প্রণয় রেখা পর্ব-১১+১২

0
357

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১১.

লায়লা বেগম হসপিটালের বারান্দায় দাঁড়িয়ে হাউমাউ করে কাঁদছেন। মোহনা আর মাহিয়া মা’কে কোনোমতেই শান্ত করতে পারছে না। তাদের নিজেদের মনও খুব একটা শান্ত নয়। কেবল মা’কে দেখিয়ে তারা সেটা প্রকাশ করতে পারছে না। মাহিয়ার চোখ থেকেও জল পড়ছে। বাবার কপাল থেকে গড়িয়ে পড়া রক্ত তার সাদা শার্ট টা নষ্ট করে দিয়েছে। সেই শার্ট টা তার চোখে ভাসছে। বাবার বুজে থাকা চোখগুলো তাকে পীড়া দিচ্ছে। বাবাকে অমন ভাবে দেখাটা তার মস্তিষ্ক মানিয়ে নিতে পারছে না। বুকের ভেতরে ছটফট করছে। মোহনা নিস্তব্ধ নয়নে বাবাকে দেখেছে। এইতো কিছুক্ষণ আগে বাবা তার কপালে চুমু খেয়েছিল। তাকে ভালোবেসে জড়িয়ে ধরেছিল। আর এই ক্ষণিক সময়ের ব্যবধানে এত কিছু হয়ে গেল, আশ্চর্য!

অপারেশন থিয়েটার থেকে ডক্টর বেরিয়ে এসে বললেন,

‘পেশেন্টের খুব রক্ত গিয়েছে। উনার এখন ইমারজেন্সি রক্ত প্রয়োজন। আপনাদের মধ্যে কারো রক্তের গ্রুপ কি বি পজেটিভ?’

মোহনা তার মা আর বোনের দিকে তাকাল। তাদের তিনজনেরই রক্তের গ্রুপ এ বি পজেটিভ। মোহনা বলল,

‘না ডাক্তার। আমাদের রক্তের গ্রুপ এ বি পজেটিভ।’

‘তাহলে এক কাজ করুন, আপনাদের পরিচিত কেউ বি পজেটিভ রক্তের থেকে থাকলে তাকে এক্ষুণি আসতে বলুন। আমাদের ব্লাড ব্যাংকে বর্তমানে এই গ্রুপের রক্ত নেই। আর এই দিকে কোনো ব্যাংককেই এই রক্ত পাওয়া যাচ্ছে না। আপনারা একটু খোঁজ খবর নিয়ে দেখুন পান কিনা। পেলে আমাকে জানাবেন।’

মোহনার খুব ভয় করছে। সে কাঁপাকাঁপা হাতে তার ফোন থেকে তার সকল ফ্রেন্ডদের কল দিল। কিন্তু তাদের কারোরই রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ না। ঐদিকে এশা আর রাফাত এসব শোনার পর তারাও রক্ত খুঁজতে লাগল। কিন্তু দুঃখের ব্যাপার হলো এই গ্রুপের রক্ত খুব কম মানুষেরই হয়ে থাকে। তাই এই গ্রুপের রক্ত ম্যানেজ করা খুব কষ্ট সাধ্য।

অনেক খোঁজাখুঁজির পরও মোহনা কোনো রক্তদাতা জোগাড় করতে পারল না। ডাক্তার আবার এল। তাদের তাড়া দিয়ে বলল যা করার একটু তাড়াতাড়ি করতে, পেশেন্টের অবস্থা ভালো নেই। মোহনার মা’র কান্না আরো বেড়ে যায়। মাহিয়াও কাঁদতে আরম্ভ করে। মোহনা কোনো উপায় বের করতে না পেরে দিশেহারা হয়ে পড়ে। আত্মীয়-স্বজনদের মধ্যে তার ছোট কাকার রক্তের গ্রুপ ও বি পজেটিভ। কিন্তু উনি এখন আসতে চাইলেও পারবেন না। এতটা পথ আসতে আসতে অনেক সময় চলে যাবে। ততক্ষণে হয়তো বাবার অবস্থা আরো খারাপের দিকে চলে যাবে। রাফাত আর এশাও হসপিটালে আসে। তারাও যথাসাধ্য চেষ্টা করছে রক্তের জোগান দেওয়ার জন্য। ফেইসবুকেও পোস্ট দিয়েছে। একজন রক্তদাতাও পেয়েছে। কিন্তু তারও হসপিটালের পৌঁছাতে দুই ঘন্টার মতো সময় লাগবে। কিন্তু এত সময় তাদের হাতে নেই।

মোহনা অস্থির হয়ে এদিক ওদিক পায়চারি করে চলছে। নিজেকে তার বড্ড অপরাধী মনে হচ্ছে। বাবার এই কঠিন সময়ে সে বাবাকে কোনোভাবেই সাহায্য করতে পারছে না। কেমন মেয়ে সে, বাবার জন্য সামান্য রক্তের জোগান দিতে পারছে না?

