#প্রণয়ের_সুর
#পর্ব৭
#মহুয়া_আমরিন_বিন্দু
শরৎ এর আকাশ টাকে বুঝা সত্যি বড় দায়,এই ভালো তো এই খারাপ।আকাশ জুড়ে উড়ে বেড়ানো সাদা মেঘেদের হঠাৎই ছুঁয়ে যায় কালো ধূরস রঙেরা।পরিবেশকে ঠান্ডা করতে বাতাসেরা পাল্লা দিয়ে ভারী হয়, ছুঁয়ে দেয় কিছু অশান্ত মনের মানুষ কে।জানালার কাঁচ টেনে নামিয়ে দিয়েছে নেহা দৃষ্টি তার শূন্যে।রাস্তায় সাই সাই আওয়াজে চলছে গাড়ি,বাতাস এলোমেলো করে দিচ্ছে মুখের উপর আঁচড়ে পড়া ছোট ছোট চুল গুলো।দুজন মানুষ পাশাপাশি তবুও তাদের মাঝের দুরত্ব যেন আকাশ সম।
নিরবতা ভেঙে নিখিল বলে উঠলো
,,এখন তুই আগের মতো কথা বলিস না কেনো নেহা?আগের মতো সেই প্রানবন্ত ভাবটা কোথায় হারিয়ে বসে আছিস?
নেহা নিরব রইলো
নিখিল অধৈর্য কন্ঠে বললো-,কথা বলছিস না কেনো আমার সাথে?
নেহার অধিক শান্ত, ও হতাশ কন্ঠ
“যাকে এতোটা ঘৃ*ণা করেন তার কথা শোনার হঠাৎ ইচ্ছে জাগলো কেনো নিখিল ভাই?”
“আপনি যে আচমকা এতো ভালো ব্যবহার করছেন, আমাকে বুঝাতে চাচ্ছেন।ইউ ফিল সামথিং ফর মি।আমার তো মনে হয় এটা পুরোটাই আমার একটা দিবাস্বপ্ন, চোখের দেখা কোনো ভুল,যা এক না এক সময় ঠিক ভেঙ্গে যাবে!ধোঁয়াসার ন্যায় মিলিয়ে যাবে যেকোনো সময়!
,,একটা কথা জানিস তো নেহা আমরা যাকে ভালোবাসি তাকে ঘৃ*ণা করাটা সবচেয়ে বেশি পীড়া দায়ক,এ এক নিদারুণ যন্ত্র*ণা!
” তবুও দিন শেষে ভালোবাসার মানুষটাকে কখনো ঘৃ*ণা করা হয়ে উঠে না।”
উল্টো তার জন্য ভালোবাসা বাড়ে,বার বার তাকে মনে পড়ে।তাকে পাওয়ার আকাঙ্খা বাড়িতে দেয় শত গুন।
“যাকে মানুষ সত্যিকারের ভালোবাসে তার প্রতি কোনো দিন বিরক্তি জিনিস টা আসেই না।”
“যারা জোর গলায় ও বলে আমি আমার ভালোবাসার মানুষটাকে ভুলে গেছি, তাকে আমার বিরক্ত লাগে,তাকে আমি ঘৃ*ণা করি,তাঁরা মূলত মহা মিথ্যুক,পৃথিবীর বুকে তাদের থেকে বড় মিথ্যাবাদী আর কেউ নেই!”
সে মিথ্যাবাদীদের দলের একজন আমি নিজেও!
নেহা নিখিলের কথা শুনে হাসলো।
মনে মনেই ভাবলো যাকে ভালোবাসেন!মানে আপনার সেই প্রত্যাসাময় নারী যার জন্য আপনার সকল ধ্যান জ্ঞান নিখিল ভাই?
আমি তো আপনার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ কেউ নই।আপনি জানেন না যাদের কে ছেড়েই দিতে হবে একদিন তাদের মনে আশার আলো ফোঁটাতে নেই!
আপনি আমার হৃদয়ের ফুটন্ত শেষ আশার আলোটাও নিভিয়ে দিয়ে হারিয়ে যাবেন না তো আবার?
