প্রণয়ের সুর পর্ব-০৮ এবং বোনাস পর্ব

0
15

#প্রণয়ের_সুর
#পর্ব৮
#মহুয়া_আমরিন_বিন্দুু
এই তোমরা সবাই এভাবে চোরের মতো উঁকি ঝুঁকি মারছো কেনো?দরকার পড়লে ভিতরে এসে দেখো,আমিও কিন্তু ভালোই পারি!

নিখিলের সম্পূর্ণ মনোযোগ চপিং বোর্ডের দিকে একবার ও তাকায়নি দরজায়, তাহলে বুঝলো কিভাবে তারা যে এখানে ঘাপটি মেরে আছে,প্রত্যেকে ধরা পড়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলো।তাহমিদা,সাহারা,হামিদা আগে ভাগলেন,ছেলের যে মুখে কিছু আটকায় না শেষে দেখা যাবে ছোটদের সামনে লজ্জায় পড়তে হলো।
সাব্বির, জেরিন কিছু না দেখার ভান করে বললো

,,কে আবার দরজায় উঁকি দিবে ভাইয়া, তুমি যে কি বলো না আমরা তো দেখতে আসলাম তোমার হলো কিনা আমরাও তো প্রতিযোগী!

নিখিল আর কিছু বললো না নেহা তো ভোঁতা মুখে দাড়িয়ে আছে এক পাশে,এতো ভালো পেঁয়াজ কুঁচি ও নিজেও করতে পারে না!এই পোলা এসব কখন শিখলো?নেহা এক হাত গালে ঠেকিয়ে ভাবনায় বিভোর, নিখিল গম্ভীর কন্ঠে বললো

,,এই যা এবার রান্না শুরু কর, আমি এখানেই থাকবো রান্না শেষ না হওয়া পর্যন্ত!

,,কেনো কেনো আপনি আবার সব ক্রেডিট নিজে নিতে চাইছেন না তো নিখিল ভাই?আপনার তো দেখছি মতলব খা’রাপ।

,,কি বললি তুই আমার মতলব খারাপ? তা খারাপের কি করেছি আমি?ক্রেডিট নেওয়ার কি আছে এখানে, তুই আর আমি তো একই,তোর যা তা তো সব আমারও!

ঠিক তো হাত পু’ড়াবি তোকে চিনি না আমি।যা তো নিজের কাজ কর!
নিখিল শার্টের দুইটা বোতাম খুলে বললো
,,ইশ্! কি গরম এখানে।

নেহা ব্যস্ত ভঙ্গিতে বললো
,,আপনি বাহিরে চলে যান নিখিল ভাই,আমি বাকিটা করে নিচ্ছি!

নিখিল কথা শোনার পাত্র নয়,সে দেয়ালে ঠেস দিয়ে দাড়ালো,নেহা পানির পাত্র বসিয়ে তাতে নুডুলস সিদ্ধ করতে দিলো মসলা কাটার জন্য হাতে কাঁচি নিতেই, হাত থেকে তা ছোঁ মেরে নিয়ে নিলো নিখিল।

,,কেটে দিচ্ছি আমি!
নুডুলস ছাকার সময়ও নিখিল নেহা কে সরিয়ে দিলো।

নেহা মুখ বাঁকিয়ে বললো
,,সব নিজে করলেই তো পারেন আজব লোক!

,,এই একদম চুপ,হাতে ভাপ লেগে যাবে তোর।

বৃষ্টি, জেরিন,সাব্বির দেখছে আর বলছে
,,বাহ্! ভাই কি প্রেম,হাত জ্ব’লে যাবে, ভাপ লেগে যাবে।আমার বউয়ের গরম লেগে যাবে, তোমার যা আমারও তা!
বলছে আর মিটি মিটি হাসছে,নেহা আঁড়চোখে একবার এদের দিকে তাকালো,জেরিন তো নেহা কে দেখেই চোখ টিপ মেরে দিলো,এদিকে নেহা,নিখিল রান্না ঘরে কি করছে তা দেখার সুযোগ পাচ্ছে না টয়া,সেতারা বেগম তাকে বসিয়ে গল্প করছে,কি কি রান্না পারে, আগের দিনে কিভাবে রান্না করা হতো এসব বলছে,টয়া বিরস মুখে হুঁ হ্যাঁ করছে,বলতেও পারছে না উঠে যাওয়ার কথা।রান্নাঘরের বাহিরে সাব্বির জেরিনের হাসাহাসি শুনেই বুঝতে পারলো রান্না ঘরে নিশ্চয়ই কিছু একটা হয়েছে।

দীর্ঘ পয়তাল্লিশ মিনিট পর রান্না ঘর থেকে বের হয়েছে দুজন,নিখিলের অবস্থা সূচনীয়, ঘেমে জুবুথুবু হয়ে গেছে।শার্ট লেপ্টে গেছে গায়ে,কপাল গড়িয়ে ঘাম পড়ছে,নিখিল বেরিয়ে এসেই নেহার পেছনে দাড়ালো ওর ওড়নায় নিজের মুখ মুছে ফেললো!

টয়া স্পষ্ট দেখলো সেসব,নেহা তো চ’টেছে বেশ,নাকের আগায় রাগ ঝুলিয়ে বললো
,,আপনার কি টিস্যু,তোয়ালে, গামছা এসবের অভাব পড়েছে?আমার ওড়নায় কি পেয়েছেন, যত্তসব!

নিখিল নেহার কপালের সাথে লেপ্টে যাওয়া চুল গুলো সরিয়ে দিতে দিতে বললো

,,মধু!

নেহা চলে গেলো সেখান থেকে।সোফায় বসে পড়লো অলস ভঙ্গিতে, নিখিল গিয়ে ওর পাশে বসলো
নেহা সরে গিয়ে বললো
,,দূরে গিয়ে বসুন,এমনি গরম জায়গার কি অভাব পড়েছে নাকি ভাই!
নিখিল দাঁতে দাঁত চেপে বললো
,,আমি তোর ভাই?তোর ব্রেন এতো ডাম কেনো নেহা?কিছু মনে থাকে না আজকাল!

নেহা দ্বিগুন বিরক্তি নিয়ে বললো
,,আমি কিছুই ভুলি নাই আপনি আমার একমাত্র চাচাতো জামাই,আর আমি আপনার নাম মাত্ররো বউ!

নেহা উঠে ফ্রিজের কাছে গেলো,রান্না ঘরে গিয়ে সরবত বানিয়ে নিলো এক গ্লাস।
রান্নাঘরে এখন হাম’লা চালাচ্ছে সাব্বির আর জেরিন,একটা ডিম ভাজতে নাজেহাল অবস্থা সাব্বিরের,বেচারা সৌন্দর্য বাড়াতে ডিমের উপর টমেটো কুঁচি দিয়েছে,এবার আর উল্টাতে পারেনি গেছে মাঝখান দিয়ে ভেঙে, তা দেখে জেরিন দুনিয়া কাঁপিয়ে হেসে দিলো।সাব্বির রেগে আলু ছুঁড়ে মেরেছে জেরিনের উপর,বৃষ্টি এসব দেখে বেরিয়ে গেছে এদের সাথে রান্না করা যাবে না,দুই পাগ’ল একসাথে ঢুকেছে।
সাব্বির নিজের ভাঙা চূড়া ডিম ভাজা এনে টেবিলে রাখলো,প্লেটিং এ কমতি রাখেনি কিছু,সস দিয়েছে তার উপর একটা আস্ত ধনেপাতা বসিয়ে দিয়ে,দু হাত উচিয়ে বললো
,,আহা আমার সাধের ডিম ভাজা তোর উপর যেনো কোনো শকু’নের নজর না পড়ে,আমি জানি তুই পাবি বিজয়ের মুকুট!
সাহারা কপাল চাপড়ালো, রান্নার চক্করে ছেলেটার আজ মাথার তাড় ছিঁড়ে গেছে।
,,,,,,,,
নেহা সরবত নিয়ে সোফায় বসতেই তাতে টান বসালো নিখিল!নেহা তো আঁতকে উঠলো,সে এই সরবত নিখিল কে কিছুতেই দিবে না,নিখিল ভ্রুকুটি করে বললো

,,নেহা তুই ছোট মানুষ আমাকে দে এটা!

,,ছোটদের হাতের বানানো সরবত খেতে আপনার কষ্ট হবে নিখিল ভাই,নিজের টা নিজে বানিয়ে খান।

নিখিল দিচ্ছে এক দিকে টান নেহা একদিকে,নেহা এবার নিখিলের হাতের উপর রেখেই অর্ধেক খেয়ে ফেললো,
নেহা বাকিটা খাওয়ার আগেই নিখিল নিয়ে খেয়ে ফেললো।
নেহা নাক মুখ কুঁচকে বললো–,আপনি আমার মুখের আধ খাওয়াটা খেয়েছেন কেনো?ওয়াক থু থু!