মোহনা অনেক ভেবে মনে হলো, সবাইকেই যখন বলেছে তখন লাস্ট একবার লরিনকেও বলা উচিত। হতেও তো পারে ওর রক্তের গ্রুপ বি পজেটিভ।

মোহনা তাই করল। আর দেরি না করে লরিন কে মেসেঞ্জারে আনব্লক করে কল করল। কয়েকবার কল করার পর কলটা রিসিভ হলো। মোহনা ইতস্তত কন্ঠে বলল,

‘আমাকে একটা সাহায্য করবেন, লরিন?’

‘সাহায্য? Means help?’

‘হ্যাঁ।’

‘কেমন সাহায্য?’

মোহনা ঢোক গিলে বলল,

‘আপনার ব্লাড গ্রুপ কী?’

লরিন অবাক হলো। বলল,

‘ব্লাড গ্রুপ দিয়ে কী হবে?’

‘আগে বলুন না।’

লরিন বলল,

‘বি পজেটিভ।’

মোহনা যেন খুশিতে আত্মহারা হয়ে গেল। কেঁদে ফেলল সে। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল,

‘লরিন, আপনাকে এক্ষুণি একবার হসপিটালে আসতে হবে। আমার বি পজেটিভ রক্তের প্রয়োজন। আমার বাবাকে বাঁচাতে হবে। প্লীজ, আমাকে আপনি সাহায্য করুন। আমার বাবাকে এক ব্যাগ রক্ত দিন। প্লীজ লরিন।’

‘ঠিক আছে, আপনি আমাখে ঠিকানা দিন। আমি এখনি আসছি।’

মোহনা ঠিকানা দিল। তারপর ফোন কেটে মা’র কাছে দৌড়ে গেল। বলল,

‘মা, রক্তের জোগান হয়ে গিয়েছে।’

লায়লা বেগম খুশি মনে আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করলেন। এশা আস্তে করে জিজ্ঞেস করল,

‘লরিন কে কল করেছিলি?’

মোহনা তার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়াল।
.

.

লরিন এল। মোহনা তাকে নিয়ে ডাক্তারের কেবিনে গেল। ডাক্তার প্রথমে তার একটু রক্ত নিয়ে ভালোভাবে টেস্ট করে নিল। টেস্টের সব রিপোর্ট ভালো এসেছে। মোহনা এতে ভীষণ খুশি হয়। ডাক্তার লরিন কে একটা বেডে শুইয়ে তার হাতে ক্যানোলা লাগিয়ে দেন। মোহনা তার পাশেই ছিল। লরিন মাথা ঘুরিয়ে তার দিকে চেয়ে বলে,

‘ঠোমার বাবার কী হয়েছে?’

মোহনা থমথমে স্বরে বলে,

‘এক্সিডেন্ট।’

‘ও মাই গড। এখন উনি কেমন আছেন?’

‘ভালো নেই। খুব রক্ত গিয়েছে। তাই জরুরি ভিত্তিতে রক্ত লেগেছে। কোথাও পাচ্ছিলাম না। অবশেষে আল্লাহ আপনাকে পাঠিয়েছেন। ধন্যবাদ লরিন।’

লরিন জবাব দিল না। সে তার হাতের ক্যানোলার দিকে তাকিয়ে আনমনে বলল,

‘শুধুই ঢন্যবাদ?’

