#প্রণয়ের_সুর
#পর্ব৬
#মহুয়া_আমরিন_বিন্দু
সকাল সকাল সাব্বিরের রুমে এক প্রকার হা’মলা দিয়েছে জেরিন আর বৃষ্টি। নেহার সাথে দেখা হয়নি সকালে মহারানী নিশ্চিত ঘুমাচ্ছে পরে পরে,তাদের কে একটু বলে ও গেলো না একা একা রাতের বেলা রোমান্টিক ডেটে গিয়েছে মহিলা।আজ একবার সামনে পাক ওর ক্লাস তো পরে নিবে আগে সাব্বিরের সাথে বোঝাপড়া টা করে নিতে হবে।রাতের বেলা দুজনের থেকে টাকা নিয়েছে কিন্তু কাহিনি বলেনি, কি বজ্জা’ত হয়েছে ছেলেটা।
জেরিন দরজায় এলোপাতাড়ি ধাক্কা দিচ্ছে আর বলছে
,,সাব্বিরা আজকে যদি তুই দরজা না খুলিস তো বেশি ভালো হবে বলে দিচ্ছি,তোর গালফ্রেন্ড গোডাউনে আগু’ন লাগাবো আমি।টাকা মে রে খাওয়ার ধান্দা করলে মস্ত বড় ভুল ধারনা হবে তোর,এই জেরিনের টাকা মে’রে কেউ শান্তি পায় নাই বলছি।আর তুই চিরকুমার থাকবি বউ জুটবে না তোর!
বেচারা বৃষ্টি কানে হাত চেপে দাড়িয়ে আছে, জেরিন আপুর গলা না ফাটা বাঁশ মা শুনতে পেলে এখন তিনজনকেই লাগাবে উত্তমমধ্যম। বৃষ্টি কন্ঠে খাদে নামিয়ে বলে
,,আপু আস্তে বলো মা শুনতে পেলে সকাল সকাল কে’লানি খেতে হবে,তার উপর আমি পড়া থেকে উঠে এসেছি।
জেরিন শোনার পাত্রি নয় শেষে হার মানলো সাব্বির দরজার হাতলে ধরে ঘুমু ঘুমু চোখে বের হলো,হাই তুলতে তুলতে বললো
,,বইনে তুই কি বিয়ে করে না যাওয়ার আগ পর্যন্ত আমাকে শান্তি দিবি না।তোর সেমিস্টারে সুম’ন্ত্রার করে
আর একদিন পর পরীক্ষা এনে দিয়ে তোর পড়াশোনা শেষ করতে পারলে শান্তি লাগতো আমার।মাস্টার্স গিয়ে শ্বশুর বাড়ির হাঁড়ি পাতিলের সাথে করতি!
জেরিন ওর কথা কানেই তুললো না যেনো, ঠেলে রুমে ঢুকে পড়লো । বৃষ্টি, জেরিন সাব্বিরের খাটে আয়েশ করে বসলো।
সাব্বির তড়িঘড়ি করে বললো দ্বারা অন্তত ব্রাশ টা করে আসি!
জেরিন নাকোচ করে বললো-, তুই পাঁচ হাত দূরে থেকে কথা বল তাহলেই হবে,গন্ধ টন্ধ আসতে পারবে না!
বৃষ্টি নাক কুঁচকালো,সাব্বির বললো-,তুই এতো অসামাজিক কেন জেরিন বইন!
সাব্বির গতকালকের টয়া আর নেহার কথা বলার সবটুকু বলে দিলো।বৃষ্টি তেতিয়ে উঠলো বিরস মুখে বললো
,,আমার ভাইটা এমন হইলো কবে থেকে নিজের বউরে একজন এসে বলছে রুমে ঢুকেছো কেনো,সে কিছু বলবে না এ কেমন কথা!সত্যি ভাইয়ার এইসব লুকাচুপি
খেলাটা এখন আমার বিরক্ত লাগছে।
,,,,,,,,,,
নেহা ঘুম থেকে উঠে, ছোট খাটো একটা চিৎকার মারলো।
নিখিল উড়ে এসে একদম ওর মুখ চেপে ধরলো।
নেহা অনবরত চোখের পাপড়ি ঝাঁপটাচ্ছে,এমনিতেই ওর হার্ট অ্যা টাকের অবস্থা হয়েছিলো তার উপর এই ছেলে এতো কাছে চলে আসলো কেনো,এবার কি হবে।
নিখিলের চোখে মুখে বিরক্তি দাঁতে দাঁত চেপে বলে
,,কি সমস্যা যখন তখন এভাবে চিল্লাতে থাকস কেন?এখানে কি সকাল সকাল ভুত এসেছে নাকি ডাকাত!