সাব্বির সবে মুখে পানির গ্লাস তুলেছে,হামিদা বেগম এসে বলে,খেয়েছে তো কি হয়েছে,খাবার ভাগাভাগি করে খেলে ভালোবাসা বাড়ে বুঝলি!
সাব্বিরের নাকে মুখে পানি আটকে যা তা অবস্থা খুক খুক করে কেশে উঠেছে বেচারা।
নেহা কাচুমাচু হয়ে সেখান থেকে কেটে পড়লো,তার মা আর বড় মার কি হচ্ছে কে জানে,কি সব বলে যখন তখন!

জেরিন রান্না শেষে দমে বসিয়ে বেরিয়ে আসলো,বৃষ্টি, টয়া এবার রান্না করছে।বৃষ্টি বানিয়েছে পায়েস,এটা ওর যেমন পছন্দ তেমন রান্না ও করে ভালো।

——–
দুপুরে সবাই এসে হাজির খাবার টেস্ট করবে একজন।সেতারা বেগম বসলেন চেয়ারে,তিনি বললেন নিখিল তুই টেস্ট করে বলবি কারটা বেশি ভালো হয়েছে!
নিখিল, বুকে দুহাত ভাজ করে রেখে বললো

,,এসব ঝামে’লায় আমাকে ফেলবে না দাদী,এমনিতে এদের এই রান্নার চক্করে আফিস যেতে পারিনি আমি।
বাপ চাচার অফিস বলে চাকরিটা আছে না হয়,যা একটা জুটেছে কপালে দুইদিন পরই চাকরি থেকে তাড়িয়ে দিতো কতৃপক্ষ!

নেহা চোখ সরু করে দেখলো একবার,এই লোক ঠিক ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে তাকে খোঁচা মেরে দিলো!

তাহমিদা,হামিদা,সাহারা বসলেন,চেয়ার টেনে।আজ শাহআলম চৌধুরী আসতে পারেনি দুপুরে নিখিল যায় নি অফিসে তাকেই সামলাতে হচ্ছে বাকিটা।
সেতারা বেগম,কড়া করে বললেন
,,নিখিল তোকে যা বলেছি কর,না শুনতে চাই নি আমি।এটা আমার নির্দেশ!

নিখিল দাদীর কথা সচারাচর কখনোই অমান্য করে না।
প্লেটে প্রথমেরই একটু ডিম ভাজা উঠিয়ে দিলো সাব্বির,ভাব খানা এমন পোলাও কোরমা দিয়েছে পাতে!
সাব্বির গদগদ হয়ে বললো–,,বলো ভাইয়া কেমন হয়েছে,তোমার উপরই নির্ভর করে পুরুষজাতির রান্নার মান!
নিখিল ডিম ভাজা মুখে তুলে নিলো,কাঁচা টমেটো মুখে গিয়েই কেমন ক্যাচ ক্যাচ করে উঠলো, নিখিল মুখের ভঙ্গিমা একটুও পাল্টায়নি চুপচাপ গিলে নিলো পানসে ডিম ভাজা!
পরে নিলো এক চামচ খিচুড়ি, খাওয়া শেষে জেরিনের দিকে তাকিয়ে বললো

,,,যাক এবার নিশ্চিত, শ্বশুর বাড়ি গিয়ে নাক কাটাবি না আমাদের!খেতে ভালো হয়েছে।

বৃষ্টি কে বললো তোরটা শেষের আইটেম অপেক্ষা কর।

টয়া ভেবেই নিয়েছে গরুর মাংসে রান্না করা কিছু নিখিল খাবে না।তাই হাত উঁচিয়ে কাচ্চি দিতে নিলেই।
নিলিখ প্লেট ভর্তি করে নুডুলস নিলো!
নেহা ভাবলেশহীন ভাবে বসে আছে,নিখিল আজকে যাই করুক সে ভেবে নিয়েছে কিছু বলবে না, কোনো প্রতিক্রিয়াই দেখাবে না,নিজেকে ব্যস্ত রাখতে চেয়ারে বসে মোবাইল চালাচ্ছে একবার তাকালো আঁড়চোখে।

টয়া আবারও নির্লজ্জের মতো বললো
,,নিখিল ভাই আপনি ওটা খাচ্ছেন কেনো?ওটাতে গরুর মাংস আছে!আপনার শরীর খারাপ করবে।

তাহমিদা নেহাকে বিরক্তি নিয়ে বললো
,,ওই গা’দা কান্ডক’জ্ঞান নেই তোর সবাই খাসির মাংস দিলো তুই গরুর মাংস দিলি কোন বুঝে?

নেহা ফোনের দিকে তাকিয়ে বললো
,,ওফ!মা তুমি এতো ভুল করো কেনো বলো তো ওটা গা’দা হবে না গা’দী হবে।আর গরুর মাংস দিয়েছি আমার ইচ্ছে হয়েছে তাই, কাউকে তো জোর করিনি আমি খাওয়ার জন্য!

নিখিল চামচ ভর্তি করে মুখে নিয়ে নিলো,সেতারা কিছুটা রেগে বললো–, এ কেমন কাজ দাদু ভাই জেনেশুনে নিজের জন্য ক্ষ’তিকর কিছু খাবে কেনো তুমি?

নিখিল নেহার দিকে তাকিয়ে বললো
,,জেনেশুনেই কিছু বি’ষ পান করতে হয় দাদী!

তাহমিদা মুখ খুললেন নিখিল কে না খেতে বলার জন্য, হামিদা বেগম তাকে থামিয়ে বললেন,এটা ওদের ব্যাপার মাঝে কিছু বলা উচিত না আমাদের!

সেতারা বেগম নাকোচ করে বললেন,, আর খাবে না তুমি।
,,দুইটা ট্যাবলেট খেলেই যদি কারো মুখের হাসি দেখতে পাওয়ার সৌভাগ্য হয় তো, এরকম খাবার আমি বার বার খেতে রাজি!

সাব্বির বললো আমার পেটে ইদুর নাচাতেছে জেরিন বইন সরি তোর টা খেতে পারলাম না, নেহা বইনের থেকে কিছু খাবার তুলে দে আমাকে!

,,সাব্বির তৃপ্তি সহকারে খেলো।
সাব্বিরের খাওয়া শেষ হতেই নেহা চেয়ার ছেড়ে উঠে বসলো।
সাব্বিরের সামনে গিয়ে বললো,,এবার দাও আমার পাঁচ হাজার!
থতমত খেয়ে গেলো সাব্বির বৃষ্টি, জেরিন টয়া তাকালো চোখ ছোট করে, নিখিল সহ বাকিরাও!
সাব্বির বুঝতেই পারেনি কি বলছে নেহা

,,কিসের টাকা নেহা বইন?

,,কিসের আবার তখন বললে না যে আজকে তোমাকে খাসির মাংস খাওয়াতে পারবে তাকে পাঁচ হাজার টাকা দিবে সাথে আইসক্রিম ট্রিট।এখন দেও,পুরো এক প্লেট নুডুলসে কম হলেও ছোট ছোট বিশ পিছ মাংস ছিলো।এবার ফটাফট আমার টাকা আমাকে দিয়ে দেও!

সাব্বির জোরে চেঁচিয়ে বললো –,ধোঁকা! আমাকে এভাবে ধোঁকা দিলি তুই নেহা।অবিশ্বাস্য, আল্লাহ! কি চিটিং’বাজ তুই নেহা।আমি এসব মানবো না মানি না।কোনো টাকা নেই আমার কাছে!

,,এখন এসব বলে লাভ নাই, টাকা দিতে হবে মানে দিতে হবে।দেখছো মেজো মা তোমার ছেলে কথা দিয়ে কথা রাখে না। টাকা দিতে বলো বলছি তোমার ছেলেরে!

সাহারা বললো–, দিয়ে দে সাব্বির এবার। একদম বেশ হয়েছে,আরো গিয়ে চ্যালেন্জ কর আর এভাবে মর!এখন কথা হচ্ছে আইসক্রিম কিন্তু সবাই কে খাওয়াবি তুই বাড়ির সবাইকে বুঝেছিস!

,,মা,,,,! না না তুমি আমার মা হতেই পারো না,এভাবে আমাকে ফকির করে দেওয়ার ধান্দা। আল্লাহ তুমি এর বিচার কইরো।নেহা বইন তোরে বিশ্বাস করছিলাম,তুই বিশ্বাসের ঘরে চুরি করলি।তোর সাথে আমার আর কোনো কথা নাই!

নেহা মাছি তাড়ানোর মতো করে বললো
,,আচ্ছা কথা না বললে নাই,আপাতত টাকা দিলেই হবে।

জেরিন বললো–, নেহা আয় বইন বুকে আয়,এই ছাগ’ল কে হারানো তোর দ্বারাই সম্ভব।আমি সত্যি গর্ব বোধ করছি তোকে নিয়ে।

নিখিল এখনো তাকিয়ে আছে,এই মোটা মাথায় যে এতো চিকন বুদ্ধি নিয়ে ঘুরে বুঝাই যায় না,তার বউটা আসলেই একটা চিজ!