প্রায় এক ঘন্টা পর ডাক্তার কেবিন থেকে বেরিয়ে বললেন,

‘উনার অপারেশন সম্পন্ন হয়েছে। মাথায় পাঁচটা সেলাই লেগেছে। এছাড়া শরীরের বিভিন্ন অংশ ছিলে গিয়েছে, সেগুলো ড্রেসিং করে দিয়েছি। আপাতত উনার জ্ঞান নেই। কিছুক্ষণের মধ্যে হয়তো চলে আসবে। আপনারা এখন বাইরেই অপেক্ষা করুন। উনার জ্ঞান ফিরলে নার্স এসে আপনাদের বলবে।’

পাঁচটার সেলাই এর কথা শুনে মাহিয়া কাঁদতে কাঁদতে বলল,

‘বাবার নিশ্চয়ই খুব কষ্ট হচ্ছে আপু, তাই না?’

মোহনা ঠোঁট গুঁজ করে মাথা নাড়াল। লায়লা বেগম মাহিয়াকে বুকে টেনে আদর করলেন। তারপর হঠাৎ লরিনের দিকে তাকিয়ে বললেন,

‘ওই তো রক্ত দিয়েছে? ও কে মোহনা?’

মোহনা লরিনের দিকে এক পলক চেয়ে বলল,

‘আমার বন্ধু মা।’

লরিন অবাক হলো ভীষণ। বড়ো বড়ো চোখ করে সে মোহনার দিকে তাকাল। লায়লা বেগম তখন লরিনকে উদ্দেশ্য করে বললেন,

‘তোমাকে অনেক ধন্যবাদ বাবা। তুমি ছিলে বলেই আমার স্বামীর আজ এত বড়ো উপকার হয়েছে। রক্ত না পেলে না জানি কী হতো। তোমার এই ঋণ আমি কোনোদিনও শোধ করতে পারব না।’

লরিন আলতো হেসে বলল,

‘It’s my pleasure aunty. আপনাদের সাহায্য করতে পেরে আমার নিজেরও খুব ভালো লাগছে।’

লায়লা বেগম প্রসন্ন গলায় বললেন,

‘তুমি খুব ভালো ছেলে বাবা। দোয়া করি তুমি অনেক বড়ো হও।’

মোহনা আড়চোখে লরিনের দিকে তাকাল। লরিনের চোখ মুখ খুশিতে যেন ঝলমল করছে। যেন বাংলাদেশে আসা আজ তার স্বার্থক হয়েছে। সে মোহনার দিকে তাকাতেই মোহনা চোখ সরিয়ে ফেলে। লরিন অতঃপর মুচকি হেসে দূরে একটা চেয়ারে গিয়ে আরাম করে বসে।

মাহবুব সাহেবের জ্ঞান ফিরলে একে একে কেবিনে সবাই প্রবেশ করে। জ্ঞান ফিরলেও তিনি এখনো কথা বলার অবস্থাতে নেই। মাথায় উনার খুব আঘাত লেগেছে। তিনি নিষ্পলক চোখে চেয়ে কেবল উনার স্ত্রী আর দুই মেয়েকে দেখছেন। উনাকে ছাড়া এই মানুষগুলো কতটা অসহায়। এই কিছুটা সময়ে একেক জনের চেহারা কেমন হয়ে গিয়েছে। যদি কখনো সত্যি সত্যিই উনি একেবারে হারিয়ে যান তখন এই মানুষগুলোর কী হবে। কীভাবে নিজেদের ওরা সামলে নিবে। আহ, ভাবতেই উনার দুশ্চিন্তা হচ্ছে। উনি না থাকলে কে এই মানুষগুলোকে আগলে রাখবে? কে?

মাহিয়া কাঁদছে। মোহনা দূরে দাঁড়িয়ে আছে। তাদের বাবা ইশারা দিয়ে তাদের কষ্ট পেতে বারণ করে। তাও মাহিয়া কাঁদছে। বাবার ঐ রুক্ষ কঠিন মুখটাতে এই নরম অসহায়ত্বের ছোঁয়া তারা মেনে নিতে পারছে না। কষ্ট হচ্ছে। লায়লা বেগমও নিরব চোখে তাকিয়ে আছেন স্বামীর দিকে। এই মানুষটাকে ছাড়া তিনি যে ঠিক কতটা অসহায় এই কিছুটা সময়ে সেটা তিনি হাড়ে হাড়ে টের পেয়েছেন।

চলবে…

#প্রণয়_রেখা
#জান্নাতুল_ফারিয়া_প্রত্যাশা
১২.