নেহা চোখ খিঁচে বন্ধ করে ফেলেছে,নিখিল সদ্য গোসল সেরে এসেছে,পড়নে বলতে শুধু একটা প্যান্ট। ঘুম থেকে উঠে খালি গায়ে নিখিল কে দেখেই কোনো কিছু চিন্তা না করেই চিৎকার দিয়েছে।নিখিল নেহার একদম কাছে এসে ওর মুখ চেপে ধরেছে,নেহার এবার শ্বাস আটকে আসার উপক্রম।নিখিলের থেকে ভেসে আসা মনমাতানো গ্রান টায় এবার নিজেকে অসার মনে হচ্ছে।নেহা হাত ছাড়ানোর জন্য উম,,উম,, শব্দ করতে থাকে,নিখিল বুঝতে পেরে নিজের হাত সরিয়ে নেয়।
নেহা কয়েকবার শ্বাস নিয়ে,কাঁপা কন্ঠে বলে
,,দূ,,রে সরুন নিখিল ভাই!
নিখিল সরলো না উল্টো আর একটু এগিয়ে আসলো,নেহা ভয় পেয়ে পিছিয়ে গেলো।নিখিলের নেহার অবস্থা দেখে হাসি পেয়ে গেলো,নিজেকে যথাসম্ভব ধাতস্থ করে বলে উঠলো
,,আমাকে এভাবে দেখার অভ্যাস করে নে নেহা।রোজ রোজই তো দেখতে হবে,আর এতো রিয়েক্ট করার কি আছে আমি তো পরপুরুষ নই!তোর নিজেরই বিয়ে করা স্বামী।
নিখিল উঠে গিয়ে আবার আয়নার সামনে দাঁড়ালো চুলে জেল লাগাতে ব্যস্ত হলো।এদিকে পর পর দুইটা কথা বলে বিমূঢ় করে রেখে গেছে এক রমনীকে।
নেহা তব্দা খেয়ে বসে আছে। কানে বাজছে নিখিলের বলা কথা,আমি পর পুরুষ নই তোরই বিয়ে করা স্বামী!
স্বামী শব্দটায় যেনো কিছু একটা আছে।
তীব্র অধিকারবোধ,কিংবা একটা মানুষের সবকিছুতে আধিপত্য পাওয়ার চাবিকাঠি।
নেহার মনটা চট করেই ভালো হয়ে গেলো,সে ভুলে গেলো নিখিল অন্য কাউকে ভালোবাসে ওসব ধারনা।তার মন শুধু বললো,নিখিল তোর সে তোর স্বামী!
নেহার মুখের হাসিটা আড়াল হলো না আজ সে হেসেই রুম থেকে বেরিয়ে গেলো,নেহা কে যাওয়ার সময় দেখলো একবার নিখিল।
নেহা বেরিয়ে গেলো আনমনে হাঁটার ফলে খেলো এক ধাক্কা তাও যার তার সাথে না সয়ং টয়ার সাথে।নেহার মেজাজ খা’রাপ হতে আর কি লাগে!
নেহা পুরোই এলোমেলো, চুল গুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে,ফুলা ফুলা চোখ নেহা কে দেখেই বুঝা যাচ্ছে সদ্য ঘুম থেকে উঠেছে।
টয়া ভ্রু জোরা কুঁচকে রেখেছে।নেহা পাশ কাটিয়ে যাবে ভেবে নিয়েছে সকাল সকাল মুড নষ্ট করার কোনো মানেই হয় না।
,,নেহা তুমি নিখিল ভাইয়ের রুমে রাতে ছিলে!