নিখিল দুই চামচ পায়েস খেলো,উঠে গিয়ে বললো, অনেক খেয়ে ফেলেছি আজকে।এবার আর পারবো না।
আজকের বিজয়ী সাব্বির,,,
নিখিলের কথা শেষ না হতেই সাব্বির উচ্ছসিত কন্ঠে বললো
,,টাকা যাওয়ার শোক আমি ভুলে গেলাম,নিজের হাতে বার কয়েক চুমু খেয়ে বললো,আমি তো জানতামই না আমার রান্নার হাত এতো ভালো!

নিখিল তপ্ত শ্বাস ছেড়ে বললো
,,তোরটা কুখা”দ্যের দিক দিয়ে প্রথম!
খাবার টেবিলে সবাই জোরে হেসে দিলো,সাব্বির মুখ ছোট করে ভাব নিয়ে বললো

,,তোমরা বুঝলে না এই প্রতিভা।কোনো ব্যাপার না!

টয়া আর দ্বিতীয় বার বলার সুযোগ পেলো না তার খাবার টেস্ট করার কথা,নিখিল দ্রুত পায়ে চলে গেছে রুমে।বাকি বড়রা সবাই চারজনের খাবারের প্রশংসাই করেছে।
———
রাতে নেহা প্রচুর বিরক্ত ম্যাথটা করলো তিনবার মিললো নাই,রুম থেকে বের হয়ে আসলো ততক্ষণাৎ।দরজা দিয়ে বেরিয়ে ওর পা থমকে গেছে রীতিমতো,,

,,টয়া নিখিল কে ঝাপটে জড়িয়ে ধরে দাড়িয়ে আছে!

নেহার মনে হলো ওর বোধবুদ্ধি লোপ পেয়েছে, একবারের জন্য চিন্তা করতে পারলো না সে ভুল দেখছে,নিখিল ভাই যখন হাতটা টয়ার বাহুতে হাত রাখলো নেহার মনে হলো ওর কলিজায় কেউ লবণ ছিটিয়ে দিয়েছে!যন্ত্র*ণায় ভিতরে ভিতরে মুষড়ে উঠলো, ভিতর থেকে আত্ন চিৎকার শুনতে পাচ্ছে নেহা।
নিখিল ভাইয়ের প্রেমিকা টয়া!তাহলে তার সাথে এতোদিন কি করলো নিখিল ভাই?সব কিছুই কি দেখানো?ক্ষনস্থায়ী!এর জন্যই কি টয়া সব সময় নেহাকে এতোগুলা কথা শুনানোর অধিকার রাখে।
নেহা উদভ্রান্তের ন্যায় দৌড়ে রুমে চলে গেলো।
টেবিল হাতরে গ্লাস নিয়ে ঢকঢক শব্দ করে পানি খেয়ে ফেললো,বড় বড় শ্বাস নিতে থাকলো,চারপাশ কেমন অন্ধকার মনে হচ্ছে তার!টেবিলে গ্লাস রাখতে গিয়েও হাত ফসকে পড়ে যায় নিচে,শব্দ করে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে যায় গ্লাসটি।নেহা নিথর রক্তশূণ্য চোখে দেখে তা।তার হৃদয় টাও ঠিক এভাবে ভেঙেছে আজ!

ভালোবাসার মানুষের আসেপাশে কারো ছাঁয়া ও সহ্য করার ক্ষমতা নেই কারোর,আর সেখানে প্রিয় মানুষ টার বুকে অন্য নারীকে দেখে কিভাবে ঠিক রাখা যায় নিজেকে?নেহা নিজেকে ধাতস্থ করে নিলো খুব তাড়াতাড়ি, সে তো জানতো এমন একদিন আসবে,নিখিল ভাইয়ের ভালোবাসার মানুষের সামনা তাকে একদিন করতেই হবে।তবে কেনো আজ শুধু নিজের টা ভেবে স্বার্থপর হতে চাচ্ছে তার মন!
নিখিল ভাই যদি তার ভালোবাসার মানুষের সাথে সুখে থাকে তো নেহা ও চায় সে ভালো থাকুক।নেহা কোনো দিন বাঁধা হয়ে দাঁড়াবে না।
পৃথিবীতে সবাই সব কিছু পেয়ে গেলে শূন্যতারা যে হারিয়ে যাবে!শূন্যতারা যে কোনো দিন হারিয়ে যাবে না এটা চিরন্তন সত্য,তাহলে কিভাবে ভাবে মানুষ সে যা চাইবে তাই পাবে?শূন্যতা হাহাকার জীবনের একটা গুরুত্বপূর্ণ অংশ কারো জীবনে আসে সাময়িক ভাবে, কারো জীবনে থাকে আমৃত্যু!
——–
,,হোয়াট দ্যা হেল,,,,,তোর সাহস কি করে হয় আমাকে জড়িয়ে ধরার!
নিখিল এক প্রকার ধাক্কা দিয়ে দূরে সরায় টয়াকে। মেয়েটা সীমা অতিক্রম করে ফেলেছে!

টয়া মাথা নিচু করে মিনমিন করে বলে–,ভাইয়া আমি ভয় পেয়ে গেছিলাম,ওই অন্ধকারে কিছু একটা ছিলো।

,,আমাকে ব’লদ মনে হয় তোর?সারাবাড়ির কোনায় কোনায় লাইটিং করা,ইলেকট্রিসিটি যায়নি, তুই ইচ্ছে করে এমনটা করেছিস?কেনো?তোকে যে চ*ড়িয়ে ঠিক করে দেয়নি এখনো এটাই আমার ভুল।মেয়ে মানুষ না তুই লজ্জাশরম বলতে কিছু দেয়নি তোকে সৃষ্টিকর্তা!

,,সত্যি বলছি ভাইয়া, ভুল হয়ে গেছে সরি।টয়া এমন ভাব করলো সে অনুতপ্ত।
মিহির এবার এগিয়ে আসলো,অনেকক্ষণ আগেই এসেছে সে, নিখিল অফিস না যাওয়ায় গুরুত্বপূর্ণ ডিল সম্পর্কে জানাতেই এসেছে সে।নিখিলের হাত ধরে রুমের দিকে টেনে নিয়ে গেলো।
নিখিল চলে যেতেই টয়া বাঁকা হাসলো,সে এসব ইচ্ছে করে করেছে,নেহাকে বের হতে দেখেই নিখিল কে জড়িয়ে ধরে সে।নেহার সাথে যদি নিখিলের কিছু থেকেও থাকে তা এবার শেষ।
——–
মিহিরের কন্ঠ বেশ চড়াও, রেগে আছে পুরো ছেলেটা
গমগমে কন্ঠে বললো
,,এই মেয়েটা আর কয়দিন থাকবে এখানে?বের কর না হয় নেহা কে চিরতরে হারাবি তুই নিখিল।

মিহিরের কন্ঠে কোনো দুষ্টুমি নেই ছেলেটা বেশ গুরুতম ভঙ্গিতে কথা বলছে আজ।

,,কি বলছিস এসব।কি এমন হলো?

,,তুই কি সত্যি বুঝতে পারছিস না নিখিল,টয়া মেয়েটা তোকে পছন্দ করে,নেহা কে ও হিং’সা করে,নেহার ক্ষ’তি করে দিতেও দুবার ভাববে না এই মেয়ে। কতোদিন এভাবে অন্যের বাড়ি পড়ে থাকবে? এর বাবা মায়ের কোনো খবর নেই নাকি মেয়ে কি করছে না করছে।
আজকে যা করলো তুই তা কিভাবে সামাল দিবি জানি না আমি!

,,কি করেছে?

,,নেহা কে দেখেই ইচ্ছে করে তোকে জড়িয়ে ধরেছে নিখিল বুঝতে পারছিস তুই?নেহা ওখান থেকে যেভাবে চলে গেলো মনে তো হয় না স্বাভাবিক ভাবে নিয়েছে,আর নেওয়ার কথাও না। নেহার তোর বউ, স্বামীর ভাগ কোনো মেয়েই অন্য কে দিতে পারে না।তুই যদি নেহাকে ওভাবে দেখতি রিয়েক্ট না করে থাকতে পারতি?
মিহির অধৈর্য কন্ঠে আবার বললো–, মেয়েটাকে যেভাবে হোক সকালের মধ্যে বিদায় কর।না হয় পরবর্তীতে কিছুই করার থাকবে না।
_______
নেহার মধ্যে কোনো পরিবর্তন নেই,সে আগের মতোই নিয়ম করে সকালে নেমেছে,সবার সাথে কথা বলেছে,টয়া ভড়কালো কিছুটা মেয়েটা এতো স্বাভাবিক কেনো?ওর তো কেঁদে কেটে ভাসিয়ে দেওয়ার কথা।

নেহার মনের খবর তার প্রাণ প্রিয় বান্ধবী কেও সে জানায়নি,এই বিষয়টা জানানোর কি আছে?কষ্টের কথা কাউকে বললে কি তা কমে যাবে নাকি!নিজের টা নিজেকেই সামাল দিতে জানতে হয়।
তাহমিদা বেগম বুঝে গেলেন মেয়ের সুক্ষ্ম হাসির পেছনের বিষন্নতা! মা তো সন্তানের কষ্ট ঠিক আঁচ করতে পেরেছেন।

নিখিল গম্ভীর কন্ঠে বললো
,,তা টয়া বাড়ি যাচ্ছিস কবে,ভার্সিটি খুলবে না তোর?অনেক দিন তো হলো তোদের ভার্সিটি তো দেখছি অনেক দিন বেশি ছুটি দেয়!

