প্রণয়ের মহাকাব্য পর্ব-১০+১১+১২

0
31

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(১০)
হিয়ার এখনো বিশ্বাস হয় না তার সত্যিই বিয়ে হয়ে গেছে তাও আবার সামীর সাথে। হিয়ার মাথায় এখনো সব জটলা পাকিয়ে আছে। কীভাবে কি হলো সে বুজে উঠতে পারছে না, সে ভাবতে বসলো সকাল থেকে ঠিক কি কি হলো? হিয়ার মনে পরে ,,
সকালে গাড়ির আওয়াজে হিয়া ভাবে তাইয়েবার শশুর বাড়ী থেকে লোকজন এসেছে, তাই সে দ্রুত বারান্দা ত্যাগ করে উদ্দেশ্য নিচে যাবে,এরই মাঝে ছোটো কাকি ডেকে গেছেন নাস্তার জন্য হিয়া দরজাও খোলে নি নিচে ও যায়নি, বলছে মাথা ব্যথা করছে, একটু ভালো লাগলে গিয়ে খেয়ে আসবে, তবে এইবার নিচে যাওয়া উচিত শত হোক বড় বোনের বিয়ের ডেট ফিক্সড হচ্ছে বলে কথা! তাই সে ধীরে ধীরে দোতলা ছেড়ে নিতলায় লিভিং রুমে যায়,, লিভিং রুমের সোফায় বসে থাকা সোহান,সোহানা আর তামিমকে দেখে সে হতবাক হয়,, এটা কীভাবে সম্ভব? ততক্ষণে সোহানা হিয়াকে দেখে দৌড়ে এসে তাকে জড়িয়ে ধরে। সোহান ভীষন রেগে তাই হিয়াকে দেখেও না দেখার ভান করে মুখ ঘুড়িয়ে নেয়। হিয়া বুঝে সোহানের রাগের কারণ মৃদু হেসে সোহানার হাত ধরে এগিয়ে যায় সোহানের কাছে, সোহানকে পাশে বসিয়ে সোহানের মাথায় হালকা মেরে
বলে,,
– কিরে কথা বলবি না আমার সাথে? রাগ করেছিস?
সোহান কথা বলে না , মুখ ঘুরিয়ে শুধু বলে,,
– কেও যেনো আমার সাথে কথা বলতে না আসে,
পর পরই হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,,
– তুই কীভাবে পারলি হিয়া? আমরা তোর কি ক্ষতি করেছি? তুই কীভাবে পারলি আমদের সাথে যোগাযোগ বন্ধ করে দিতে? তুই খুব খারাপ ,
হিয়া হেসে ফেলে কান ধরে সরি বলতেই সোহান ও হেসে ফেলে, প্রিয় সখীর উপর রেগে থাকা যায় নাকি? ততক্ষণে লিভিং রুমে একে একে আয়েশা মীর, তুহিন, তায়েবা, তানিয়া (হিয়ার ছোটো কাকার মেয়ে)মীর রাহেলা খাতুন, হিয়ার ফুপ্পি তাহমিনা মীর, ও তাঁর দুই মেয়ে তাসনিয়া ও তানজিলা সবাই এসে হাজির হয়,সোহান সোহানা কে দেখে আয়েশা মীর সে কি খুশি, প্রফুল্লচিত্তে সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দেয় , সোহান সোহানা ও হাসি মুখে সবার সাথে পরিচিত হয়, এসবের মাঝেও তামিমের কোনো হেলধোল নেই শুধু শুকনো মুখে দু একটা কথা বলেছে ছেলের অমন অদ্ভুত আচরণে আয়েশা মীর তামিমের কে বলে,,
– তোর আবার কি হলো?আসবি আগে বললি না কেনো?
– সোহান সোহানা বনুর সাথে দেখা করবে বলে খুব বায়না ধরছিলো মা , তাই ভাবলাম ওদের নিয়ে আসি, কলেজ তো বন্ধ ওরাও বসায় বসে বোর হচ্ছিল, হিয়ারও মন খারাপ তাই ভাবলাম ওদের নিয়ে এলে ওর ও মন ভালো হয়ে যাবে, তাই ওদের নিয়ে এলাম।
– সে তুই খুব ভালো করেছিস, এমনিতেও সামনে বাড়ীতে বিয়ে, সে যাই হোক চল খেতে দেই সেই কত দূর থেকে এলি নিশ্চয়ই খুব ক্ষিদে পেয়েছে? হিয়া ও এখনও খায় নি আয় তোদের খাবার দিচ্ছি,,
এ পর্যায়ে সোহান আয়েশা মীরের কাদ জড়িয়ে ধরে বলে,,
– হুম মামুনি, জলদি খাবার দাও তোমার এই কিপ্টা ছেলে আমদের এক পয়সার চকলেট ও কিনে খাওয়ায় নি,
সোহানা সোহানের মাথায় হালকা মেরে বলে,,
– ওতো সকালে দোকান খোলা ছিলো নাকি, তুই ভাইয়ার নামে মিথ্যে দোষ দিচ্ছিস কেনো?
সবার কথার মাঝে ফুরফুরে চঞ্চল তামিম গম্ভির গলায় বলে,,
– যা করার তাড়াতড়ি কর, আমাদের আবার দ্রুতই বের হতে হবে
সোহান সোহানার টনক নড়ে সোহান আয়েশা মীর কে ছেড়ে হিয়ার হাত ধরে বলে,,
– চল বেইবি এখন খেতে হবে না, আজকে তোকে আমরা ট্রিট দিবো চল,,
– সে কি এখন আবার কোথায় যাবে তোমরা? এই তো মাত্রই এলে কিছু মুখে অন্তত দেও একটু বিশ্রাম করে না হয়,,
রাহেলার প্রশ্নে সোহানা হেসে বলে,,
– আসলে আন্টি আমাদের একটু জরুরি কাজ ছিলো তাই তো নাটোরে আসা , তাছাড়া আমরা কাজ টা শেষ করেই আবার ফিরবো তাই না তামিম ভাই?
– হ্যাঁ কাকিমনি ,, ওদের আমি বাহিরে খাইয়ে দেবো আমাদের এক্ষুনি বের হোতে হবে,আমাদের একটু তাড়া আছে ,চল তোরা,,
বলেই তামিম বেরিয়ে যায়,তবে হিয়া বেঁকে বসে সে এখন কোথা ও যাবে না, সোহান সোহানা এক প্রকার জোর করেই তাকে টেনে বাড়ী থেকে বেড় করে গাড়িতে তুলে, ওরাও উঠে বসে, সোহান তামিম কে বলে ,,
– ভাইয়া ফাস্ট ড্রাইভ কোরো ওরা প্রায় স্পটে এসে পড়েছে! শুনেই মাথা নাড়িয়ে তামিম গাড়ী স্টার্ট করে, আর তার পর সব কিছু যেনো খুব দ্রুত হলো গাড়ী এসে থামলো মহা সড়কের উপর তারপর ? তারপর হিয়া সামীর মুখোমুখী হলো, কিছু বুঝে ওঠার আগেই কাজী সাহেব বিয়ে পড়াতে শুরু করলো আর আশ্চর্যজনক ভাবে হিয়া সামীহ শিকদারের নামে দলিল হয়ে গেলো!