নেহার বিরক্তির সীমা এবার আকাশ ছুঁই ছুঁই নেহা তার জামাইয়ের সাথে ঘুমিয়েছে তাতে টয়ার কি?নেহার রাগ ফুটে উঠেছে চোখে মুখে,আজকে এই মেয়েকে একদম খু*ন করে ফেলবে,শুধু মাত্ররো আত্মীয় বলে নিখিল ভাইয়ের সাথে ঢলা’ঢলি করাটা সহ্য করেছে, তাই বলে কি মাথা কিনে নিয়েছে নাকি?নেহা কে চিনে না তো এই মেয়ে এ পর্যন্ত কতো জনের মাথা ফাটিয়েছে তা শুধু বৃষ্টি জানে।জেরিন,বৃষ্টি তখনই সাব্বিরের রুম থেকে বেরিয়েছে নেহা টয়াকে মুখোমুখি দেখেই দুজন দৌড়ে আসে।
বৃষ্টি ভয় পেয়ে গেছে নেহার চোখ মুখ দেখে।জেরিন বলে উঠলো কিরে তোরা দুইজন এখানে কি করছিস যে যার কাজে যা!
টয়া আবার বলে উঠলো
,,নেহা কে দেখলাম নিখিল ভাইয়ের রুম থেকে আসলো জিজ্ঞেস করলাম উত্তর তো দিলোই না, বড়দের কথার উত্তর দিতে হয় নেহা কি জানে না।কেমন অভদ্র হয়ে যাচ্ছে ও,নিখিল ভাই ঠিকই করে ওকে কড়া করে কথা শোনায়।
নেহা এবার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে বসে,হাত উঠায় টয়া কে কষিয়ে একটা মা রার জন্য। কিন্তু তা হয়ে উঠে না বৃষ্টি এসে হুট করে নেহাকে জড়িয়ে ধরে,কিছুটা দূরে নিয়ে কানের কাছে বলে
,,কি করছিলি তুই এটা!এটা বাড়ি সবাই পরে তোকে ভুল বুঝতো পা’গল।অন্য ভাবে সামলাতে হবে প্লিজ কুল ডাউন!
নেহা বৃষ্টি কে জড়িয়ে ধরে জোরে জোরে শ্বাস টানলো।সাব্বির হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসলো, রুম থেকে কাহিনি শুনতে না পারলেও বুঝলো কিছু একটা ঘটছে!
টয়ার হাতে কফি মগ সাব্বির দেখেই এক টানে তা ছিনিয়ে নিয়ে বড়সড় একটা চুমুক বসালো
,,কফিটা কি তুমি বানিয়েছো টয়া?তা আমার জন্য বুঝি?
টয়া নির্লজ্জের মতো বললো
,,না, নিখিল ভাইয়ের জন্য।
সাব্বির নেহার দিকে তাকালো, একটা ফুটন্ত প্রায় বো’মা।সাব্বির দ্রুত ভঙ্গিতে বললো
,,নিখিল ভাই তো সকালে দুইবার কফি খায় না,জানো না তুমি?এইতো কিছুক্ষণ আগে নেহা নিজের জন্য কফি আনতে গিয়েছিলো তখন বড় মা ওর হাতে নিখিল ভাইয়ের জন্যও কফি পাঠিয়েছে, ওটা দিয়েই আসলো এখন।তাই তোমারটা আমিই খেয়ে নিলাম কিছু মনে করোনি তো?
টয়া বিস্ফো’রিত নয়নে তাকালো।নেহা কি নেহার ছায়াও তো রান্নাঘরের আশেপাশে দেখলো না। টয়া তো সকাল থেকেই নিচে ভোরে উঠে জোর করে সবাই কে সরিয়ে রান্না করলো!ওর খালামনি তো ওকে ঢুকতে দিতেই চায়নি সে হাত পুড়িয়ে রান্না করলো শুধু নিখিলের জন্য।আর এই মেয়ে কখন গেলো রান্না ঘরে মিথ্যা কেনো বলছে সাব্বির?
,,কখন দেখলাম না তো, আমি তো এতোক্ষণ রান্না ঘরেই ছিলাম আজ সকালে সবার জন্য নাস্তাও আমি বানিয়েছি!
