প্রণয়ের মহাকাব্য পর্ব-৭+৮+৯

0
23

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(৭)
সামীর ঘরের দরজা ঠেলে পা রাখতেই পুরুষালী পারফিউমের ঘ্রান এসে বিধলো হিয়ার নাকে, বদ্ধ ঘরটার চারি দিকে তাকালো হিয়া , অনেক বার সে এসেছে শিকদার নিবাসে এই ঘরে তবে আগে এমন অনুভব হয়নি, তখন সামী থাকতো দেশের বাহিরে তবে এখন এখানে এই ঘরে তার রাজত্ব ।তার স্পর্শ তার শরীরের ঘ্রাণ তার অস্তিত্ব সব যেনো মিসে আছে ঘরটার চার দিকে, ।চোখ বন্ধ করে জোরে শ্বাস নিলো হিয়া যেনো নিঃশ্বাসেই টেনে নিবে সামীর ব্যক্তিগত শরীরের ঘ্রাণ তার অস্তিত্ব ।
– আমার ভীষন ভয় করছে সোহান, ভাইয়া না জানি কখন চলে আসে , এভাবে কারো পার্সোনাল জিনিস পত্র দেখা কি আমাদের ঠিক হচ্ছে?
– এই তুই যা তো বোন যা, তোর নীতিমালা নিয়ে তুই নিজের ঘরে যা ,আমাদেরকে আমাদের কাজ করতে দে ,
প্রচণ্ড বিরক্তি নিয়ে বলল সোহান, সে আবারও বেস্ত হলো আলমারির কাপড় ড্রয়ের কিছুই বাদ দিচ্ছে না,সোহানের হাবভাব এমন আজকে সামীর ঘর পুড়ো চিরোনি তল্লাসী চালাবে,সোহানার কথায় হিয়ার ঘোর ভাঙ্গে মনে প্রভাব ফেলে, ধীর শান্ত কন্ঠে সোহান কে উদ্দেশ্য করে বলে,,
– আমার ও মনে হয় আমাদের চলে যাওয়া উচিত, এইভাবে কারো অনুমতি ব্যতিত কারো ঘরে আমারদের আশা উচিত হয়নি আমারই ভুল হয়েছে , চল ফিরে যাই !
– তুই ও কি সোহার মতো পাগল হলি হিয়া ?
হিয়া শান্ত চোখে তাকালো , সোহান বিরক্ত হয়ে বলল,,
– যা মন চায় কর, পড়ে যেনো কেদে কেটে ভাসাতে না দেখি,আমার ভালো বুদ্ধি তো তোদের ভালো লাগে না !দেখি সর তো আমার সামনে থেকে হুদাই আমার মূল্যবান সময় গুলো নষ্ট হলো এখন এইগুলা সব আমাকে গোছাতে হবে সর তো বইন ,,,
সামীর এলোমেলো হয়ে থাকা আলমারি গোছাতে গোছাতে হুট করেই একদম হুট করেই জামা কাপড়ের ভেতর থেকে বেরিয়ে এলো একটা ডাইরি বেশ সুন্দর দেখতে, সোহান ডায়রিটা হাতে নিয়ে দেখে উল্টে পাল্টে ডার্ক ব্লু রঙের একটা ডাইরি, সোহান কৌতূহলী হলো, অধরে ফুটে উঠল বিজয়ের হাসি,, ততক্ষণে হিয়া সোহানার সাথে সামীর রুম পরিত্যাগ করেছে , সোহান ডায়রিটা বেডের উপর রেখে দ্রুত সামীর রুম আগের মতো গুছিয়ে ডাইরি হাতে ছুটে সোহানার রুমের দিকে।
————–
– শুনলাম হিয়া নাকি তোমাদের বাসায়? আমাকে লুকিয়ে আমার মেয়ের মাথায় কুবুদ্ধি দিচ্ছ না তো?
– আপনার কেনো মনে হচ্ছে আমি আপনার মেয়েকেকুবুদ্ধি দিচ্ছি?
সামীর ঠান্ডা কন্ঠস্বর, মীর সাহেব সামীর বরাবর চেয়ার টেনে বসলো গম্ভীর কণ্ঠে বলল,,
– কারণ হিয়ার কিছু পরিবর্তন চোখে লাগছে, আগের মত চঞ্চল নেই কি জানো ভাবে, আবার মুচকি মুচকি হাসে, তুমিকি ভাবো আমি বুঝি না?সামীহ বারবার করে বলছি হিয়ার সামনে বোর্ড এক্সাম ওর এখন পড়াশোনায় মন থাকা জরুরি। তাই তুমি এখন ওর থেকে দূরে দূরে থাকবে বলে দিলাম।
এক প্রকার সামীকে শাসিয়েই মীর সাহেব চলে গেলেন সামীর কেবিন থেকে,, তবে সামীর তার কথায় কিছু এলোগেলো না, আর না আজ কোনো তর্কে গেলো তার মাথায় একটাই চিন্তা মীর সাহেবের একটাই কথা ঘুর পাক খাচ্ছে আর তা হলো ,,
“হিয়ার কিছু পরিবর্তন চোখে লাগছে, আগের মত চঞ্চল নেই কি জানো ভাবে, আবার মুচকি মুচকি হাসে”
কার কথা ভাবে হিয়া? হিয়া ভীষন আবেগী তার বয়সই তো আবেগের এখন সে উড়বে, প্রেম ভালোবাসা বিয়ে এইসব এখন তার মাথায় একবার চেপে বসলে পড়াশোনা সে লাটে উঠাবে, এমনি সে পড়া ফাকিবাজ তাই হিয়ার সামনে বোর্ড এক্সামের কোথা ভেবেই তো সামী নিজেকে দমিয়ে রেখেছে,, কাজে মন দিয়েছে ,, না হলে তো কবেই নিজের মনের মাঝের লুকানো ভালোবাসা এতো বছরের অনুভূতি মেলে ধরত তার মনের রানীর কাছে! হুট করেই সামীর চোখে ভেসে উঠলো, হিয়ার নীরবকে হাসি মুখে ফুচকা খাইয়ে দেয়ার দৃশ্য! ধড়ফড় করে উঠলো সামী ,, না না হিয়ার মনে সে ছাড়া আর কারো অস্তিত্ব থাকতে পারে না, হিয়ার হয়েছে কি? তাকে জানতে হবে, এই ব্যাপারে তাকে সোহান সোহানা সাহায্য করতে পারে। সামী আর এক মিনিটও দেরী করলো না, তড়িঘড়ি করে উঠে বেরিয়ে গেলো শিকদার নিবাসের উদ্দেশে!