***********
– কিরে হিয়া কোথায় হারিয়ে গেলি? নিশ্চয়ই ভাইয়ার কথা ভাবছিস?
সোহানের রসিকতায় হিয়ার ধ্যান ভাঙ্গে হিয়া সোহানের রসিকতায় পাত্তা না দিয়ে কৌতূহলী হয়ে সোহানকে বলে,,,
– আচ্ছা আমি যে শিকদার সাহেব কে ভালোবাসি এই কথা উনি জানলেন কীভাবে? মানে আমার না এখনো বিশ্বাস হয় না আমার বিয়ে হয়ে গেছে তাও আবার শিকদার সাহেবের সাথে! তোরা হুট করে এলি , জোর করে নিয়ে গেলি জরুরি কাজ আছে বলে , আর বিয়ে হয়ে গেলো তাও মাঝ রাস্তায়!মানে কীভাবে কী হলো আমার মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে। একটু বুঝিয়ে বল না দোস্ত,,
সোহান হেসে বলে,,
– তোরে ভাবী বানানোর জন্য যে কী পরিমান কষ্ট করতে হইছে শুধু আমিই জানি ,
হিয়া ভ্রু কুঁচকে তাকায়,, সোহান গাঁ এলিয়ে দেয় বেডের হেড বোর্ডে বলে,,
– ভাইয়ার মনে অন্য কেউ আছে শুনে যখন তুই বাড়ী থেকে বেড় হয়ে গেলি, ভাইয়াও তোর পিছু ছুটলো, আমি আর সোহা যেতে চেয়েছিলাম, ভাইয়া আমাদের যেতে না করে তোর পিছু নিলো, যখন খবর পেলাম তখন জ্ঞান হারিয়ে , আমরা সাথে সাথেই তোদের বাসায় যাই, ভাইয়ার চোখ মুখের সে কি করুণ অবস্থা, তার মাঝে টের পেলাম তোর খুব জ্বর, তাতে যেনো ভাইয়ার মুখের অবস্থা আরও বিবর্ণ হয়ে গেলো, আঙ্কেল সবাইকে তোর পাশ থেকে সরাতে পারলেও ভাইয়াকে সরাতে পারেনি, তখনই আমার একটু একটু সন্ধেহ হয় কোনো ভাবে ভাইয়ার ভালোবাসার মেয়েটি তুই না তো, আমার সন্ধেহ তখন মজবুত হয় যখন তুই ভাইয়াকে এবয়েড করা শুরু করলি ভাইয়ার যেনো পাগল পাগল অবস্থা, শুধু মাত্র তোর রাগ ভাঙ্গাতে বার বার তোদের বাড়ীতে আসা, তোকে সামনে না পেয়ে আমাদের থেকে তোর খবর নেওয়া, নম্বর নেয়া, বার বার কল এসএমএস সব মিলিয়ে আমার সন্ধেহ যেনো আরো জোরালো হলো,
এই পর্যায়ে সোহান একটু থামলো, শ্বাস নিয়ে আবারো বলতে শুরু করলো,,,
– এর মাঝে পেলাম আরেক চমক তুই মামুনির সাথে ঢাকা ছেড়ে নাটোর মীর ম্যানসনে চলে গেছিস, তামিম ভাই থেকে এই খবর পাওয়া মাত্রই ভাইয়া তার হাতের কাছে যা পেয়েছে তাই ভেঙেছে, আমি আর তামিম ভাই ধরে রাখতে পারি না এমন অবস্থা,, অনেক কষ্টে তামিম ভাই থামলো ভাইয়া কে। হুট করেই ভাইয়া তামিম ভাইকে জড়িয়ে ধরে বলে,,
– ও আমার সাথে এমন কেনো করছে তামিম,, তুই ওকে বলনা একটু কথা বলতে,, আমি সত্যিই ওকে ইচ্ছে করে মারিনি, ঐ ছেলের বেড কমেন্টে রাগ উঠে গিয়েছিল তাই নিজেকে সামলাতে পারিনি ,, তুই ওকে বোঝা প্লিজ,, ও চাইলে আমি মাফ চাইবো,,আমি আর সত্যিই পারছি না ভাই,,
তামিম ভাই আর ভাইয়া ভেবেছিল তোকে মারার জন্য তুই রেগে এমন করছিস, তামিম ভাই ভাইয়া কে শান্ত করতে বোঝায় উনি তোকে বোঝাবে, এতো কিছুর পর আমার সন্ধেহ শত ভাগ বেড়ে যায়, আমার সন্ধেহের কথা সোহানাকে বলি, পড়ে আমরা দুজন মিলে সিদ্ধান্ত নেই ভাইয়াকে তোর এমন আচরণের আসল কারণটা জানাতে,, এদিকে তুই কষ্ট পাচ্ছিস অন্যদিকে ভাইয়া তাই ঐ দিন রাতেই ভাইয়া হসপিটাল থেকে ফিরতেই আমি আর সোহানা সেই ডায়রিটা নিয়ে জাই ভাইয়ার কাছে, অনেক সাহস যুগিয়ে সেদিন ভাইয়ার কাছে গিয়েছিলাম আমারই মনে হচ্ছিলো স্বেচ্ছায় বাঘের গুহায় প্রবেশ করেছি,সোহানা বেচারীর অবস্থা আরো খারাপ!
– তারপর? তারপর কি হয়েছিল?
হিয়ার প্রশ্নে সোহান থেমে একটু হেসে আবারো বলতে শুরু করে,,
সেদিন সোহান আর সোহানা সামির রূমে প্রবেশের পর দেখতে পায় সামী বেডের হেড বোর্ডে হেলান দিয়ে আধশোয়া অবস্থায় বসে মাথায় এক হাত তার মুখমন্ডল থমথমে আর চোখ দুটো বুজে রাখা, সোহান ধীরে ডাক দেয়,,
– ভাইয়া,, একটু কথা ছিল,
সামী উঠে বসে, চোখের ইশারায় বসতে বলে,, সোহান বসে সোহানা পাশেই দাড়িয়ে থাকে,, সামী কিছু জিজ্ঞেস করবে তার আগেই খুব সাহস করে সোহান জিজ্ঞেস করে,,,
– ভাইয়া তুমি কি হিয়া কে ভালোবাসো?