সাব্বির যে হারার পাত্র নয় তা তো টয়া জানে না সে মিথ্যা ও বলে পুরো কনফিডেন্সের সহিত।সাব্বির কফি মগ টা জোরিন হাতে গুঁজে দিয়ে বললো
,,তুমি তো কিছু জানোই না টয়া আমার নেহা বোন তো সুপার ফাস্ট কখন যায় কখন আসে বুঝাই যায় না পুরো বাতাসের গতি ওর। তাই বেশি চাপ নিও না বুঝলে।
সাব্বির হেলেদুলে চলে গেলো,জেরিন ও গেলো।বৃষ্টি নেহাকে নিয়ে নিজের রুমে গেলো।
,,,,,,,,,,
খাবার খাওয়ার জন্য সবাই টেবিলে বসে পড়েছে,কিছুক্ষণের মধ্যেই নিখিল আসলো পেছনে নেহা।নিখিল শেষ সিঁড়িতে নেহা প্রথম,নিখিল নামতেই টয়া এসে গদগদ হয়ে বললো
,,নিখিল ভাই আসুন আজকে আমি রান্না করেছি খেয়ে বলুন কেমন হয়েছে।নেহা এবার নামা বন্ধ করে দিয়েছে দেখতে চাচ্ছে নিখিল কি বলে।যদি নিখিল আজকে এই মেয়ের হাতের রান্না খায় তো নেহা বাড়িতে আ’গুন লাগিয়ে দিবে একদম।টয়ার সাথে নিখিলকেও জ্বালিয়ে দিবে তাতে!
নিখিল ঘড়ির দিকে তাকালো একবার,তার পর সিঁড়িতে থমথমে মুখে দাড়িয়ে থাকা মেয়েটিকে দেখলো।
নিখিল টয়া কে জবাব না দিয়ে হামিদা বেগমের উদ্দেশ্য বললো
,,মা আজ একটু বেশি কাজ আছে,বাহিরে খেয়ে নিবো।
নিখিল আর দাড়ায়নি লম্বা কদমে সদর দরজা ছাড়লো।
কিছুক্ষণ পর সাব্বির উঠে গেলো
নিখিল দাড়িয়ে আছে গাড়িতে হেলান দিয়ে,সাব্বির গিয়ে বললো
,,হ্যাঁ ভাইয়া বলো।
নিখিল বিনা বাক্য ওর হাতে একটা প্যাকেট ধরিয়ে দিয়ে বললো
,,এটা নেহা কে দিবি আর চুপচাপ সবটা খেয়ে ঔষধ খেতে বলবি না হয় ওর কপালে দুর্গতি আছে বলে দিলাম!
সাব্বির মাথা নেড়ে চলে আসলো,নেহা খেতে আসেনি সিঁড়ি থেকেই ফেরত গিয়েছে, দরকার পড়লে চার দিন না খেয়ে থাকবে তাও এই মেয়ের রান্না করা খাবার মুখে তুলবে না।নিখিল খাবার না খাওয়ায় নেহা খুশি তবু প্রকাশ করবে না। ভাব নিয়ে চলতে হবে এই ছেলের সাথে, ভাব শুধু ওর একার আছে নাকি।
সাব্বির কে বাহিরে গিয়ে আবার আসতে দেখে সাহারা বললেন
,,কিরে না খেয়ে এরকম ছুটোছুটি করছিস কেনো?আবার উপরে যাচ্ছিস কেনো?
সাব্বির আসছি বলে চলে গেলো
,,,,
সাব্বির নেহার দরজার সামনে দাড়িয়ে দাঁত কেলিয়ে বললো
,,নেহা বোনটি আমার,থুরি ভাবি সাহেবা আমার এই নিন আপনার খাবার।খেয়ে ঔষধ খেতে বলেছে আপনাকে আপনার উনি!
নেহা পানসে মুখে বললো
,,ছি!ছি! সাব্বির ভাইয়া তুমি ছোট বোনরে ভাবি বানাইয়া দিলা,পর করে দিলা একদম।
,,হইছে কাহিনি কম কর,খেয়ে নে তো না হয় ভাইয়া এসে তোকে উপরে পাঠিয়ে ছাড়বে।
সাব্বির খাবারের প্যাকেট নেহার হাতে দিয়ে চলে গেলো,এই লাইলি মজনুর চক্করে ওর সকালের খাবারে মাছি পড়লো।
,,,,,,,,
ভার্সিটি যাবে না আজ জেরিন, সাব্বিরও যায়নি ওদের তো ঘুরতে যাওয়ার কথা নেহাকে শুধু বলেনি।নেহা কে চেপে ধরেছে রাতের কাহিনি জানার জন্য ওরা, নেহা কাটছাট করে কিছু একটা বুঝিয়েছে ওদের,যখন সবাই শুনেছে সবার জন্য গিফট এনেছে তখন মুখ বন্ধ হয়েছে এদের।
সকাল থেকে মন খারাপ টয়ার নিখিল তাকে এভাবে এরিয়ে চললো,সময় নেই ওটা মুখেও তো বলতে পারতো,নিখিল না খাওয়ায় যতটা না কষ্ট হচ্ছে তার চেয়ে বেশি কষ্ট হচ্ছে নিখিলের ওকে এরিয়ে চলায়।যে মানুষ টাকে পছন্দ করে যার মন পাওয়ার জন্য এতোকিছু করে বেহায়ার মতো লাজ লজ্জা ভুলে ছুটি পেলেই ছুটে আসে সে মানুষ টা তার দিকে ফিরেও তাকায় না! এতো এতো রূপের প্রশংসা পায় সে প্রতিনিয়ত এসব দিয়ে কি লাভ যদি নিখিল তার দিকে ফিরেও না তাকায়।ভালোবাসা আসলে কিভাবে সৃষ্টি হয়,রূপে,গুনে,নাকি অদৃশ্য কোনো শক্তি যার নাগাল পেতে ব্যর্থ টয়া!