আমি প্রত্যাখান হওয়ার ভয়ে স্বীকার করতে পারিনি ভালোবাসি।
আমি একপাক্ষিক থাকতে চেয়েছি নিখিল ভাই জানেন তো একপাক্ষিক ভালোবাসাতে হারানোর ভয় নেই,হারানোর ভয়টা যে আমার ভীষণ বেশি।আপনি হাত বাড়িয়ে গুটিয়ে নিলে আমি সত্যি নিঃশ্ব হয়ে যাবো নিখিল ভাই!জ্ব’লে পু’ড়ে যাবো অবশিষ্ট ছাই ও পাওয়া যাবে না আর।
আমি আপনাকে চাই,সবটুকু চাই।আদো আদো, অধরা,অস্পষ্ট, নীরবে নিভৃতে চাই না।আমি চাই আপনি আমার কাছে স্পষ্ট রূপে ধরা দেন।আমাকে নিজে বলুন আপনি আমার,শুধু একবার বললেই হবে নিখিল ভাই শুধু একবার!
মৃত্যুর আগে আমার শেষ ইচ্ছেই হবে আপনি একবার বলুন আপনি আমার।আমার সব ভুল গুলো কেনো ভেঙ্গে দিচ্ছেন না নিখিল ভাই?আমার মনের দ্বিধা দূর করতে আর কতো সময় নিবেন?
এই তো মন আষাঢ়ের বৃষ্টির ন্যায় ছড়ায় শীতলতা,এই আপনি বয়ে আনেন কালবৈশাখী কেনো বলতে পারেন?ভালোবাসা এই শব্দ টা এতো কঠিন কেন?এর উপর জোর খাটে না কেন নিখিল ভাই?
যদি কোনো ভর চাইতে পারতাম তবে
”আমি শুধু আপনারে চাইতাম”শুধুই আপনারে!
কিন্তু আমার যে প্রশ্ন জাগে আপনি আমারে চাইবেন তো?কেনো যেনো বার বার মনে হয় আপনি অন্য কারো আমার নন।কেনো এতোটা দু-টানায় রাখেন আমারে।আপনার এই বিশাল মন টায় কি একটু জায়গা আমারে দেওয়া যায় না।কথা দিলাম একবার শুধু বলেন
নেহা আমি তোর,বাকি জীবন আমার সবটা ভালোবাসা আমি আপনারে দিমু।
এই কথা গুলো সরাসরি বলার মতো সাহস জোগাতে কেনো পারি না আমি নিখিল ভাই?সাহসের দিক দিয়ে এতোটা দুর্বল কেনো আমি।নিজেকে প্রচুর বিরক্ত লাগে আজকাল প্রুচর মানে প্রচুর মাত্রাতি’রিক্ত!
নিখিল ড্রাইব করার ফাঁকে বেশ কয়েকবার তাকিয়েছে নেহার ফ্যাকাশে মুখের পানে।নিজের ভিতরে অসম্ভব অস্থিরতা কাজ করা শুরু হয়েছে নিখিলের, এই মেয়েটার হাসি না দেখলে যে তার দ’ম বন্ধ লাগে, তা কি জানে না মেয়েটা!তবুও হাসতে এতো কৃপণতা কেন দেখাচ্ছে ইদানিং?
নিখিল জবাব পায় না,আর না জবাব মিলে নেহার,কি করে মিলবে তাদের প্রশ্নের যথাযথ উত্তর, যে জিনিস পাওয়া যাবে অপর ব্যক্তির কাছে তা খুঁজলে কি লাভ হবে নিজের কাছে!
একটা রেস্তোরাঁয় তাদের গাড়ি থামে।জেরিন,বৃষ্টি, মিহির,সাব্বির,রৌফ নিজেদের মতো কথা বলছে,শুধু অধৈর্য একজন মানুষ, টয়া শুধু বার বার রাস্তার দিকে তাকাচ্ছে,তারা নেমেছে পাঁচ মিনিট হলো তার পরও মনে হচ্ছে কতো বছর সময় যেনো পেরিয়ে যাচ্ছে।
নিখিল,নেহা এগিয়ে আসলো ওদের কাছে।সবাই ভেতরে যাওয়ার উদ্দেশ্য পা বাড়াতেই নেহার হাত টেনে দাঁড় করালো নিখিল,বেন্ডেজ করা হাতটি নিজের শক্তপোক্ত হাতের ভাজে নিলো খুব সাবধানে। নেহার হাতের উপরে আলতো হাতে স্লাইড করলো নিখিল।
নেহা চোখ বন্ধ করে ফেললো, কিছুটা সুরসুরি দেওয়ার মতো লাগছে তার হাতে,ব্যাথাটাও পেয়েছিলো তখন।নিখিল নেহার মুখের দিকে তাকালো কিছুক্ষণ, পরেই নিজের কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লো।
নিখিল এতো আলতো হাতে বেন্ডেজ খুলছে যেনো নেহার হাত টা একটা ছোট্ট বাচ্চা যার গায়ে একটু জোরে চাপ পড়লেই সে ব্যাথা পাবে।নিখিল হাতের দিকে তাকিয়ে নরম সুরে বললো
,,বেশি ব্যাথা দিয়ে ফেলিছি নীহারিকা?বেশি ব্যাথা করছে বুঝি!