সামীর কুচকানো ভ্রু সিথিল হয়ে যায় মুখ হয় গম্ভীর থমথমে,,, শান্ত গলায় জিজ্ঞেস করে,,
– এইসব কি হাবিজাবি কথা বলছিস? মাথা ঠিক আছে?
– প্লিজ ভাইয়া আমাদের এই ব্যাপারটা জানা খুব জরুরি,, তুমি যেই মেয়েকে ভালোবাসো সে কি আমাদের হিয়া?
– তোদের কে বলল আমি কাওকে ভালবাসি?
সোহান উত্তর দেয় না লুকিয়ে রাখা ডায়রিটা সামীর সামনে এগিয়ে দেয়,, সামী রাগে না চিল্লায় না হুট করেই যেনো সব স্তব্ধ নীরব হয়ে গেল, যেনো ঝড় উঠার পূর্বাভাস, নীরবতা ভেঙ্গে সোহান সামীর হাত ধরে বলে,,
– তোমার ব্যক্তিগত জিনিস তোমাকে না বলে ধরার জন্য আমরা খুবই দুঃখিত, আমরা এর জন্য সরি, তবে আমি আর সোহানা এই ডায়রির একটা পাতাও উল্টে দেখিনি তুমি রাগ করো না।
সামী শান্ত চোখে তাকায় সোহান শুকনো একটা ঢোক গিলে বলে,,
– হিয়া তোমাকে ভালোবাসে ভাইয়া, কখন কিভাবে ভালোবাসলো জানি না শুধু জানি হিয়া তোমাকে খুব ভালোবাসে,,সেদিন কোনো ভাবে তোমার ডায়রিটা হিয়ার চোখে পড়ে আর সেখানে এক মেয়েকে নিয়ে তোমার অনুভূতি জড়ানো কিছু লাইন লিখা ছিলো,, তবে কারো নাম দেখেনি, ও খুব ভেঙ্গে পড়েছে ভাইয়া,, ও রাগ করে নয় ও তোমার থেকে নিজের অনুভূতি থেকে পালিয়ে বেড়াচ্ছে,, ও ভালো নেই ভাই আমাদের হিয়া ভালো নেই।
এই পর্যায়ে এসেও সামী শান্ত নির্বিকার সোহানার , সোহানের সাধ্য হলো না সামীর মধ্যেকার আছড়ে পড়া ঝড়ের আভাস পাওয়ার, সোহান সামীর হাত এইবার দুহাতে শক্ত করে ধরে বলে,,
– হিয়ার জন্য যে ব্যাকুলতা আমি তোমার মধ্যে দেখেছি, আমার মন বলছে ভাই এই ডাইরিতে থাকা মেয়েটা আমাদের হিয়াই, যদি সত্যি তাই হয়ে থাকে তাহলে তুমি সত্যিটা হিয়া কে জানিয়ে দাও প্লিজ,, হিয়া সত্যিই তোমাকে অনেক ভালোবাসে।
সামী কোনো উত্তর দেয় না,, রাগ ও করে না হুট করেই সোহানের মাথায় হাত বুলিয়ে পকেট থেকে ফোন বের করে কল লাগায় কারো নম্বরে ওপাশ হতে রিসিভ হতেই গম্ভীর কণ্ঠে বলে,,
– তোর বোনকে আগামী কালকের মধ্যে বিয়ে করতে চাই তামিম তুই ব্যবস্থা কর,,
ওপাশ থেকে কি যেন বললো যা সোহান সোহানা কিছুই শুনলো না ,, পরপরই সামী গম্ভীর কণ্ঠে সব খুলে বলল,, তারপর একটু নিরবতা হয়তো তামিম কিছু বলল তবে তাকে থামিয়ে দিয়ে সামী গম্ভীর হয়ে বলে,,
– তুই কালকে সকালেই সোহান আর সোহানাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বি তামিম। সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি, এই বার আর আমি কারো বাঁধা নিষেধ মানবো না, এমনকি তোর কথাও না এন্ড আই মিন ইট ,
বলেই খট করে ফোনটা কেটে দিলো সামীহ।
***********
সোহানের মুখে সব শুনে আশ্চর্য বনে গেলো হিয়া,, ঠিক তখনই তার পাশে থাকা ফোন টা ঝংকার তুলে বেজে উঠলো,, হিয়া ফোনটা রিসিভ করার আগেই সোহান খপ করে ফোনটা নিয়ে রিসিভ করে স্পিকার অন করতেই ভেসে আসে গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠের এক বাক্য,,
-” হ্যালো, বউ?”

#চলবে,,,

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(১১)

-” হ্যালো, বউ?”
ফোনের ওপাশ থেকে ভেসে আসে গম্ভীর পুরুষালী কন্ঠের এক বাক্য,, হিয়ার হৃদয় ছলাত করে উঠে,সাথে সাথে সোহানের হাত থেকে ফোনটা নিতে চায় কিন্তু তার আগেই সোহান লাফ দিয়ে ফোন নিয়ে সরে দাড়ায় , ঢাকা থেকে নাটোর, আবার নাটোর থেকে ঢাকার প্রায় মাঝ রাস্তা আবার সেখানে থেকে নাটোর এতো এতো জার্নি করে বেচারি সোহানা হিয়ার রুমের বিছানায় শুয়ে ছিলো, এতো ক্ষণ চুপ করে পড়ে থাকলেও ভাইয়ের গম্ভীর কণ্ঠে এমন রোমান্টিক বাক্য শুনে লাফ মেরে উঠে, সোহানের ইশারায় হিয়াকে চেপে ধরে যাতে হিয়া ফোন টা নিতে না পারে। তখনই ফোনের ওপাশ থেকে গম্ভীর কণ্ঠের পরিবর্তে ভেসে আসে নরম কন্ঠস্বর,,
– কি হলো বউ কথা বলছিস না কেন? এখনো রেগে আছিস? তোকে রেখে চলে এসেছি দেখে রাগ করেছিস (একটু থামে হুট করেই ভেসে আসে মৃদ্ধ হাসির শব্দ) আচ্ছা কোনো ব্যাপার না আজকের মতো না হয় দুটো চুমু দিয়ে রাগ ভেঙ্গে দিবো, এমনিতেও বিয়ের পর কোনো গিফট দেওয়া হয়নি তোকে যা সে জন্য আরো দুটো চুমু ফ্রিইইইইই,,
একটু টেনে বলল সামী ,,সোহান এক হাতে মুখ চেপে আরেক হাতে ফোন ধরে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে,লজ্জায় হিয়া হাসফাস করে উঠলো,হিয়ার কান দিয়ে যেনো ধোয়া বের হয়ে যাচ্ছে, একি বোলছে শিকদার সাহেব, এই লোকের কি মাথা খারাপ হয়ে গেলো নাকি! উপায় না পেয়ে হিয়া সোহানার হাতে জোরে সরে এক কামড় বসায় সাথে সাথে সোহানা হিয়ার মুখ থেকে হাত সরিয়ে নেয় , মুখ খোলা পেয়ে হিয়া চেঁচিয়ে উঠে,,
– আল্লাহর ওয়াস্থে চুপ করুন, খাটাস লোক, আপনার দুই খাটাস ভাই বোন ফোন স্পিকারে রেখে সব শুনছে,, আমাকে,,,,
হিয়া শেষ করার আগেই খট করে ফোন টা কেটে গেলো,, সাথে সাথে সোহান আর সোহানা উচ্চসরে হেসে উঠলো,, হিয়া কি রাগ করবে নাকি লজ্জায় মাটির নিচে ঢুকে যাবে ভেবে পায় না, সোহানা হিয়া কে মৃদু ধাক্কা দিয়ে বলে,,
– কি বান্ধবী কোথায় হারিয়ে গেলে, আমার ভাইয়ের চুমুতে?