টয়া কষ্ট চেপে মুখে হাসি নিয়ে সেতারা বেগমের প্রশংসা শুনে যাচ্ছে এই একটা মানুষই তার আশার আলো।নিখিল কে পেতে যেভাবেই হোক সেতারা বেগমকে পটানো বেশি জরুরি নিখিল সেতারা বেগমের কথা কখনো ফেলতে পারবে না তা জানে টয়া।
দুপুরের ঠিক কিছুক্ষণ আগে রান্না শেষ করেছেন হামিদা,তাহমিদা,আর সাহারা মিলে।
নেহা সবাইকে বসার ঘরে ডাকলো,আগে হামিদা বেগম,পরে সব বড়দের কালকে রাতে আনা উপহার গুলো দিলো।জেরিন,বৃষ্টি, সাব্বির কে দিলো রৌফ স্কুল থেকে ফিরেনি এখনো তাই ওরটাও সাব্বির ভাইয়ের হাতে দিয়েছে নেহা।
টয়া এক পাশে দাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো
,,আমার জন্য কিছু আনোনি নেহা!
নেহা এবার চমকে উঠলো সে সত্যি রাতে টয়ার কথা ভুলে গেছিলো,এক বড় লজ্জায় পড়ে গেছে নেহা, তা ঠিক বুঝতে পারলো বৃষ্টি। বসার ঘরে তখন সদর দরজা দিয়ে প্রবেশ করলো মিহির সাথে নিখিল,পেছনে শাহআলম চৌধুরী।
নেহা কি বলবে বুঝে উঠতে পারলো না, জেরিন সাব্বির মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে।বৃষ্টি চট করে বলে উঠলো
,,কেনো আনবে না টয়া আপু নেহা তো সবার জন্য এনেছে,আমার টা আগেই দিয়েছে, তুমি এতোক্ষণ দাদির ঘরে ছিলে তাই তোমারটা আমার হাতে দিয়েছে।
এই নাও!
বৃষ্টি নিজেরটা টয়াকে দিয়ে দিলো,এদিকে নেহার চোখ ছলছল করে উঠলো।তাকে বিব্রত পরিস্থিতি থেকে বাঁচাতে বৃষ্টি নিজের টা টয়া কে দিয়ে দিলো!সব ঘটনাই মিহির নিখিল দেখলো দাড়িয়ে। শাহআলম ছোটদের মাঝ থেকে সরে গেলেন।
টয়া তো গিফট পেয়ে খুশি, সে ভেবেই নিয়েছে এসব নিখিল কিনেছে নিশ্চয়ই নিখিল নিজের হাতে না দেক ওর পক্ষ থেকে ভেবেই নিয়ে খুশি টয়া।বৃষ্টির মুখেও হাসি গিফট না পাওয়ায় তার মাঝে কোনো কষ্ট দেখা গেলো না তার কাছে নেহা আগে পরে সব কিছু এসব গিফট নেহা তাকে আরো দিতে পারবে।একবার এই গিফটের বদলে যদি বন্ধুর সম্মান বাঁচে তো তাই হোক!
নিখিল রুমে চলে গেলো মিহির নেহার দিকে তাকিয়ে বললো
,,এই নেহা এটা তোমার জন্য, বুঝলে বলেই মুখ ভরে হাসলো নেহা হাতের শপিং ব্যাগটার উপর মেঘবালিকা লেখা দেখে নিজেও হাসলো।জেরিন টিপ্পনী কেটে বললো
,,বাহ্!মিহির ভাই শুধু নেহার জন্য আমাদের কি চোখে পড়ে না তোমার?