এতোটা আদুরে কন্ঠ নেহা আগে কোনো দিন শুনেনি।এই মানুষটা সব সময় এভাবে কথা বলে না কেনো?নেহার যে সারাজীবন এরকম একটা মানুষই চাই,যে থাকুক শক্তপোক্ত খোলসের আড়ালে শুধু তার কাছে এসে হয়ে যাক একদম নরম, আদুরে,যত্নশীল!
নেহার কেনো যেনো ভীষণ কান্না পেলো এখন,টপ করে গড়িয়ে পড়লো এক ফোঁটা জল।নিখিল সেই ক্ষুদ্র মুক্তার ন্যায় পানির ফোঁটাটা গাল বেয়ে গড়াতে দেয়নি বেশি দূর, নিজের একহাতে মুছে দিলো স্বযত্নে।
কন্ঠ টা ঠিক আগের মতো রেখেই বললো
,,কাঁদছিস কেনো বোকা?এতোটুকু ব্যাথাতে কেউ কাঁদে। তুই না বড় হয়ে গেছিস।
নেহার কান্নার বেগ যেনো বেড়ে গেলো,কিন্তু মন বলছে থেমে যা নেহা,রাস্তা ঘাটে কিভাবে কেঁদে দিলি তুই?
নিখিল হাতের বেন্ডেজ খুলার ফাঁকে আবার বললো
,,কাঁদে না লক্ষীটি!
নেহার মুখ এবার হা হয়ে গেলো,কান্না করা তো দূর সে যেনো সব কিছুই ভুলে গেছে।নিখিল ভাই তো এটা, তার সামনের ব্যক্তিটি এতোটা নরম সুরে তার সাথে কথা বলছে!
নিখিল পকেট থেকে একটা শুভ্র রঙা রুমাল বের করলো।নেহার হাতের বেন্ডেজের জায়গায় রুমালটি পেচিয়ে দিলো ভালো করে।
নেহাকে বোকার মতো চেয়ে থাকতে দেখে নিখিল হাসলো।নেহার চোখ দুটো মুছে দিয়ে বললো
,,এবার হাসি দে।হাসি দে বলছি!
ধমকের সুরে কেউ হাসতে বলে?কিন্তু নেহা সত্যি হেসে দিলো!তার পাতলা ঠোঁটের ভাঁজে হাসিটা নিখিলের বুকে ঠিক তীরের মতো বিধলো।
নেহা সামনের দিকে হাঁটা দিতেই,নিখিলের বুকের বা পাশে হাত রাখলো।
,,এই এখান টায় ঠিক বুকের বা পাশে তার কেমন সুখ সুখ অনুভব হচ্ছে।এই সুখ তো আছে শুধু তার অবুঝ পাখির কাছে!
নেহা নিখিলের কান্ড দেখে মিটিমিটি হাসছে সব গুলো মিলে,নেহা যেতেই সবাই নরমাল। মানে কিছু ঘটেনি কিছুই দেখেনি এমন ভাব।
একজন মানুষের এসবের কিছুই পছন্দ হয়নি।তার মনে সন্দেহেরা দানা বেঁধেছে,তার মানে কি নেহা নিখিল কে তার কাছ থেকে কেঁড়ে নিবে কিছুতেই এটা হতে দিতে পারে না টয়া।সে যে বাড়িতে গিয়েই সেতারা বেগমের সাথে কথা বলবে, তা এখনই ঠিক করে নিলো।
রেস্তোরাঁটার এক পাশে খোলামেলা একটি জায়গা, গাছের ছায়া আছে,শহরের বুকেও গ্রামীণ পরিবেশ টা বেশ নজর কাড়ছে সবার।
ওয়েটার কে বলে দুইটা টেবিল একত্রে করে বসেছে ওরা সবাই।
সাব্বির জেরিনের মারা’মারি তো আছেই।সবাই হাসি আনন্দে মেতে উঠেছে পুরো।
পুরোপুরি বাঙালি খাবারের আয়োজন এখানে,ভর্তা থেকে শুরু করে মাছ,মাংস,সবজি,দই,পায়েস,,,,,
ওয়েটার ছেলেটা বিনয়ের সাথে জিজ্ঞেস করলো তারা কি নিবে।
একেক জন একেক রকম খাবার অর্ডার দিয়েছে,টয়া অপেক্ষায় আছে কখন নিখিল অর্ডার দিবে।নেহা চুপচাপ বসে আছে,চাইনিজ হলেও চামচ দিয়ে খাওয়া যেত,ভাত জিনিসটাই এমন হাতে না খেলে তৃপ্তি মিলে না।
নিখিল পর পর অর্ডার দিলো ডাল, ভর্তা, মাটান, রোস্ট, চিংড়ি, দই আর ভুনা খিচুড়ি!