হিয়া অবিশ্বাস্য চোখে সোহানার দিকে তাকিয়ে বলে,,
– তুই? সোহান বললে মানা যায় তাই বলে তোর কাছে এইসব একদম আশা করিনি সোহানা, তোদের একটুও লজ্জা করলো না? উনি তোদের বড় ভাই হয়!
– উহ তোমরা করলে দোষ নাই, আমরা শুনলেই দোষ? সকালে যা দেখার তো দেখেই ফেলেছি , আর শুনো বান্ধুপি তোমার উনি আমদের বড় ভাই হলেও এখন আমাদের বান্ধবীর জামাই দুলাভাই লাগে , আর আমাদের হক আছে তুমার রোমাঞ্চের কাহিনী শোনার সোহান মুখ বাঁকিয়ে বলে।সোহানা মুখ টিপে টিপে হাসছে,হিয়া উঠে দাড়ায় আর শুনতে পারছে না এই বেলাজদের কথা কিছু বলতেও পারছে না সোহান টা এক নম্বরের ঠোঁট কাটা কখন কি বলে লজ্জায় ফেলে দিবে বলা যায় না।
***********
– আসসালামুয়ালাইকুম,,,বিয়াইনসাব !
সুর টেনে বলল সোহান, তানিয়া ভ্রু কুঁচকে তাঁকালো সোহানের দিকে,, সোহান ঠোঁট কামড়ে হাসছে, মেয়েটা হিয়ার ছোটো কাকার মেয়ে,, এইবার এসএসসি দিবে, সোহান এসে থেকে দেখছে তানিয়া একটু বদমেজাজী মেয়ে কেও কিছু বললেই ফোস করে উঠে, তাই তানিয়াকে একা পেয়ে এসেছে একটু জ্বালাতে,, তানিয়াও সুর টেনে ভ্রু কুঁচকে রেখেই বলে,,
– তুই আমার কোন জনমের, বিয়াইসাব,,,?
– তুই তুকারি করেন কে বিয়াইনসাব,বুকে লাগলো ব্যথা !
– দেখুন ভাই সরুণ সামনে থেকে ,,এমনিই কাজের জ্বালায় কিছু সামনে দেখছি না ,
তানিয়ার বিরক্তকর কন্ঠস্বর,,
– আপনাদের বাসায় মেহমান এলে বুঝি আপনারা এইভাবে ট্রিট করেন?
– অবশ্যই না, তবে আপনার মত লাফাঙ্গা মার্কা হলে আমি এমনি করি,,আপনাকে আমি ঠিক করে চিনি নাকি? আপনি কেনো বিয়াইন বলে রসিকতা করতে এলেন? আপনার কোন ভাইয়ের কাছে আমার কোন বোন বিয়ে দিয়েছি হ্যায়?
সোহান গালে হাত দিয়ে ভাবার মতো ভান করে বলে,,
– ওহ তাহলে তো মিস্টেক হয়ে গেলো,, বিয়াইন যেহেতু না , তাহলে বউ হয়ে যান! আপনাকে আমার ভালো লেগেছে, মিস ধনীলঙ্কা
তানিয়া তেড়ে আসে , আঙুল উঠিয়ে শাসিয়ে বলে,,
– এইসব ফালতু কথা বা নামে একদম ডাকবেন না,, মেহমান বলে কিন্তু একদম ছেড়ে দিবো না! দেখি সরুন তো ,,
তানিয়া ঝাড়ি এক প্রকার সোহান কে ধাক্কা দিয়ে চলে যায়, সোহান তানিয়ার যাওয়ার দিকে তাকিয়ে হেসে বলে,,
– ঝাসিকি রাণী!
***************
শীত কালীন দুপুরের মিঠা দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই মীর মানসনের ড্রয়িংরুমে একে একে সবাই এসে হাজির একটু পরই সবাই শপিংয়ে যাবে, যেহেতু তায়েবার বিয়ে আগে থেকেই ঠিক হয়ে আছে তাই ছেলের বাড়ির লোক দ্রুতই বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে চান, তাই বিয়ের দিন ঠিক করা হয়েছে আগামী শুক্রবার আজ রবি হাতে মাত্র আর তিন দিন বৃহস্পতিবার তো হলুদই তাই তাসাউফ মীর ফোন করে ছোটো ভাই তৌফিক মীর আর সবাইকে বলে দিয়েছেন শপিংয়ের কাজটা সবার আগে করে ফেলতে,তার মতে শপিং শেষ মানে বিয়ের অর্ধেক কাজ শেষ,, যেহেতু হসপিটালের চাপে তিনি আসতে পারছেন না ,তাই এই গুরু ভার তিনি তামিম, তুহিন আর তৌফিক মীরের উপর সপে দিলেন বাকি কাজ তিনি এসে সামলে নিবেন । সেই কথা মতোই দুপুর গড়িয়ে বিকেল হতেই
সবাই তৈরি হয়ে নিচে নেমে আসছে, তখনই ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে নিচে নামলো তামিম মায়ের উদ্দেশে হাক ছেড়ে বলল,,,
– তোমাদের সবার হলো আম্মু? একে তো শীতের সময় দিন ছোটো হওয়ায় একটু সমস্যা হয়ে যাবে,তার উপর এখানে শপিং মল অনেক দূর এখন না বের হলে আর ফিরে আসতে পারবো না,
সোফায় হিয়ার সাথে বসে কি কি কিনবে,, সে সব নিয়ে ডিসকাস করছিলো সোহানা, তার পাশেই সোহান অলস ভঙ্গিতে পড়ে আছে,,তামীমের কন্ঠ শুনে সোহানা এক পলক চাইলো তামিমের দিক সেই চাওয়াই যেনো তার কাল হয়ে দাঁড়ালো,, যেনো দুটো বিট মিস করলো মেয়েটি,,ব্ল্যাক জিন্স আর শার্ট পড়ে পুরোই ব্ল্যাক আউট ফিট, চুল গুলো জেল দিয়ে সেট করা, শীতের এই মিষ্টি বিকেলেও চোখে কালো সানগ্লাস পড়ে তৈরি হয়ে ঘড়িতে সময় দেখতে দেখতে নিচে নামছে তামিম সোহানা যেনো আবারও নতুন করে প্রেমে পড়লো এই লোকটার,, খুব ছোট থেকেই মূলত জ্ঞান হবার পর থেকেই সামী আর তামিমের ছায়া তলে তাদের বেড়ে ওঠা, হুট করে যখন সামী দেশ ছাড়লো তখন তামিম নামের লোকটা যেনো তাদের তিন বন্ধুর কাছে বটবৃক্ষ হয়ে গেলো, কখনও তামিমের কড়া শাসন তো কখনও স্নেহময় বাক্য কখনও গম্ভীর তামিমের আদেশ নিষেধ তো কখনও চঞ্চল রসিক হয়ে হাসানো সবই যেনো স্বল্পভাষী চাপা সভাবের মেয়েটার আকর্ষণ কারতে সক্ষম, একটা সময় পর নির্বোধ মেয়েটা বুঝে তার এই আকর্ষণ তার এক রোগের সূচনা মাত্র যা তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে এক মহাব্যাধির দিক, আজ সপ্তদশী চাপা কন্যা জানে বুঝে সে প্রেমে মজেছে, ভুল করে হলেও তামিমের প্রেমে পড়েছে!