রাতে কেবল একটা স্যুপ’ই মাহবুব সাহেব কে দেওয়া হলো। বেশি ভারী খাবার তিনি আপাতত খেতে পারবেন না। মাহিয়ার এতে খুব মনক্ষুন্ন হলো। ঐটুকু একটা স্যুপে কি আর কারো পেট ভরে? বাবার মতো এমন বলিষ্ঠ দেহী মানুষদের সুস্থ থাকার জন্য আরো বেশি খাবারের প্রয়োজন, ডাক্তাররা কি এসব বোঝেন না? মাহিয়ার অভিযোগের আর অন্ত নেই। মাহবুব সাহেব এই শরীরেও মেয়ের কথা শুনে প্রসন্ন হাসলেন। বাবার পেট ভরল না বলে মেয়ের কত কষ্ট। আহ, মেয়ের কী চিন্তা, কী ভালোবাসা!

মোহনা দেখে দেখে বাবাকে ঔষধ খাইয়ে দিল। রাতে তাদের একটা বড়ো কেবিনে শিফট করা হলো। মাহবুব সাহেব সারাদিনের অসুস্থতায় ঘুমিয়ে পড়লেন। এতক্ষণ মোহনা মাহিয়া আর তাদের মা কেবিনেই ছিল। মাহবুব সাহেব ঘুমিয়ে পড়ায় এখন তারা কেবিনের বাইরে বেরিয়েছে। বাইরে এশা রাফাতের সাথে দূরে একটা বেঞ্চে লরিনও বসে আছে। লরিন কে দেখেই মোহনা তার কাছে যায়। গিয়ে বলে,

‘আপনি এখনো যাননি কেন?’

‘ঠোমার বাবা ঘুমিয়েছেন?’

‘জ্বি, কিন্তু আপনি এখনো এখানে বসে আছেন যে? আপনি হোটেলে ফিরে যান। আপনারও রেস্ট প্রয়োজন।’

‘না না, আমি ঠিক আছি। ঠোমরা তো কিছু খাওনি তাই না? আমি খাবার নিয়ে এসেছি সবার জন্য। এগুলো খেয়ে নিও।’

এই বলে লরিন মোহনার দিকে খাবারের প্যাকেটগুলো এগিয়ে দিল। মোহনা যেন কেমন অপ্রস্তুত হয়ে পড়ল। লরিন কখন গিয়ে খাবার আনল তার কোনো ধারণা নেই। সে ইতস্তত করছে খাবারের প্যাকেটগুলো নিবে কী নিবে না। এশা পেছন থেকে এসে বলল,

‘কী হলো নে।’

মোহনা এশার দিকে তাকালে এশা তাকে ইশারা দিয়ে আশ্বস্ত করে। মোহনা প্যাকেটগুলো হাতে নিয়ে বলে,

‘ধন্যবাদ। তবে খাবার না আনলেও চলতো। আমরা ক্যান্টিনে খেয়ে নিতে পারতাম। তবে কষ্ট করে আনার জন্য অনেক ধন্যবাদ। আপনি খেয়েছেন?’

লরিন মাথা নাড়িয়ে না করল। মোহনা বলল,

‘চলুন, আমাদের সাথে খেয়ে নিবেন।’

লরিন খুশি হলো। তার ক্ষুদ্র মন যেন এইটুকু আহ্বানেই বারবার প্রস্ফুটিত হয়ে উঠছে। এই আহ্বানে আনন্দ আছে, আছে ভালোলাগা। লরিন তার পেছন পেছন গেল। মোহনা মা’র কাছে গিয়ে বলল,

‘আম্মু দেখো, লরিন আমদের জন্য খাবার নিয়ে এসেছে।’

লায়লা বেগম আরো বেশি কৃতজ্ঞ হয়ে পড়লেন। আপ্লুত কন্ঠে বললেন,

‘আমাদের জন্য আর কত কষ্ট করবে বাবা? এমনিতেই তুমি এতকিছু করলে, তার উপর এত খাবার আনার কী দরকার ছিল?’