নেহা ঠোঁট উল্টালো এই লোক একা এতো খাবে নাকি পেটে কি বস্তা বেঁধে এসেছে ,ভাত আবার ভুনা খিচুড়ি!
টয়া পড়লো দ্বিধায় নিখিল যা যা দিয়েছে তার মধ্যে এসব সে যদি রিপিট করে তো সবাই কি ভাববে,তাই ছোট করে বললো,ভুনা খিচুড়ি দিতে।
ওয়েটার চলে যাওয়ার পূর্ব মুহুর্তে মিহির ডেকে বললো।একটা বেশি নারিকেল দেওয়া গুড়ের পায়েস ও দিবেন।সবাই চোখ বড় করে মিহিরের দিকে তাকালো,মিহির ভাই তো কোনো কালেই পায়েস খায় না।মা,ছোট মারা ধরে কতো জোর করে তবু এক চামচ খেতে দেখেনি এই ছেলে কে।আজ তাহলে অর্ডার দিলো কেনো,কে জানে ভাই মানুষের কখন কি হয়।কিন্তু নিখিল হাসলো,তার বোনের পছন্দ ঠিক মনে রেখেছে মিহির।
মিহির কতোটা ভালোবাসে বৃষ্টি কে এটা তার থেকে ভালো আর কে জানে।
খাবার টেবিলে দিয়ে গেলো কিছু সময় পর,নেহা বুকের সাথে দুহাত ভাজ করে ঠোঁট উল্টে বসে রইলো, তার না আসাই উচিত ছিলো, এরা সবাই মিলে তাকে এখানে এনেছে সামনে বসিয়ে নিজেরা খাওয়ার জন্য।
সন্ধ্যা নেমে এসেছে প্রায়,আকাশে সোনালী আভা ছড়িয়ে মনোমুগ্ধকর একটা দৃশ্য ফুটে উঠেছে চারপাশে।
নেহা কে মুখ ফুলাতে দেখেও কেউ কিছু বললো না।তারা জানে এখন কি হবে।সাব্বির তো খাচ্ছে আর আঙুল উঁচিয়ে বলছে
,,আহ্! যা রেঁধেছে না, একে বারে মুখে দিতেই মোমের মতো গলে যাচ্ছে।
জেরিন কিছু সময় পর পর ওকে থামাচ্ছে
,,,ভাই থাম না মানুষ জন তাকিয়ে আছে দেখ,মনে করবে তুই জীবনে কোনো দিন খেতে পাসনি।
সাব্বির এসব শুনেও শুনছে না,সে মন মতো খাচ্ছে আর তৃপ্তির ঢেঁকুর তুলছে!
সবে মুখে খাবার তুলেছে টয়া,নিখিলের কথায় ওর খাবার গলায় আঁটকে গেছে।
,,হা কর নেহা।
নেহা মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে বললো
,,আপনার নিজের টা নিজে খান আমি খাবো না!
,,তোর কাছে জানতে চেয়েছি আমি?হা করতে বলেছি হা কর।না হয় তোকে প্রথমে কোলে এনে বসাবো পরে মুখটা চেপে ধরবো পরে খাবার টা মুখে ঢুকাবো!এবার ভেবে দেখ কি করবি?সবার সামনে কোলে উঠতে চাস তুই?
নেহা বিস্ফো রিত নয়নে তাকালো,কি ভয়ানক থ্রে’ট, এই লোকের লজ্জা না থাকতে পারে তাই বলে কি বাকিদেরও নেই নাকি?সবাই কি ভাববে এখন!
,,নেহা মুখ খুললো খুব দ্রুত সবাই কে বিশ্বাস করা যায়,কিন্তু নিখিল ভাই যে কথা সাথে সাথে কাজটাও করে এটা তার ঢের জানা আছে।
টয়ার কাশি উঠে গেছে রীতিমতো, নিখিল মেহমেত চৌধুরী ভরা রেস্টুরেন্টে মানুষের সামনে একটা মেয়েকে খাইয়ে দিচ্ছে?কি বিরল দৃশ্য! টয়ার অবাকের রেশ কেটে যায় মুহুর্তে, নিখিল কেনো নেহাকে খাইয়ে দিবে আরো তো অনেকে আছে মেয়েরাও তো আছে উনাকেই কেনো?