সোহানাকে হা হয়ে তামিমের দিকে থাকতে দেখে সোহান মেরুদন্ড সোজা করে বসে ,, বাঁকা হেসে সোহানার কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,,
– মনে হচ্ছে আরেকটা বিয়ের ঘটকালি খুব শীগ্রই করতে হবে, বলা তো যায় না কোন শকুনী কখন আমার ব্রো কে চোখ দিয়েই গিলে খায়!
সোহানের কথা শুনে থতমত খেয়ে তড়িৎ তামিমের দিক থেকে নজর সরায় সোহানা,, সোহানের পিঠে জোড়ে এক কিল বসিয়ে শাসিয়ে হয়ে,,
– মাইন্ড ইউর লঙ্গুইজ
মার খেয়ে বাঁকা হয়ে পিঠে হাত বুলিয়ে সোহান ও দাঁতে দাঁত চেপে সোহানার দিকে ডান হাতের শাহাদাত আঙুল তাক করে বলে,,
– কিপ ইউর হ্যান্ডস এন্ড আইস রেস্ট্রেইনড , নিজের হাত এবং চোখ সংযত রাখ রাক্ষুসী,
ওদের দুই জনের মারামারি দেখে তানিয়া মুখ বাঁকিয়ে বলে,,
– আই থিঙ্ক আপনার উচিত নিজের হাত সংযত রাখা মিস্টার ঝগড়ুটে!
০০০০০০০০০০০০০
শপিং মলে সবাই কেনাকাটা করতে বেস্ত,বাড়ির বড়রা সব তাইয়্যেবার কে নিয়ে তার জন্য কেনাকাটায় বেস্ত, তুহিন আর তামিম প্রকিংয়ে গাড়িতে বসে আছে তারা বলে দিয়েছে মহিলা মানুষের সাথে শপিং করার মতো ধৈর্য তাদের নেই, তারা পার্কিংয়ে ওয়েট করছে সব শেষ
হলেই যেনো তাঁদের কল করা হয়। তৌফিক মীর ও বাড়িতেই কাজ আছে বলে কেটেছেন ,,তবে সোহান বীর পুরুষ সেজে মেয়েদের সাথে ভেতরে আসলেও যখন দেখলো সামান্য বিয়ের শাড়ি কিনতেই সবার বিকাল থেকে রাত পার হয়ে যাচ্ছে তখন সে অধৈর্য হয়ে হিয়ার হাত ধরে বলে,,
– বইন আমাকে বাঁচা, জীবনে মনে থাকলে আর মহিলা মানুষের সাথে শপিংয়ে আসবো না,, চল আমরা অন্য দিকে যাই,, এই মহিলা পার্টি তো এক জায়গায়ই তখন থেকে হ্যাং মেরে আছে,, আর এক জায়গায় এতক্ষণ দাড়িয়ে থেকে আমার মাথা, মেজাজ আর ঠেঙ সব হ্যাং মেরে যাচ্ছে!
হিয়া হাসে সোহানের কোথায় পিঠে হালকা মেরে বলে,,
– তুই আর তোর মুখের ভাষা কোনো দিন শুধরাবিনা না? আচ্ছা চল আমরা ঐ দিকে যাই।
———-
গাঢ় সবুজ আর বাসন্তী রংয়ের দুটো ড্রেস হাতে নিয়ে অসহায় চোখে তাকিয়ে আছে তানিয়া , সে ভেবে পাচ্ছে না সে হলুদের জন্য কোন ড্রেস টা নিবে, কারণ দুটো ড্রেসই তার পছন্দ হয়েছে,হলুদে সবাই শাড়ি পড়লেও তানিয়া পড়বে না কারন সে শাড়ি পরতে জানে না , তাই সে হলুদের জন্য ড্রেস পছন্দ করতে মনযোগী যেহেতু হলুদের জন্য বাসন্তী ও সবুজের মধ্যে ড্রেস কোড তাই সে ভেবে পাচ্ছে না কোন ড্রেস টা পড়লে তাকে বেশী সুন্দর লাগবে,,তানিয়াকে এমন হ্যাং হয়ে বসে থাকতে দেখে বিরক্ত হলো দোকানের সেলস গার্ল মেয়েটি, তবুও নিজের বিরক্ত চেপে মিষ্টি কন্ঠে বলে,
– কোন ড্রেস টাপ্যাক করবো ম্যাম? আপনার কি কোন টাই পছন্দ হয় নি?
জবাবে মাথা নাড়িয়ে ঠোঁট উল্টে তানিয়া বলে,,
– উহু,, দুটোই ভালো লাগছে কোনটা নেই বলুন তো?