টয়া বুঝতে পারলো নিখিল তাকে তাড়াতে চাইছে।টয়া ধীর কন্ঠে বললো–, দুইদিন পর চলে যাবো ভাইয়া!

নিখিল নেহার দিকে খেয়াল করলো,মেয়েটা মনোযোগ দিয়ে খাবার খাচ্ছে কারো দিকে তাকালো না পর্যন্ত,নিখিল আঁতকে উঠলো এবার, নেহার হাতের ক্ষ’ত
এখনো শুকায়নি ঝোলে হাত বেশ মাখিয়েছে, পরোটা খাচ্ছে নিজ মনে।নেহা মুখে খাবার দিতে নিলেই নিখিল হাতের কবজিতে ধরে আটকে দিলো

,,কি করছিস নেহা?হাত জ্বল’ছে না তোর!যা হাত ধুয়ে আয়।এখানে সবাই আছে কাউকে বললেই তো খাইয়ে দিতো।

নেহা মৃদু হাসলো,,
,,সমস্যা নেই ভাইয়া আমার হাতে কিছু হয়নি,সামান্যই তো জ্ব’লছে না একদম।আর কতোদিন সবার হাতে খাবো বলো,রোজ রোজ কাউকে না কাউকে বিরক্ত করতে ভালো লাগে না আমার!
এমনিতেও সবাই বিরক্ত হও আমার কাজে।তাই ভাবলাম এখন থেকে কম জ্বালা’বো তোমাদের।

সেতারা বেগম কঠিন কন্ঠে বললেন
,,যাক অবশেষে মাইয়াটার মতিভ্রম কিছুটা কমলো!বুঝদার হইতাছে।

নেহা নিজের হাত ছাড়িয়ে নিয়ে,খেতে লাগলো নেহার হাত এখন বরফে চুবিয়ে রাখতে ইচ্ছে করছে,তবুও তার কাছে এই কষ্টটা সামান্য মনে হচ্ছে, এর থেকে বেশি পুড়’ছে ওর হৃদয়। ওই ব্যাথাটা আপনার চোখে পড়লো না নিখিল ভাই?বাহ্যিক সব কিছুই তো মানুষ দেখতে পায়,অন্দরমহলের খবর টা কেনো কেউ রাখে না।

নেহা সারাদিন বইয়ে মুখ ডুবিয়ে রাখছে,বৃষ্টির সাথে টুকটাক কথা বলছে,কারো সাথেই প্রয়োজনের বেশি কথা বলেনি।নিখিলের রুমে যায় নি দুইদিন,রুম থেকে বের হয়নি।
পরের দিন চলে যাবে টয়া,সন্ধ্যায় নেহা সেতারা বেগমের রুমে গেলো,হামিদা বেগম তাকে পাঠিয়েছে সেতারা বেগমের সন্ধ্যার ঔষধ টা দেওয়ার জন্য!

নেহা রুমে ঢুকেই বললো
,,দাদী তোমার ঔষধ,,,,,
টয়া দাঁত কেলিয়ে হেসে বলে,আরে নেহা যে আমি তো নানুকে ঔষধ দিয়ে দিয়েছি।বুঝলে আগে থেকে দায়িত্ব বুঝে নিচ্ছি!

নেহা ভালো বলে বেরিয়ে যেতে নিলেই টয়া পিছু ডাকলো
,,আরে নেহা বসো না গল্প করি কিছু,সারাদিন তো তুমি পড়াশোনাতেই ব্যস্ত থাকো,দেখলাম নিখিল ভাই তোমার সাথে দুইবার কথা বলতে গেলো তুমি বললে তুমি নাকি ব্যস্ত!

সেতারা বেগম রাগান্বিত দৃষ্টি রাখলো নেহার উপর,তার নাতির বউ হিসাবে মেয়েটা মোটেও যোগ্য না তার তো প্রথম থেকেই পছন্দ না।নাতির খেয়াল ও রাখে না ঠিক মতো,সারাদিন ছেলেটা অফিসে খেটে ম রে আর এই মেয়ে কথা বলার সময়ও পড়াশোনা দেখায়!

নেহা বিরক্তি নিয়ে চেয়ার টেনে বসলো।
টয়া সুর তুলে বললো
,,তা নানু তোমাকে আমার কেমন লাগে?
সেতারা মুখে পান গুঁজে দিয়ে বললো–,কেমন লাগে মানে তুই তো একটা সোনার টুকরা বইন!যেমন রূপ তেমন গুন।তোর মতো মাইয়া পাওয়া ভাগ্যের ব্যাপার।
,,নেহাকে কেমন লাগে নানু?
এমন প্রশ্নে নেহা বিভ্রত হলো।এই মেয়েটা তাকে টানছে কেনো মাঝখানে!
সেতারা বেগম মুখ কুঁচকে ফেললেন।থমথমে কন্ঠে বললেন–, এই অকর্মার ঢেঁকির কথা কেনো জিজ্ঞেস করছিস?কোথায় তুই আর কোথায় এই মাইয়া।চান্দের লগে তুই মাটির তুলনা দিতে কস কোন বুঝে!

,,ও কি আমার থেকেও বেশি সুন্দর নানু?

,,না না তোর মুখে মায়াবী একটা ভাব আছে,আর এ তো সারাদিন রেগে থাকে উড়ন*চণ্ডী একটা।এরে দেখে কোন দিক দিয়া মায়া দয়া আসে!গুনের কথা আর কি কমু কিচ্ছু নাই গটে।

নেহা অপমানে নুইয়ে পড়লো,তার দাদী তাকে এতোটা খা’রাপ ভাবে!একটা বাহিরের মানুষের সামনে এভাবে বলতে পারলো?নেহা ভাবতো হয়তো শুধু মুখে মুখে বলে, মনের দিক থেকে তার দাদী তাকে ভালোবাসে!
টয়া থামেনি প্রশ্নের পর প্রশ্ন করতেই আছে।সেতারা বেগম নেহার পক্ষে একটা কথাও বলেনি!
টয়া বলে উঠলো
,,নিখিল ভাইয়ের বউ করার কথা উঠলে তুমি কাকে বাছতে নানু?
এবার নেহার হৃদপিণ্ডে ঝড় উঠলো এতোক্ষণের জমিয়ে রাখা কান্না যেনো বেরিয়ে আসতে চাইলো।

সেতারা বেগম হেসে বললেন
,,নিঃসন্দেহে তোকে রে টয়া, তোর মতো লক্ষী মন্তর বউ ই তো আমার নিখিলের পাশে মানাবে বেশি!

টয়া গদগদ চন্দ্রিমা হয়ে নেহার দিকে তাকালো, নেহাকে দেখে বুঝার উপায় নেই ওর মনের ভিতর কি চলছে।অবিশ্বাস্য চোখে সে সেতারা বেগমকে দেখতে ব্যস্ত।
নেহা এতোটাই অযোগ্য!
সেতারা বেগম দুঃখ নিয়ে বললো কিন্তু নিখিল টা আমার কথা মানবে না রে এক্ষেত্রে!
,,তোমার কোনো কথা কি নিখিল ভাই ফেলেছে কখনো?এবারও ফেলবে না তুমি নিশ্চিন্ত থাকো!
নেহার দিকে তাকিয়ে সেতারা বেগম মুখ বাঁকিয়ে বললেন জে*দী মাইয়ারা কোনো দিন স্বামী সোহাগি হইতে পারে না।এরা দুইদিন ও সংসার করতে পারে না কিন্তু কেউ বুঝলো না আমার কথাটা!

পর্দার আড়াল থেকে এবার গর্জে উঠলো তাহমিদা।উঁচুতে তার কন্ঠ শাশুড়ী কে মান্য করার কোনো ভয় নেই আজ তার মাঝে।

,,আমার মেয়েটা আপনার কি ক্ষ’তি করছে আম্মা!
এতোটা বি’ষ পুষে রাখছেন মনের ভিতর আমার ছোট মেয়েটার জন্য! এতো অপছন্দ আপনার আমার মাইয়ারে?
সেতারা বেগম চেঁচিয়ে বললেন
,,গলা নামাইয়া কথা কও ছোট বউ!

,,কেনো আম্মা গলা উঁচা করার অধিকার কি আপনার একারই আছে নাকি?আপনি অন্যায় করবেন তা আমরা চুপচাপ দেখমু এটা কি করে ভাবেন আপনি?
আজকে আপনার সামনে আপনার ছোট বউ মা না, একজন মা দাঁড়িযে আছে!

তাহমিদা বেগমের কন্ঠ শুনে দৌড়ে এসেছেন হামিদা।সকাল প্রায় দশটা বাজে ব্যস্ত পায়ে অফিসে যাওয়ার জন্য বের হচ্ছিলো নিখিল,সে ও দৌড়ে এসেছে এখানে।সাহারাও এসেছে সাথে বৃষ্টি!