টয়া চট করে বললো
,,নিখিল ভাই আপনি কেনো কষ্ট করছেন?নেহা তো নিজেও খেতে পারে চামচের সাহায্যে খিচুড়ি খেতে তো হাতের দরকার পড়বে না!
নিখিল নেহা মুখে খাবার দেওয়ার সময় একহাতে আলতো করে গালের নিচে হাত রাখলো।টয়ার মনে হলো ওর ভিতরে কেউ জ্বা’লা ধরিয়ে দিয়েছে।নিখিল এই মেয়েটাকে ছুঁয়েছে!
নিখিল অতি গম্ভীর কন্ঠে বললো
,,তা টয়া আমার কষ্ট নিয়ে কবে থেকে ভাবা শুরু করেছিস তুই?আমি কি করবো না করবো তা কি তোর থেকে পারমিশন নিয়ে করতে হবে নাকি এখন?
নিখিলের স্বাভাবিক কথাটায় ও ঘাবড়ে গেলো টয়া,সে তোতলানো শুরু করেছে এখন,সাহস টা মনে হয় বেশিই দেখিয়ে ফেলেছে আজ।
,,না মানে নিখিল ভাই!
,,চুপ বেয়াদ’ব!কিসের নিখিল ভাই নিখিল ভাই করিস?
“অনলি কল মি ভাইয়া, গট ইট”?
যত দ্রুত বুঝবি ততোই তোর জন্য মঙ্গল। তোর সাহস দেখে আমি অবাক হচ্ছি,চুপ চাপ আছি কিছু বলছি না দেখে কি ভেবেছিস আমি কিছু বলবো না?আসার পর থেকে নেহার পিছনে লেগেছিস কেনো তুই?আনসার মি?
নিখিল এক হাতে টেবিলের উপর আ ঘাত করলো মৃদু কেঁপে উঠলো টেবিলটি,সাথে কেঁপে উঠলো টয়া।
,,আমি শুধু,নেহাকে এটা বুঝাতে চেয়েছিলাম তোমার ওসব কাজ পছন্দ নয় ভাইয়া যেগুলা নেহা করছিলো!
,,আমার কি পছন্দ আর কি অপছন্দ তোকে কখনো বলেছি আমি?আর তোকে বলেছি আমার হয়ে উকালতি করতে আমার মুখ নেই আমার পছন্দ না হলে তো আমি নিজেই বলবো,তুই কেনো বলবি এসব?
আর তোর সাহস তো আকাশচুম্বী তুই নিখিল মেহমেত চৌধুরীর কাছে কৈফিয়ত চাস?
টয়া মাথা নিচু করে রাখলো,তবুও জবাব দিতে ভুল করলো না।
,,আপনি তো নেহার সাথে এমন করেন না, নেহা ও তো আপনাকে নিখিল ভাই বলে ডাকে।
,,নেহার সাথে তুই নিজের তুলনা দিচ্ছিস?জানিস নেহা কে?নেহা কে কিছু বলা মানে ওই কথাটা সরাসরি আমাকে বলা।নেহা যা খুশি করতে পারে,যা খুশি, আরেকদিন যদি তোকে দেখিছি ওকে এসব নিয়ে কোনো কথা বলেছিস?বা আমি কোনো কাজ করার সময় তার মাঝে এসে ইন্টারফেয়ার করিস তো আমি ভুলে যাবো তুই আমার খালাতো বোন!
টয়া থমকালো চমকালো,মিহির নিখিলের হাত চেপে ধরে ধরলো,মিন মিন করে বললো
,,কি করছিস নিখিল?পাবলিক প্লেসে সিনক্রি’য়েট করিস না।থাম এসব নিয়ে বাড়িতে গিয়ে ও কথা বলা যাবে।
নিখিল আবার নেহাকে খাওয়ানো তে মন দিলো।
টয়া নিজের কটমট দৃষ্টি রাখলো নেহার উপর।এই মেয়েটার জন্য নিখিল তার সাথে এমন করলো, এই মেয়েটাকে নিখিলের জীবন থেকে সরিয়ে টয়া আসবে সম্পুর্ন অধিকার নিয়ে নিখিল মেহমেত চৌধুরীর বউ হয়ে,তখন এ সব কিছুর বদলা নিবে।সব কিছুর!