– আপনাকে সবুজেই মানাবে মিস ঝগড়ুটে,,
কথা টা কানে যেতেই তানিয়া পেছন ফিরে তাকায়,, দেখে সোহান দাঁত কেলিয়ে তাঁর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে, তানিয়া একবার সোহানের দিকে তাকিয়ে আবার নিজের হাতে থাকা ড্রেস গুলোর দিকে এক পলক তাকিয়ে হেসে ডান হাতে থাকা বাসন্তী রংয়ের ড্রেসটা সেলস গার্ল মেয়েটির দিকে বাড়িয়ে বলে,,
– আপনি এইটাই প্যাক করুণ আপু, আমি এইটাই নিবো,
বলে ড্রেসটি এগিয়ে দিতেই সেলস গার্ল মেয়েটি চলে গেলো বিল করতে তখন তানিয়া পিছন ফিরে সোহানরে দিকে তাকিয়ে হেসে তাকে দেখিয়ে দেখিয়ে বা হাতে থাকা সবুজ ড্রেসটি রেখে দিতেই, সোহান ও রহস্যময় হেসে পকেটে দু হাত গুজে শিস বাজাতে বাজাতে চলে গেলো। সোহানের ব্যবহারে তানিয়া একটু অবাক হলো বটে, তার পছন্দকে রিজেক্ট করার পরও এতো প্রফুল্ল কেন এই ছেলে!?
**********
সেই কখন থেকে এক জোড়া কাপল আউট ফিটের দিকে চোখ আটকে আছে হিয়ার আর সৌভাগ্য বসত ড্রেস গুলোর বাসন্তী রংয়ের শাড়ি ও পাঞ্জাবি,, তখনই শিস বাজাতে বাজাতে সেখানে এসে হাজির হলো সোহান, হিয়াকে এমন এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকতে দেখে ভ্রু কুঁচকে হিয়াকে ধাক্কা দিয়ে বলল,,
– কিরে কি দেখিস?
– আচ্ছা ঐ ড্রেসে আমাদের একসাথে কেমন লাগবে বলতো?
হিয়ার উচ্ছ্বাসিত কন্ঠ,, সোহান কুচকানো ভ্রু আরেকটু গুটিয়ে বলে
– আমাদের বলতে?
– আরে আমাদের, আমাদের, আমাকে আর শিকদার সাহেব কে!
শুনেই সোহান চোখ বড় বড় করে তাকালো, হিয়া যখন বুজলো সে ভুল যায়গায়, ভুল মানুষের কাছে ভূল কথা বলে ফেলেছে, ততক্ষণে খুব দেরি হয়ে গেছে না জানি এখন এইটা নিয়ে এই বেলাজ ছেলে কতদিন লজ্জা দেয়।
#চলবে,,,

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(১২)
বিকেল হতে না হতেই মীর ম্যানসনের ছাদে কাজিন আর সোহান সোহানাকে নিয়ে হিয়া শুরু করে দিয়েছে মেহেন্দির জন্য তোড়জোড়, আজ বুধবার আগামী কাল তায়েবার হলুদ সন্ধ্যা যার জন্য মীর ম্যানসনের উঠোনে করা হচ্ছে বিশাল স্টেজ, স্টেজের কাজ এখনো চলছে, যেহেতু মেহেন্দি অনুষ্ঠানের কোনো প্লান ছিলো না তাই স্টেজের কাজ এখনো চলছে,, তবে সকালে তৌফিক মীরের কাছে হিয়া বায়না ধরে তারা চায় ছোটো করে হলেও একটা মেহেন্দি প্রোগ্রাম তারা করবে, তৌফিক মীর অনুমতি দেয় তবে স্টেজের কাজ শেষ না হওয়ায় ছাদে তাদের মতো করে সব কিছুর ব্যবস্থা করে নিতে বলে, হিয়ারা রাজি হয়ে যায় যেহেতু তামিম, তুহিন অন্যান্য কাজে বেস্ত সেহেতু ছাদের এই প্রোগ্রামের দায়িত্ব নেয় হিয়া আর তার কাজীনরা । সব গুছিয়ে শেষ করতে করতে সন্ধ্যা হয়ে গেলো,, দিনের আলো ফুরিয়ে যখন গোধূলির সন্ধ্যা নামলো লাল কমলায় আকাশের রং হয়ে উঠলো মোহময় সেই মূহুর্তেই হুট করে জ্বলে উঠলো লাল নীল আরও ভিন্ন রংয়ের ফেইরি লাইট গুলো, হিয়া একবার তাকালো তাদের তৈরী মেহেদী অনুষ্ঠানের জন্য তৈরী ছোট্ট সেই বসার জায়গাটায় , মোটামুটি ভালোই সাজিয়েছে তারা, বড় মেট্রেস বিছিয়ে তার উপর চাদর পেতে করেছে বসার জন্য আসন, পেছনে ডেকোটরের লোক দিয়ে স্ট্যান্ড লাগিয়ে সে খানে ঝুলিয়ে দিয়েছে গাদা ফুলের মালা মাঝে দিয়েছে ফেইরী লাইটের তার জেগুলো থেকে থেকে জ্বলছে আর নিভছে, বসার জাগায় ডালার উপর ফুল ছিটিয়ে তার উপর রাখা অর্গানিক মেহেদীর কোন ,, বসার আসনের দুই পাশে ফ্লাওয়ারবাস রাখা কতগুলো করে রজনীগন্ধার ডাল বাতাসে যার মিষ্টি ঘ্রাণ ভেসে বেড়াচ্ছে, কাজ শেষ করে প্রায় সবাই চলে গেছে তৈরী হতে, ছাদে এখন শুধু সোহান,সোহানা হিয়া আর তানিয়া, হুট করে তানিয়া হিয়াকে বলে,,
– আচ্ছা আপু বসার স্টেজটা খালি খালি লাগছে না?
এক কাজ করি সোফার কুশন গুলো এনে রাখি দেখতে ভালো লাগবে তাই না?
হিয়ার আগে উত্তর দেয় সোহান,,
– জীবনে প্রথম দেখলাম একটা ভালো কথা বললেন মিস ঝগড়ুটে
– আপনারা জীবনটাই আর কতটুকু মিস্টার ঝগড়ুটে, দু দিন হলো দুনিয়ায় এসেছেন, থাকুন, দেখুন, বুঝুন পড়ে না বুঝবেন এই তানি কি কি জানে !