•••••••••••••••
” প্রিয় প্রণয়িনী,, আমার অব্যক্ত ভালোবাসা বুকের মাঝে অব্যক্ত রেখেই তোমাকে ছেড়ে যাচ্ছি, তবে আমি ফিরবো, অবশ্যই ফিরবো আমার প্রনয়ের পরিণতি দিতে, তোমাকে নিজের করে নিতে আমি অবশ্যই ফিরবো। তুমি তৈরী থেকো কিন্তু!

“ভালোবাসা এক মরণ ব্যাধির নাম ভয়ঙ্কর তম সুন্দর এক অনুভূতি জড়িত ব্যাধির নাম,, যা কেও একবার অনুভব করে সে শেষ হয়ে যায় ভয়ঙ্কর ভাবে ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যায়” ( সামীহ শিকদার)

কবে বড় হবি তুই? কবে,,
নাহ আর পড়তে পারলো না হিয়া এক, দুই, তিন পরপর তিনটি পাতা উল্টো হিয়া কিন্তু আর পড়তে পারলো না তার হাত কাপে , চোখে জমে নোনা জল চোখ ঘোলা হয়ে আসে,মনে যেনো ঝড় উঠেছে তার মন,মস্তিষ্ক,শরীর অসার হয়ে আসে ,,শুকনো এক ঢোক গিলে নাহ সব শুকিয়ে আসছে, কি ছিলো সেই দুই লাইনের কথা গুলিতে এতো ভালোবাসা এই গম্ভীর লোক একজনের জন্য জমিয়ে রেখেছে? হিয়া দুপ করে ফ্লোরে বসে পড়ে। সোহানাদৌড়ে আসে হিয়া ধরে জিজ্ঞেস করে
– কি লিখা আছে এতে হিয়া তুই এমন করছিস কেন? কিরে কথা বল,
ডায়রিটা সোহান খুঁজে পেলেও সে খুলে পড়ে নি সোজা এনে হিয়ার হাতে দিয়েছিল, ছোটো ভাই বোন হয়ে বড় ভাইয়ের ব্যক্তিগত লিখা পড়বে এতে বেশ আপত্তি ছিলো সোহানার সাথে সোহানকে ও পড়তে দেইনি। হিয়ার হাতে ডায়রিটা তুলে দিয়ে দু জন একটু সরে দাড়িয়ে ছিল।সোহান এগিয়ে আসে চিন্তিত কন্ঠে জিগ্গেস করে
– ভাইয়া কাউকে পছন্দ করে তাই না?
হিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানালো কিন্তু কিছু বললো না। পাথর হয়ে বসে রইলো। সোহানা কি বলবে কি করবে বুঝতে পারলো না ,, ঠিক তখনই সোহানার রুমে হাসি মুখে প্রবেশ করলেন শাহানা শিকদার, হাতে তার নাস্তার ট্রে,,তাকে দেখে ওরা তড়িঘড়ি উঠে দাড়ালো, সোহানা হিয়াকে ধরে আছে। হিয়ার চোখ মুখের অবস্থা দেখে তিনি চিৎকার করে উঠলেন দ্রুত ট্রে টা রেখে হিয়ার সামনে এসে ওকে ধরে বলেন,,

– হিয়া কি হলো তোর? মুখ চোখের এই অবস্থা কেনো? কিরে খারাপ লাগছে? এই সোহানা কি হয়েছে ওর? আল্লাহ!
হিয়ার বুকের বা পাশে মোচড় দিয়ে ওঠে, সে দিন সামিও ঠিক এভাবেই তাকে বলেছিল, হিয়ার কাছে কেমন কেমন লাগে সে মৃদু হেসে বলে
– কিছু হয়নি মামুনি, এমনি শরীরটা খারাপ লাগছে আমি বাড়ি ফিরে রেস্ট করলেই ঠিক হয়ে যাবো, তুমি একটু বেশীই হাইপার হয়ে যাও চিন্তা কোরো না, আমি ঠিক আছি সোহান আয় তো আমাকে একটু দিয়ে আসবি।
সোহান আর সোহানা অসহায় চোখে দুজনের দিকে তাকালো,মিসেস শাহানা তড়িঘড়ি করে হিয়ার মাথায় হাত রেখে জ্বর মাপে, নাহ জ্বর নেই, কোমল কন্ঠে সুধালেন,,
– কেমন লাগছে? বল মামুনিকে, দারা আমি সামীকে ডেকে আনি, ও বাড়িতেই আছে,বেশি খারাপ রাখলে একটু চেকাপ করিয়ে আনবে তুই বস,
তিনি দ্রুত পায়ে বেরিয়ে গেলেন। সোহান সোহানা চমকে একে অপরের দিকে তাকালো, সামী বাড়ী ফিরেছে, সোহান দ্রুত ডায়রিটা লুকালো, হিয়া সোহানার হাত ধরে করুন মূখে বলল,,
– উনাকে আমার সামনে আনিস না সোহা, সোহান আমাকে দিয়ে আয় আমার সহ্য হবে না
এই পর্যায়ে হিয়ার চোখে পানি চলে এলো, তখনই সামী হন্তদন্ত হয়ে রুমের ভিতর ঢুকলো , তার শরীর ভেজা গায়ের টিশার্ট ও উল্টো পড়ে আছে, শাহানার মুখে হিয়ার শরীর খারাপ শুনে দৌড়ে এসেছে, এতো কিছু খেয়াল সে করেনি এসেই সোজা হিয়ার! কাছে গিয়ে ওকে ধরে বলতে লাগলো,,
– কি হয়েছে তোর ? কোথায় কষ্ট লাগছে? কেমন লাগছে বল! কিরে?