নেহাকে খাওয়ানো শেষ করে নিখিল নিজে ভাত খেতে শুরু করলো,ভর্তা দিয়ে খাওয়া শুরু করলো ও।সবার খাওয়া এখন মাঝপথে নিখিলের ধ্বংসা”ত্মক রূপ দেখে নেহা নিজেই ভয় পেয়েছে তাই দ্রুত খাবার পেটে পুরে নিয়েছে, না জানি কখন ওকে ধরে চ*ড় লাগায়।
রৌফ খেয়ে গিয়ে দাঁড়িয়েছে দূরে,বড়দের মাঝে থাকা ওর বরাবরই অপছন্দের।নেহা বসে আছে চুপচাপ, বৃষ্টির খাওয়া শেষ হতেই মিহির তার দিকে পায়েসের বাটি এগিয়ে দিলো।
বৃষ্টি একবার তাকালো মিহিরের দিকে,মিহির মনযোগ দিয়ে খেতে ব্যস্ত।যেনো কোথাও কিছু ঘটেনি এই দুই বন্ধুর আচরন এমন ভুতুরে কেনো?হুলস্থুল কান্ড ঘটিয়েও এমন ভাব করে যেনো কিছুই হয়নি।
বৃষ্টি চুপচাপ খেতে লাগলো,সাব্বির দেখলো মুগ্ধ নয়নে।বৃষ্টি, নেহা,জেরিন তিনজনই তার কাছে কলিজার টুকরার মতো।দুই বোনের এতো ভালো জীবনসঙ্গী পেয়েছে দেখেই হৃদয় খুশির আবেশে পুলকিত হলো।জেরিনের জীবনেও একজন ভালো মানুষ আসুক এই দোয়াই করে।তারা সব ভাই বোন এক কখনো চাচাতো ভাই বোন হিসেবে নিজেদের মনেই হয়নি।
মিহিরের খাবার শেষ হতে বৃষ্টি আর ও উঠে গেলো।
,,,,,
,,,তা আমার মেঘবালিকা আপনার মন খারাপ হলো কেনো হঠাৎ?
,,আপনি কথা বলবেন না আমার সাথে।
মিহির বৃষ্টির এক হাত টেনে নিজের হাতের ভাঁজে রাখে।
,,এই অধমের পছন্দ আছে বলতে হবে।তার দেওয়া শাড়িতে তার প্রেয়সীকে একটা চাঁদের কন্যা লাগছে।তা মহাশয়া এই অধম বামুন যে আপনার দিকে হাত বাড়িয়েছে,দিন শেষে পাবে তো আপনাকে?নাকি আপনিও থাকবেন চির অধরা!
বৃষ্টি ধুম করে কি’ল বসালো মিহিরের পিঠে।
,,অসভ্য লোক এখানে এসে এসব বলা হচ্ছে আমাকে?আর কল দিলে যখন কল ধরার সময় হয় না আপনার?আমাকে তো একটু গুরুত্ব ও দেন না আপনি!
,,সত্যি ব্যস্ত ছিলাম তো সোনা,এভাবে রাগ করলে হয়।আচ্ছা এই শেষ আর হবে না এমন, এই দেখোনা কান ধরছি আমি।
জেরিন, সাব্বির এসে যে পিছনে দাড়িয়েছে তা খেয়ালই করে নি এই কপোত-কপোতী।
সাব্বির ইনিয়েবিনিয়ে বললো
,,আমরা কিছুই দেখিনি, তাই না জেরিন আপা?আমরা কি কিছু দেখেছি।
,,জেরিন মাথা দুলালো দু পাশে,যার অর্থ তারা কিছুই দেখেনি।
এদিকে বৃষ্টি পড়েছে মহা লজ্জায়,এভাবে বড় ভাই বোনের সামনে কিনা প্রেম করছিলো,ইশ্!কি লজ্জা এবার এই বিচ্ছু ভাই বোন গুলা তাকে তিন বেলা খাওয়ার মতো করে লজ্জায় ফেলবে।বৃষ্টি কোনো রকম কেটে পড়লো সেখান থেকে।জেরিন,সাব্বির,মিহির হেসে উঠলো স্ব শব্দে।
নিখিলের খাবার এখনো শেষ হয়নি, সে বসেছেই তো শেষে,নিখিল জানে নেহা ঝাল খেতে পারে না।তার পর ও নেহার দিকে হাত বাড়িয়ে বললো খাবি?
নেহা মুখ ঘুরিয়ে নিলো নিখিল,নেহার দিকে ঝুঁকে ফিসফিস করে বললো
,,নিখিলের বউ হয়েছিস একটু আধটু ঝাল খেয়ে প্র্যাক্টিস করা উচিত তোর!