সোহান তানিয়ার দিকে এগিয়ে ধীর কন্ঠে বলে,,
– আপনি কি বাই এনি চান্স আপনার দুনিয়ায় থাকার কথা বললেন মিস ঝগড়ুটে? আমার তো তাই মনে হলো, না হলে তো দুনিয়ায় আপনার আগে আমি এসেছি,
সোহান আর কিছু বলার আগেই হিয়া বিরক্ত হয়ে বলল,,
– এই তোরা যা তো যা তাড়াতাড়ি কুশন গুলো নিয়ে আয় বহুৎ ঝগড়া হয়েছে তোরা এলেই আমরা নিচে যাবো তৈরী হোতে , সবাই বোধহয় এতোক্ষণে তৈরি হয়েও গেছে,
হিয়ার ঝাড়ি খেয়ে তানিয়া আর সোহান ভদ্র ছেলে মেয়ের মতো নীচে চলে যায়, হিয়া আবারো সোহানার দিকে তাকিয়ে কথা বলতে শুরু করে আজকের অনুষ্ঠানের জন্য,, হুট করেই নিচ থেকে গাড়ীর হর্নের আওয়াজ পেলো হিয়া ও সোহানা । হিয়া ছাদের কার্নিশ ঘেষেই দাঁড়িয়ে ছিলো কে এলো দেখার জন্য উল্টো ঘুরে ছাদের কার্নিশে ভর দিয়ে নিচের দিকে ঝুকে তাকাতেই দেখলো পরপর দুটো গাড়ি ঢুকলো মীর ম্যানসনের মূল ফটক গলিয়ে,, প্রথম গাড়িটা জসীম শিকদারের হিয়া চিনে কিন্তু পরবর্তী গাড়ীটা কার? মাথায় একটু জোড় পড়তেই মনে পড়লো এইটাতো সামীর গাড়ি যেই গাড়িতে বসেই সামী তাকে বিয়ে করেছে! হিয়াকে নিচের দিকে ঝুকে থাকতে দেখে সোহানা ও ওর মতো করে নীচের দিকে তাঁকিয়ে বাবা মা, ভাইকে দেখে উপর থেকে চিৎকার করে ডেকে উঠলো,,
– আম্মুউউউ,,,
সবে মাত্রই গাড়ি থেকে নেমে দাঁড়িয়েছে সামীহ বোনের চিৎকার শুনে শব্দের উৎস খুঁজতে ছাদের দিক তাকাতেই দেখলো হিয়া আর সোহানা ছাদের উপর দাঁড়িয়ে আছে, হিয়া ও সামীর দিকে তাকিয়ে ছিলো সামী তাকাতেই চোখাচোখি হলো দুজনের,সামী এক নজর তাকালো পরপরই নজর ঘুড়িয়ে ফেলল,, সামী সাথে সাথে চোখ সরিয়ে নেওয়ায় হিয়া মন খারাপ করলো ভাবলো সামী বুঝি এখনো তার উপর রেগে আছে, অথচ সপ্তদশী জানলোই না, গায়ে শাল জড়িয়ে খোলা চুলে দাঁড়িয়ে থাকা ফাইরি লাইটের আলোয় নিজের বউ রুপি প্রেয়সী কে দেখে আরো একবার তার প্রেমে পিছলে গেছে সামীহ শিকদার ওরফে তার শিকদার সাহেব!
———
নিজের রূমে বসে একা একা তৈরী হচ্ছে হিয়া ,সোহানা তাঁর মায়ের কাছে চলে গেছে তৈরি হতে মাকে এতদিন পর দেখে সে মায়ের কাছে চলে গেছে মায়ের সাথে গল্পকরে তৈরি হবে বলে,,যেহেতু সোহানা নেই তাই হিয়া নিজেই গুণ গুণ করে গাইছে আর তৈরী হচ্ছে, হিয়া আজ একটা গাঢ় সবুজ রঙের চুড়িদার পড়েছে, হিয়া তাঁর কোমর নামা রেশমি চুল গুলো কিভাবে বাঁধবে ভেবে পাচ্ছে না, তাই মাথার মাঝ বরাবর সীথি করে দুইপাশে টুইস্ট করে সিম্পল বেনি করার জন্য চুল গুলো ঘাড় থেকে সরিয়ে সামনে নিয়ে আঁচড়ে বেনি করায় মনোযোগ দিলো হুট করে খট করে দরজায় আওয়াজ হলো হিয়া ভাবলো সোহানা এসেছে,, তাই সে নীচের দিকে তাকিয়ে বেনি করতে করতে বলল,,
– সোহা এসেছিস? যাক ভালোই হয়েছে দেখতো আমার এই ড্রেসের সঙ্গে কোনো জুয়েলারী গুলো ভালো মানাবে,, কিরে কথা,,,,
হিয়া আর কথা বলল না তার কথা ও হাত দুটোই থেমে গেছে কাঁধে কারো শীতল ঠোঁটের স্পর্শ পেয়ে,, যখন বুজলো কেউ তাকে ছুঁয়ে দিয়েছে সাথে সাথে হিয়া চিৎকার করতে চাইলো,, আগুন্তক ও মূহুর্তেই হিয়ার মুখ হাত দিয়ে চেপে ধরে কানের কাছে মুখ নিয়ে ফিসফিসিয়ে বলে,,
– হুস,, শব্দ করে না ফুল,, ইটস মি ইউর মেন।
হিয়া ঘোলা হয়ে আসা চোখ তুলে তাকায় তবে আয়নায় সামী দেখে যেনো অশান্ত মন একটু শান্ত হলো সামী ও আয়নায় হিয়ার দিকেই তাকিয়ে ছিলো চোখাচোখি হতেই সামীর চোখে পড়ে হিয়ার ছলছল করা চোখ দুটো, সামী সাথে সাথে হিয়াকে দু হাতে নিজের দিকে ঘুরায় বেস্ত কন্ঠে বলে,,
– হিয়া কি হলো তোর? তোর চোখে পানি কেনো?
হিয়া কথা বলে না এক মুহুর্ত সামীর দিকে তাকিয়ে থেকে হুট করেই আছড়ে পড়ে সামীর বুকে,, হিয়ার কাণ্ডে সামী হতভাগ হয়, দু হাতে শক্ত করে নিজের সাথে চেপে ধরে শুধায়,,
– হিয়া কি হলো? আরে বাবা আমি ছিলাম আমি তোর শিকদার সাহেব
– আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম, শিকদার সাহেব ভেবেছিলাম অন্যকেউ বুঝি আপনার আগে ছুঁয়ে দিলো, আমি তো আপনার বলুন ?আপনি ছাড়া কি অন্য কারো ছোঁয়া সহ্য হয় বলুন?