হিয়া হাত ছাড়িয়ে নিলো বলল
– কিছু হয়নি ভাইয়া, আমি ঠিক আছি, সোহান আয় আমাকে একটু বাড়ীতে দিয়ে আসবি
সামী অবাক হতবাক হিয়ার আচরণে হিয়ার সম্বোধনে, মূহুর্তেই চোয়াল শক্ত হয়ে গেলো হিয়ার হাত আবারও ধরে বলল,,
– এমন করছিস কেনো কি হয়েছে? আচ্ছা আয় আমিই তোকে দিয়ে আসছি দাড়া গাড়ির চাবি টা নিয়েই আসছি
– তার কোনো প্রয়োজন নেই ভাইয়া ,আমি সোহানের সাথে যাবো ।
হিয়ার ভঙ্গুর কন্ঠস্বর, এইবার সামীর মেজাজ গরম হয়ে গেলো, শান্ত গলায় সোহান কে বলল ,,
– তোকে যেনো আশেপাশে ও না দেখি , তোরা দুজন সর এখান থেকে
সোহান সোহানা বের হতেই সামী ঝড়ের গতিতে এগিয়ে এসে হিয়ার কাঁধে দু হাতে চেপে ধরে বলে,,
– কি সমস্যা তোর, তখন থেকে ভাইয়া ভাইয়া করছিস কেন? নিষেধ করেছিলাম মনে নেই? এতো দিনতো ঠিকই ছিল, অজকে হটাৎ কি হলো বল!
– কিচ্ছু হয় নি ছাড়ুন আমার লাগছে
– লাগুক আগে বল এমন করছিস কেনো?
– কেমন করছি, সরুন আমি বাড়ী যাবো
– আমি বললাম তো দিয়ে আসবো, তার আগে বল এমন করছিস কেনো?
হিয়ার সহ্যের সীমা অতিক্রম করে সে হুট করেই সামিকে জড়িয়ে ধরে, ফুঁফিয়ে কেঁদে ওঠে।সামীর শরীর অবশ হয়ে যায়, সে যেনো স্তব্ধ, সামী কিছু বলবে তাঁর আগেই হিয়া মুখ তুলে তাকায়, ঝড়ের গতিতে পেছন ফিরে ছুট লাগায়,, সামীর হুস ফিরে সে হিয়ার পিছন পিছন ছুটে বলে,,
– হিয়া দাড়া, কথা শুনে যা,,
হিয়া দাঁড়ায় না এক ছুটে রাতের আধারে বেরিয়ে যায় শিকদার নিবাস ছেড়ে।
#চলবে,,

#প্রণয়ের_ মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(৮)
– তুই যা বলছিস ভেবে বলছিস তো সামী? এইটা কি ঠিক হবে? বলছিলাম যে খুব বেশি তাড়াহুড়ো করে ভুল সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলছি না তো?
ফোনের ওপাশ নীরব শান্ত তামিম অধৈর্য হয়ে পড়ে , বলে – কি হলো অমন চুপ করে গেলি কেনো?
– তুই কালকে সকালেই সোহান আর সোহানাকে নিয়ে বেরিয়ে পড়বি তামিম। সিদ্ধান্ত আমি নিয়ে ফেলেছি, এই বার আর আমি কারো বাঁধা নিষেধ মানবো না, তোর কথাও না এন্ড আই মিন ইট ,
বলেই খট করে ফোনটা কেটে দিলো সামীহ , তামিম দীর্ঘশ্বাস ফেলে সব কেমন যেমন গুলিয়ে যাচ্ছে কি থেকে যে কি হয়ে গেলো!
—————-
ঘড়ির কাঁটা জানান দিচ্ছে এখন বাজে সকাল সাত টা, শীত কাল হওয়ায় বাহিরটা দেখে বোঝার উপায় নেই যে এখন সকাল সাত টা বাজে, শহরেই বোঝা যায় না আর এইটা তো গ্রাম, শরীরে পাতলা একটা চাদর জড়িয়ে চুপি চুপি দোতোলা থেকে নেমে সদর পেরিয়ে বেরিয়ে এলো হিয়া, শীত কাল হওয়ায় নামাজ শেষে যে যার রুমে আবারো শুয়ে পড়েছে, বা বসে আছে। বাহিরে আসতেই ঠাণ্ডা বাতাস হিয়ার গাঁ ছুঁয়ে কাপন ধরিয়ে দিলো, হিয়া গাঁয়ের চাদর টা ভালো করে চেপে ধরলো , জুতো জোড়া হাতে নিয়ে শিশির ভেজা নরম কচি ঘাসের উপর দিয়ে পা বাড়ালো বাড়ীর পেছনের পুকুর পাড়ের দিকে,,
– এতো সকালে ঐদিক কোথায় যাচ্ছিস হিয়া?
হুট করেই কারো কোথায় থেমে গেলো হিয়া, পেছন ফিরে দেখে তুহিন কে, ছেলেটা তার ছোটো কাকা তৌফিক মীরের বড়ো ছেলে তামিম থেকে এক বছরের ছোটো। তুহিন এগিয়ে আসে হিয়ার কাছে উত্তর না পেয়ে আবারো শুধায়,,
– কিরে কোথায় যাচ্ছিস?
– পুকুর পাড়ের দিক যাচ্ছিলাম ভাইয়া,
হিয়ার শান্ত কন্ঠস্বর, তুহিন চিন্তিত হয়, আরেকটু এগিয়ে হিয়ার কপালে হাত দিতে দিতে বলে,,
– তোর কি আবারো জ্বর এসেছে? আয় তো দেখি, তুই এমন হুট করে শান্ত হয়ে গেলি কেনো ? শরীরে খারাপ লাগছে?
– না তেমন কিছু না ভাইয়া, গ্রামে এসেছি একটু নির্জনে শীতের সকাল উপভোগ করার জন্য বেরিয়ে এলাম ঐ আর্কি,
হিয়া পেছন দিকে এক পা সরে দাড়ায়, হিয়ার পিছিয়ে যাওয়া দেখে তুহিন বাড়িয়ে দেওয়া হাত গুটিয়ে নেয়, বলে,,
– চল তাহলে একটু বাহিরে থেকে হেঁটে আসি, খুব সুন্দর লাগে জানিস,
হিয়া আপত্তি করে না, আবার মুখ ফুটেও বলে না, সোজা এগিয়ে যায় মীর ম্যানসনের মূল ফটকের দিকে, তুহিন হেসে হিয়ার পেছনে যেতে যেতে বলে,,,
– তুই হুট করে এতো শান্ত হয়ে গেলি কিভাবে হিয়া? তুই তো এমন না, তিনদিন ধরে এসেছিস , ঘর কুনো হয়ে পড়ে রইলি আজ বের হলি তো একদম চুপচাপ কি হয়েছে বল না?