নেহার মুখে হাত রেখে ভর্তা সহ ভাত নেহার মুখে পুরে দিলো নিখিল।নেহা খেয়ে নিলো কোনো মতে,কিন্তু ঝাল টা তাকে ধরেছে ভালো মতো। সামান্য ঝালেই নেহার নাগের ডগা লাল হয়ে উঠেছে।
নিখিল আরেক হাতে দইয়ের গ্লাস এগিয়ে দিলো ওর দিকে।নেহা আর এক মুহূর্ত ও বসলো না এখানে,
টয়া দেখলো ক্ষু’ব্ধ নয়নে।তার বুঝতে বাকি নেই নেহা আর নিখিলের মধ্যে কিছু একটা আছে।তবে যাই থাকুক নিখিল শুধু তার, যে কোনো মূল্যে নিখিলকে তা চাই!
সেদিনের মতো ওরা বাড়ি ফিরলো,রাত নয়টায় বাড়ি ঢুকেছে সবাই মিহির হেলেদুলে নিজের বাড়ি চলে গেলো পাশাপাশি বাড়ি হওয়ায় ওতোটাও বেগ পেতে হয়নি তাকে।
——–
তিন দিন কেটেছে খুব সুন্দর ভাবে বিশেষ করে নেহার,টয়া ওইদিনের পর আর নেহাকে বিরক্ত করেনি।অযথা প্রশ্ন করে মাথা খায়নি।
তবে টয়া মেয়েটা যে মোটেও সুবিধার না তা বেশ বুঝেছে তারা।
সকালে খাবারের পরই সেতারা বেগম এসে বসলেন। টয়া ঠিক এসে ওর পাশে ঘাপটি মেরে বসলো।
সেতারা বেগমের কানে তুললেন এক মুখ্যম কথা।সেতারা বেগম এমনিতেই নাতনিদের হাতের কাজ নিয়ে খুঁত খুঁত করেন এখন যেনো পেয়ে বসলেন টয়ার কথায়।
টয়া বললো নানু আমরা সবাই মিলে একটা রান্না কম্পিটিশন করলে কেমন হয়,একজনকে জাজ দিবে, দেখবে কার হাতের টা বেশি মজা হয়!
সেতারা সেই মতো নাতনিদের কে ডাকলেন সাথে আসলেন তার তিন বউমা।আজ ছোটরা রান্না করবে তাই গৃহিণীরা ছুটি নিবে, মেয়েদের হাতের খাবারই খাবেন আজ।তারাও মত দিলেন এতে।
নিখিল সিঁড়ি বেয়ে নেমে আসলো,নেহা আর বৃষ্টির দিকে তাকিয়ে বললো
,,দুইদিন পর পরীক্ষা এখন এসব রান্না করার ভুত চেপেছে কার মাথায়, চুপচাপ গিয়ে পড়তে বস।
সেতারা নাকচ করে বললেন
,,না না দাদু ভাই আজ তোমার কথা শুনতে পারবো না আমি।পরীক্ষা তো আরো দেঢ় মাস বাকি, আর এরা তো পড়েই সারাদিন একদিন না পড়লে তেমন কোনো ক্ষ’তি হবে না!
সাব্বির এসে বললো ওয়াও!আমি ও অংশগ্রহণ করতে চাই,তবে শুধু ডিম ভাজতে পারি আমি।একবার খেলে ছয়বার হাত চাটবে তোমরা।
সাহারা হেসে ফেললেন,ছেলেটাও হয়েছে।তাহমিদা বললেন
,,ঠিক আছে তুইও ডিম ভাজ, দেখি কয়বার হাত চাটতে পারি আমরা।
নিখিল কড়া ভাষায় বললো এই নেহা হাতের সেলাই খুলেছিস সবে এখন এসবে যাবি না তুই।
টয়া পিন মেরে বললো,আমি তো শুনলাম নেহা রান্না তেমন জানে না, আপনি জেনে বুঝে নেহাকে বাঁচিয়ে দিচ্ছেন না তো?
নেহা এবার রেগে গেলো,তেতে উঠে বললো
,,এমন ভাব করছো সব শুধু তুমি একাই পারো।আমি কম পারি কিন্তু যতটুকুই পারি তা বেশ ভালো করেই পারি!
একটা একটা আইটেম রান্না করবে সবাই।
টয়া বলে উঠলো-, আমি কাচ্চি রান্না করবো।
সাব্বির নাক কুঁচকে বললো,এসব খাসি খাই না আমি, এটা তো খাবো না আমি।জেরিন বললো,আমি ভুনা খিচুড়ি রান্না করবো তাও খাসি দিয়ে আজকে দেখবো তুই খাসি না খেয়ে কই যাস!