নেহা এদের কথায় পাত্তা না দিয়ে বৃষ্টির হাত টেনে নিয়ে চললো রুমের দিকে।
রুমে এসে নেহা বৃষ্টি কে একটা রাম ধম’ক দিলো
,,তুই ওই টয়া ফয়াকে নিজের টা দিলি কেন?যা হওয়ার হতো এখন তো মনে হচ্ছে আমি ভুলে গিয়ে ভালোই করেছি এই শাঁক’চুন্নির জন্য আনবে আমার শত্রু!
,,ওফ নেহা তুই কি বাচ্চা সব সময় শুধু বোকা বোকা কথা চুপ যা তো।
মিহির টা তোকে আবার কি দিলো রে?
নেহা হেসে বললো
,,তোকে বলবো কেনো?
বৃষ্টি টেনে নিয়ে বললো-,দেখা বলছি।
বৃষ্টি দেখলো গোলাপী রঙের একটা শাড়ি,সাথে চুড়ি গহনা আর একটা ছোট চিরকুট!
“প্রিয় মেঘবালিকা”
,,আমার হৃদয়ের এক পশরা সুখের পায়রা তুমি।
,, এই হৃদয় মরুভূমির অধিক প্রতিক্ষিত জলরাশি তুমি।
,,আমার ভালোবাসা উষ্ণতম সুখতারা তুমি।
,,আমার হৃদয় শ্রাবনের ভালোবাসার ইলশেগুঁড়ি তুমি।
ইতি—,তোমার অধম প্রেমিক~
নেহা হু হা করে হাসলো,হাসতে হাসতে বললো
,,মিহির ভাইয়াকে তুই এবার কবি সাহিত্যিক বানিয়ে ছাড়বি দেখছি।
বৃষ্টি এবার বললো
,,তুই নিজের জন্য কাল কি এনেছিস দেখালি না তো, আর ভাইয়া কি দিয়েছে দেখা।
নেহা ভোঁতা মুখে বললো
,,তোর ভাই দিবে গিফট দুনিয়া উল্টাইয়া যাইবো তোর কথা শুনে।আর কোনো মানুষ পেলি না,এর থেকে কিছু আশাও করি না আমি।আমাকে তো কিছু দিবে না আলমারি ভর্তি শাড়ি এনে রেখেছে প্রেমিকার জন্য!
নেহার মনটা ক্রমশ কষ্টে ভরে উঠলো কথাটা বলে,বৃষ্টি বুঝেও চুপ রইলো কি করার আছে তার এখানে যেখানে তার ভাই কিছু করছে না।মেয়েটাকে কবে বুঝবে তার ভাই,সময়টা যেনো দীর্ঘতম না হয় সে আশাই করে বৃষ্টি।
———-
দুপুরে সবাই রেডি ঘুরতে যাওয়ার জন্য, টয়া গেলে নেহা যাবে না, নিখিলের সাথে গিয়েই এই মেয়ে রঙ্গ করবে তা কিছুতেই দেখতে পারবে না নেহা।এতোটাও মহান নারী সে না।
জেরিন,বৃষ্টি মুখ গোমরা করে বসে আছে।
,,প্লিজ চল না তুই না গেলে ভাইয়া আমাদের নিয়ে যাবে না।
,,কেনো নিয়ে যাবে না,অবশ্যই যাবে আমি না গেলে তো উনি বেঁচে যায়।
,,প্লিজ সোনা বেবি রাগ করে না বড় আপুর কথা শোন না বাবুটা।
,,দেখো দেখো জেরিন আপু তুমি একদম এভাবে বলে আমাকে গলাতে চাইবে না।তোমার ভাই যদি এসে বলে নেহা চল তবেই যাবো না হয় এক পাও নড়বো না আমি!
দরজা থেকে নিখিলের গম্ভীর কন্ঠস্বর শুনে সবাই চুপ করে গেলো
,,ওহ! তোকে আবার আলাদা করে নিমন্ত্রিত করতে হবে তাই তো নেহা?
নেহা শুকনো ঢোক গিললো কথা টা এসে নিখিলকেই কেনো শুনতে হবে,এভাবে ফেঁসে যাবে ভেবে চিন্তে তো এসব বলেনি তখন।
,,তুই যদি পাঁচ মিনিটের ভিতর তৈরি না হয়েছিস তো, তোকে কিভাবে নিয়ে যেতে হবে জানা আছে আমার!
