ করে তখন কি করবি?
– আস্তাগফিরুল্লাহ ,,মিন জালেক! আল্লাহ মাফ করুক। ভাই তুই ভালা কথা কো, বাচ্চার জান নিয়ে নিবি নাকি?
– না, তা কেনো নিব আমি তো ভালো কথাই বললাম, দেখ ভাইয়া এতো বছর দেশের বাহিরে ছিলো, এমনও তো হোতে পারে ভাইয়া কোনো আমেরিকান কোনো সুন্দুরির সাথে ভাব ভালোবাসা আছে।
কথা টা শুনেই হিয়ার বুকে যেনো একটু ব্যাথা অনুভব করলো,মাথাটা কিছুক্ষণের জন্য ফাঁকা ফাঁকা লাগলো হাসি হাসি মুখ টা দুপ করেই নিভে গেল হিয়াকে একটু অস্থির দেখা গেলো, হিয়ার অবস্থা দেখে সোহান বলল,,
– আরে দোস্ত চিল, ভাবী আমি তোকেই বানাবো, ঐ বিদেশিনীদের আমি মানি না লাগলে ভাইকে তুলে নিয়ে তোর সাথে বিয়ে দিবো!এখন সুন্দর করে আমাদের বাসায় চলে আয় তো ভাইয়া বাসায় নেই এই ফাকেই ওর রুম চেক করে দেখবো কোনো সন্ধেহ জনক কিছু পাওয়া যায় কিনা!
– ঠিক বুঝলাম না?
– তুই কি সোহার মত গাঁধী হয়ে যাচ্ছিস হিয়া? জিএফ থাকলে নিশ্চই এমন কিছু পাবো ?
– তাহলে এখন কি করবো?
হিয়ার নিষ্প্রাণ গলারস্বর,
– তাড়াতাড়ি আমাদের বাসায় চলে আয় একটু পড় সন্ধ্যা হয়ে যাবে!
– কিন্তু উনি যদি চলে আসে?
– তোর উনি বর্তমানে খুব বিজি নিজের বিজনেস চালু করছে সাথে হসপিটালের ম্যানেজমেন্ট পরিচালনার দায়িত্ব সব মিলিয়ে ভাইয়া এখন খুব বিজি বাসায় ফিরতে রাত হয় তুই আয় তো।
হিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে ফোন রেখে দেয়।
———–
আসরের নামাজ শেষ করে ড্রইং রুমের সোফায় বসে চোখে চশমা দিয়ে অজিফা থেকে দোয়া পড়ছে জাহানারা বেগম, হিয়া বাড়ীতে প্রবেশ করতেই তার চোখ মুখে হাসি ফুটে ওঠে বইটা বন্ধ করে পাশে রেখে হিয়াকে পাশে এসে বসার আহ্বান জানায়। হিয়া ও চুপচাপ গিয়ে বসে, সবসময়ের মতো আজকে হিয়াকে চঞ্চল দেখায় না। জাহানারা বেগম হিয়াকে দু চোখ ভরে দেখে, হিয়ার উজ্জল শ্যামলা গায়ের রং, মায়াবি মুখ ভীষন আদুরে লাগে তার কাছে, উনার সবচেয়ে ভালো লাগে হিয়ার ঘন কালো রেসমি কোমড় নামা চুল গুলো তবেই না তার নাতি এতো পাগল উন্মাদ এই মেয়ের জন্য। মীর সাহেবের মেয়ে হিসেবে জাহানারা বেগম হিয়া কে নিজের নাতনি স্নেহেই দেখেছে তবে এখন সেই স্নেহ আরও বেরে গেছে তার বড় নাতির প্রাণ ভোমরা যে এই মেয়েই। ভেবেই হাসল বৃদ্ধা, হিয়া চোখ ছোটো ছোটো করে চায়, হিয়ার প্রতিক্রিয়া দেখে তিনি আরেকটু হেসে বলেন,,,
– মুখ টা অমনি কইরা রাখসিস কে? আজই এতো চুপচাপ যে?
– আগে বলো তুমি বুড়ি এতো খুশি কেন?
– সে তো তোরে দেখেই আমার খুশি খুশি লাগতাছে, কত দিন পরে আইলি, অহন কি আর আমাগো কথা মনে পড়ে না? এই বুড়িরে তো ভুল্লাই গেছস
হিয়া জড়িয়ে ধরে জাহানারা বেগম কে মৃধূ হেসে বলে,,
– তোমাকে কে বলল ভুলে গেছি, দেখো না মনে আছে দেখেই তো সোজা চলে এলাম
– আমার কাছে দারুণ এক বুদ্ধি আছে দাদুমনি। হিয়াকে একেবারে আমাদের বাড়িতে নিয়ে আসলে কেমন হয় বলতো
সোহানের কথায় জাহানার বেগম মুচকি হেসে বললেন,
– ভালোই তো হয় তয় তাসাউফ কি দিবো নাকি আইতে?
– আমার কাছে আরও ভালো বলতে পারো খুউউউব ভালো একটা বুদ্ধি আছে
– কিভাবে
জাহানারা বেগম চোখ পিট পিট করে জিজ্ঞাস করে সোহান চউড়া একটা হাসি দিয়ে বলে,,
– কেন সামীহ শিকদারের বউ করে!
বলেই ভ্রু নাচিয়ে হাসলো,সঙ্গে সঙ্গে সোহানের পিঠের উপর দুপ করে এক কিল দিলো হিয়া। জাহানারা বেগমের ঠোঁটের হাসি চওরা হয় হিয়া বলে,,
– তুই আমার নাতিডারে মারলি কে ওয় ভুল কি কইছে? হইবি নাকি আমার সামীর বউ?
হিয়ার মন খারাপ উড়ে গেলো বরং সে একটু লজ্জা পেয়ে বলল,,
– আমার বয়েই গেছে তোমার ঐ তিতা করলা নাতির বউ হতে, সরো তো
বলেই হিয়া উঠে দাড়ালো সঙ্গে উঠে দাড়ালো সোহান ও
হিয়ার পাশ ঘেসে হেসে বলল
– ঐ তিতা করলার জন্য না একটু আগে কেঁদে কেটে সাগর বানালি?
হিয়া ঝাড়ি মেরে বলে,
– সর ফালতু, তোর থেকে আমার সোহা বেবিই ভালো।
হিয়া উঠে চলে গেলো সোহান হাসতে হাসতে জাহানারা বেগমের মতো করে আবারও বলল,,,
– হবি নাকি আমার ভাইয়ের বউ!

#চলবে,,