লরিন জবাব না দিয়ে সৌজন্যমূলক হাসি দিল। তারপর সবাই কেবিনের ভেতরের একটা টেবিলে খেতে বসল। খাবারের প্যাকেটগুলো খুলে মোহনা অবাক হলো খুব। এতসব বাঙালী খাবার লরিন খুঁজে খুঁজে আনল কী করে। সে লরিনের দিকে তাকাতেই লরিন তার বিস্ময় বুঝতে পারে। মোহনা প্রশ্ন করার আগেই তাই সে জবাব দিয়ে উঠে,

‘রাফাতকে নিয়ে গিয়েছিলাম। ওই খাবারগুলো কিনতে আমাখে সাহায্য করেছে।’

মোহনা ম্লান হেসে সবার প্লেটে খাবার বাড়তে লাগল। খাওয়া দাওয়া শেষ করে রাফাত আর এশা চলে গেল তাদের বাড়ির উদ্দেশ্যে। যদিও তারা কেউই যেতে চাচ্ছিল না তবে মোহনা তাদের জোর করেই পাঠিয়ে দিয়েছে। কেবিনের ভেতরে আরেকটা বেডে মাহিয়া আর তার মা শুয়ে পড়েছে। মোহনা একটা সোফায় কিছুক্ষণ শুয়েছিল। তবে তার ঘুম আসছিল না। উঠে আস্তে আস্তে বাইরে বের হলো সে। যদিও এখন অনেক রাত। তবে হসপিটালের বাইরের পরিবেশ যেন অন্য কথা বলছে। বাইরে এখনো বেশ মানুষ এদিক ওদিক ছোটাছুটি করছেন। বেশ কিছু ডাক্তার নিজস্ব পেশেন্ট দেখায় ব্যস্ত হয়ে আছেন। এর মাঝেই মোহনা বাইরে লম্বা বারান্দায় হাঁটতে লাগল। কিছুটা সামনে যেতেই সে থেমে যায়। দূর থেকে লরিন কে আসতে দেখে কপালে চওড়া ভাঁজ ফেলে। লরিনের হতে ধোঁয়া উঠা ওয়ান টাইম কফির গ্লাসটা তো অন্য সুর গাইছে। তারমানে লরিন এতক্ষণ এইখানেই ছিল, সে হোটেলে ফিরে যায়নি? লরিন আরো কিছুটা পথ এগিয়ে এসেই মোহনা কে দেখে থমকে দাঁড়ায় তারপর মুচকি হেসে আবারও সামনের দিকে এগুতে থাকে। মোহনার একেবারে কাছে আসার পর মোহনা বিচেলিত গলায় বলে উঠে,

‘আপনি এখনও যাননি?’

‘না।’

‘কেন?’

‘সবাই চলে গেলে এখানে কে ঠাকবে?’

মোহনা বলল,

‘আমরা আছি তো।’

‘তাও মনে হলো আমার ঠাকার প্রয়োজন। তাই ঠেকেছি।’

এই বলে সে একটা বেঞ্চে গিয়ে বসল। তার পেছন পেছন মোহনাও গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থেকে বলল,

‘আপনার হোটেলে ফিরে যাওয়া উচিত লরিন। আমরা সবাই এখানে আছি। কোনো অসুবিধা হলে আমি আপনাকে বলবো। আপাতত আপনি ফিরে যান।’

লরিন চোখ উপরে করে চেয়ে বলল,

‘আমার এখানে ঠাকাতে ঠোমার এত কিসের আপত্তি? আমি তো আর ঠোমাকে বিরক্ত করছি না। ঠুমি বরং কেবিনে গিয়ে ঘুমিয়ে পড়, ঠোমার এখন রেস্টের প্রয়োজন।’

মোহনা ঈষৎ চটে গেল। বলল,

‘আপনারও রেস্টের প্রয়োজন মি. ডানিয়েল লরিন। এখানে বসে বসে কফি খেয়ে ঘুমের বারোটা না বাজিয়ে হোটেলে ফিরে গিয়ে একটা ঘুম দেন। তারপর না হয় কাল সকালে এসে আবার দেখা করে যাবেন। আর এটাতেই আপনার ভালো, বুঝেছেন?’

‘আমার ভালো ঠুমি বুঝবে না। থাক বাড দাও, কফি খাবে?’

মোহনা কোমরে হাত দিয়ে জোরে শ্বাস টানল। তা দেখে ঠোঁট ছড়িয়ে হাসল লরিন। লরিনের হাসিতে মোহনা কেমন বিব্রত বোধ করল। তাই সে কোমর থেকে হাত সরিয়ে বলল,

‘হাসছেন কেন?’

‘You are just looking a angry bird. My angry bird.’