হিয়া বিরক্ত হলো ভীষন বিরক্ত হলো আজ প্রায় সপ্তাহখানেক ধরে সবাই এই এক প্রশ্ন করে করে তার মাথা খেয়ে ফেলছে। আচ্ছা সে কি সত্যিই বদলে গেছে? প্রশ্নইটা করতেই ভেতর থেকে কে যেনো চেঁচিয়ে উঠল,,
– হ্যায় হিয়া তুই পাল্টে গেছিস খুব করে পাল্টে গেছিস,, এখন তুই যে হিয়া আছিস সে একজন ভঙ্গুর হিয়া যার হৃদয় তার অজান্তেই দখল করেছিলো শিকদার সাহেব, আবার তার অজান্তেই ছিন্নবিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে শিকদার সাহেব। হিয়ার মন বলে উঠে,,
– আপনি ঠকই বলেছেন শিকদার সাহেব,,
“ভালোবাসা এক মরণ ব্যাধির নাম ভয়ঙ্কর তম সুন্দর এক অনুভূতি জড়িত ব্যাধির নাম,, যা কেও একবার অনুভব করে সে শেষ হয়ে যায় ভয়ঙ্কর ভাবে ছিন্ন বিছিন্ন হয়ে যায় ” তবে আমার বেলায় সুন্দর অনুভূতি হওয়ার আগেই কেনো শেষ হয়ে গেলো? কেনো আমার অনুভুতি পরিপক্ক হওয়ার আগেই হারিয়ে গেলো? কেনো আমি বুঝে উঠার আগেই আপনি এলেন এবার চলেও গেলেন, হিয়া আর ভাবতে পারে না, তুহিন ডেকে উঠে,, হিয়া তুহিনকে কিছু না বলেই উল্টো ঘুরে বাড়ির ভেতরের দিকে দৌড় দেয়,, তুহিন পিছু ডাকতে গিয়েও ডাকে না,,
হিয়া এক ছুটে নিজের ঘরে এসে থামে,, মনটা যন্ত্রণায় বিষাদে ছড়িয়ে গেছে,মনের যন্ত্রনা যেনো ধীরে ধীরে মাথায়ও প্রবেশ করছে। হিয়া মাথার চুল খামচে ধরে মেঝেতে বসে পড়ে, এক পাক্ষিক ভালোবাসো এতো যন্ত্রনা হয়? এতো? এটা সে কেমন ভালোবেসে ফেললো? কেনো নিষিদ্ধ জিনিসে এতো টান এতো প্রেম এলো? এই বেলাজ বেহায়া মনটা কেনো মানতে চায় না শিকদার সাহেব তার হবে না? সে কেনো বুঝে না নিষিদ্ধ জিনিসের প্রতি এই টানের বিনিময়ে মিলবে শুধু, মন ভাঙার যন্ত্রনা, হাহাকার, কষ্ট মরিচীকা!
————-
সকাল আটটা বাজতেই মীর ম্যানসনের বাহিরের রান্না ঘরে রান্নার ধুম পড়েছে, রান্না ঘরে বেস্ত মীর বাড়ির দুই পুত্রবধূ, আঞ্জুমান মীর আয়েশা ও তার ছোটো ঝা মীর রাহেলা খাতুন, সাথে আছেন দুই ভাইয়ের বউকে সাহায্য করতে মীর বাড়ির একমাত্র মেয়ে হিয়ার ফুপ্পি তাহমিনা মীর। যদিও মীর বাড়ীতে সব রকম সুযোগ সুবিধা আছে তাও আয়েশা মীর বাহিরে মাটির উনুনে রান্না চড়িয়েছেন। ঢাকা থেকে গ্রামে আসলে হিয়ার প্রথম আবদার থাকে তার মায়ের কাছে মাটির চুলায় রান্না করার। তার মতে মাটির চুলায় রান্না করা খাবারের স্বাদই আলাদা যার কোনো তুলনা হয় না। আয়েশা মীর বেস্ত টাটকা খেজুরের রস দিয়ে পায়েশ রান্নায়,তাহমিনা মীর আয়েশা মীরকে কাজের ফাঁকে বলে,,,
– হিয়ার কি হয়েছে বড় ভাবী? এসেছে পড় থেকে দেখছি চুপচাপ মন মরা হয়ে ঘরে পড়ে আছে, ওতো ওমন চুপচাপ থাকার মেয়ে না, ওতো একাই বাড়ী মাতিয়ে রাখার মতো মেয়ে সেখানে আজকে বাড়ীতে বিয়ের কথা চলবে আর ও ওমন চুপচাপ?
– জানি না তাহমীনা, হুট করে কি হয়ে গেলো মেয়েটার আমি জানি না। জিজ্ঞেস করলে ও কিছু বলে না,
দীর্ঘ শ্বাস ফেলে বললেন আয়েশা মীর।
তাদের কথার মাঝে রান্না ঘরের দরজার কাছ থেকেই সর গেলো একটি ছায়া,হিয়া আবারও ঘরে চলে যায়। বারান্দায় এসে দাঁড়ায় মীর ম্যানসনের দোতোলার দক্ষিণের রুমগুলো দুই নম্বর রুমটা হিয়ার, বারান্দায় দাড়াতেই দক্ষিণা ঠাণ্ডা বাতাস তাকে ছুঁয়ে দিলো, হিয়ার চোখের দৃষ্টি ঘোলা হয় যায়, পলক ফেলতেই এক ফোঁটা চোখের জল গড়িয়ে পড়ে গাল বেয়ে, হিয়া চোখ বুজে নেয়, তার চোখে ভেসে উঠে সপ্তাহ খানেক আগের সেই রাতের কথা। সামীর মনে অন্য কেউ আছে কিনা তা জানার জন্য শিকদার নিবাসে যাওয়া, একটা ডাইরি, শিকদার সাহেবের মনেররাণী,হিয়ার পাগলামি, আর শিকদার সাহেবের বুকে মুখ গুজে কান্না। তারপর?