,,যাবো না,,আ,মি!
নিখিল ভ্রু উঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলো
,,কি করবি না তুই?
,,যাবো!
,,গুড গার্ল!এই তরা গিয়ে গাড়িতে বস আমি ওকে নিয়ে আসছি।
বাকিরা সবাই শাড়ি পড়ে যাবে,শাড়ি পড়ে তৈরিও হয়েছে,নেহা পাঁচ মিনিটে শাড়ি কেনো শাড়ি বের করতেই তো দশ মিনিটের ব্যাপার।
নেহা পিচ রঙের একটা চিকেনকারি কাজের থ্রি পিস নিলো,ছুটে গিয়ে বের হয়ে আসলো।মুখে মাখার মতো শুধু ক্রিম টাই সামনে পেলো,মেখে একটা খুবই হালকা রঙের লিপস্টিক লাগিয়েছে।চুল গুলো উচু করে কাটা দিয়ে আটকে বের হতে নিলেই, নিখিল বললো
,,এই চুল ছেড়ে বের হ!
নেহা পারবো না বলে পাশ কাটিয়ে চলে এলো।নিখিল আঙুলের সাহায্য কপাল ঘষঁলো।
এই মেয়েটা তো এই অতি সাধারণ রূপেই রোজ রোজ তাকে ডুবিয়ে মারছে অনুভূতির এক অতল সাগরে।কতোদিন সামাল দিতে পারবে নিখিল, নিজেকে সামলাতে ব্যর্থ হয়ে পড়ছে ক্রমশ।
নেহা নিখিল নামছে পাশাপাশি, তাহমিদা, হামিদা,সাহারা বসে আছেন সোফায় সময় পেয়ে তিন জা মিলে টিভি দেখতে বসেছে।
ছেলে মেয়ে দুটোকে একসাথে কি সুন্দর মানিয়েছে,মুগ্ধ চোখে দেখলেন তিনজন।
হামিদা এগিয়ে এসে নেহা কে জড়িয়ে ধরে কপালে চুমু খেয়ে বললেন
,,মাশাআল্লাহ অনেক সুন্দর লাগছে আমার মাকে!
নেহা হামিদা বেগম কে জড়িয়ে ধরে বলে,তুমি শুধু প্রশংসা করলে বড় মা যানো কিছু মানুষ সারাদিন শুধু
,,পে’ত্নী বলে ডাকে।
নেহা কথা টা বলে নিখিলকে একটা ভেংচি কাটলো।হামিদা বেগম হাসলেন,নিখিলকে কড়া ভাষায় বললেন
,,মেয়েটাকে নিয়ে যাচ্ছিস একদম বকা*ঝকা করবি না বলে দিলাম।দেখেশুনে রাখবি আর নিজ হাতে খাইয়ে দিবি মনে থাকবে?
নিখিল বাধ্য ছেলের ন্যায় মাথা নাড়লো।
দুজন বেরিয়ে যেতেই হামিদা এসে বসলো,হেসে বললো
,,কোনো কু নজর না লাগুক ছেলে মেয়ে দুটোর উপর।
তাহমিদা তৃপ্তি পেলেন মেয়ে কপাল করে বড় আপার মতো শাশুড়ী পেয়েছে।তার যা মেয়ে সব কিছুতে ভুল করে অন্য বাড়ির মানুষের কাছে দিয়ে তিনি কোনো দিন শান্তিতে থাকতেন না।এখন তিনি নিশ্চিন্ত। তার পরে ও মেয়েকে দেখে রাখার কতো মানুষ আছে,সাহারা ও কম না নিজের মেয়ের মতোই আগলে রাখে!
,,,,,,,,
গাড়ি পাশে আসতেই আরেক বিপদ নেহা আর নিখিলকে এক সাথে পাঠাবে বলে আগে ভাগেই প্ল্যান করেছে মিহির, জেরিন,বৃষ্টি আর সাব্বির,তাই ওরা সবাই যাবে বাড়ির বড় গাড়িটায় আর নেহা কে পাঠাবে নিখিলের গাড়িতে।কিন্তু সমস্যা হলো টয়া কে নিয়ে।
নেহা, নিখিল আসতেই টয়া এসে বললো
,,চলো এবার যাওয়া যাক।
জেরিন এসে বললো -, হ্যাঁ চল টয়া তুই আমরা ওই গাড়িতে যাবো।
,,কেনো নিখিল ভাইয়ার সাথে গেলে কি সমস্যা উনার গাড়িতে তো জায়গা আছে,তোমরা ওটায় যাও আমি নিখিল ভাইয়ার গাড়িতে যাবো।
সাব্বির মিহির কে গুতো মেরে বললো
,,দেখলে তো মিহির ভাই এই মেয়ে কেমন নির্লজ্জ।আমার তো রুচিতে বাঁধতেছে সারাজীবন চিরকুমার থাকবো তবু এমন মেয়ে বিয়ে করবো না, কসম খোদার!