এই বলে সে কফির কাপে চুমুক দেয়। মোহনা অবাক চিত্তে ভাবতে থাকে, ছেলেটা বাঙালী না হয়ে বড্ড ভুল করে ফেলেছে। যদি সে বাঙালী হতো তবে একটা খাঁটি প্রেমিক পুরুষ হতে পারতো। দেবদাসের মতো কঠিন হতো তার সেই প্রেম। রবীন্দ্রনাথের মতো তখন তীক্ষ্ণ হতো তার প্রেমের কবিতা। ইশ, বড্ড ভুল করে ফেলেছে সে বাঙালী না হয়ে। তবে মোহনাও হতে পারতো তার একনিষ্ঠ সুদর্শনা, তার কোমল হৃদয়ের প্রেমপূজারী। আহ, কী একটা সুযোগ মিস হয়ে গেল।

মোহনা এক সিট জায়গা ফাঁকা রেখে বসল। কিছুক্ষণ কী যেন চিন্তা করল। অতঃপর বলল,

‘আপনি কি আজ ঐ ঝুমকোগুলো কিনেছিলেন?’

লরিন তাকাল তার দিকে। ভ্রু খানিক কুঁচকে বলল,

‘ঝুমকা মিনস?’

‘Earing.’

‘ওহ।’

“ওহ” বলে লরিন আবার তার কফি পানে মনোযোগ দিল। মোহনা তাকিয়ে আছে তার জবাবের জন্য। লরিন তাতে পাত্তা না দিয়ে খুব মনোযোগ দিয়ে এদিক ওদিক দেখছে আর কফি খাচ্ছে। মোহনা বিরক্ত হয়ে গলা ঝাড়ে। ফুঁস করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বলে,

‘আপনাকে আমি কিছু জিজ্ঞেস করেছি লরিন; উত্তর দিচ্ছেন না কেন?’

লরিন তার দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসল। আহ্লাদিত কন্ঠে বলল,

‘কফি খাবে?’

মোহনা নাকের পাল্লা ফুলিয়ে অন্যদিকে মুখ ঘুরিয়ে বসল। লোকটার সাথে কথা বলাই বৃথা। লরিন মোহনার রাগকে খুব একটা আমলে নিল না। সে উঠে দাঁড়াল। দাঁড়িয়ে বলল,

‘আরো দু কাপ কফি আনছি। একসাথে খাবো।’

এই বলেই সে কফি আনতে চলে গেল। আর মোহনা আহাম্মকের মতো চেয়ে তার যাওয়া দেখল। লোকটার কি আজ কফির পিনিক উঠেছে নাকি? খালি কফি কফি করছে কেন, আশ্চর্য!

মোহনার সাথে কফি খেয়ে তবেই হাল ছাড়ল লরিন। সে এবার তৃপ্তির নিশ্বাস ছাড়ল। মোহনার দিকে চেয়ে দেখল তার চোখ মুখ এখনো আগের মতোই বিরক্তের সাগরে ডুবে আছে। মোহনার দুই ভ্রু’র মাঝে কুঁচকে যাওয়া অংশটা যেন খুব নিখুঁত ভাবে তার নিরব রাগটা ফুটিয়ে তুলছে। মেয়েদের এমন নিরব রাগ বেশ সুন্দর। মোহনা এমনিতেই সুন্দর, এখন তাকে আরো সুন্দর লাগছে। লরিন চেয়ে থেকে ম্লান সুরে বলল,

‘ঠুমি খুব সুন্দর মোহনা।’

মোহনা লরিনের দিকে তাকাতেই লরিন অপ্রস্তুত ভঙিতে হাসল। মোহনা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল,

‘আমার সৌন্দর্যের মোহে’ই হয়তো আপনি পড়েছেন।’

লরিন আলতো হেসে বলল,

‘ভালোবাসতে কি সৌন্দর্যের প্রয়োজন হয়?’

মোহনা অন্যদিকে তাকিয়ে বলল,

‘জানি না।’

লরিন বলল,

‘মানুষ সুন্দরের প্রেমে পড়ে, আমিও পড়েছি। তবে সেই সৌন্দর্যঠা আত্মিক। আর এই সৌন্দর্য অবিনশ্বর। আর ঠাই আমার প্রেমও অবিনশ্বর।’

মোহনা অবাক হয়ে তাকাল। বলল,

‘এসব কথা আপনাকে কে শিখেয়েছে লরিন? এত কঠিন কথা আপনি কার থেকে শিখলেন?’

চলবে…