তারপর হিয়া পালিয়ে যায় ছুটে বেড়িয়ে যায় শিকদার নিবাস ছেড়ে সামী ও ছুটে আসে পিছু পিছু কিন্তু হিয়া থামে না, শীত কাল হওয়ায় সাত টার পরপরই সামীদের বাড়ির আশপাশ নীরব হয়ে যায়, সেখানে হিয়া প্রায় সাড়ে আটটার দিকে একাই উদ্ভ্রান্তের মতো ছুটে বেরিয়ে যায়, এদিকে গাড়ির চলাচল নেই, আর কিছুটা গেলে মেইন রোড হিয়া এগিয়ে যায় কিন্তু বিপত্তি ঘটে রাস্তার মোড়ে এলাকার ছেলে পেলেরা ল্যাম্পপোস্টের নিচে বসে নিকোটিনের ধোঁয়া উড়াচ্ছে আর আড্ডা দিচ্ছে, হিয়া ওদের সামনে দিয়ে রাস্তা ক্রস করতে যাবে অমনি একটা ছেলে বেড কমেন্ট করে বসে হিয়াকে। হিয়া চোখের জল মুছে আগুন চোখ তুলে তাকায়,হিয়া কিছু বলতে যাবে তাঁর আগেই সামী ঝড়ের গতিতে এগিয়ে এসে সেই ছেলেটাকে কলার ধরে বাম গাল বরাবর মারে এক সপাং চর, একটা দুটো পরপরই একের পর এক, বাকি ছেলেরা এগোয় না শিকদার বাড়ির বড়ছেলে কে চিনে সবাই,এতো ক্ষণ হিয়া পেছন ফিরে তাকায় নি তাকালে হয়তো দেখতে পেতো, সামী ওর পেছনেই ছিলো, সামী কে দেখে হিয়া চমকায়,, হুস ফিরতেই এগিয়ে যায় সামী কে থামাতে বলে,,
– কি করছেন কি? থামুন ছেড়ে দিন মেরে ফেলবেন নাকি?
সামী ছারে না, হিয়া না পেরে সামীর হাত ধরে টেনে বলে,,,
– অনেক হয়েছে ভাইয়া, এইবার থামুন ছেড়ে দিন প্লিজ!
এবার সামীর মাথায় আগুন ধরে যায় ছেলেটিকে ছেড়ে দেয় ছাড়া পেতেই ছেলেগুলো পালায় এরই মাঝে সামী রাগে হিতাহিত জ্ঞান হারিয়ে সোজা এক দাবাং চর বসায় হিয়ার ডান গালে, হিয়ার দুনিয়া যেনো দুলে ওঠে। বিদ্ধস্ত মন, ক্লান্ত শরীরে এতো বড় চর পড়তেই হিয়া টলে পরে যেতে নেয় অমনি সামী খপ করে ধরে দাঁতে দাঁত চেপে বলে,,,
– কি সমসসা? কি? ডাকছিলাম শুনতে পাসনি? কোন সাহসেএতো রাতে একা একা বেরিয়ে এলি ? বল চুপ করে আসিস কেনো এই মেয়ে , আমার কিন্তু সহ্যের সীমা অতিক্রম করে ফেলছিস হিয়া,
হিয়া আর কিছু বলতে পারে না জ্ঞান হারিয়ে লুটিয়ে পড়ে সামীর বুকের উপর
সামী দ্রুত দু হাতে হিয়াকে ধরে ফেলে, চোখ বন্ধ করতে করতে হিয়ার কানে খুব ধীরে ধীরে বাজে সামীর আতঙ্কিত কন্ঠস্বর
– হিয়া এই হিয়া কি হলো তোর, এই মেয়ে চোখ খোল , খোল চোখ এইইই ,,,
*******
হিয়া যখন চোখ খুলে তখন সে নিজেকে নিজের রুমে আবিষ্কার করে, মাথা ভার হয়ে আছে তার, চোখ দুটো বন্ধ হয়ে আসতে চায়,হিয়া নিজের শরীরের তাপ অনুভব করে বোধ করে জ্বর এসেছে তার, খুব কষ্টে মাথা ঘুরিয়ে তাকাতেই দেখে সব সময়ের পরিপাটি হয়ে থাকা সামী বিদ্ধস্ত অবস্থায় বসে তার রুমে থাকা সোফায়। এক দৃষ্টিতে তার দীকেই তাকিয়ে,হিয়া কে চোখ মেলতে দেখেই সামী তড়িঘড়ি করে সোফা থেকে উঠে এসে পাশে বসে,, মাথায় হাত দিয়ে দেখে জ্বরের পরিমাপ হিয়া এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে প্রিয় পুরুষের দিকে হুট করেই তার মনে পড়ে এই লোক তার প্রিয় হলেও, সে তার প্রিয়তমা নয়, আর না হওয়ার সৌভাগ্য তার আছে! হিয়া তাঁর দৃষ্টি ঘুরিয়ে নেয়, তখনই সামী তার ডান গালে আদুরে ভাবে হাত দিয়ে কোমল কন্ঠে বলে,,
– খুব জোড়ে লেগেছে এইখানে তাই না? আমি সরি,আমি সত্যিই এতো জোরে মারতে চাইনি, মাথায় রাগ উঠে গেলে নিজের হুসে থাকি না, কি করবো বল !
হিয়া উত্তর দেয় না মুখ ঘুরিয়ে নেয়, মনে মনে বলে,,
– কেনো এভাবে কাছে এসে আমাকে আরো ও এলোমেলো করে দিচ্ছেন শিকদার সাহেব? কেনো ?
হিয়ার ধ্যান ভাঙ্গে সামীর করুন কন্ঠস্বরে,,
– কিরে মুখ ঘুড়িয়ে নিলি যে, আমি,,
শেষ করতে পারে না সামী রুমে প্রবেশ করে আয়েশা মীর সাথে তামিন তাদের দেখে সামী হিয়ার গাল ছেড়ে দ্রুত উঠে দাড়ায়, সে দাড়াতেই আয়েশা মীর এসে বসে সামীর জায়গায় মেয়ের মাথায় হাত বুলিয়ে বলেন,,
– তুই ঠিক আছিস? বেশি খারাপ লাগছে? তোর বাবাকে ডাকবো?
হিয়া মাথা নাড়িয়ে না বলে, মুখ ফুটে শুধু বলে ,,
– আকটু রেষ্ট নিতে চাচ্ছি আম্মু, একা থাকতে চাই, একা মানে একা !