বৃষ্টি বিরক্ত নিয়ে বললো-,টয়া আপু একটাতে গেলেই তো হয় আমারা সবাই এটাতে যাবো ভাইয়া নিজের গাড়িতে কাউকে নেয় না উনার এটা পছন্দ না বুঝলে আর কথা বাড়িয়ো না তো এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে।
টয়া নেহা কে বললো -,চলো তাহলে নেহা সবাই মিলে যাই।
,,কেনো নয় আসো।নেহাকে চলে যেতে দেখেই নিখিলের রাগ উঠে গেলো নেহার হাত শক্ত করে চেপে ধরলো পেছন থেকে। কটমট দৃষ্টি রাখলো নেহার উপর।
নেহাকে থেমে যেতে দেখে টয়াও থামলো।
,,নেহা টয়া কে বললো -, আপু তুমি নিখিল ভাইয়ার সাথে যাও উনার একা যেতে ভয় লাগছে!
সাব্বির কপাল চাপড়ালো এ কি মহা শনির দশা ভাই, এদের কেউ থামা।নিখিল মিহিরের দিকে তাকালো বেচারা বন্ধুর করুন দশা দেখেও কিছু করতে পারলো না।
নিখিল রেগে চোখ বন্ধ করে অতি রাশভারী কন্ঠে বললো–,টয়া তুই এখান থেকে যা বলছি, নেহা আমার সাথে যাবে।আর একটা কথাও যদি কেউ বলিস তো যাওয়া ক্যন্সেল!
নিখিলের রাগী কন্ঠে সবাই কেঁপে উঠলো। টয়া নিখিলের এই রুপের সাথে পরিচিত নয়,নিখিল বাহিরের মানুষের সামনে সহজে রাগে না।নানা বাড়িতেও কখনো রাগ দেখায়নি তাই এসব অজানা তার।
নেহার হাত ধরে ওকে এক প্রকার টেনে গাড়িতে উঠালো নিখিল।
গাড়ির ফ্রন্ট সিটে বসে হাতের ব্যাথায় কুঁকড়ে উঠলো নেহা।জোরেই লেগেছে অনেকটা তার উপর হাতের বেন্ডেজে ও চাপ পড়েছে শুভ্র বেন্ডেজে রক্তের লাল ছাপ দেখা গেলো।
নেহা সিটে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে ফেললো ঠোঁট কামড়ে ব্যাথাটাও গিলে ফেললো।
নিখিল গাড়ির স্টিয়ারিং এ মাথা রেখে রাগ নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যস্ত। মেয়েটা কি তাকে রাগিয়ে দেওয়া ছাড়া আর কিছু পারে না?নিজেকে শান্ত রেখে ওর সাথে কথা বলতে যায় সব সময়,নেহার সাথে রাগ দেখিয়ে তো নিখিল নিজেও ভালো থাকে না।নিজের কলিজায় আ’ঘাত করে কোন মানুষ ঠিক থাকতে পারে, এ মেয়েকে কে বুঝাবে সে কথা!সব সময় শুধু ছটফট করে হাত পা কে’টে বাড়ি আসে,সারাদিন ছুটোছুটি করে, নিখিল কে রাগিয়ে দেয় কি করবে, সে তো নিজেকে নিয়ন্ত্রণ করতে ব্যর্থ। প্রিয় মানুষকে রক্ষা করার আড়ালে নিজেকে সবার কাছে প্রমান করেছে কঠিন মানব রুপে।প্রেয়সির কাছে হয়েছে নি’র্দয়,পা’ষাণ, অনুভূতিহীন মানুষ!
নিখিল বদ্ধ চোখে থাকা নেহা কে দেখলো একবার, গাড়ি স্টার্ট দিলো মুহুর্তে,,,,
চলবে?