বলেই হিয়া আরও শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো সামিকে, হিয়ার কথায় সামী অবাক হয়,মুগ্ধ হয়, হিয়ার মাথায় চুমু খেয়ে বলে,,
– শান্ত হ, চেয়ে দেখ আমি তোর শিকদার সাহেব তোর স্বামী আছি তোর পাশে, তোর কাছে ,, আমি ছাড়া কারো সাহস হবে না তোকে ছোঁয়ার সেই অধিকার আমি কাও কে দেইনি, যখন তুই আমার ছিলী না তখনই দেই নি এখন তো তুই আমার হয়ে গেছিস হিয়া।
হুট করেই হিয়ার মনে পড়ে সে তো রেগে আছে সামীর উপর , যেই লোক বিয়ের প্রায় সপ্তাহ খানেকের মধ্যে ফোন করে বউয়ের খোঁজ নেয় না তাঁর সাথে কিসের কথা? হিয়া সামিকে ছেড়ে দূরে সরে দাড়ায়, হিয়ার এমন ব্যবহারে সামী হিয়ার দিকে তাকিয়ে বলে,,
– কি হলো সরে গেলি কেনো? ভালোই তো লাগছিল
হিয়া মুখ ঝামটা মেরে আবারও চুল গুলো হাতে নিয়ে বেনি করতে করতে বলে,,
– যে লোক বিয়ে করে বিয়ের প্রায় সপ্তাহ খানেকের মধ্যে একটা বার ফোন করে খোঁজ নেয় না , তাঁকে আমি স্বামী হিসেবে মানি না, যান শরুন এখন এখান থেকে,
বিস্ময়ে সামীর চোখ মূহুর্তেই বড় বড় হয়ে গেলো,, মূহুর্তেই কীভাবে পাল্টি খেলো এই মেয়ে,, পরমুহুর্তেই মুচকি হেসে বলল,,
– বাহ! ভালোই শাসন করা শিখেছিস দেখছি,, ভালোই বউয়ের শাসনে এইবার মনে হচ্ছে না আসলেই আমি বিয়ে করেছি, বাই দ্যা ওয়ে তোর অবগতির জন্য জানিয়ে রাখি যে,, তোর স্বামী এতো দিন ঢাকার বাহিরে ছিলো চট্টগ্রাম, নিজের ব্যবসার কাজে সে বেস্ত ছিলো তাছারা সেখানে নেটওয়ার্ক এর ও প্রবলেম ছিলো তাঁর জন্যই ঐ দিন রাতে কল দিয়েছিলাম কিন্তু আমার ভাগ্য দেখ বিয়ে করে বউ রেখে যেতে হলো যাও ফোনে দুটো কথা বলবো ঐ ফাজিলগুলোর জ্বালায় তাও পারলাম না!
বলেই হতাশার শ্বাস ফেলল বেচারা সামী, হিয়া এইসব কথা এক কান দিয়ে শুনছে তো আরেক কান দিয়ে বের করে দিচ্ছে সে ডোন্ট কেয়ার ভাব নিয়ে নিজের মতো করে সেজে যাচ্ছে,, আর সামী বউয়ের পাত্তা না পেয়ে চুপ করে বউয়ের সাজ দেখতে বেস্ত, তবে একটু পড়ই
দেখ গেলো সামী জোড়ে জোড়ে শ্বাস নিচ্ছে হিয়া সম্পূর্ণ সাজ কমপ্লিট করে সামীর দিকে ফিরতেই দেখে সামী কেমন করে যেনো তাকিয়ে আছে হিয়ার ভ্রু কুঁচকে যায়,, জিজ্ঞেস করে,,
– কি? এমন করে তাকিয়ে আছেন কেনো?
– এতো সেজেছিস কেনো?
সামীর গম্ভীর কন্ঠস্বর, হিয়া কুচকানো ভ্রু আরও কুঁচকে ফেলে বলে,,
– কোথায় এতো সেজেছি? বাকিদের গিয়ে দেখুন তারা আরো সেজেছে ,,
– দুঃখিত বউ ছাড়া আর কারো দিকে তাকাতে উৎসাহিত নয় তাছাড়া সবাই আর তুই কি এক? যা গিয়ে এসব মুছে আয়
– আরে আশ্চর্য, বিয়ে বাড়ীতে এইটুক সাজ যদি না দেই তাহলে তো সবার তুলনায় আমাকে ফকিন্নী লাগবে, এই আপনি যান তো কখন কে দেখে ফেলবে পড়ে আরেক জামেলা হবে,
সামী গেলো না নড়ল ও না বলল,,
– দেখুক আই ডোন্ট কেয়ার, আর তোকে এমনিতেই অনেক সুন্দর লাগে যা মুছে আয়,
– সরি আমি পারবো না ,,
বলল হিয়া
– তাহলে আমিও সরি আমিও পারবো না,
হিয়া প্রশ্নবোধক চোখে তাকাতেই সামী ওর দিকে এগিয়ে বলল,,,
– আই ক্যান্ট কন্ট্রোল মাইসেল্ফ ফ্লাওয়ার,, সরি,,
********
ছাদে মেহন্দির অনুষ্ঠানে সবার শেষে এসে উপস্থিত হলো হিয়া, সে এসে দেখে তাইয়্যেবার এক হাতে অলরেডি মেহেদী দেয়া শেষ আরেক হাতে আর্টিস্ট মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে, ছাদে সাউন্ড বক্স চলছে ঋত্বিকের আজা মাহিয়া গানটি, প্রায় সবাই ব্যস্ত মেহেদী নিয়ে শুধু বাচ্চা গুলো, গানের তালে তালে নেচে যাচ্ছে,হিয়া মুখ ফুলিয়ে গিয়ে বসলো সোহানার পাশে সোহানা হিয়ার ফুপাতো বোন তানজিলা কে মেহেদী দিয়ে দিচ্ছে,, হিয়া বসতেই
সোহানা হিয়া কে বলল,,
– এতো লেট করলি যে? মুখ ফুলিয়ে থাকিস না আমরা তোর জন্য বসেই ছিলাম , তবে শীতের রাত বুঝিসই তো আরেকটু পর তো ঠান্ডায় ছাদে টেকা যাবে না , তাই আমিই সবাই কে বলেছি শুরু করতে,
সোহানার কথায় তাইয়্যেবা ও সুর মিলিয়ে বলল,,
– হ্যায় হিয়া আমি চাইনি , তুই কিন্তু রাগ করিস না,,
– না আপু আমি রাগ করিনি, তাছারা মেহেদী অনুষ্ঠানে তো মেহেদী দেয়ার পরই ফটোশুট হবে,
মুচকি হেসে বলে হিয়া, ততক্ষণে তানজিলার হাতে মেহেদী দেয়া শেষ, বাকিরা কিছু আর্টিস তো কেও তাদের মধ্যেই যারা মেহেদী দিতে পারে তাদের হাতে মেহেদী পড়ে নিচ্ছে, সোহানা হিয়াকে বলে,,
– আয় তাহলে তোকে আগে দিয়ে নেই, পড়ে আমি তুই পারলে তোর হাতে নয়তো কোনো আর্টিস্টের হাতে দিবো নে,,
হিয়া একটু ভেবে বলে,,
– না, তুই আগে আয়,, আমার হাতে তুই পরেও দিতে পারবি আমার আবার মুড হারিয়ে গেলে তোর হাত খালি যাবে,,
হিয়ার এসব অদ্ভুত যুক্তি শুনে সোহানা না করতে চায় তবে হিয়া শুনে না জোর করে সোহানার হাত টেনে নিয়ে রাঙ্গাতে শুরু করে সোহানার হাত,,

#চলবে,,,