সাব্বির ভাব নিয়ে বললো -, যে আমাকে খাসি খাওয়াতে পারবে তাকে আমি দুহাজার দিবো সাথে আইসক্রিম ট্রিট দিবো।
নেহা বললো আমি নুডুলস রান্না করবো গরু দিয়ে তুমি চিন্তা করো না ভাইয়া তোমার জন্য তোমার বোন আছে!
সাব্বির গদগদ হয়ে বললো
,,নেহা বইন তুই একমাত্র আমার আসল বইন বাকি সব ঘসেটি বেগম!
টয়া বেশ খুশি নেহা গরির মাংস রান্না করবে মানে নিখিল তা খাবে না, নিখিলের যে গরুতে এলার্জি তাই তো বুঝে শুনে সে কাচ্চি রান্নার কথা ভেবেছে!
নিখিল দাঁত চেপে দাড়িয়ে আছে,রেগে তাহমিদা বেগমের দিকে তাকিয়ে বলে
,,ছোট মা তোমার মেয়েকে মানা করো বলছি,অযথা জে’দ করছে।হাত জ্বলবে ওর!
নেহা হাসি দিয়ে বললো, তাহলে চলুন আপনি পেঁয়াজ,মরিচ,টমেটো, ধনেপাতা কুচি করে দেন।আমার আর হাত জ্ব’লবে না।সাব্বির ভাইয়া তো ডিম ভাজবে আপনি কেনো বাদ থাকবেন।আপনার কাজ হলো এগুলা করে আমাকে সাহায্য করা।এতোই যখন চিন্তা হচ্ছে আপনার আমার জন্য।
কথাটা বলে থেমে থাকেনি নেহা, নিখিলের বাহু চেপে তাকে টেনে নিয়ে যাচ্ছে রান্না ঘরে।
হামিদা বেগম বললো–, ঠিকই তো যা যা নিখিল।
,,আমি অফিস যাবো মা, তুমি এর সাথে যোগ দিচ্ছো কেনো?নেহা ছাড় আমাকে ভালো হবে না বলছি!
নেহা রান্না ঘরে গিয়ে থামলো,নিখিল কে রেখে সে চুলার পাশে খালি জায়গায় উঠে বসলো।নিখিলের দিকে দাঁত কেলিয়ে তাকিয়ে থেকে বললো
,,আপনি কি পারেন না?ছি!ছি! নিখিল ভাই দ্যা গ্রেট নিখিল মেহমেত চৌধুরী সামান্য পেঁয়াজ, মরিচ কাটতে পারে না!
নিখিল শার্টের হাতা গোটালো,নেহার দিকে এগিয়ে গেলো অনেকটা, নেহা মাথা এলিয়ে পিছিয়ে গেলো।নিখিল নেহার দিকে আরো ঝুঁকে যেতেই নেহা চোখ বন্ধ করে ফেললো।নিখিল নেহার মুখের উপর ফু দিয়ে ওর পেছন থেকে চপিং বোর্ড টা টেনে বের করলো।নিখিল সরে এসে ঠোঁট কামড়ে হাসলো,নেহা তিন বার বুকে থু থু দিয়েছে,আল্লাহ এই ছেলে কবে জানি তাকে হার্ট অ্যা’টাক করিয়ে ছাড়ে!
নিখিল যা যা লাগবে এনে কাটা শুরু করলো।নেহার দিকে না তাকিয়েই বললো
,,আমাকে দিয়ে তুই আর কি কি করাবি নেহা?
নিখিল সত্যি নেহার কথায় কাজ করে কিনা তা দেখতে সবাই দরজায় আড়ি পেতেছে,ছোটদের সাথে হামিদা,সাহারা, তাহমিদাও যোগ দিয়েছে।
হামিদা অবিশ্বাস্য চোখে ছেলের গুপ্ত প্রতিভা দেখছে, নেহার মুখ যে হা হয়েছে কখন তা আর বন্ধ হয়নি।নিখিল ভাই তার এক কথায় রান্নাঘরে এসে এই কাজ করছে!আল্লাহ আর কতো অবাক হওয়া বাকি আছে তার।
হামিদা বেগম তো তাহমিদা বেগম কে বলেই ফেলেছে
,,তোর মেয়ে সত্যি যা দু জানেরে ছোট,আমার এই তেঁদড় ছেলে কে দিয়ে রান্নার কাজ করাচ্ছে,এর বাপকেও একবার আনতে পারিনি এখানে আমি!
চলবে?