হিয়ার কথা শুনে সামীহ সোজা গটগট পায়ে রুম ছেড়ে বেরিয়ে যায় , তারপর কেটে যায় তিন দিন এর মাঝে সামী অনেক বার তাকে ফোন করে, দেখতে আসে হিয়া ফোন ধরে না, সামী বাসায় আসলে তার সামনে ঘর থেকে বেরোয় না, সামী ভাবে হিয়াকে মারায় সে রাগ করে এমন করছে তাই এসএমএস করে হিয়ার কাছে মাফ চায়, কিন্তু হিয়া তো রাগ করে নেই সে তো পালিয়ে বেড়াচ্ছে, তার অনুভূতি থেকে তার শিকদার সাহেবের থেকে, তিন দিন পর হিয়ার জ্বর কমতেই নাটোর থেকে হিয়ার ছোটো কাকা তৌফিক মীর ফোনে জানান তার বড় মেয়ে তাইয়্যেবা মীরের যে ছেলের সাথে বিয়ে ঠিক হয়ে আছে তারা এই শীতেই বিয়ের কাজ সেরে ফেলতে চান, তাই দ্রুতই বিয়ের ডেট ফিক্সড করতে মীর বাড়ীতে আসতে চাচ্ছেন,যেহেতু হিয়ার দাদাভাই, দাদু মণি বেঁচে নেই তাই তৌফিক মীর বড় ভাই , ছোটো বোন ছাড়া এগোবেন না। তাই তাসাউফ মীর কে দ্রুতই নাটোরের মীর ম্যানসনে তার পরিবার সহ যেতে বলেছেন তৌফিক, গ্রামে যাবার নাম শুনে হিয়া হুট করেই সিদ্ধান্ত নেয় শহর ছেড়ে গ্রামে যাওয়ার , যেহেতু হিয়ার মন মেজাজ শরীর ভালো নেই তাই মেয়ের কথা ভেবে তার জেদের কাছে হার মেনে আয়েশা মীর স্বামী ছেলেকে রেখে আগে আগেই হিয়া কে নিয়ে নাটোরে চলে আসেন । এখানে এসেও হিয়ার
মন মানে না, ফোন বন্ধ করে রাখায় বন্ধু মহলের সাথেযোগাযোগ নেই, আর না সে এখানে এসে ভালো আছে, সে তো সারা দিন ঘরের এক কনে বসে থাকে, ঘর বন্দি করে রেখেছে হিয়া নিজেকে, সে সাড়া দিন শুধু নিজের মন কে মানায় কিন্তু বেলাজ হিয়ার মনের মাঝে বার বার একটাই প্রশ্ন, এতো বছরেও শিকদার সাহেব কি সেই মেয়েকে ভলোবাসে?
হিয়ার ভাবনার সুতো ছিঁড়ল গাড়ির হর্নের আওয়াজে, হিয়া ঘাড় ঘুরিয়ে ঘড়ির কাঁটার দিকে তাকায় এখন বেলা বাজে প্রায় এগারো টা, হিয়া ভাবে তাইয়েবার শশুর বাড়ী থেকে লোকজন এসেছে, তাই সে দ্রুত বারান্দা ত্যাগ করে উদ্দেশ্য নিচে যাবে,এরই মাঝে ছোটো কাকি ডেকে গেছেন নাস্তার জন্য হিয়া দরজাও খোলে নি নিচে ও যায়নি, বলছে মাথা ব্যথা করছে, একটু ভালো লাগলে গিয়ে খেয়ে আসবে, তবে এইবার নিচেযাওয়া উচিত শত হোক বড় বোনের বিয়ের ডেট ফিক্সড হচ্ছে বলে কথা!

#চলবে,,

#প্রণয়ের_মহাকাব্য
#সামিয়া_আক্তার
(৯) (বিয়ে স্পেশাল)
“বলো মা কবুল!”
কানে কথাটা যাওয়া মাত্রই হিয়ার সারা শরীর যেনো কাটা দিয়ে উঠল, সে এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলো ড্রাইভিং সিটে বসে থাকা সামীহ শিকদারের দিকে, যে তীক্ষ্ম দৃষ্টিতে তার দিকেই তাকিয়ে আছে, এটা কি সত্যিই নাকি স্বপ্ন? স্বপ্ন হোলে না ভাঙ্গুক হিয়া আজীবন এমন মধুর স্বপ্ন দেখতে চায় । তার কানে আবারও ভেঁজে ওঠে কাজী সাহেবের কন্ঠস্বর,
“তুমি যদি এই বিয়েতে রাজি থাকো তাহলে বলো মা কবুল”
হিয়ার মাথা ঘুরে উঠে সে হেলান দিয়ে পাশে বসে থাকা সোহানার উপর ঢলে পড়ে, তার জ্ঞান হারায়নি তবে এতো কিছুর চাপ তার ছোট্ট মাথায় সইছে না , হিয়াকে ঢলে যেতে দেখে সোহানা মুখ নিচু করে দু হাতে হিয়ার মুখ খানা আগলে ধরে এক হাতে গালে হলকা হলকা থাপ্পর মেরে বলে,,
– হিয়া, হিয়া এই কিরে কি হলো তোর?
– বলছিলাম কি সামী আরেক বার একটু,,,
শেষ করতে পারে না তামিম সামী তেজি কন্ঠে বলে
– এই পর্যন্তই অফ যা, আমি আর কারো কথা শুনতে চাই না, কাজী সাহেব আপনি বিয়ে পরান।
কাজী সাহেব প্রচুর বিরক্ত হলেন, বিরক্ত হয়ে বলে
– কীভাবে পড়াবো বাপ? মেয়ে তো জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে। এমন আশ্চর্য জনক বিয়ে আমি আমার জীবনে দেখি নাই। জোর করে বিয়ে মানা যায় তাই বলে এভাবে? গাড়িতে? ঢাকা থেকে নাটোরের মাঝ পথে মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে বিয়ে? তাও আবার মেয়ে আধা জ্ঞান হারিয়ে পড়ে আছে!
– আপনি কিন্তু বেশি কথা বলেছেন কাজী সাহেব,আপনাকে এইজন্য এতো বেশি টাকা দিয়ে এখানে আনা হয়নি।
সামীর গম্ভীর কন্ঠস্বর , মাথা চুলকে বাম পাশে মাথা ঘুড়িয়ে তামিম কে বলল,,
– তোরা একটু বের হ, আমি হিয়ার সাথে কথা বলে সব ঠিক করে রাখছি, ডাক দিলে এসে বিয়ের কাজ শেষ করবি যা বের হ ফাস্ট ,
তামিম আর কাজী সাহেব নেমে গেলেন দ্রুতই তবে সোহানা নামতে পারলো না, সামী ফ্রন্ট সিট ছেড়ে পেছনে আসে ডোর খুলে সোহানা কে বের হোতে না দেখে ভ্রু কুঁচকে বলল,,
– বের হচ্ছিস না কেন? যা তামিমের গাড়িতে ওয়েট কর,
সোহানা বেচারি করুন মূখে একবার ভাইয়ের তো একবার সখীর দিকে তাকাচ্ছে, সে কীভাবে বের হবে? হিয়া যে তাকে আস্টেপিস্টে ধরে রেখেছে এই কথা সে কীভাবে বলবে? সামীর এবার মেজাজ বিগ্রালো সে ধমকে উঠল,,
– কিরে নামছিস না কেন?