সবাইকে দেখেও থামার নাম নেই তাহমিদার,মেয়েটা হওযার পর থেকে কোনো দিন শাশুড়ীর মুখে ভালো কথা শুনেনি মেয়ের নামে।কান বিষি’য়ে যেতো তার, তার পরও চুপ থাকতেন তিনি উল্টো মেয়েকে বকতেন।
আজ মেয়ের সংসার, জীবন,ভালোথাকা নিয়ে প্রশ্ন উঠছে মা হয়ে পারলেন না চুপ থাকতে।

,,আপনাকে কোনো দিন মে’রেছে আম্মা?কোনো দিন আপনাকে খোঁচা দিয়েছে আম্মা?বড় আপা, মেজো আপা তোমাদের মে’রেছে নেহা বলো?তোমাদের কোনো ক্ষ’তি করেছে কোনো দিন?তোমাদের কোনো দামী জিনিস নষ্ট করে দিয়েছে?আম্মা আপনি বলুন আপনার কি নষ্ট করেছে?বলছেন না কেনো আম্মা?

হামিদা বেগম তাহমিদা বেগমকে টেনে বললেন–, পাগ’ল হয়ে গেছিস ছোট?উনি আম্মা বড় মানুষ তুই বেয়া’দবি কেনো করছিস?

,,আজকে বলতে দাও না আপা,আঠারো বছর ধরে জমিয়ে রেখেছি এবার আমি ক্লান্ত। আম্মার কাছে আজ আমি জবাব চাই।পরে যা শাস্তি দিবে মাথা পেতে নেবো!

হামিদা বেগম জানেন না কি হয়েছে কোন বিষয়ে এতো তর্ক,হামিদা নেহার দিকে এগিয়ে গিয়ে বললো
,,বল নেহা কি হয়েছে?এমন করছে কেনো তোর মা।
নেহার বাহুর চেপে ধরতেই নেহা ব্যলেন্স হারিয়ে দেয়ালে ঠেসে গেলো,মুর্তির ন্যায় শুধু দাড়িয়ে রইলো।

,,আম্মা আপনি চুপ করে গেলেন কেনো?বলুন নেহা যেহেতু আপনার এতো সমস্যার কারন?ছোট বেলা বলতেন কে’টে টুকরো টুকরো করে নদীতে ভাসিয়ে দিতাম,বড় করতাম না! আপনার শান্তির জন্য এতটুকু অনায়াসে করতাম আমি আম্মা!

নিখিল এবার চেঁচিয়ে উঠে বলে উঠলো–,ছোট মা!

,,কেনো বার বার বাহিরের মানুষের সামনে আমার মেয়েটাকে অপমান অপদস্ত করেন আম্মা ও কি ছোট মানুষ ওর মন নেই, ওর কষ্ট লাগে না আম্মা।আমার মেয়েটাকে প্রতিনিয়ত অপমান করে কি খুব শান্তি পান আম্মা?
তাহমিদা সমান তালে কাঁদছেন,থেমে থেমে আবার বললেন।আমার কোনো ছেলে সন্তান নেই দেখে আপনার আমার প্রতি অনেক ক্ষো’ভ রাগ তাই না আম্মা?বড় আপা মেজো আপার মতো ছেলে হয়নি দেখে ওই রাগটা আপনি আমার বাচ্চা মেয়েটার উপর ফলাচ্ছেন আম্মা?আপনার কি একটু মায়া হয় না ওর জন্য, আপনার চোখের কাটা হয়ে গেলো এভাবে,বাড়ি থেকে বের করে দিতেন আম্মা আমি আমার মেয়েকে নিয়ে দূরে কোথাও চলে যেতাম আপনি শান্তি তে থাকতেন।

নেহা এবার ধমকের সুরে বললো –,থামো মা!

তাহমিদা বেগমের সব রাগ গিয়ে এবার পড়লো নেহার উপর উনি রেগে তেড়ে গেলেন মেয়ের দিকে।নেহা মাকে একটা হাসি উপহার দিলো বিনিময়ে, নেহাকে হাসতে দেখে প্রত্যেক টা ব্যক্তি অবাক হলো,মেয়েটা পাগ’ল হয়ে যায়নি তো আবার এতোকিছু মাঝে হাসছে কেনো?

তাহমিদা মেয়ের হাসি সহ্য হলো না হাত টেনে নিজের সাথে নিতে নিতে বললো
,,আজ তোকে মে’রে ফেলবো আমি নেহা।তোর জন্য আমার জীবনের সব অশান্তি তোর মতো সন্তান জন্ম দেওয়াই ভুল হয়েছে আমার!
নেহা তাহমিদার হাতে টেনে দাঁড় করালো,অতিসয় ভাঙ্গা গলায় বললো।
,, যা খুশি করতে পারো মা বাঁধা দিবো না।একটা শেষ কাজ এখনো বাকি আছে ওটা করে যাবো!

সেতারা বেগম বাকহারা হয়ে পড়লেন ছোট বউ মা এতো রাগ তার প্রতি জমা রেখেছে?

নেহা এগিয়ে দাঁড়ালো সেতারা বেগমের সামনে, নিজের হাতের দিকে একবার তাকিয়ে এক টানে খুলে ফেললো হাতে থাকা চুড়ি গুলো,নিখিল বিষ্ময় ভরা নয়নে দেখলো,নিজের নামের চিহ্ন কিভাবে নিজের থেকে আলাদা করলো তার প্রেয়সী!

চুড়ি জোড়া হাতে নিয়ে দীর্ঘশ্বাস ছাড়লো
,,যোগ্য ব্যক্তির হাতে পড়িয়ে দিয়ো দাদী।তোমার নাতিকে মুক্ত করে দিলাম!

নিখিলের মনের ভিতরে কামড়ে ধরলো যেনো কেউ,নেহার থেকে মুক্তি তার কাছে মৃত্যুর সমান!মেয়েটা সম্পর্ক ছিন্ন করতে চাইলো কি এমন ঘটেছে এখানে?

তাহমিদা ফের টান দিলেন নেহার হাতে,সেতারা বেগম বলে উঠলেন
,,আমার প্রতি তোমার এতো রাগ ছোট বউমা,আমাকে না তুমি মা বলে ডাকো!
তাহমিদা বেগমের কঠিন স্পষ্ট গলা
,,শাশুড়ী কোনো দিন মা হয় না।আর দাদী কোনো দিন ছেলের ঘরের নাতনিদের মন থেকে স্নেহ ভালোবাসা দেখায় না, তার জল’জ্যান্ত প্রমান আপনি আম্মা!

নেহা কে টেনে হিঁচড়ে সাথে করে নিয়ে যাচ্ছে তাহমিদা নেহা মাঝেমধ্যে ব্যাথা পাচ্ছে তবুও টু শব্দটি করলো না!

তাহমিদা বেগমের পেছনের ছুটেছে হামিদা বেগম সহ সকলে।তাহমিদা নিজের ঘরে মেয়েকে ঢুকিয়ে ভিতর থেকে দরজা আটকে দিলেন।হামিদা বেগম নিখিল দরজায় অনবরত ধাক্কা দিতে লাগলো।
ভিতর থেকে তাহমিদা বেগম বললেন
,,যদি আজকে কেউ আমাকে বাঁধা দেওয়ার চেষ্টা করেছো তো আগে নেহাকে খু*ন করবো পরে নিজে গলায় ফাঁ*স লাগিয়ে দিবো!
হাত থেমে গেলো নিখিলের,নেহার কথা ভেবেই দরজায় সাথে ঠেস দিয়ে মেঝেতে বসে পড়লো সে।
নেহা শান্ত ভাবে বসে পড়লো খাটে,তাহমিদা বেগম রাগ দেখালেন না শান্ত চোখে দেখলেন মেয়েকে!
নেহা এসে মাকে জড়িয়ে ধরে হাউ মাউ করে কেঁদে দিলো।
তাহমিদা বেগমের কলিজায় যেনো কেই আ’ঘাত করছে অনবরত। মেয়েকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরলো তাহমিদা।

,,মা বলোনা কি করলে আমার কষ্ট টা কমবে?আমার যে কলিজা ফে’টে যাচ্ছে মা।আমাকে তুমি মে’রে ফেলো মা আমি শান্তি চাই।আমার এই অশান্তি আর ভালো লাগে না।আমি শান্তিতে নিঃশ্বাস নিতে চাই, বাঁচতে চাই।আমার ধ’ম বন্ধ লাগছে মা!
——-
সকাল গড়িয়ে দুপুর গড়িয়েছে নেহা বের হলো তাহমিদা বেগমে রুম থেকে।নিখিল তখন ও বসে আছে দরজার পাশে,নেহা কে বের হতে দেখে ওর হাত ধরলো নিখিল
টেনে নিয়ে গেলো নিজের সাথে।

,,আপনি এখান থেকে চলে যান নিখিল ভাই,আমি একটু একা থাকতে চাই!

,,না আগে তুই আমার প্রশ্নের উত্তর দে!টয়া কিছু বলেছে তোকে?
,,না!
নিখিলের মুখে টয়ার নামটাও সহ্য করতে পারলো না নেহা,আপনাআপনি চোখ দিয়ে পানি বেরিয়ে আসলো তার।
,,কাঁদছিস কেনো নেহা,বলনা আমাকে কি হয়েছে,বুঝবো কি করে না হয়!

নেহা কাঁদতে কাঁদতে এক পর্যায়ে নিখিলের কলার চেপে ধরে বললো
–,,আপনি কেনো আমার সাথে এমন করলেন নিখিল ভাই?আমার দোষটা কি ছিলো বলেন,আমি আপনাকে বলেছিলাম আমাকে ভালোমানুষি দেখান?তবে কেনো দেখিয়েছেন?বলেছিলেন না ঘৃ*ণা করেন কোনো প্রকার সহানুভূতি দেখাতে পারবেন না,তবে কেনো দেখালেন?আমি তো আশা করিনি কিছুই কেনো আগ বাড়িয়ে সব করলেন? কেনো নাটক করলেন আমার সাথে নিখিল ভাই?আমি আপনার কি ক্ষ’তি করেছি বলুন, কেনো আমার ফিলিংস নিয়ে খেললেন আপনি?
ওই টয়া যদি আপনার এতোই যোগ্য হয়,এতোই আপনি ওকে ভালোবাসেন তো আমাকে কেনো বিয়ে করেছেন?কেনো এসেছেন আমার জীবনে?কেনো কেনো কেনো?উত্তর দিন, বলছি উত্তর দিন!

নিখিল দিকভ্রান্তের ন্যায় হয়ে পড়লো,নেহা তাকে ভুল বুঝছে!এর থেকে খারাপ আর কি হতে পারে?
নিখিল নেহাকে আলতো হাতে জড়িয়ে ধরে বলে

—,শান্ত হ প্লিজ,বুঝার চেষ্টা কর এরকম কিছু,,,,,,,

নেহা নিখিল কে এক ধাক্কায় সরিয়ে দিয়ে বলে
,,ওই নোং’রা হাতে আমাকে একদম ছুঁয়ে দিবেন না আপনি,আপনার ছোঁয়াকে ঘৃ*ণা করি আমি।একদম ছুঁবেন না আমায়।দূরে থাকুন, দূরে থাকুন বলছি,আমার সামনে আসবেন না আর!

নিখিল দু কদম পিছিয়ে গেলো,হৃদয়ে তীব্র য*ন্ত্রণা হচ্ছে তার,নেহা তার থেকে দূরত্ব চায়!
নিখিল দেয়ালে সজোড়ে একটা ঘু’ষি বসায়,দরজা শব্দ করে বন্ধ করে বেরিয়ে চলে যায় রুম থেকে।

নেহা মেঝেতে বসে পড়ে,পাগ’লের মতো নিজের চুল খামচে ধরে কান্না করতে থাকে,
,,-আপনি আমাকে এভাবে নিঃস্ব করে দিলেন কেনো নিখিল ভাই?আপনাকে ভালোবাসাটাই কি আমার সবচেয়ে বড় ভুল?বড় কোনো অপরাধ!

নেহার বুকে চিনচিনে ব্যাথা শুরু হলো,অতিরিক্ত রাগ,কষ্টের ভার সইতে পারলো না তার মন মস্তিষ্ক।স্বচ্ছ মেঝেতে লুটিয়ে পড়লো নেহার চিকন গড়নের দেহটা!
চলবে?

#প্রণয়ের_সুর
#বোনাস_পর্ব
#মহুয়া_আমরিন_বিন্দু
বাড়ির ছুটা কাজের লোকের কিশোরী মেয়ে রুম্পা,আজ মায়ের বদলে এসেছে,মেয়েটি ভয়ে সড়োসড়ো হয়ে দাড়িয়ে আছে এক কোনায়,এই বড় বাড়িতে এসেছে আজ প্রথম, সাধারণ গরিব পরিবারের মেয়ে সে প্রথম দিন এসেই এমন তিক্ত অভিজ্ঞতার স্বীকার হবে বুঝতেই পারেনি,তার কাছে বড় লোক হওয়াটা স্বপ্নের মতো,ভেবেইছিলো বড়লোকরা সব সময় সুখে শান্তিতে থাকে।কিন্তু আজ যা দেখলো তাতে এমন কিছু হওয়ার ইচ্ছেটাই শেষ হয়ে গেছে।
হামিদা বেগম,আর নিখিলের সামনে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি
নিখিল শান্ত কন্ঠে জিজ্ঞেস করলো–,তুমি যা শুনেছে ওটুকুই নির্ভয়ে বলো।আমরা তোমাকে কিছু করবো না,তুমি তো আমার বোনের মতো ভয় পেয়ো না ভাইকে নিরদ্বিধায় সব বলো!

মেয়েটি কিছুটা ভরসা পেলো,টয়া যখন নেহাকে ডেকেছে তখন থেকেই সে সেখানে ছিলো,সেতারা বেগমের ঘরের পাশের অংশ সে পরিষ্কার করছিলো।
মেয়েটা দাঁড়ি কমা সহ সবকিছু বলে দিয়েছে একদমে।নিখিলের রাগে কপালের শিরা ফুলে উঠলো,হামিদা বেগম ছেলের উপর রাগলেন উল্টো,ছেলের এই বিয়ে লুকানোর চক্করে এতোকিছু হয়েছে।
হামিদা বেগম রাগে দুঃখে চেঁচিয়ে উঠলেন নিখিলের উপর
,,তোর জন্য আমার সাজানো গোছানো সংসারটায় এতো এতো সমস্যা হয়েছে নিখিল।আমি আগের মতো চাই সব কিছু তুই যেভাবে সব ধ্বং’স করেছিস ঠিক সেভাবে সব আগের মতো করে দিবি।যতক্ষণ না পারবি ততক্ষণ আমাকে মা বলে ডাকবি না!
হামিদা বেগম হন হন করে চলে গেলেন,নিখিল মৃদু চেঁচিয়ে একবার ডাকলো–,মা!

নিখিল ছুটলো টয়ার রুমের দিকে ওর সাথে বুঝা পড়া তো এখনো বাকি,নিখিল মেহমেত চৌধুরীর বউ হওয়ার এতো সখ এই মেয়ের!
নিখিল কে নিজের ঘরে ঢুকতে দেখে ভয়ে হাতের সামনে গোছানো কাপড় গুলো পড়ে গেলো নিচে।টয়া এটার ভয়ই পাচ্ছিলো তাই চুপচাপ চলে যাওয়ার কথা ভেবেছে।

নিখিল টয়ার দিকে তাকিয়ে শান্ত কিন্তু খুবই কঠিন কন্ঠে বললো–,চলে যাচ্ছিস?তা বিয়ে করবি না আমাকে? না করেই চলে যাচ্ছিস যে বিয়ে করবি বলেই তো প্রথম দিন থেকে এতো কিছু করলি!

টয়া তরতর করে ঘামতে থাকলো,সে তো এরকম ভাবে কিছু চায়নি, বুঝতে ও পারেনি সেতারা বেগমকে এই সামান্য কথা বলাতে বাড়িতে এতো কিছু ঘটে যাবে!

নিখিল বাড়ি কাঁপিয়ে এক ধমক দিলো টয়া কে
,,ওই কথা বলছিস না কেনো?উত্তর না দিলে তোর জি’ব টেনে ছিঁ’ড়ে ফেলবো আজ আমি!

টয়া ভয়ে চুপসে গেলো,নিখিল গিয়ে পর পর পাঁচটা চ*ড় মেরেছে টয়ার গালে!
বৃষ্টি দরজায় দাড়িয়ে চম*কে উঠলো,ভাইয়ের অগ্নিমূর্তির ন্যায় রূপে যেনো জ্বল’সে যাবে সব কিছু।জেরিন,সাব্বির সব বাড়ি ফিরেছে,বাড়ির পরিবেশ শান্ত দেখেই বুঝেছে কোনো একটা গন্ডগোল আছে।দুজন উপরে উঠে দাড়িয়ে পড়লো।
টয়ার ঠোঁট কে’টে রক্ত বেরিয়ে গেছে।রাগে তরতর করে কাঁপছে নিখিল,হিতাহিতজ্ঞান ভুলে গেছে প্রায়।

,,তুই কি মনে করেছিস নিখিল ভাই চুপ আছে মানে সে মেরুদণ্ডহীন পুরুষ, তাকে পেয়ে বসেছিস তুই,ওইদিন ও তোকে সাবধান করেছিলাম নেহার থেকে দূরে থাক।