সাথে সাথে হিয়া চোখ খুলে উঠে বসে সোহানার এক হাত শক্ত চেপে ধরে বলে,,
– কোথাও যাবে না ও, আপনার যা বলার ওর সামনেই বলুন।
– বাহ নিজে নিজেই জ্ঞান ফিরেছে দেখছি, যাক ভালোই হলো আমার আর কষ্ট করতে হলো না,
বাঁকা হেসে বলল সামী। সোহানার দিকে চেয়ে বলল,,
– তোকে ঐ গাড়িতে যেতে বলিছি সুনিস নি যা বের হ!
হিয়া আরও চেপে ধরে সোহানার হাত, সামী ঘুরে গিয়ে সোহানার হাত ছাড়িয়ে বের করে বলে,,
– ঐ গাড়ি তে একটু অপেক্ষা কর,,
সোহানা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে পেছনে তামিমের গাড়িতে গিয়ে বসে, সোহানকে দেখে সোহান বলে,,
– কিরে হিয়ার জ্ঞান ফিরেছে? তুই চলে এলি যে,
হিয়া মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বলল
– ভাইয়া হিয়ার সাথে একা কথা বলতে চায় তাই,
এখানে পাঠিয়ে দিলো,
কথাটা বলতে সোহানা একটু লজ্জা পেলো কারণ তামিম তার দিকে তাকিয়ে ছিল তাই, বড় ভাইয়ের সামনে বোনের এইসব কথা বলতে সোহানা একটু লজ্জাই পেলো,
*********
সামীর গাড়িতে পিনপতন নিরবতা একটু পর পর শুধু মহাসড়কে ছুটে যাওয়া সা সা গাড়ির শব্দ আর হর্নের শব্দ ছাড়া আর কোনো শব্দ শোনা যাচ্ছে না। হিয়ার অসস্তি হচ্ছে সামী কেমন করে যেনো তাঁকিয়ে আছে তার দিকে, হিয়ার অসস্তি আরও বাড়িয়ে দিয়ে সামী হিয়ার দিক চেপে বসে হিয়া সোজা হয়ে বসে পড়ে তার শিরদাঁড়া বেয়ে এই শীতেও যেনো এক ফোঁটা ঘাম বেয়ে গড়িয়ে পরলো ,, হিয়া গাড়ীর সাইটে আরেকটু চেপে বসে, সামীও ঠোঁট কামড়ে হেসে আরেকটু চেপে বসে এইবার আর চেপে বসার জায়গা নেই, হিয়া অস্থির লাগে এলোমেলো দৃষ্টি ফেলে বলে,,,
– কি করছেন কি? এভাবে আমার সাথে চেপে বসছেন কেনো, একটু ধুরে বসুন প্লিজ
সামী সরে না উল্টো আরেকটু কাছে এগিয়ে চেপে বসে এইবার তাঁদের মধ্যে এক ইঞ্চিও দূরত্ব নেই, হিয়া তাকায় সামীর দিকে কিছু বলার জন্য মুখ খুলবে অমনি সামী তার ঠোঁটে এক আঙুল চেপে ধরে, নেসাময় তার চোখের দৃষ্টি হাস্কি কন্ঠস্বরে বলে,,
– আমায় ভালবাসিস ফুল??
হিয়া কথা বলে না, চোখ নামিয়ে নেয়
সামী দু আঙুলের সাহায্যে হিয়ার থুতনিতে স্পর্শ করে হিয়ার মুখ তুলে আবারও জিজ্ঞেস করে,,
– ভালবাসিস আমায়?
হিয়া লুকায় না আবার মুখ ও খুলে না শুধু চোখ বুজে মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানায়। সাথে সাথে সামী তাকে নিজের বুকে টেনে এনে চেপে ধরে, সে কি জোড় সেই জরিয়ে ধরায় হিয়ার মনে হলো সে বুঝি সামীর ভেতরেই ডুকে যাবে ,, তবুও হিয়া চুপ করে বসে পড়ে রইলো প্রিয় পুরুষের বুকে, হা করে ভুস ভুস করে সুকে নিলো সামীর শরীরের ব্যক্তিগত ঘ্রাণ। সামী হিয়াকে আরেকটু চেপে ধরে বলে,,
– কবে থেকে তুই আমাকে এতো ভালবাসিস হিয়া, আমার চোখে কেনো এতদিন পড়লো না? আমি কেনো বুঝলাম না?
– আপনি তো আপনার প্রণয়িনীতে মজে শিকদার সাহেব, আমার ভালোবাসা দেখার সময় কই আপনার?
হিয়ার মৃদু কন্ঠস্বর, সামী হাসে হিয়াকে ছেড়ে দু আঙুলের সাহায্যে হিয়ার মুখ আবারও তুলে দেখে হিয়ার চোখে জল সামীর ঠোঁটের হাসি চওড়া হয়,, হিয়াকে অভাবেই ধরে রেখে বলে,,
– নিজের প্রতি নিজেই এতো জেলাস? অন্য কাউকে ভালবাসলে তো খুন করে দিবি রে হিয়া!
হিয়া বুঝে না সামীর কথা , সামী বুঝে হিয়া বুঝেনি তার কথা সে হেসে ওঠে আজ যেনো তার মুখ থেকে হাসিই সরছে না এটা এই মেয়ে কি করে দিলো তার সাথে? সামী আবারও ঠোঁট কামড়ে হাসে, হিয়ার থুতনি টা দু আঙুলের সাহায্যে ধরে নিজের মুখ এগিয়ে নেয়, হিয়া সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে ফেলে, সামীর ঠোঁট গিয়ে ঠেকে হিয়ার কানের কাছে সামী ঠোঁট নাড়িয়ে ফিসফিস করে বলে,,,
– মাথা ভর্তি কি শুধু চুল আর গোবর আছে গাঁধী? এই সাধারণ কথাটাও বুঝিস না? তাই তো বলি কবে বড় হবি তুই? কবে বুঝবি আমায়? কবে বুঝবি আমার অনুভূতি?
সামী একটু থামে , থেমে আবার বলে,
– কংগ্রাচুলেশন,, আই লাভ ইউ!