তুই কি যেনো জিজ্ঞেস করেছিস দাদীকে, নিখিল ভাইয়ের বউ হিসাবে কাকে মানাবে।তুই কে এসব বলার?নিখিল মেহমেতের জীবনের প্রথম ও শেষ নারী শুধু নেহা নূর বুঝতে পেরেছিস তুই।তোকে দেখেও ঘৃ’ণায় গাঁ গুলিয়ে আসছে,নিজেকে একটা মেয়ে কিভাবে দাবি করোছ তুই।তুই ছোট বাচ্চা এখনো বুঝতে পারোস নাই, তোকে ঢাক ঢোল পিটিয়ে জানাতে হবে?নিখিল শুধু নেহার!তুই কি ভেবেছিস নেহা আর আমার মাঝে ভুল বুঝাবুঝি সৃষ্টি করে দিলেই,আমি তোকে বিয়ে করবো?
সেতারা বেগম কেনো,পুরো পৃথিবীর মান্যগণ্য ব্যক্তি এসে রিকুয়েষ্ট করলেও নেহা ব্যতিত কাউকে আমি জীবনে জায়গা দিবো না।
শুধু মাত্ররো মেয়ে বলে তোকে এতোদিন সম্মান দেখিয়েছি,কিন্তু তুই একটা কু’ত্তা যার লেজ কোনো দিন সোজা হবে না।যদি ছেলে হতি আজ এখানেই মে’রে পুঁতে দিতাম তোকে।নিখিল টয়া কে উঠিয়ে দাঁড় করিয়ে এবার গলা চেপে ধরে।

,,তুই কি যেনো বলছিলি, কে দেখতে সুন্দর বেশি?নেহা যদি পু’ড়া জ্বল’সানো পৃথিবীর সবচেয়ে কুৎসিত চেহারা নিয়েও আমার সামনে আসে তবুও আমি শুধু তাকেই বেছে নিবো।শুনতে পেয়েছিস তুই?তোর জন্য আমার নেহা কষ্ট পেয়েছে তোকে আমি খু*ন করে ফেলবো মে’রে ফেলবো একদম!

টয়ার চোখ উল্টে যাওয়ার উপক্রম সাব্বির নিখিল কে বাঁধা দিয়ে ও পারছে না,হামিদা বেগম এসে টয়াকে ছাড়িয়ে নিলো।
নিখিল রাগে চুল খামচে ধরলো।তীব্র আ’ক্রোশে ফেটে পড়ছে যেনো।

,,মা তুমি তোমার বোনের মেয়েকে এই বাড়ি থেকে এখন যেতে বলো।এখন মানে এখন ও যাতে কোনো দিন এই বাড়ির ত্রিসীমানায় না আসে।যদি ভুল করেও পা বাড়ায় তো খোদার কস*ম নিজ হাতে খু*ন করবো আমি। কাল*নাগিনী টাকে সরাও আমার চোখের সামনে থেকে!

হামিদা বেগম টয়া টেনে নিয়ে গেলেন এক প্রকার বোনের মেয়ে এতোটা নির্লজ্জ হবেন জানলে ভুলেও আনতেন না বাড়িতে,তার কন্ঠে স্পষ্ট রাগ।
টয়াকে গাড়ি করে পাঠিয়ে দিলেন তিনি,কড়া ভাষায় বলে দিলেন তোর মাকে সব কিছু জানাবো আমি।টয়া যাওয়ার পূর্বে হামিদা বেগমের পা জড়িয়ে ধরলেন,মিনতি করলেন যাতে তার মাকে কিছু না জানায়!
সেতারা বেগম নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইলেন নিজের ঘরে।তার মুখ দিয়ে শব্দ বের হচ্ছে না।কি থেকে কি হয়ে গেলো!

বৃষ্টি দৌড়ে গেলো নেহার অবস্থা দেখতে মেয়েটার সাথে কথা পর্যন্ত বলতে পারেনি এখন পর্যন্ত।
জেরিন সাব্বির বৃষ্টি কে কিছু জিজ্ঞেস করার সময়ই পেলো না।বৃষ্টি তার আগে ছুট লাগিয়েছে নেহার কাছে।

বৃষ্টি নেহাকে মেঝেতে পড়ে থাকতে দেখেই গগনবিদারী এক চিৎকার দিয়ে উঠলো!
নেহার হাত পা বরফের ন্যায় জমে গেছে।জেরিন সাব্বির তার পেছনেই ছিলো,নিখিল নিজেও চিৎকার শুনে দৌড়ে আসলো,নেহা কে এভাবে পড়ে থাকতে দেখে ছুটে গিয়ে বৃষ্টির পাশে বসে নেহার গালে হাত রাখলো।

,,নে,,,হা!
নিখিলের কন্ঠ কাঁপা, হাত কাঁপছে। নিখিল নেহার মাথা কোলে তুলে নিলো–,নেহা কথা বলছিস না কেনো?নেহা কথা বল বলছি।
বৃষ্টি ভাইয়ের করুন অবস্থা দেখে কি করবে বুঝতে পারছে না।বৃষ্টি সাব্বির কে বললো
,,সাব্বির ভাইয়া এম্বুলেন্স ফোন করো নেহা কে ডাক্তারের কাছে নিতে হবে।ওর হাত পা ঠান্ডা হয়ে গেছে পুরো। নিখিল নেহা কে কোলে উঠিয়ে নিলো,নেহার ফ্যাকাসে মুখটা নীল বর্ণ ধারন করেছে।তাহমিদা বেগম মেয়ের এমন অবস্থা দেখে সিঁড়ির গোড়ায় এসে নিজেও জ্ঞান হারালেন!হামিদা বেগম পড়লেন অথৈজলে,এ কি হলো তার পরিবারের।সাহারা ছুটে এসে ধরলেন তাহমিদা বেগম কে,সেতারা বেগম বেরিয়ে এসে দেখলেন ছোট বউ আর নাতনির বেহাল দশা।ভিতরটা কেমন ধ’ক করে উঠলো তার।মনের ভিতর থেকে একটা কথাই কানে এসে ঠেকছে,সব কিছুর পেছনে শুধু তুই দায়ী সেতারা,তোর এই ছোট মনমানসিকতা, অপমান,নিজেকে কঠিন ধাঁচে আটকে রাখার ফল ভোগ করছে বাড়ির দুইটি সদস্য!

জেরিন তার বাবা চাচাদের হসপিটালে আসতে বলে গাড়িতে উঠে বসলো,
ইমারজেন্সি তে ভর্তি করা হলো মা মেয়েকে।হামিদা বেগমের প্রেসার কমেছে দুর্বলতায় তিনি জ্ঞান হারিয়েছেন।
নেহার খবর দিতে পারেননি ডাক্তার, ধারনা করছেন প্যা’নিক অ্যা’টাক করেছে নেহা।মস্তিষ্কে অধিক চাপ পড়ার ফলে জ্ঞান হারিয়েছে।
হসপিটালে এসে পৌঁছেছে মিহির।শাহআলম চৌধুরী, শহিদুল চৌধুরী পেছনে মাহফুজ চৌধুরী।
মিহির নিখিল কে খুঁজতে ব্যস্ত নিখিল নিজের শরীরের ভার ছেড়ে দিয়ে দেয়ালে ঠেস দিয়ে চোখ বন্ধ করে দাড়িয়ে আছে।

মিহির নিখিলের কাঁধে হাত রাখলো,নিখিল চোখ বন্ধ করেই বললো–,মিহির!
মিহিরের হতাশ কন্ঠ –, চল আমার সাথে।

নিখিল মিহিরের সাথে যেতে চাইলো না মিহির টেনে নিয়ে গেলো অনেকটা।শাহআলম সহ বাকি দুইজন ও সব শুনলো বৃষ্টির মুখে।
শহিদুল চৌধুরী তপ্ত শ্বাস ছাড়লো সে বরাবরই গম্ভীর প্রকৃতির মানুষ, চুপচাপ।
নিজের স্ত্রীর কোনো অন্যায় খুঁজে পেলেন না তিনি,সে নিজেও মাকে অনেক বার না করেছে নেহা একটু ডানপিটে মেয়ে,কিন্তু মনের দিক দিয়ে তার মতো ভালো দুটো নেই,তাও মা কোনো দিন তার মেয়েকে কথা শুনাতে ছাড় দেয়নি।তাহমিদা প্রায় সময়ই স্বামীর কাছে অভিযোগ তুলতো,শুধু পরিবার থেকে আলাদা না হওয়ার জন্য পরিবারের সবার খুশির কথা চিন্তা করে স্ত্রী কে বুঝাতেন।কিন্তু আজ!তার মায়ের জন্য তার জীবনের গুরুত্বপূর্ণ দুইজন মানুষ নিথর হয়ে পরে আছেন।মেয়েটা মৃত্যুর সাথে তাল মিলিয়ে বাঁচা মরার লড়াই চালাচ্ছে।কি করে ক্ষমা করবে নিজের মাকে?
বাবা মা মানুষের জীবনে গুরুত্বপূর্ণ দুজন মানুষ, তেমন স্ত্রী সন্তান ও, বাবা মা সব সময় অন্যায় করতে থাকলে তা মেনে নেওয়াটাও উচিত না।যদি স্ত্রীর কথা শুনতেন প্রতিবাদ করতেন তাহলে হয়তো আজ আর এদিন দেখা লাগতো না।
তাহমিদা বেগমের জ্ঞান ফিরেছেন, তিনি উঠেই সে-লাইন হাত থেকে খুলে দৌড়ে বেরিয়ে আসলেন, শাড়ি পরিহিত মধ্যবয়স্কা নারী, একজন সম্মানিত গৃহিণী, যে মহিলা আজ অব্দি বড় ভাইয়ের মতো ভাসুরদের সামনে মাথায় কাপড় ছাড়া আসেনি তিনি আজ আঁচল ছেড়ে দিয়ে চুল ছাড়া অবস্থায় পাগ’লের ন্যায় সবার সামনে এসে স্বামীর বাহু ঝাঁকিয়ে বললো

,,আমার মেয়েকে এনে দাও বলছি।মেয়েকে সুস্থ করে দাও না হয় নিজেকে শেষ করে ফেলবো আমি।তোমরা সবাই আমার মেয়ের এই পরিস্থিতির জন্য দায়ী।কথা বলছো না কেনো এখন।আমার একটাই সন্তান তুমি জানো না,,ও চলে গেলে কাকে নিয়ে থাকবো আমি!

শব্দ করে কেঁদে দিলেন এবার তাহমিদা।নিখিল এসে তাকে জড়িয়ে ধরলো।মাথায় হাত রেখে সান্ত্বনা দিচ্ছে,
যেদিকে ওর নিজের ভিতরেই এক উত্তাল সমুদ্র! বাঁধ ভাঙ্গা ঝড়ে নিজেই ভিতরে ভিতরে ভেঙ্গে চূড়ে শেষ হয়ে যাচ্ছে,সে কিভাবে অন্য একজন কে সামলানোর ক্ষমতা রাখে!তবে পরিস্থিতি মানুষকে দিয়ে সব করিয়ে নেয় যেনো।
,,তুই বল নিখিল নেহা কথা বলছে না কেনো?উঠে আসছে না কেনো?আমার মেয়েটা তো কথা না বলে থাকে না,ওকে উঠতে বল না তোর সব কথা তো শুনে,আজকেও শুনবে যা বাবা ডেকে দে না একটু!

নিখিলের অতি ভাঙ্গা কন্ঠ গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছে না ওর।টেনে টেনে শ্বাস নিয়ে বললো

,,নেহা ঠিক হয়ে যাবে তো ছোট মা। সত্যি বলছি আমাদের নেহা অনেক স্ট্রং তুমি জানো না,ঘুমিয়ে আছে তো,ঘুম ভাঙ্গার পর যদি দেখে তুমি এভাবে কেঁদেছো ওর কি ভালো লাগবে বলো?চোখ মুছে ফেলো না ছোট মা,তুমি ভালো মা না আমার!
তাহমিদা এলোমেলো হাতে চোখ মুছলেন,কই কাঁদছি না তো আমি,এই দেখ একদম কাঁদছি না আমি।

শহিদুল চৌধুরী নিজে এবার কেঁদে দিলেন,শাহআলম চৌধুরী জড়িয়ে ধরে বাচ্চাদের মতো কেঁদে উঠলেন, হামিদা এক পাশে দাড়িয়ে চোখ মুছলেন জেরিন,সাব্বির,বৃষ্টি এক পাশে দাড়িয়ে চোখের জল ফেলছে।পরিবারের দুর্দশা যেনো আর চোখে দেখা যাচ্ছে না।কিছু সময়ের ব্যবধানে সব কিছু এলোমেলো হয়ে পড়েছে।
হামিদা বেগম বসলেন তাহমিদা বেগমের পাশে
নিখিল চুপচাপ উঠে গেলো একপাশে।হসপিটালের বাহিরে খোলা রাস্তার পাশে বেঞ্চ টা তে বসে পড়লো সে।
জীবনে সিগারেটের প্যাকেট ও হাতে তুলেনি সে।রাস্তার পাড়ে বসা চা বিক্রেতার কাছে সিগারেট দেখলো সে,হতাশ শ্বাস ফেলে তার থেকে সিগারেট নিয়ে নিলো একটা!
লাইটারের আ’গুন টার দিকে তাকালো কয়েক মিনিট,এই আগু’ন টা থেকেও শত গুন বেশি নিজের ভিতরে জ্ব’লছে এখন।ঠোঁটের আগায় সিগারেট টা চেপে ধরতেই মিহির ছো মেরে কেঁড়ে নিলো ওটা।পায়ের নিচে ফেলে পিষে ফেললো।
মিহির শান্ত কন্ঠে ধমক দিলো একটা

নিখিলে ঠোঁট এলিয়ে হাসলো!মিহির পাশে বসে বললো

,,তুই তো এমন না, কেনো করতে যাচ্ছিলি ওটা?

,,আমি কেনো বাউণ্ডুলে মানুষ হতে পারলাম না।কোনো এক অগোছালো অনিয়ম প্রেমিক হতে পারলাম না?আমি এতোটা নির্বোধ,স্বার্থপর,পাষা’ণ কেনো হলাম মিহির।কাপুরুষের তকমাটা আজ নিজেকে দিতে ভীষণ ইচ্ছে জাগছে!

,,তুই কাপুরুষ হলে সুপুরুষ বলতে পৃথিবীতে আর কিছু থাকবে না!

,,বন্ধু বলে বলছিস তো?কিন্তু আমার অন্তর আত্মা চেঁচিয়ে বলছে,আমি এক ব্যর্থ মানুষ! একজন ব্যর্থ স্বামী,একজন ব্যর্থ সন্তান!

পরিবারের বড় সন্তান হয়ে জন্মানোটা ভীষণ রকম কঠিন! এতো এতো দায়িত্ব এদের,সব কিছুর মাঝে নিজের সবচেয়ে প্রিয় জিনিসটাও এদের কাছে থেকে যায় চির অধরা!

ভাবছি কি জানিস?চলে যাবো!

,,নেহাকে ছেড়ে ভালো থাকবি তুই?

,,ও ভালো থাকবে!আমি কাছে থাকা কালিন তো কষ্ট ছাড়া কিছুই দিতে পারিনি।জোর করে বিয়ে করে ফেলেছি,ওর জীবনটা নষ্ট করে দিলাম!এর শাস্তি হিসাবে চির কাল ওর থেকে দূরত্ব রেখে নিজেকে জ্বা’লিয়ে পু’ড়িয়ে মার’তে চাই।

আমি কাউকে ভালোবাসার যোগ্যতাই রাখি না!নেহা ডিজার্ব বেটার দেন মি!

,,তোর থেকে বেশি ভালো নেহাকে কেউ বাসতে পারবে না।তুই যতটুকু ভালো নেহা কে বাসিস ততটুকু হয়তো আমি তোর বোন কে বাসি না নিখিল!
নেহা যদি তোকে ভালোবাসে তার পরও কি তুই ওকে ছেড়ে চলে যাবি নিখিল?

,,আমি ওকে আগলে রাখতে পারলাম কই মিহির,দেখ কেমন করে আইসি’ইউর বেডে শুয়ে আছে।আমি কি পারছি ওর যন্ত্র’ণা কমাতে,উল্টো বাড়িয়ে দিচ্ছি।

,,তোর রাগের মাঝে যে ভালোবাসা আছে,এটা লোক চক্ষুতে ধরা না পড়তেই পারে। নেহার ভালোর জন্য তুই ওকে এভাবে বিয়ে করেছিস না হয় ওই শয়তা’নটা নেহাকে নিজের ভোগের স্বীকার বানাতো!শত্রুদের চিনতে পারা এতো সহজ নয় নিখিল, কিন্তু তুই পেরেছিস!তোর থেকে যোগ্য স্বামী যোগ্য জীবনসঙ্গী আর কেউ হতে পারে না।

,,আমি ভুল করেছি মিহির,আমার লুকানো উচিত হয়নি!

,,এখানেও তোর ভুল নেই,পরিবার বাঁচাতে করেছিস তুই এটা, শহিদুল আংকেল ও তো জানে।কেনো নিজেকে ছোট করতে চাইছিস!

,,দায়িত্বের বেড়াজালে আমার ভালোবাসার মানুষটা হারিয়ে যাচ্ছে মিহির।

,,হারিয়ে যেতে দিবি কেনো তুই।আমি জানি নিখিল কখনো নেহার ক্ষ’তি হতে দিতে পারে না।নেহাকে কষ্ট দিতে পারে না।আমার চেনা নিখিল মেহমেত চৌধুরী কখনো পরিস্থিতির কাছে হেরে যায় না।তুই নিজেও জানিস এখন তোর কি করা উচিত!

,,দূরে যেতে চাইছেন মিসেস চৌধুরী , কিন্তু তাকে এখন আরো কাছের টেনে নেওয়ার সময় এসেছে।এটাই বুঝাতে চাইছিস তুই!

মিহির গাল এলিয়ে হাসলো,এতো এতো কমপ্লিকেশন এই নিখিলের জীবনে তার থেকে ভালো কে জানে!শুধু একটাই সমস্যা ওর অনুভূতি প্রকাশে ভীষণ কাঁচা ছেলেটা,তবে মহাশয় রাগের ক্ষেত্রে পিএইচডি করে রেখেছে!মানুষ আসলেই সব দিক দিয়ে পারফেক্ট হয় না।
অনুভূতি প্রকাশ করার প্রয়োজন হয় না যদি অপর ব্যক্তিটা মন পড়তে জানে!

চলবে?