বলেই হিয়ার কানের লতিতে ছোট্ট একটা চুমু খায় সামী। হিয়ার শরীর কেঁপে উঠে হৃদযন্ত্রের চলাচল হয় অস্বাভাবিক, হিয়া চোখ বড় বড় করে তাকায় সামীর দিকে, সামী হেসে দু হাতে আগলে ধরে হিয়ার মুখ টুকু,, কাছে টেনে কপালে কপাল ঠেকিয়ে বলে,,
– আমার প্রণয়ের প্রয়নিকা তুই, আমার কিশোর বয়সের আবেগ তুই, আমার জীবনের প্রথম ভালোলাগা-ভালবাসা তুই, আর তুই কিনা ভাবলি আমি অন্য মেয়েকে ভালবাসি? আই লাভ ইউ হিয়া আই লাভ ইউ আ লট তুই হীনা আমার বেঁচে থাকা হারাম হোক,, আমার শেষ ঠিকানা তোর মধ্য হোক, যতদিন বেঁচে আছি তোর সাথেই থাকতে চাই, শেষ নিশ্বাস তোর কোলে মাথা রেখে ত্যাগ করতে চাই, তোর আর আমার #প্রণয়ের_মহাকাব্য রচনা করতে চাই, আর সবশেষে তোর মাঝে মরেও বাঁচতে চাই। হবি না আমার বউ? হবি না সামীহ শিকদারের বউ?
হিয়ার কান্নায় গলা ধরে আসে উত্তাল ঢেউয়ের মতো আঁচড়ে পড়ে সামীর বুকের উপর,উত্তর না দিয়ে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে সামী কে। সামী বুঝে হিয়ার অনুভূতি সেও হেসে জরিয়ে ধরে তার মনের রাণী কে, ঠিক তখনই বাহির থেকে গাড়ীর কাচে টোকা মারে সোহান, সাথে সাথে হিয়া সরে বসে সামীর কাছ থেকে, সামী ও ছোটো ভাইয়ের সামনে অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে। তাড়াতাড়ি গাড়ির ডোর খুলে দিতেই সোহান তার বত্রিশ পাটি বের করে হেসে বলে,,,
– আরে রিল্যাক্স ব্রো,, আমি কিছু দেখিনি। যা দেখার তো তামিম ভাই দেখে গেছে, তাই তো আমাকে পাঠালো আসলে আমার লজ্জা একটু কম তো তাই আমিই এলাম, বাই দ্যা ওয়ে,, কাজী শালার ব্যাটা বিরক্ত হচ্ছে,, বাসায় যাওয়ার জন্য চিল্লাফাল্লা করছে তোমাদের হলে কি কাজীরে ডাকবো?
একদমে বলে থামলো সোহান, সামী দাঁতে দাঁত চেপে বলল,,
– তোকে এতো কথা বলতে কে বলেছে ইডিয়েট? ঝাড়ি দিয়ে বলল,,যা সবাই কে ডেকে আন ।
ঝাড়ি খেয়ে ও সোহান বেলাজের মত হেসে চলে গেলো তামিমের গাড়ির কাছে,, তামিম রা সবাই এলো কাজী সাহেব আবারো বিয়ে পড়ানো শুরু করলেন,, সামী কে কবুল বলতে বললে সে মূহুর্তেই কবুল বলে দেয়,,, এইবার কাজী সাহেব হিয়াকে কবুল বলতে বলে,, হিয়া করুন চোখে ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে কিছু বলতে চায়,, তামিম হেসে হিয়ার মাথায় স্নেহের পরশ বুলিয়ে দেয়, বলে,,
– তোর কিছু বলতে হবে না বোন, আমার বন্ধু কম ভাই বলে বলছি না , সামী সত্যিই অনেক ভালো ছেলে তোকে খুব ভালোবাসে, তখন থেকে যখন তুই ভালোবসা কি তার জ্ঞান তোর ছিলো না তোর প্রতি ওর লয়ালিটি ঠিক কত টুকু আমার থেকে ভালো কেউ জানে না তাই তো নিজের একমাত্র ছোট বোন কে ওর হাতে তুলে দিতে আমার কোনো আপত্তি নেই। সুখী হ , নে এবার আর কোনো চিন্তা ছাড়া কবুল টা বলে ফেলত দেখি,,
খুশিতে হিয়ার চোখ জ্বলজ্বল করে উঠে পরক্ষনেই বিচলিত দেখায় হিয়াকে ভাইয়ের হাত চেপে ধরে বলে,,
– বাবা কে না জানিয়ে এভাবে বিয়ে করা কি ঠিক হবে ভাই, পড়ে যদি সমস্যা হয় , আমার ভয় করছে ভাই।
সামী খপ করে হিয়ার এক হাত ধরে বলে,,
– তুই শুধু কবুল বল,, বাকিটা দেখার জন্য আমি আছি, এখন শুধু কবুল বলে আমার হয়ে যা, আমি শোষক হয়ে তোর সব চিন্তা শোষণ করে নেবো,
সোহান গাড়ীর এক ডোরে ঝুলে আছে সে তার বোচা নাক টা সামীর কথার মাঝে গলিয়ে বলে,,,
– আরে হিয়া বেঈব ,, পেয়ার কিয়া তো ডারনা কেয়া,, জলদি করে কবুল বলে আমাদের ভাবী হয়ে যা তো দেখি,, তোরে ভাবী বানানোর জন্য অনেক কষ্ট করতে হইলো রে বান্দুপিইইইইই,,,
কাজী সাহেব বিরক্তি প্রকাশ করলেন,,
– বাপ তোমাদের টাকা তোমাদের মোবারক আমি বাসায় গেলাম,,
সোহান কাজী সাহেব কে ধরে বলে,,
– আরে কাজী সাহেব তো রেগে গেলেন,, দাঁড়ান দাঁড়ান আমার বেইবি এখনই কবুল বলবে ,,বেইবি ঝটপট কবুল বলতো দেখি,,
অবশেষে সকল বাঁধা বিপত্তি ছাড়িয়ে হিয়া মিনমিন করে,, কবুল ববলে। শীতের দুপুরে গাড়িতে, ঢাকা থেকে নাটোরের মাঝ পথে মহাসড়কে গাড়ি থামিয়ে বিয়ের বন্ধনে আবদ্ধ হয়, সামীহ শিকদার ও তার হিয়ারাণী আমায়রা মীর হিয়া।

#চলবে,,,,